#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ২৭(অনুভূতির খাদে)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী
আকসাদ প্রাহীর মুখটা সামনে এনে নাকের ডগায় গভী*র ভাবে চু*মু খেলো। প্রাহী কেঁপে উঠে আকসাদের বাহুতে হাত রাখলো। প্রাহী এখনও চুপ! গলার কন্ঠস্বরটা যেন কেউ নিজ দায়িত্বে চুপ করিয়ে রেখেছে! যাতে আকসাদের কথার প্রেক্ষিতে কোনো কথা ও বলতে না পারে! প্রাহী আকসাদের চোখে চোখ রাখলো! কি স্বচ্ছল সেই দৃষ্টি! প্রাহী হালকা ঠোঁট নাড়তেই আকসাদ প্রাহীর গাল আরও জড়িয়ে ধরে বললো,
– ‘আপনার প্রশ্নের উত্তর আশা করি আমি দিতে পেরেছি। এক না এক সময় এইকথাগুলো আমার বলতে হতোই তাই আজই বলে দিলাম! অনেক তো চেঁপে রইলাম! আর কতো বলুন!’
– ‘আকসাদ! আ…আমি!’
প্রাহী হালকা ঠোঁট নাড়তেই আকসাদ এক আঙুল ওর ঠোঁটের উপর রেখে ওকে থামালো।
– ‘প্রাহী! আমি উত্তর দিয়েছি বিধায় আপনায়ও যে আমার কথার জবাব এখনই দিতে হবে তা কিন্তু নয়!’
প্রাহী দীর্ঘচোখে আকসাদের দিক তাকিয়ে! আকসাদ মুচকি হেসে প্রাহীর গাল ছেড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– ‘শুনলাম কাল থেকে ফাইনাল! বাসায় যেয়ে পড়াশোনা করুন! ‘আপাতত এইসব চিন্তা বাদ কেমন!’
বলেই প্রাহীর মুখ হালকা ফুঁ দিলো। প্রাহী চোখ বুজলো। আকসাদ তা দেখে হেসে প্রাহীর কানে ফিসফিস করে বললো,
– ‘আবার পুরোপুরিভাবে আমাকে নিয়ে ভাবা বন্ধ করবেন না যেন!’
আকসাদের কথায় প্রাহী মাথা উপর নিচ করতেই। সাথে সাথেই মাথা নিচু করে ফেললো! আকসাদ তা দেখে ফিক করে হেসে দিলো!
,
কলমের মুখটা নিজের থুতনীতে লাগিয়ে প্রাহী আনমনে বইয়ের পাতার দিক তাকিয়ে আছে! এতক্ষণ টানা পড়ে কিছুক্ষণ ব্রেক নিয়েছে ও। আকসাদের কথা ভাবছে! ও কখনও ভাবেনি আকসাদ এভাবে দুম করে সব বলে দিবে! প্রাহী হালকা একটা শ্বাস ফেলে ভাবলো, একটু একটু করে আকসাদ নিজের অনুভূতির সাথে ওকে পরিচয় করাচ্ছে! কিন্তু ও কিছুই বলতে পারছে না! বরাবরের মতো ছিল নিশ্চুপ! ওর যে কিছুই বলতে ইচ্ছা করেনা তা কিন্তু না! এই যেমন আজ ওর ইচ্ছা করছিলো অনেক কিছুই বলার! অতঃপর ভাবলো, ওর মতো…!
– ‘পড়া শেষ হয়নি!’
প্রাহী ভাবনা ফেলে পিছন ফিরে তাকালো। ওর মা হাতে গরম দুধ নিয়ে দাঁড়িয়ে! ওর কাছে এগিয়ে এসে টেবিলে গরম দুধ টা রেখে বললো,
– ‘রাত জাগবি আজকে!’
প্রাহী মাথা নেড়ে বললো,
– ‘হ্যাঁ! আরও পড়া বাকি!’
প্রাহীর মা মেয়ের দিক তাকালেন। মুখটা শুকনো হয়ে আছে! হালকা শ্বাস ফেলে উনি ট্রে এর দিক ইশারা করে বললেন,
– ‘এখানে কফির মিনি প্যাকেট আর চিনি আছে! কফি খেতে মন চাইলে দুধের সাথে মিশিয়ে খাস!’
প্রাহী তা দেখে গরম দুধটা হাতে নিয়ে কয়েকটা সিপ নিলো।
– ‘রাত হয়েছে! আর রাত জাগিস না! শরীরটা এমনেই দূর্বল তোর! সকালে উঠে পড়িস! আমি ডেকে দিব নে!’
প্রাহী মায়ের দিক চেয়ে বললো,
– ‘একটু পরেই শুয়ে পড়বো মা!’
প্রাহীর মা মাথা নেড়ে রুম থেকে বেড়োতে নিলেই প্রাহীর ডাকে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে তাকালেন,
– ‘মা! দু’টো ড্রাইকেক দিবে প্লিজ! খিদে পেয়েছে!’
প্রাহীর মাথা নেড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে মেয়ের জন্য ড্রাই কেক আর কিছু ফল কেঁটে নিয়ে মেয়ের রুমে নিয়ে গেলেন। প্রাহী দুধে কফি আর চিনি মিশিয়ে ড্রাইকেক একটা নিয়ে তাতে ভিজিয়ে খেতে খেতে মায়ের দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘ধন্যবাদ মা! আর শুনো সকালে একটু ডাক দিয়ে দিও তাড়াতাড়ি! আমার ফোনটায় চার্জ কম! আজ আর এলার্ম দিতে পারবোনা!’
– ‘আচ্ছা ডেকে দিব! তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়িস!’
বলে প্রাহীর মাথায় হাত বুলিয়ে নিজ রুমের দিক চলে গেলেন। প্রাহী হাতে থাকা বিস্কুটের গুড়ো ঝাড়া দিয়ে ঘড়ির দিক তাকালো!দেড়টা বাজে! আরও কিছু ম্যাথ শেষ করা বাকি! ভেবেই খাতায় কলম লাগালো। সকালে উঠে আরও কিছু ম্যাথ দেখতে হবে! বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে ও একবার ভাবলো সকালের মধ্যে প্রিপারেশন কম্পলিট করে যেতে পারবে তো!
,
টানা পরীক্ষা শেষে হাতগুলো বেশ ব্যথা করছে! হল থেকে বেড়িয়ে সবাই ভার্সিটির মিনারের চত্বরটাতে বসে। প্রাহীর সাথে হয়ে যাওয়া ঘটনা নিয়ে সবাই এতক্ষণ কথা বলছিলো। সবাই ওকে স্বান্তনা দিয়েছে সাথে শোয়াইব ওরা বলেছে!
