#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
২০.
“আমায় দাও স্নিগ্ধ এক সকালের ঋণ
বিনিময়ে পাবে গোটা এক আনন্দঘন দিন,
আমায় দাও সকালের একটুখানি প্রশান্তি
বিনিময়ে দিবো মুছে অন্তস্তলের ক্লান্তি।
আমায় দাও সকালের এক ফোঁটা কোমলতা
বিনিময়ে পাবে হৃদয় নিংড়ানো সরলতা,
আমায় দাও সকাল, হলেও তা হ্রস্ব
বিনিময়ে দিবো তোমায় এক মহাবিশ্ব।”
স্নিগ্ধ সকাল, আমার প্রিয় একটা সময়। আমার বহু পুরোনো এক অভ্যাস হচ্ছে, ভোরের আলো ফোটার পর বাড়ির সামনের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করা। কখনও সামনের রাস্তা ধরে পেছনে চলে যাওয়া, কখনও সোজা রাস্তা ধরে বাড়ির অনতিদূরে অবস্থিত নদীর তীরে যাওয়া। নদীর তীরে গিয়ে খালি পায়ে ভেজা তুলতুলে মাটিতে হাঁটা, তারপর নদীর পানিতে পা ধোয়া বা পাড়ের ঢেউয়ের পানিতে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মতো আনন্দ সকালের অন্য কোনো কিছুতেই পাওয়া যায় না। তার সাথে নদীর তীরের মাটির টিলার ওপর দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধ সকালের সূর্যদয় দেখা তো আছেই। পূর্ব আকাশ লালচে আভা ছড়িয়ে সফেদ মেঘের আড়াল থেকে থালার মতো গোলগাল লাল টুকটুকে সূর্যটা উঁকি মা’রে। তারপর ধীরে-ধীরে মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে গোটা ধরণি উত্তপ্ত আলোয় আলোকিত করে তোলে। আহ্, কী মনোরম সে দৃশ্য! নদীর পাশে একটা ইটের ভাটাও আছে। যে ছয় মাস ওটা বন্ধ থাকে, সে সময়টাতে পুরো ইটের ভাটা সবুজ ঘাসের আস্তরনে ঢাকা থাকে। সকালের শিথিল পরিবেশে খালি পায়ে সেই ঘাসের ওপর হাঁটলে মন আপনা-আপনি হেসে ওঠে। এবার বাড়ি আসার পর এমন সকাল উপভোগ করা হয়ে ওঠেনি। অথচ এক সপ্তাহ হয়ে গেছে বাড়ি এসেছি। এই এক সপ্তাহ রোজ সময় কেটেছে এক রুটিনে। সারাদিন পরিবারের সাথে হাসি-খুশি সময় কাটানো, আম্মুর হাতের মজার-মজার সব খাবার খাওয়া আর রাত হলে চুপচাপ বিছানায় পড়ে থাকা। কোথাও ঘোরাঘুরি করারও ইচ্ছে নেই। রাত হলে কোনো এক কারণে মনটা বড্ড উতলা হয়ে থাকে। ফলস্বরূপ সকালটা অলসতা মাখিয়ে ঘুমিয়েই কাটাই। আজকের সকালটাও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ফজরের নামাজের পর সেই যে আবার ঘুমিয়েছিলাম, এখন উঠে দেখি বেলা সাড়ে আটটা। অলস শরীরটাকে টেনেহিঁচড়ে বিছানা থেকে নামিয়ে ফ্রেশ না হয়েই রান্নাঘরে চলে গেলাম। দেখলাম আম্মু সকালের নাস্তা বানাচ্ছে। আমাকে দেখেই হাঁক ছাড়ল,
“অমি, মুখটাও ধুসনি এখনও? যা হাত-মুখ ধুয়ে আয় তাড়াতাড়ি।”
আম্মুর আদেশের দিকে আমার বিশেষ খেয়াল নেই। তখন আমার বিস্মিত দৃষ্টি খাবারের আইটেমের দিকে। সকাল-সকাল এত পদ রান্না করছে কেন? তবে প্রশ্নটা নিয়ে ঘাঁটলাম না। কারণ অনেক দিন পর আমি এলে আম্মু এই কাজটাই করে। আজ সকাল-সকাল করেছে বলেই একটু অবাক হয়েছি। ফ্রেশ হয়ে চুলে চিরুনি চালানোর সময় চোখ গেল শিয়রের পাশে পড়ে থাকা অলস ফোনটার ওপর। গত একটা সপ্তাহ কতশত বার ম্যাসেজ বক্স চেক করেছি। কিন্তু কেবল সিম কোম্পানির ম্যাসেজ ছাড়া বাড়তি একটা ম্যাসজও কারো থেকে আসেনি। রাজ ভাইয়ের বউ নিয়ে পুরো পরিবার শরীয়তপুর এসেছে দুদিন ধরে। আব্বুকে বারবার ফোন করে বলা হয়েছে আমাদের সবাইকে নিয়ে যেন সে সদরে যায়। কিন্তু আব্বুর এক কথা, নতুন বউ নিয়ে আগে আমাদের বাড়ি আসতে হবে। আম্মি আমাকে যেতে বলার পর আমিও এ কথাই বলেছি। এই অছিলায় জেনিফার ভাবি আমাদের বাড়িও চিনতে পারবে, আর মনমতো ঘোরাঘুরিও করতে পারবে। নূর আঙ্কেল বলেছেন আসবেন, তবে কবে আসবেন সেটা অনিশ্চিত। খুব বেশিদিন শরীয়তপুর থাকা হবে না তাদের। হয়তো আগামী সপ্তাহেই ঢাকায় ফিরে যাবেন। আমার একটা বাজে অভ্যাসের মধ্যে একটি হচ্ছে চুল আঁচড়ানোর সময় সারা ঘর হেঁটে বেড়ানো। আজও স্বভাবসুলভ মাথায় চিরুনি চালাতে-চালাতে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। হঠাৎই চোখ গেল ডাইনিং টেবিলের দিকে। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। মাথা থেকে চিরুনি ধরা হাতটা আপন শক্তিতে নেমে পড়ল। সকাল-সকাল এমন শক নেওয়া যায়? এরইমধ্যে আম্মুর ডাক পড়ল।
“কিরে? দাঁড়িয়ে আছিস কেন? চিরুনি রেখে খেতে বোস।”
আমি চিরুনিটা রেখে চুপচাপ আব্বুর পাশের চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। আড়চোখে এদিক-ওদিক দৃষ্টি বিচরণ করতে-করতে রুটি চিবোচ্ছিলাম। হঠাৎ আব্বু কথায়-কথায় বলে উঠল,
“এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আজকের দিনটা থেকে কাল যেয়ো, তাজ।”
আয়েসি ভঙ্গিতে একের পর এক খাবার গলধঃকরন করা তাজ সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। কায়দা করে একবার সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বললেন,
“না আঙ্কেল, আজই যেতে হবে। আমাদের কিছু প্ল্যান প্রোগ্রাম আছে। কাল সকালেই ঢাকায় রওয়ানা হব।”
আম্মু আহাজারি করে উঠল,
“এ কেমন কথা? রাজের বউটা নতুন। আমাদের বাড়িতে একবার আসতেও পারবে না? ভাই তো বলেছিল আসবে।”
“আব্বু বলেছিল, কিন্তু আমাদের প্ল্যানিংয়ের জন্য আসতে পারবে না। তাতে কী হয়েছে আন্টি? পরেরবার এসে না হয় বেশিদিন বেড়াবে।”
আব্বু-আম্মু বড়ো নারাজ হলো। দুজন আহাজারিতে পরিবেশ ভারী করে তুলছে। এদিকে আমার মাথায় এক প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে, এই আপদ কখন এল? আমি টের পেলাম না কেন? একদম সকালে সেই সদর থেকে হাটুরিয়া আসা তো মুখের কথা নয়। তবে এল কীভাবে? আবার বলছে আজই চলে যাবে। কী আজগুবি ব্যাপার-স্যাপার! পরে শুনলাম গতকাল রাতে এসেছে। গতকাল রাতে আমি একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তাই টেরও পাইনি। খাবার টেবিলে আমি প্রয়োজনের বেশি বাক্য ব্যয় করলাম না। একপ্রকার চুপচাপ খাওয়া শেষ করে কে’টে পড়লাম। তাজ ভাইও আব্বুর সাথে বাইরে বেরুল। সকাল এগারোটার দিকে আমি আমাদের বাড়ির সবচেয়ে ছোটো সদস্য তাসবির সাথে দুষ্টুমি করছিলাম। তাসবি আব্বুর চাচাতো ভাইয়ের ছোটো মেয়ে। বাড়ির সবার আদুরে মিষ্টি মেয়ে সে। বয়স মাত্র তিন বছর হলেও তার কথার ধরন ছয় বছরের বাচ্চাদের মতো। অতিরিক্ত দুষ্টু মেয়েটা। সারাদিন সারা বাড়ি দৌড়ানো আর দুষ্টুমি করাই তার প্রধান কাজ। কথাগুলোও মন ভালো করার মতো। আমাকে সে খুব ভালোবাসে। বাড়ির সবাই আমাকে ডাকে ‘অমি’ নামে। তাসবি ‘অমি’ ডাকতে পারে না বলে ‘ইমি’ ডাকে। মিহি সুরে ‘ইমি’ ডাকটা কী যে মিষ্টি লাগে! ওর আর আমার জন্ম তারিখ, মাস একই। তাই সবাই মজা করে বলে এই কারণেই তাসবি আমাকে এত পছন্দ করে। আমি এলেই ও আমার পেছনে ফেভিকল আঠার মতো লেগে থাকে। এই তো এখন আমার রুমের সব ওলট-পালট করে খেলছে। ওর খেলাই হচ্ছে গোছানো ঘর অগোছালো করা। আমি ওকে টেনেটুনে এনে বিছানায় বসালাম। আবার শুরু হলো বালিশ নিয়ে খেলা। খেলার মাঝেই সে ফটাফট সব কথার উত্তর দিচ্ছে। আমি প্রশ্ন করলাম,
“তোমার নাম কী?”
সে সুমিষ্ট সুরে উত্তর দিলো,
“তাবজি।”
“তাবজি না, তাসবি,” সংশোধন করে দিলাম আমি।
“তাবজি।”
যতবারই সংশোধন করে দেই না কেন, ও এই ভুল উচ্চারণই করবে। তাই পরবর্তী প্রশ্ন করলাম,
“তোমার বাবার নাম কী?”
“বাশা উকিল।”
আমি ফিক করে হেসে উঠে বললাম,
“বাশা না, বাশার। আর তোমার আম্মুর নাম?”
“পাব্বিন।”
নাম পারভীন, ওর উচ্চারণ পাব্বিন।
“তোমার ভাইয়ার নাম কী?”
“পঅশ।”
“পঅশ? না কি পরশ?”
“না, পঅশ।”
অর্থাৎ ও যা বলবে তা-ই ঠিক। আমারটাই ভুল। ক্যালেন্ডারে কাঁঠালের ছবি দেখে বলল,
“কাঁতাল।”
“কাঁঠাল? আচ্ছা, বলো তো জ্যাকফ্রুট।”
তাসবি কপাল কুঁচকে তাকিয়ে উচ্চারণ করার চেষ্টা করল,
“ঝ্যাপ্রুত।”
আমি হেসে বললাম,
“বলো জ্যাক?”
সে মাথা দুলিয়ে বলল,
“জ্যাক।”
“ফ্রুট।”
“প্রুট।”
“জ্যাকফ্রুট।”
“ঝ্যাপ্রুত।”
আমি খিলখিল করে হেসে উঠলাম। এরপর যতবারই শব্দটা সঠিকভাবে উচ্চারণ করাতে চাইলাম, ততবারই ও ভুল উচ্চারণ করল। বড়ো শব্দ বলে সম্পূর্ণ উচ্চারণ করতে কষ্ট হয়ে পড়েছে, তবু মেয়েটা চেষ্টা তো করেছে। আমি হাসতে-হাসতে বিছানায় লুটিয়ে পড়েছি দেখে তাসবিও ছোট্ট ঝকঝকে দাঁতগুলো বের করে হাসছে। হাসলে ওর চোখ দুটোও কুঁচকে যায়। হঠাৎ দরজায় দৃষ্টি পড়তেই আমার হাসি কর্পূরের মতো উবে গেল। মুখ বন্ধ করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ভেতরে চলে এল। বিছানার একপাশে বসে তাসবিকে টেনে নিজের কোলো তুলে নিল। কিন্তু তাসবি এই মুহূর্তে কোলে উঠতে নারাজ। সে হাত-পা ছুঁড়ে কোল থেকে নামার চেষ্টা করছে। তাজ ভাই সামলানোর চেষ্টা করতে গিয়ে উলটো তাসবির কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে নাকে ব্যথা পেলেন। মৃদু সুরে ব্যথাতুর শব্দ তুলতেই আমি চমকে উঠলাম। তাসবিও শান্ত হয়ে গেল। হয়তো ভেবেছে তার জন্যই মানুষটা ব্যথা পেয়েছ। তাই তাজ ভাই যে হাত দিয়ে নাক ঘঁষছিলেন, ওই হাতটা ধরে চট করে বলে বসল,
“ছুরি।”
তাজ ভাই অবাক হয়ে বলল,
“এই পুঁচকি, স্যরি মানে বুঝিস তুই?”
