মন একে একে দুই পর্ব-১৮+১৯

0
6

#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ১৮(হাওয়াই মিঠাই!)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী

– ‘বাড়ি থেকে এসব ছেড়ে আসতে পারিস না! এখানে এসেই করা লাগবে!! যত্তসব!’

প্রাহী নিচে এসে দেখলো ওর মামাতো ভাই আরাভ নক্ষত্রের কোলে। নক্ষত্র মেজাজ গরম নিয়ে ছয় বছর বয়সী আরাভের দিকে তাকিয়ে আছেব। আরাভও বেকুব দৃষ্টি নিয়ে নক্ষত্রের দিক তাকিয়ে রয়েছে। অথচ চোখে কোনো ভয় ডর নেই!

– ‘কি হয়েছে!’

নক্ষত্র প্রাহীর দিকে তাকিয়ে বললো,
– ‘কি আর করবে! এটাকে পটি ট্রেইন*ড করানো হয়নি। প্রত্যেক বার এসে সব কিছু ভিজিয়ে ভুজিয়ে যায়।’

প্রাহী তাকিয়ে দেখলো আসলেই আরাভের সুতির প্যান্টটা ভিজে। সাথে নক্ষত্রের হাঁটুর কাছের প্যান্টের জায়গাও কিছুটা ভিজে অবস্থায় রয়েছে। প্রাহী হালকা শ্বাস ফেলে আরাভকে নক্ষত্রের কোল থেকে নামিয়ে ওয়াশরুমে নিয়ে ফ্রেশ করিয়ে দিলো। এসে দেখে নক্ষত্র ততক্ষণে নিজের জামাকাপড় চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে এসেছে। হাতে হেলমেট। প্রাহী আরাভকে কোলে নিয়েই জিজ্ঞেস করলো,

– ‘রাত বাজে সাড়ে নয়টা এখন কোথায় যাচ্ছিস!’

নক্ষত্র প্রাহীর কোল থেকে আরাভকে নিতে নিতে বললো,
– ‘এটার যন্ত্রনা সহ্য করবে কে! দিয়ে আসি।’

– ‘তাই বলে এতো রাতে!’

– ‘মামার বাসা এখান থেকে এখানে দশ মিনিটের রাস্তা! আর তাছাড়া ওকে এখানে রাতে রাখাটা ঠিক না!’

প্রাহী ভাবলো সত্যিই! আরাভ মাঝরাতে মাকে না দেখলে কান্না তো করবেই সাথে বার বার ওকে রাতে ঘুম থেকে তুলে বাথরুমে নেয়া লাগে নয়তো বিছানাতেই ও টয়লে*ট করে ফেলে। আর প্রাহীর এখন রাত জেগে পড়তে হয়। ওর মনেও থাকেনা বার বার ছেলেটাকে ওয়াশরুমে নেয়ার কথা! নক্ষত্র তো ওকে রাখবেই না! কাজেই দিয়ে আসলেই ভালো!

– ‘নেক্সট টাইম আসলে আর এফ এল এর পটি করার পট টা নিয়ে আসবি। আর নয়তো ডায়াপার পড়ে আসবি! যত্তসব ‘মুতু*ইন্না পাব্লিক!’

প্রাহী ভ্রু-কুঁচকে আরাভ কোলে থাকা অবস্থায় নক্ষত্রের দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘বার বার এভাবে বলছিস কেন! নিজের ছেলেমেয়ে হলে কি করতি!’

নক্ষত্র যেতে যেতে ত্যাড়াভাবে বললো,
– ‘নিজের ছেলেমেয়ে হলে সহ্য করে নিতাম। অন্যের ছেলেমেয়ের ওসব সহ্য করার মতোন পাব্লিক আমি না!’