– ‘রাতে আর একা বের হোস না!’
হাতের তালু ঘষতে ঘষতে তুলি বললো,
– ‘কার পরীক্ষা কেমন হয়েছে! আমি দশ নাম্বার ছাড়লাম!’
তুলির কথায় রাতুল তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
– ‘কোনদিন ফুল মার্কস এন্সার করেছিস!’
তুলি রাতুলের দিক কোণা চোখে চেয়ে বললো,
– ‘তুই কত এন্সার করেছিস!’
হালকা ভাব নিয়ে রাতুল বললো,
– ‘ফুল!’
– ‘তাহলে আমাকে দেখালি না কেন!’
তুলি অবাক হয়ে রাতুলের দিক তাকিয়ে বললো! রাতুল সেদিক চেয়ে বললো,
– ‘রাত জেগে পড়েছি তোকে দেখানোর জন্য না নিশ্চয়ই!’
তুলি রাতুলের হাতে বাড়ি মেরে বললো,
– ‘এত খারাপ কেন তুই! একবারই তো ডেকেছিলাম! শুধু একটা জায়গায় আটকে গিয়েছিলাম দেখে! আজকে তন্নিও মেয়ে হয়ে শোয়াইবকে হেল্প করেছে আবার শোয়াইবও তন্নিকে একটু আকটু হেল্প করেছে! আর তুই ঘাড়ই ফিরালি না! বেয়াদপ একটা!’
তন্নি আর শোয়াইব তুলির কথায় একজন আরেকজনের দিক তাকালো। তন্নি চোখ নামিয়ে তুলিকে বললো,
– ‘নেক্সট পরীক্ষা ভালো মতো দিতে পারবে অসুবিধা নেই!’
তুলি রাতুলের দিক চেয়ে বললো,
– ‘তা তো অবশ্যই!’
প্রাহী ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,
– ‘ঝগড়া অনেক হয়েছে! বাসায় চল। ঘুম পাচ্ছে অনেক।’
শিমলাও দাঁড়িয়ে বললো,
-‘আমারও! বাসায় যেয়ে ঘুম দিব একটা!’
তুলি ওদের সাথে যেয়ে বললো,
– ‘তোদের সাথে যাব আজকে!’
শিমলা ওর দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘কেন রাতুলের সাথে যাবিনা!’
– ‘না!’
তুলি গটগট পায়ে হাঁটতে থাকলো। প্রাহী আর শিমলা,তন্নি ওরাও পিছন পিছন চললো। তন্নি আর শোয়াইব দের বাসা আলাদা। তাই ওরা কিছুদূর হেঁটেই নিজ বাড়ির পথে হাঁটা ধরলো। প্রাহী,শিমলা,তুলি হাঁটতে হাঁটতেই ওদের পাশে গাড়ি থামলো। চেনা পরিচিত গাড়ি দেখেই সবাই থামলো। প্রাহী গাড়ির ভিতর থেকে বেড়িয়ে আসা মানুষটার দিক তাকিয়ে মুচকি হাসলো! আকসাদও হালকা হেসে সবার দিক তাকালো!
– ‘পরীক্ষা শেষ সবার!’
তুলি লাজুক হেসে বললো,
– ‘জ্বী!’
– ‘আচ্ছা! তা কেমন হলো পরীক্ষা!’
তুলি বেজারমুখ করে বললো,
– ‘ভালোই হয়েছে ভাই…। মানে ভালো হয়েছে আর কি!’
শিমলা ভ্রু কুঁচকে তুলির দিক তাকাতেই তুলি দাঁত দেখিয়ে বললো,
– ‘সুন্দর ছেলেদের ভাইয়া ডাকা উচিত না! এমনেই আমার ভাইয়ের অভাব নেই! আর ভাই বানানোর ইচ্ছে নেই! হি হি হি।’
শিমলা বিরক্ত হয়ে বললো,
– ‘তুই…।’
– ‘আচ্ছা সবাইকে বাসায় পৌঁছে দেই! গাড়িতে উঠো!’
শিমলা আকসাদের কথায় তুলিকে সাথে নিয়ে বললো,
– ‘তার দরকার নেই আকসাদ ভাই! আমি আর তুলি চলে যাব! তুমি প্রাহীকে নিয়ে যাও!’
আকসাদ শিমলার দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘পরীক্ষা দিয়ে এসেছিস! ক্লান্তি নিয়ে হেঁটে হেঁটে যাবি কেন! গাড়িতে উঠ!’
তুলি লাফিয়ে বললো,
– ‘হ্যাঁ হ্যাঁ উঠছি!’
তুলি গাড়িতে উঠে গেছে দেখে শিমলাও না পারতে গাড়ির পিছনে তুলির সাথে বসলো। প্রাহী পিছনে বসতেই তুলি ওকে ঠেলে বললো,
– ‘তুই পিছনে বসবি কেন! সামনে বস যা!’
প্রাহী অবাক হয়ে বললো,
– ‘কেন!’
– ‘আরে তুই ভাইয়া কে একলা কেন রাখবি! যা যা!’
তুলি ওকে সরিয়ে গাডির দরজা আঁটকে দিলো! প্রাহী বেকুব হয়ে সেদিক চেয়ে রইলো। পিছন ফিরে আকসাদের দিক তাকাতেই দেখলো আকসাদ ওর দিক ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়ে আছে! প্রাহী মাথা নিচু করে আকসাদের পাশে বসার দরজা খুলতে নিলে আকসাদ তা খুলে দিলো। প্রাহী চুপটি করে সেখানে বসে পড়লো। আকসাদ দরজা লাগিয়ে নিজের জায়গায় বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। গাড়ি ছাড়তেই তুলি জিজ্ঞেস করলো,
– ‘আপনার কি পড়ালেখা শেষ!’
আকসাদ গাড়ি চালাতে চালাতেই বললো,
– ‘আপাতত শেষ! তবে আরও করার ইচ্ছে আছে!’
তুলি আড়চোখে প্রাহীর দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘তা বিয়ের ইচ্ছে নেই!’
আকসাদ প্রাহীর দিক আড়চোখে চেয়ে বললো,
– ‘তা তো আছেই!’
– ‘আচ্ছা! তা কবে!’
আকসাদ চোখ প্রাহীর দিক রেখে বললো,
– ‘এখন যদি কেউ করতে চায় তাহলে এখনই!’
– ‘ওহোওওও!’
