মনে রবে কিনা রবে আমাক পর্ব-০৮

0
18

মনে রবে কিনা রবে আমাকে
কাজী জেবুন্নেসা

পর্ব–৮

রিকশায় বসে লাবণ্য ভাবছিল, মানুষের জীবন কত অদ্ভুত। মেরুন শাড়িটা পড়েছে, হাত খালি, আকাশের দিকে তাকালো, আজকের বিকেলের আবহাওয়াটা খুব সুন্দর। হঠাৎ করেই ওর জীবনে যেন একরাশ আলো চলে এসেছে। সেদিন তটিনী এবং রিয়া চলে যাওয়ার পরে, ও আরো ভেঙে পড়েছিলে। নিজের ভেতর আরো গুটিয়ে গিয়েছিল। আত্ম গ্লানি ছিল, সাথে ছিল নিজের ভালোবাসা হারাবার যন্ত্রণা। এই যন্ত্রনা থেকে তাকে মুক্ত করেছে ওর মা।
গতকাল রাতেই, ও যখন শুয়ে শুয়ে পড়ছিল। ওর মা ঘরে এসে, ওর মাথাটা নিজেই কোলে তুলে নেয়। চুলে বিলি দিতে দিতে, হঠাৎ করে বলে ওঠে, “ আচ্ছা লাবণ্য ভালোবাসার ঋণ কি শোধ করা যায়?”
লাবণ্যর মন মানসিকতা এমনিতেই খারাপ, তার উপরে ওর মা হঠাৎ করে ভালোবাসার কথা শুরু করে দিলে, অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকায়। “ না তো মা!”

“তাহলে তুই আমাদের ভালবাসার ঋন শোধ করতে, নিজের ভালোবাসা বিসর্জন দিচ্ছিস কেন?”

লাবণ্য উঠে বসল, “কি বলছ মা?” ওর কন্ঠ কাঁপছিল, “ মা বুঝে ফেললো কিভাবে?”

“তোর বান্ধবীরা যাওয়ার পরে, এতগুলো দিন আমি রাতে দুই চোখের পাতা এক করতে পারি না। আমার চোখের সামনে আমার মেয়েটা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমি কিভাবে মেনে নিব?”

“তুমি সব শুনেছ?” লাবণ্য দৃষ্টি এড়িয়ে যায়।

“হ্যা, আমি সব শুনেছি… অনেক ভেবেছি এই কয়দিন, সেই পঁচিশ বছর আগের একটা ঘটনার জন্য আমার মেয়ে কেন কষ্ট পাবে?”

লাবণ অবাক হয়ে ওর মাকে জড়িয়ে ধরে, এতদিনের জমানো কান্না গুলো বের করে দেয়। ওর মাও কি সুযোগ দেয় মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, “ আমি ছেলেটার ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছি, তোর বান্ধবী রিয়া আছে না, সে সাহায্য করেছে। আমি মোটামুটি সন্তুষ্ট, তবে একটা কথা আমি চাই, তুই কখনো সীমালংঘন করবি না। কারণ বিয়ে বহির্ভূত ভালোবাসা ভালো কিছু না। তোর ভালোবাসার কাছে আমি অসহায়, তাই তোর বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে তোকে অনুমতি দিচ্ছি। আমাকে কখনো ছোট করবি না!”

লাবণ্য মায়ের বুকে মুখ লুকায়, “ কখনোই করবো না মা তুমি আমাকে বিশ্বাস করো। কিন্তু বাবা রাজি হবে তো?”

এই অমিমাংসিত উত্তর এর কাটা বুকে নিয়েই লাবণ্য একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল।

ধানমন্ডির একটা রুট টফ রেস্টুরেন্টে বসে আছে লাবণ্য, বুকটা দুরু দুরু করছে, ওর কথাগুলো কি বুঝতে পারবে অরণ্য? নাকি নিতান্ত অবহেলায় মুখ ফিরিয়ে নেবে! মাফ করবে ওকে?

