#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
২৬.
সময়গুলো চোখের পলকে পার হয়ে যায়। সোনাদিয়া থেকে ফিরে আবার সেই নিয়মমাফিক জীবনে ফিরতে হয়েছে। কোথাও আট’কে থাকার যে উপায় নেই। তবু মাঝে-মাঝে সেই রোমাঞ্চকর ভ্রমণটা ভীষণভাবে অনুভব করি। ইচ্ছে করে আবার ছুটে যেতে সেই নীল, সবুজের রাজ্যে। কিন্তু চাইলেই তো আর আমাদের জীবনের নিয়ম থেকে নিস্তার মেলে না। সোনাদিয়া থেকে ফেরার প্রায় মাস খানেক পেরিয়ে গেছে। তারপর শুধু বাসা থেকে ভার্সিটি, ভার্সিটি থেকে বাসা। এছাড়া কোথাও যাওয়া হয়নি। আজ ছুটির দিন। আম্মির স্পেশাল রান্নার দিন। আমি আগেভাগেই নিজের ইচ্ছেমতো কোনো আইটেমের কথা বলার জন্য ছুটলাম। রান্নাঘরে গিয়ে আম্মিকে জিজ্ঞেস করলাম,
“আম্মি, আজ কী ডিশ হবে?”
“আজ না কি জেনিফার রান্না করবে। মেয়েটা নিজেই জোরাজুরি করছে। তাই তাজ বলল আজ রোস্ট, কাবাব করতে।”
আপদ আগেই বলে ফেলেছে। ধুর! আমি হতাশ হলেও জেনিফার ভাবি আজ প্রথম রান্না করবে শুনে খুশি হলাম। বললাম,
“যাক, আজ ভাবির হাতের রান্না খাওয়া যাবে।”
জেনিফার ভাবি বলে উঠলেন,
“ভাবি কিন্তু আগেও খাওয়াতে চেয়েছে। আম্মিই দেয়নি।”
আম্মি বলল,
“আমি থাকতে তুমি কেন রান্না করবে? যখন আমি পারব না, তখন করবে।”
আমি বললাম,
“ভাবি, তুমি কি লাকি দেখেছ? এমন শ্বাশুড়ি কজন পায়?”
ভাবি প্রশস্ত হেসে বলল,
“তোমার কপালেও যেন এমন শ্বাশুড়ি জোটে।”
আমি মেকি হাসলাম। আম্মি বলে বসল,
“ইলোর শ্বাশুড়ি আমিই খুঁজে দিবো, চিন্তা নেই।”
আমি প্লাস্টিক মার্কা হাসি মুখে ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মন বলছে, শুধু-শুধু হারিকেন ভেঙে কী লাভ আম্মি? কিন্তু প্রসঙ্গ এড়িয়ে বললাম,
“আমি কোনো হেল্প করব?”
জেনিফার ভাবি উত্তর দিলেন,
“লাগবে না। আমি পারব। আর আম্মি তো আছেই।”
আমি ভাবলাম আজ ছুটির দিনে গতকালের বইটা শেষ করে ফেলব। কিন্তু তার আগে বুক শেলফটা পরিষ্কার করতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। কোনোমতে অলসতা কা’টিয়ে শুকনো কাপড় নিয়ে এলাম। বুক শেলফ পরিষ্কার করার জন্য প্রাপ্ত সেই হ্যান্ড রাইটিং করা কাপড়টা এখনও সেভাবেই পড়ে আছে। সুন্দর কাপড়টা ময়লা লাগিয়ে নষ্ট করতে ইচ্ছে হয়নি। একে-একে বই নামানো ধরতেই আম্মি রান্নাঘর থেকে উঁকি দিয়ে বলল,
“কী করছ তুমি? রাখো ওসব। কুলসুম করে দিবে।”
সঙ্গে-সঙ্গেই কুলসুম আপা ছুটে এলেন। বললেন,
“আফা, দেন আমি কইরা দিতাছি। আমারে ডাকলেই তো হইত।”
“না, আমিই করব। আপনি নিজের কাজে যান।”
কুলসুম আপা নিচু স্বরে বললেন,
“আফা, একখান কথা কই?”
