মন একে একে দুই পর্ব-১৪+১৫

0
6

#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ১৪(এলোমেলো)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী

ওড়নার কোনা দ্বারা মুখটা মুছতেই আকসাদ পাশ হতে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
– ‘বাইরে এভাবে আর আইসক্রিম খাওয়া যাবেনা দেখছি! নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে বেশ বেগ পেতে হয়!’

প্রাহী মনে মনে বলে উঠলো, নিয়ন্ত্রণ! কিসের নিয়ন্ত্রণ এর কথা বলছে এই লোক! আড়চোখে তাকাতে দেখলো সম্মোহনী ওই চোখজোড়ার নজর ওর দিকেই! প্রাহী দৃষ্টি সরাতেই আকসাদ বললো,
– ‘এখন থেকে ঘরে আইসক্রিম খাবেন! বাইরে আর খাওয়া চলবে না!’

প্রাহী বুঝতে না পেরে বললো,
– ‘কেন!’

আকসাদ শান্ত কন্ঠে উত্তর দিলো,
– ‘যাতে অগোছালো মুখখানা আর কারো খেয়ালে না আসে তাই!’

প্রাহী থম চোখে তাকিয়ে রইলো আকসাদের দিক! ও অগোছালো! আকসাদের এহেন কথায় হালকা ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
– ‘আপনি…’

– ‘কি রে তোর আইসক্রিম টা তো মাটিতে পড়ে গেলো!’

শিমলার কথায় আকসাদ দেখলো আসলেই হাতের আইসক্রিম টা মাটিতে পড়ে রয়েছে। আকসাদ বাঁকা হেসে প্রাহীকে বললো,
– ‘ওহো মিস প্রাহী! আইসক্রিম টা তো পড়ে গেলো! আরেকটা এনে দিব!’

প্রাহী শুষ্ক ঠোঁটজোড়া আবারও ভিজিয়ে বলে উঠলো,
– ‘না আর আনা লাগবে না!’
অতঃপর শিমলার দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘পানি হবে তোর কাছে! একটু হাত টা ধুতাম!’

শিমলা মাথা নেড়ে পানির বোতলটা ব্যাগ থেকে বের করে দিতেই প্রাহী হাতটা ধুঁয়ে নিলো।

– ‘আচ্ছা চলো এবার! রোদের মাঝে আর দাঁডিয়ে থাকা উচিত না।

আকসাদের কথায় শিমলা মাথা নাড়িয়ে প্রাহীকে নিয়ে গাড়ির দিক এগিয়ে গেলো। বরাবরের মতো প্রাহী পিছন সিটেই শিমলা আর আকসাদ সামনের দিকটায় বসেছে। জানালা থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকালো। গাড়ি চালাতে চালাতে আকসাদ ফ্রন্ট মিরোরে চোখ রাখতেই দুজনের চোখাচোখি হতেই প্রাহী চোখ নামিয়ে জানালার সাথে আরও গুটিয়ে বসে বাহিরে তাকালো। আকসাদ হালকা হেসে ড্রাইভিং এ মন দিলো।

গাড়ি থেকে নেমে প্রাহী শিমলাকে হাতের ইশারায় বিদায় জানাতেই আকসাদ পাশ থেকে বলে উঠলো,
– ‘বাই মিস প্রাহী! আবার দেখা হবে!’
বলেই আকসাদ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো। প্রাহী আকসাদের দূড়ন্ত গতিতে চলতে থাকা গাড়ির দিক তাকিয়ে মনে মনে বলে উঠলো, ‘দেখা! সে তো না চাইতেও হয়ে যায়!’। ছোটো একটা শ্বাস ফেলে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলো প্রাহী। মেইন গেটের কাছে আসতেই দেখলো নক্ষত্র এক ভ্রু উঁচিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

– ‘আজকেও গাড়ি দিয়ে এসেছিস!’

