#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
২৪.
আমরা যখন সোনাদিয়ার মাটিতে পা রাখলাম, তখন সূর্য ঠিক মাথার ওপর। ট্রলার থেকে নামতে গিয়ে সবার পা কাঁদায় মাখামাখি হয়ে গেল। কাঁদা পার হয়ে পা ধুয়ে তবেই সোনাদিয়ার সবুজ ঘাসে পা ফেললাম। এরমধ্যে আবার কাঁদা মাটির মধ্য থেকে আমিরা আপুর পায়ে ছোটো শামুক ফুটে গেল। খুব বেশি ব্যথা না পেলেও একটুখানি র’ক্তক্ষ’রণ হলো। আপু ঠোঁট উলটে বলল,
“দ্বীপে পা রাখতে না রাখতেই বি’পদ। ধুর!”
জুম্মান ভাইয়া আমিরা আপুর পায়ের র’ক্ত মুছে ঔষধ লাগিয়ে দিলেন। এখানটায় কোনো জনবসতি চোখে পড়ছে না। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে শুধু ঝাউবনের সমারোহ। এ যেন সবুজের ছড়াছড়ি। আমিরা আপুর জন্য আমাদের কিছু সময় খোলা মাঠে বসতে হলো। তৃণলতার ওপর আমরা আরাম করে বসে পড়লাম। এই দুপুরে ঝাউবনের বাতাসে একরাশ প্রশান্তি খুঁজে পেলাম। জনশূন্য নির্জন সবুজ মাঠে আমরা দশ জন মানব। মনে হচ্ছে আমরা হারিয়ে গিয়ে কোনো এক অচেনা দ্বীপে ঢুকে পড়েছি। এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি নিয়ে আমাদের সামনে এগোতে হবে। কারণ সামনে কী আছে তা এখনও আমাদের কারো-কারো কাছে অজানা। সবার ব্যাগপত্র তুলে নিয়ে দীর্ঘ ঝাউবন পেরিয়ে সামনে এগিয়ে চললাম। সোনাদিয়া দ্বীপ দুটো পাড়ায় বিভক্ত। একটা পূর্ব পাড়া, আরেকটা পশ্চিম পাড়া। পূর্ব পাড়ায় জনবসতি বেশি। তাই খাওয়ার ব্যবস্থার জন্য পূর্ব পাড়া ভালো। তবে ঘোরাঘুরি এবং ক্যাম্পিংয়ের জন্য পশ্চিম পাড়া বেশি নিরাপদ। পূর্ব পাড়ার স্থানীয় এক লোককে দিয়ে আগে থেকে দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা ছিল। সর্বপ্রথম আমরা সেই লোকের বাড়িতেই উঠলাম। এখানকার বাড়িগুলো দেখতে কেমন কুঁড়েঘরের মতো। প্রায় সকল বাড়ির সামনেই শুঁটকি মাছের ছড়াছড়ি। কড়া রোদে বিভিন্ন রকমের শুঁটকি শুকানো হচ্ছে। এই দ্বীপ শুঁটকির জন্য বেশ বিখ্যাত। বাংলাদেশে শুঁটকি উৎপাদনের জন্য সোনাদিয়া দ্বীপ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। বাড়িওয়ালাকে বেশ হাস্যোজ্জ্বল মনে হলো। খুব বিনয়ের সাথে আমাদের ভেতরে নিয়ে বসালেন। ওনারা খাবারের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। আমরা টিউবওয়েলের ঠান্ডা পানিতে হাত-মুখ ধুয়েই খেতে বসে গেলাম। সবার পেটেই দারুণ ক্ষুধা। ভাতের সাথে মুরগির ঝোল আর শুঁটকি রান্না করা হয়েছে। বেশ তৃপ্তি নিয়েই আমরা খাওয়া সম্পূর্ণ করলাম। বাড়িওয়ালা এবং তার স্ত্রীর আচরণ বেশ। হাসিমুখে সবার সাথে কথা বলছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কয়েকজন বাদে আমরা অনেকেই এদের ভাষা বুঝতে পারছি না। এরা কথা বলে চাটগাঁইয়া ভাষায়। যা আমি এক লাইনও বুঝতে সক্ষম হচ্ছি না। ফাহিম ভাইয়ার বাসায়ও আমাকে এই সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। ওনার মায়ের কোনো কথাই আমি বুঝতে পারিনি। কোথাও গিয়ে সেখানকার মানুষের ভাষা বুঝতে না পারার মতো অস্বস্তিকর ব্যাপার আর দ্বিতীয়টি নেই। বাড়িওয়ালা যখন তাজ ভাইদের সাথে এই দ্বীপের ব্যাপারে কথা বলছিলেন, তখন আমি তাজ ভাইকে খোঁচা মে’রে ফিসফিসিয়ে শুধালাম,
“লোকটা কী বলছে?”
“লোকটা বলছে ওনার বউয়ের না কি তোকে খুব পছন্দ হয়েছে। ওদের ছেলের জন্য রেখে দিতে চায়।”
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
“আজাইরা কথা।”
“বিশ্বাস না হলে তুই জিজ্ঞেস করে দেখ। ওহ্, তুই তো মূর্খ। ভাষা বুঝিস না।”
“আমি এই ভাষা বুঝে কী করব? আমার নিজের ভাষা বুঝলেই হলো।”
“এইজন্যই ভাবছি তোকে রেখে যাব। এদের সাথে থাকলে ভাষা শিখে যাবি।”
“দাঁত ভাঙার শখ নেই আমার।”
একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম সোনাদিয়ার বুকে। পূর্ব পাড়া ডিঙিয়ে এবার পশ্চিম পাড়ায় যেতে হবে। তখন সূর্যের তেজ খানিকটা শিথিল হয়ে এসেছে। নির্জন দ্বীপটা সম্পূর্ণ বালিয়াড়িতে পূর্ণ। চারদিকে ধূ-ধূ বালুচর। কোথাও বালির ছোট্ট টিলাও নজরে পড়ল। বালিয়াড়ির বুকে মাঝে-মাঝেই আবার সবুজ ঘাসের ছোঁয়া পাওয়া যায়। চারদিকে নাম না জানা বিভিন্ন ধরনের গাছ। এরমধ্যে শুধু গুটিকয়েক নারকেল গাছ আর ক্যাকটাস চিনতে পারলাম। বন্য ফুল গাছও দেখা গেল, কিন্তু আমার এসবের নাম জানা নেই। নারকেল গাছে নানান রঙের বাহারি পাখি বসে আছে। কিছু সংখ্যক আবার সমুদ্রের পাড়ে হাঁটাহাঁটি করছে। সাগর লতায় মুড়ানো বালিয়াড়িতে হাঁটতে গিয়ে সবার পা বালিতে মাখামাখি হয়ে গেছে। দু-এক জন চাষী ছাড়া এখানেও কাউকে নজরে পড়ল না। সবুজ ঝাউবনের পাশেই বালিয়াড়ির মধ্যে আমাদের তাঁবু খাটানো হলো। কক্সবাজার থেকেই তাঁবুর সকল সরঞ্জাম কিনে আনা হয়েছিল। কক্সবাজার থেকে উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত এই সোনাদিয়া সম্পূর্ণ নিরিবিলি একটি দ্বীপ। একে বিচ্ছিন্ন দ্বীপও বলা চলে। বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে মাত্র নয় কিলোমিটার আয়তন নিয়ে এ দ্বীপটি গড়ে উঠেছে। এখানে না আছে পর্যটকদের জন্য বিশেষ কোনো থাকার জায়গা, আর না আছে খাওয়ার ব্যবস্থা। হয় স্থানীয়দের বলে তাদের বাড়িতে খেতে হয়, নয়তো নিজেরাই ব্যবস্থা করে নিতে হয়। থাকার ব্যবস্থাও একইভাবে করতে হয়। এসব ক্ষেত্রে স্থানীয়দের কিছু টাকা-পয়সা দিতে হয়। আবার কতৃপক্ষের সাথে কথা বলে সেখানকার বন বিভাগের অফিসেও রাত্রিযাপন করা যায়। তবে কারো বাড়িতে থাকার চেয়ে তাঁবু খাটিয়ে থাকাটাই বেশি উপভোগ্য। কারণ সোনাদিয়ার আসল সৌন্দর্য রাতেই খুঁজে পাওয়া যায়। তার ওপর যদি হয় জ্যোৎস্না রাত। তাহলে তো কথাই নেই। নিঃসন্দেহে এই নির্জন দ্বীপ যেকোনো পর্যটকদের মন মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ করতে সক্ষম। একদিনে সম্পূর্ণ দ্বীপ ঘুরে দেখা সম্ভব নয়। তাই তাজ ভাই আগে থেকে সম্পূর্ণ পরিকল্পনা করে হাতে দুদিন সময় নিয়ে এই দ্বীপ ঘোরাঘুরি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছেন। তাঁবু খাটানো শেষ হওয়ার আগেই আমরা কয়েকজন নেমে পড়লাম সমুদ্রে। এতটা পথ ভ্রমণের পর এখন গোসলটা খুব জরুরী। সাগরের বুকে নেমে মনে হলো নীলের রাজ্যে হারিয়ে গেছি। মাথার ওপর নীল আকাশ, নিচে নীল সমুদ্র। দুটোই সুবিশাল। যতদূর চোখ যায় শুধু নীল রঙের রাজত্ব। এ যেন আকাশ আর সমুদ্রের পার্থক্য করা দায়। মাঝে আবার কিছু সামুদ্রিক পাখি উড়ে চলে যাচ্ছে। ওদের দেখলে কয়েক মুহূর্তের জন্য নিজেরও পাখি হওয়ার ইচ্ছে জাগে ব্যাকুল মনে। তাহলে আর পানিতে ডুবে যাওয়ার কোনো ভয় থাকত না, আর না এই তীরে বসে সৌন্দর্য উপভোগ করতে হত। পাখি হলে উড়ে চলে যাওয়া যেত ওই সমুদ্রের মাঝে, নীল আকাশের বুকে। আহ্! ব্যাপারটা কী অদ্ভুত সুন্দর হত! সোনাদিয়ার সাগরের স্বচ্ছ নোনা পানির শীতলতা মনকে তরতাজা করার জন্য যথেষ্ট। একেকটা ঢেউ এসে তীরে আছড়ে পড়ার দৃশ্যটাও নজরকাড়া। দু-একটা জেলে নৌকা ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে সমুদ্রের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে। আমাদের পুরো টিম রীতিমতো ঝাঁপাঝাঁপি শুরু করে দিয়েছে। সবাই যেন নিজেদের হারানো শৈশবে ফিরে গেছে। তীরে বসে আমরা মরা শামুক কুড়িয়ে ভেজা বালিতে উদ্ভট সব আঁকিবুঁকি করলাম। রা’ক্ষসী ঢেউ এসে আবার সব আঁকিবুঁকি ভাসিয়ে নিয়ে গেল। রাজ ভাই আর জেনিফার ভাবি দল থেকে আলাদা হয়ে হাঁটু অবধি পানিতে বসে ছবি তুলছেন। তাদের দেখে জুম্মান ভাইয়া চেঁচানো গলায় সুর তুললেন,
ভাই যখন বউ নিয়া
আমার চোখের সামনে দিয়া,
রঙ্গ কইরা সেলফি নেয়
ফাইট্টা যায়, বুকটা ফাইট্টা যায়।
জুম্মান ভাইয়ার গান শুনে আমরা হাসতে-হাসতে একজন আরেকজনের গায়ে পড়লাম। শ্রেয়ান ভাইয়া বাহবা জানালেন,
“তোমার ফাটা বাঁশের মতো গলায় এটা জোস ছিল ভাই। আমাদেরও একই গান গাওয়া দরকার।”
রাজ ভাই হাসলেন। জুম্মান ভাইয়ার দিকে পানি ছুঁড়ে মে’রে বললেন,
“তাজ আর আদনানকে স্কিপ করে তুই কাজ সেরে ফেল। না করেছে কে?”
“তোমার কাকা আমার বাপে মানবে মনে করছ? ঘরে বউ তুলতে গিয়ে পরে দেখা যাবে আমি নিজেই ঘরছাড়া হয়ে গেছি। নিজেই যদি ঘরে থাকতে না পারি, তো বউ ঘরে সাজিয়ে রাখব কার জন্য?”
তাজ ভাই বললেন,
“চিন্তা কিসের? আমি আছি তো। তোর বদলে এন্ট্রি নিয়ে নিব।”
জুম্মান ভাইয়া মুখ কুঁচকে, নাক সিঁটকে বললেন,
“ছেহ্! তুমি ভাসুর হয়ে এই আশা করছ?”