তাসবি চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আছে। তাজ ভাই রেগে আছে ভেবে এবার তার গালে একহাত রেখে বলল,
“আবিউ।”
এবার তাজ ভাই আরও অবাক হলেন। আমি আবার হেসে উঠলাম। তাজ ভাই তাসবির থুতনি ধরে বলল,
“আই লাভ ইউ?”
“আবিউ,” পুনরায় বলল তাসবি।
তাজ ভাই ওর নরম গালে চুমু খেয়ে আদর করে দিলেন। আমাকে হাসতে দেখে বলে উঠলেন,
“এত খুশি হওয়ার কী আছে? ওকে এসব তুই শিখিয়েছিস তাহলে? আহহা, বুঝেছি। নিজে বলতে পারছিস না বলে এই পুঁচকিকে কাজে লাগাচ্ছিস। এত কষ্ট করার দরকার ছিল না, নিজেই বলতে পারতি। যদিও আমি পাত্তা দিতাম না।”
আমি হাসি থামিয়ে চোখ সরু করে বললাম,
“নিজেকে এত স্পেশাল ভাবা বন্ধ করুন, তাজ ভাই। কাকি ওকে এসব শিখিয়েছে, আমি নই। আমার ঠেকা পড়েনি। পৃথিবীতে বহু ছেলে আছে।”
তাজ ভাই ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে বললেন,
“তারা সবাই তাজের মতোই ছেলে, কিন্তু কেউ তাজ নয়। স্বীকার করে নে, তাজ দ্য গ্রেট ডিটেকটিভ। যদিও তুই হিং’সুটে, স্বীকার করবি না। তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। নিন্দুকদের মুখে চুনকালি মেখে তাজ সবসময়ই গ্রেট থাকবে।”
“হাহ্, ওভার কনফিডেন্স।”
তাচ্ছিল্যের স্বরে কথাটা বলেই আমি বিছানা ছেড়ে হাঁটা ধরলাম। পেছন থেকে তাজ ভাই বলে উঠলেন,
“তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে নিন ম্যাম। পরে রওয়ানা হওয়ার সময় তাড়াহুড়ো যেন না হয়।”
আমার পা দুটো দরজার কাছেই থমকে গেল। ঘুরে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে বললাম,
“আমি ব্যাগ গুছিয়ে কী করব? আমি কি আপনার সাথে যাব বলেছি?”
“তো আমি কি চেহারা দেখাতে এসেছি? আম্মিই তো পাঠাল তার পালিত মেয়েকে নিতে।”
“কী? মিথ্যে কথা বলছেন আপনি। আমাকে তো কেউ কিছু বলেনি। যাওয়ার কথা তো না-ই।”
“বলতে হবে কেন? তুই নিজেই না কি বলে এসেছিস সবাই এলে তাদের সাথে ফিরবি?”
আমি হোঁচট খেলাম। কথাটা তো তখন অজুহাত হিসেবে বলেছিলাম। আমি আর ওখানে দাঁড়ালাম না। চলে যেতে-যেতে শুধু বললাম,
“আপনি চলে গেলে যান, আমি যাব না।”
রান্নাঘরে গিয়ে আম্মুকে বললাম,
“আমি তাজ ভাইয়ের সাথে যাব না। আরও কয়েকটা দিন থাকব।”
“থাকতে তো না নেই। কিন্তু তখন তোকে দিয়ে আসবে কে? তোর আব্বু তো যেতে পারবে না।”
“আমি কিছু জানি না। আজ আমি যাব না মানে যাব না। আর একটা কথা, এবার গিয়ে আমি নূর আঙ্কেলের বাসায় উঠব না। হয় হলে উঠব, নয় ভাড়া বাসায়। তুমি আব্বুর সাথে কথা বলে এসো। বলবে আমায় যেন কোনো একটা ব্যবস্থা আরে দেয়।”
আম্মু রান্না থামিয়ে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
“হঠাৎ এসব বলছিস কেন? কেউ কিছু বলেছে?”
“কে কী বলবে? আমারই মনে হচ্ছে ওখানে এভাবে মাসের পর মাস পড়ে থাকা ঠিক হচ্ছে না।”
আম্মু সন্দিহান কন্ঠে বলল,
“সত্যি করে বল তো, কে কী বলেছে। আমি নিশ্চিত তুই কিছু লুকাচ্ছিস।”
“ওই বাসার কেউ আমাকে কিচ্ছু বলেনি, আম্মু। তুমি কি জানো না তারা কেমন?”
“তাহলে যেতে চাইছিস না কেন? কোনো সমস্যা থাকলে বল আমাকে।”
“অন্য সমস্যা। ওসবে তারা জড়িত না, তাই পরে বলব। আপাতত তুমি আব্বুকে বলে আমার যাওয়াটা আটকাও আর থাকার ব্যবস্থা করো।”
আম্মু বলে উঠল,
“তুই নিজে গিয়ে কথা বল। হুট করে এমন কথা শুনলে তোর আব্বুও নিশ্চিত সন্দেহ করবে।”
“সন্দেহ করার কী আছে?”
“না করারই বা কী আছে? এখন এই কথা শুনলে যেকেউ সন্দেহ করবে। আসল কারণ জানতে চাইবে। তুই আসল কারণটা না বললে আমি গিয়ে কী বলব তোর আব্বুকে?”