প্রাহী হালকা মাথা নেড়ে বললো,
-‘হু

– ‘গাড়িতো মনে হয়না তোর ওই চামচিকা চালাচ্ছিল! তা ড্রাইভিং সিটে বসা ছেলেটা কে!’

প্রাহী ধীর কন্ঠেই বললো,
– ‘শিমলার কাজিন!’

নক্ষত্র চোখ ছোটো ছোটো করে বললো,
– ‘কাজিন মানে!’

প্রাহী বিরক্তিদৃষ্টি নিয়ে বললো,
– ‘কাজিন মানে বুঝিস না! চাচাতো ভাই হয় ওর!’

– ‘কখনও তো দেখলাম না একে!’

– ‘বিদেশে থাকে দেখবি কিভাবে! সামনে থেকে সর।! গরমে দাঁডিয়ে তোর জেরা শুনতে ভালো লাগছে না। বাসায় যাই। একটু শান্ত হই পরে যা জিজ্ঞেস করার করিস।’
বলেই নক্ষত্রকে সরিয়ে গটগট পায়ে বাডির ভিতর চলে গেলো।

নক্ষত্র প্রাহীর দিক তাকিয়ে বের হয়ে বাড়ির দরজা আঁটকে চায়ের দোকানের দিক রওনা দিলো। এখন ওর হয় ঠান্ডা বা গরম জাতীয় কিছু একটা খেতে হবে।

– ‘তুই এ ঘরে!’

আকসাদের আওয়াজ পেয়ে শিমলা ঘাড় ঘুরিয়ে হালকা হেসে বললো,
– ‘ছোটো কাকী বললো তোমার বিছানায় নাকি ছোটো ছাড়পোকা পাওয়া গেছে! তাই একটু ঝেড়ে দিয়ে গেলাম। আজ দেখো আবার কিছু পাও কি না! তোষকটা না হয় চেঞ্জ করাতে হবে!’

আকসাদ পকেট থেকে ফোন বের করে ড্রয়ারে রাখতে রাখতে বললো,
– ‘আচ্ছা জানাবো। আমি এখন ফ্রেশ হবো। নিচে যেয়ে বলিস লাঞ্চ টা পরে করবো। খিদে নেই আপাতত।’

শিমলা মাথা নেড়ে রুম হতে বেরিয়ে দরজা চাপিয়ে দিলো। আকসাদ এদিকে দরজা লক করে ফ্রেশ হতে চললো। ফ্রেশ হয়ে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছতে লাগলো। কানাডা থেকে আসার সময় হেয়ার ড্রায়ারটা নিয়ে আসা হয়নি। এখন ওর চুলগুলো ফ্যানের বাতাসেই শুকাতে হবে! হালকা একটা শ্বাস ফেলে চওড়া শরীরটাকে হালকা নীল টিশার্ট আর হোয়াইট ট্রাউজার পরে বারান্দায় যেয়ে বসলো। সবে মাত্র বিকেল হচ্ছে। পিচ্চি ছেলেমেয়েগুলো সাইকেল নিয়ে নেমেছে, কারো হাতে ব্যাট আবার কারো হাতে ফুটবল! আকসাদের ছোটোবেলাতেই কানাডাতেই কেঁটেছে। খেলাধুলার প্রতি ওর অনেক ঝোঁক ছিলো এবং এখনও আছে। পড়াশোনার পাশাপাশি অনেক স্পোর্টস ক্লাবে ওর নাম ছিলো। সপ্তাহে ২ বা ১ দিন সেসব জায়গায় যেয়ে ম্যাচ খেলে আসে। বাড়ির সামনের মাঠের ছেলেগুলো ক্রিকেট খেলছে এখন৷ ওদের ব্যাটিং করার সিস্টেম দেখে আকসাদ হালকা হাসলো। ব্যাট ভালোমতো না ধরতে না পারলেও ঠাসঠুস মেরে ছয়, চার মেরে যাচ্ছে। আকসাদ রেলিং এ ভর করে হালকা চেঁচিয়ে বললো,
– ‘হেই বয়েজ! আর একজন নেয়া যাবে নাকি!’