অরণ্য ইচ্ছে করে একটু দেরি করে এসেছে, ওকে যেন লাবণ্য হ্যাংলা মনে না করে। অথচ এতক্ষণ একটু স্বস্তি পায়নি। দূর থেকে লাবণ্যকে দেখল, এই মেয়ে তাতের শাড়িটা পড়েছে। এত অপূর্ব লাগছিল বিকেলে আলোতে, অরণ্যর মন চাইছিল,লাবণ্যর সৌন্দর্য আর কেউ না দেখুক। সবাই অন্ধ হয়ে যাক খানিক।
এরপর নিজের দিকে তাকালে, কি একটা শার্ট পড়ে এসেছে জায়গায় জায়গায় দুমড়ে মুচড়ে আছে। ইচ্ছে করে সেভ করে আসেনি, লাবণ্যকে দেখাতে ইচ্ছে করছিল, মেয়েটা ওর কি হাল করেছে। এটাও মানব চরিত্র!

অরণ্য কাছাকাছি এসে সালাম দিল, লাবণ্য চোখ তুলে তাকালো। সে দৃষ্টিতে ছিল কেবল মায়া আর ভালোবাসা। তাই অরণ্যর পক্ষে নিজের চেহারার কঠিন ভাবটা ধরে রাখা সম্ভব হলো না। চেয়ার টেনে বসে পড়লো। অস্বস্তিকর নীরবতা খানিক। লাবণ্য নির্নিমেষ দেখছে অরণ্যকে…আহা! চেহারার কি অবস্থা।

লাবণ্যী নীরবতা টা ভাঙার দায়িত্ব নিল, “আপনাকে আমি দুটো গল্প শোনাবো।শুনবেন?”

অরণ্য ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো , “শুনেন লাবণ্য, আমি সেদিন বৃষ্টিতে টানা তিন ঘন্টা ভিজেছিলাম। হাসপাতালে ছিলাম একদিন, কারণ কি? আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা। আর আপনি আমাকে এখন গল্প শোনাতে চাচ্ছেন। আপনি কি আমার সাথে কোন মজা করছেন?”

লাবণ্য অরণ্য চোখে চোখ রাখে, “আপনি আমার কথাগুলো শুনেন, তারপরে মজা করছি নাকি জীবনের বাস্তবতা আপনাকে বলছি সেটা বুঝতে পারবেন!”

অরণ্য টেবিলে থাকা, মেনুটা দেখছিল, “ কি পছন্দ আপনার?”

“আপনার কি পছন্দ? আজকে আমি খাওয়াই, আপনি না হলে আরেকদিন?”

অরণ্য মেনু থেকে চোখ তুলে লাবণ্যর দিকে তাকায়, “তাহলে আজকের পরেও আবার আমাদের দেখা হওয়ার সম্ভাবনা আছে?”

“সেটা তো আপনি আমার গল্প শেষ হবার পরেই বুঝতে পারবেন! আমি কি শুরু করব?”

অরণ্য ওয়েটার ডাক দিয়ে, দুইটা বেকড পাস্তা আর পানি অর্ডার করলো। “ জি শুরু করুন।”

লাবণ অরন্যর দিকে তাকালো, বিকালের আলো ছুয়ে যাচ্ছে অরণ্যকে।তবে চেহারায় একটা হতাশা খেলা করছে।