আমি চুপসানো মুখে বললাম,
“সমস্যা আফরা আপুকে নিয়ে।”
আম্মু গোয়েন্দার মতো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
“আফরা, তাজের ফুপাতো বোনটা না? মেয়েটার চালচলন আমার কাছে সুবিধার লাগে না। কী করেছে তোর সাথে?”
আমিও এই পর্যন্ত আমার সাথে আফরা আপুর করা সব দুর্ব্যবহার আর বাজে কথাগুলো গরগর করে বলে দিলাম। পৃথিবীতে এই একটা মানুষটার কাছে এসেই আমি আটকে যাই। কখনও কোনো কথা গোপন রাখতে পারি না। যতক্ষণ না অবধি বলতে পারি, ততক্ষণ পেটের কথা হজম হয় না। আফরা আপুর বি’শ্রী কথা শুনে আম্মুর মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেল। তবে আম্মু বুদ্ধিমান নারী। আগেই আব্বুর সাথে কথা বলল না। কারণ আব্বু বদমেজাজি পুরুষ। মেয়েকে কেউ এমন কুরু’চিপূর্ণ কথা বলেছে শুনলে মাথায় র’ক্ত চড়ে বসবে। তাই আম্মু গেল আগে তাজ ভাইয়ের সাথে কথা বলতে। আমিও পেছন-পেছন গিয়ে দরজার বাইরে থেকে আড়ি পাতলাম। আম্মু ঠান্ডা মাথায় তাজ ভাইকে ব্যাপারটা জানাল। আমি ভেবেছিলাম তাজ ভাই এসব শুনলে রেগে যাবেন। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। উনি স্বাভাবিক গলায় বললেন,
“আমি এসব জানি আন্টি। এই ঘটনার সময় আমি ওখানে ছিলাম না। পরে সৌরভ আমাকে সব বলেছে। সৌরভ তখন সব কথা শুনেছিল। ওর থেকে জানার পর আমি তখনই এসবের সমাধান করেছি।”
আমি অবাক হলাম। সৌরভ ভাইয়া তখন আশেপাশে ছিল তা আমি একদমই জানতাম না। এই লোক কী সমাধান করেছে তা শোনার জন্য কৌতুহলী হয়ে উঠলাম। আম্মু জিজ্ঞেস করল,
“কী সমাধান করেছ? তোমার ফুপা-ফুপুকে জানিয়েছ?”
“আসলে আফরার তো বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। দু-এক মাসের মধ্যেই বিয়ে হয়ে যাবে। এই মুহুর্তে এমন কিছু শুনলে হয়তো আব্বু রেগে যাবে। আমি আসলে চাচ্ছিলাম না যে আব্বুর সাথে ফুপা-ফুপুর মনোমালিন্য হোক। ব্যাপারটা সবাই জানলে আরও খারাপ হয়ে দাঁড়াত। তাই আমি শুধু ভাইয়াকে জানিয়েছিলাম। ভাইয়া আর আমি মিলে আফরার সাথে কথা বলেছি। ধরা পড়ে যাওয়ায় ও আমাদের কাছে ক্ষমাও চেয়েছে। কারণ ফুপা জানলে ওকে-ও ছেড়ে কথা বলবে না। বউ-ভাতের অনুষ্ঠানের পরদিনই আমি ওকে ওর বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। ও কথা দিয়েছে যে ওর বিয়ের আগে আর ও আমাদের বাসায় পা রাখবে না। এখন আপনিই বলুন আন্টি, আমার সমাধান কি ভুল হয়েছে? আপনার যদি মনে হয় ভুল হয়েছে, তাহলে আপনাদের সিদ্ধান্তই মেনে নিবে সবাই। আপনাদের মেয়ের সম্মান আমাদের কাছে কোনোকালেই তুচ্ছ ছিল না।”
আম্মুর প্রত্যুত্তর শোনার অপেক্ষায় রইলাম না আমি। দীর্ঘশ্বাস চেপে সরে পড়লাম। মানসপটে ভাসছে আমার অনুপস্থিতিতে কী অবস্থাই না হয়েছিল ওদিকে। আফরা আপুর ক্ষমা প্রার্থনার ব্যাপারটা ভেবে শান্তিও পেলাম। উচিত শিক্ষা পেয়েছে মেয়েটা। এটারই দরকার ছিল। কিন্তু আমার যাওয়াটা আর আটকাতে পারলাম না। আম্মুর কথায় সেই তাজ ভাইয়ের সাথেই যেতে হলো। আমাদের সাথে গেল আব্বু। আব্বু সবার সাথে দেখা করে আজ রাতেই আবার ফিরে আসবে। তাজ ভাইদের গ্রামের বাড়িতে থাকে শুধু হিমেল কাকার পরিবার আর দাদিমা। নূর আঙ্কেল এলে যখন সবাই এই গ্রামের বাড়িতে একত্রিত হয়, তখন বাড়িটা যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। এবার শুধু ফুপুর পরিবার ছাড়া বাকি সবাই এসেছে। আমি আসার পর থেকে আমার কানের কাছে পুরো গ্যাং মাছির মতো ভনভন করে চলেছে। গ্রামে এসে গত দুদিন ধরে তারা কী করেছে, কোথায় গিয়েছে, কী খেয়েছে সব বিবরণ কানে ঢালছে। এদিকে আমি বড্ড আফসোসে ম’রে যাচ্ছি। সব বিনোদন মিস করে ফেললাম আমি। কেন যে অতিরিক্ত রাগে বাড়ি বসে থাকতে গিয়েছিলাম। এখন এ বাড়িতে শুধু আজ রাতটুকুই আমার কপালে জুটবে। তা-ও আজ রাতটা সবাই ঘুমিয়ে কা’টাবে। কারণ আগামীকাল সকালেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতে হবে। রাজ ভাইকে রাজি করিয়ে সবাই সন্ধ্যাটুকু বাইরে থেকে ঘুরে আসার পরিকল্পনা করছে। এদিকে তাজ ভাইকে দেখে আমি বললাম,
“আপনার কার্ডটা দিন তো তাজ ভাই।”
“কোন মহাবিশ্ব উদ্ধার করতে?”
