মন আকাশে তুই পর্ব-০৫

0
21

#মন_আকাশে_তুই
#পর্ব_০৫
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি

অহি সেদিনই বাসা ছেড়ে ফের ফিরে গেল ভাড়া বাসাটায়। হৃদি হৈমি সহ মোটামুটি ভাবেই সময় গেল তার। প্রায় ছয়মাস। ছয় ছয় মাস কাঁটল এমনি এমনিই। অথচ সেদিনের পর সাদিদের সাথে আর কথা হলো না তার। নিরবে আগের মতোই সোশ্যাল মিডিয়ায় ফলো করেছে কেবল মানুষটাকে। আর মাঝেমধ্যেই হৈমির থেকে খোঁজ পেয়েছে। এটুকুই! তারপর হুট করেই ছয়মাস পর একদিন অহি ভার্সিটি থেকেই বাসায় ফিরছিল। সাথে অবশ্য তাসিন হৈমিও ছিল। কিছুটা পথ হেঁটে যাওয়ার পর আচমকায় ওদের সামনে এসে একটা বাইক থামল। প্রথম দফায় তিনজনেই চমকালেও পরমুহুর্তে সামলে নেয়।অহি তাকিয়ে দেখে কেবল। সাদিদ? নাকি আবিদ? বুঝার জন্য ফ্যালফ্যাল করে চাইতেই সাদিদের নাকের ডগা লালচে দেখে বুঝতে পারল এটা সাদিদ। কয়েক মাস পর এভাবে দেখা পেয়ে প্রথম দফায় ড্যাবড্যাব করে তাকালেও পরমুহুর্তে নজর সরায় সে। সাদিদ তখন কেবল শুধাল,

“ উঠে বস। বেশি সময় নেই আমার হাতে। ”

অহি মাথা নাড়াল কেমন যেন বাধ্য মেয়ের মতো। একবার হৈমি আর তাসিন এর দিকে তাকাল না উঠে বসে। সাদিদ ফের বলল,

“ কি হলো? উঠতে বললাম তো তোকে। ”

অহি এবারে উত্তর করল,

“ উঠছি। ”

এইটুকু বলেই সে উঠল। ঠিক পরমুহুর্তেই সাদিদ বাইক স্টার্ট করল। হৈমি আর তাসিনের সাথে একটা শব্দ পর্যন্ত বলার প্রয়োজন বোধ করল না। হৈমি আর তাসিন অবশ্য সাদিদের এহেন আচরণে পেছন থেকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েই থাকে কেবল!

অহি বাইকে বসলেও বেশ দূরত্বই রাখল দুইজনের মাঝে। সাদিদের কাঁধ চেপে ধরবে ভেবেও ধরল না। সাদিদ একবার মিররে তাকিয়ে দেখল। ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,

“ এতোটা সময় আস্তে চালিয়েছি, এখন গতি বাড়ালে তুই যদি মাঝরাস্তায় পড়ে যাস তাহলে আমি তোকে ওভাবেই মাঝরাস্তায় ফেলে চলে যাব অহি। ”

অহি ভয় নিয়ে তাকায়। পড়ে গেলে তাকে ফেলে চলে যাবে? কি নির্দয়? একটুও মায়াদয়া নেই? সাদিদ ফের আবারও বলল,

“ধর আমায়। ধরে বসলে পড়বি না। ”

অহি এবারেও তাকিয়ে থাকেই। ধরল না। সাদিদ আবারও ভ্রু কুঁচকে বলল,

“ আমার জায়গায় ঐ তাসিন থাকলে তুই ধরে বসতি? আমি বলে বসছিস না রাইট? ”

অহি ছোটশ্বাস ফেলে। হাত এগিয়ে সাদিদের কাঁধ আঁকড়ে ধরে। সাদিদের চুল গুলো ঘন, গাঢ়। অহি পেছন থেকেই ঘন চুলে তাকিয়ে বলে,

“ তাসিন কেবল আমার ফ্রেন্ড সাদ ভাইয়া। বিশ্বাস না হলে হৈমিকেও জিজ্ঞেস করতে পারেন। ”

