#মনোভূমির_ছায়া
পর্ব – ৩৪
#মাহীরা_ফারহীন
কলিং বেলের ট্রিং ট্রিং শব্দ হলো৷ ইভান দরজার বাইরে অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে অন্ধকার। লোহার গেটের দুপাশে দুটো হারিকেন আকৃতির প্রকোষ্ঠে আলো জ্বলছে শুধু। আজ আকাশে চাঁদার মতো দুধ সাদা চাঁদ একদিকে নিরবে ঝুলে রয়েছে। ঝিঁঝি পোকারা নিরবচ্ছিন্ন গান করে চলেছে। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে গেল। ইভান নিনাকে দেখা মাত্রই বলল,
‘হেই সরি এই অদ্ভুত সময় এসে হাজির হওয়ার জন্য। কিন্তু আমি তোমাকে একটা জিনিস দেখাবো এন্ড আই গেজ সেটা তোমার দেখা দরকার।’
উত্তরে নিনা শুধু সায় জানিয়ে মাথা ঝাঁকাল। তারপর ভেতরে সরে দাঁড়াল। ইভানের ভ্রু সূচালো হলো। বলল,
‘এখনো কথা বলবা না আমার সাথে?’
‘সেটা তো বলি নি। ভেতরে এসো।’ বলল ও।
ইভান এবার ভালো ভাবে নিনার দিকে তাকাল। ওর কন্ঠটা অন্যরকম শোনাচ্ছে। নিনাকে বেশ গোলগাল দেখাচ্ছে। অন্য রকম একটা ভাব। ঠোঁটের নিচে একটু ডান দিকে ছোট্ট তিলটা চোখে পরতেই ইভান হেসে উঠল। বলল,
‘ওহ্হ তুমি নিমা রাইট? বুঝেছি।’
‘হ্যা দুলাভাই। শালিকে তাহলে চিনতে পেরেছেন।’ ঈষৎ হাসি দিয়ে বলল ও।
ইভান শব্দ করে হাসল। ভেতরে ঢুকে জুতা খুলতে খুলতে বলল,
‘তোমাদের শুধু চেহারাটাই এক। বাকিসব দেখি উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরুর মতো উল্টা।’
‘তা বটে। কিন্তু সবসময় নয়। এই যেমন এখন তোমাকে দেখলে অবশ্যই ওর মুখে একটু হলেও হাসি ফুটবে।’
‘ওপস আমার তা মনে হয় না। দেখো ও মোটেও হাসবে না আমাকে দেখে।’
‘চকলেট ট্রিটে বাজি?’
‘আইসক্রিম ট্রিটে বাজি।’
‘ঠিক আছে।’ বলে হাসল নিমা।
ইভান করিডর পার করে লিভিং রুমে এলো। জিজ্ঞেস করল,
‘তুমি আমাকে চিনলা কিভাবে?’
‘অমিতের কাছে ছবি দেখেছি।’
‘বাহ আমার সাথে দেখা হওয়ার আগেই ওর সাথেও দেখা হওয়া সারা। কী ভাই ও? এখানেই এসে বসে থাকে নাকি?’
‘না না, আমাদের জন্মদিনের দিন এসেছিল। ওর সাথে ফাজলামো টা করতে পারিনি। আমাদের একসাথেই দেখে ফেলেছিল। কিন্তু কী ভাই একেকজন দেখি সেকেন্ডের মধ্যে পার্থক্য বুঝে যায়।’
‘অমিতের কথা জানি না। আমি আমার নিনাকে খুব ভালো করে চিনি।’ গর্বিত কন্ঠে বলল ইভান।
‘বুঝতেই পারছি। বাই দ্যা ওয়ে সেদিন পুরাই অদৃশ্য পাগল প্রেমিক জাদুঘরের মতো আমাদের বাড়ির আশেপাশে উড়ে বেড়ালা অথচ একবারও দেখা করলা না কেন?’
‘ধুর তোমার বোন দেখাই করতে দিল না। আর আমার বাসায়ও মেহমান এসেছিল তাই চলে যেতে হয়েছে।’
‘ওহ্ আচ্ছা।’
ইভান সোফার ওপর আরাম করে বসল। বলল,
‘তোমার বোন কোই?’
‘ওর কামরায়৷ আমি গিয়ে খবর দিচ্ছি দাঁড়াও।’ বলেই এমন ভাবে ছুটতে ছুটতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল যেন না ছুটলে ওর ট্রেন ছুটে যাবে। নিনার কামরায় গিয়ে ঝড়ের গতিতে দরজা খুললো। নিনা চমকে উঠে ওর দিকে তাকাল। লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘কী হলো? কিছু হয়েছে?’
‘হয়েছে মানে? দুলাভাই এসেছে! দুলাভাই!’ গানের সুরে কথাটা বলেই নাচের ভঙিতে এক পাক ঘুরল।
নিনা হা করে তাকিয়ে থাকল ওর দিকে। তারপর ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
‘দুলাভাই? কিসের দুলাভাই? কী বলছিস?’
‘আমি দুলাভাইকে উপরে পাঠাচ্ছি।’ বলেই নিনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঝড়েরবেগে কামরা ত্যাগ করল। নিনা পুনরায় হা করে খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবল, ‘পাগল রে। নিশ্চয়ই ইভান এসেছে। আর কাকেই বা দুলাভাই বলবে ও।’
মিনিটও না পেরোতেই ঠিকই ইভনা এসে দরজা নক করল। নিনা সারা দিতেই ভেতরে ঢুকল। এখন বাজে প্রায় রাত নয়টা। নিনা এখনো ওর টেবিলেই বসে আছে। ইভানকে দেখে বলল,
‘হেই। হঠাৎ এখানে?’
‘হ্যা। আমি আসলে যেই কাজে এসেছি ওটা আই গেজ চ্যাটেও করা যেত। হুদাই এত কাহিনী করে আসলাম।’
‘কী কাজ?’
‘ওহ ওয়েট নিমা আমাকে একটা আইসক্রিম ট্রিট দিবে।’ উচ্ছসিত কন্ঠে ঘোষণা দিল ইভান। নিনা কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
‘আইসক্রিম ট্রিট? কিন্তু কেন?’
‘আমরা বাজি ধরেছিলাম। আর আমি জিতেছি!’
‘তোমাদের না মাত্র পাঁচ মিনিট আগেই প্রথম দেখা হলো?’
‘হ্যা। এবং বাজি ধরতে তো আর এক ঘন্টা লাগে না। তাই না?’
‘তো তুমি জিতলা কীভাবে?’
‘আমরা বাজি ধরেছিলাম যে আমাকে দেখে তোমার মুখে হাসি ফুটনে কি না সেটা নিয়ে। এবং তুমি হাসোনি। সো আমি জিতেছি।’ এবার নিনা এ কান থেকে ও কান পর্যন্ত হেসে উঠল। বলল,
‘ওফ কাদের সাথে বাস করি আমি।’
ইভান মুচকি হাসল। তারপর বলল,
‘আচ্ছা যাই হোক আমি তোমাকে কিছু একটা দেখাবো।’
‘কী?’ বলেই উঠে গিয়ে বিছানায় ইভানের পাশে বসল। ইভান পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সেই নির্দিষ্ট ছবিটা বের করে নিনার সামনে ধরল। বলল,
‘এটা এগারো সেপ্টেম্বর বিকালে টনি আমাকে পাঠিয়েছিল। ওর প্রজেক্টের ছবি।’
নিনা ওর মোবাইলটা হাতে নিয়ে ভালো ভাবে পরখ করল সেটা। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ ওর চোখে পরল পেছনে বেশ দূরে বাগানে দাঁড়িয়ে থাকা অবয়বটা৷ সে মূলত কোথাও হেঁটে যাচ্ছিল। হাতে সবুজ মতো কী যেন একটা ধরা। তাছাড়া তার হাতে লাল রঙের গ্লাভস ও রয়েছে।
তবে ছবিতে সেই অবয়বটা এত দূরে দাঁড়িয়ে আছে যে হাতের সেই ছোট চিকন বস্তুটি ঘোলা দেখাচ্ছে। নিনা বিস্মিয়াবিষ্ট দৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকাল। বলল,
‘এটা..এটা কী হেমলক?’
