মন একে একে দুই পর্ব-৩৬+৩৭+৩৮

0
5

#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ৩৬(নীরবে!)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী

– ‘প্রাহী রিল্যাক্স!’

আকসাদের পাশে বসে প্রাহী ফুঁপিয়ে যাচ্ছে। আকসাদ এবার প্রাহীর কাঁধে হাত রেখে মাথাটা ওর নিজের কাঁধে নিলো।

– ‘প্রাহী আমি বললাম তো! বউভাতের অনুষ্ঠানের পর তুমি তোমার বাবা-মায়ের কাছে থাকবে কিছুদিন। এখন একটু শান্ত হও!’

প্রাহী মাথার একপাশ আকসাদের কাঁধে ফেলে চোখ বুঝলো। কান্না করার শক্তিটা ওর মধ্যে নেই! শুধু মুখ দিয়ে ফুঁপানোর আওয়াজটাই ভেসে আসছে। আকসাদ প্রাহীর মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। গাড়ি শিমলাদের বাড়ির সামনে থামতেই আকসাদ গাড়ি হতে থেমে প্রাহীকে আগে নামালো। শিমলার মা ওরা আগেভাগে ঘরে ঢুকে গেলো। আকসাদ প্রাহীকে নিয়ে আস্তে ধীরে বাড়িতে ঢুকলো। দরজার সামনে যেতেই দেখলো রাজ,তাইয়ান,শিমলা ওরা সবাই আকসাদের মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে। আকসাদের মায়ের হাতে একটা প্লেটে কিছু দুর্বাঘাস আর তাতে চাল আর ফুল রাখা। আকসাদ আর প্রাহী সামনে দাঁড়াতেই আকসাদের মা ওদের দূর্বাঘাস দিয়ে বরণ করে নিলো। আকসাদের মা প্রাহীর দিক তাকিয়ে আকসাদকে বললো,

– ‘বরণ করা শেষ। তোরা ঘরে যেতে পারিস এখন।’

রাজ এবার হাত নেড়ে বললো,
– ‘ঘরে যাবে কিন্তু এভাবে না ভাবীকে কোলে করে নিয়ে যেতে হবে!’

সবাই রাজের কথার তালে তাল মিলালো। আকসাদের মা আকসাদকে ইশারা দিতেই আকসাদ প্রাহীকে সোজা কোলে তুলে নিলো। দূর্বল প্রাহী আকসাদের কাঁধ চেপে ধরে মাথা নুইয়ে ফেললো! একরাশ লজ্জা তাকে ঘিরে ধরেছে! আকসাদ প্রাহীকে কোলে নিয়ে একদম সিড়ি বেয়ে নিজের ঘরে নিয়ে এলো। প্রাহীকে খাটে বসিয়ে দিতেই প্রাহী দম ছাড়লো। আকসাদ প্রাহীর সামনে একটু ঝুঁকে বললো,

– ‘ড্রয়িং রুমে বসালাম না কারণ ওখানে অনেক মানুষ! আপাতত তুমি ফ্রেশ হও! আমি তোমার লাগেজ টা দিয়ে যাচ্ছি। চেঞ্জ করে নাও।’

আকসাদ বেড়িয়ে যেতেই প্রাহী রুমের চারপাশটা চোখ বুলাচ্ছে! লাল গোলাপ আর গন্ধরাজ ফুলের গন্ধে আকসাদের ঘরটা কেমন মৌ মৌ করে করছে! বিছানায় সাদা রঙের মখমলের চাদর বিছানো তার উপর বড় করে গোলাপের পাপড়ি দিয়ে শেপ করে লেখা ‘আকসাদ+প্রাহী’। প্রাহী ক্ষণিকের জন্য ভুলে গিয়েছিলো আজ তার আর আকসাদের বাসর রাত! কথাটা ভাবতেই একরাশ শীতল হাওয়া যেন ওর শরীর দিয়ে নেমে গেলো! অজানা শঙ্কা ওকে চেঁপে ধরলো! যদিও আকসাদ ওর স্বামী! ওর উপর এখন আকসাদের পুরোপুরি অধিকার কাছে সব দিক থেকেই! কিন্তু ও কি আদৌও সবকিছুর জন্য প্রস্তুত!