” কিন্তু আমি শিওর, ও তোকে ফ্রেন্ড হিসেবে দেখে না। ”

“ আপনার ভুল ধারণা হয়তো। ও সত্যিই আমার খু্ব ভালো ফ্রেন্ড। অন্য চোখে দেখার প্রশ্নই উঠে না। আমি ওকে খুবই বিশ্বাস করি। ”

সাদিদ ভ্রু বাঁকায়। হঠাৎ বাইক থামাল রাস্তায় এক সাইড করে। অতঃপর ঘাড় ঘুরি অহির দিকে তাকাল। চোখ ছোটছোট করে দাঁতে দাঁত চেপে সে শুধু শুধাল,

“ ওহ, খুব ভালো ফ্রেন্ড? খুব বিশ্বাস করিস?”

সাদিদ রাগ ভঙ্গিতে বলেনি কথাগুলো তবুও স্পষ্ট টের পাওয়া গেল সে কথাগুলো রেগেই বলেছে। অহি তাকিয়ে ছোটশ্বাস টেনে কিছু বলতে নিতেই সাদিদ বলল,

“ বাইক থেকে নাম।

অহি নামল না। সাদিদ আবারও বলল,

“ কি হলো নাম? ”

অহি নামতে চাইল না। শুধাল,

“ এভাবে মাঝরাস্তায় নামব কোন কারণে? ”

“ কারণ মাঝরাস্তা থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তোর বিশ্বস্ত ফ্রেন্ড আছে। নেমে যা৷ ”

অহি চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকে। নামে না। উত্তর করে,

“ আপনিও বিশ্বস্ত। বিশ্বাস না করলে আপনার সাথে সাথে একা একা চলে আসতাম না। ”

সাদিদ ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,

“ তো? এসে কি খুব মহান কাজ করেছিস?আমার এখন তোর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত আসার জন্য?”

অহি ছোটশ্বাস টানল। সাদিদের দিকে তাকিয়ে থেকে শুধাল,

“ তুমি কি সবসময় এমন রেগে থাকো সাদ ভাইয়া? ”

সাদিদ নিজেই নিজেকে প্রশ্নটা করল। আসলেই কি সবসময় রেগে থাকে সে? অথচ একটু আগেই অহির ভাই অহনের সাথে ভালোরকমের আড্ডা দিয়েছে সে। আবিদের সাথে একটা দস্তাদস্তি মারপিট করে এসেছে। তখন তো রাগ হয়নি। সে উত্তর করল,

“ আজকাল তোকে দেখলেই আমার রাগ লাগছে। ”

অহি কেমন করে যেন তাকায়। তাকে দেখলেই কেন রাগ লাগবে এই পুরুষটার? সবসময় কি এমন রাগই দেখাবে তাহলে তাকে? অহি মায়ামায়া চাহনিতে তাকিয়ে হুট করে বলল,

” তাহলে কি আমি চলে যাব সাদ ভাইয়া? রাগ লাগবে না আর? ”

সাদিদ এখনও ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে থাকে। দৃষ্টি যেন স্পষ্ট বলছে, নেমে দেখ কেবল! সাদিদ সামনের দিকে ফিরল এবার৷ অহি আবার ও বলল,

“ নেমে যাব সাদ ভাইয়া? ”

“ তোর ইচ্ছে!”

অহি উত্তরটা পেয়ে নামবে কি নামবে না দ্বিধায় ভুগল। আবারও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল,

“ বাইক কি চালাবেন না? ”

সাদিদের স্পষ্ট উত্তর,

“ না। ”

অহি এবারে সে বাচ্চাকালের মতো করেই ভয় ভয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

“ আমি তাসিনের সাথে কম মেশার চেষ্টা করব। আমি স্যরি এর জন্য। সত্যিই স্যরি।আর হবে না। ”

সাদিদ তবুও কিয়ৎক্ষন চুপ থাকল। পরমুহুর্তেই কেন জানি হেসে ফেলল অহির আড়ালে৷ বাইকটা হুট করেই স্টার্ট দিল। আকস্মিক বাইক স্টার্ট দেওয়াতে অহি কিছুটা ভয়ই পেল। সাদিদের কাঁধের দিকটায় খামচে ধরল যেন৷