‘আমার তো তাই মনে হয়।’
‘আর এটা তো এ্যাভরিল হতেই পারে না। এ্যাভরিল এমন ক্যাপ্রি কখনোই পরে না।’
‘আমি এটা লিজাকে দেখিয়েছি। এবং ও বলেছে ওই দিন এমিলি এই ড্রেসটাই পরেছিল।’ বলল ইভান। নিনা নিরবে ছবিটার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। কিছুক্ষণ পর লাফিয়ে উঠে বলল,
‘এক কাজ করি বাবাকে পাঠাই এটা। তাহলে ওরা এই ছবিটা এক্সেস জুম করে ক্লিয়ার ছবি পাঠাবে।’
‘ওয়েল এটা ভালো আইডিয়া। আমি তোমাকে ছবিটা পাঠাচ্ছি।’
‘ইমেইলে পাঠাও। নাহলে ছবির রেজুলেশন আরো খারাপ হয়ে যাবে।’
‘ওকে।’ বলেই কাজে লেগে পরল। ছবিটা পেতেই নিনা ওর বাবাকে সেটা ইমেইল করল। তারপর মি.মালিককে ফোন করে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা খুলে বলল। উনি আধা ঘণ্টার মধ্যে কাজটা করিয়ে পাঠাবেন বলে রেখে দিলেন। নিনা উৎকন্ঠিত ভাবে বলল,
‘ইভান আমিও তোমাকে কিছু একটা দেখাব।’ বলেই উঠে গিয়ে টেবিল থেকে এ্যাভরিলের ডায়েরিটা নিল। এসে পূ্র্বের স্থানে বসল। ডায়েরিটা খুলে আগের পাতাগুলোর লেখা দেখাল। তারপর শেষের খু*নের স্বীকারোক্তি টা দেখাল।
একটা জিনিস খটকা লেগেছে ওর। টনিকে খু*ন করার ঘটনাটার লেখা এবং এর আগের লেখা গুলোর মাঝে একটু পার্থক্য রয়েছে। এমনকি টনির খু*নের ঘটনা টার তারিখ টাও উল্টো লেখা। প্রথমে মাস, তারিখ তারপর সাল। কিন্তু বাকি সবগুলোতেই সাল প্রথমে লেখা। খু*নের ঘটনার মধ্যে লেখায় S, R, W এবং Y একটু অন্যরকম ভাবে লেখা৷ প্রথম তিন চারটে বাক্যে এ্যাভরিল যেভাবে লেখে সেভাবেই লেখা কিন্তু পরের পুরোটাতেই এই বর্ণ গুলো লেখার ধরণ ভিন্ন। ইভান বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে লেখাগুলো খুঁটিয়ে দেখল। তারপর বলল,
‘আসলেই লেখার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে৷ দুটো খুব সম্ভবত আলাদা হাতের লেখা।’
নিনা কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলল,
‘এ্যাভরিলের ডায়েরিটা পড়া এবং এই কিছু দিনের ঘটনাগুলো মিলিয়ে আমি একটা অন্যরকম ব্যাপার ধরেছি।’
‘কী?’
‘এ্যাভরিলের খুব সম্ভবত কোন একটা মানসিক সমস্যা আছে। ও প্রায়ই এটা সেটা ভুলে যেত। মানে এমন জিনিস যেটা সাধারণত কারো ভোলার কথা নয়। মাঝে মাঝে একটু অন্যরকম আচরণ করত। এমনকি যেসব জিনিস ওর পছন্দ নয় বা ও কখনো পরেনি অথবা দেখেনি সেসব থেকে থেকে ওর করতে ভালো লাগতো। দেখতে ভালো লাগতো।’
‘মানে মোট কথা হচ্ছে ও আসলে মাঝেমাঝে সম্পূর্ণ অন্য একটা মানুষের মতো আচরণ করত?’ আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞেস করল ইভান।
‘হ্যা।’
‘তোমার না স্টেটমেন্ট দেওয়া এখনো বাকি? তাহলে এইসব তোমার সেখানে বলা উচিৎ।’
‘আমার মনে হয় না দরকার পরবে।’ কিছুটা ভেবে বলল নিনা।
‘কেন?’
‘কারণ এই প্রমাণগুলো। লাইক এই লেখাটা যেহেতু এ্যাভরিলের হাতের লেখার সাথে মিলছে না। এমনও তো হতে পারে যে ও এটা লেখেই নি।’ বলে উত্তরের আশায় ইভানের দিকে তাকাল। ইভান কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইল। তারপর বলল,
‘ওয়েট ওয়েট আসলেই এমন হতে পারে যে এ্যাভরিল থেকে থেকে নির্দিষ্ট সময়ের ঘটনা ভুলে যায়, এবং সেটা এ্যামিলি জানতো। কাজেই সেদিন এ্যামিলি বিকেলে নিজেই হেমলকটা টনির স্ট্রবেরি শেইকের গ্লাসে মিশিয়ে রেখেছিল। এবং বাকি কাহিনি নিজেই এ্যাভরিলের ডায়েরিতে লিখে দিয়েছে। আর যেহেতু এ্যাভরিল জানে যে ওর ভুলে যাওয়ার এমন কোন সমস্যা আছে। কাজেই ও নিজের ডায়েরিতে যা লেখা আছে সেটাই মেনে নিয়েছে।’
‘পার্ফেক্ট ইভান! তার মানে এ্যাভরিল খু*ন করেইনি!’ প্রফুল্লচিত্তে বলল নিনা। ইভান হেসে উঠে নিনার দিকে তাকাল। তারপর হঠাৎ করেই হতাশা ভরা একটা মুখভঙ্গি করল। নিনা জিজ্ঞেস করল,
‘কী?’
‘আমি ভাবলাম তুমি খুশিতে আমাকে জড়িয়ে ধরবা।’ নিরাশ কন্ঠে বলল।
‘ধুরো ইভান!’ মুচকি হেসে ওকে কনুই দিয়ে হালকা ঠেলা দিল।
হঠাৎ একটা কথা মনে পরতেই নিনা বলল,
‘ওহ এ্যাভরিলের আরেকটা ডায়েরি আছে। ভুলিয়েই গিয়েছিলাম।’ বলেই উঠে দাঁড়াল। কামরা থেকে বেরিয়ে গিয়ে এ্যাভরিলের কামরায় ঢুকলো। কিছুক্ষণ পর আরেকটা ডায়েরি হাতে ফিরে এলো। বিছানায় বসে সেটা খুলে পৃষ্ঠা গুলো ঘাটতে ঘাটতে একটা পৃষ্ঠায় এসে থামল। পৃষ্ঠার সাথে একটা খাম আঠা দিয়ে লাগিয়ে রাখা। ওরা খামের মধ্যে দুটো দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া কাগজ পেল। কাগজের দুপাশেই পাতা ভরে লেখা। একটা পৃষ্ঠার নিচে অল্প একটু ছেঁ*ড়া। পাতা দুটো ইভানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ড্রেসিংটেবিলের কাছে চলে গেল। ড্রয়ার থেকে সেই কাগজের টুকরো টা নিয়ে ফিরে এলো। সেটা নিয়ে এসে মিলিয়ে দেখলো। হ্যা, এই পাতারই ছেঁ*ড়া অংশ। ইভান অবাক হয়ে তাকাল। জিজ্ঞেস করল,
‘টনির ডায়েরির পৃষ্ঠা এতদিন তোমার বাসায়ই ছিল? আর এই টুকরোটা তুমি কোথায় পেয়েছিলা? ওইদিন তো বললা না।’
‘ওয়েল এগুলো আসলে গ্রেউড বাড়ির ডাস্টবিনে ছিল। ফিউনেরালের দিন আমি যখন স্ট্রবেরি শেইকের বোতল ডাস্টবিন থেকে তুলে এনেছিলাম তখন এইসব কাগজ ওখানেই ছিল। তাই এগুলো দিয়েই বোতলটা মুড়িয়ে এনেছিলাম।’
ইভানের চোখের পাতা সরু হয়ে এলো। নিনার দিকে এমন ভাবে তাকাল যেন এর চেয়ে বেশি আশ্চর্যজনক কথা ও এর পূর্বে কখনোই শোনেনি৷ নিনা বিচলিত ভাবে বলল,
‘কী হলো? এমন ভাবে তাকিয়ে আছো কেন?’