“একটা মেয়ে বাবা মায়ের খুব আদরের, তার বয়স মনে করেন আট। তাদের পুরো পরিবার কানাডায় শিফট হবে খুবই আনন্দ সবার মনে। বাবা মেয়েকে ইন্টারনেটে, কানাডার ছবি দেখায়। মেয়ের কাছে ভালো লাগে দেখতে। যাবার আগে তিনজনে মিলে, ঘুরতে যায়। ঘুরাঘুরি শেষ হবার পরে মেয়ে বায়না ধরে পিজা খাবে। তিনজনে একটা রেস্টুরেন্টে যায়। খাবার অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে, যেকোনো সময় পিজা চলে আসবে। কিন্তু হঠাৎ করেই আগুন লেগে যায় রেস্টুরেন্টে। ইলেকট্রিক শর্ট সার্কিট থেকে। মুহূর্তে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সিঁড়িতে আগুন লেগে যায়। হঠাৎ আগুন লেগে গেলে রেস্টুরেন্ট জুড়ে চিৎকার আর ধোঁয়ায় ভরে যায়। মানুষজন হুড়োহুড়ি করে নিচে নামার চেষ্টা করছে, কিন্তু সিঁড়িতেও আগুন। রেস্টুরেন্টটা ছিল দোতালায়, আর পেছনের দিকে একটা সরু লোহার বারান্দা ছিল, যেখানে সাধারণত দাঁড়িয়ে মানুষ সিগারেট খায়। দেখে থাকবেন হয়ত।

মেয়েটার বাবা- মা দিশেহারা, এক মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নেয় তারা যে, সিঁড়ি দিয়ে নামা অসম্ভব। মা মেয়েটাকে কোলে তুলে নিয়ে বারান্দার দিকে দৌড় দেয়। বারান্দায় গিয়ে দেখে নিচে পাশের ভবনের ছাদটা একটু কাছেই, একদম লাফিয়ে পড়ার মতো না।কিন্তু সাহায্যের জন্য ডাক দিলে পৌঁছানো সম্ভব।

নীচে থেকে কেউ একজন চিৎকার করে, “আপা, মেয়েটারে নামাই দেন, আমি ধরতাছি! মই আসতেছে!”

মেয়েটির বাবা-মা আশার আলো দেখে। দ্রুত মেয়েকে দুইজন দুইটা চুম্বন করে,মা চোখের জল মুছে মেয়েটার কপালে চুমু খায়, তারপর নিজের ওড়না দিয়ে মেয়ের মুখ ঢেকে দেয় যেন ধোঁয়ায় দম না কেটে যায়। বাবা লোহার রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে মেয়েটাকে ধীরে ধীরে বারান্দার কিনারায় নামিয়ে দেয়। নিচে থেকে দুইজন লোক উঠে আসে পাশের ভবনের ছাদ থেকে, একটা কাঠের মই নিয়ে। সাবধানে, সময় নিয়ে মেয়েটাকে নিচে নামিয়ে ফেলা হয় কাঠের মই বেয়ে।

এইদিকে ঠিক তখনই আবার বিস্ফোরণের মতো একটা শব্দ — রান্নাঘর দিক থেকে গ্যাসের সিলিন্ডার ফেটে যায়। আগুন মুহূর্তে পুরো ছড়িয়ে পড়ে। মেয়েটির বাবা-মাকে আগুন কোন সুযোগ দেয় না। মেয়েটি দেখে তাদের জীবন্ত দগ্ধ হতে নিরাপদে দাঁড়িয়ে।” লাবণ্য থেমে যায় চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে।

লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে অরণ্যের মনে হতে থাকে লাবন্যর চোখে পানি, মুখে যন্ত্রণা… এরচেয়ে কষ্টের দৃশ্য যেন আর নেই। অরণ্যর বুকের ভেতর অদ্ভুত এক বিষন্নতা ওকে বিহবল করে দেয়। কিছু বলতে মুখ খোলার আগেই নিজেকে সামলে আবার লাবণ্য মুখ খোলে, “ সেই মেয়েটি এক লহমায় পুরো এতিম হয়ে যায়। সেই এতিম মেয়েটিকে বুকে তুলে নেয় মেয়েটির বড় চাচা-চাচী যারা নি:সন্তান ছিলেন। তারা শুধু বুকে তুলে নেন নাই মেয়েটাকে নিজেদের চোখের তারা বানিয়েছে। যেন তাদের সমস্ত পৃথিবীর কেন্দ্রতে সেই মেয়েটা। মেয়েটাও তাদের ভালোবাসায় আবার খুঁজে পায় মা আর বাবা। আপনি হয়ত বুঝতে পারছেন না এই গল্প কেন শোনাচ্ছি আপনাকে! দ্বিতীয় গল্পটা শুনলে হয়ত বুঝবেন।”