“আশা করছি কখন বললাম? তোর চিন্তা দূর করে উপকার করলাম।”
“ধন্য হলাম ব্রো। এমন উপকার পাওয়ার চেয়ে আজীবন সিঙ্গেল থাকব।”
মাঝখান থেকে শ্রেয়ান ভাইয়া বলে উঠলেন,
“বউ নিয়ে যারা দুশ্চিন্তায় আছো, তাদের জন্য আমি আছি। সোজা আমার কাছে ট্রান্সফার করে দিবে। আমি আবার দয়ালু মানুষ। ভাবি আপনাকে কিন্তু বাদ দিয়ে বলেছি। কিছু মনে নিয়েন না। রাজ ভাইয়ের বউ হিসেবে আপনিও আমাদের মুরব্বি।”
জেনিফার ভাবি মৃদু শব্দ তুলে হেসে বলল,
“তোমরা পারোও বটে! ফা’জিলের দল।”
দারুণ উচ্ছাসে আমাদের কতটা সময় কে’টে গেল হিসেব নেই। হুট করে খেয়াল করলাম তাজ সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমার সাথে চোখাচোখি হতেই চোখের ইশারায় উঠে যেতে বললেন। আমি মোটেও তোয়াক্কা করলাম না। এত আনন্দ রেখে আমি উঠতে যাব কেন? পরপর দুইবার উনি একইভাবে ইশারা করলেন। তারপর আর আমি ওনার দিকে তাকালামই না। কিছুক্ষণ পর উনি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“চলো এবার ওঠা যাক।”
আনহা আপু আপত্তি জানাল,
“এখনই? আরেকটু পর উঠি। রোজ-রোজ তো আর সমুদ্রে গোসল করব না।”
“সবাই কি ঠান্ডা সইতে পারে? পরে কারো সর্দি লেগে গেলে তাকে আরও এক ঘন্টা যাবত সমুদ্রে চু’বাব। ঘুরতে এসে অসুস্থ হওয়ার সাধ মিটিয়ে দিবো।”
আমি কপাল কুঁচকে ফেললাম। এসব ইঙ্গিতে আমার ওপর ঝাড়া হলো। পরে আদনান ভাইয়াও বললেন,
“বিকেল কিন্তু হয়ে গেছে। আমাদের এদিক-ওদিক ঘুরতেও হবে। চল উঠে পড়ি। নইলে সময় নষ্ট হবে।”
তার কথায় সম্মত হয়ে সবাই উঠে পড়লাম। ভেজা কাপড় পালটে আমরা তাঁবুতে বসে কিছু সময় অবসর নিলাম। তারপর সবাই বেরিয়ে পড়লাম দ্বীপের পেছনের দিক ঘুরে দেখতে। পায়ে হেঁটে চারদিকের অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্যপট দেখতে-দেখতে এগিয়ে চললাম। খুব একটা জনমানব চোখে না পড়ায় নিজেকে কেমন এই দ্বীপের রানি মনে হয়। এ যেন একার রাজত্ব। দ্বীপের পেছন দিকে গিয়ে দেখলাম সেখানে অনেকটা জায়গা ঘের দিয়ে লবন উৎপাদন হচ্ছে। এই জায়গাটাকে বলা হয় লবনের মাঠ। লবন উৎপাদন এই প্রথম দেখা। এই দ্বীপের মানুষের উপার্জনের প্রধান উৎসই হচ্ছে লবন চাষ আর মাছ ধরা। লবনের বিশাল একটি অংশ এই দ্বীপে উৎপাদন হয়। নোনা পানিতে ঘেরা এই দ্বীপে তেমন খাদ্য শস্য উৎপাদন সম্ভব হয় না। উৎপাদনের পরিমাণ খুবই স্বল্প। তার মধ্যে তরমুজ উৎপাদন হয় বছরের বারো মাস, অর্থাৎ সারা বছর। এক চাষির সাথে কথা বলে আমাদের তরমুজ খাওয়ার ব্যবস্থা হলো। তরমুজ জিনিসটা আমার কোনোকালেই খুব একটা ভালো লাগে না। সবার থেকে কম খেলাম আমি। তাজ ভাইয়েরা একেকজন পেট পুরে তরমুজ খেলেন। আমি বললাম,
“এসব পেট পুরে খাওয়ার জিনিস?”
তাজ ভাই শ্লেষের সুরে বললেন,
“নাহ্, কাঁদা মাটি দিয়ে বানানো চকোলেট পেট পুরে খাওয়ার জিনিস।”
“আপনাকে বলেছে কাঁদা মাটি দিয়ে বানায়?”
“ডিটেকটিভ হয়েছি আর এসব জানব না?”
“ঘোড়ার ডিম জানেন।”
“হুঁ, তা-ও জানি। আমি তো তোর মতো মাথামোটা না।”
শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,
“কী আশ্চর্য! তোরা ঝগড়া করছিস কেন?”
“নারী জাতির তো এটাই স্বভাব। কেউ সঠিক বুঝাতে গেলে তার গোষ্ঠী উদ্ধার করে নিজে ওপরে থাকবে। নইলে ভাব, তরমুজের মতো এত মজার একটা ফল কেন ভালো লাগবে না? তুই বুঝাতে গেলে দেখবি তোরও দোষ হয়ে গেছে,” প্রতিবাদ করে বলে উঠলেন তাজ ভাই।
আমি বললাম,
“এটাকে বুঝানো বলে? উচ্চারণ করবেন ক, আর বলবেন কলকাতা বানান শিখিয়েছি? আপনার মতো ঝগড়াটে লোককে গোয়েন্দা বিভাগে চাকরি দিলো কে?”
“আমার শ্বশুর দিয়েছে। কেন, তুই জানতি না? আমার শ্বশুরের বাচ্চার ঘট তো ফাঁকা, তাই তার ঘটের বুদ্ধির অনুসন্ধান করতে আমাকে ডিটেকটিভ বানিয়ে দিয়েছে।”
শ্রেয়ান ভাইয়া বলে উঠলেন,
“আজ একটা শ্বশুরের অভাবে ডিটেকটিভ হতে পারলাম না।”
আমি কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলাম না। এই গ্যাংয়ের সামনে মুখ খুললেই বিপদ। সোনাদিয়ার বিকেলের মনোরম দৃশ্য আমাদের প্রত্যেকের মন ফুরফুরে করে ছাড়ল। তবে আমরা উদগ্রীব হয়ে আছি সন্ধ্যা থেকে রাতের দৃশ্য উপভোগের জন্য। সারা বিকেল ঘুরেফিরে আমরা গোধূলি লগ্নের আগমুহূর্তে সাগরের পাড়ে ফিরলাম। সাগরের বুকে সূর্যের ডুব দেখতে হবে। সবাই বসে পড়লাম সাগর পাড়ে। সূর্যের চিকচিকে আলোক রশ্মি সমুদ্রের বুক থেকে ধীরে-ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। নীল আকাশ রূপান্তরিত হলো লালচে আভায়। সেই আভা ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত আকাশসহ সমুদ্রের স্বচ্ছ পানিতে। সারি-সারি সাদা বক উড়ে যেতে লাগল আকাশ আর সমুদ্রের মাঝ দিয়ে। তারা ফিরছে তাদের আপন নীড়ে। দুচোখে মুগ্ধতা নিয়ে আমরা গোধূলির অপরূপ সাজ দেখলাম। কী অদ্ভুত সুন্দর সব দৃশ্য! এ যেন রূপকথার জগত। লাল টুকটুকে সূর্যটা ঘোমটা টেনে লজ্জাবতী বধূর মতো ধীরে-ধীরে সমুদ্রের বুকে ডুব দিলো। সূর্যাস্তের পর নেমে এল সাঁঝের বেলা। তবে ঘুটঘুটে অন্ধকারের বদলে আকাশে উঁকি দিলো থালার মতো গোল চাঁদ। সঙ্গে নিয়ে এল এক ঝাঁক তারা। চাঁদের চারপাশে তারারা মেলা বসাল। চাঁদমামা আকাশে বসে চারদিক আলোকিত করে তুলল। আমরা তখন রাতের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে লেগে পড়লাম। সর্বপ্রথম ক্যাম্পিং ফায়ার, তারপর বারবিকিউ পার্টির আয়োজন। দুপুরে যে লোকের বাসায় খাওয়া-দাওয়া করেছিলাম, উনিই আমাদের চারটা মুরগির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বাদবাকি সবকিছু আমরা সংগ্রহ করেই এসেছি। সমুদ্রের তীরে বারবিকিউ। আহ্, কী আনন্দ! বালি খুঁড়ে গর্ত করা হলো। পাশের ঝাউবন থেকে শুকনো ডালপালা কুড়িয়ে এনে আগুন ধরানো হলো। আগুন জ্বা’লাতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হলো। তাজ ভাই, আদনান ভাইয়া আর জুম্মান ভাইয়ার চোখে ধোঁয়া গিয়ে একাকার। আমরা পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। রাতেরবেলা বলে তাঁবুতে চশমা রেখে এসেছি। এদিকে ধোঁয়া চোখে লাগতেই আমার চোখে জ্বা’লাপো’ড়া শুঊ হলো। আমি চোখ ঘঁষতেই তাজ ভাই ধমকে উঠলেন,
“এখান থেকে সরবি, না চোখ যেটুকু আছে তারও বারোটা বাজাবি? কানার গোষ্ঠী।”
কোনোরকমে আগুন জ্বে’লে মুরগি বসানো হলো। তারপর শুরু হলো আগুন নিয়ন্ত্রণে রাখার পালা। মুরগি সিদ্ধ হতে বেশ সময় লাগল। এরমধ্যে আমরা বসে-বসে গল্পগুজব করলাম। একেকজনের কৌতুক মাখা কথায় হাসতে-হাসতে পেটে খিল ধরার জোগাড়। নির্জন দ্বীপে দশজনের হাসির আওয়াজ যেন চারপাশে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল। বহুকষ্টের বারবিকিউ দেখতে খুব একটা সুবিধার না হলেও, তেমন খারাপও হয়নি। খোলা মাঠে গোল হয়ে বসেই আমরা পেটপূজা করলাম। মাথার ওপরে খোলা আকাশে চাঁদ, তারার বিচরণ। নিচে ক্যাম্পিং ফায়ার আর চাঁদের আলোয় বসে আমাদের ভোজন বিলাস। খাওয়ার সাথে দারুণ এক আড্ডা হলো। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমরা এদিক-ওদিক হাঁটছিলাম। তখন হঠাৎ শ্রেয়ান ভাইয়া সবাইকে ডেকে বললেন,
“গাইস, এদিকে এসো। আমি কিছু বলতে চাই।”
তার কথা শুনে উৎসুক হয়ে সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়ে দাঁড়াল। তাজ ভাই বললেন,
“এত আড্ডার পরও তোর পেটে আবার কোন কথা বাকি পড়ে রইল?”