“আপনি আবার কবে একখান কথা বলতে পারেন? একখানের জায়গায় তো দশখান বলে বসে থাকেন। বলুন।”
“আপনে সবসময় এই বইয়ের তাক নিজে পরিস্কার করেন ক্যান? আমারে করতে দিলে তো আমি আরও তাড়াতাড়ি করতে পারি।”
আমি হাসলাম। দিবো কীভাবে? এই গোটা শেলফের দায়িত্ব তো আমার একার।
“বইয়ের দায়িত্ব অন্য কাউকে দিতে নেই, বুঝলেন কুলসুম আপা?”
“ক্যান? আমি কি খাইয়া ফালামু, না চু’রি করমু? আমি তো জীবনে ইস্কুলের বারান্দায়ও যাইনাই।”
“উঁহু, ওসব কিছু না। বইপ্রেমীদের কাছে তাদের একেকটা বই খুব দামী হয়। তাই বই নষ্ট হলে তাদের কষ্ট লাগে। অন্য কারো হাতে নষ্ট হলে আরও বেশি খারাপ লাগে। তাছাড়া নিজের বইয়ের যত্ন নিজে করার মাঝে অন্যরকম আনন্দ থাকে। এতে পুরোনো বইগুলোও ছুঁয়ে দেখা হয়।”
কুলসুম আপা দাঁত কেলিয়ে হেসে বললেন,
“এইবার বুঝছি। আপনে কী সুন্দর কইরা কইলেন! আমি যদি পড়তে পারতাম, তাইলে ঠিকই বই পড়তাম।”
শেলফের একপাশ পরিষ্কার করে অন্যপাশ করার সময় তাজ ভাই দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে একবার তাকিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়ে হাঁক ছাড়লেন,
“আম্মি, কফি পাওয়া যাবে?”
আম্মি উত্তর দিলেন,
“দিচ্ছি বাবা। একটু অপেক্ষা করো।”
কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম হাতে কফি মগ নিয়ে বেরিয়ে এলেন। কিন্তু বদ লোকের মাথায় তো বাঁদর ঘাপটি মে’রে বসে থাকে চব্বিশ ঘন্টা। শেলফের পাশ ঘেঁষে গিয়ে রুমে ঢুকে পড়লেন। তারপর আমার খেয়াল হলো ওপাশটায় দুই তাকে কফির গুঁড়া ছিটিয়ে পড়ে আছে। আমি কপাল কুঁচকে ফেললাম। হাতের মুঠোয় কফি নিয়ে এসেছিল? আশ্চর্য! এ কেমন বাচ্চামি? হাতের কাপড়টা দিয়ে তাক থেকে গুঁড়া কফি পরিষ্কার করলাম। কিন্তু কফির গুঁড়া কাপড় থেকে ঝেড়ে ফেললাম না। কাপড়টা মুঠোয় নিয়ে হনহনিয়ে ওনার রুমে ঢুকলাম। মহারাজ খাটে হেলান দিয়ে দিব্যি কফি পান করছেন। আমাকে দেখেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। যেন এখানে মানুষ না, অদৃশ্য পে’ত্মী এসে দাঁড়িয়েছে। এগিয়ে গিয়ে আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,
“এটা কোন ধরনের অকাজ? আমি কষ্ট করে শেলফটা পরিষ্কার করছি না? আপনি আমার পরিষ্কার করা জায়গায় ইচ্ছে করে কফি ফেললেন কেন?”
ওনার যেন গায়েই লাগল না। ভাবলেশহীন মুখে আমাকেই উলটো প্রশ্ন করলেন,
“প্রমাণ আছে?”
আমি হাতের কাপড়টা দেখিয়ে বললাম,
“এসব কী?”
“আমি ফেলেছি তার কী প্রমাণ আছে?”