‘লাইক সিরিয়াসলি! এই কাগজগুলো ওদের বাড়ির ডাস্টবিন থেকে সেই ফিউনেরালের দিন তুলে এনেছিলা? আর আজকে হাতে পেলা? আর ডাস্টবিন?’ বলেই শব্দ করে হেসে উঠল। নিনা বিব্রতবোধ করল। ইভানের বাহুতে গুঁতো দিয়ে বলল,
‘হইসে হইসে! অনেক ফাজলামো করসো তুমি।’
ইভান হাসি থামাল। নিনা বলল,
‘এ্যাভরিল নিজের সেন্সে থেকে হোক আর না হোক ওই এই কাগজগুলো পেয়ে হয়তো নিজের ডায়েরিতে রেখে দিয়েছিল।’
‘তাই হবে।’ ওরা ডায়েরির পাতা দুটো সোজা করে সামনে মেলে ধরল।
|| ১১/০৯/২৩ ||
আমি কখনো ভাবিনি আমার জীবনের শেষ ডায়েরি লেখাটা আমি এটা জেনে লিখে যাব যে আমি মা*রা যাচ্ছি। শরীরের ভেতর হেমলকের বি*ষটা কাজ করতে শুরু করেছে কিনা জানি না। আমি চাইলে নিজেই হাসপাতাল যেতে পারি। কিন্তু কী লাভ বেঁচে থাকার এত চেষ্টা করে? আমি জানি আমি মা*রা যাচ্ছি বি*ষের কারণে নয়। কষ্টে। গত চারটা মাস প্রতিটা দিন প্রতিটা ক্ষণে আমি একটু একটু করে মা*রা যাচ্ছিলাম। হয়তো তার ফিরে আসার একটা ক্ষীণ আশার আলোর দিকে তাকিয়েই শেষ নিঃশ্বাস টা ত্যাগ করিনি। কিন্তু আজ যখন লিজা নিজেই আমার বেঁচে থাকার কারণটা আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলো। তখন আর চেষ্টা করেও লাভ কী?
আজকের সারাটা দিন খুব ব্যস্ত গেল। বিকেলে এ্যামিলি লিজাকে নিয়ে ওদের বান্ধবীর বাসায় চলে গেল। অরল্যান্ডোও এসে ঘুরে গেল। মিস ম্যারিও চলে গেলেন। শেষবারের জন্য যেই মুখ গুলো দেখার সুযোগ পেলাম তাদের মধ্যে দুজন দানির ভাই বোনই রয়েছে। একা একা বসে এসাইনমেন্ট করছিলাম। ভালো লাগছিলো না কিছু। হঠাৎ আটটার পর লিজা এলো বাসায়। আইসক্রিম নিতে। ফ্রিজে অনেক দিন ধরে ডজন খানেক আইসক্রিম পরেছিল। আগে খুব পছন্দ করতাম। ইদানীং সেসব থেকে মন উঠে গিয়েছে। জেন বাগানের হ্যামোকে বসে বই পড়ছে সেই কখন থেকে। লিজা আইসক্রিম নেওয়ার কথা জিজ্ঞেস করতে লিভিং রুমে এলো। লিজার সাথে ব্রেকআপ এর পর অনেক দিন আমার সাথে কথা বলাবলি বন্ধ ছিলো। এই কয়েকদিন যাবৎ কিছুটা স্বাভাবিক আচরণ করছে ও। দুপুরে অরল্যান্ডো স্টারবাক্স থেকে এনে দিয়েছিল এটা। তখন খেতে ইচ্ছে করছিল না। খুব ক্লান্ত লাগছিল। মাথাটাও ব্যাথ করছিল। লিজা আইসক্রিমের কথা জিজ্ঞেস করতেই উঠে দাঁড়ালাম। কিন্তু ও মাথা ব্যাথার কথা শুনে আমাকে বসিয়ে দিয়ে নিজেই চলে গেল শেইকটা আনতে। লিজাকে দেখতে পেলাম না আর। লিভিং রুমের ডান দিকের দরজাও খোলা। জেনকে সরাসরি দেখা যাচ্ছে। আর ও এখনো বইয়ের মধ্যেই ডুবে আছে। সেই কাঁচের গ্লাস হাতে লিজাকে বাগানে আসতে দেখলাম। তখনই কলিংবেল বেজে উঠল। লিজা বাগানের সাদা টেবিলে গ্লাসটা রাখল। তারপর ছুটে গেল দরজা খুলতে। তখনই এপাশে দেখলাম জেনও বই রেখে উঠে দাঁড়িয়েছে। সাধারণত সামনের বাগান থেকে ডানদিকের বাগান দেখা যাওয়ার কথা নয়। হয়তো জেন ও লিজা একে-অপরকে দেখেনি৷ কিন্তু জেন কী দরজা খুলতে যাচ্ছে? ওর তো কেউ আসলে দরজা খোলা নিষেধ। জেন সামনের বাগানে গেল। সাদা টেবিলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটু থামল। হয়তো গ্লাসটা ওখানে পরে থাকতে দেখে থেমেছে। তারপর বাম দিকে চলে গেল। কয়েক মিনিটের মাথায় লিজা ফিরে এলো। গ্লাস নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। আমার সামনে এসে সেন্টার টেবিলে গ্লাসটা রাখল। কে এসেছে জিজ্ঞেস করতেই বলল, এ্যামিলি৷ ওরা আবারও বেরিয়ে যাবে এখুনি। তারপর তিড়িংবিড়িং করে চলে গেল। আমি সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। গ্লাসটা হাতে নিয়েই চমকে উঠলাম। গোলাপি তরলের মধ্যে গুঁড়ি গুঁড়ি শুভ্র ফুল৷ হেমলক! আমি কী ঠিক দেখলাম? লিজা সত্যি সত্যি নিজের হাতে আমাকে বি*ষ দিচ্ছে? এতটাই ঘৃ*ণা আমার প্রতি? আমি বেশ কিছুক্ষণ গ্লাসটা হাতে নিয়ে বসে থাকলাম। বি*ষ এটা। একবার বাগানের দিকে চোখ তুলে তাকালাম। ইমোজেন পুনরায় এসে আগের স্থানে বসেছে। এখনো বই-ই পড়ছে। জেন তো গ্লাসটা দেখল একটু আগে। ভালো করেই জানে লিজা আমাকে কী দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ও ভ্রুক্ষেপহীন। নাহ অবাক হওয়ার কী আছে। ওর যথেষ্ট কারণ আছে আমাকে ঘৃ*ণা করার। আমি মা*রা গেলেও ওর কিছুই যায় আসে না। যদিও এমনিতে ও খুবই ভালো ব্যবহার করে। ওর মতো মিষ্টি জেনুইন মেয়ে হয়তো আর কখনোও আরেকটা দেখব না। কিন্তু মাঝে মাঝে আমার প্রতি ওর ঘৃ*ণার প্রকাশও ঘটায়। ওর কাছ থেকে আমরা সব কেঁড়ে নিয়েছি। সব! এমনকি ওর একমাত্র আপনজনকেও। আমাকে সবাই ঘৃ*ণা করে। করবে নাই বা কেন? আমি হয়তো এখন আমার কর্মের ফলই পাচ্ছি। আমি যেখানে ওর কাছ থেকে ওর বোনকে কেঁড়ে নিয়েছি ঠিক সেই ভাবে কেউ আমার একমাত্র ভালোবাসা লিজাকেই কেঁড়ে নিলো। হয়তো ইভান সবসময়ই সত্যিই বলেছিল। কে বলতে পারে? আমি তো ওর কথা বিশ্বাস না করে ওর সাথে অন্যায় করেছি। ওকে জেনে শুনে সাস*পেন্ড করিয়েছি। ওদের দোষ না দিয়ে হয়তো নিজের যোগ্য শাস্তিটাই মেনে নেওয়া উচিৎ। হয়তো আমার ম*রে যাওয়াটাই সবার জীবনে শান্তি এনে দিবে। এই ভেবে শেইকটা এক ঢোকে খেয়ে শেষ করলাম। আমি উঠে দাঁড়ালাম। আমার কামরায় যেতে হবে। মা*রা যাওয়ার পূর্বে আমাকে ডায়েরিতে শেষ কথাগুলো লিখতে হবে। এবার ক্লাসে আমাদের “দ্যা এপোলজি” নামক একটি গদ্য আছে। সেটা এখনো পড়ানো হয়নি। কিন্তু আমার ইন্টারেস্টিং লেগেছিল বলে আগেই পড়ে ফেলেছিলাম। তখন হেমলক নিয়ে বেশ রিসার্চ করেছিলাম বলে জানা ছিল, আমার শরীরে বিষটা কাজ করতে প্রায় আধা ঘণ্টার মতো সময় লাগবে। আমার শেষ কথাগুলো লেখার জন্য যথেষ্ট এই সময়। যাওয়ার সময় দেখলাম সিসিটিভিটা কেন জানি বন্ধ হয়ে ছিল। সেটা চালু করে দিলাম। আমাদের বাগানে হেমলকের গাছ সেদিন মি.