অরণ্য কিছু বলে না লাবণ্যকে বলার সুযোগ দেয়। বুঝতে পারে সেই মেয়েটি লাবণ্য। মনে একটা কষ্ট অনুভব করে।

“একটা অল্পবয়সী মেয়ে, বয়স সবে পনেরো। সেই মেয়েটি ভালোবাসায় জড়িয়ে যায়—এলাকায় নতুন আসা এক ছেলের সঙ্গে, যে তার চেয়ে বয়সে অনেকটা বড়। পঁচিশ বছর আগে, সেই মেয়েটি অল্পদিনের পরিচয়ের ছেলেটার হাত ধরে পালিয়ে যায়।

বাংলাদেশের নিষিদ্ধ পল্লির বেশিরভাগ নারী তাদের প্রেমিকের হাতেই বিক্রি হয়। দুর্ভাগ্যবশত, সেই মেয়েটিও এই অধিকাংশের দলেই পড়ে যায়। মেয়েটির দুই ভাই, বাবা—সবাই থানা-পুলিশ এক করে ফেলে। কিন্তু যখন তারা তাকে খুঁজে পায়, তখন সে ঘৃণা আর গ্লানির ভারে নিজেই নিজের জীবন শেষ করে ফেলেছে।

পরিবারের মান-ইজ্জত চূর্ণ হয়ে যায়। তার উপর, একমাত্র আদরের মেয়ে ও বোনের মৃতদেহ পুরো পরিবারকে স্তম্ভিত করে দেয়। সেই থেকে সেই পরিবারে ‘ভালোবাসা’ একপ্রকার নিষিদ্ধ হয়ে যায়।

প্রথম যে মেয়েটির কথা বললাম, সেই মেয়েটির ফুফু হচ্ছেন এই ‘হাতভাগ্য’ নারী—যার ভালোবাসা তাকে দিয়েছে শুধু মৃত্যু আর অপমান।”

তারপর চোখের জল সামলে, ধরা গলায় বলে
“আর সেই এতিম মেয়েটি আমি।
আমার বাবা মানে বড় চাচা আমাকে সেই কিশোরী বেলাতেই ভালোবাসার ব্যাপারে নিষেধ করে দিয়েছেন। আমাদের পরিবারের কাছে ভালোবাসা যেন এক অভিশাপ—যদি সেটা ঘটে বিয়ের আগেই।”

একটা নীরবতা জায়গাটাকে ঘিরে ধরে। চারপাশে অনেক শব্দ, কিন্তু অরণ্যের মনে হচ্ছিল, জায়গাটাতে শুধু একা ও দাঁড়িয়ে। লাবণ্য এইমাত্র যা বলল, তাতেই স্পষ্ট, লাবণ্যের পক্ষে কোনো সম্পর্ক করা সম্ভব না। ও তো স্পষ্ট জানতই যে সম্ভব না। তাহলে কেন, অল্প হলেও, অরণ্য মনে নিজের ছাপ ফেলল, উসকে দিল ওর ভালোবাসাকে? কিন্তু মেয়েটার উপর রাগ করতে পারছে না! বরং মেয়েটার কান্না কান্না চেহারা দেখে আরও কষ্ট লাগছিল। এই অনুভূতিগুলো অরণ্যের জন্য একদম নতুন, সামলে উঠতে বেগ পেতে হচ্ছে। কী বলবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে অরণ্য লাবণ্যের চোখের দিকে তাকালো।

“একটা প্রশ্নের সত্যি উত্তর দিবেন?”

লাবণ্য চোখের পানি মুছে ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে, “হ্যাঁ, অবশ্যই বলুন।”

“আপনি কি আমাকে সত্যি ভালোবেসে ছিলেন? অথবা ভালোবাসেন এখনো?”