“বলছি ভাই। দাঁড়া না।”
তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে শ্রেয়ান ভাইয়া পকেট হাতড়ে একটা রিং বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে বসলেন,
“আই লাভ ইউ ইলোমিলো। উইল ইউ ম্যারি মি?”
কয়েকটা ব’জ্র যেন একসঙ্গে আমার মাথায় আছড়ে পড়ল। কয়েক মুহূর্তের জন্য পুরোদস্তুর হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। স্তব্ধ দৃষ্টিতে সকলের হৈ-হৈ দেখলাম। সবাই তাড়া দেখিয়ে বলছে,
“ইলো, হ্যাঁ বলে দে। বললেই কি এখনই বিয়ে করতে হবে? পরে করে নিবি। তুই তো লাকি। চান্স মিস করিস না। আঙ্কেলের ভয়ে না করিস না আবার। শ্রেয়ান ভাইয়ার কথা শুনলে খুশি হবে রে ভীতুর ডিম। হ্যাঁ বল, হ্যাঁ বল।”
আমি চোখ তুলে শ্রেয়ান ভাইয়ার ঠিক পেছনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে তাকালাম। মনে হলো সে আমার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে হাসল। শ্রেয়ান ভাইয়া উৎসুক দৃষ্টিতে উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছেন। সবার তাড়ায় জল ঢেলে দিয়ে আমি মৃদু স্বরে বললাম,
“সরি ভাইয়া। আমার পক্ষে এটা সম্ভব না।”
সঙ্গে-সঙ্গে সবাই চুপ মে’রে গেল। শ্রেয়ান ভাইয়া আ’হত মুখে বললেন,
“কেন? তোমার কোনো প্রবলেম আছে? তাহলে বলতে পারো।”
বাকি সবারও একই প্রশ্ন। আমি কোনোমতে বললাম,
“এখন আমি এসব নিয়ে ভাবতে চাই না।”
ওখানে আর দাঁড়ালাম না। আর না ঝুপ করে শান্ত হওয়া মানুষটার দিকে তাকালাম। সোজা তাঁবুতে ফিরে এলাম। আমি ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যে প্রায় সবাই ফিরে এল। আমাদের দশজনের জন্য তাঁবু খাটানো হয়েছে ছয়টি। আমার সাথে ঘুমাতে এল আমিরা আপু। ততক্ষণে আমি শুয়ে পড়েছি। সে এসে বলল,
“এটা কী হলো বল তো?”
আমি বুঝেও উলটো প্রশ্ন করলাম,
“কোনটা?”
“কোনটা আবার? শ্রেয়ান ভাইয়াকে রিজেক্ট করলি কোন দুঃখে? সে যথেষ্ট যোগ্য ছেলে।”
“যোগ্যতা নিয়ে আমি কিছু বলেছি না কি?”
“তাহলে? শ্রেয়ান ভাইয়া দেখতেও হ্যান্ডসাম। তোর সাথে মানাবে। আঙ্কেলের না মানার কোনো চান্সই নেই। তাহলে তোর কী সমস্যা?”
“বলেছি তো আমি এসব নিয়ে ভাবতে চাই না।”
“ধুর! এতদিন ভাবিসনি তো কী হয়েছে? এখন ভাববি। তোর মাথায় যে বুদ্ধিসুদ্ধি কবে হবে মাবুদ জানে। গাধা একটা। তাজ ভাই সাধে তোকে বলদ বলে না।”
আমি মৃদু হেসে বললাম,
“তাহলে আরেকটা বলদ খুঁজে নিয়েই বিয়ে করব। এটা ভালো হবে না?”
“ধুর! আকাইম্মা পোলাপাইন।”
আমিরা আপু প্রচণ্ড বিরক্ত। তাই তার সাথে কথা বাড়ালাম না। ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম। আমিরা আপু শোয়ামাত্রই ঘুমে বেহুঁশ হয়ে গেল। আমার চোখে সহজে ঘুম ধরা দিলো না। ঘুমেরা আজ লুকোচুরি খেলছে। অনেকক্ষণ অবধি এপাশ-ওপাশ করে সারাদিনের রোমাঞ্চকর সব অনুভূতি স্মরণ করলাম। রাত দেড়টার দিকে চোখ লেগে এল। কিন্তু কাঁচা ঘুমের বারোটা বাজাল ফোনের রিংটোন। বিরক্ত হয়ে ফোন তুলে দেখলাম তাজ ভাইয়ের মিসড কল। ভ্রুকুটি করে কিছু একটা ভেবে শোয়া থেকে উঠে বসলাম। সতর্ক দৃষ্টিতে আমিরা আপুর দিকে তাকালাম। তার ঘুম বেশ কড়া। সহজে ঘুম ভাঙবে না। তার ওপর আজ সারাদিন হাঁটাহাঁটি করেছে। ফোনটা হাতে তুলে আমি নিঃশব্দে তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলাম। ক্যাম্পিং ফায়ার নিভে গেছে বহু আগে। বাইরে বেরোতেই ঝকঝকে চাঁদের আলো এসে সারা গায়ে আছড়ে পড়ল। ভরপুর জোৎস্না রাতেও এই নির্জন পরিবেশে কেমন গা ছমছম করে উঠল। দুরুদুরু বুকে আমি সামনে পা বাড়ালাম। দূর থেকেই দেখতে পেলাম সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে থাকা এক অবয়ব। দ্রুত গতিতে পা ফেলে আমি এগিয়ে গিয়ে অবয়বটির পাশে দাঁড়ালাম। কিন্তু তার মাঝে কোনো হেলদোল দেখা গেল না। নীরব চোখে সমুদ্রের বড়ো ঢেউয়ের ভীড়ে তার দৃষ্টি যেন কোনো গুপ্তধন খুঁজে বেড়াচ্ছে। মাথার ওপরের চাঁদটার আলোক রশ্মি সমুদ্রের পানিতেও পড়েছে। প্রত্যেকটা ঢেউ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বড়ো মনোরম পরিবেশ। মনে হচ্ছে অপরূপ সুন্দর এক রাজ্যে দাঁড়িয়ে আছি। এ রাজ্যের কানায়-কানায় শুধুই মুগ্ধতার ছড়াছড়ি। বড়ো-বড়ো ঢেউগুলো বিকট শব্দে গর্জন করে ছুটে এসে কূলে আছড়ে পড়ছে। নাম না জানা কোনো এক পাখি কাছে কোথাও ডেকে চলেছে। অদ্ভুত তার সুর। অন্য সময় হলে ভয় লাগত। এই মুহূর্তে ভয় আমাকে স্পর্শ করতে পারল না। পাশে যেন অদ্ভুত এক মনোবল দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘ সময়ের নীরবতা ভেঙে উনি আপন মনে মৃদু শব্দে গেয়ে উঠলেন,
তুমি কখনও আমায় ভালোবাসোনি,
আমি ফিরে এসেছি
তুমি ফিরে আসোনি।
সীমানা ছাড়িয়ে, কেন দূরে দাঁড়িয়ে?