ছেলেগুলো নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ চাওয়াচাওয়ি করে ‘হ্যাঁ’ বলতেই আকসাদ রুমে যেয়ে চুলগুলো ব্যাক ব্রাশ করে নিচে চললো।

ভাত খেয়ে একটা ঘুম দিয়েছিলো প্রাহী। মাত্র উঠলো! সন্ধ্যে হয়ে এসেছে প্রায়! এক কাপ কড়া চা দরকার ওর এখন। ঘুমঘুম চোখে নিচে নামতেই দেখলো নক্ষত্র চা বানিয়ে কাপে ঢালছে। মা নেই! হয়তো ঘুমে বা নামাজে। রান্নাঘরে যেতেই নক্ষত্র ওর দিক চেয়ে বললো,
– ‘এক কাপ চা বেশি বানিয়ে ফেলেছি খাবি!’

প্রাহী এক চোখ ডলতে ডলতে বললো,
– ‘হু! দে।’

নক্ষত্র আরেক কাপে চা ঢেলে ওর হাতে দিয়ে ড্রয়িংরুমে সোফাতে যেয়ে বসলো। প্রাহীও ওর পিছু পিছু চা সহো টোস্টের পট টা নিয়ে সোফায় বসে চা দিয়ে টোস্ট ভিজিয়ে খেতে লাগলো। টিভিতে ইংলিশ মুভি চলছে। থ্রিলার মুভি ‘দ্য পেল ব্লু আই’। ছবিটা সুন্দর। দৃশ্যপটে একটা ছেলেকে দেখে কেন জানিনা হুট করে প্রাহীর আকসাদের কথা মনে পড়ে গেলো। ছেলেটার গায়ের রঙ আর চুলগুলো আকসাদের মতোই। আশ্চর্য ওর ওই লোকটার কথা কেন মনে পড়লো! হালকা একটা শ্বাস ফেলে প্রাহী ভাবতে থাকলো আকসাদ মানুষটা আপাতত ওর জন্য যথেষ্ট রহস্যময়! তাকানো, কথাবার্তা, ব্যবহার সবই কেমন যেন ওর কাছে অন্যরকম লাগে! তার মধ্যে যেভাবে তাকায়! ভিতরের ছোট্ট মাংসপিণ্ডটা যেন কড়া নারে!

– ‘আরে এই ধেন্দী!’

প্রাহীর আচমকা ধ্যান ভাঙলো। নক্ষত্রের দিক তাকাতেই দেখলো ও ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।

– ‘কি সমস্যা!’

নক্ষত্র ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
– ‘কি সমস্যা মানে! তোর কি হয়েছে! কতক্ষণ ডাকলাম খবর আছে! কোন ধ্যানে ছিলি! চায়ের বিস্কিট গলে কাপে ভাসছে খেয়াল আছে!’

প্রাহী চায়ের কাপে তাকাতেই দেখলো আসলেই তো! বিস্কিট টা নরম হয়ে ভেঙে চায়ে পড়ে গেছে! চটজলদি বিস্কিট টা সরিয়ে আরও একটা বিস্কিট নিয়ে যত ভাবনা চিন্তা আছে সব বাদ দিয়ে আপাতত টিভির দিকে খেয়াল দিলো। মুভি শেষে দু’ভাইবোন উপরে যার যার রুমের দিক চললো।

রাত তিনটা। আকসাদের চোখে ঘুম নেই! বিকেলে অনেকক্ষণ বাচ্চাদের সাথে খেলে এসে সন্ধ্যার চা নাস্তা খেয়ে রুমে এসে একটু ঘুমিয়েছিল৷ রাতের খাবার খেয়ে মা কফি দিয়ে গিয়েছিলো। এখন আর ঘুম আসছে না! বারান্দার ডিভানে হেলান দিয়ে চিন্তাভাবনার মাঝেই পরিচিত সুরে ওর ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনটা ধরার সাথে সাথেই ও পাশ থেকে কেউ গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,
– ‘আর ইউ ট্রায়িং টু এভোয়েড মি আকসাদ!’