প্রাহী নক্ষত্রের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে শ্বাস ফেলে ঘড়ি দেখলো! একটু পর মা নিচে আসবে রান্নাঘরে রাতের খাবার গুছাতে। ওকে বলেছিলো দুটো ডিম ভাজার কথা! প্রাহী ফ্রিজ থেকে দুটো ডিম আর পেঁয়াজ নিয়ে রান্নাঘরের দিক গেলো।

ক্লাস শেষ হয়েছে বেশিক্ষণ হয়নি। রাতুল, তুলি আর শিমলা আগেভাগেই বেরিয়ে গিয়েছিলো। একটা ক্লাস করেনি ওরা! নতুন লাইব্রেরি নাকি খুলেছে বাজার এর একটু কাছেই। ওটাতে গেছে। ওকে বলেছিলো যাবে কি না। ক্লাস একদিন মিস করেছে বিধায় ও আর যায়নি।ও, তন্নি, সোহেল আর রয়ে গিয়েছিলো। তন্নি আর সোহেলের সাথে ঝালমুড়ি খেতে খেতে সামনে এগোচ্ছিলো প্রাহী।পথ আলাদা হতেই একা একাই হাঁটতে লাগলো। ঝালমুড়ির কাগজটা হাতের মাঝে মুচড়ে ছোট্ট বলের মতোন বানিয়ে সেটা দিয়ে খেলতে খেলতে এগোতে থাকলো। একটা গাছের নতুন ডালের দিক তাকালো প্রাহী। সতেজ পাতা গজিয়েছে! ছোট্ট ছোট্ট সবুজ পাতা কি সুন্দর লাগছে! কারো হাঁপানোর আওয়াজ শুনতেই প্রাহী চোখ সরিয়ে পাশে তাকালো! একজন হাঁটুতে হাত দিয়ে ভর করে জোড়ে জোড়ে শ্বাস ফেলছে! শেষ একটা দম ছেড়ে মাথা তুলে তাকাতেই প্রাহী স্তব্ধ হয়ে সামনের মানুষটার দিক তাকালো। ঘামিয়ে কি অবস্থা আকসাদের!

– ‘হ্যালো মিস প্রাহী!’

প্রাহী না চাইতেও হালকা হেসে ফেললো। আকসাদ কপালের ঘামে ভেজা চুলগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে ভ্রু নাড়িয়ে বললো,
– ‘হাসছেন যে!’

প্রাহী হাসি মুখে নিয়েই বললো,
– ‘এই গরমেও দৌড়িয়েছেন! এমনেই তো মানুষ ঘেমে কুল পায়না!’

আকসাদ হালকা হেসে বললো,
– ‘ঘামার জন্য না! বাংলাদেশে আসার পর থেকে জগিং খুব কম করা হয়েছে। তাই ভাবলাম আজ একটু দৌড়াই!’

প্রাহী মাথা তুলে আকসাদের দিক ভালোভাবে তাকালো। ঘেমে ফর্সা মুখটা লাল লাল হয়ে আছে। কপালের দু’পাশে ঘামে ভেজা চুলগুলো লেপ্টে আছে! পড়নে ব্ল্যাক জগিং স্যুট। এ অবস্থাতেও দেখতে বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে! আকসাদ হালকা ঝুঁকে ওর মুখে ফু দিতেই প্রাহী চোখ নামিয়ে পিটপিট করে করে ওর দিক তাকালো। আকসাদ ওর দিক স্নেহময় দৃষ্টি নিয়ে বললো,
– ‘নজর সরালেন যে! বাঁধা তো দেয়নি!’

প্রাহী আকসাদের চোখের দিক তাকিয়ে আনমনে বলে উঠলো,
– ‘অনুমতিও তো দেননি!’

আকসাদ শব্দ করে হাসলো। প্রাহী আবারও চোখ সরিয়ে অন্যদিক তাকালো। আশ্চর্য! ও এই কথা বলেছে! তাও নিজ মুখে! নিজেই নিজের প্রতি অবাক হচ্ছে! এমনটা কেন হচ্ছে!

আকসাদ হাসি থামিয়ে প্রাহীর দিকে ঝুঁকে বললো,
– ‘আপনার ক্ষেত্রেই যেখানে আমি কোনো বাঁধা মানিনি বা অনুমতি নেইনি সেখানে আপনি কেন নিবেন প্রাহী!’