শরীরে কাঁটা অনুভব হতেই প্রাহী ভাবলো এখন আগেভাগে ওর শাড়িটা চেঞ্জ করা খুব প্রয়োজন! এই ভারী শাড়ি পড়ে ওর আরও বেশি খারাপ লাগছে! প্রাহী মাথার আঁচল টা খুলে আয়নার সামনে যেয়ে দাঁড়ালো। এঁকে এঁকে সব গয়না খুলে মুখের মেকআপ টা তুলে ফেললো। পুরো মুখ ওর কেমন যেন লাল হয়ে গেছে! এত ভারী মেকআপ ওর স্কিনে স্যুট করেনা। মেকআপ তুলতেই এখন চুলটা কিভাবে খুলবে এটাই ভাবছে ও! মাথার এত বড় খোপা, স্প্রে করে ফাঁপানো চুল, ক্লিপ এগুলো ওর একার পক্ষে খোলা সম্ভব না!

– ‘হেল্প লাগবে!’

পিছনে আয়নায় শিমলাকে দেখেই প্রাহী ঘুরলো,
– ‘খুব! আমার চুলগুলো খুলতে একটু সাহায্য কর! আমি একা পারবো না।’

শিমলা নারিকেলের তেলের বোতল টা আয়নার সামনে রাখলো। আগে ও প্রাহীর মাথার চুলগুলোর ক্লিপ খুললো, এরপর খোপাটা আস্তে করে খুলে তেল হাতে নিয়ে প্রাহীর চুলে লাগিয়ে জটগুলো ছাড়াতে লাগলো।

– ‘মেকআপ তুলা শেষ!’

– ‘হ্যাঁ!’

– ‘রুমে আকসাদ ভাই লাগেজ পাঠিয়ে দিয়েছে। চেঞ্জ করে নে এখন!’

বলেই প্রাহীর মাথার চুলগুলোর জট ছাডানো শেষে ওর চুলগুলো খোপা করে দিলো। শিমলা তেলের বোতলের ঢাকনা আটকাতে আটকাতে বললো,

– ‘রাতে আর চুল ভেজাস না! কাল একেবারে শ্যাম্পু করে ফেলিস!’

প্রাহী মাথা নেড়ে লাগেজ থেকে কাপড় নামাতে লাগলো। শিমলা তেলের বোতল নিয়ে যেতেই ঘরের দিকে চোখ পড়লো ওর! ফুলে।সাজানো ঘর দেখেই ওর ভেতর থেকে একটা ভারী দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো! কিছু না বলেই বড় বড় পা ফেলে ও চলে গেলো!

আকসাদ বেশ দেরী করেই রুমে ঢুকছে! কাজিন দের সাথে আড্ডা দিতে যেয়েই দেরীটা হলো। তার মধ্যে তাঁদের বাসর ঘর সাজানোর টাকাও দিতে হয়েছে! সব কাহিনী শেষে ঘরে ঢুকতেই ওর নজর গেলো বিছানায় বসে থাকা প্রাহীর দিক! যে কিনা ওর রুমের প্রতিটা জিনিস খুঁটে খুঁটে দেখছে। আকসাদ প্রাহীর সামনে দাঁড়াতেই ও চোখ তুললো,

– ‘ফ্রেশ হওয়া শেষ!’

প্রাহী মাথা নাড়তেই আকসাদ বললো,

– ‘আমিও ফ্রেশ হয়ে আসি কেমন! তুমি বসো।’

আকসাদ ওর রুমের আলমারি থেকে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। গ্রাহী এদিকে হাত খালি মুচড়ে যাচ্ছে! কি হবে কি হবে ভেবে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ বাদে আকসাদ বেড়িয়ে আসলো। ওর পড়নে গ্রিন টি-শার্ট আর পেল ব্লু ট্রাউজার। আকসাদ টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে এগোতেই ওদের দরজায় কেউ নক করলো। আকসাদ দরজা খুলতেই দেখলো ওর মা খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে!

– ‘থাংক ইউ!’

