#মন_আকাশে_তুই
#পর্ব_০২
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি
দীর্ঘ সাতবছরের ভালোবাসার পুরুষটিকে অহি নিজের চোখের সামনেই অন্যের হতে দেখল। তাও আবার নিজেরই প্রিয় বান্ধবীর স্বামী। একটু একটু করে জমানো অনুভূতি গুলো ভেঙ্গে চূড়মার হলো।অহির প্রিয় বান্ধবীর সাথে তারই প্রিয় পুরুষের আকদ অনুষ্ঠান হওয়ার আজ এক সপ্তাহ পার হলো। এই এক সপ্তাহে অহি একবারও হৈমির সাথে যোগাযোগ করল না৷ হৈমির সাথে শেষ কথা হয়েছে বিয়ের দিনই। এর পর আর কথা হয়নি। হৃদি অবশ্য বুঝিয়েছে তাদের বরের ছবি আগে দেখায়নি বলে সে রাগ করেছে। অহির সাথে অবশেষে আজ দেখা হলে হৈমির সাথে। আশপাশে উত্তপ্ত রোদের তেজে দুজনেরই মুখ লাল হয়ে এসেছে। অহি তাকায়। দুইজন দুই ডিপার্টমেন্টে হওয়াতে ভাবল হৈমির জরুরী ক্লাস বোধহয়। জিজ্ঞেস করল,
“ হৈমি, শুনে যা। আমি রাগ করিনি। হৃদি আপু তোকে মিথ্যে বলেছে। ”
হৈমি মিষ্টি করেই হাসে। এগিয়ে এসে দ্রুত জড়িয়ে নিয়ে বলল,
“ আমি জানি আমাদের ইনোসেন্ট অহি আমার উপর কোনভাবেই রাগ করে থাকতে পারে না। আস্ত রসগোল্লা কিনা আমার অহিটা। ”
অহি হাসে। হৈমি এবারে তাড়া দেখিয়ে ঘড়িতে সময় দেখল। দ্রুত বলল,
“উহ সময় অনেক হয়ে গেল রে অহি, তোর দুলাভাই বোধহয় দাঁড়িয়ে আছে। আমায় যেতে হবে রে অহি। ”
অহি এবারেও হাসল। তবে বুক চিড়ে বেরিয়ে এল সূক্ষ্ম দীর্ঘশ্বাস। সাদ ভাইয়া বাইরে দাঁড়িয়ে আছে হৈমির জন্য? নিশ্চয় খুব ভালোবাসে হৈমিকে? ইশশ! যদি সাদ ভাইয়া তাকে ভালোবাসত? যদি তাকে বিয়ে করত? এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকত ভার্সিটিতে এসে? অহি বিষয়টা ভেবে পরমুহুর্তেই নিজেই অস্বস্তিতে পড়ল। ছিঃ! কি নোংরা ভাবনা ভাবছে সে। অন্যের বরকে নিয়ে ভাবছে? এাটা বিবাহিত পুরুষ নিয়ে ভাবছে? বিবাহিত পুরুষের জন্য অনুভূতি পুষছে? ছিঃ! অহির নিজেকেই নিজের ছোট লাগে। আর যায় হোক, বিবাহিত পুরুষের প্রতি অনুভূতি রেখে নিজেকে নিচু প্রমাণ করার মেয়ে সে নয়। মনে মনে নিজেকে শাসাল সে। নিজেকেই মনে মনে শুধাল,
“ ছিঃ অহি। সে অন্যের বর। অন্যের বিয়ে করা বর। তুমি তার দিকে নজর দিতে পারো। অন্যের জিনিসে নজর দিতে নেই অহি। ”
অহি কথাটা মনে মনে বলেই নিজেকে শাসিয়ে নিয়ে হৈমির দিকে চাইল। বলল,
“ যা, সাবধানে যাস। ”
হৈমি খুশিতে হাসল। দৌড়ে যেতে যেতে বলল,
“ তোর সাথে ফিরে কথা বলব রে অহি৷ আপাতত বরের সাথে ঘুরতে যাচ্ছি।”
অহি তাকিয়ে হাসল। পরমুহুর্তেই দেখা মিলল রাফিদ, নিহা আর তাসিন এর৷ এক ডিপার্টমেন্টে এবং বহুকালের বন্ধুত্বের সুবাধে এদের সাথে অহির সম্পর্কটা সুন্দর। খুবই সুন্দর।
.