প্রাহীর গালদুটো গরম হয়ে গেলো। লাজুক চোখে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। আকসাদ আলতো হেসে হাত নাড়িয়ে বললো,
– ‘পানি হবে!’

প্রাহী মাথা দুলিয়ে ব্যাগ থেকে পানি বের করে দিতেই আকসাদ সেটা নিয়ে বোতলের ছিপি খুলে মুখ লাগিয়ে পানি খেতে লাগলো। এক নিঃশ্বাসে পুরো পানি শেষ করে প্রাহীর দিক বোতলটা এগিয়ে দিলো। প্রাহী খালি বোতলের একবার তাকিয়ে আকসাদের দিক তাকালো। বেচারা! গরমে দৌড়ে মনে হয় বেশিই তেষ্টা পেয়েছিলো!

– ‘আরও পানি খাবেন!’

আকসাদ হালকা শ্বাস ফেলে বললো,
– ‘নো! আপাতত আর লাগবে না! আমি আজকে এনার্জি ড্রিংকটা নিয়ে বের হতে ভুলে গিয়েছিলাম। যার কারণে গলাটা বেশি শুষ্ক লাগছিলো! ক্লাস শেষ না আপনার!’

প্রাহী মাথা নেড়ে বললো,
– ‘হু! অনেক আগেই!’

আকসাদ মুচকি হেসে বললো,
– ‘তাহলে চলুন!’

প্রাহী আলতো হেসে হাতে থাকা ঝালমুড়ির দলাপাকানো কাগজটা পাশে বালির দিক ছুড়ে আকসাদের সাথে সাথে নিরবে হাঁটতে লাগলো।

– ‘জগিং করতে যেয়ে,হাঁটতে যেয়ে আমার বাসার রাস্তার দিকেই আপনি চলে আসেন যে!’

আকসাদ প্যান্টের পকেটে হাত রেখে বললো,
– ‘উম! আপনার বাসার রাস্তাটা বেশি চওড়া তাই এদিক দিয়ে দৌড়োতে ভালো লাগে!’

প্রাহী এবার ফিক করে হেসে দিলো। আকসাদের দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘আচ্ছা তাই!’

আকসাদ মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সামনে তাকিয়ে প্রাহীর দিক ফিরে বললো,
– ‘হাওয়াই মিঠাই খাবেন মিস প্রাহী!’

প্রাহী সামনে তাকিয়ে দেখলো হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করছে! প্রাহী আকসাদের দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘হাওয়াই মিঠাই! এই গরমে!’

আকসাদ হালকা ভ্রু কুঁচকে বললো,
– ‘হাওয়াই মিঠাই খাওয়ার সাথে গরমের কি সম্পর্ক! চলুন খাই!’

প্রাহী হেসে বললো,
– ‘এতদূর দৌড়ে আসলেন এখন আবার মিষ্টি জিনিস খাবেন! লস হয়ে গেলো না!’

আকসাদ প্রাহীর দিক তাকিয়ে উৎফুল্ল দৃষ্টি দিয়ে বললো,
– ‘দিনের প্রায় সময়ই একটা মিষ্টি মেয়ের দর্শন, তার সাথে কথা বা তার কথা ভাবলে যেহেতু কোনো লস হয়না! সেখানে এই হাওয়াই মিঠাই এর মতো নিছক একটা জিনিস এ কি আর এমন লস হবে!’

বলেই আকসাদ হাওয়াই মিঠাই কিনতে চললো। প্রাহী লাজুক চোখে আকসাদের যাওয়ার দিক তাকালো। ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি টেনে সেদিক এগোলো।

প্রাহীর হাতে গোলাপী রাঙা আর আকসাদের হাতে সাদা হাওয়াই মিঠাই। প্রাহী হাওয়াই মিঠাই খাচ্ছে আর একটু পর পর মৃদু হাসছে।হুট করে আকসাদ ছো মেরে ওর হাওয়াই মিঠাই টা টেনে নিয়ে ওর হাতে নিজের হাওয়ায় মিঠাই টা দিয়ে দিলো। প্রাহীর হাসি মিলিয়ে গেলো। ডাগর চোখে আকসাদের দিক চেয়ে বললো,

– ‘এটা কি হলো!’