প্রাহী লজ্জায় বাইরে তাঁকিয়ে রইলো। তুলি হাসছে। আকসাদ প্রাহীর দিক চেয়ে হালকা হাসলো। শিমলা এসব দেখে চুপ করে আছে। রাস্তায় চোখ রেখে নিজেকে কোনোরকম সামলে নিচ্ছে। এজন্যই গাড়িতে উঠতে চাচ্ছিলো না ও! ঘুরে ফিরে না চাওয়ার জায়গাতেই উপরওয়ালা দাঁড় করায়!
তুলি নেমে গেছে। কিছুদূর বাদে গাড়ি যেতেই শিমলাকে আকসাদ নামিয়ে দিলো।
– ‘আমি প্রাহীকে দিয়ে বাসায় আসছি!’
আকসাদের কথায় শিমলা মাথা নাড়ালো। আকসাদ গাড়ি নিয়ে চলে গেলো। শিমলা ওদের যাওয়ার দিক তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সেই দীর্ঘশ্বাসে ছিলো কিছু কষ্ট,খারাপ লাগা বা দুঃখ!
.
গাড়ি চালাতে চালাতে আকসাদ প্রাহীর দিক তাকিয়ে দেখলো প্রাহী জানালার বাইরে তাকিয়ে।
– ‘পরীক্ষা কেমন হয়েছে!’
প্রাহী পাশ ফিরে আকসাদের দিক চেয়ে বললো,
– ‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো!’
– ‘বাহ্!’
প্রাহী মুচকি হেসে হাতের আঙুলগুলো ভাজে নিয়ে ফুঁটালো। আকসাদ প্রাহীর হাতজোড়া নিজের হাতের ভাজে নিয়ে বললো,
– ‘হাত বেশি ব্যথা করছে!’
প্রাহী মাথা নাড়লো। আকসাদ প্রাহীর হাতের উল্টো পিঠে ঠোঁট স্পর্শ করে বললো,
– ‘মুখে বলুন!’
প্রাহী হালকা কেঁপে বললো,
– ‘না তেমন করছে না।’
– ‘মাথার কি অবস্থা!’
আকসাদ প্রাহীর মাথায় ইশারা করে বললো।
– ‘ভালোই কিন্তু হালকা ব্যথা করছে। হয়তো রাত জেগেছি এজন্য!’
আকসাদ প্রাহীর দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘চা খাবেন!’
আকসাদ গাড়ি চালানো অবস্থাতেই প্রাহী আকসাদের হাতের ভাজে থাকা হাতের উপর অন্য হাত দিয়ে বললো,
– ‘আকসাদ গাড়ি থামান!’
আকসাদ তৎক্ষণাৎ গাড়ি থামালো। জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে প্রাহীর দিক তাকাতেই প্রাহী সামনে ইশারা করে বললো,
– ‘উমমম্ আকসাদ! ওই দেখুন টং এর দোকান! টং এর চা খাবেন!’
আকসাদ সামনে তাকিয়ে বললো,
– ‘শিউর!’
প্রাহী হেসে গাড়ি থেকে নামলো। আকসাদও গাড়ি থেকে নেমে প্রাহীর হাত ধরে টং এর দোকানের সামনে গেলো। দুপুর সময়। অন্যান্য সময়ের মতো রোদের তাপ নেই! মোটামুটি বাতাস বইছে! আশেপাশে তেমন একটা কেউ নেই! টং এ থাকা মামা ঝিমুচ্ছে। আকসাদ এগিয়ে গিয়ে বললো,
– ‘মামা দু’টো চা দিবেন!’
টং এ বসা বয়োজ্যেষ্ঠ লোকটা চোখ টেনে বললো,
– ‘বেঞ্চিত বন। দিতাসি।’
আকসাদ প্রাহীর দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘বেঞ্চিত বন প্রাহী!’
প্রাহী ফিক করে হেসে দিয়ে কাঠের বেঞ্চিতে বসলো। আকসাদও প্রাহীর পাশে বসলো।
– ‘কি চা দিতাম!’
চাওয়ালা মামার প্রশ্নে প্রাহী আকসাদের দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘কি নিবেন! দুধ চা নাকি রঙ চা!’
– ‘আপনি যেটা নিবেন সেটাই!’
প্রাহী চাওয়ালা মামাকে বললো,
– ‘কড়া লিকারের দু’টো দুধ চা দিবেন! আর চিনি…।’
– ‘আর একটায় চিনি দিবেন না একদমই!’
প্রাহী আকসাদের কথায় একটা অবাক হলো।
– ‘আপনি চিনি খান না!’
আকসাদ মাথা নাড়িয়ে বললো,
– ‘না প্রাহী!’
– ‘ডায়েট!’
– ‘উম কিছুটা! বাংলাদেশে এসে সেভাবে জিম বা হার্ডলি ওয়ার্ক আউট হচ্ছেনা! এজন্য চিনি বা ওয়েল একটু কম খাচ্ছি!’
প্রাহী ভ্রু কুঁচকে আকসাদের পা হতে মাথার দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘কই আপনি তো ঠিকই আছেন!’
আকসাদ প্রাহীর দিক ঝুঁকে বললো,
– ‘আচ্ছা! একদম পারফেক্ট?’
প্রাহী আকসাদের কথা মানে একটু বুঝতেই চোখ নামিয়ে পাশে তাকিয়ে মিনমিন করে বললো,
– ‘বাইরে আছি!’
– ‘তো!’
– ‘চা লইয়া যান!’
আকসাদ যেয়ে চা নিয়ে আসলো। প্রাহীর চা টা প্রাহীর হাতে দিয়ে নিজের চা নিয়ে প্রাহীর পাশে বসলো। প্রাহী চায়ে চুমুক দিয়ে আকসাদ এর দিক তাকালো।
– ‘চা কেমন! ভালো লাগছে!’
আকসাদ চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললো,
– ‘হুম ভালো! এভাবে প্রথম খেলাম আই লাইক ইট!’
প্রাহী হালকা হেসে বললো,
– ‘যাক! আপনার ছোট্ট একটা অভিজ্ঞতার কারণ তো হতে পারলাম!’
আকসাদ চায়ের কাপটা পাশে রেখে প্রাহীর হাতের আঙুলগুলো নিজের হাতের ভাজে নিয়ে বললো,
– ‘আমার জীবনের এখন থেকে সকল সুন্দর কিংবা কষ্টের অভিজ্ঞতা বা সময়গুলো যাতে আপনার সাথেই উপভোগ করতে পারি প্রাহী!’
