মনে রবে কিনা রবে আমাক পর্ব-০৬

0
5

মনে রবে কিনা রবে আমাকে
কাজী জেবুন্নেসা
পর্ব –৬

অরণ্য তটিনীদের বাসায় গিয়ে কোথাও লাবণ্যকে খুঁজে পেল না। দ্রুত নিচে নেমে এলো, না, নিচেও তো নেই। এত রাতে কি একা একাই চলে গেল? ভাবতে ভাবতে ফোনটা হাতে নিল। ডায়াল করার পর রিং হতেই ওপাশ থেকে কেউ কেটে দিল। তারপর একটা মেসেজ আসল।

“আসসালামু আলাইকুম, আসলে আমার মাথাটা প্রচণ্ড ব্যথা করছিল। একাই বাসায় চলে গেলাম। তটিনীকে বলে দেবেন।”

মেসেজটা কয়েকবার পড়লো অরণ্য। হঠাৎ করেই মাথা ব্যথা? নাকি…

লাবণ্য বাসায় ফিরে এল বিধ্বস্ত অবস্থায়।সারা রাস্তা রিক্সায়, কান্না করতে করতে এসেছে। তাই তখন অরণ্যর ফোনটা ধরেনি, শুধু মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছে। ঠিক করলো আর কখনো অরণ্যের মুখোমুখি হবে না। বাসার কাছাকাছি এসে চোখ-মুখ মুছে ফেলল। অবশ্য দরজা খুলে মা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কি হয়েছে?”

“প্রচণ্ড মাথা ব্যথা, মা।”

এরপর আর কোনো কথা না বলে নিজের ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে জামাকাপড় বদলে শুয়ে পড়ল। চুপচাপ ভাবছে—এতটা আপসেট হওয়ার মতো কী হলো? বরং এটাই ভালো হলো না, মনে আর কোনো আশা বা স্বপ্ন বেঁচে রইল না। এই পরিবারে বিয়ের আগের প্রেম এত অভিশপ্ত শব্দ! সেই কবে একজন কিশোরী মেয়ে ভুল করেছিল, সেই ভুলের মূল্য দিয়েছিল নিজের জীবন দিয়ে। তার জন্যই ওদের পরিবার যতই আধুনিক হোক, এই বিষয়টা কেউ মানতে পারে না।

লাবণ্য বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল, আকাশের দিকে তাকাল। এই বরং ভালো হয়েছে। খুব ভালো। নিজের মনটাকে এখন সে শক্ত করে বাঁধতে পারবে। নিজের পরিবারকে, বাবাকে কষ্ট দিয়ে কিছু করতে পারবে না। তার চেয়ে বরং নিজেই একা একা কষ্ট পাবে। তারপর হঠাৎ দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল, কিন্তু এই কষ্টটা বড় অসহ্য।
কখনো অরণ্যের মুখোমুখি হতে চায় না লাবণ্য—কখনোই না।

রুমে গিয়ে দেখল তটিনীর মিস কল। মেসেজ এত্তগুলা সব গালাগালিতে পূর্ণ।
“কাল যেন সকাল সকাল চলে যায়, ঢং না করে।”এই বার্তাও আছে ম্যাসেজে।

লাবণ্য আস্তে ধীরে একটা মেসেজ করল—
“আমি খুব অসুস্থ। হঠাৎ শরীর খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে। ভাইয়ার বিয়ের কোনো অনুষ্ঠানে যেতে পারব না।”

মেসেজ শেষ করে মোবাইলটা বন্ধ করে রাখল। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম সব ডিএক্টিভ করে দিল। চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল।
এটা একটা যুদ্ধ। এই যুদ্ধে না চাইলেও নেমে গেছে লাবণ্য। হেরে গেছে। হারাটা নিশ্চিত ছিল।
এভাবেই বরং ভালো হয়েছে।

হলের টানা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে অরণ্য, অনেক রাত। নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করছে, লাবণ্য এভাবে চলে গেল! কারণ একটা অবশ্যই আছে। অনেকবার ফোন করেছে—ফোনটা বন্ধ। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম সবকিছুই ডিএক্টিভ করা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কিছুই বুঝতে পারছে না ও নিজেও। নিজেকে খুব অস্থির লাগছে। ফাজিল তটিনী ওকে মাঝেমধ্যে বিয়ে ঠিক হওয়া নিয়ে খ্যাপালেও, এভাবে যে মুখ খুলে ফেলবে সবার সামনে, অরণ্য বুঝতে পারেনি। নিজেকেই তো বুঝতে পারছে না। কারো সাথে আলোচনা করতে পারলে ভালো লাগত। কিন্তু তূর্য এখন নারী জাতি বিরোধী।

এত দুঃখের মাঝেও হঠাৎ হাসি এসে গেল। শালা, তন্দ্রাকে ভুলতে পারে না, আবার অন্য নারীদের নিয়ে মনে বিরাগ!