আকসাদ প্রাহীর হাওয়াই মিঠাইটা একটু একটু করে ছিড়ে খেতে খেতে বললো,
– ‘কি হয়েছে!’

প্রাহী ভ্রু কুঁচকে বললো,
– ‘আমার টা নিলেন কেন!’

আকসাদ প্রাহীর দিক তাকালো। মেয়েটা ছোটো ছোটো চোখে ওর দিক তাকিয়ে। হাওয়াই মিঠাই এর রঙে ঠোঁটেদুটো গোলাপী রাঙা হয়ে উঠেছে। আকসাদ সেদিক তাকিয়ে সামনে তাকিয়ে হালকা একখানা ঢোক গিলে বললো,
– ‘ঠোঁট এমনেই গোলাপী! আর রঙিন জিনিস খেয়ে আর গোলাপী করার দরকার নেই!’

প্রাহীর দিকে ফিরে ওর হাতে থাকা হাওয়াই মিঠাই এর দিক ইশারা করে আবার বললো,
– ‘এটাতে অসুবিধে কি! হাওয়াই মিঠাইই তো! খেয়ে ফেলুন!’

প্রাহী অবাক হয়ে বললো,
– ‘তাহলে আপনার অসুবিধে কি! এভাবে আমার টা নিলেন কেন!’

আকসাদ প্রাহীর দিক ঝুঁকে ফিসফিস কন্ঠে বললো,
– ‘আমার অনেক অসুবিধা প্রাহী! অনেক!’

আকসাদ সামনে হেঁটে চললো। এখানে আর বেশিক্ষণ মেয়েটার সামনে দাঁড়ানো যাবেনা। সামলাতে না পারলে পরে আরেক বিপদ!। পিছে প্রাহী হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো! আকসাদের কথার মানে প্রথমে না বুঝলেও এখন একটু আকটু বুঝতেই গালটা গরম হয়ে গেলো ওর! কি সহজভাবে ঠাস ঠাস কথাগুলো বলে যায় এই লোক! আর কথাগুলোর ভার সহ্য করতে ওর হিমিশিম খেতে হয়!

– ‘দাঁড়িয়ে আছেন কেন! সাদা হাওয়াই মিঠাইটা এখনও শেষ করেননি দেখছি!’

প্রাহী বিড়বিড় করে আকসাদের দিক এগিয়ে গেলো!

নক্ষত্র কাল চলে যাবে! নোটিশ দিয়ে দিয়েছে ভার্সিটি থেকে। দুইদিন বাদে ক্লাস শুরু! ব্যাগপত্র গুছাচ্ছে! সাথে সাথে প্রাহীও ওর জামাকাপড়গুলো এগিয়ে দিচ্ছে। নক্ষত্রের মা একসাইডে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটার দিক তাকাতেই কেন যেনো চোখের কোন বারবার ভিজে উঠছে! গন্ডগোলের পর থেকে শুরু করে ছেলেটা এখানে এসে পড়েছে। অনেকগুলো দিন ছিলো। এখন আবার হুট করে চলে যাচ্ছে! বুকটা ভার হয়ে আসলো নক্ষত্রের মার! ছেলের রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে যেয়ে তেলের পিঠা আর নকশে পিঠা বানানোর জন্য কাই করতে লাগলো। নক্ষত্রের এগুলো খুব পছন্দ! গরম হোক বা ঠান্ডা যেকোনো সময়েই এই দুটো পিঠা খেতে ওর কোনো আপত্তি নেই!

– ‘এইবার যাচ্ছিস একদম মার্স্টাস শেষে ফিরবি!’