আজ দেখছ আমায়
কেন এমন করে?
প্রবল ঢেউয়ের তান্ডবের সাথে এই সুর কেমন বুকের ভেতর কাঁপন ধরাল। আমি একটুখানি কাছে সরে দাঁড়ালাম। কোনো এক জাদুবলে আমার হাত দুটো পাশের বলিষ্ঠ বাহুটাকে আঁকড়ে ধরল। অতঃপর কাঁধের একটু নিচে মাথা ঠেকিয়ে সমুদ্রের তোলপাড় দেখতে-দেখতে আনমনে বললাম,
“এত-এত অভিযোগ তো আমি মেনে নিব না। কেউ যেচে য’ন্ত্রণা বাড়ালে আমার কী করার? আজীবন আমি দর্শকই থেকে গেলাম। পরিচালক যা ইচ্ছে বুঝিয়ে দিবে, আর আমি তা-ই বিশ্বাস করব।”
প্রত্যুত্তরে উনি মৃদু শব্দে হাসলেন। রয়েসয়ে জবাব দিলেন,
“ভাগ্যিস পরিচালক তার বন্ধুর জীবনের সাথে জড়িয়ে দিতে চায়নি।”
খোঁচা মা’রা হলো বুঝি? চোখ তুলে ওনার মুখের দিকে তাকালাম। চাঁদের এই মায়া বুঝি ওই মুখটাতেও ভর করেছে। আমি ওই মায়ায় জড়াতে গিয়েও চাপা অভিমান নিয়ে সরে দাঁড়ালাম। পরমুহূর্তেই উনি আমার ডান হাতটা মুঠোয় আবদ্ধ করে সামনে পা বাড়ালেন। অগত্যা আমিও এগিয়ে গেলাম। সমুদ্রে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এবার উনি মুখোমুখি দাঁড়ালেন। মুঠোবন্দী হাতটা তুলে ধরলেন। হুট করেই ডান হাত দিয়ে আমার অনামিকা আঙুলে কিছু একটা পরিয়ে দিলেন। আমি চকিতে আঙুলের দিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকালাম। ছোট্ট একটা লতানো ঘাসফুলে মোড়ানো রিং। চকচকে দৃষ্টি তুলে তাকাতেই দুটো গভীর চোখে ধরা পড়ে গেলাম। উনি মাথা তুলে একবার আকাশের চাঁদটা দেখলেন। অতঃপর আমার মুখে শান্ত দৃষ্টি নিবদ্ধ করে কেমন নমনীয় স্বরে আওড়ালেন,
“আমৃত্যু ব্যক্তিগত মানুষের ব্যক্তিগত চাঁদ হয়ে থাকো ইলুরানি। আকাশের চাঁদেরও যেন হিং’সা হয়।”
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।
#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
২৫.
ভোরবেলায় আমরা সবাই ঘুম থেকে উঠে তাঁবু ছেড়ে সমুদ্র সৈকতে ছুটলাম। তখনও সূর্য ওঠেনি, তবে পূর্ব আকাশে সূর্যোদয়ের প্রস্তুতি চলছে। আকাশটা এখনও ধূসর রঙে সেজে আছে। চারদিকে আধো আলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো সূর্যোদয়ের সাথে গোটা পৃথিবী আলোকিত হবে। পাশের ঝাউবন আপন ছন্দে দুলে সকালের পরিবেশে শীতলতা ছড়াচ্ছে। শীতল হাওয়া এসে আমাদের শরীরে লাগছে। উচ্ছল সমুদ্রটা একদম শান্ত, যেন চঞ্চলা ঝুপ করে শান্ত হয়ে পড়েছে। শুধু মাঝে-মাঝে মৃদুমন্দ ঢেউ উঠছে। জুতা খুলে রেখে আমরা খালি পায়ে বালুকাময় সৈকতে হাঁটাহাঁটি করতে লাগলাম। তীরে অসংখ্য মরা শামুক পড়ে আছে। তার সাথে আছে ঝিনুক আর নুড়ি পাথর। আমরা সেখান থেকে কিছু কুড়ালাম। কিছুক্ষণ পরেই পূর্ব আকাশে লালচে আভা দেখা গেল। আমরা দারুণ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। ধীরে-ধীরে লালচে আভা গাঢ় থেকে প্রগাঢ় হতে লাগল। গোটা ধূসর আকাশ নানান রঙে সেজে উঠল। পূর্ব আকাশে সূর্যটা ঘোমটা তুলে উঁকি দিলো। যেন সমুদ্রের অপর প্রান্ত থেকে মস্ত বড়ো এক গোলাকার লাল বৃত্ত আকাশে উড়ে যাচ্ছে। এরইমধ্যে ডান দিক থেকে এক ঝাঁক পাখি উড়তে-উড়তে বাঁ দিকে চলে গেল। বোধ হয় তারাও আমাদের মতো সূর্যোদয় উপভোগ করতে নেমেছে। আমি চোখ বন্ধ করে এই স্নিগ্ধ সকালের মনোরম পরিবেশটা অনুভব করলাম। জুম্মান ভাইয়া ক্যামেরায় ছবি টুকে নিচ্ছে আর বকছে,
“এমন অসাধারণ পরিবেশে যদি পাশে বউই না থাকে, তাহলে কী লাভ এসব উপভোগ করে? সিঙ্গেলদের জন্য এসব পানসে।”
সৌরভ ভাইয়া উত্তর দিলেন,
“সিঙ্গেলদের জন্য না, বলো যাদের মাথায় বউয়ের ভূত থাকে তাদের জন্য পানসে। আমরা তো ভীষণ এনজয় করছি। সমস্যা তোমার একার।”
“তুই চুপ কর জলহস্তী। তোকে জিজ্ঞেস করেছি? তোর আবার বউ লাগে? ফোনটার সাথেই তুই সারাজীবন কা’টিয়ে দিবি।”
“হুঁ, উচিত কথা বললেই আমার ফোনের পেছনে লাগো।”
“ত্যাড়ামি না করে রাজ ভাইকে জিজ্ঞেস কর। তার কিন্তু এখন ইচ্ছে করছে খেয়ে না খেয়ে আজীবন এই দ্বীপে পড়ে থাকতে। কারণ তার পাশে একটা সুন্দরী বউ আছে। জিজ্ঞেস কর, জিজ্ঞেস কর।”