প্রাহী আকসাদ এর চোখে তাকালো। হরিণ চোখের দিক চেয়ে রইলো। যে চোখে আছে একরাশ ভালোলাগা, স্বচ্ছ অনুভূতি আর ভালোবাসা! সেই অনুভূতির অতলে বা খাদে হয়তো যেকোনো সময় ও ডুবে যাবে! আচ্ছা ও কি ইতিমধ্যে ডুবে গেছে!
চলবে,,,
#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ২৮(কারণ!)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী
– ‘কিছুই তো নিলিনা!’
শিমলার মা আকসাদের দিক তাকিয়ে আছে৷ এই ছেলে কয়েকটা ভাত খেয়েই বলছে আর নাকি খিদে নেই! অথচ এক প্লেটের সমান খাবারও খাইনি বোধহয়! আকসাদ প্লেট এক সাইডে রেখে বললো,
– ‘কাকী আর পসিবল না! আমি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি!’
– ‘কোথা থেকে এমন কি খেয়ে আসলি যে এভাবে টেবিলে বসেই উঠে যাচ্ছিস! বলিস ও তো না কিছু!’
আকসাদ চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললো,
– ‘রাগ করোনা! কাল সকাল দুপুর বেশি বেশি খাব কেমন!’
আকসাদ সিড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো। শিমলার মা আকসাদের যাওয়ার দিক তাকিয়ে রইলেন। ছেলেটা শান্ত কিন্তু ঘাড়ত্যাড়া! হালকা শ্বাস ফেলে শিমলার মা তরকারির বাটি গুলো রান্নাঘরে নিতে থাকলেন। শিমলা তড়িঘড়ি করে রান্নাঘরে যেয়ে ঢুকলো।
– ‘এভাবে গুছাচ্ছো যে সবকিছু! আমি তো এখনও খাইনি!
– ‘তোর ঘরে খাবার নিয়ে যাব ভাবছিলাম। যাই হোক এসে যখন গিয়েছিস খেয়ে যা একবারে!’
শিমলা মাথা নেড়ে টেবিলে যেয়ে বসলো। ওর মা ওকে প্লেটে ভাত বেড়ে দিচ্ছে। শিমলা ভাত মুখে দিয়ে ওর মা’য়ের দিকে তাকালো।
– ‘মুখটা এমন করে রেখেছো যে!’
শিমলার দিক একবার তাকিয়ে ওর মা বলে উঠলো,
– ‘ছেলেটার কি হলো কিছু বুঝলাম না! আজকাল বেশিরভাগই দিনই বাইরে থাকছে! আবার বাসায় এসে খাবারও তেমন খাচ্ছে না! এমন করে যদি শরীরটা খারাপ হয় তখন? কিছু বললে শুনেও শুনে না। শুন, তোর খাওয়া শেষে বাকিখাবার গুলো একটু গরম করে ফ্রিজে রেখে দিস! প্লেট বাটিগুলো রান্নাঘরে নিয়ে রাখিস।’
শিমলা মায়ের কথায় হালকা মাথা নাড়লো। উপরের দিক আকসাদের রুম বরাবর একবার তাকালো। আজ এত তাড়াতাড়ি আকসাদ ভাইয়ের রুমের লাইট ওফ যে! চোখ নামিয়ে খাবারে মন দিলো ও।
|
রাত প্রায় দু’টোর কাছাকাছি। পুরো বাড়ি অন্ধকার! কোনো রকম আওয়াজ না করে ঘর থেকে বেড়িয়ে মেইন গেইট এর সামনে এসে দাঁড়ালো আকসাদ। গেইটে তালা ঝূলানো! লোহার গেইটটা টপকে মেইন রাস্তায় পা রাখলো ও। কোমড়ে একটা পাতলা জ্যাকেট বাঁধা! চাঁদের আলোয় আশপাশটা উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। পকেটে দু’হাত দিয়ে শুনশান রাস্তায় ও একলা হেঁটে চলছে। পথিমধ্যে দু’একটা কুকুর শুয়ে আছে! মাথা নিচু করে আকসাদ মধ্যম গতিতে চলছে। আকাশে মেঘ ডাকছে। গুড়গুড় আওয়াজ! বৃষ্টি হবে নাকি! পকেট থেকে একহাত বের করে চুলগুলো একপাশে সরিয়ে হাঁটতে থাকলো। দোতলা পুরোনো একটা বাড়ির সামনে এসে ও থামলো। ক্যারক্যার আওয়াজে মেইন গেইট পেরিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকলো ও। বাড়িটায় তেমন কোনো আলো নেই! নিচতলার একপাশের স্যাঁতসেঁতে গ্যারেজ হতে টিমটিম আলো দেখা যাচ্ছে। গেইট আটকে আকসাদ সেদিক এগিয়ে গেলো। গ্যারেজের ভিতর ঢুকে সাটারটা অর্ধেক নামিয়ে দিলো। রুমের এক সাইডে কাঠের চেয়ারটায় যেয়ে বসলো। পায়ের উপর এক পা তুলে তা নাড়াতে থাকলো। দৃষ্টি ওর সামনে! রুমের মধ্যিখানে মোটা দড়ি দিয়ে তিনজন মানুষ বেঁধে রাখা অবস্থায় পড়ে আছে। প্রত্যেকের শরীরে দাগ আর দাগে ভরপুর৷ আকসাদ একহাত মাথায় ঠেকিয়ে সেই কালশিটে দাগগুলোয় নজর বুলাচ্ছে। ঠোঁটের কোনে হাসি টানলো ও। পরক্ষণেই চোখমুখ শক্ত করে উঠে দাঁড়ালো ও। ঠেসে বসে থাকা লোকগুলোর দিক এগিয়ে গেলো যারা কিনা ভয়ার্ত চোখে ওর দিক তাকিয়ে! কাছাকাছি দাঁড়িয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো আকসাদ।
– ‘স্যা…স্যার! আ…আমাগো এইবার ছাই…ছাইড়া দেন! দু…দুইদিন ধইরা আমা…আমাগোরে এম…এমনে…।’
– ‘দুইদিন না তিনদিন হবে।’
আকসাদের শান্ত কথায় লোকগুলোর শঙ্কা নিয়ে তাকিয়ে আছে। গত দু’দিন ধরে আকসাদ ওদের এভাবে আটকে রেখেছে। শরীরের একটা জায়গায় ও মনে হয় দাগবিহীন নেই। মারতে মারতে ওদের হাত-পা অবশ করে ফেলেছে প্রায়! এদিক খাওয়া দাওয়া তো নেইই। পানি চাইলে আকসাদ ওদের মদের বোতলের সবটুকু মদ মুখের উপর ঢেলে দিতো।
– ‘বলেছিলাম না! আ’ম নট ফিনিশড উইথ ইউ পিপল!’