নক্ষত্রের মা রান্নাঘর থেকে গুলানো কাই হাতে নিয়েই বের হতে হতে বললো,

– ‘কিসব কথা! ছেলের মাস্টার্স শেষ হতে হতে আরও সাত থেকে আট মাস! এতগুলো মাস আমার ছেলে একটু বাড়ি আসবে না!’

নক্ষত্রের বাবা বাজারের ব্যাগটা রেখে বলে উঠলো,
– ‘এতগুলো মাস! এখানে এসে কতদিন থেকেছে! মাঝখানে আর সেশন জোটে না পড়লে একবারে পড়িয়ে বেরিয়ে আসবে! ছেলে মানুষ! আর কত ঝুলে থাকবে! এই এক গন্ডগোল, আন্দোলনের জন্য কতমাস পিছিয়েছে হিসেব আছে! না হয় ও তো আর চার পাঁচ মাসে বেরও হয়ে যেত!’

নক্ষত্র রুম থেকে উঁকি দিয়ে একবার বাবা আর মার দিকে তাকিয়ে
বললো,

– ‘গেলামই তো না! এখনি এইসব কথা তুলে ফেলছো!’

নক্ষত্রের বাবা ওর দিক তাকিয়ে বলে উঠলো,
– ‘বলবো না! সিরিয়াস হবি কবে!’

নক্ষত্রের মা ত্যাড়াভাবে স্বামীর দিক তাকিয়ে বলে উঠলো,
– ‘ও সিরিয়াস না! হাওয়ায় হাওয়ায় অনার্স শেষ করেছে তাইনা!’

নক্ষত্রের বাবা সোফায় বসতে বসতে বললো,
– ‘তুমি না বোঝে…..।’

– ‘ ছেলের জন্য মেয়ে পছন্দ হলে একটা ফোন দিলেই এনাফ! তখন মাসে মাসে কেন! সপ্তাহে চারবার বাড়ি আসব! বুঝেছো ডিয়ার মোম!’
বলেই নক্ষত্র বাইকের হেলমেট টা নিয়ে বেরিয়ে গেলো। নক্ষত্রের বাবা ছেলের যাওয়ার দিক বিস্মিত হয়ে বললো,

– ‘এইটার কি লজ্জা নেই নাকি!’

চলবে,,,

#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ১৯(প্রথম ধাপ)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী

নক্ষত্র বাইকের হেলমেট টা নিয়ে বেরিয়ে গেলো। নক্ষত্রের বাবা ছেলের যাওয়ার দিক বিস্মিত হয়ে বললো,

– ‘এইটার কি লজ্জা নেই নাকি!’

গোসলের পর আকসাদ একটু বারান্দায় বসেছিলো। পর পর ফোনে মেইলগুলো আসতেই ও কিছুটা ভ্রু কুঁচকে মোবাইলের দিক তাকিয়ে রইলো৷ বারান্দা থেকে রুমে এসেই ল্যাপটপটা চার্জে দিয়ে ওন করতেই শিমলা আকসাদের ঘরে হালকা উঁকি দিয়ে বললো,
– ‘আকসাদ ভাই!’

আকসাদ ল্যাপটপে চোখ রেখেই বলে উঠলো,
– ‘হু বল! কিছু লাগবে!’

শিমলা দরজার কাছটায় একটু ঢুকে বললো,
– ‘না কিছু লাগবে না! বড় কাকা তোমায় ডেকে পাঠিয়েছে!’

আকসাদ হালকা মাথা নেড়ে বললো,
– ‘আচ্ছা তুই যা! আমি আসছি!’

শিমলা যেতে যেতে বললো,
– ‘আচ্ছা এমনে তোমার কিছু লাগলে বলো!’