লাবণ্য থমকে যায়। ও ভেবেছিল হয়তো কোনো অভিযোগ অনুযোগ থাকবে, অথবা জিজ্ঞেস করবে, সব জেনেও কেন লাবণ্য এগিয়ে গিয়েছিল? কিন্তু যে প্রশ্নটা করল, তার উত্তরটা দেওয়া কি এত সহজ? লাবণ্য চোখ নামিয়ে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইল খানিক। তারপর স্পষ্ট গলায় বলল, “জ্বি, আমি আপনাকে ভালোবাসি।” গালগুলো ক্রমশ লাল হচ্ছিল, এই অনুভূতির কোনো তুলনা নেই। “আমি নিজেকে চেষ্টা করেও বেঁধে রাখতে পারিনি, তাই আপনার কষ্টের কারণ হয়েছি। তবে বিশ্বাস করুন, আপনি যেমন কষ্টে ছিলেন, আমিও ছিলাম।”

অরণ্য কিছু বলছে না বা বলতে পারছে না। বিকেলের নীভু নীভু আলোতে লাবণ্যকে কী অদ্ভুত মায়াবী লাগছে। দুইজন দুইজনকে ভালোবাসে, অথচ কখনো ওদের গল্প পূর্ণ হবে না। লাবণ্যের উপর রাগের অনেক কারণ থাকলেও এখন অরণ্য অনুভব করছে অসম্ভব মায়া। ঠোঁট চেপে ভাবছে, এটা আরও কষ্টের। আমি যাকে ভালোবাসি, সে আমাকে ভালোবাসে না, এটা কষ্টের। তবুও মনকে বুঝ দেওয়া যায়। কিন্তু সেও আমাকে ভালোবাসে, তারপরও কখনো এক হতে পারব না, এটা একটা ভয়াবহ যন্ত্রণা। অরণ্যের মাথায় কিছু বিস্ফোরণ হচ্ছিল। প্রেম ভালোবাসার দরকার কি? লাবণ্য কি ওর জন্য বছর তিনেক অন্তত অপেক্ষা করবে? তাহলে না হলে একবারে বিয়ের প্রস্তাব… ভাবনায় ছেদ পড়ল, ওয়েটার খাবার দিয়ে গেল।

অরণ্য কণ্ঠটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল, “নিন, শুরু করুন। আপনার আর আমার গল্প আজ এখানেই হয়ত সমাপ্ত।”

লাবণ্য অরণ্যের দিকে তাকালো। অরণ্যর চেহারা পুরো বিধ্বস্ত। “হয়তোবা গল্পের শুরুটা আজকেই হবে?” মুখে রহস্যময় হাসি।

অরণ্য ঝট করে মাথা উঁচু করলো, “কি বলতে চাইছেন?” চোখেমুখে প্রশ্ন।

লাবণ্য উত্তর দিল না, দুইটা হাত সামনে বাড়িয়ে ধরল, “কখনো কোনো মেয়েকে দেখেছেন শাড়ি পরা কিন্তু হাত খালি?”

সম্পূর্ণ অন্য রকম একটা প্রশ্ন করলো।

অরণ্যের এখন চরম বিরক্ত লাগলো, রুক্ষ কণ্ঠে উত্তর দিল, “জানিনা, রাস্তাঘাটে মেয়ে দেখে বেড়াই না!” চামচ দিয়ে পাস্তা নাড়ছে।

লাবণ্য অরণ্যের মুখের ভাবটা দেখে নিল। ইশ! কি চেহারা করে রেখেছে! অথচ একটু আগেই না লাবণ্য স্পষ্ট বললো, ও অরণ্যকে ভালোবাসে। সেই উচ্ছ্বাস কেন নেই চেহারায়? কষ্ট পেয়ে ধরা গলায় বলল, “আপনি আমাকে তো চুড়িগুলো পাঠাননি। তাই আমি ভেবেছিলাম, নিশ্চয়ই সেগুলো আপনি রেখে দিয়েছেন, সাক্ষাতে আমার হাতে পরিয়ে দিবেন। তাই তো হাত দুইটা খালি রেখেছি। চুড়িগুলো কোথায়?”