“আপনি তো ঘুরতে যাবেন না বললেন। আমি ভাবছি শরীয়তপুর পুলিশ লাইনের দিকে ঘুরতে যাব। ভেতরে গিয়ে আপনার কার্ডটা দেখিয়ে একটু আদর-আপ্যায়ন পেলে মন্দ কী? ঘুরতে যাওয়াটা সার্থক হবে আমাদের।”
উনি বিদ্রুপ করে বললেন,
“ওটা তো তোর শশুর বাড়ি, তুই যাবি আর তোকে বউআদর করতে লেগে পড়বে সবাই। তাই না? আর শ্বশুরবাড়িতে উঠলে তো জামাইয়ের পরিচয় অত্যধিক জরুরি। তা, কার্ড দেখিয়ে নিজেকে কার বউ পরিচয় দিবি ঠিক করেছিস?”
আমি বিরক্ত চোখে চেয়ে বললাম,
“লাগবে না আপনার কার্ড। মাফ চাই মাননীয় ডিটেকটিভ সাহেব।”
“ওমা! তুই কেন মাফ চাইছিস? মাফ তো আমার চাওয়া উচিত, তাই না?”
আমি অবাক হয়ে শুধালাম,
“আপনি কিসের মাফ চাইবেন?”
“আমার কারণেই না কি অত বাজে পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল?”
সেই এক কথা। আমি আন্দাজ করেছিলাম ঠিক এই কথাটার কারণেই মহাশয় কটা দিন মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন। লাভ কী হলো? সেই তো আবার নিজেই আগে কথা বলেছে। শুধু-শুধু মাঝের কয়েকটা দিন অসহ্যকর করে তুলেছিল।
“এতদিন পর মাফ চাওয়ার কথা মনে হলো কেন?”
“আমাকে না দূরে থাকতে বলা হয়েছিল?”
“বড়ো বাধ্য ছেলে, হুহ্। দূরে থাকল কই?”
“সেই তো, যত দোষ নন্দ ঘোষ। দূরে থাকার তাড়ায় একেবারে হলে ওঠার পরিকল্পনা, ভাবা যায়!”
“হুঁ, খুব তাড়া।”
উনি সূক্ষ্ম চোখে তাকালেন। হুট করে এসে একদম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একহাতে চুলের মুঠি চেপে ধরলেন। খুব বেশি শক্ত করে না ধরলেও চুলে টান পড়ায় আমি মুখ কুঁচকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। ওই জল’ন্ত চোখে একবারের বেশি চোখ রাখার সাহস করলাম না। উনি চোয়াল শক্ত করে আরেক হাতের দুই আঙুল আমার মাথায় ঠেকিয়ে নিচু স্বরে বললেন,
“খুলি এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিবো ইলুরানি। গানটা কিন্তু লাইসেন্সধারী।”
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।🖤
#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
২১.
ঢাকায় ফেরার দুদিন হলো। কিন্তু এখনও জানতে পারলাম না তাজ ভাই কোন প্ল্যানিংয়ের জন্য এত তাড়াহুড়ো করে সবাইকে নিয়ে এসেছেন। যে জিজ্ঞেস করেছে তাকেই বলেছে সময়মতো বলবে। এরমধ্যে আজ সবাইকে ধরে-বেঁধে জেনিফার ভাবিদের বাসায় নিয়ে এসেছেন রাজ ভাই। কেউ আসতে রাজি ছিল না। জেনিফার ভাবির আত্মীয়-স্বজন যারা বিয়ে উপলক্ষে এসেছিল, তারা সবাই চলে যাবে। সেজন্যই আবার এই আয়োজন। জেনিফার ভাবির কাজিনগুলোকে আমার খুব একটা সুবিধার মনে হয় না। কেমন গায়ে পড়া স্বভাবের মেয়ে! অসভ্য লোকটাও এসে হতে জেসিকা আপুর সাথে সুপার গ্লুর মতো চিপকে আছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এখানে আসতে হয়েছে বলে আমাদের সবার মাঝেই একটা অলস ভাব জেঁকে বসেছে। এসে হতে সবাই এক জায়গায় বসে আছি। রাজ ভাইয়ের শাশুড়ি একের পর এক খাবার সামনে হাজির করছে, সেগুলো সব আদনান ভাইয়া আর জুম্মান ভাইয়ার পেটেই চালান হচ্ছে। হুট করে জেসিকা আপু আর তাজ ভাই প্রস্তাব রাখলেন, সবাই মিলে কোনো গেম খেলা হবে। কেউ আগ্রহ প্রকাশ করল, কেউ নারাজ। দুজন মিলে পরিকল্পনা করে গেম খেলতে এসেছে, হুহ্। এই লোক সুইডেনে সুন্দরী মেয়েদের ভিড়ে যে কী কী অকাজ করে এসেছে, তা নিয়ে মাঝে-মাঝে সন্দেহ হয়। এই তো জেসিকা আপুর সাথে গলায়-গলায় ভাব। অথচ কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলবে, আমরা খুব ভালো ফ্রেন্ড। ফ্রেন্ড না ছাই। কী গেম খেলা হবে, এই নিয়ে সবাই চিন্তায় পড়ে গেল। প্রথমে ঠিক হলো লুডু খেলা হবে। কিন্তু লোকসংখ্যা বেশি, তাই বাদ দেওয়া হলো। তারপর এটা-ওটা করতে-করতে শেষে ঠিক হলো ট্রুথ অ্যান্ড ডেয়ার খেলা হবে। এমনিতেও আমি মনে-মনে ভেবেছিলাম খেলব না। তারমধ্যে এই খেলার নাম শুনেই আমি সঙ্গে-সঙ্গে নাকচ করে দিলাম। জেসিকা আপুর রুমে মেঝেতে চাদর বিছিয়ে সবাই গোল হয়ে বসল। আমি আর আমিরা আপু একদমই নারাজ। আমিরা আপু বলল,
“আর কোনো গেম খুঁজে পান না আপনারা? সবসময় ঘুরেফিরে এক গেম বিরক্ত লাগে।”
তাজ ভাই আমাদের দুজনকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেলেন। খেলা শুরু হলো জেসিকা আপুকে দিয়ে। সে ডেয়ার নিল। তাজ ভাই বলে বসলেন,
“তোমার বয়ফ্রেন্ডের ছবি দেখাও।”
জেসিকা আপু অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল,
“তাজ, হোয়াট ইজ দিস? তুমি সুযোগ বুঝে আমাকে বাঁশ খাওয়ানোর চেষ্টা করছ?”