আকসাদ সেদিক তাকিয়ে হালকা হেসে ল্যাপটপের দিক তাকিয়ে রইলো! শিমলা আলতো করে দরজা চাপিয়ে বেড়িয়ে গেলো! ইদানীং আকসাদ ভাইকে রুমে আসলেও পাওয়া যায়না! আবার রুমে থাকলেও ব্যাস্ত থাকে! হয়েছেটা কি! ভাবতে ভাবতে শিমলা ছাদের দিকে গেলো। দুপুরের দিক! ছাদে উঠতেই গরম বাতাস ওর গা স্পর্শ করে দিচ্ছে। তাও কিছুক্ষণ রেলিং এর সাথে হালকা হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ও। একদৃষ্টিতে সামনের পুকুর আর খোলা মাঠের দিক তাকিয়ে কিছু একটা ভাবতে লাগলো। ভিজা চুলগুলো হাত দিয়ে হালকা ঝেড়ে ছাদে শুকাতে দেওয়া জলপাই থেকে একটা জলপাই হাতে নিয়ে মুখে দিতেই চোখ মুখ কুঁচকে এলো ওর টকে! একটু লবণ থাকলে ভালো হতো! জলপাই মুখে নিয়েই একটু সামনে চোখ যেতেই ও দেখলো নক্ষত্র বাইক নিয়ে যাচ্ছে! এই ছেলে দুপুরের দিক এভাবে বাইক নিয়ে বের হয়েছে! হুট করে নক্ষত্র বাইক থামিয়ে ছাদের দিক তাকিয়ে ওকে হাত দিয়ে ‘থাপ্পড়’ ইশারা করে আবার বাইক চালিয়ে চলে গেলো। শিমলা মুখটা থম মেরে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইলো! এই ছেলের সমস্যা কি! ‘ফাজি*ল একটা’ বলে বিড়বিড় করে শিমলা ছাদ থেকে নেমে গেলো।

– ‘সবগুলো শিপমেন্ট ক্যানসেল!’

আকসাদের বাবা কিছুক্ষণ ছেলের দিক তাকিয়ে নিরবে উত্তর দিলো,
– ‘আপাতত ক্যানসেল করে দিয়েছি।’

আকসাদ বাবার সামনে বসতে বসতে বললো,
– ‘কিন্ত কেন!’

আকসাদের বাবা একটা শ্বাস ফেলে বললেন,
– ‘লস তো হচ্ছেই! আর কি!’

আকসাদ হালকা কন্ঠে বললো,
– ‘কিন্তু…।’

– ‘বেটার এটাই হয় এখন নিজেদের সবকিছু সামলানো!’

আকসাদ বাবার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। বাবা ওকে কি মিন করছে তা ও জানে! কিন্তু ও যদি এখন সবকিছু নিয়েই তাড়াহুড়ো করতে চায় এতে লাভের লাভ কিছু হবে বলে ওর মনে হয়না!

নক্ষত্রের বাইকটা ভালোমতো একবার ঝেড়ে কভার দিয়ে ঢেকে দিলো। ছেলেটা এবার যাওয়ার আগে বাইক নিয়ে যেতে পারেনি। বাবা দেয়নি। নয়তো যাওয়ার আগে চেয়েছিল বাইক দিয়েই ঢাকায় চলে যেতে। যাবার আগে বলছিলো,

– ‘বাইক নিয়ে গেলে কি সমস্যা!’

নক্ষত্রের বাবা ছেলের দিক গম্ভীর দৃষ্টি ফেলে বলেছে,
– ‘সব মাত্র ঢাকায় যাচ্ছিস! এখন লেখাপড়ায় মন দে! কয়েকদিন আগেই অনেক ঝামেলা টামেলা গেছে! আপাতত বাইক নেয়ার দরকার নেই! বাসের টিকিট কেটে দিয়েছি রাতের দিক। সময়মতো বের হয়ে যাবি!’