কাঁধে কারো হাত পড়ল। অরণ্য ঘুরে দাঁড়ালো।

“ঘুমাচ্ছিস না কেন? পড়াশোনাও করলি না। কী হয়েছে, দোস্ত?”
তূর্য অরণ্যকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলল।

ইতস্তত করে অরণ্য পুরো বিষয়টি তূর্যকে খুলে বলল।

তূর্য কেমন হাসতে লাগল, “তুই শেষ, ফিনিশ! যে রোগ তোকে ধরছে, তার শেষ গন্তব্য হচ্ছে সিগারেট।”
বলে আবার হাসতে লাগল, “মেয়েটার জন্য মায়া লাগছে। সে নিশ্চিত আজ রাত নির্ঘুম আছে।”

অরণ্যের নিজেকে বোকা বোকা লাগছিল। সবকিছু সহজ করে দিতেই যেন, হঠাৎ হাতের মোবাইলে ওর আপার নাম্বারটা বেজে উঠল। কুশল বিনিময়ের পরে অরণ্য হঠাৎ করেই বলে উঠল, যেন কেউ ওকে দিয়ে বলিয়ে নিল—

“আপা, শোন। আমি একটা কথা প্রায়ই শুনছি—তোমার কোনো ননদের সাথে নাকি আমার বিয়ে ঠিক করেছ?”
খুব অস্বস্তি নিয়ে বাকিটা বলল, “আমি চাই না কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করুক। উনার অন্য কোথাও বিয়ে ঠিক করতে পার।”

ওর আপা কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তারপর যেন ফেটে পড়ল,
“তুই বাড়ি গিয়েচিলি না? বড় ভাবি কিছু কয়েচে? আমি সব জানি। ভাবি চায় খালাতো বোনের সাথে তোর বিয়ে দিতে। আমার ননদ কোন দিকে কম? বয়স অল্প, শিক্ষিত, সুন্দরী।”

অরণ্যের এখন ক্লান্ত লাগছিল। ওর ভাবি আর বোনের দড়ি টানাটানির মাঝখানে পড়ার কোনো ইচ্ছা নেই।

“ভাবি আমাকে কিছু বলেনি। আমি নিজেই বলছি, আপা। এসব আমার ভালো লাগে না।”

“ও আচ্ছা, এখন বড় হয়ে গেচিস! খুব পাকনা গজিয়েছে! প্রেম করেচিস নাকি? ঢাকা শহরের মেয়েরা তো এক-একটা ডাইনি।”

“কি শুরু করলা আপা? আমি ফোন রাখছি। পরে কথা বলব।”

আপা যতই রাগ করুক, কথাগুলো বলে অরণ্য নিজেকে খুব হালকা বোধ করল। মুখে একরকম হাসি ফুটে উঠল। কাল নিশ্চয়ই দেখা হবে লাবণ্যের সাথে।
লাবণ্যকে কথাটা জানাতে হবে, যেভাবেই হোক।
যে বিয়েটা অরণ্য ভেঙে দিয়েছে—কার জন্য?
যে, অরণ্যের কাছে চেনা হয়েও অচেনা হয়ে আছে।

____________________

আজকে তটিনীর ভাইয়ের বউ ভাত অনুষ্ঠান, লাবণ্য ফোন সহ সবকিছু বন্ধ করে বসে আছে। বিয়ের ছবিও দেখবে না। কে জানে হয়ত সেই বাগদত্তা মেয়েটাও আসবে, অরণ্য তার সাথে হাসবে মজা করবে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। চায়ের মগ নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে লাগলো।

হঠাৎ পিছন থেকে এসে কেউ ওর দুটো চোখ ধরল জোরে শক্ত করে।
“এই বুঝি তোর শরীর খারাপ?”
রিয়ার কন্ঠ কানে গেল লাবণ্যর। একটা কথাও শুনতে চাই না, এক্ষুনি তৈরি হয়ে আমার সাথে যাবি। তটিনী কিন্তু তোর উপর খুব রাগ।

লাবণ্য কিছু বলছে না, ওড়নার কোনা হাতে পেচাচ্ছে। বেশ বুঝতে পারছে এখন আর এড়িয়ে যাবার উপায় নাই। যেতে হবে।

“আজ একটু ভালো আছি রে…!”