বার্টন উঠিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এ্যামিলির কথায় রেখে দিতে বলেছিলাম।আজ বুঝতে পারছি হেমলকের ঝোপটা আমাদের বাগানে আপনাআপনি হয়েছিলই হয়তো আমার ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের ভূমিকা হিসেবে। আমি জেনে বুঝেও বি*ষাক্ত গাছটা রেখে দিয়েছিলাম আর সেটাই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কী লাভ নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে? জেন, লিজা তবুও আমাকে ঘৃ*ণা করেই যাবে। এ্যামিলির কাছে কখনোই আমি একজন ভালো ভাই হতে পারবো না। অরল্যান্ডো, কাইলি, রোজ আর নিনা ওদের কাছে হয়তো একজন ভালো ফ্রেন্ড ছিলাম। তাছাড়া ইভানকেও কীই বা দোষ দেওয়া যায়? ওর কম ক্ষতি করিনি আমি। ও যতটা না আমাকে ঘৃ*ণা করত তার চাইতে বেশি আমিই ওকে ঘৃ*ণা করতাম। আর কী? বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গিয়েছে। শরীরের ভেতর জ্বা*লাপোড়া করছে। বুকটা অতিরিক্ত দ্রুত গতিতে ধরফর করছে। আর হয়তো কিছুক্ষণ। তারপর এই যন্ত্রণা শেষ হয়ে যাবে। আমাকে হয়তো ওরা মা*র্ডার করলো কিন্তু আমি এককথায় আ*ত্নহ*ত্যা করছি। আমার এই ডায়েরিতে আমার মৃ*ত্যুর জন্য আমি কাউকে দোষারোপ করবো না। কেউ আমাকে বি*ষ দিয়ে থাকুক আর না থাকুক আমি সবাইকে মাফ করে দিলাম। যদিও মাফটা আমার চাওয়া উচিৎ। আমি সবার সাথে অন্যায় করেছি। আর এখন তারই শাস্তি পাচ্ছি। এবং মা*রাও যাচ্ছি আমার নিজের ইচ্ছায়। আমি শুধু এতটুকু লিখে যেতে চাই, আমি আমার বাবা, মা এবং বোনকে খুব ভালোবাসি। তাদের কাছে কখনো আমার কৃতজ্ঞতার কথা লিখে শেষ করতে পারবো না। এবং আমি এখনো লিজাকে অতটাই ভালোবাসি যতটা ভালোবাসতাম যখন ওকে ড্যান্ডালাইনের মাঠে বসে থাকতে দেখেছিলাম। এবং সবসময় ভালোবাসবো।
টনি।
পড়া শেষ করেই ইভান বলল,
‘ওয়েট আমি ওকে ঠকিয়ে ছিলাম কিনা সেটা নিয়ে তাহলে কী টনি সত্যিই বিভ্রান্ত ছিল? ও পুরোপুরি এটা বিশ্বাস করত না?’
‘ওয়েল লেখাটা পড়ে তো মনে হলো ও অনেকটা দুঃখীতও ছিল তোমার প্রতি।’
কিছুক্ষণ দুজনেই নিশ্চুপ রইল। এরপর ইভান বলল,
‘তখন যে এ্যামিলি এলো। ও-ই সময়ই হয়তো সিসিটিভিটা বন্ধ করে দিয়েছে।’
‘হ্যা। তাই হবে। কিন্তু এটা কী কোর্টে জমা দেওয়া উচিৎ আমাদের?’
‘ওয়েট এখানে একটা ঝামেলা আছে। টনি এ্যাভরিলকে দেখেছিল টেবিলের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে। ও হয়তো কিছু না করে শুধু দাঁড়িয়েই ছিল। কিন্তু এই একটা কথার জন্য জিনিসটা জটিল হয়ে যাবে। ইউএসএর প্রসিকিউটর আর এটর্নিরা প্রচুর বাঁকা ধরনের। এই জিনিসটা ছেড়ে দিবে না। কিন্তু এ্যামিলি বা কে আসলে হেমলকের গাছটা রেখে দিতে বলেছিল এই তথ্যটা আমাদের দরকার।’
‘অবশ্যই। এটা খুব প্রয়োজন। এক কাজ করতে পারি আমরা ওদের মালিকে জিজ্ঞেস করে তার জবানবন্দি নিতে পারি।’
ইভান বলল,
‘ভালো বুদ্ধি। আচ্ছা ওয়েট এগারো তারিখের যেই ঘটনাটা এ্যাভরিলের ডায়েরিতে লেখা সেটা যদি এ্যামিলির লেখা হয়, তাহলে আসলেই এ্যাভরিলের নিজের দিক থেকে কিছু লেখা নেই কোথাও?’
‘থাকতে পারে। এই ডায়েরিটা তো পুরো ঘেটে দেখিনি।’
বলে ডায়েরির প্রতিটা পাতা উল্টাতে লাগলো। অবশেষে ওরা ডায়েরির খালি পাতাগুলোর মাঝের দিকে বেশ কয়েকটা পৃষ্ঠায় লেখা খুঁজে পেল।
| ২০২৩, ১১ই সেপ্টেম্বর |
আজকের সন্ধ্যাটা বড়ই অদ্ভুত কেটেছে। এমনিতে সারাদিন সবই স্বাভাবিক ছিল। আমার এমনিতে আজকে সন্ধ্যায় কোন কাজ নেই। তাই বাগানে বসে বই পড়ছিলাম। বুঝলাম না আজকে কী বাসায় কিছু ছিল? বিকাল থেকে দেখলাম দুনিয়ার মানুষ এলো একে একে। এখনই আবার লিজা এলো। ওকে দেখিনি, কথা বলার শব্দ শুনলাম। এর মধ্যেই আবারও কে জানি এলো। আজব তো আর কতজন আসবে আজকে? বইটা হ্যামোকে রেখে উঠে দাঁড়ালাম। লিভিং রুমের দরজা টা খোলা। টনি সোফায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। বাগানের টেবিলে আবার একটা গ্লাস রাখা কেনো জানি। সেটায় স্ট্রবেরি শেইক। ওহ, লিজা নিশ্চয়ই টনিকে দিতে আসছিল এটা। আমি তো সামনের দরজায় যেতে পারবো না। রান্নাঘরের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। এ্যামিলির কন্ঠ শুনতে পেলাম করিডোরে। বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছিল বলে তিনতলায় লফ্টে গেলাম কোন গরম কাপড় গায়ে দিতে। হাতে আমার গ্লাভস। জুলস আন্টির বাসায় যাব বলে নিচের কামরাটা ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করেছি বিকেলে।
তারপর নিচে নেমে আবারও বই হাতে হ্যামোকে গিয়ে বসলাম। আমি যেখানে বসে আছি সেখান থেকেও লিভিং রুম আংশিক দেখা যায়। টনি একটু পরেই উঠে চলে গেল। আমার যাওয়ার সময় হয়েছে। জুলস আন্টির বাসায় যাব আজ। তাই বের হব। লিভিং রুমে এসে দেখলাম টেবিলের পাশে কার্পেটের ওপর একটা ব্রেসলেট পরে আছে। ওমন ব্রেসলেট লিজার হাতে দেখেছি। ওরই হবে। টনিকে দেয়ার জন্য পকেটে রেখে দিলাম। টনিকে বলে যাওয়ার জন্য ওর কামরায় গেলাম। গিয়ে দেখি টনি নিজের বিছানায় কেমন অদ্ভুত ভাবে বসে আছে। না প্রায় শুয়ে আছে। আমাকে দেখা মাত্র ওর হাতে থাকা ডায়েরিটা লুকিয়ে ফেললো। অদ্ভুত তো! ডায়েরি লিখছিল, ঠিক আছে। সেটা লুকানোর কী আছে? বললাম,
‘কী হলো? ওমন চমকে উঠলা কেন?’
‘ন..না কিছু না।’
‘তুমি ঠিক আছো?’
‘একটু খারাপ লাগছে।’
‘ওহ।’ আমি আবারও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম তখনই টনি কেমন নিস্পৃহ কন্ঠে বলল,
‘জেন শোন।’
‘কী?’