“এখানকার কেউ তোমাকে বাঁশ খাওয়াবে না। তুমি শুধু তোমার কাজিনদের ম্যানেজ করে নিয়ো।”
“নো ওয়ে। এটা বাদ দাও, অন্য যেকোনো কিছু দাও।”
জেসিকা আপুর এক কাজিন বলে উঠল,
“আপু, আমরা কাউকে বলব না। প্রমিস। তুমি দেখাও না প্লিজ।”
“একদমই না, এক্ষেত্রে আমি কাউকে বিশ্বাস করি না।”
জেসিকা আপুকে অনেক জোরাজুরির পর সে হতাশ ভঙ্গিতে বলল,
“ঠিক আছে, দেখাচ্ছি। কিন্তু কেউ এই খবর বাইরে প্রকাশ করতে পারবে না। আমি আপাতত চাই না আব্বু-আম্মু এসব জানুক।”
সবার সম্মতিতে শেষে জেসিকা আপু তার বয়ফ্রেন্ডের ছবি দেখাল। সঙ্গে-সঙ্গে তার কাজিনদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তাদের প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝলাম ছেলেটা তাদের পরিচিত। জেসিকা আপুর আত্মীয়-স্বজনের মধ্যেই পড়ে। এতক্ষণে বিশ্বাস হলো সত্যিই জেসিকা আপুর বয়ফ্রেন্ড আছে। তবু তাজ সাহেবের সাথে এত খাতির কেন কে জানে? এদিকে আমিরা আপু চাপা স্বরে আনন্দ প্রকাশ করছে।
“উফ্! ভালো হয়েছে এই জেসিকা আপুর বয়ফ্রেন্ড আছে। নইলে নিশ্চিত আমার কলিজা, ফুসফুস নিয়ে টানাহেঁচড়া করত। বাঁচা গেল।”
একে-একে সবাইকে যত অদ্ভুত ট্রুথ, ডেয়ার দেওয়া হচ্ছে। আমার পালা এলে আমি বললাম,
“আমি বারবার বলেছি না আমি খেলব না? আমার এসব ভালো লাগে না। তোমরা খেল, আমাকে বাদ দাও প্লিজ।”
কিন্তু কাউকে সে কথা শুনাতে পারলাম না। সবাই মিলে জোরাজুরি শুরু করল। শেষমেষ বাধ্য হয়ে ট্রুথ নিলাম। এদের উলটা-পালটা ডেয়ার নেওয়া মানে যেচে নিজের পায়ে নিজে কুঠার মা’রা। জেসিকা আপুর এক কাজিন আমায় ট্রুথ দিলো,
“তোমার জীবনের একটা সিক্রেট বলো, যা আজ পর্যন্ত কাউকে বলনি।”
খুঁজতে গিয়ে টের পেলাম, আমার জীবনের সিক্রেট আমি নিজেই জানি না। প্রয়োজনের সময় কোনোকিছুই মনে পড়ে না আরকি। বহুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করার পর একটা কথা মনে পড়ল, কিন্তু তা বলতে ভীষণ দ্বিধা বোধ করলাম। কাঁচুমাচু করে শেষে বলেই ফেললাম।
“কয়েক বছর আগের কাহিনি এটা। আমার এক কাজিনের বিয়ে ছিল। প্রোগ্রাম ছিল রাতে। আমার হঠাৎ খুব পানি পিপাসা পেয়েছিল, কিন্তু পানির গ্লাস খুঁজে পাচ্ছিলাম না। গ্লাস খুঁজতে-খুঁজতে আরেক কাজিনের রুমে ঢুকে পড়েছিলাম। ওই রুমের দরজা ভেজানো ছিল। তো আমি ভেবেছিলাম ভেতরে কেউ নেই। কারণ সবাই কাজে ব্যস্ত। কিন্তু দরজা খুলে হনহনিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে নিজেই আহাম্মক বনে গিয়েছিলাম। ঘরটা অন্ধকার ছিল।”
মিনহা আপু কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করল,
“অন্ধকার ঘরে কে ছিল রে? কোনো হ্যান্ডসাম ছেলে?”
দেখলাম সবাই খুব উৎসুক দৃষ্টি তুলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি রয়েসয়ে বললাম,
“শুধু ছেলে না, মেয়েও ছিল। আসলে আপু আর ভাইয়ার রোমান্সের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলাম আমি। তারা অবশ্য সঙ্গে-সঙ্গে দূরে সরে গিয়েছিল। আমিও নিজেকে সামলে দ্রুত বাইরের আবছা আলোয় টেবিলের দিকে গিয়ে গ্লাস নিয়ে চুপচাপ কে’টে পড়েছিলাম। মাঝখান থেকে তারা ভেবে নিয়েছিল আমি কিছুই দেখিনি। আমি তো সেদিন কানে ধরেছি, এভাবে আর বিবাহিত মানুষজনের রুমে ঢুকব না।”
এই নিয়ে সবাই বেশ মজা পেল। আনহা আপু হুঁ-হা করে হাসতে-হাসতে বলল,
“একদম সঠিক সময়ে অ্যান্ট্রি নিয়েছিস তুই, ইলো। না দেখার ভান করে ভুল করেছিলি। তোর উচিত ছিল খুব অবাক হওয়ার ভান করে কিউট করে জিজ্ঞেস করা, অ্যাই, তোমরা কী করছ।”
হাসাহাসির মধ্যে জুম্মান ভাইয়া বলে উঠলেন,
“এই ইলো, তারা কি চুমু-টুমু খাচ্ছিল?”