আকসাদ উঠলো৷ কিছুটা দূরে যেয়ে দাঁড়ালো।
– ‘এই নিয়ে কটা মেয়েকে এখানে নিয়ে এসেছিলি!’
লোকগুলো অসহায় দৃষ্টি দিয়ে আছে। আকসাদ এবার কিছুটা জোরে বললো,
– ‘কটা মেয়েকে এখানে এনেছিলি! স্পিক আপ!’
– ‘তিন…তিনজনরে।’
– ‘তারপর!’
– ‘তা…তারপরে রে*প কইরা দূর…দূরে ফালায়…।’
বলতে না বলতেই আকসাদ ওদের পেট বরাবর জোড়ে লাথি মারলো। গ্যারেজের সাটারটা পুরোপুরিভাবে বন্ধ করে কোনায় পড়ে থাকা হকিস্টিক টা নিয়ে ওদের সামনে গেলো। সমানে তিনজনের পায়ে হকিস্টিক দিয়ে নিজের সবটা দিয়ে মেরে যাচ্ছে। একপর্যায়ে মারা শেষে রুমের একপাশের টেবিলের ড্রয়ার হতে কিছু একটা বের করে তা হাতে নিয়ে ওদের সামনে এসে ঝুকলো আকসাদ।
– ‘এই হাতগুলো দিয়ে ওই মেয়েগুলোর উপর জুলুম করেছিস না! সাথে আমার প্রাহী… ওকে ছোঁয়ারও চেষ্টা করেছিস!’
বলেই হাতের লোহার হাতুড়ি টা দিয়ে তিনজনের হাতের নরম আঙুলের হাড্ডিগুলোর উপর পরপর তিনটে স্বজোড়ে বাড়ি মারলো আকসাদ। হাহাকার শব্দে লোকগুলো কাতরে যাচ্ছে। হাতের আর পায়ের হাড্ডিগুলো মনে হয় ভেঙে গেছে ইতিমধ্যেই
– ‘যেই হাত দিয়ে এই পর্যন্ত মেয়েদের অসম্মান করেছিস। আজ থেকে সেই হাত দিয়ে মেয়েদের দেয়া ভিক্ষে নিয়ে বাঁচবি!’
হাতে থাকা লোহার হাতুড়িটা আকসাদ একপাশে ছুড়ে মারলো। পিছন ফিরতে যাবে তার আগেই কারোর গোঙানি মিশ্রিত রাগী কন্ঠে ও ফিরে তাকালো। কালো মোটা লোকটা দাঁতে দাঁত চেপে ওর দিক তাকিয়ে বলছে,
– ‘শালা। তোর মা*লের সাথে তো তেমন কিছুই করলাম না! তার মধ্যে…।’
আকসাদ সাথে সাথে মুষ্টিবদ্ধ হাত দ্বারা লোকটার মুখ বরাবর পরপর কতগুলো কিল বসালো।
– ‘হোয়াট ডিড ইউ যাস্ট সে!’
বলেই লোকটার মুখ বরাবর শেষ বারের মতো জোড়ে একটা পাঞ্চ মেরে পকেট থেকে কিছু একটা বের করলো। পাশের দু’টো লোক সমানে কেঁপে যাচ্ছে আকসাদকে দেখে। একজন আরেকজনের সাথে ঘেষে সিটিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ পর এক গগনবিদারী আওয়াজে পুরো গ্যারেজটা যেন কেঁপে উঠলো! আকসাদ ক্রুর হাসলো। মোটা লোকটার মুখ থেকে গলগল করে রক্ত পড়ছে। আকসাদ উঠে দাঁড়িয়ে রেইনকোট জ্যাকেটটা কোমড় থেকে খুলে হাতে নিলো। লোকগুলোর শরীরের চামড়া ফেঁটে রক্ত গড়াচ্ছে।আকসাদ সেদিক ইশারা করে বললো,
– ‘নাও আই লাইক ইট!’
এগিয়ে গ্যারেজের সাটারটা খুলে বেড়িয়ে যাবার আগে একবার পিছন ফিরলো ও। মরণের ন্যায় ব্যথায় জর্জরিত হেলে পড়ে থাকা লোকগুলোর দিক চেয়ে বললো,
– ‘দিনকে দিন সব মায়া দয়া আস্তেধীরে উঠে যাচ্ছে আমার থেকে! সো স্যাড ওফ মি!’
হতাশার এক্ক শ্বাস ফেলে আকসাদ সবগুলো দরজা খুলে মেইন রাস্তায় এলো। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে! রেইনকোট জ্যাকেটটা গায়ে জড়ালো ও। হুডিটা মাথায় তুলে নির্জন রাস্তায় হাঁটতে থাকলো। কিছুক্ষণ আগের শুয়ে থাকা কুকুরগুলো এখন ঘুড়ে বেড়াচ্ছে৷ মানুষের ছায়া দেখে ওরা কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালো। আকসাদ বাঁকা হাসলো৷
– ‘কাম! ওয়াক উইথ মি!’
কুকুরগুলো আকসাদের পিছু পিছু কিছুদূর যেয়ে আর গেলো না। আকসাদ শীষ বাজাতে বাজাতে বাড়ির সামনে এসে পৌঁছে দেয়াল টপকে বাড়ির ভিতর ঢুকলো। ঘরের ভিতরটা আগের ন্যায়ই নীরব! হুডিটা খুলে সামনের ভিজে চুলগুলো একপাশে সরিয়ে ফ্রিজের সামনে গেলো। ফ্রিজ খুলে লাল টকটকা একটা আপেল বের করে সেটাতে কামড় বসাতে বসাতে সিড়ি বেয়ে নিজ রুমের দিক রওনা দিলো।
|
-‘সিরিয়াসলি! এতো পুরো মরার মতো অবস্থা করে ছেড়েছে!’
পরীক্ষা শেষে সবাই একসাথে বাড়ি ফিরছিলো। হুট করে রাতুলের কথায় সবাই সেদিক তাকালো। শোয়াইব যেয়ে রাতুলের হাত হতে ফোনটা নিলো। তিনটে লোককে কোনোরকম ধরেবেঁধে পুলিশের গাড়িতে তোলা হচ্ছে।
– ‘এটাতো আমাদের বাসার ওইদিকেই!’
শোয়াইবের কথায় রাতুল বলে উঠলো,
– ‘হ্যাঁ! এরা স্টেটমেন্ট দিয়েছে এই নিয়ে তিনজনকে মেয়েকে তুলে এনে রেই*প করেছে!’