বালুকাময় সৈকতে আরও এক চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের সাক্ষী হলাম। তা হচ্ছে লাল কাঁকড়া। সূর্য উঠতেই সারা সৈকত জুড়ে লাল কাঁকড়ার বিচরণ শুরু হয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে সমুদ্র সৈকত জুড়ে কেউ নিজ হাতে লাল টুকটুকে ফুল ছড়িয়ে দিয়েছে। অদ্ভুত সুন্দর এই লাল কাঁকড়ার বিচরণ সকালের সৈকতটা আরও বেশি মুগ্ধতায় ভরিয়ে দিয়েছে। আনহা আপু একটা কাঁকড়া তুলে জুম্মান ভাইয়ার গায়ে ছেড়ে দিলো। জুম্মান ভাইয়া লাফিয়ে উঠল। আনহা আপু দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“বাচাল লোকদের এভাবেই থামাতে হয়।”
জুম্মান ভাইয়া তেড়ে এসে দুটো কাঁকড়া তুলে ছেড়ে দিলেন আনহা আপুর মাথায়। আনহা আপুও তার মতো লাফিয়ে উঠল। জুম্মান ভাইয়া হেসে বলল,
“নে, এবার সুন্দর করে নাচ। এই আমি গান ধরলাম।
ভালো কইরা জ্বালাও গো কাঁকড়া, সুন্দরী কমলা নাচে।”
পূর্ব পাড়া থেকে এক পাল মহিষ সমুদ্রের তীর ঘেঁষে পশ্চিম পাড়ার দিকে যেতে দেখা গেল। এই দ্বীপে বা’ঘ, হরিণের বদলে মহিষের বিচরণ দেখা যায়। সারারাত সমুদ্রের মাঝে বিচরণ করা জেলে নৌকাগুলো তীর ঘেঁষে ফিরে যাচ্ছে। তাদের থেকে বড়ো কয়েকটা মাছ রাখল রাজ ভাই। ফ্রেশ হয়ে সবাই লেগে পড়ল মাছগুলো দিয়ে বারবিকিউ করতে। মাছের আঁশ ছাড়িয়ে ভালোভাবে ধুয়ে তাতে মসলা মাখানো হলো। শুকনো ডালপালা কুড়িয়ে এনে গতকালের করা গর্তেই আবার আগুন জ্বা’লিয়ে মাছ বসানো হলো। কেমন অ্যাডভেঞ্চার ধরণের অনুভূতি কাজ করছে। মনে হচ্ছে এই অচেনা দ্বীপে নিজেদের খাবার নিজেদেরকেই জোগাড় করে নিতে হয়। সমুদ্রের পানি তখন সূর্যের রশ্মি পড়ে চিকচিক করছে। আমরা বিচ্ছিন্নভাবে এদিক-ওদিক হাঁটছিলাম। আমি কিছুটা দূরের ফুলে ভর্তি গাছগুলোর দিকে এগিয়ে গেলাম। কত সুন্দর রঙিন ফুল! এই গোটা দ্বীপটাই এক আস্ত সৌন্দর্যের চাদরে ঢাকা। সবকিছুতেই সৌন্দর্যের ছোঁয়া। আমি ফুলগুলো ছুঁয়ে দেখলাম। ফোনে কয়েকটা ছবি তুলে রাখতে লেগে পড়লাম। পেছনে শ্রেয়ান ভাইয়া কখন এসে দাঁড়িয়েছে টেরই পাইনি। হুট করে সে বলে উঠল,
“ফুলগুলো খুব সুন্দর, তাই না?”
আমি ফিরে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হেসে মাথা ঝাঁকালাম। উনি এগিয়ে এসে হাতের ক্যামেরায় একটা ছবি দেখিয়ে বললেন,
“ফুলগুলো তোমার মতো সুন্দর ইলোমিলো। ছবিটা দেখো, এক ফুল অন্য ফুলের ছবি তুলছে। মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।”
আমি যখন মনোযোগ দিয়ে ফুলগুলোর ছবি তুলেছিলাম, তখন হয়তো উনি এসে ছবিটা তুলে ফেলেছেন। ছবিটা আমার ভীষণ পছন্দ হলেও, ওনার সব কথাতেই কেমন ইতস্তত বোধ করলাম। বারবার গতকালের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। এতদিন ধরে ওনাকে সিনিয়র হিসেবে বেশ লাগত। বন্ধুসুলভ মানসিকতা ওনার। ওনার সাথে কথা বলতে বেশ লাগত। কিন্তু ওনার মনে যে অন্যকিছু ছিল, তা বিন্দুমাত্র আঁচ করা যায়নি। কেন জানি আমার মনে হলো তাজ ভাই আঁচ করেছিলেন। এ কারণেই হয়তো উনি শ্রেয়ান ভাইয়ার ধারেকাছে গেলে খেপে যেতেন। শ্রেয়ান ভাইয়া ফুলগুলোর দিকে ক্যামেরা তাক করে বললেন,
“আমাকে যে তুমি এতটা অপছন্দ করো, তা তো জানতাম না ইলোমিলো।”
“এসব কী বলছেন ভাইয়া? অপছন্দ কেন করব?”
“তাহলে আমি মানুষ হিসেবে খারাপ, না দেখতে খারাপ?”
“কোনোটাই না।”
“তবে রিজেক্ট করার কারণ?”
আমি চুপ মে’রে গেলাম। ওনার সামনে থেকে সরে যেতে পারলে ভালো হত। কিন্তু এতে হয়তো উনি মনে-মনে অসন্তুষ্ট হবেন। একপ্রকার বাধ্য হয়ে আমি মুখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি ফিরে তাকিয়ে বললেন,
“আমি তোমার কাছে কৈফিয়ত চাইছি না। তোমাকে দেখার পর থেকেই আমি নিজের জন্য তোমাকে পছন্দ করেছিলাম। আর তোমার সাথে আমার বন্ধুত্বও তৈরি হয়েছে, তাই ভেবেছিলাম তুমি হয়তো আমাকে ফিরিয়ে দিবে না। সেজন্য জানতে ইচ্ছে করছে কেন ফিরিয়ে দিলে। আচ্ছা তুমি সময় নিয়ে একটু ভেবে দেখবে? আমাকে যতদিন বলবে ততদিন অপেক্ষা করব।”
“না ভাইয়া।”
“কেন? কোনো সমস্যা হলে বলো আমাকে। তোমার ফ্যামিলি নিয়ে কোনো সমস্যা থাকলে সেটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। না কি তোমার নিজের কোনো পছন্দ আছে?”
এ কোন বিপদে পড়লাম রে বাবা! না পারছি ভালোভাবে কথার উত্তর দিতে, না পারছি চলে যেতে। মহাবিপদ থেকে উদ্ধার করতেই আবির্ভাব ঘটল তাজ ভাইয়ের। এদিকে আসতে-আসতে অদূর থেকেই শ্রেয়ান ভাইয়াকে বললেন,
“চিপায় কী কাজ ভায়া?”