আকসাদ চুলগুলো হাত দিয়ে পিছনে নিতে নিতে বললো,
– ‘নো!’

– ‘তাহলে ফোন কেন ধরছিস না এই দু’দিন ধরে!’

আকসাদ কিছু না বলে চুপ করে রইলো।

– ‘আকসাদ সে সামথিং! এভাবে দায়িত্বহীনদের মতো কাজ করছিস কেন! তুই গিভ আপ করতে চাচ্ছিস!’

আকসাদ চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস ফেলে বললো,
– ‘সেরকম কিছুই না! এদিকটা সামলে উঠিনি এখনও! কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিনা!’

– ‘এখনও সামলাসনি মানে! নরমাল একটা ম্যাটার!’

আকসাদ রেলিং এ বারি মেরে বললো,
– ‘ইট্স নট এ নরলাম ম্যাটার! সময় লাগবে আরও!’

– ‘আকসাদ আমি এদিকটা সামলাতে পারছিনা একা হাতে! ওখানে থেকে তুই যা হেল্প করছিস সেটায় হচ্ছেনা। যা করার তাড়াতাড়ি করে ব্যাক কর। আমি পরে আবার ফোন দিব। আপাতত রাখছি।’

আকসাদ ফোনটা হাতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বাইরের দিক তাকালো। কিভাবে কি ম্যানেজ করবে বুঝতে পারছেনা। তারমধ্যে ওদিকের অবস্থাও ভালোনা। এদিকটা যদি একটুও ম্যানেজ হয়নি! তাহলে কিভাবে কি! দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকসাদ বাইরের দিক তাকিয়ে রইলো। নিকষ অন্ধকারে ভাবনার মাঝে ডুবেই অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো,
‘সবকিছু তো এলোমেলো করে দিলেন! কি করা উচিত আপনাকে বলুন তো!’
বলেই আকসাদ হালকা হেসে ঘরের দিক চলে গেলো।

চলবে,,,

#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ১৫(কে বাঁচাবে!)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী

‘সবকিছু তো এলোমেলো করে দিলেন! কি করা উচিত আপনাকে বলুন তো!’
বলেই আকসাদ হালকা হেসে ঘরের দিকে চললো।

– ‘দে এভাবে হাত দিয়ে খাবিনা!’
নক্ষত্রের হাত থেকে ছোঁ মেরে আচারের বয়োম টা নিয়ে নিলো প্রাহী। নক্ষত্র বিরক্তিসহিত ভ্রু কুঁচকে সেদিক তাকিয়ে রইলো। প্রাহী আচারের বয়োমগুলো খুলে খুলে দেখতে লাগলো। মুখটা বেজার করে নক্ষত্রের দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘আচারের ফাঙ্গাসগুলো যায়নি! অথচ অনেকক্ষণ ছাদে রেখেছি!

নক্ষত্র ছাদের রেলিং এ বসতে বসতে বললো,
-‘আজকের আকাশটা মেঘলা। তেমন কড়া রোদ পড়েনি। কাল বা পরশু রোদ উঠলে সকাল সকাল দিয়ে যাস!’

প্রাহী মাথা নাড়িয়ে আচারের বয়োম গুলো সরিয়ে একপাশে রাখলো। নক্ষত্রের পাশে যেয়ে রেলিং এ পা ঝুলিয়ে বসলো। আকাশটা আজ সত্যিই মেঘলা! নীল রঙের মাঝে সাদা মেঘ হিজিবিজি অবস্থায় লেপ্টে আছে। বৃষ্টি আসবে হয়তো! প্রাহী নক্ষত্রের দিক ফিরে বললো,

– ‘তুই ঢাকায় যাবার আগে আমাকে দুটো চারা কিনে দিয়ে যাস তো!’