“আমাকে আপনার অন্ধ মনে হয়?”
“তুই তো এমনিতেও হাফ অন্ধ। তা তুই নিজের হাফ অন্ধ চোখ দিয়ে দেখেছিস আমি কফি ফেলেছি?”
“না দেখলে কি বুঝা যায় না? আপনি রুমে আসার সময় শেলফের পাশ দিয়ে আসেননি? না কি আপনার প্রেতা’ত্মা এসেছিল?”
“আমি আন্দাজে বিশ্বাসী না, প্রমাণে বিশ্বাসী। আপনি আসতে পারেন।”
আমি চরম বিরক্ত হয়ে বললাম,
“আপনাকে এখানে ডিটেকটিভিটি করতে বলেছি? নিজের দোষ ঢাকার তো খুব ভালো পদ্ধতি জানেন। মাথার ভেতর কয়টা শয়তান নিয়ে ঘোরেন?”
“ওসব তোর ফাঁকা মাথায় জায়গা পেলে পেতে পারে। আমার মাথায় ওসব রাখার জায়গা নেই। আমার মাথা যে একদম পিওর জ্ঞানবুদ্ধি আর সততায় ঠাসা, তা জাতি জানে।”
“ঘোড়ার ডিম জানে। আপনার মতো নিজের ঢোল নিজে বাজানো মানুষ আমি দুটো দেখিনি।”
“দেখবি কী করে? এই সিম্পল ব্যাপারটাও ধরতে পারছিস না? মাথামোটা। পৃথিবী জুড়ে বহু তাজ পাবি, কিন্তু ইউনিক তাজ এই একটাই। তার কোনো বিকল্প হয় না। বুঝেছিস? না বুঝলে গিয়ে আমিরাকে জিজ্ঞেস করতে পারিস। গড়গড় করে বলে দিবে। আফটার অল, তাজ দ্য গ্রেট ডিটেকটিভ।”
ওনার আজাইরা চাপাবাজি আর ভাব দেখে গা জ্বলে উঠল। আমার কাজের মধ্যে অকাজ করে আবার নিজেই নিজেকে ভূখণ্ডের মহারাজা ভাবছে। রাগে আমি হাতের ময়লা কাপড়টা ওনার মাথায় ছুঁড়ে মে’রে বলে উঠলাম,
“ফালতু অ’হংকার। বলুন তাজ দ্য গ্রেট বদের হাড্ডি। ”
আমায় আর পায় কে? সা’পের গর্তে ঢুকে সা’পের লেজেই পা দিয়েছি, কখন না ফোঁস করে ওঠে। তাই আগেভাগেই কে’টে পড়লাম। ভাগ্যিস আমার পিছু নেয়নি। নয়তো বুক শেলফ পুরোপুরি গুছিয়ে উঠতেও পারতাম না। কিন্তু দুপুরে খেতে গিয়ে পড়লাম ফ্যাসাদে। তাজ ভাই এলেন সবার শেষে। এসে আমার পাশের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে তাড়া দেখালেন, ক্ষুধায় তার পেট জ্বলে যাচ্ছে। আমি সবেমাত্রই খাবারে হাত দিয়েছি। আম্মি খাবার দেওয়া পর্যন্ত যেন ওনার ধৈর্য সইলো না। সামনে থেকে আমার প্লেট টেনে নিয়ে গেল। আমি কিছু বলার আগে খেতেও আরম্ভ করে দিলো। আম্মি বলল,
“একি! ওরটা নিলি কেন? ও তো খাওয়া শুরু করছিল।”
উনি ত্যাড়াভাবে উত্তর দিলেন,
“আমার ক্ষুধা পেয়েছে, নিয়েছি। আমারটা ওকে দিয়ে দাও, তাহলেই তো হয়।”
সবার সামনে কিছু বলতে না পেরে আমি গাল ফুলিয়ে আড়চোখে তাকালাম। আম্মি ওনার জন্য তোলা খাবারটা আমাকে দিয়ে দিলো।
নূর আঙ্কেল তাজ ভাইকে বললেন,
“তাই বলে সামনে থেকে খাবার নিয়ে নিবি? তোর এই পাজি স্বভাব কবে যাবে বল তো?”