নক্ষত্র পরে আর জোড়াজুড়ি করেনি। যাবার আগে একবার বাইকটার দিকে তাকিয়েছিলো প্রাহীর সেটা দেখে খারাপই লেগেছে। ছেলে মানুষ! যেকোনো সময়েই ঠাস ঠুস বের হয়ে যেত এই বাইক নিয়েই! আর এখন বাইক ছাড়া যাচ্ছে! প্রাহীর দেখে মায়াই লেগেছে। ও অবশ্য বাবাকে একবার বলতে চেয়েছিলো কিন্তু নক্ষত্রের চুপ থাকা দেখে আর কিছু বলেনি! হয়তো নক্ষত্রও চাচ্ছে এইবার একটু সিরিয়াস হতে! বাইকটা সাইড করে রাখতে চেয়েছিলো। এত বড় বাইকের ভার তো ওর পক্ষে বহন করা সম্ভব না! বাইকটার দিক একবার তাকিয়ে প্রাহী ঘরের দিক চললো।

আকসাদ ঘরে এসে চেয়ারে বসে মোবাইলে কিছু একটা টাইপ করতেই কাউকে ফোন লাগালো। ওপাশ থেকে ফোন ধরতেওই আকসাদ গম্ভীর কন্ঠে বললো,
– ‘স্যাম্পল গুলো আমাকে পাঠাও! সফট্ কপি আর কয়েকটা ফাইলের ডকুমেন্টস আমার লাগবে! এন্ড সেন্ড ফার্স্ট হু!’

ফোনটা রেখে আকসাদ কিছুক্ষণ চেয়ারে বসে থাকলো। পেপার ওয়েট টা হাতে নিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়িয়ে কিছু একটা ভাবতে থাকলো। অতঃপর চেয়ার ছেড়ে ফোনটা হাতে নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।

ভাত খেয়ে একটু বের হয়েছে প্রাহী। দুপুরে সবসময় ভাতঘুম দিলেও আজ কেন জানি ঘুমাতে ইচ্ছা করছে না! মা আজ তিনপদের ভর্তা করেছে। ভর্তা দিয়ে ভাত বেশি খেয়ে ফেলেছে একটু অস্বস্তি লাগছে এখন ওর! তাই বাড়ির সামনের রাস্তায় এখন একটু হাঁটতে বের হয়েছে ও! হাঁটতে হাঁটতে প্রাইমারি স্কুলের খোলা মাঠের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে প্রাহী। হালকা বাতাসে ভালোই লাগছে! পিচ্চিগুলো মাঠে বল দিয়ে খেলছে। প্রাহী দাঁড়িয়ে ওদের খেলা দেখছিলো। হুট করে একটা ছেলে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে জোরে বল ছুড়েছে যা প্রাহীর দিকেই আসছে। ওর গায়ে লাগার আগেই সাথে সাথেই সেই বলটা ধরে নিলো। প্রাহী কিছুটা হকচকিয়ে পাশে ফিরতেই দেখলো আকসাদ বল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আকসাদ প্রাহীর দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলটা পা দিয়ে হালকা ঠেলে বলটা পিচ্চিগুলোর দিক ছুড়ে দিলো। পিচ্চিগুলো বল নিয়ে আবার খেলায় ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। ওদের দিক তাকয়ে প্রাহী এবার আকসাদের দিক ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো। আকসাদ প্রাহীর দিক তাকিয়ে বললো,

– ‘কি!’

– ‘আজও বুঝি জগিং করতে করতে এখানে চলে এসেছেন!’

আকসাদ প্রাহীর কথায় হেসে ফেললো। মাথা নেড়ে বললো,
– ‘না! আসলে একটু কাজ ছিলো। কাজ শেষে বাড়ির দিক ফিরছিলাম।’

প্রাহী আকসাদের দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘ওহ্! গাড়ি আনেননি আজ!’

– ‘না আজকে আর আনিনি। হেঁটেই বাড়ি যাবার ইচ্ছা ছিলো। তা আপনি বের হয়েছেন যে! কাজ ছিলো কোনো!

প্রাহী মাথা দুলিয়ে বললো,
– ‘না আমি হাঁটতে বেরিয়েছিলাম!’