– ‘কিসের চারা!’

– ‘একটা সাদা গোলাপ আর গন্ধরাজের চারা। জবা ফুলেরও যদি পাস তাহলে ওটাও এনে দিস!’

নক্ষত্র মাথা নাড়িয়ে বললো,
– ‘আচ্ছা। কাল সকালে বের হবার আগে মনে করিয়ে দিস!’

প্রাহী মাথা দুলিয়ে চারপাশের পরিবেশটা উপভোগ করতে লাগলো। আজকে তেমন বাতাস নেই নইলে একটু ঘুড়ি উড়ানো যেতো! সন্ধ্যার আভা দেখা দিতেই দু’ভাইবোন নিচে নেমে গেলো।

– ‘বাকি শিপমেন্ট গুলো আপাতত না হয় থাকুক! ওগুলো পরে পাঠাব।’

ওপাশ থেকে কিছু কথার প্রেক্ষিতে আকসাদ সাথে সাথেই বলে উঠলো,
– ‘নিউ কোনো শিপমেন্ট আপাতত পাঠাতে চাচ্ছিনা! আমি আসি আগে তারপর! ফর নাও যা বলেছি তাই করো। আন্টিল আই কাম ব্যাক!’

আরও কিছু কথা বলে আকসাদ ফোনটা পকেটে রেখে কোনো ল্যাপটপটা ওন করে কিছু ডকুমেন্টস চেক করলো। ই’মেইলের রিপ্লাই গুলো দিয়ে কিছু ফাইল চেক করে তা নিজের পেনড্রাইভে নিয়ে নিলো। প্রায় এক ঘন্টা যাবত ল্যাপটপে আঙুল চালিয়ে মাথা টা চেয়ারে এলিয়ে দিলো। প্রচুর মাথা ব্যথা করছে ওর! এক কাপ কফি এখন খুবই দরকার। ল্যাপটপ টা চার্জে দিয়ে চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করতে করতে বারান্দায় যেয়ে বসলো। ফোনটা বের করে টাইম দেখলো। রাত এখন প্রায় এগারোটা। কিছুক্ষণ পর ডিনারের জন্য নিচে যেতে হবে। কিন্তু এখন ওর কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না আপাতত। দাঁড়িয়ে মাথাটা রেলিং এ এলিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো। হুট কাঁধে কারো স্পর্শ পেতেই পাশ ফিরে দেখলো ওর মা দাঁডিয়ে। হাতে মগ ভর্তি কফি! আকসাদ ঠোঁটের কোনে হাসি টেনে মায়ের হাত থেকে কফি নিয়ে দু’একটা সিপ নিয়ে বললো,

– ‘ব্লাক কফি! বেডলিইইই নিডেড দিস! থ্যাংক ইউ মা!’

আকসাদের মা হালকা হেসে বললেন,
– ‘ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম! অনেকক্ষণ ধরে নিচে যাচ্ছিস না। তাই ভাবলাম মাথা টাথা ধরলো কি না! তাই এটা নিয়ে এলাম!’

আকসাদ হালকা হেসে বললো,
– ‘হুউ! মাথা আসলেই ধরেছে অনেক!’

আকসাদের মা বাইরে তাকিয়ে বললেন,
– ‘ধরতেই পারে! ওয়েদার চেঞ্জের জন্য মাঝে মাঝে এমনটা হয়! যাই হোক ক্রিম নিয়ে এসেছি! কফিটা শেষ করে মাথায় লাগিয়ে নিস!’