অহি, হৃদি, হৈমি তিনজনই এক বাসায় ভাড়া থাকে। বাসা একই শহরে হলেও ওরা বাসায় না থেকে এভাবেই থাকে এখানে। হৈমি যদিও আকদ অনুষ্ঠানের পর এখনও ফেরেনি। অহি বাসায় ফিরল সন্ধ্যার একটু আগে। মুখেচোখের ক্লান্তিতে যখন কার বুকের ব্যাথা তীব্র হয়ে উঠে তখন অহি চোখ বুঝে নিয়ে শরীর এলিয়ে দিল বিছানায়। বুকের পোড়া ব্যাথা এবং যন্ত্রনা নিয়ে আপসোস করে বলল,
“ কেন আমার হলেন না সাদ ভাইয়া? কেন আমার হলেন না? যদি আমার হতেন, আমি আপনার সমস্ত রাগ মেনে নিতাম সাদ ভাইয়া, সমস্ত উত্তাপ সহ্য করে নিতাম। সমস্ত জেদ, সমস্ত ক্ষোভ আমি সামলে নিতাম সাদ ভাইয়া। অথচ আপনি আমায় একটাবারের জন্যও মনে করেননি।একটাবারের জন্যও মনে রাখেননি অহিকে।”
আবারও টলমলে আবেগ নিয়ে বলল,
“ আপনি অহির হলে অহি স্বর্গে ভাসত সাদ ভাইয়া। আপনি যদি অহির হতেন অহি আপনাকে সত্যিই আঁকড়ে নিত। এত বেশি আঁকড়ে ধরত যে অহির এই জীবনের সমস্ত দুঃখ, সমস্ত ক্লান্তি সে সুখ হিসেবে ভেবে নিত। ”
অহি এসবই বিড়বিড় করে বলছিল। চোখ টলমল করছে। এতদিনের ভালোবাসা, এতদিনের অনুভূতি ভুলে উঠা সহজ নয়। আক্ষেপ, কষ্ট, যন্ত্রনা প্রতিমুহুর্তেই মনে করাচ্ছে এই পুরুষটার প্রতি তার কতশত অনুভূতি বন্দি ছিল।অহি চেষ্টা করছে, পুরোপুরি চেষ্টা করছে ঐ পুরুষটিকে ভুলে যাওয়ার। হয়তো ভুলতে পারবেও কোন একদিন…
.
হৈমি আজ শাড়ি পরেছে। একদম লাল টকটকে একটা শাড়ি। কানে গুঁজে নিয়েছে একটা লাল গোলাপ। অতঃপর সুন্দরভাবে একটা টিপ গুঁজে নিয়েছে কপালের মাঝখানটায়। নিচে তার বর দাঁড়ানো। একটু পরই হয়তো অপেক্ষার বাঁধ ভেঙ্গে হর্ন বাঁজাবে। হৈমি আয়নায় নিজেকে দেখে শুনে নিয়ে নিচে নামল। মোটরবাইকে বসা ছেলেটাকে ছোট ছোট চোখে পরখ করে নিয়ে সামনে গিয়ে বলল,
“ মিঃ আবিদ এহসান? বউ এর দিকে তাকান তো চোখ তুলে। ”
আবিদ অন্য দিকে ফিরে ছিল। ইচ্ছে করেই বোধহয় তাকায়নি। তবে হৈমির কথা শুনে সে ঠোঁট কাঁমড়ে হাসে। পরমুহুর্তেই তাকায়। মুগ্ধ দৃষ্টি না ফেললেও কিয়ৎক্ষন চেয়ে থেকে সে হেসে ফেলল। বলল,
“ মিসেস আবিদ এহসান, আমাকে প্লিজ এভাবে চক্রান্ত করে ফাঁসিয়ে দিবেন না। অনুরোধ রইল আমার। ”
হৈমি হাসে। নিজেই গিয়ে আবিদের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“ ফাঁসিয়ে তো আমায় দিলেন। এত ভদ্র ভালো একটা ছেলে হয়ে তো আমাকে বিবাহিত নারীর পদবী দিয়ে দিলেন। যেখানে আমার বড় ছোট,বান্ধবী কেউ এখনও বিবাহ করল না। ”
আবিদ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ বিয়ে করে পস্তাচ্ছো? ”
হৈমি চোখ ছোট ছোট করে ফেলে। বলে,