আদনান ভাইয়া তাকে থা’প্পর মে’রে বললেন,
“তা-ও শুনতে হবে তোর? অশ্লীল পোলা-মাইয়াগুলা।”
তাজ ভাই বললেন,
“এই জেসি, ভাইয়া আর ভাবিকে সাবধান করে দিয়ো তো। এই মেয়ে আবার কখন তাদের রোমান্সে এলাচি হয়ে ঢুকে পড়ে, তার তো ঠিক নেই। বলা তো যায় না, পুরোনো অভ্যাস পুনরাবৃত্তি হয়েও যেতে পারে।”
আমি উত্তর দিলাম,
“এমন হলে তো আমি আপনার রোমান্সেও ঢুকে পড়তে পারি।”
উনি বেহায়ার মতো উলটো বলে দিলেন,
“নো প্রবলেম। ছোটোদের জন্য আমি এটুকু দয়ালু হতেই পারি। বাচ্চাদেরও তো শিখতে হবে। বড়োরা না শেখালে বাচ্চারা শিখবে কীভাবে? আমার থেকে যদি শেখে, তাহলে সমস্যা কোথায়? তুই চাইলে বাসর রাতেও আমার রুমে ঢুকে যেতে পারিস।”
জুম্মান ভাইয়ারা হৈ-হৈ করে উঠল। যেন এখনই তারা সবাই তাজ সাহেবের বাসর ঘরে ঢুকে পড়েছে। অনেক হৈ-চৈ করে আবার শুরু হলো গেম। সৌরভ ভাইয়াকে জোর করে ডেয়ার দেওয়া হলো, এখন থেকে ঠিক চব্বিশ ঘন্টা তার জন্য ফোন নিষিদ্ধ। এই চব্বিশ ঘন্টা তার ফোন থাকবে জুম্মান ভাইয়ার কাছে। সময় শেষ হলে আবার ফেরত দেওয়া হবে। সৌরভ ভাইয়া এমন অবিচার হজম করতে পারল না। ফোন দিতে সে কোনোভাবেই রাজি না। ওটা হচ্ছে তার প্রাণভোমরা। কিন্তু এতগুলো মানুষের সাথে পেরেও উঠল না। অবশেষে অসহায় বালকের মতো কাঁদো কাঁদো মুখ করে ফোনটা জুম্মান ভাইয়ার হাতে তুলে দিলো। জুম্মান ভাইয়া তো ইদের চেয়েও বেশি খুশি হলো। সৌরভ ভাইয়ার মুখটা দেখেই সে মজা নিচ্ছে। তাজ ভাইকে ট্রুথ দিতে চাইলে উনি নাকচ করে দিলেন। কিছুতেই ট্রুথ নিবে না সে। চো’রের মন পুলিশ-পুলিশ। তাকে কোন ধাঁচের প্রশ্ন করা হবে তা সে খুব ভালোভাবেই জানে। সেজন্যই ইচ্ছে করে ব্যাপারটা থেকে নিস্তার পেতে চাইছে। পরে তাকে ডেয়ারই দেওয়া হলো। আদনান ভাইয়া রুমে একটা ব্যাট পেয়ে সেটা তাজ ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“আমি ছাড়া এদের মধ্যে যার মাথা ফাটাতে মন চায়, ফাটিয়ে দে। তোর জন্য দারুণ সুযোগ।”
আদনান ভাইয়া মজা করে ডেয়ারটা দিয়েছে বলে সবাই না, না করে উঠল। তাজ ভাই নিজেও না করলেন। আদনান ভাইয়া বললেন,
“আরে ভাই, এত সিরিয়াস হওয়ার কী আছে? তোকে কেউ পু’লিশে দিবে না, চাকরিও খাবে না। ইটস্ জাস্ট ফর ফান। মাথায় না হলে পিঠে মে’রে দিবি।”
জেসিকা আপুর কাজিন বলল,
“আপনি নিজে কে’টে পড়ে আমাদের ফাঁসালে তো চলবে না। এটা চিটিং।”
আদনান ভাইয়া তাজ ভাইয়ের থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে বলল,
“ঠিক আছে, আমিও আছি। বেয়াইন সাহেবার মর্জি কবুল।”
তাজ ভাই ব্যাটটাকে যেভাবে ঘুরাচ্ছেন, মনে হচ্ছে সে ক্রিকেট খেলতে নেমেছে। এক্ষুনি কারো মাথাটা বল বানিয়ে ছক্কা মে’রে দিবে। সবাই সন্দিহান, ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে। তাজ ভাই হেঁটে-হেঁটে যেদিকেই যাচ্ছে, সেদিকেই একেকজন চোখ বন্ধ করে জড়োসড়ো হয়ে অনুরোধ করছে। জুম্মান ভাইয়ার কাছে গিয়ে ব্যাট উঁচু করতেই সে দুহাত তুলে চেঁচিয়ে উঠল,
“ব্রো, ব্রো, ব্রো। মাফ চাই, দয়া করো। তোমাকে রোজ দুই টাকার চকলেট খাওয়াব, প্রমিস।”
কিন্তু তাজ ভাই মজা করে ব্যাট উঁচু করেছিলেন। এবার সবার সামনে থেকে সরে পেছনে ঘুরছিলেন উনি। কখন যেন দুম করে তাল ফেলেন কারো পিঠে। আতঙ্কে কেউ পেছন ফিরেও তাকাচ্ছে না। আদনান ভাইয়া তাড়া দিচ্ছেন। প্রায় দুই মিনিট পর হুট করে ব্যাটটা আমার পিঠেই পড়ল। শব্দ শুনেই আমি মুখ চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠলাম। আমার চেঁচানো শুনে বাকিরাও চমকে উঠল। কিন্তু যখন আতঙ্ক কে’টে গেল, তখন খেয়াল হলো ব্যাটটা আমার পিঠে পড়লেও, ব্যথাটা আসলে আমি পাইনি। ব্যাট আমার পিঠে লাগার আগেই একটা শক্ত হাত আমার পিঠে ঠেকেছিল। হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়ালাম। চারদিক থেকে সবাই চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করছে আমার বেশি ব্যথা লেগেছে কি না। অথচ ওই মানুষটা নির্বিকার ভঙ্গিতে এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাটটা এখনও হাতে ঘুরাচ্ছে। যেন কিছুই হয়নি। বিমর্ষ মুখটা সামলানোর চেষ্টা করে আমি সবাইকে জানালাম, তেমন ব্যথা পাইনি। তাজ ভাই বললেন,
“আরে রিল্যাক্স গাইস। আমি এত নির্দয় না কি? বাচ্চা মানুষ তো, দয়া করে আস্তে মে’রেছি। জোরে মা’রলে তো এতক্ষণে ফ্লোরে গড়াগড়ি খেয়ে কেঁদে নাকের পানি, চোখের পানি এক করত।”
সবাই বিশ্বাস করে নিল তাজ ভাই আস্তে মে’রেছেন। দুপুরের খাবারের পর একটা সময় সুযোগ পেয়ে ওনার হাত পরীক্ষা করলাম। উনি বাঁধা দিলেন না, চুপ করে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসলেন। আমি কপাল কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে বললাম,
“হাসছেন কোন সুখে?”