আকসাদ কফিতে লাস্ট সিপ দিয়ে বললো,
– ‘স্টপ মা! আমার কফি শেষ! তুমি একটু ক্রিমটা লাগিয়ে দাও না প্লিজ!’
চুলগুলো এলোমেলো করে বললো,
– ‘নিজ হাতে দিতে ইচ্ছে করছে না!’

আকসাদের মা ছেলের মুখের দিক তাকিয়ে ফিক করে হেসে বললেন,
– ‘ভিতরে আয়! বিছানায় বসছি আমি!’

আকসাদ কফির কাপটা ল্যাপটপ এর পাশে রেখেই বিছানায় যেয়ে মায়ের কোলে রাখা বালিশটার উপর মাথাটা রাখলো। আকসাদের মা কিছুক্ষণ ছেলের ঘন চুলে হাত বুলিয়ে কপাল কুঁচকে বললেন,
– ‘তোর তো দেখছি মাথার গোড়ায় গোড়ায় ঘেমে আছে! মাথা তো ব্যথা করবেই!’

আকসাদ মাথা নেড়ে বললো,
– ‘হু! হতে পারে!’

আকসাদের মা ক্রিম হাতে নিয়ে কপালে লাগাতে লাগাতে বললেন,
– ‘হতে পারে মানে! চুলপুরো ভিজা! হুট করে এদেশে এসেছিস! ওয়েদারের সাথে একটু তাল মিলাচ্ছে এরকমটা হচ্ছে! ঘরে তো এসি আছে সেটা চালিয়ে ঘুমাস না!’

আকসাদ বুকে হাত ভাজ করে পা নাড়াতে নাড়াতে বললো,
– ‘চালাই। রাতে বাইরের বাতাসটা ঠান্ডা লাগে এজন্য…।’

– ‘না চালিয়ে শুবি! ঠান্ডা লাগানোর কোনো মানে হয়না!’

আকসাদ মাথা নেড়ে চুপ করে রইলো। আকসাদের মা নিবিড়ভাবে কপালের দুপাশে ক্রিম দিয়ে ম্যাসেজ করে দিচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে ম্যাসেজ করার পর ছেলের মাথায় তিনি এখন হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
– ‘আকসাদ কিছু কথা ছিলো!’

কিছুক্ষণ পর উনি নিজ থেকেই বলে উঠলেন,
– ‘তোর ছোট বোনটার রেজাল্ট বেরিয়েছে। ওর এখন একটা…।’

আকসাদ এর তরফ থেকে অনেকক্ষণ ধরে কোনো উত্তর না পেয়ে আকসাদের মা হালকা ঝুঁকে দেখলেন ছেলে তার ঘুমে কাদা। হালকা একটা শ্বাস ফেলে ছেলের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আয়লিনা হোসেন। ছেলেকে যা বলতে এসেছেন তার কিছুই বলতে পারলেন না তিনি! ওদিকে সময়ও কম! আকসাদের বাবাও ঢাকায় গেছেন দুইদিন হয়েছে। আজ আসবে হয়তো! বালিশসহ ছেলের মাথাটা আলতোভাবে রেখে গায়ে হালকা মোটা চাদরটা দিয়ে মিডিয়াম পাওয়ারে এসিটা ছেড়ে দিলো। রুম থেকে বের হওয়ার আগে ল্যাপটপের পাশ থেকে কফির মগ টা নিয়ে লাইট নিভিয়ে দরজাটা লক করে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে খাবারের বাটিটা ভালোমতো ঢেকে রেখে দিলেন। ছেলে তার মাঝ রাতে অবশ্যই উঠবে! খিদে পেলে এখানে থেকেই খেয়ে নিবে!