– ‘এগুলোকে মেরে ফেলা উচিত।’
রাতুল তন্নির দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘মরার চেয়েও জঘন্য করেছে ওদের! দেখো!’
ফোনটা সামনে ধরতেই শিমলা, প্রাহী, তুলি ওরা মুখ চেপে ধরেছে। তিনজনের মধ্যে একজনের মুখে কেউ স্টেপলার দিয়ে পিন গেঁথে দিয়েছে! ঠোঁটগুলো কেমন ফালাফালা হয়ে গিয়েছে একদম! প্রাহী এই লোকটাকে দেখে চিনলো! এটাতে সেদিন রাতের ওই লোকটা! যে কিনা ওর উপর! প্রাহীর মাথাটা ঘোরাচ্ছে। এই ভাবে কে মারলো এদের!
– ‘এদেরকে পুলিশে দেওয়ার আগেই তো আধমরা করে ফেলেছে!’
শোয়াইব বাঁকাভাবে বললো,
– ‘পুলিশের কাছে দিয়ে লাভ আছে! উনাদের মারা না মারা তো একই কথা! তার চেয়ে আগেভাগে মেরে হস্তান্তর করেছে এটাই ভালো!’
তুলি আর রাতুল নিজ নিজ বাড়ির দিক চলে যাচ্ছে। শোয়াইব আর তন্নিও হালকা পাতলা কথা বলে চলে গেছে। শিমলা আর প্রাহী শুধু রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। শিমলা প্রাহীর দিক তাকিয়ে দেখলো ওর মুখটা বেশ শুকনো হয়ে আছে।
– ‘মুখটা এমন করে রেখেছিস কেন!’
প্রাহী একপলক শিমলার দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘আমার কেন জানিনা মনে হচ্ছে ওই লোকগুলোর এই অবস্থা…।’
– ‘যেই করে থাকুক না কেন! বেশ করেছে!’
প্রাহী করুণ চোখে শিমলার দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘আমি এসবের সাথে মানিয়ে নিতে পারব না শিমলা। আমার এসব পছন্দ না।’
শিমলা শান্ত চোখে ওর দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘একটা মানুষের ভালো দিকটার সাথে মানিয়ে নিতে পারলেও তার খারাপ দিকটার সাথেও মানিয়ে নিতে হবে! যদি সে তোর ভালো চায় তাহলে অসুবিধা কোথায় এতে!’
– ‘কিন্তু…।’
– ‘সময় দে একটু! সবটা ঠিক হয়ে যাবে!’
প্রাহীর মাথায় শিমলা হাত রাখলো। কিছুক্ষণ গল্প করে শিমলার বাড়ির সামনে আসতেই ও চলে গেলো। প্রাহী এখন নিজবাড়ির দিক হাঁটছে। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই পিছন থেকে পরিচিত কন্ঠস্বর পেয়ে ও থামলো।
– ‘প্রাহী!’
প্রাহী পিছন ফিরে দেখলো আকসাদ দাঁড়িয়ে। হালকা হাপাচ্ছে। দৌড়ে এসেছে মনে হচ্ছে!
– ‘কি অবস্থা! পরীক্ষা কেমন হলো!’
প্রাহী স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলো,
– ‘ভালো হয়েছে!’
আকসাদ ঘামাচ্ছে। প্রাহী সেদিক তাকিয়ে আনমনে বলে উঠলো,
– ‘আকসাদ! আপনিই ওই লোকগুলোর…। ‘
– ‘হু! কি হয়েছে এতে?’
আকসাদের সহজ স্বীকারোক্তিতে প্রাহী বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো! কিভাবে এতটা সহজভাবে কথা বলে যাচ্ছে!
– ‘কি হয়েছে মানে? আকসাদ আপনি ওই লোকগুলোর কিছুই বাদ রাখেন নি! একজনের মুখে স্টেপলার দিয়ে…।’
বলেই প্রাহী মুখে হাত চেপে ধরলো।
– ‘আপনি কি আমাকে ভয় পাচ্ছেন প্রাহী!’
– ‘ভয় পেলেও কি কারণে?’
প্রাহী অসহায় চাহনী দিয়ে রইলো! আকসাদ প্রাহীর মাথাটা নিজের ঘর্মাক্ত বুকের সাথে লাগিয়ে বললো,
– ‘আপনার ভয়ের কারণ কি প্রাহী! আমি! আমাকে নিয়ে ভয়ের কিছুই নেই প্রাহী! আপনার উপর কারোর খারাপ নজর বার বিপদের কারণ যেই হবে তার এই দশাই হবে! ওদের ভাগ্য ভালো ছিলো যে ওরা বাংলাদেশে আছে বিধায় তেমন কিছুই করতে পারিনি! কানাডায় থাকলে হয়তো মনমতো এদের সাথে কিছু করতে পারতাম!’
প্রাহী আকসাদের বুক থেকে মাথা তুলে নির্বাকভাবে আকসাদের দিক তাকিয়ে রইলো! আকসাদ প্রাহীর গালে হাত দিতেই ওর ফোন বেজে উঠলো। পকেট থেকে ফোনটা বের করতেই আকসাদ প্রাহীকে বললো,
– ‘প্রাহী! এখন আপাতত আসি। একটু বাসায় যেতে হবে। এমনিতেও দৌড়িয়েছি সকাল থেকে। ঘেমে গেছি। বাসায় যেয়ে শাওয়ার নিব! আপনি যেয়ে ফ্রেশ হোন! রেস্ট নিন কেমন! আমি পরে আবার আসব হুম?’
প্রাহীর গালে হাত বুলিয়ে আকসাদ দৌড়ে চলে গেলো। এত মার মেরেও নাকি এই লোক মনমতো এদের মারতে পারেনি? ভয়ের নাকি কোনো কারণ নেই! করুণ চোখে আকসাদের যাওয়ার দিক তাকিয়ে প্রাহী বাড়ির দিক চললো। মাথাটা ধরেছে ওর। বাসায় যেয়ে একটা ঘুম দিতে হবে। বাড়ির দরজার সামনে আসতেই প্রাহী কপাল কুঁচকালো। পাশ ফিরে দেখলো,,,,
চলবে,,,
#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ২৯(আমি আর তুমি!)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী
বাড়ির দরজার সামনে আসতেই প্রাহী কপাল কুঁচকালো। পাশ ফিরে দেখলো মধ্যম বয়সী একটা লোক ব্যাগ হাতে কেমন করে যেন ওর দিক একবার তাকিয়ে ওদের বাড়ির দিক চোখ বুলাচ্ছে। লোকটাকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে! ওইদিন রাতের ঘটনার পর থেকে এমনিতেই অচেনা পুরুষ মানুষের আশেপাশে থাকতে ভয় লাগেনা৷ প্রাহী দ্রুত বাড়ির ভিতর ঢুকে গেলো। মেইন দরজা লাগাতেই দেখলো লোকটা রিকশায় চড়ে চলে যাচ্ছে। এই লোক এই জায়গায় আসলে করছিলো টা কি? ভাবতে ভাবতে প্রাহী ঘরে ঢুকলো।
\
শিমলা ওর মায়ের ঘরের দিক যাচ্ছে। খুচরো টাকা ওর সব শেষ৷ লাইব্রেরিতে একটু যাওয়া দরকার। বড় নোট ভাঙলেই টাকার আর বরকত পাওয়া যায়না! কিভাবে কিভাবে যেন শেষ হয়ে যায়! তাই আপাতত মায়ের কাছ থেকে কটা খুচরো টাকা নিয়ে কাজ চালাবে। নইলে ওর জমানো টাকা শেষ হতে দেরী নেই!