“তাইলে চলরে মা, আমি বসছি তুই তাড়াতাড়ি রেডি হ।”

সন্ধ্যে সাতটা বেজে দশ মিনিট, খালাতো ভাইয়ের বিয়ে, তাই অরণ্যকে আগে আগে আসতে হয়েছে। কিন্তু মন টানছিল না। খুব আশা করেছিল গতকালকে লাবণ্য আসবে। কিন্তু সে আসেনি। অত্যন্ত খারাপ লেগেছে, মনে হয়েছে কেউ বুকের ভেতরটাতে তপ্ত কিছু দিয়ে আঘাত করছে।

আজকে একটা কালো শার্ট পড়েছে,ফরমাল শার্ট। তুরাগ ভাই গিফট করেছে, হাতে ঘড়ি। বাড়ন্ত চুল গুলোকে সুন্দর করে কেটেছে। কিন্তু তবুও কিছুই ভালো লাগছিল না। এসব সাত পাঁচ ভাবছে, আর তাকিয়ে আছে অরণ্য। এতক্ষণে রিয়া’দের গাড়িটা এসে থামল।

লাবণ্য একটা কালো সালোয়ার কামিজ পরেছে। কোন সাজসজ্জা করেনি, ওড়নাটা দিয়ে মাথা জড়িয়ে রেখেছে। চোখে মুখে বিষন্নতা। গাড়ি থেকে নেমেই, কি মনে হতে উপরের দিকে তাকালো। তখনই দেখতে পেলে সেন্টারের বারান্দায় অরণ্য দাঁড়ানো। দুজনের চোখাচোখি হতেই, লাবণ্য দ্রুত দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল।

লাবণ্যকে দেখা মাত্র, অরন্যর হাত-পা কাঁপতে লাগলো। বুকের ভিতরে হৃদপিণ্ডটা যেন বের হয়ে আসবে।ঠোঁট চেপে ভাবলো এ কেমন অনুভূতি? এর নাম যদি ভালোবাসা হয়, তূর্য তাহলে কিভাবে সহ্য করছে।ও দ্রুত সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলো।

অরণ্যকে দেখে লাবণ্য কষ্টটা আরো বেড়ে গেল, বুকের ভিতর কষ্টের ঢেউ। খুবই খারাপ লাগা অনুভূতি। কিন্তু কিছু করার নেই,এটাই বয়ে বেড়াতে হবে। কেন যে তটিনীর সাথে বন্ধুত্ব করেছিল! সিড়ি বেয়ে আস্তে আস্তে উপর উঠছে, তখনই মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল অরণ্যের সাথে।

“ভালো আছেন ম্যাডাম।” অরণ্যর কন্ঠটাও কেমন কাঁপা কাঁপা।

“জি ভালো আছি, সিড়ির সামনে থেকে সরে দাঁড়ান আমি উপরে উঠবো।” কাটা কাটা গলায় কথাগুলো বলে লাবণ্য উপরে চলে গেল। সোজা হেঁটে কণের সামনের সারির চেয়ারে বসে গেল।

অরণ্য খুবই হতাশ হয়ে গেল, বুঝতে পারলো কথা বলার চান্স পাওয়া যাবে না।

বিয়ে বাড়ির শত ব্যস্ততার মাঝেও, অরণ্য চোখ খুঁজতে লাগলো লাবণ্যকে । এমন সময় দেখতে পেল লাবণ্য একটা ছেলের সাথে গল্প করছে। ওর মনে হল ওর বুকের ভিতরে হাজারো নখের আঁচড় দিয়ে দিচ্ছে কেউ । নিজেকে বুঝালো ক্লাসমেট হবে, তটিনীর অনেক বন্ধুরাই তো এসেছে। তবুও ভালো লাগছিল না, এসব ভাবতে ভাবতেই, হাতে ধরা বোরহানি গ্লাস সহ আরেকজনের সাথে ধাক্কা খেলো। অরণ্যর কালো শার্টে বোরহানি পরে চুপচুপে। অপর পক্ষ সরি বলল, তবে ওর সেসবে খেয়াল নেই। লাবণ্য হাসছে কেন ছেলেটার সাথে! কপাল কুঁচকে ভাবতে লাগলো। বাসায় যাচ্ছে না কেন? কত রাত হয়ে গেল?
শেষে আর না পেরে হেঁটে সামনে গেল, ছেলেটার কাঁধে হাত রাখল। “ খাওয়া দাওয়া হয়েছে ভাইয়া?”