‘একটু বসো এখানে।’ এবার সত্যিই অদ্ভুত লাগলো। কী আজব? এই ছেলে আবার কী চায়? নিশ্চয়ই কোন কিছু নিয়ে উল্টা পাল্টা কথা বলবে। বিরক্তিকর! আমি গিয়ে বেডসাইড গদি বসানো টুলে বসলাম। অনেকটা বিরক্তি নিয়েই৷ আমার আবার দেরি না হয়ে যায়। টনি বলল,
‘আই…এম সরি জেন। এত বছর তোমার সাথে অনেক অনেক অন্যায় করেছি….ওর কথা শেষ না হতেই আমি বললাম,
‘অহেতুক সময় নষ্ট করছো। তোমার এসব আউল ফাউল কথায় আমার কোন আগ্রহ নেই।’ বলেই উঠে যাচ্ছিলাম।
‘না! না দাঁড়াও।’ বলে কোন রকমে সোজা হয়ে উঠে বসল ও।
ও প্রচন্ড ঘামছিল। চোখমুখে ক্লান্তি এবং অস্থিরতা লেগে আছে।
বললাম,
‘কী চাও টা কী তুমি? তোমার কী মনে হয় তোমার এইসব মাফ টাফ চাওয়া দিয়ে কী হবে? আমার এত বছরের কষ্ট, আমার ওপর হওয়া অ*ত্যাচার, অ*ন্যায় সব মুছে যাবে? আমার কাছ থেকে যা যা কেঁ*ড়ে নিয়েছ সব ফিরে আসবে?’
মেজাজ টা হঠাৎ গরম হয়ে গেল ওর এইসব বিরক্তিকর কথাবার্তায়। এখন এত ভালোমানুষি কোথা থেকো উথলে উঠছে?
‘না জেন শুন। আমি জানি আমার মাফ চাওয়ার কোন মূল্যই নেই তোমার কাছে। আমি জানি না আমি কী করলে তোমার শান্তি লাগবে। তুমি যেভাবে চাও আমাকে শাস্তি দিতে পারো। তাতে যদি তোমার শান্তি….পুনরায় ওর কথা শেষ হওয়ার পূর্বে আমি ঝট করে ওর টেবিলের ওপর থেকে গিটারটা হাতে তুলে নিলাম। বললাম,
‘কী করলে আমার শান্তি লাগবে জানো? যেই সব জিনিস তোমার প্রিয় সেসব তোমার কাছ থেকে কেঁড়ে নিতে পারলে।’
বলেই ওখানে রাখা কাঁ*টার টা দিয়ে গিটারের স্ট্রিং গুলো কে*টে ফেললাম। সেটা বিছানায় ফেলে দিলাম। তারপর পকেট থেকে লিজার সেই ব্রেসলেটটা বের করলাম। ব্রেসলেটটা খুব চিকন। বেশ জোর দিয়ে টান দিতেই ছিঁ*ড়ে গেল। হাতে গ্লাভস থাকার কারণে হাতে তেমন একটা লাগলো না। তারপর এগিয়ে গিয়ে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে বললাম,
‘তোমার ডায়েরিতে কী এমন লিখছিলা যেটা আমার কাছ থেকে ওভাবে লুকাতে হলো?’
‘তেমন কিছুই না…..ম্লান কন্ঠে ও উত্তর দিতে দিতেই আমি ওর হাতের নিচ থেকে ডায়েরিটা টেনে বের করলাম। শেষ কয়েকটা পৃষ্ঠা ঘেটে দেখি কী সব আবোলতাবোল লিখেছে। অনেকটা সুই*সাইড নোটের মতো। কিন্তু নাহ ওর তো আমাকে বিপদে না ফেললে পেটের ভাত হজম হয় না। শেষের দিকে এক জায়গায় লেখা আমি নাকি ও ম*রে যাচ্ছে জেনেও চুপ করে আছি? এটা দেখে মেজাজটা গেল আরোও বিগড়ে। কিসের ম*রে যাচ্ছে ও? আর আমি সেটা কিভাবেই বা জানলাম? ঝাঁঝাল কন্ঠে বললাম,
‘ওহ ওয়াও টনি! নাইস প্লে! আমি জানতাম অবশ্যই তোমার এসব মন ভুলানো কথাবার্তার পেছনে কোন কারণ আছে। এই সেই কারণ আমাকে খু*নের দায় ফাঁসাতে চাইছো? তাই? তাহলে তোমাকে মা*রবে কে টনি? আসলেই আ*ত্নহ*ত্যা করবা? পারবা না। তোমার মতো মানুষের নিজের জীবন নেওয়ার মতো মন থাকে না। অসহ্যকর একটা!’
বলে ডায়েরির পৃষ্ঠাগুলে ছিঁ*ড়ে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম।
যেতে যেতে পৃষ্ঠাগুলো দুমড়ে মুচড়ে বাইরের ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমি ভাবতেও পারিনি পরেরদিন সকালে জুলসের বাসায় বসে খবর পাব আসলেই টনি মা*রা গিয়েছে। তাও আবার নাকি খু*ন হয়েছে। আবার চাচা চাচি বলছে আ*ত্নহ*ত্যা করেছে। আমি সত্যিই বুঝতে পারলাম না আসলেই ও আ*ত্নহ*ত্যা করল? কিন্তু কেন?’
নিনা ও ইভান ডায়েরিটা পড়ে একে অপরের দিকে চাইল। নিনা বলল,
‘এটাই এ্যাভরিলের তরফ থেকে লেখা আসল ঘটনা।’
‘আমি শিওর ওর যদি আরেকটা সেল্ফ থেকে থাকে এটা তার তরফ থেকেই লেখা। কারণ আমাদের এ্যাভরিল মোটেও এমন রুড এন্ড মিন আচরণ করতে পারে না।’
‘হ্যা। অবশ্য তার জন্যে ওর যে স্প্লিট পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের মতো সমস্যা আছে সেটা প্রমাণ করতে হবে।’
‘তাছাড়া এ্যামিলির হাতের লেখার সাথে এ্যাভির ডায়েরির লেখাটা মিলিয়ে দেখতে হবে। দাঁড়াও লিজাকে ফোন দেই।’
বলল ইভান।
নিনা উঠে ঘর জুড়ে পায়চারি করতে লাগলো। লিজা ফোন রিসিভ করতেই ইভান বলল,
‘হ্যালো লিজা?’
‘হ্যালো। হ্যা বলো।’
‘আমাকে এ্যামিলির হাতের লেখার ছবি পাঠা। এখনি।’
‘কেন?’
‘অত প্রশ্ন করিস না তো। আচ্ছা রাখি।’ বলেই ফোনটা কেটে দিল।
‘ওয়েল তাহলে? আমরা এখন এই লেখা দুটো টেস্ট করতে পাঠাবো। ছবিটা তো পাঠিয়েছিও। আর এখানে স্পষ্ট লেখা এ্যামিলিই টনিকে বলেছিল গাছটা রেখে দিতে। এর চাইতে বেশি আর কী লাগে?’
ইভান উঠে দাঁড়িয়ে নিনার হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে বলল,
‘সো ডার্লিং কেস সল্ভ! তুমি অহেতুক এত দিন ধরে এত কাহিনী না করে, আমাকেও উল্টো স’ন্দেহ না করে আমার সাথেই কাজ করতা। একদিনেই কেস সমাধান হয়ে যেত!’
‘ওহ্হ। আমি যেন তোমাকে খুব চিন্তাম।’ বলল নিনা।
‘যা হয় তা কোন কারণেই হয়। এত কাহিনী না হলে অবশ্য তোমাকে আমি পেতাম না।’
নিনা লাজুক হাসলো।
ইনশাআল্লাহ চলবে।
#মনোভূমির_ছায়া
পর্ব – ৩৫
#মাহীরা_ফারহীন
এরপরের কয়েকটা দিন কেটে গেল খুব ব্যস্ততায়। বারবার থা*নায় ছুটে যাওয়া। বিভিন্ন প্রমাণাদি জমা দেয়া। নিজ নিজ স্টেটমেন্ট দেয়ার ওপর দিয়ে কেটে গেল সময়। অক্টোবরের প্রকৃতির রঙিন সাজ ধীরে ধীরে মলিন হয়ে যাচ্ছে। গুটি গুটি পায় এগিয়ে আসছে রুক্ষ শীতের দিন। নভেম্বরের মাস। কিছুদিন পর ফাইনাল। হাইস্কুলের শেষ বছর। এরমধ্যেই কোর্টের হিয়ারিং ডেট পরেছিল। সে অনেক কাহিনী। তবে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে এ্যাভরিলের ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসওর্ডার রয়েছে। এ রোগে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একই মানুষের আলাদা আলাদা চরিত্র এবং সত্তা থাকে। তাদের নিজস্ব জীবন কাহিনি, পছন্দ অপছন্দ এবং স্বপ্ন ইত্যাদি থাকতে পারেন এবং একটির সঙ্গে আরেকটির কোন মিলও থাকে না। তবে এ্যাভরিলের আলাদা চরিত্র ছিল না। ওর দুটো সত্তাই এ্যাভরিল নিজেও ছিল। পার্থক্য এতটুকুই ছিল যে একটি দয়ালু, পজিটিভ ও ভালো মনের সত্তা ছিল। সেটাই এ্যাভরিলের নিজস্ব চরিত্র। আর আরেকটা যেটা থেকে থেকে ট্রিগার হতো সেটা ছিল ওরই নেগেটিভ সাইড।
এসব প্রমাণ হওয়ার পর এমনিতেও ও “Not guilty by insanity plea” অর্থাৎ অপরাধের সময়ে মানসিকভাবে অস্থিতীশীল থাকায় ওর এ্যাসাইলামে হয়তো ২/৩ বছরের জন্য ব*ন্দি থাকতে হতো। তবে এরপরে খুঁজে পাওয়া বাকি প্রমাণ গুলো খেলাটাই ঘুরিয়ে দিয়েছে। সেই প্রমাণ অনুযায়ী এ্যামিলিই দোষি সাব্যস্ত হবে। ওর আরেকটা হিয়ারিং ডেট পরেছে। যদিও ততদিন পর্যন্ত এ্যামিলি হাজতেই বন্ধ থাকবে। যেদিন হিয়ারিংয়ে ব্যাপারটা পরিষ্কার সেদিনই ওকে লকআপে নিয়ে যাওয়ার পূর্বে নিনা ওর সাথে একবার কথা বলার সুযোগ পেয়েছিল।
নিনা ওকে থামিয়ে বলেছিল,
‘কয়েকটা মিনিট কথা বলতে পারি?’