শ্রেয়ান ভাইয়া এগিয়ে যেতে-যেতে বললেন,
“আর চিপা! খোলা মাঠেই কাজ হয় না।”
তাজ ভাই মৃদু হেসে বললেন,
“এসব ব’লদের বংশধর দিয়ে তোর কাজ নেই। আই থিংক ন্যান্সি ইজ বেটার ফর ইউ।”
“তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড? কোথায় যাকে পছন্দ করেছি তাকে পটিয়ে দিবি, তা না করে বিদেশিনী সাজেস্ট করছিস। পারলে একজনকে পটিয়ে দে।”
বকতে-বকতে শ্রেয়ান ভাইয়া চলে গেল। তাজ ভাই আমার কাছে এগিয়ে এসে হাসিমুখে বললেন,
“বলদ, গাধাও দেখছি আজকাল সেলিব্রিটি হয়ে যাচ্ছে। চারদিকে প্রেমিকের আনাগোনা।”
আমি উত্তর দিলাম,
“উঠতে-বসতে যে সুন্দরী মেয়েদের পটিয়ে পা’গল করে ফেলে, সে বাদে অন্য কারো আবার সেলিব্রিটি হওয়ার উপায় আছে?”
“তোদের মেয়ে জাতিটাই পা’গল। আমার মতো হ্যান্ডসাম ছেলে দেখেছে তো সেখানেই কুপোকাত।”
বলতে-বলতে উনি সামনের দিকে হাঁটা ধরলেন। আমি পিছু নিয়ে প্রতিবাদ করলাম,
“আপনাদের পুরুষ জাতি খুব সাধু বুঝি? যত সুন্দরী মেয়েদের দেখে, তাদের সবই লাগে। আর আপনার মতো পুরুষদের জন্য সবাই কুপোকাত হয় না। আপনাদের তো ব্যক্তিত্বের চেয়ে ওভার কনফিডেন্স বেশি।”
“আমার মতো পুরুষের ওভার কনফিডেন্সেরও ক্ষমতা আছে। কারণ আমি তোর মতো মাথামোটা নই।”
“ঘোড়ার ডিম আছে। নিজেকে মহাজ্ঞানী ভাবে,” মুখ বাঁকিয়ে বললাম আমি।
“প্রমাণ চাই?”
আমি ভ্রুকুটি করে বললাম,
“এই ফাঁকা দ্বীপে আপনার সুন্দরী রমণীরা নেই। তাই প্রমাণ দেখাতে চেয়েও লাভ নেই।”
“দ্য গ্রেট ডিটেকটিভ আহনাফ তাজওয়ারের মুখের কথা প্রমাণ করার জন্য এই ফাঁকা দ্বীপও যথেষ্ট।”
“দিন-দিন আপনার চাপাবাজির মাত্রা আকাশ ছুঁয়ে চলেছে। এত চাপাবাজি টিকিয়ে রাখা মুশকিল দ্য গ্রেট ডিটেকটিভ সাহেব।”
কথাটা বলার সাথে-সাথেই উনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। তার সঙ্গে আমিও থামলাম। কিন্তু হুট করেই এমন এক কান্ড ঘটে গেল যে, আমি কয়েক মূহুর্তের জন্য পুরোদস্তুর আহাম্মক বনে গেলাম। উনি ঘুরে দাঁড়িয়েই চোখের পলকে আমার দুই বাহু ধরে কাছে টেনে দাঁড় করালেন। কয়েক ইঞ্চির দূরত্বে আমি রুদ্ধশ্বাসে বিস্মিত দৃষ্টিতে ওনার চোখের দিকে তাকালাম। উনি পলকহীন গভীর চোখে তাকিয়ে কেমন মোলায়েম গলায় বললেন,
“শ্রেয়ানকে রিজেক্ট করলে কার জন্য ইলুপাখি? দ্য গ্রেট ডিটেকটিভ সাহেবের জন্য, যে তোমার চোখে আজন্মের দোষী?”
আমি কোনোমতে ঠোঁট নেড়ে বললাম,
“কে বলল?”
উনি ঠোঁট এলিয়ে হাসলেন। আরও কিছুটা ঝুঁকে পড়ে ফিসফিসিয়ে বললেন,
“ভালোবাসারা।”
আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বাঁ হাতটা আমার ডান গালে রাখলেন। কনিষ্ঠ আঙুলে আলতো করে ছুঁয়ে দিলেন ডান গালের তিল। অন্যরকম এক অনুভূতিতে আমি শিউরে উঠলাম। শুষ্ক কন্ঠনালি দিয়ে অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলাম,
“সরুন।”
উনি এবার দুহাতে আমার মুখ তুলে ধরলেন। চোখে চোখ রেখে মৃদু স্বরে বললেন,
“ইলুপাখি, আমি তোমায়-”
উনি থেমে যেতেই আমি উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। শেষ শব্দটা শোনার জন্য ভেতরটা বড্ড অস্থির হয়ে উঠল। অস্থিরতায় আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যাচ্ছে। উনি আগেরবারের চেয়েও অধিক চমকে দিয়ে হঠাৎ আমার মাথায় সজোরে এক গাট্টা মে’রে বলে উঠলেন,
“আমি তোমায় এভাবেই কুপোকাত করলাম। দেখলি তো আমার ওভার কনফিডেন্সের কেমন ক্ষমতা?”