অরন্যের কন্ঠ শুনে চমকে গেল লাবণ্য, এতক্ষণে ছেলেটার সাথে হেসে হেসে কথা বলছিল অরণ্যকে দেখিয়েই। কেন সেটা জানে না, কিন্তু ভালো লাগছিল।

“জ্বী খেয়েছি ভাইয়া, আমার নাম আশিক। আমি তটিনীদের ক্লাসে পড়ি।”

অরণ্য ছেলেটার হাত ধরে, গল্প করতে করতে আরেকদিকে নিয়ে গেল। লাবণ্য সেদিকে তাকিয়ে ভাবল, কি সমস্যা এই ছেলের?
এরপর মনে হল, অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে বাসায় যেতে হবে। রিয়াকে খুঁজতে চলে গেল লাবণ্য। আর দেখা হলো না অরন্যের সাথে।
___________________________

বাসায় এসে লাবণ্য জামা কাপড় বদলে চুপচাপ বসে আছে, রাতের বেলা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি হাতে নিয়ে একটা দোয়া শিখিয়েছে বাবা। সেটাই করলও শব্দ করে। অরণ্যর চেহারাটাই চোখের সামনে ভাসতে লাগলো, ফোনটা অন করাই আছে, তবে অরণ্যকে ব্লক করে দিয়েছে। সারা জীবন তো আর ফোন বন্ধ করে চলতে পারবে না। করার প্রয়োজন নেই, আর অরণ্যই বা কেন ওকে যেচে ফোন দিতে যাবে।

ঘড়িতে রাত একটা বেজে দশ মিনিট, লাবণ্যর চোখে ঘুম নেই। ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠল, অচেনা নাম্বার৷ কেটে ফোন সাইলেন্ট করে রাখলো। এরপর হঠাত একটা ম্যাসেজ আসলো,

“দয়াকরে ফোন ধরেন, নয়তো আমি আপনার বাবাকে ফোন করে আপনাকে চাইবো।”

মেসেজ পড়ে লাবণ্যর হাত-পা কাঁপতে লাগলো, মাথায় আসলো না ওর বাবার ফোন নাম্বার কেউ কিভাবে পাবে?

এরপর ফোনে রিং আসতেই ধরে ফেললো,
“আস সালামু আলাইকুম।”

ওপাশে অরণ্যর হাত পা যেন ছেড়ে দিল লাবণ্যর কন্ঠ শুনে। “ অলাইকুমুস সালাম, আপনি কেমন মানুষ বলেন তো?”

লাবণ্য নিজের আবেগ সামলে বলে, “ এই কানা রাতে ভদ্রলোকের বাসায় এই প্রশ্ন করতে অচেনা নাম্বার দিয়ে ফোন করেছেন বুঝি?” গলা কাঁপছিলো।

“আমার নাম্বার ব্লক করেছেন কি করতাম? একটা খবর দেওয়ার ছিল, আমার যে বিয়ের কথা শুনে আপনার মাথা ব্যাথা আর শরীর খারাপ করছিল সেটা ভেঙে দিয়েছি।”

লাবণ্যর পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটা শিহরন বয়ে গেল, দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো, ধপ করে বসে পরলো, “ এ কথা আমাকে বলছেন কেন?”

অরণ্য এবার হাসে, “ আপনাকেই তো বলব।”

লাবণ্য কথা খুঁজে পেল না কিছুক্ষন, তারপর ফিসফিস করলো, “ আমাকেই কেন?”

“উত্তরটা আপনিও জানেন আমিও জানি। তাই না?”

লাবণ্য উত্তর দেয় না।

“আজ আমাকে এত ইগনোর না করলেও পারতেন। বিনা দোষেই শাস্তি দিলেন।”

অরণ্যের এই কথা শুনে লাবণ্যর খুব কষ্ট হয়, “আমি…মানে…”

“যাইহোক কাল ক্লাস শেষ করে নিউ মার্কেটের এক নাম্বার গেটে থাকবেন।”

“কেন?”