– ‘হেনা শোন! এটো হাতে তোর সাথে কথা বলছি! হাতটা ধুঁয়ে আমি পরে ফোন দিচ্ছি তোকে!’
শিমলা বিছানাই ওর মায়ের পাশে বসতে বসতে বললো,
– ‘কে ফোন দিয়েছে?’
– ‘তোর মামী।’
– ‘বড় মামী? উনি আবার ফোন দিলো যে?’
শিমলার মা ফোনটা বিছানার উপর রেখে ওর দিক ফিরলো।
– ‘কি বলবে বললো! আমি বললাম পরে ফোন দিতে! এঁটো হাতে কথা বলা যায়?’
শিমলা কপাল কুঁচকালো,
– ‘উনার সাথে কথা না বললে হয়না? উনার কথাবার্তা আমার পছন্দ না।’
শিমলার মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
– ‘এরা হচ্ছে পরিবারের মানুষজন! তুই তোর জীবন থেকে বন্ধু বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী বা যে কাউকে বাদ দিতে পারলেও এইসকল পারিবারিক মানুষদের কখনও বাদ দিতে পারবিনা! ঘুরে ফিরে এদের সাথেই দিনশেষে তোর উঠাবসা করতে হবে! কিছু করার নেই।’
– ‘উনাকে একটু এড়িয়ে চলবে তা হলেই তো! আর এমন পারিবারিক মানুষ থাকার চেয়ে না থাকাই উত্তম।’
– ‘আচ্ছা হয়েছে? কোনো কাজে এসেছিস এ ঘরে নাকি এমনিতেই এলি!’
শিমলা মাথা নেড়ে বললো,
– ‘হু খুচরো টাকা লাগবে। কাজ আছে।’
শিমলার মা বিছানা ছেড়ে উঠলেন,
– ‘আচ্ছা বোস! আমি হাতটা ধুঁয়ে এসে দিচ্ছি।’
শিমলা ওর মায়ের যাওয়ার দিক তাকিয়ে মায়ের ফোনের দিক একবার তাকালো। ফোনটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ গুতাগুতি করতে থাকলো।
\
দুপুরের শেষের দিক এখন। প্রাহী ওদের বাড়ির সামনে উঠোনে চেয়ার পেতে বসে আছে। কালকে পরীক্ষা নেই। এজন্য একটু হালকা লাগছে নিজেকে! নক্ষত্রের সাথে অনেকদিন কথা হয়না! দাঁড়িয়ে ঘর থেকে ফোনটা নিয়ে আসলো। ফোন হাতে চেয়ারে বসতেই দেখলো বাড়ির মেইন গেইটের সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে! কেও এলো নাকি? প্রাহী সেদিক এগিয়ে গেলো। দরজা খুলে কাউকে তেমন দেখলো না। বের হয়ে কিছুক্ষণ দাঁডালো। ভিতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই হাতে হেচকা টানে ও পিছন ফিরে গেলো। প্রাহী ভয়ে হালকা চিল্লিয়ে উঠলো।
– ‘আকসাদ! আপনি?’
আকসাদ মাথা নাড়লো। প্রাহীর হাত ছেড়ে দিলো,
– ‘হ্যাঁ! ভয় পেলেন নাকি?’
প্রাহী বুকে হাত দিয়ে বললো,
– ‘অবশ্যই! এভাবে টান দিয়ে আচমকাভাবে যে কেউই ভয় পাবে?’
আকসাদ দুঃখী ভাব নিয়ে বললো,
– ‘সরিইইই! আপনি ওভাবে উঁকিঝুঁকি দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন তাই আটকালাম আপনায়?’
– ‘তাই বলে এভাবে? ডাক দিলেই তো হতো?’
আকসাদ হেসে মাথার চুলগুলো একহাত দিয়ে পেছন সরালো। প্রাহী চোখজোড়া ছোটো ছোটো করে বললো,
– ‘আপনি এখন এখানে? তাও আমার বাসার সামনে! বাবা কিন্তু বাসায়?’
আকসাদ এক ভ্রু উঁচালো,
– ‘তো?’
– ‘তো মানে? এভাবে বাড়ির সামনে আসাটা রিস্ক না?’
আকসাদ পকেট থেকে হাত বের করে প্রাহীর হাত ধরে বললো,
– ‘আচ্ছা ওকে। তাহলে চলুন?’
প্রাহী অবাক চোখে আকসাদের দিক তাকালো,
– ‘চলুন মানে কোথায়?’
আকসাদ প্রাহীর হাত ধরে নিয়ে যেতে যেতে বললো,
– ‘গেলেই দেখতে পারবেন। আসুন।’
.
এটা মূলত আশ্বিন মাস। আকাশ এর বাহারী রূপের দেখা মিলে এই সময়। কখনও বিশাল সামিয়ানার ন্যায় মেঘ এদিক সেদিক ছুটে বেডায় কখনও বা ঝুম করে সেই মেঘ সড়িয়ে নামে এক পশলা বৃষ্টি। যদিও এখন বাংলাদেশে কোনটা কোন ঋতু তা বোঝা বেশ মুশকিল। কিন্তু কোনো মেঘ বৃষ্টির খেলা, আর বিলের ধারে বাতাসের সাথে কাশফুলের মাথা হেলে পড়া দেখে মনে মনে আন্দাজ হয় এটা শরৎকাল! মাঝেমধ্যে কাশফুলের কিছু বাতাসে উড়ে আসা কিছু অংশ চারপাশে ঘুরতে দেখলেও বোঝা যায় শরৎ এলো বুঝি! অন্যতম মাধুরীর এক খেলায় প্রাহী মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! সাথে আকসাদও। তবে প্রাহীর দৃষ্টি সামনের প্রকৃতির দিক হলেও আকসাদের দৃষ্টি তার প্রেয়সীর দিক! মেয়েটা আজ মিষ্টি গোলাপি রঙের জামা পড়েছে। যদি সাদা বা নীল রঙের জামা পড়তো তাহলে হয়তো মেয়েটাকে ‘প্রকৃতি কন্যা’ নামে ডাকা যেতো!