এ্যামিলি ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। শীতল কন্ঠে বলল,
‘জেন খুব কষ্ট পাবে। আর যাই হোক আমি ওর নিজের বোন। যা যা করেছে আজ পর্যন্ত সব আমার জন্যেই।’
‘কী পেলা বলো তো? মানলাম টনি তোমার নিজের ভাই ছিল না। কিন্তু ও তোমাকেই সবচাইতে বেশি ভালোবাসতো।’
‘ওহ প্লিজ। ওই পরিবার আমার এবং আমার বোনের কাছ থেকে সব কেঁ*ড়ে নিয়েছে। আমাকে বলতে এসো না এসব। আমি সবচাইতে ভালো করে জানি জেনের সাথে কী কী অ*ন্যায় হয়েছে, অ*ত্যাচার হয়েছে।’
‘ওহ তাই নাকি? আর তুমি এভাবে প্রতিদান দিচ্ছ তোমার বোনকে?’
‘আমাদের এত এত সম্পত্তি সবই শেষে টনি একাই পেত। কিন্তু সে না থাকলে আপনাআপনি আমার আসল মা বাবার এত বছরের পরিশ্রম করে তৈরি সম্পত্তি আমিই পেতাম। আর জেন? জেনের আইডেন্টিটি ডিসওর্ডার আছে আমি জানতাম। নট গিল্টি বাই ইনস্যানিটি প্লিয়ায় ওকে স্বাভাবিক কারাদন্ড দেয়া হতো না। এই বড়জোর দুই তিন বছরের জন্য মানসিক হাসপাতালে থাকার নির্দেশ দিত। তাছাড়া জেন যতটা কর্মঠ এবং দয়ালু। ওর এইসব দেখে এমনিতেও শাস্তির সময়কাল কমিয়ে দেওয়া হোত।’
এর চেয়ে বেশি কথা বলার সুযোগ হয়নি। ওকে নিয়ে যাওয়া হয় এরপর৷ নিনা শুধু স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এতই যখন বোনের প্রতি ভালোবাসা, তখন কিভাবে পারলো নিজে ঠান্ডা মাথায় একটা মানুষকে খু*ন করে নিজের বোনের মানসিক সমস্যার সুযোগ নিয়ে সেটা তার ওপর চাপিয়ে দিতে? কিভাবে পারলো নিজের ভাইকে এভাবে খু*ন করতে? কিসের জন্য? শুধুই সম্পত্তির জন্য? টাকা পয়সার জন্য? লোভটা কী এতই বড় হয়ে দাঁড়াতে পারে? মানুষের সম্পর্ক, ভালোবাসার কোন মূল্য নেই? এসব প্রশ্ন বারবার নিনার মনে বেজেই চলেছে কয়েকদিন। এছাড়াও কোর্ট থেকে এ্যাভরিল কে বলা হয়েছে,
মিস ইমোজেন এ্যাভরিল কক্স প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় প্রয়াত অভিভাবক মিস্টার গ্যারি গ্রেউড এবং আমান্ডা গ্রেইডের উডিমেয়ার কোম্পানির সম্পূর্ণ শেয়ার ও ২০১৩ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত আয়কৃত লভ্যাংশ মিস কক্সের নামে চলে যাবে। এছাড়াও ন্যাশভিল 24th স্ট্রিটের ৯ নম্বর প্লট, গ্রেউড ম্যানশন, ক্যালিফোর্নিয়ার বেভারলি হিলস 81th গ্রেউড ফার্ম হাউজ, ওকলাহোমা ও নিউইয়র্ক ম্যানহাটেন এ একটি অ্যাপার্টমেন্ট এবং কলোরাডোতে একটি কটেজ ও লন্ডন ও টাস্কানির দুটো ম্যানশন মিস কক্সের নামে স্থানান্তরিত হবে।’
মিস্টার এবং মিসেস গ্রেউড কে দু*র্নীতি, চাইল্ড এ্যা*বিউজ এবং জব*রদখলের জন্য গ্রে*ফতার করা হয়েছে। তাদেরও যথার্থ শাস্তি দেয়া হবে। তাছাড়া এ্যাভরিলের মানসিক সমস্যার কারণে ওর জন্য নিয়মিত ট্রিটমেন্ট শুরু করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সেটা অবশ্য কোন সমস্যা নয়। এই সমস্যা টা যেহেতু চাইল্ডহুড ট্রওমার কারণে হয়েছে, কাজেই এটা বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতির কারণেই ট্রি*গার হতো। নিনার সঙ্গে থাকা শুরু করার পর থেকে ওর আরেকটা পার্সোনালিটি বলতে গেলে খুবই কম ট্রি*গার হয়েছে। কারণ ওর মনমেজাজ ভালো থাকতো। বড় কথা ও নিজেই শান্তিতে, আনন্দে নিজের বাড়ি ভেবে সেখানে থাকতো। এছাড়াও ওর উডিমেয়ার কোম্পানির দায়িত্ব পালন করার জন্য একজন ম্যানেজার হায়ার করা হবে। তাছাড়া এ্যাভরিল গ্রেউড ম্যানশনে থাকতে চাচ্ছে না। সেটা ভাড়া দিয়ে দিবে ও৷ অন্য কোথাও সিফট হয়ে যেতে চাচ্ছিল তবে নিনা ও মি.মালিক ওকে যেতে দেননি৷ যতদিন ইচ্ছা এ্যাভরিল ওদের বাড়িতেই ওদের পরিবারের মতো করেই থাকতে পারে। অবশেষে সেটাই মেনে নিয়েছে ও।
কয়েকদিন লিজাও বেশির ভাগ সময় নিজের কামরায় ব*ন্দি হয়ে বসে থেকেছে৷ যাকে পছন্দ করত সে খু*ন হয়েছে। সে ওকে কখনো চি*ট করেনি। যেই ঘৃ*ণার আড়াল নিয়ে ওর মৃ*ত্যুতে খারাপ না লাগার ভান করতো সেটা নিমিষেই ভে*ঙে চুর*মার হয়ে গিয়েছে। আর সেই মানুষটাকে পৃথিবী থেকে কে সরিয়ে দিয়েছে? ওরই ছোট বেলার বেস্ট ফ্রেন্ড? টনির নিজের বোন? এটাও যেন মানা যাচ্ছিল না। বারবার মনে হচ্ছিল কোথাও একটা গরমিল নিশ্চয়ই হচ্ছে। যেই মানুষটাকে ছোট বেলা থেকে চিনে আসছে, সেই মানুষটা কিভাবে এমন নিকৃষ্ট একটা কাজ করল? লোভের কাছে হার মেনে নিলো? কিভাবে ও একটা খু*নির সাথে দিব্যি ঘুরে বেড়ালো এতদিন? লিজা এখন সবকিছু থেকেই ক্লান্ত হয়ে হার মেনে নিয়েছে। এখন ওকে বাংলাদেশে নিয়ে চলে গেলেও যেন কিছু যায় আসে না। সারাদিন বাসা থেকে বের হয় না। আগে কেন এত পাগল হয়ে থাকতো বাইরে যাওয়ার জন্য তার কোন উত্তর খুঁজে পায় না ও। বাসায় চুপচাপ ঘর অন্ধকার করে নিজের বিছানায় পরে থাকতেও কিছুটা হলেও শান্তি লাগে।
———————–
ঝকঝকে পরিষ্কার নীল আকাশে নিরুদ্দেশ ভেসে যাচ্ছে ধোঁয়া ধোঁয়া শুভ্র মেঘগুলো। গোলগাল নিরুদ্যম সূর্যটা ঠিক মাথার ওপর স্থির দাঁড়িয়ে। তার ঝলমলে উষ্ণ সোনালি রোদ এসে ভারি মনোরোম ভাবে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর বুকটা। তাপমাত্রা ভারি আরামদায়ক। অজানা অচেনা গাছ, ফুল, ঘরবাড়িতে পরশ বুলিয়ে আসা বাতাসে লেগে আছে সতেজতা মাখা মিষ্টি এক মাটি মাটি সুবাস। সে সুবাস নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করে শরীর মনকে স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে দেয়। একটা কালো শিভ্রেলেই স্বাভাবিক গতিতে ছুটে চলেছে লেইপার ফোর্কের ফ্র্যাঙ্কলিন রোড ধরে। ড্রাইভারের সিটে বসে আছে ইভান। পাশেই বসে আছে নিনা। দুপাশের খোলা জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস আসছে। দুপাশেই যতদূর চোখ যায় শুধু ঝকঝকে সবুজ মাঠ, টিলা, গাছ ঝোপঝাড়। এবং কিছু দূর দূর পর নজরকাড়া পুরনো ধাঁচের বাড়িগুলো। ওরা দুজন ন্যাশভিল থেকে চল্লিশ মিনিটের দূরত্বে লেইপার ফোর্কে এসেছে। এটা ছবির মতো সৌন্দর্য মন্ডিত ছিমছাম ছোট একটা গ্রাম। জনসংখ্যা মাত্র সাতশো। ইভান সামনের রাস্তায় দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বলল,
‘তুমি তেমন একটা ঘুরতে বের হওনা তাই না?’