অহিকে নিয়ে মোটামুটি চারঘন্টা সময় লাগিয়ে একগাঁধা কেনাকাটা করল সাদিদ। নিজের জন্য এবং অহির জন্য। অহি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে তাকিয়ে কেবল হ্যাঁ না করে যাচ্ছিল যেন। অবশেষে শেষ মুহুর্তে এসে প্রশ্ন ছুড়ল সে,

“ সাদ ভাইয়া? আমরা এত কেনাকাটা কেন করলাম? লেহেঙ্গা, শাড়ি এতসব কেনার কি অর্থ? ”

সাদিদ ফোঁস করে শ্বাস ফেলে তাকায়। উত্তরে বলে,

“ ছয়মাস টাইম এনাফ না তোর সংসার সম্পর্কে জানার জন্য? বিয়ে নিয়ে নিশ্চয় সব জেনে বুঝে নিয়েছিস অহি। এখন আর কোন সমস্যা নেই নিশ্চয় তোর? ”

অহি আগের মতোই তাকিয়ে থাকে। বিয়ে? কেমন যেন শীতল অনুভূতি ছুঁয়ে গেল মনে হলো। এই মানুষটাকে বিয়ে করবে? সত্যিই এই মানুষটার সাথে বিয়ে হচ্ছে তার? অবিশ্বাস্য এই অনুভূতিতে তার আনন্দ আনন্দ লাগে যেন। আবারও কেমন অস্বস্তি ভয় ও হচ্ছে। সে তো সত্যিই এই ছয়মাসে ও সংসার সম্পর্কে কিচ্ছু শিখেনি৷ নিরাশ চাহনিতে বলল,

” আপনি তো বলেননি ছয়মাস পর বিয়ে করবেন, তাহলে সংসার সম্পর্কে সব জেনে নিতাম। ”

“সমস্যা নেই, না জানলে আমি জানিয়ে দিব। আই থিংক, আমি সব জানি৷ ”

শেষের বাক্যটা সাদিদ কিছুটা হেসেই বলল। সাদিদকে অহি খুব একটা হাসতে দেখেনি। কেমন যেন রাগ রাগ সবসময়। এখন হাসতে দেখে সে তাকায় মুগ্ধ চাহনিতে। হেসে সেও বলে,

“ আমি তো আরো ভেবেছিলাম আপনি আমার বিষয়টা ভুলে নিনীকে বিয়ে করে নিচ্ছেন। ”

সাদিদের হাসি হাসি মুখটা আবার কেমন হলো। অহির দিকে চেয়ে উত্তর করল,

“ তোকে যখন এতবছরেও ভুলতে পারিনি তখন এই ছয় মাসে ভুলে যাব এটা ভাবা বোকামো অহি। ”

অহি চুপ থাকে। কিয়ৎক্ষন পর আবার বলে,

“ বিয়ের সিদ্ধান্ত পরিবার থেকে নিয়েছে? আব্বু আম্মু তো কিছু বলল না। ”

“ না নিলে কি করবি না বিয়ে আমাকে? ”

“ করব। ”

সাদিদ হেসে বলে,

“ অতোটা সাহস তোর মধ্যে দেখি না আমি।”

অহি এর বিরোধিতা করে দ্রুতই বলল,

“ কেন? আমি সত্যিই আপনাকে ভালোবাসি।এই সাহসটা আমি করতে পারব অবশ্যই। ”

সাদিদ ঠোঁট কাঁমড়ে হাসে। বলে,

“ ভালো তো। আমিও দেখি আবির আঙ্কেলের পুতুলের মতো মেয়ের কত সাহস।চল, এক্ষুনি গিয়ে বিয়েটা করে ফেলি। ”