“ অবশ্যই পস্তাচ্ছি। আমার প্রেম করা হলো কোথায়? প্রেম করার আগেই ছেলের বিয়ে করে ফেলতে হবে । অলরেডি দুই দুইবার বিবাহ সম্পন্ন করে ফেলেছে এই ভদ্র ভালো আবিদ এহসান। দেখে বুঝা যায়? ”
আবিদ হেসে ফেলে। বলল,
“ হৈমির মতো মেয়ে প্রেমিকা হলে যা হয় আরকি। রিস্ক নিতে চাইনি। ”
হৈমি মুখ ভেঙ্গায়। বলে,
“ দাঁড়িয়ে থাকব নাকি বাইকে উঠতে বলবেন? ”
“ থাকো, কাছাকাছি থাকলে আমার যদি সর্বনাশ ঘটে? ”
হৈমি ভ্রু বাঁকিয়েই তাকায়। অতঃপর বাইকে উঠে বসে বলল,
“ ঘটুক তবে সর্বনাশ। ”
আবিদ নিঃশব্দেই হাসে। ঠোঁট কাঁমড়ে কিয়ৎক্ষন তাকায় বাইকের মিররে ভেসে আসা তার প্রিয়তমার মুখপানে।
.
সাদিদ এহসান নামা পুরুষটা আজ বেশ কয়েকদিন যাবৎ বাসায় ঝামেলা পাকিয়েছে। আজ সে ঝামেলা কিছুটা চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। রাগারাগি করে এক পর্যায়ে সাদিদ ফুলদানিটা ছুড়ে ফেলেছে ফ্লোরে। নিধি ছেলের এই বেয়াদবি রূপ দেখে বিরক্তই হলো। কপাল কুঁচকে বলল,
“ সমস্যা কি? নিনীকে তুমি সত্যিই বিয়ে করবে না? ”
সাদিদ নাকমুখ কুঁচকে নিয়ে তাকায়। উত্তরে বলে,
“সমস্যা অনেক। নিনীকে যে আমি জীবনেও বিয়ে করব না তা তুমি জানো আম্মু। আবিদকে ওর বউ বুঝিয়ে দিয়েছো, এবার আমাকেও আমার বউ বুঝিয়ে দেওয়া হোক। শত হোক, ওর থেকে আমি এক মিনিটের বড় হই। ”
নিধি চোখ ছোটছোট করে তাকিয়েই ছেলের দিকে ফিরে বলল,
“ আবিদ বলেছে ওর বউ আকদের পর ও বাড়িতেই থাকবে৷ হৈমির পড়া শেষ হওয়ার পর একেবারে আনুষ্ঠানিক বিয়ের পর হৈমিকে ঘরে তুলবে,সংসার করবে। কিন্তু তুমি তো তাতে রাজি নও। তুমি বিয়ের পরপরই বউ তুলবে,সংসার করবে। বউ এর বাড়ির লোক এতে রাজি না হলে আমরা কি করব ? এর থেকে নিনী তোমার সব চাওয়ার সাথে মিল আছে। সে বিয়ের পর সংসারও করতে রাজি আছে। ”
সাদিদ দাঁতে দাঁত চাপে। পুণরায় রাগ দেখিয়ে টেবিলের উপর থাকা কাঁচের গ্লাসটা ছুড়ে ফেলে বলল,
“ নিনীর কথা এখানেই থামাবে তুমি আম্মু। নয়তে খারাপ হবে। ”
“ ওকে বাদ, কিন্তু তুমি যার কথা বলেছো এবং যা চাও তা হবে না। ”
সাদিদ ভ্রু বাঁকায়। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
“ হবে না কেন? ও কি সবসময় ও বাড়িতে থাকবে নাকি?বিয়ের পর তো অবশ্যই সংসার করবে তাই না? তাছাড়া বিয়ের পর কি তুমি থেকেছিলে নানু বাড়ি? ”
সাদিদের আব্বু মহাশয় উপস্থিত হলো এতক্ষনে। ছেলের নাকের ডগায় রাগ দেখে শান্ত করাতে আশ্বাস দিয়ে বলল,
“এতবছর যখন অপেক্ষা করেছো আরেকটু অপেক্ষা করো।”
সাদিদ হনহন করে চলে যেতে যেতে বলে গেল,
“ পারব না। তোমরা ব্যবস্থা না করলে আমি নিজেই স্টেফ নিব। তখন দোষ দিবে না। ”
.