‘উম অনেকটা তাই৷ একা বা সাথে একজন দুজন সঙ্গী নিয়ে ঘুরতে পছন্দ করি না তা নয়। কিন্তু সাধারণত বাসায় থাকতেই বেশি ভালো লাগে।’
‘টিপিক্যাল ইনট্রোভার্টেড ব্যাপার।’ কন্ঠে ক্ষ্ণীণ টিটকারি মিশে ছিল।
‘উহ্ আমার পাক্কা ধারণা এখানে এর আগেও অন্তত পাঁচ বার হলেও এসেছ।’
‘ভুল! সাত বার এসেছি। এবারেরটা নিয়ে আটবার।’ মুচকি হেসে উত্তর দিল ইভান।
‘তুমি তো বাইরেই থাক আর বাসায় ঘুরতে যাও।’ এবার নিনা টিটকারি দিল। ওরা একটা হোটেলের সামনে এসে থামল।
ওপরে মাঝারি আকারের ব্যানারে লাল জ্বলজ্বলে অক্ষরে লেখা “Puckett Bros Market”। জায়গাটা একই সাথে মার্কেট ও হোটেল। তবে ওরা হোটেলের সামনে দাঁড়িয়েছে। সবে মাত্র দুপুর বেলা দেড়টা বাজে। ইভান নিনাকে নামতে নিষেধ করে নিজে প্রথমে নামল। তারপর দ্রুত অপর পাশে গিয়ে নিনার দিকের দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে দিল। নিনা মুচকি হেসে ওর হাতটা নিল। হোটেলটার ভেতরে একদম অন্য রকম একটা পরিবেশ। পুরো হোটেলটা কাঠের তৈরি। লাল, বাদামি বা ডার্ক চকলেট রঙা কাঠের তৈরি আসবাব। কিছু চারকোনা, কিছু গোল টেবিল। ভেতরে বেশ জমজমাট পরিবেশ। এই মুল্লুকের অত্যন্ত সাধারণ দৃশ্য, সকলেই উচ্চস্বরে গল্পগুজব ও হাসি ঠাট্টায় মেতে আছে। ওরা বেশ একটা খালি টেবিল পেয়ে বসে পরল। ইভান নিরবতা ভে*ঙে বলল,
‘আহা আফসোস আমার। তুমি যদি আর কয়েকটা বছর আগেই আমাদের স্কুলে চলে আসতা তাহলে আমার সব সিঙ্গেল এডভেঞ্চারই একেকটা ডেট হত।’
‘দুঃখ দেখে বাঁচি না। তোমার ভাগ্য ভালো যে আমি আগে আগে স্কুলে আসিনি৷ নাহলে আমরা আজীবন ওই শত্রু বনেই বসে থাকতাম। ডেট তো দূরের কথা বন্ধু হওয়াও লাগতো না।’
ওরা অর্ডার করল। কিছুক্ষণ মৌনতা বজায় রেখে আশেপাশটা পরখ করল। কাটা চামচের টুংটাং শব্দ। মৃদুস্বরে ক্রিস স্টেপলনের কোন একট কান্ট্রি মিউজিক বাজছে। যদিও তা বোধহয় আদোওতে মৃদু নয়। মানুষের সোরগোলের মাঝে আওয়াজটা চাপা পরে গিয়েছে।
পুনরায় ইভানই নিরবতা ছিন্ন করে বলল,
‘সেদিন রাতে মানে অক্টোবরের চার তারিখ আমি যখন তোমার বাসায় এসেছিলাম।’ এতটুকু বলে থামল। নিনা ভ্রু জোড়া কুঁচকে কাছাকাছি এলো। ইভান বলে গেল,
‘সত্যি সত্যি বলো তো তুমি ভয় পেয়েছিলা আমাকে দেখে। তাই না?’
‘কোই না তো!’ মুখের বিব্রত ভাবটা ঢাকার চেষ্টা করে বলল।
‘নাহ না। আমি নিশ্চিত তুমি ভয় পেয়েছিলা। আমার হাতে র*ক্ত দেখে নিশ্চয়ই ভেবেছিলা না জানি আমি আবার কাকে খু*ন করে এসেছি।’
নিনা মুখ ভেঙ্গচি দিয়ে হাসল। বলল,
‘আমার দোষ কী? মুখের সামনে অমন ছু*ড়ি ধরে কেউ ডেটের প্রস্তাব দেয় নাকি?’
‘ওয়েল আমি দেই।’ শ্রাগ করে বলল ইভান৷ বলেই টেবিলে রাখা বাটার না*ইফ তুলে নিনার দিকে তাক করল। কিছু গম্ভীরমুখে বলল,
‘এ্যাই মেয়ে আমার সাথে ডেটে যাবা?’
‘নাহ।’ ড্যাম কেয়ার ভাবে উত্তর দিল নিনা।
‘কেন?’
‘কারণ আমরা অলরেডি একটা ডেটেই এসেছি ইভান।’
‘হুম যুক্তিসঙ্গত।’ বলে ছু*ড়িটা নামিয়ে রাখল।
‘ভাগ্যিস আমার হাতে যে ছু*ড়ি ছিল আর সেটা পরেও গিয়েছিল সেটা ও খেয়াল করেনি। নাহলে অবশ্যই অভিমান করত।’ ভাবল নিনা।
তখনই ওদের খারাব দিয়ে যাওয়া হলো। বিফ বার্গার, ফিস ফ্রাই ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। খাওয়া দাওয়া শেষে ওরা হাঁটতে বের হলো। গাড়িটা আরেকটু সামনে এগিয়ে নিয়ে একটা পার্কিং প্লেসে রেখে দিল। বড় চওড়া রাস্তা যেন ইঞ্চি ইঞ্চি ধরে ঘোষে মেঝে পরিষ্কার করা। দুপাশে শুধু সবুজ ঘাসে মোড়া ভূমি। গাছের ছায়ায় ঘাসগুলো গাঢ় সবুজ দেখায়। আবার খোলা স্থানের ঘাসগুলো সোনালী রোদের ছোঁয়ায় হলদে লেবু রঙা দেখায়। কোন অচেনা পাখি সুরেলা কণ্ঠে গান গায়।
হাঁটতে হাঁটতে নিনা বলল,
‘এমন সুন্দর ছবির মতো যানজট বিহীন রাস্তায় সাইকেল চালাতে কিন্তু সেই লাগবে।’
‘ওহ ঠিক বলেছো তো! চলো আমরা সাইকেল চালিয়ে জায়গাটা ঘুরি।’
‘হুম খুব মজা হবে! কিন্তু সাইকেল টা কী আকাশ থেকে টপকাবে মি.দানির?’