“সব কেন’র উত্তর ফোনে তো দিব না, কিছু উত্তর মুখোমুখি দিতে চাই।”

সে রাতে লাবণ্য আর অরণ্য কারোই ভালো ঘুম হল না।

____________________

আজ দিনটা খুব সুন্দর। লাবণ্য একটা গাঢ় সবুজ রংয়ের ড্রেস পড়ে নিল, সাজসজ্জা করল না। ভার্সিটি যাচ্ছে, সাজসজ্জা করলে মা আবার সন্দেহ করবে। কিন্তু খুব ইচ্ছা করছিল, মনের মধ্যে একটা কেমন আন্দোলন। অরণ্য ওকে নিউমার্কেটে প্রথম গেটে কেন যেতে বলল? কিছু কিনবে? নাকি কিছু বলবে? কি বলবে? আচ্ছা নিউ মার্কেট কি একটা জায়গা কিছু বলার!

অরণ্যর অনেক নার্ভাস লাগছিলো, আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিল।
লাবণ্য রিক্সা থেকে নেমে অল্প জায়গা হেটে অরণ্যের কাছাকাছি দাঁড়ালো। “ আস সালামু আলাইকুম, এখানে কেন?”

“অলাইকুমুস সালাম,আপনি সারাক্ষণ এত প্রশ্ন করেন কেন? একজনের জন্য একটা গিফট কিনব। আপনি সাহায্য করবেন।”

লাবণ্য ভ্রুঁ কুঁচকে নিল “আমি কেন?”

অরণ্য হাসছিলো, “আপনি নন কেন?”

লাবণ্য বুঝতে পারলো এ বান্দার সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, “ কি কিনবেন?”

“একটা শাড়ি কিনব, আর কিছু চুড়ি।এসবের বিন্দুমাত্র কোন আইডিয়া নাই আমার, আপনি সাহায্য করবেন।”

“কাকে দিবেন?” হাঁটছে আর কথা বলছে, আজকের দিনটা খুব সুন্দর কেমন মেঘলা মেঘলা।

“আপনি আদার ব্যাপারী জাহাজের খবরে আপনার কি দরকার?” ফিচেল হাসে অরণ্য।

ফট করে জায়গায় দাঁড়িয়ে যায় লাবণ্য, “ আপনি যদি এরকম অপমান করে কথা বলেন, আমি আপনার সাথে কোথাও যাব না।”

“অপমান, এড়িয়ে যাওয়া, পাত্তা না দেওয়া এগুলো ভাই আপনার জিনিস, আমি পরের জিনিস ধার নিই না।”

অনেক ঘুরে ঘুরে একটা ডিপ মেরুন তাতের শাড়ি আর কিছু মেরুন চুড়ি নিয়ে নিল। লাবণ্য মনে মনে ভাবছে এগুলো কার জন্য? অরণ্যর বোনের জন্য? কিন্তু অরন্যের বোন তো শুনেছে খুব বয়স্ক। মেরুন শাড়ি দিয়ে কি করবে? আর চুড়ি?

“আপনি কিন্তু, যার জন্য চুড়ি কিনেছেন তার হাতের মাপ বলেননি, তাই আমি তিন ডজন নিয়ে নিলাম।”

“বুঝেছি আপনার আমার টাকার মায়া নেই।” ঠোট দুটো গোল করল অরণ্য।

“বাজে কথা বলবেন না! আমি আন্দাজে কীভাবে বুঝব?”

“বুঝতে পারছেন না?” গাঢ় স্বরে বলল অরণ্য, “ আপনার হাতের মাপে নিয়ে নিন।”

হঠাৎ করে, লাবণ্যর সমস্ত মুখে রক্তকণিকা ছড়িয়ে পড়ল। তবে কি শাড়ি, চুড়ি ওর জন্য? অবশ্য বেশি আশা করল না, এ ভদ্রলোককে দিয়ে কোন বিশ্বাস নেই।

কেনাকাটা শেষ করে ওরা নিউ মার্কেটের বই এর দোকানের সামনে চলে আসল।এই জায়গাটা লাবণ্যকে খুব টানে। বইয়ের গন্ধ, প্রচ্ছদের ভিড়ে লুকিয়ে থাকা অজানা গল্প, কিছু একটা অদ্ভুত মায়া আছে এখানে।বই এর মায়া, বই এর চিরচেনা ঘ্রান।