অহি দুদিন পরপরই বাসায় যায়। বাবাকে আর ছোট ভাইকে দেখে আসে৷ যদিও সে বাসাতেই থাকতে চেয়েছিল, বাসা থেকে ভার্সিটি আসা যাওয়া করতে চেয়েছিল কিন্তু বাসা ভার্সিটির পথটা প্রায় দেড় ঘন্টার। কিছুটা কষ্ট হয় বলেই বাবা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তার জন্য৷ অহি ছোটশ্বাস ফেলে। গতকালই সে বাসা থেকে ফিরেছে। অথচ আজ তাকে তার আব্বু কল দিয়ে জানাল,
“ অহি? তোমার সাথে আমার কথা আছে।তুমি বাসায় ফিরবে? ”
অহি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হেসে জানাল,
“অবশ্যই আব্বু। ফিরছি আমি। ”
তারপর রওনা হলো। ঘন্টা দুয়েক বাস জার্নি করে বাসায় পৌঁছে যখন লম্বা একটা গোসল সেরে বেলকনিতে বসল তখন আব্বু এল তার ঘরে। শুধাল,
“বসার ঘরে গিয়ে বসো। দেখো কারা আছেন। কথা বলে এসো। বাকিটা আমি একটু পর বলছি তোমায় আম্মু। ”
অহি ছোট করে বলল,
“ যাচ্ছি। ”
অহি গেল। তারপর সরাসরি প্রথমে যাদের চোখে পড়ল তারা হলো জমজ দুই ভাই। সাদিদ-আবিদ। তবে ছোটকালের মতো অহি এই দুইজনকে আজ চিনে উঠতে পারছে না। কে সাদিদ আর কে আবিদ বুঝে উঠে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকাতেই দুইজনের একজন বলে উঠল,
“অহি বুড়ি? ভালো আছিস তুই? কত্ত বড় হয়ে গেছিস বুড়ি।”
অহির এবার আন্দাজ হলে এটা আবিদ। আবিদই হবে। সাদিদ জীবনেও এভাবে হেসে কথা বলবে না। অহি একটু পাশ ঘুরে তাকাতেই দেখল পাশে সাদাফ আঙ্কেল। সাদাফ আঙ্কেলকে দেখছে সে বহুবছর পর। আবিদ আর সাদিদকে ফেইসবুক আর ইন্স্ট্রাগ্রামের কল্যানে এই কয়েকবছর যাবৎ দেখে আসলেও এই মানুষটাকে সে আজই দেখছে। হেসে জানাল,
“আসসালামুআলাইকুম আঙ্কেল,কতবছর পর! ”
সাদাফ হাসে। অহি ফের একটু আগের আবিদ ভাবা মানুষটার দিকে চেয়ে বলল,
“তুমি… ”
সে নিজেই হেসে বলল,
“ আমি আবিদ। ”
অহি হেসেই বলল,
“ আদ ভাইয়া? ”
“ছোটকালের মতো আদই ডাকবি বুড়ি? অবশ্য ওটাই সুন্দর। খারাপ শোনাচ্ছে না। ”
অন্যদিকে সাদিদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে আবিদের দিকে। এত গদগদ ভাব দেখাচ্ছে যেন বিয়েটা আবিদই করবে৷ আশ্চর্য, আশ্চর্য! সে এই আবিদকে এখনও ঈর্ষা করে বিষয়টা যদি হয় অহি। ভ্রু চাপিয়ে তাকিয়েই থাকে শীতল চাহনিতে।ভাবে, অহি? অহি কি তাকে দেখেনি? শুধু আবিদকেই চোখে পড়েছে নাকি এই মেয়ের? এতসব কিছু ভাবতে ভাবতেই অহি হঠাৎ তার সামনে এল। হেসে বলল,
“ আর তুমি সাদ ভাইয়া। চিনেছো আমায়, তোমার বিয়েতে সেদিন ছিলাম আমি সাদ ভাইয়া। ”
#চলবে….