বিলের ধারের অগোছালোভাবে দুলতে থাকা একগোছা কাশফুল হতে দুই থেকে তিনটা কাশফুল ছিড়লো প্রাহী। সামনে কাশফুলের ছোটো বন। প্রাহী সেদিক হাঁটতে হাঁটতে আকসাদের দিক তাকালো,
– ‘এখানে নিয়ে এলেন যে?’
আকসাদ প্রাহীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। হেসে বললো,
– ‘অনেক পড়াশোনা করছেন। মাঝেমধ্যে একটু ব্রেইক এরও প্রয়োজন আছে! তাছাড়া এর ফাঁকে আপনার কাশবনও ঘোরা হলো! এর আগে এসেছেন?’
প্রাহী মাথা নেড়ে কাশফুলগুলো ঝারতে ঝারতে বললো,
– ‘না এবার এই প্রথমই এলাম! পরীক্ষার পর আসবো ভাবছিলাম।’
– ‘যাক! এইদিক দিয়ে আমি প্রথম! আগেভাগে নিয়ে এসেছি!’
প্রাহী হাসলো। আকসাদ সেই হাসির দিক অবিরত চেয়ে। কোমল,স্নিগ্ধ প্রকৃতির সাথে মেয়েটাকে ততোটাই স্নিগ্ধ লাগছে!
– ‘একটা সাদা জামা পড়লে একদম মানাতো আপনাকে এই পরিবেশের সাথে। যদিও এখনও বেশ কমনীয় লাগছে?’
প্রাহী লাজুক হাসলো। আরও দুটো কাশফুল ছিলে বাতাসে ঝাড়ছে। ফুলগুলো উড়ে উড়ে বাতাসে মিশে যাচ্ছে! সাধারণ দৃশ্য কিন্তু লাগছে অসাধারণ!
– ‘কাশফুল তো কানে গোজা যায়না! তাইনা?’
প্রাহী এক গাল হেসে আকসাদের দিক তাকালো,
– ‘এতবড় পালকের ন্যায় ফুল কানে কিভাবে গুজবেন!’
– ‘তাও ঠিক?’
আকসাদ নিজ জামার দিক তাকিয়ে কিছুটা ঝাড়লো। প্রাহীর দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘ফুলের অংশগুলো জামা থেকে উঠছে না যে?’
প্রাহী আকসাদের কাছে এসে বুকের কাছের জামায় আঙুল দিয়ে খুঁটে খুঁটে ফুলের অংশগুলো নিয়ে ফু দিয়ে বাতাসে ছেড়ে দিচ্ছে।
– ‘এ সময় জামায় কাশফুল লাগবেই। কাশবনে এসেছেন ফুলের ছোয়াতো লাগবেই!’
– ‘হু এই যেমন আপনার ছোয়া পাচ্ছি?’
আকসাদের ঝুঁকে আসা দেখে প্রাহী পিছাতে নিলো। আকসাদ খপ করে প্রাহীর হাতটা বুকের সাথেই চেপে ধরলো। প্রাহী আকসাদের দিক তাকালো। শক্ত পুরুষালী দেহের বাম পাশের ‘ধুকধুক’ শব্দের সাথে উঠানামা ও বেশ টের পাচ্ছে! প্রাহী সরে আসতে নিলে আকসাদ আরও ওকে নিজের সাথে চেপে ধরলো।
– ‘এমন ছোটাছুটি করছেন কেন?’
– ‘এভাবে ধরে রেখেছেন যে?’
– ‘শুধু তো ধরেই রেখেছি! আর তো কিছুই করিনি?’
আকসাদের ওমন কথায় প্রাহী নজর সরালো। আরেকহাত দিয়ে আকসাদের বাহতে হালকা ধাক্কা দিতে দিতে বললো,
– ‘চুপ থাকুন! অসভ্য পুরুষ!’
আকসাদ বাঁকা হাসলো,
– ‘কিছু না করেই অসভ্য! তাহলে তো কিছু করতে হয়!’
আকসাদ ঝুকলো প্রাহীর দিক। প্রাহী অসহায় চোখে আকসাদের দিক তাকিয়ে। আকসাদ সেই দৃষ্টি হেসে উঠলো। প্রাহীর ছোট্ট গোলগাল মুখটা নিজের হাতে নিয়ে ঠোঁটদুটো কপালে নিয়ে ঠেকালো। গাঢ় স্পর্শ সেখানে অনুভব হতেই প্রাহী চোখ বুঝলো। আকসাদ সেই বন্ধ চোখের উপর হালকা ফুঁ দিতেই প্রাহী পিটপিট করে চোখ মেলে চাইলো। প্রাহীর হাতখানা ধরে সামনে এগোলো।
বিকেলের সময়টা শেষ হয়ে যাচ্ছে। আকসাদ আর প্রাহী টুকটাক কথা বলতে বলতে সুন্দর একটা মুহূর্ত পার করে সময়টা কাটালো। প্রাহীর কপালের চুলগুলো কানে গুজে দিয়ে দিলো,
– ‘সন্ধ্যে আলোর কোমল বনে
তুমি আমি কাশবনে!
দিনটা রয়ে যাবে মনে মনে!’
প্রাহী মিষ্টি হাসলো,
– ‘ভালোই তো বাংলায় কবিতা বলতে পারেন আপনি!’
আকসাদ চুলগুলো পিছনে সরালো,
– ‘হালকা! ওতো পারিনা। না পারলেও অসুবিধা নেই। পাশের বাঙালি নারী হতে শিখে নিব?’
প্রাহী মুচকি হাসলো। দু’একটা কথা বলতে বলতে আকসাদ আর প্রাহী কাশবন ঘুরে বাড়ির পথে রওনা হলো।
কিছুক্ষণ আগেই প্রাহী বাড়িতে ফিরেছে। ফ্রেশ হয়ে নিয়ে আসে কাশফুলের কিছু গুচ্ছ ফুলদানিতে রেখে বিছানায় বসতেই ফোনের শব্দে ফোনটা হাতে নিলো। ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো,,,
চলবে,,,