অরণ্য অবাক হলো। আসলে বিষয়টা তাই। কিন্তু সেদিন লাবণ্য আসেনি, তাই চুড়িগুলো প্রচণ্ড রাগে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল অরণ্য। ফেলে দিয়ে শান্ত হয়নি, পা দিয়ে সেগুলোকে গুড়োগুড়ো করেছে। লাবণ্যের থমথমে চেহারার দিকে তাকিয়ে মনে হলো, এই কথাটা কি বলা ঠিক এখন?

“ফেলে দিয়েছি তো সেদিন!”

“ফেলে দিয়েছেন! আমার জন্য কেনা আপনার প্রথম উপহার! আপনি কিভাবে ফেলে দিলেন? এভাবে তো আপনি আমাকেও ফেলে দিবেন! একটুও মায়া লাগলো না?” লাবণ্য যেন কেঁদেই ফেলবে।

অরণ্য এদিকে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে লাবণ্যের দিকে তাকিয়ে ছিল। একটু আগে চেহারাটা এখন অভিমানে ফুলে উঠেছে, যেটা এখন অরণ্যকে বড্ড টানছে, বিপন্ন বোধ করল। একটা কথা মনে হতে হাসিও পেল, এই চুড়ির জন্য এত হাহাকার করছে এখন। কিন্তু অরণ্য কেন ফেলেছে? এ দায় কার? সেটা লাবণ্য ভাবছে না, স্বীকারও করছেও না।

“সেই চুড়ি দিয়ে কি করবেন আপনি?”

“আপনারা যারা ভাল ছাত্র, মেধাবী, তারা কিছু বিষয়ে এত বুদ্ধু কেন? কিছুই বুঝেন না, নাকি? আমি আজ এখানে শাড়ি পরে কেন এসেছি?”

“কেন এসেছেন?” ভয়ে ভয়ে পালটা প্রশ্ন করলো অরণ্য।

“ঘোড়ার ঘাস কাটতে!” ফোঁস করে উঠলো লাবণ্য।

“এই রুফটপ রেস্টুরেন্টে ঘাস কই পাবেন?”

লাবণ্য ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেললো, “আমি যাচ্ছি! থাকুন আপনি নিজের হেয়ালি নিয়ে।”

“হেয়ালি আমি করছি না, আপনি? হঠাৎ করে চুড়ির কথা কেন আসলো!”

“হঠাৎ করে আসবে কেন চুড়ি? আপনি তো ভেবেছিলেন, যেদিন আমাদের নতুন পথচলা শুরু হবে, আমার হাতে চুড়িগুলো পরিয়ে দিবেন। আমার আন্দাজ কি ঠিক?”

“হ্যাঁ, একদম। কিন্তু…”

“আপনি সত্যি বুঝতে পারছেন না, আমি আজ এই শাড়ি পরে কেন এসেছি? আমার মা আমাকে এই সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে। আপনার বিষয়ে খোঁজ খবরও নিয়েছে।”

কথাগুলো শোনার পর বুঝতে যেটুকু সময় এরপর অরণ্যের মনে হল, এখন ও যা অনুভব করছে তা অবিশ্বাস্য এক অনুভূতি। এবং কিছু ভাগ্যবান মানুষ এটা জীবনে একবারই অনুভব করে। আজ এই মুহূর্তটা ওর জন্য থমকে গেল। এরপর ওদের অনেক কথা হবে, অনেক ভাব বিনিময় হবে। কিন্তু নতুন সম্পর্কে সূচনা, ভালোবাসা, স্বীকৃতি,যেভাবে হলো, সেটা অকৃত্রিম, অনন্য, অসাধারণ।

“আপনার মা তো দুর্দান্ত একজন মানুষ! একদম অ্যারেঞ্জ ম্যারেজের মত অ্যারেঞ্জ প্রেমের ব্যবস্থা করেছেন।”

“ফাজলামো বাদ দিন। এখন চুড়ি দেন।”

লাবণ্যের চেহারাটা খুব থমথমে। সেদিক তাকিয়ে অরণ্য বললো, “সামান্য কয়টা চুড়ি…”

“ও! ভালোবাসা শুরুই হল না, এরমধ্যেই আমার জন্য কেনা চুড়ি সামান্য হয়ে গেল? আমি সামান্য হইতে আর কয়দিন!”