আকসাদ মুচকি হেসে বললো,
– ‘দ্যাটস্ গুড! চলুন হাঁটি।’

আকসাদ প্যান্টের পকেটে হাত রেখে ওর দিক তাকিয়ে রইলো। প্রাহী হালকা একটা শ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকলো। আকসাদও হেসে প্রাহীর সাথে সাথে এগোলো। হাঁটতে হাঁটতে প্রাহী আড়চোখে আকসাদের দিক তাকাতেই দেখলো আকসাদ ওর দিকেই তাকিয়ে! প্রাহী ঠোঁট ভিজিয়ে আলতো কন্ঠে আকসাদকে জিজ্ঞেস করলো,

– ‘এইযে যেখানে যাচ্ছি সেখানেই আপনার দেখা মিলছে! সবটাই কি কাকতালীয় আকসাদ!’

আকসাদ প্রাহীর দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘না প্রাহী! তবে কিছু কাকতালীয়!’

প্রাহী আকসাদের দিক তাকিয়ে হালকা কন্ঠে বললো,
– ‘আকসাদ! আপনার ব্যপারে আমি কিছু বুঝে উঠেও বুঝতে পারছি না! আমি…।’

– ‘কিছু হলেও তো বুঝেতে পেরেছেন প্রাহী!’
আকসাদের প্রশ্নে প্রাহী ধীরভাবে চেয়ে রইলো।

আকসাদ প্রাহীর দিক তাকিয়ে গভীরভাবে আবার জিজ্ঞেস করে উঠলো,
– ‘এতটুকু তো বুঝেছেন যে আমি আসলেই কি চাই!’

আকসাদের ওমন কথায় প্রাহীর গা হালকা নড়ে উঠলো। আকসাদ কি চায়! আসলেই তো! ছেলেটাকে নিয়ে ভেবে গেলেও এই প্রশ্ন টা মনে সেভাবে উঠেনি প্রাহীর!

– ‘কি হলো প্রাহী! বলুন!’

প্রাহী আকসাদের কথায় হালকা কেঁপে উঠে,
– ‘আ…আমি!’

আকসাদ প্রাহীর সামনে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো। অতঃপর প্রাহীর দিক শান্তভাবে তাঁকিয়ে নরম কন্ঠে বললো,
– ‘প্রাহী! আমি জানি আপমার মনে অনেক প্রশ্ন বা সংকোচবোধ! অস্বাভাবিক কিছু না! আপনার জায়গায় যে কেউ হলে হয়তো সেও ঠিক এভাবেই রিয়েক্ট করতো!’

বলে আকসাদ প্রাহীর দিক আরও একধাপ এগিয়ে বললো,
– ‘তবে এই সংকোচ বা প্রশ্ন যেহেতু আমাকে ঘিরেই তাহলে আমাকেই না হয় সেগুলো সমাধান করে নিতে দিন! আমিই না হয় আপনার মনের একটার পর একটা দ্বিধা বা প্রশ্নের সিরিয়ালগুলোর মীমাংসা করলাম! কি বলুন!’

প্রাহী একদৃষ্টিতে আকসাদের দিক তাকিয়ে মাথা নাড়ালো। আকসাদ আলতো হেসে প্রাহীর দিক ঝুকে বললো,
– ‘এবার না হয় আপনার হাতের যেকোনো একটা আঙুল ধরে আমায় হাঁটতে দিন! আপাতত তাতেই হবে!’

প্রাহীর আকসাদের দিক তাকিয়ে স্তব্দ কন্ঠে বললো,
– ‘হ্যাঁ?’

আকসাদ মুচকি হেসে প্রাহীর কানি আঙুলটা নিজের শক্ত হাতের ভাজে নিয়ে হাঁটতে থাকলো। প্রাহীর গালদুটো যেন গরম হয়ে গেল! আকসাদের তালে তালে ও হাঁটতে লাগলো। হাঁটার মাঝেই আকসাদ প্রাহীর দিক হালকা ঝুঁকে কানে ফিসফিস করে বললো,

– ‘আমাদের চেনাজানার প্রথম ধাপ কিন্তু শুরু মিস প্রাহী!’

চলবে,,,

(কপি করা নিষিদ্ধ! ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন!)