অরণ্য পাশাপাশি হাঁটছে, হাতে শাড়ির ব্যাগ। দমকা বাতাস এসে অরণ্যের চুল উড়িয়ে দিচ্ছে, লাবনার ইচ্ছে করছে চুল গুলোকে গুছিয়ে দেয়।ওর আঙ্গুলগুলো চাইছে, অরণ্যর আঙুলগুলো কি স্পর্শ করতে। নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারছে না লাবণ্য। কিন্তু কেন? নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল। এদিক সেদিক দৃষ্টি দিচ্ছিল।

“বই পড়েন?” হঠাৎ বলে উঠে অরণ্য।

“ কি বললেন ?” চমকে উঠল লাবণ্য। এতক্ষণের ভাবনা থেকে যেন ওকে টেনে বাস্তবে আনল এই প্রশ্নটা।

“বলছি বই পড়া হয় ? নাকি পড়লেও তা রূপচর্চা ও রান্নার বই এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ?” হাল্কা খোঁচা দিয়ে বলল অরণ্য।

থমকে দাঁড়িয়ে গেল লাবণ্য। কোমরে হাত, “আপনার সমস্যাটা কি? খালি খোঁচা মেরে, মেরে কথা।”

লাবণ্যর অনুকরণে অরণ্যও কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল, “আপনার সমস্যা কি? কথায় কথায় কোমরে হাত?”

লাবণ্য গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকাল, ওর দিকে আড় চোখে তাকিয়ে অরণ্য বলল “এত রাগ!” ওকে পাশ কাটিয়ে অরণ্য আগে চলে গেল বই এর দোকানে, দাঁড়িয়ে বই দেখতে লাগলো।

অরণ্যর দিকে তাকিয়ে থাকতে, থাকতে লাবণ্যর অদ্ভুত এক অনুভূতি হল, মনে হল ছেলেটির সাথে কাঠ ফাটা রোদে ও ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় হেটে বেড়ায়। ঝুম বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়………। আজব ওর আর অরণ্যর সম্পর্ক যেন কেবল রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঝগড়া করার।

“এই যে, ঝগড়া কইন্যা, এই নিন এটা আপনার জন্য।” বলে ওর হাতে তুলে দিল সমরেশ মজুমদারের “কালবেলা” উপন্যাস। তারপর হাত বাড়িয়ে বলল,” পৃথিবীটা হল, দেওয়া আর পাওয়ার জায়গা ,কই আমার বই কই?”

লাবণ্য হেসে ফেললো, “ ইশ আমি বুঝি, চেয়েছি? এত বেহায়া মানুষকে আমি দেখি নাই । ” মুখে বলল বটে কিন্তু এগিয়ে গেল বই এর দোকানের দিকে।

“এই নিন।” বলে অরণ্যর দিকে সুনীলের “মধুময়” গল্পের বইটা বাড়িয়ে ধরল লাবণ্য “ আমার সবচেয়ে প্রিয় বই, আপনাকে দিলাম।”

“ আমার নকল করে।” টিটকারি মারল অরণ্য,“ মাধবী লতা হল দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ প্রেমিকা ,বইটা পড়লেই বুঝবেন। ”

“বললেই হল ? মধুময়ের তুলনা মধুময়। ওর মত এত ভালবাসতে পারবেনা কেউ। মাধবীলতা ও না।”

“আবার ঝগড়া! আচ্ছা মুশকিল তো!” আচ্ছা মাধবী লতা হল শ্রেষ্ঠ প্রেমিকা। এই ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ প্রেমিক হল মধুময়, খুশি?”

“আপনি কি সব কিছুতেই এরকম কম্পিটিশন করেন? ভালোবাসা কি প্রতিযোগিতা?” চোখ সরু করে বলে লাবণ্য।

“ভালোবাসা কি ব্যাখ্যা করা যায়? সে তো অনুভব করার জিনিস।” রহস্য করে অরণ্য। “ দেখেন পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন জিনিস সম্ভবত ভালোবাসা, এখনো স্বমহিমায় টিকে আছে।”

লাবণ্য কিছু বলে না, এখন যেতে হবে। “ আমি যাই, বই এর জন্য ধন্যবাদ। শাড়ি যাকে দিবেন আশাকরি তার পছন্দ হবে!”

“হতেই হবে…মুচকি হাসে অরণ্য। হাতে সুনীলের মধুময় বইটা।

লাবণ্য ফিরে তাকায় এই অসম্ভব সুন্দর দৃশ্যটা হৃদয়ে বন্দি করে দ্রুত রিক্সায় উঠে যায়।

চলবে।