‘ডার্লিং তুমি যখন মুখ থেকে কথাটা বের করেছো তখন আকাশ থেকে হলেও সাইকেল যোগার করব।’
নিনা ভ্রু উঁচু করল। ইভান দ্রুত হেঁটে কিছুক্ষণের মাথায় একটা পুরনো দেখতে রেন্টাল সপের সামনে এসে পৌঁছল। নিনার উদ্দেশ্যে বলল,
‘আমরা সাইকেল ভাড়া করব।’
‘ওহ এই তাহলে ব্যবস্থা।’ বলল নিনা। ওরা একটা সাইকেল কয়েক ঘন্টার জন্য ভাড়া নিয়ে বেরিয়ে পরল। ইভান সামনে বসে প্যাডেল ঘোরাচ্ছে। আর নিনা পেছনে বসে আরামসে বাতাস খাচ্ছে। হঠাৎ রাস্তার পাশ দিয়ে জাস্টিন টিম্বারলেক কে হেঁটে যেতে দেখা গেল। ওরা মুহূর্তের মধ্যে তাকে পার করে সামনে এগিয়ে গেল। নিনা অবাক হয়ে বলল,
‘দ্যা হেল এতবছর মিউজিক সিটিতে থেকেও কোন মিউজিশিয়ানের মুখোমুখি হইনি। আর এই সাতশো জনসংখ্যার ছোট্ট গ্রামে এসে জাস্টিন টিম্বারলেক কে পেলাম। সিরিয়াসলি!’
‘সিরিয়াসলি। কারণ এখানে অনেক তারকারাই থাকে। এখানে তারা সাধারণ মানুষের মতো ঘুরে বেড়াতে পারে। সাধারণ জীবনযাপন করতে। আর এখানকার মানুষরাও খুবই সুইট। তারাও সেলিব্রিটিদের দেখে ছুটে গিয়ে হামলে পরে না।’
ওরা কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা আর্ট গ্যালারির সামনে এসে থামল। গ্যালারিটির নাম “David Arms”। ডেভিড আর্মসের চিত্রকর্মই মূলত এখানে প্রদর্শন করা হয়। নিনা সাইকেল থেকে নেমে জিজ্ঞেস করল,
‘তোমার আর্ট ভালো লাগে?’
‘অবশ্যই।’
‘প্রিয় আর্টিস্ট?’
‘ক্যাসপার ডেভিড ফ্রেডেরিক আর পাবলো পিকাসো।’
‘ওয়াহ! ক্যাসপারের ছবিগুলো আমারও ভালো লাগে।’
‘তোমার পছন্দের শিল্পীর নাম তো বললা না।’ গ্যালারির কালো ওক কাঠের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল।
‘ওয়েল স্যালভাদর ডালি, ভ্যান গঘ আর ক্লাউড মনেট।’
‘স্যালভাদর ডালি? হুম সেই!’
নিনা চোখ সরু করে তাকাল। ওরা কাঠের তৈরি গ্যালারিটা বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ঘুরে দেখল। না শুধু ডেভিড আর্মসের চিত্রকর্ম রয়েছে, তার পাশাপাশি সেই সব ছবির আদোলে তৈরি বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্রও কিনতে পাওয়া যাচ্ছে। কাউন্টারের ওপর একটা স্ফিংক্স বিড়াল বসে আছে। এগুলোর গায়ে পশম থাকে না৷ একদম হাড্ডিসার শরীরে লালচে দেখতে চামড়া বেরিয়ে থাকে। নিনা ওটা দেখেই বলল,
‘দেখো, র্যাচেলের বিড়াল মিসেস উইস্কারসনের মতো।’
ইভান একবার বিড়ালের দিকে তাকাল আরেকবার নিনার দিকে। অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
‘ওহ না না। তুমি সিরিয়াসলি ফ্রেন্ডস দেখেছ?’
‘কে না দেখেছে?’
ইভান ভ্রু উঁচু করল। নিনা পুনরায় বলল,
‘ওহ প্লিজ বলো না তুমি ভেবেছ আমি সিটকম দেখতে পারবো না। আমি ফ্রেন্ডস, বিগ ব্যাং থিওরি, দ্যা অফিস, হাও আই মেট ইওর মাদার, গিলমোর গার্লস, গসিপ গার্লস সবই দেখেছি।’
‘অবিশ্বাস! অবশ্য আমার বোঝাই উচিৎ ছিল তোমার মুখ দিয়ে করলার রষ ঝরলেও এদিকে আবার ড্যারি মিল্কের পোকা তুমি। অদ্ভুত কম্বিনেশন স্বাভাবিক।।’
নিনা মুচকি হাসলো। ওরা গ্যালারি ঘোরা শেষে বেরিয়ে পরল আবার সাইকেল নিয়ে। এবার রাস্তার দুপাশে ঘরবাড়ি কম। দুপাশে শুধু খোলা সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ ও গাছপালা। এক জায়গায় ঘাসের মাঝে কয়েক গুচ্ছ ল্যাভেন্ডার ফুল হয়ে থাকতে দেখা গেল। সেটা দেখে ইভান সাইকেল থামাল। ওরা হেঁটে কিছুটা দূরে গেল। ফুলগুলোর কাছে। কড়া ল্যাভেন্ডারের সুবাসে বাতাস ভারি হয়ে আছে। নিনাই আগে আগে কয়েকটা ল্যাভেন্ডার তুলে নিয়ে ইভানের দিকে বাড়িয়ে ধরল। ইভান ভ্রু উঁচু করল। নিনা খেয়াল করল ইভানের ফরসা গালে অত্যন্ত হালকা এক গোলাপি আভা ফুটে উঠেছে। হেসে বলল,
‘ওয়াও! তুমি দেখি ব্লাস করছ? এটা কিভাবে সম্ভব হলো ইভান?’
ইভান লাজুক হাসল। বলল,
‘তুমি আমাকে ফুল দিচ্ছ?’
‘কেন আমি দিতে পারি না? তুমি এত ভাইওলেন্টলি আমার জন্মদিনে স্টকারের মতো আমার বাড়ি বেয়ে উঠে, মাঝরাতে জানালার মধ্যে ফুল রেখে গিয়েছো। সারাদিন স্পাইডার ম্যানের মতো বাড়ির ছাদরের সাথে সিটকে থাকলা।
তার সামনে তো এটা কিছুই না।’
ইভানের ঠোঁটে লজ্জা রাঙা হাসিটা এখনো ঝুলেই রয়েছে। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ ঠাই হলো না। মুহূর্তেই দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
‘গার্লফ্রেন্ড যদি আমার ডার্ক, গথিক, পাগলাটে ধরনের হয় তাহলে তার লেভেলে পৌঁছতে হলে আমাকেও তো সেই ধরনের কাজ করতে হবে। তাই না?’
‘তুমি আমাকে গার্লফ্রেন্ড বলবা না।’ গাঢ় কন্ঠে বলল নিনা।
‘কেন? কী সমস্যা?’
‘আমরা জাস্ট ডেটে এসেছি৷ তুমি আমাকে এখন পর্যন্ত প্রপোজও করোনি৷ তাই আমাকে গার্লফ্রেন্ড বলার অধিকার কিন্তু তোমার নেই।’
‘ওহ আমাকে চ্যালেঞ্জ করছ? ঠিক আছে। দেখো আমি কী করি।’
তখনই কারোও কান্নার শব্দ পাওয়া গেল। সাথে সাথে ওদের দুজনের চোখ চলে গেল রাস্তার দিকে। একটা মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণের মধ্যে অনেক দূর এগিয়ে গেল। তখনই একটা ছেলে ছুটতে ছুটতে এলো। চিৎকার করে বলছে,
‘ম্যান্ডি! থাম।’ বলতে বলতেই সে নিমিষে ওদের সাইকেলে চড়ে বসল। ওরা দুজনই চোখ বড় বড় করে তাকাল। ইভান ততক্ষণাৎ ছুটে গেল কিন্তু ইতোমধ্যেই ছেলেটা বেশ অনেক দূর চলে গিয়েছে। সাইকেল চালাচ্ছে না মোটরসাইকেল। গতি কী! ইভান কিছুদূর ছুটে গিয়ে উচ্চস্বরে বলল,
‘হেই! সাইকেল চোর! ওটা আমাদের। থাম!!’
নিনা দ্রুত পায় রাস্তায় এসে দাঁড়াল। ইভান নিনার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত কন্ঠে বলল,
‘ড্যামিট! এখন কী হবে?’
ইনশাআল্লাহ চলবে।