“ব্যথা তো পাইনি, কাঁদব কোন দুঃখে?”
“এতগুলো মানুষের মাঝে আপনি আমাকেই চোখে দেখলেন? কেন? জেসিকা আপুর মাথায় মা’রতে পারলেন না?”
“তুই হিং’সুটে বলেই তোকে মে’রেছি। মাথায় মা’রলে ঠিক হত। মাথা থেকে সব ভূ’ত নেমে যেত।”
“তো নিজের হাতে মা’রলেন কোন দুঃখে?”
“আমি যে দয়ার সাগর, সেই সুখে। তোর কোনো সমস্যা? না কি মাথায় বাড়ি খেতে চাইছিস? এখন দিবো? শর্ত হচ্ছে, অজ্ঞান হলে কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়।”
আমি শক্ত মুখে বললাম,
“আপনি না ডিটেকটিভ হয়ে ভুল করেছেন। আপনার উচিত ছিল গ্যাংস্টার হওয়া। ওই পেশাই আপনার জন্য পারফেক্ট ছিল।”
সারাদিনে যতটা সময় ওই বাসায় ছিলাম, একদমই ভালো সময় কা’টেনি। বাসায় ফিরলাম সন্ধ্যায়। ফ্রেশ হয়ে যখন বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, তখন একটা ম্যাসেজ এল। সঙ্গে-সঙ্গেই সেটা অন করলাম।
মনোহারিণী,
কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যদি পাপ না হত, আজ তোমায় মা’রার এক পার্সেন্ট চান্সও যদি থাকত; তবে আমি সেটা কাজে লাগাতাম। সব ব্যথা চুকিয়ে নিতাম। অতঃপর এই নশ্বর পৃথিবীর এক ভয়ানক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি ছিনিয়ে নিতাম। কিন্তু আমি তো এত তাড়াতাড়ি শ্বাসকষ্টে ভুগতে চাই না। নেহাত আমার বেঁচে থাকার তাগিদ আছে, সুস্থ শ্বাসকার্যের প্রয়োজন আছে, তাই তো এক জীবন্ত যন্ত্রণাকে অতি যত্নে অন্তস্তলে জিইয়ে রেখেছি।
ম্যাসেজটা বার কয়েক পড়ে ফোনটা রেখে দিলাম। অনেকটা সময় বিছানায় পড়ে রইলাম, কিন্তু ঘুম এল না। তারপর বিছানা ছেড়ে চলে গেলাম বিপরীত দিকের রুমটার দিকে। দরজার নব ঘুরিয়ে একটু ফাঁক করে ভেতরে উঁকি দিলাম। ডাকলাম,
“শুনুন?”
উনি বই ঘাঁটছিলেন। ডাক শুনে মাথা তুলে তাকালেন। আমি পুনরায় বললাম,
“ট্রুথ, ডেয়ার গেমে আর কখনও আমায় টানবেন না। গেমটা আমার ভালো লাগে না।”
উনি ত্যাড়াভাবে উত্তর দিলেন,
“আমি খুব পছন্দ করি। তাই সবসময় সবাইকেই টানব। তোর পছন্দ না হলে তুই দূরে গিয়ে ম’র।”
আমি কিঞ্চিত রাগত স্বরে বললাম,
“হ্যাঁ, পছন্দ তো হবেই। আমাকে যত অপমান তো এই ফালতু গেমটার জন্যই করার সুযোগ পেয়েছিলেন। অযথা কেন ওমন করেছিলেন, সেটা পর্যন্ত বলেননি আজও। আপনি ইচ্ছে করে সুযোগ কেন নিয়েছিলেন, এবার জানতে পারি?”
উনি বই রেখে এগিয়ে এলেন। দরজা ধরে মাথা ঝুঁকে বললেন,
“তোর বয়ফ্রেন্ডের ভাগ্য সুপ্রসন্ন করার জন্য দয়া করেছিলাম।”
তারপর ঠাস করে মুখের ওপর দরজা আটকে ফেললেন। আমার রাগ বেড়ে গেল। দরজায় জোরেশোরে থা’প্পর মে’রে গজগজ করতে-করতে সরে গেলাম। রাতেই তাজ ভাই ঘোষণা দিলেন তার প্ল্যান হচ্ছে সবাইকে নিয়ে একটা ট্যুরে যাওয়া। এই অছিলায় রাজ ভাই আর জেনিফার ভাবির ছোটোখাটো একটা হানিমুনও হয়ে যাবে। যদিও কদিন পরেই তারা বাহিরের দেশে হানিমুনে যাবে। কিন্তু এই ট্যুরটা তাজ ভাইয়ের তরফ থেকে। ঘোষণা শুনে সবাই আনন্দে নেচে উঠল। কিন্তু তারপরই উনি জানালেন আগামীকাল সকালেই রওয়ানা হবেন। আজ রাতের মধ্যে যেন সবাই যার-যার ব্যাগপত্র গুছিয়ে নেয়। এটা শুনে একেকজনের মাথায় হাত পড়ল। আমিরা আপু দুঃখ প্রকাশ করল, আগে জানলে সে কেনাকাটা করে রাখত। রাতে ঘুম বাদ দিয়ে ব্যাগপত্র গোছাতে হবে ভেবেই আমার কাঁদতে বসে পড়তে ইচ্ছে করল। ট্যুরে যাওয়ার কথা শুনে সবার মাঝে চাপা উত্তেজনা আর আনন্দের সাথে ব্যাগ গোছানোর অলসতাও দারুণভাবে জেঁকে বসেছে। তার ওপর আবার কাল সবাইকে খুব সকালে উঠতে হবে। সব মিলিয়ে আমাদের মাথা ঘোরার জোগাড় হলো। দ্য গ্রেট তাজ সাহেবের প্ল্যান বলে কথা! এটুকু ধাক্কা তো খেতেই হবে। না হলে এই ট্যুর হজম হবে না কি?
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।