আমি যেন এর চেয়ে বড়ো ছ্যাঁ’কা আগে খাইনি। অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকাতেই উনি হুঁ-হা করে হাসতে শুরু করলেন। হাসতে-হাসতে বললেন,
“তোর এই এক্সপ্রেশনটা দারুণ। এভাবেই দাঁড়া, একটা ছবি তুলে রাখি। পরে যখনই তাজকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবি, তখনই এই মুহূর্তের কথা মনে পড়বে।”
উনি ফোন বের করতেই আমার রাগ আকাশ ছুঁল। ঘুরে দাঁড়িয়ে উলটো পথে হাঁটা দিলাম। কিন্তু তাঁবুতে ফিরে যেতে পারলাম না। উনি ছুটে এসে আমার হাত ধরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে চললেন। প্রথমে আমি জেদ দেখালেও, তা ধোপে টিকল না। গাল ফুলিয়ে সারা পথ বিনা বাক্যে হেঁটেছি। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা-ও জানতে চাইনি। হাঁটতে-হাঁটতে পা ধরে যাওয়ার জোগাড়। কিছুক্ষণের মধ্যেই অদূরে জনবসতির চিহ্ন দেখতে পেলাম। তারপর যখন ছোটো একটা দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম তখন ভাবলাম হয়তো কিছু কেনার জন্য এসেছে। কিন্তু এবারেও আমাকে ভুল প্রমাণ করে উনি দুটো চায়ের অর্ডার দিলেন। টংয়ের দোকানে চা খেতে-খেতে আমি চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলাম। এই দ্বীপে এখনও বাজার গড়ে ওঠেনি। ছোটো-ছোটো মুদি দোকানের ওপরই এখানকার মানুষ নির্ভরশীল। এখানকার চায়ের স্বাদ যে ভোলার মতো না, তা খেতে গিয়েই টের পেলাম। দেখতে খুবই সাধারণ মনে হলেও, খাওয়ার দিকে প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। এই চা-টা টেস্ট করা ছাড়াও, আমার জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কেননা আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে চা খাওয়া হয়নি। এরপর দেখা যেত সারাদিন মাথার য’ন্ত্রণায় অতিষ্ট হতে হত, আর গোটা দিনটাই মাটি হয়ে যেত। সকালের শুরুতে চায়ে অভ্যস্ত মানুষের এই দিক থেকে য’ন্ত্রণার অন্ত নেই। অন্য সময় হলে মহাশয়কে বড়োসড়ো এক ধন্যবাদ জানাতাম। কিন্তু এখন জানাব না। এসব পা’জি লোকের ধন্যবাদ পাওয়ার অধিকার নেই। চুপচাপ চা শেষ করে চারদিকে একটু ঘুরেফিরে আমরা আবার ফিরতি পথে হাঁটা দিলাম। এবার উনি নিজেই আগে কথা বললেন।
“মাথার ব্যারামের রোগীকে চা খাইয়ে তরতাজা করতে এতদূর নিয়ে এলাম, যাতে আমাদের এত সুন্দর ভ্রমণটার বারোটা না বাজে। ভালোয়-ভালোয় চায়ের বিলটা যেন ফেরত পাই। সুবিধাবাদী নারী জাতির পেছনে আমি কষ্টের উপার্জনের টাকা খরচ করি না।”
আমি রুক্ষ কন্ঠে প্রত্যুত্তর করলাম,
“আমি কাউকে বলিনি এত দয়া দেখিয়ে চা খাওয়াতে। আর কেউ আমায় বলেওনি এতদূর কেন এসেছে। কারো কষ্টের উপার্জনের টাকা খরচ করার শখও আমার নেই।”
“দুদিন পর তো ঠিকই কোনো এক গোবেচারার ঘাড়ে বসে খাবি আর টাকা উড়াবি। এজন্যই আমি কোনো ফেরিওয়ালার গলায় ঝুলিয়ে দিতে চেয়েছি। এবার দেখছি তা-ই করতে হবে।”
“আমাকে নিয়ে কারো মাথা না ঘামালেও চলবে।”
“আমার মাথাটা আবার ডিটেকটিভিটির উপাদানে তৈরি তো। তাই সব জায়গায় নির্দ্বিধায় ঢুকে পড়ে। কোনো বাঁধা নেই।”
তাঁবুর কাছাকাছি আসতেই উনি হঠাৎ পাশের ঝোপ থেকে একটা হলুদ ফুল তুলে আমার কানের পাশে গুঁজে দিলেন। আমি তাকাতেই বলে উঠলেন,
“আকাঙ্ক্ষিত ওই শব্দটা বড়ো ভয়া’নক ইলুরানি। তোমার ব্যাকুলতা বাড়াবে বই কমাবে না। অনুভবে সন্তুষ্ট থাকো।”
তারপর আমাকে রেখেই বড়ো-বড়ো পা ফেলে তাঁবুর কাছে চলে গেল। আমি আস্তে-ধীরে ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডে পৌঁছে দেখলাম আদনান ভাইয়ার আনা বল দিয়ে বালির মধ্যে ফুলবল খেলা চলছে। দু-এক জন আবার পাশের গাছের সাথে দোলনা টাঙিয়ে দোল খাচ্ছে। আমিরা আপু তাজ ভাইকে বলছে,
“একজনকে একা চা খেতে নিয়ে যাওয়া কি ঠিক হলো তাজ ভাই? আমরা বুঝি ভেসে এসেছি? তা-ও শুধু রাজ ভাইকে বলে আমাদের ফাঁকি দিয়ে গেলেন।”
তাজ ভাই উত্তর দিলেন,
“ট্যুরটা সুস্থ রাখতে আমি শুধু রোগীকে তার ঔষধ সেবন করাতে নিয়ে গিয়েছি। এখানে আরও রোগী আছে বলে আমার জানা ছিল না।”
বারবিকিউ নামিয়ে রেখেই সবাই খেলছিল। আমরা ফেরার পর হাত-পা ধুয়ে খেতে বসা হলো। তাজ ভাই দোকান থেকে কিছু-কিছু হালকা খাবার কিনে এনেছেন। বারবিকিউর সাথে সেগুলো আর আমাদের আনা শশা, টমেটো দিয়ে সালাদ বানিয়ে নাস্তা প্রস্তুত করা হলো। জম্পেশ আড্ডার সাথে সকালে নাস্তা সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য দুপুরের আগ পর্যন্ত সোনাদিয়া দ্বীপ চষে বেড়ানো। মাথায় টুপি চাপিয়ে রোদকে পরাস্ত করে আমরা সবুজ তৃণমূল মাড়িয়ে হেঁটে চললাম সোনাদিয়ার বুকে। প্রতিবারই যেন নতুন করে মুগ্ধ করে এই অপরূপ সোনাদিয়া। এই দ্বীপে পর্যটকদের জন্য একটি কচ্ছপের হ্যাচারি তৈরি করা আছে। আমরা হ্যাচারি পরিদর্শন করলাম। ডাব কিনে ডাবের পানি খেলাম। চারদিক চষে বেড়িয়ে শেষে ক্লান্ত হয়ে সবাই বালিতেই বসে পড়লাম। সেখানেও আমাদের মাঝে যেন শৈশব ভর করল। বালি দিয়ে এটা-ওটা বানালাম, আঁকিবুঁকি করলাম। মোটকথা সবাই বালিতে মাখামাখি হয়ে গেলাম। এতে আমাদের দারুণ আনন্দ ছিল। তারপর আমরা আজ আবার দ্বিতীয় এবং শেষবারের মতো সোনাদিয়ার সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। টলটলে নীল পানির শীতলতায় শরীর, মন পরিছন্ন করলাম। তারপর চলল আমাদের সমস্ত কিছু গুটিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি। নিজেরা তৈরি হয়ে তাঁবু তুলে আমরা পশ্চিম পাড়া ছাড়লাম। পথে আরও একদল পর্যটকের সাথেও আমাদের সাক্ষাৎ হলো। তারা আজই সোনাদিয়ায় পা রেখেছে। এবারেও আমরা সিদ্ধান্ত মতো গতদিনের সেই বাড়িতেই উঠলাম। আজকে দুপুরের ভোজের ব্যবস্থাও এখানেই হয়েছে। আজকের খাবারে ছিল ভাতের সাথে বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক মাছের আইটেম। খাবার দেখেই যেন অর্ধেক ভোজন হয়ে গেল। একেক আইটেমের একেক রকম স্বাদ। রান্নারও প্রশংসা করতে হয় বটে! পেটের সাথে মনও তৃপ্ত হলো। তারপর এল আমাদের ফেরার পালা। পিপাসু মন এই অপরূপ সৌন্দর্যকে যেন ছাড়তেও চাইছিল না। কিন্তু ফিরতে তো হবেই। এবার আর কক্সবাজারে থেমে থাকার সিদ্ধান্ত নেই। কক্সবাজার থেকে বাস ধরে সোজাসুজি ঢাকায় ফেরা হবে। স্পীড বোটে চড়ে সোনাদিয়া ছাড়তে হবে। দুরুদুরু বুকে আমি ভরসাযোগ্য মানুষটাকে আঁকড়ে ধরে নীল সমুদ্রে ভেসে চলে সোনাদিয়াকে বিদায় জানালাম। স্পীড বোট এগোনোর সাথে-সাথে চিরহরিৎ, নয়নাভিরাম সোনাদিয়া আমাদের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল।
চলবে, ইন শা আল্লাহ্