দুপুরের দিকটা প্রাহী ধীরে ধীরে পুকুরপার ধরে হেঁটে যাচ্ছে। বিলগুলোর দিকে ভালোমতো দেখে দেখে এগিয়ে যাচ্ছে। নাহ্! শাপলা নেই কোথাও! ভরা বিলের সব শাপলা আশেপাশের মানুষ নিয়ে খেয়ে ফেলেছে! হালকা শ্বাস ফেলে পাশের দোকান থেকে একটা ব আঁচার কিনে সেটা খেতে খেতে আগাচ্ছে ও। ওর মা বলেছিল আজ মাছ দিয়ে না চিংড়ি দিয়ে শাপলা রাঁধবে। আশেপাশে কোথাও পেলে যাতে নিয়ে আসে! ওর বাবাও খেতে চেয়েছিলো। প্রাহীরও শাপলার তরকারি বেশ পছন্দের! ভার্সিটি থেকে তাই আজ সোজা চেনা পুকুর,ডোবা,বিলগুলোর আশপাশ হেঁটে যাচ্ছিলো যদি কোথাও শাপলার দেখা মিলে তাহলে সেগুলো নিয়ে বাড়ি ফিরবে! কিন্তু কোথাও নেই! হুট করে একটা বিলের সামনে আসতেই ও থেমে গেলো। আচার এর বিচিটা মাটিতে ফেলে বিলের দিক তাকাতেই দেখলো ভালোই শাপলা আছে এই বিলে! পানিগুলোও পরিষ্কার! আর বেশ কাছেও শাপলাগুলো! বেশি দূরে নয়! কাঁধের ব্যাগটা মাটিতে রেখে আচার টা ফেলে ওড়নাটা ভালোমতো ভাজ করে বেঁধে পায়ের জুতোগুলো মাটিতে রেখে ঢালু মাটি পার করে বিলের দিক নামলো।

দূর থেকে ভেবছিলো প্রাহী শাপলাগুলো বেশ কাছে! কিন্তু না! বেশ দূরে দূরে! তাও পানির নিচের নরম মাটিতে ভর করে কোনোরকম কয়েকটা শাপলা তুলে বিলের ধারে ফিরে মাটিতে রাখলো। শাপলা যা তুলেছে তাতে তো হবেনা! ওরা মানুষ চারজন! এই শাপলায় ওদের হবে! প্রাহী কিনারায় হাটু সমান পানিতে থাকা অবস্থাতেই বিলের দিক তাকালো। বাকি শাপলাগুলো খানিকটা দূরে! প্রাহী কাদামাটি পেরিয়ে কোনোরকম ধীরে ধীরে শাপলাগুলোর কাছে গেলো। ও এখন কোমর সমান পানিতে রয়েছে! কোনোমতে আর কয়েকটা শাপলা নিয়ে আস্তে ধীরে সামনে যেতে লাগলো। যেকোনো ভাবে বিলের ধারে যেতে পারলেই হয়। যে কয়েকটা শাপলা নিয়েছে তাতেই হয়ে যাবে। হুট করে সামনে একটা চিকন লম্বা সাপ দেখেই ও নড়ে উঠলো। ‘আয়ায়া’ শব্দ করে উঠলো। পিছাতে যেয়েই ও ঠাস করে পিছলে পড়লো। ভয়ে ভয়ে সামনে আগাতে চাইলেও পারছেনা! কাঁদামাটিতে পাজোড়া বারবার পিছলে যাচ্ছে। খেয়াল করতেই দেখলো ও এখন গলাসমান পানিতে! কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো,
– ‘আল্লাহ্! আ…আমি তো সাঁতার জানিনা!
দুপুরের দিক! আশপাশটা কেউ নেই। ওকে কে বাঁচাবে! যত পা নাড়াচ্ছে ততোই ও বেশি পানির দিক এগিয়ে যাচ্ছে! মাঝপুকুরে গেলে ও আর পারবে না কিছু দেখতে। নিভু কিভু কন্ঠে কোনোরকম বলে উঠলো,
– ‘কেউ আছেন! একটু সাহায্য করুন প্লিজ!’

এদিকে প্রাহীর মাথা ততক্ষনে পানির নিচে!

চলবে,,,