উনি জবাব দিলেন,
“শ্বশুর হলে।”
টেবিলের সবাই হেসে উঠল। জেনিফার ভাবি বললেন,
“তোমার নিজেরই এখনও শ্বশুর হলো না, আর তুমি এখনই শ্বশুর হওয়ার কথা বলছ?”
“এখনকার কথা কে বলেছি? যখন হব তখন।”
আম্মি প্রশ্ন করল,
“তো এখন কি তোমার শ্বশুর চাই না কি?”
তাজ ভাই পালটা প্রশ্ন করল,
“বাজিয়ে দেখছ?”
“বাজিয়ে দেখার কী আছে? রাজ বিয়ে করে ফেলেছে। তোরও তো বিয়ের বয়স হয়েছে। তোর বাবা আছেই আর দুই মাস। এরমধ্যে যদি তোর বিয়েও দেখে যেতে পারে, তাহলে তো খারাপ হয় না।”
“এমনভাবে বলছ, যেন বাবা এবার সৌদি গিয়ে আরেক বিয়ে করে স্থায়ীভাবে সংসার পেতে বসবে। আর দেশে ফিরে ছেলের বিয়ে দেখতে পারবে না।”
আম্মি চোখ রাঙিয়ে বলল,
“বাবার সামনে এসব কেমন কথা তাজ?”
উনি নূর আঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“বাবা, ভুল বলেছি?”
আঙ্কেল হেসে বললেন,
“আমার ছেলে ভুল বলবে? কিন্তু বাপ, বিয়ে নিয়ে তোর কী চিন্তা-ভাবনা?”
“কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। তোমার ছেলে বুদ্ধিমান পুরুষ, বুঝলে বাবা? বুদ্ধিমান পুরুষ এত তাড়াতাড়ি নারী জাতিকে ঘাড়ে ঝুলায় না। তারপর দেখা যাবে কদিন পর ঘাড়টাই উধাও।”
আম্মি প্রতিবাদ করে উঠল,
“ইঙ্গিতে আমাদের অপমান করা হচ্ছে?”
উনি মিষ্টি হেসে বললেন,
“একদম না আম্মি। আমি এ যুগের ইয়াং জেনারেশনের কথা বলেছি। তোমাদের যুগে তো এ যুগের মতো ধান্দাবাজ নারী জাতি ছিল না। এ যুগের নারী হচ্ছে একেকটা ঘষেটি বেগমের কার্বন কপি।”
আমি এতক্ষণ চুপ থাকলেও, এবারের কথাটা গায়ে লাগল। নূর আঙ্কেলের সামনে গলা উঁচিয়ে কিছু বলতে না পেরে কৌশলে জেনিফার ভাবিকে উস্কে দিলাম।
“ভাবিও কিন্তু এ যুগের নারী।”
সঙ্গে-সঙ্গে ভাবি বলে উঠল,
“এটা কিন্তু আমি মানব না। আমি মোটেও ঘষেটি বেগমের কার্বন কপি নই, তা সবাই জানে। তোমার এ দোষারোপ ভুল। আম্মি, তোমার ছেলে কিন্তু আমাকেও অপমান করল।”
আম্মি বলল,
“ঠিকই তো। আমার বৌমা আর মেয়ে একদমই ওমন না। তোর এই দোষারোপ বাইরে ফলাবি।”
উনি সকৌতুকে বললেন,
“বুঝি আম্মি। তুমি নারী বলে অন্যদের সাপোর্ট করছ। কিন্তু এদের ভেতরের রহস্য তোমার অজানা।”
সুযোগ বুঝে আমি বলে বসলাম,
“আপনি জাতীয় সিঙ্গেল পুরুষ হয়ে নারী জাতির রহস্য জানেন কীভাবে?”