অরণ্য ফট করে লাবণ্যের হাত ধরলো। কী এক অনুভূতি বুকের ভেতর যেন কিছু বয়ে চলছে। “চল, তোমাকে চুড়ি কিনে দেই।” সম্পর্ক নেমে এল আপনি থেকে তুমিতে!

“না, লাগবে না।” রেগে আছে তাই হাত ধরার অনুভূতিটা বুঝতে পারল না। “সারা দুনিয়ার চুড়ি এনে দিলেও হবে না।”

অরণ্য ভালো জব্দ হলো। কী বিপদ! “আসলে ওই দিন অনেক রাগ হয়েছিল, তাই…”

লাবণ্য ওয়েটার ডেকে বিল শোধ করলো। তারপর ব্যাগ কাঁধে তুলে দাঁড়ালো, “আমি যাচ্ছি এখন।”

লাবণ্য রিকশায় উঠা মাত্র পাশ থেকে অরণ্য উঠে বসলো। রিকশা চালককে বললো, পুরো ধানমন্ডি এলাকা চক্কর দেন অন্তত এক ঘণ্টা। তারপর লাবণ্যের দিকে তাকালো, “সরি, মাফ করে দাও প্লিজ।”

লাবণ্য অরণ্যের দিকে তাকালো, “মা আরেকটা কথা বলেছে, কোনো সীমালঙ্ঘন করা যাবে না। হুড ফেলে দিন, আর…”

তক্ষুনি অরণ্য লাবণ্যের হাতটা নিজের মুঠিতে পুরে নিল, “একটা লিস্ট দিতে বল তোমার আম্মুকে, কী কী করা যাবে আর যাবে না।”

লাবণ্য কিছু বলে না। হাত ধরাটা অন্যায় হচ্ছে বুঝতে পারছে, কিন্তু নিজের ভালোলাগাটুকু বশে আনতে পারছে না।

ঠান্ডা, ঠান্ডা আবহাওয়া। রিকশা যখন ধানমন্ডির একটা নীরব এলাকা দিয়ে যাচ্ছিল, তখন অরণ্য গান শুরু করে, “আমার একটা তুমি আছো বলে ভালো আছি এত…” প্রচণ্ড বেসুরে। তবুও লাবণ্য কিছু বলে না। ওর খুব ভালো লাগে। মনে হয়, এই মানুষটা পৃথিবীতে এসেছে শুধু ওর জন্য।

এক সময় লাবণ্য ডাক দেয়, “অরণ্য।”

“হুঁ, বল। এখনও বেঁচে আছো? ভেবেছিলাম, এমন গান শুনে তুমি মরেই গেছ বুঝি!”

“মরে গেলে খুশি হতেন?” অভিমানি জিজ্ঞাসা লাবণ্যের।

“হ্যাঁ, আবার জিগায়। তাই তো গান শুরু করেছিলাম। আর আমি যদি মরে যাই?”

লাবণ্য হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায়, “রিকশা থেকে নামুন। এটা কোনো প্রশ্ন হলো? আপনি বুঝতে পারেন, মৃত্যু নিয়ে আমার একটা ট্রমা আছে?” ওর কণ্ঠে কান্না ধরা পড়ে।

অরণ্য হঠাৎ ওর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে, “সরি… পাখি…”

“কি বললেন?”

“বলেছি, আমার হৃদয়ের রানী, আমার ময়না, টুনটুনি।”

“থামেন থামেন! আগে ঠিক করে বলেন, আমি পাখি না মানুষ?”

“তুমি আমার, তুমি আমার… আমার মেঘ বালিকা।”

“আমি বালিকা?” জোরে হেসে ওঠে লাবণ্য।

চলবে…..

#মনে_রবে_কিনা_রবে_আমাকে
#কাজী_জেবুন্নেসা