অহি মুহুর্তেই বলে উঠল,

“ বিয়েটা আমি পারিবারিক ভাবেই করব সাদ ভাইয়া। আমার বিশ্বাস আছে আব্বু আম্মুর প্রতি। উনারা আমায় বুঝবেন। কেন জেনে বুঝে শুধুশুধু তাদের কষ্ট দিয়ে নতুন জীবন শুরু করব বলুন? ”

“ উনাদের কষ্ট না দিয়েই শুরু কর তাহলে। ”

এটুকু বলেই সাদিদ বাইক চেপে বসল। অহিকে উঠার জন্য বলতে অহিও উঠল। শুধাল,

“ রাগ করলে তুমি? ”

সাদিদ বাইকের মিররে তাকিয়ে অহির মুখটা দেখে। বলল,

“ না, তবে তোর কখনো আপনি, কখনো তুমিটা কিসের উপর নির্ভর করে ঠিক বুঝলাম না। ”

অহি এবারে আর উত্তর করে না। সে নিজেও জানে না কখন তুমি বলে, কখন আপনি বলে। মিক্স হয়ে যাচ্ছে অনেকটা। সাদিদ ফোঁস করে শ্বাস টেনে বলল,

“ আবিদই জিতে গেল। দুই দুইবার বিয়ে করে নিয়েছে অলরেডি।আমি পিছিয়ে গেলাম। ”

অহি আগ্রহ নিয়ে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গেই বলল,

” হৈমি ছাড়া আর কাকে বিয়ে করেছে? হৈমির আগেও একবার বিয়ে করেছে? আমি দেখেছিলাম আদ ভাইয়ার আইডিতে ম্যারিড স্ট্যাটাস।মনে মনে এই প্রশ্নটা ছিল ও। ”

সাদিদ চাপা হেসে উত্তর দিল,

“ হৈমিকেই। ওরা পারিবারিক ভাবে বিয়ের বছরখানেক আগেই বিয়ে করে নিয়েছিল।”

অহি বোকার মতো চেয়ে থাকে। হৈমি? হৈমিকে বিয়ে করেছে? অথচ তারা এতদিন হৈমির সাথে থেকেও বুঝল না? বলল,

“ হু? হৈমি? আমরা বুঝলামই না এতগুলোদিন? হৃদি আপু আর আমি কি বোকা! বুঝলামই না। ”

“ বোকাই তো। বুদ্ধির ছিঁটেফোটাও তো নেই তোর মাঝে। ”

অহি আবারও শুধাল,

“ বুদ্ধির ছিঁটেফোটা নেই?বুদ্ধিহীন আমি? ”

“ অবশ্যই, সে ছোটবেলা থেকেই তুই বুদ্ধিহীন। ”

অহি আর কিছুই বলে না। কেমন মুখ ফুলিয়ে রাখে চুপ থেকে। তার বুদ্ধি নেই? সত্যিই বুদ্ধি নেই? তাকে বুদ্ধিহীন বলতে পারল এভাবে?

.

অনেকটা সময় পার হওয়ার পর বাইক এসে থামল একদম অহির বাসার সামনেই। যেটা ওর নিজের বাসা। যদি ও আজ তার বাসায় ফোরার কথা ছিল না। অহি চোখ ছোটছোট করে তাকিয়েই বলল,

“ সোজা এখানে?”

“ তোকে এখানে আজকে এমনিতেই আসতে হতো। বাস জার্নি না করে আমি এনে দিলাম, তোর তো খুশি হওয়া উচিত। ”

অহি আবারও বলল,

“ কেন আসতে হতো? বিয়ে কি আজই? ”

সাদিদ হেসে ফেলল এবারে। বলল,

“ না।”

অহির মুখ তখনো আগের ফোলা মনে হলো যেন। বোধহয় রাগ করেছে তাকে বুদ্ধিহীন বলাতে। অহি ফের বলল,

“ কোনদিন তাহলে? ”

সাদিদ ঠোঁট চেপে হাসে। ভ্রু উঁচিয়ে বলে,

“ খুব আগ্রহ দেখছি তোর। ”

“ কৌতুহল। ”

সাদিদ ফের হেসে বলল,

“ তোর বাপ মা বলবে কবে বিয়ে। ভেতরে যা৷”

#চলবে…