“কারণ আমি ডিটেকটিভ, মাথামোটা নই।”
কথায়-কথায় এক সুর পেয়েছে। ডিটেকটিভ। ঘোড়ার ডিম। যেন এই আজাইরা অ’হংকা’র দেখানোর জন্যই ডিটেকটিভ হয়েছে।
বিকেলে ভাবলাম অবসর সময়টা গতকালের বইটা পড়ে শেষ করব। কিন্তু শেলফ ঘেঁটে বইটা পেলাম না। বুঝতে মোটেও অসুবিধা হলো না বই কোথায় নিরুদ্দেশ হয়েছে। শুনেছি তাজ ভাই বেরোবেন। দরজা খোলা দেখা যাচ্ছে। আমি চুপচাপ গিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে গলা বাড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিলাম। উনি যাননি এখনও, রেডি হচ্ছেন। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছেন। একবার ভাবলাম উনি যাওয়ার পর এসে বই নিয়ে যাব। আবার কী ভেবে ওনাকে ভালোভাবে লক্ষ্য করে খুব সাবধানে ভেতরে পা বাড়ালাম। নিচু হয়ে পা টিপে হেঁটে নিঃশব্দে খাটের কাছে এগিয়ে গেলাম। সতর্ক দৃষ্টিতে ওনার গতিবিধি খেয়াল করে বালিশ সরাতেই বই পেয়ে গেলাম। বইটা নিয়ে যেভাবে এসেছি, সেভাবেই চলে যাওয়া ধরলাম। কিন্তু হুট করে চোখের পলকে উনি যেন রকেটের গতিতে এসে পেছন থেকে আমার চুল টেনে ধরলেন। চুলে টান পড়তেই আমি দাঁড়িয়ে পড়ে মৃদু আর্তনাদ করে উঠলাম। উনি বললেন,
“আবারও আমার ঘরে চু’রি?”
আমি চুল ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললাম,
“আমি বই নিতে এসেছি। ব্যথা পাচ্ছি, ছাড়ুন।”
উনি চুলগুলো হাতের সাথে আরও পেঁচিয়ে নিয়ে বললেন,
“চোরের মতো করে বই নিতে এসেছিস? ধান্দা কী ছিল?”
যেচে চুলে এত বেশি ব্যথা দেওয়ায় মেজাজ গরম হয়ে গেল। রাগত স্বরে বললাম,
“তাজ ভাই, চুল ছাড়ুন। এসব কোন ধরনের আচরণ? ইচ্ছে করে ব্যথা দিচ্ছেন কোন সুখে? আমি বই নিতে এসেছি, আপনার অমূল্য সম্পদ না।”
“আমার অমূল্য সম্পদ নেওয়ার সাধ্য তো তোর নেই। তোর যা সাধ্য আছে তা হচ্ছে, আমার অমূল্য সম্পদের খেয়াল রাখা।”
কথাটা বলেই উনি চুল ছেড়ে দিলেন ঠিকই, কিন্তু সাথে আমার হাতের বইটাও কেড়ে নিলেন। আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে গোমড়া মুখে বললাম,
“বই দিন। আমার পড়া শেষ হয়নি।”
উনি বইটা নাড়াচাড়া করতে-করতে বললেন,
“দিতে পারি, যদি তুই তোর ফালতু চা করে খাওয়াস। ভাবিস না সাধ করে খেতে চাইছি। মাথা ধরছে বোধ হয়।”
আমাকে এত জ্বালিয়ে, আবার আমার হাতেরই চা খাওয়ার ইচ্ছে। তা-ও আবার আমার চাকে ফালতু চা বলা হচ্ছে। ব্যাটা হাঁড়ে ব’জ্জাত। তোমায় চা না, গালে জোরেশোরে চাপ দেওয়া উচিত। কিন্তু আমি ভালো মানুষ। বেয়াদবি করব না। প্রত্যুত্তরে শক্ত মুখে বললাম,
“নিজে করে খান। আমার চাকে অপমান করে আবার তা-ই খেতে লজ্জা করে না? পেটে শুধু শয়তানি। বই লাগবে না আমার।”
বই রেখেই ফিরে এলাম। অত চাপ কিসের? এমনিতেও উনি এখন চলে যাবেন। তারপর গিয়ে বই নিয়ে ওনার খাটের উপর বসে পড়লেই উনি দেখবেন কীভাবে? এই ভেবে অন্য একটা বই নিয়ে বসলাম। কিন্তু পড়ার আগেই দরজায় ডিটেকটিভ সাহেব এসে দাঁড়ালেন। হাতে ওই বইটা। আমি দেখেও না দেখার ভান করলাম। উনি এগিয়ে এসে হাতের বইটা আমার পাশে ছুঁড়ে ফেলে বললেন,
“এসব নিয়ে অতিরিক্ত সময় পড়ে থাকবে না। এসে যেন পড়ার টেবিলে দেখি।”
হুকুম ঝেড়ে সাহেব বিদায়। পড়ার টেবিল পরে বুঝা যাবে, আমি আমার বই তো পেয়েছি। হাতের বই রেখে দিয়ে ওই বইটা নিলাম। বই খুলে বুকমার্কের নিচে একটা কাগজ পেলাম। হুট করেই যেন খুশি-খুশি লাগল। বই রেখে দ্রুত কাগজটার ভাঁজ খুললাম।
মনোহারিণী,
আমার ব্যক্তিগত রাগিণী। এই যে সে গোটা বিশ্বের কাছে বড্ড চাপা স্বভাবের শান্ত একটা হরিণী, অথচ গোটা বিশ্বের কাছে চেপে রাখা রাগটা কেবল আমার ওপর ঢেলে দেয় নির্দ্বিধায়; একে কি বলে? ভরসা, না কি সাহস? সে যা-ই হোক, তার বিশ্ব সমান রাগ ধারণের ক্ষমতা বোধ হয় সৃষ্টিকর্তা আমায় দিয়েছেন। তবু সে সবার কাছে চাপা রাগটা আমার কাছে উজাড় করে দিক। আমার ব্যক্তিগত রাগিণীর জন্য সমস্ত দ্বিধা মানা। ফিরে এসে কি তার ফোলানো গাল দেখব? আচ্ছা, শেলফে কয়েকটা নতুন বই উঠলে কেমন হয়?
ইতি
রাগিণীর রাগ জমা রাখার সিন্দুক
আমি মুখ বাঁকিয়ে স্বগতোক্তি করলাম, ‘গলছি না, হুহ্।” কিন্তু তাজ সাহেব বলেছেন, আর সেটা করবেন না, তা কি হতে পারে? রাতে তার ফেরার সাথে-সাথে সত্যিই শেলফে কয়েকটা নতুন বই উঠল। তা দেখেই আম্মি হাঁক ছাড়ল,
“এসব কী তাজ? বস্তা ভর্তি বই এনে যে শেলফ সাজিয়েছিলি, ওগুলো এখনও এক ভাগও পড়ে শেষ করেছিস কেউ? আবার এগুলো এনেছিস কী করতে? আনতে পারলেই হয়?”
তাজ ভাই একগাল হেসে উত্তর দিলেন,
“রাগ কোরো না আম্মি। বইয়ের সুবাদে বউ মেলে, বুঝলে?”
আম্মি ওনাকে মৃদু থা’প্পড় মে’রে বলল,
“দুপুরে বলো এক কথা, আবার রাতেই সুর বদল? তোমাকে এ বছরেই বিয়ে করাব, দেখে নিয়ো।”
আমি তখন মনে-মনে আকাশে উড়ছি। যে যা ইচ্ছে বলুক, কয়েকটা নতুন বই তো জুটেছে। আপাতত এই আনন্দে বাকি সব দুধভাত।
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।
(ভুলত্রুটি মার্জনীয়। সকলের মন্তব্য আশা করছি।🙂)