আকসাদের মা হেসে আকসাদের হাতে খাবার দিয়েই চলে গেলো। মূলত আকসাদই বলেছিলো খাবার দিতে কারণ অনুষ্ঠানে প্রাহী আর ও কিছুই খেতে পারেনি। তাই ও ভাবলো এখন হালকা পাতলা কিছু খাওয়া প্রয়োজন!

প্লেট হাতে নিয়ে প্রাহীর সামনে বসতেই ওকে ‘হা’ করতে বললেই প্রাহী জিজ্ঞাসাবাদ দৃষ্টিতে তাকালো,

– ‘এভাবে তাকানোর কিছু নেই! সারাদিন তুমি না খাওয়া চলো কিছু খেয়ে নিবে!’

আকসাদ প্রাহীর মুখের সামনে পোলাও মাংস মিশিয়ে মেখে ধরতেই প্রাহী তা মুখে নিলো। ওর সত্যিই ক্ষুধা পেয়েছে! প্রাহীকে খাইয়ে দিয়ে প্লেটে যা ছিলো নিজেও একটু খেয়ে হাতধুয়ে প্লেট, বাটি রেখে আসতেই আকসাদ দেখলো প্রাহী বেশ সংকুচিত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে! আকসাদ প্রাহীর মুখ মুছে প্রাহীকে বিছানায় শুইয়ে দিতেই ও কেঁপে উঠলো। আকসাদ নিজেও বিছানায় শুয়ে প্রাহীকে একটানে নিজের বুকে নিয়ে আসলো।

– ‘রিল্যাক্স প্রাহী! তোমার টাইম লাগবে আই নো! এইযে আমার বুকে এখন আছো এটাই অনেক! এটা নিয়ে এখন টেনশন করা লাগবেনা!

প্রাহী আকসাদের বুকে মাথা রেখেই মিনমিন করে বললো,
– ‘আমি টেনশন করিনি!’

আকসাদ হাসলো। প্রাহীর মাথা তুলে ওর চোখের দিক তাকালো। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে! আকসাদ প্রাহীর মুখটা কাছে আনতেই প্রাহী চোখ বুজে ফেললো। তপ্ত গরম শ্বাস মুখে ফেলে আকসাদ ওর বন্ধ চোখের পাতায় চু*মু দিতেই প্রাহী আকসাদের বুকে শক্ত হাতে ধরতেই আকসাদ ওর মুখটা আরও কাছে এনে প্রাহীর পাতলা ঠোঁটের কোনে গাঢ় চু*মু আঁকলো! প্রাহী আকসাদের বাহু জড়িয়ে ধরতেই আকসাদ মুচকি হাসলো। প্রাহীর মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে বললো,

– ‘ঘুমাও!

প্রাহী আকসাদের কথায় চুপ রইলো! আকসাদের বুকে মাথা রেখে ক্লান্তিতে একরাশ ঘুম ওর চোখের পাতায় হানা দিলো।

,
,
,
,
,
,
,
,
,
,

বৌভাতের অনুষ্ঠান বেশ বড়সড় করেই করা হয়েছে৷ আকসাদ এবং প্রাহীর সকল বাড়ির লোক এসেছে। প্রাহী পাথরের ভারী কাজের মধ্যে লেহেঙ্গা পড়েছে, মাথায় সাদা ওড়না, চুলগুলো কার্ল করে একপাশে ছেড়ে দেওয়া, চোখে অল্প আইশ্যাডো দিয়ে মেকআপ করে কাজল দেওয়া, ঠোঁটে ন্যুড লিপস্টিক হালকা সাজে ওকে বেশ সুন্দর লাগছে। আকসাদের পড়নে সম্পূর্ণ কালো স্যুট, মাথার চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করে রাখা, তীক্ষ্ণ চোয়াল আর বরারের মতো ঠোঁটের কোনে হাসি রেখে সবার সাথে কথা বলছে। প্রাহীর মা এসে প্রাহীর সাথে দেখা করতেই প্রাহী উনাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠতেই প্রাহীর মা মেয়ের পিঠে হাত বুলালেন,

– ‘কাঁদছিস কেন! মা এসেছি তো! এভাবে কাঁদলে সাজ নষ্ট হয়ে যাবে!’

প্রাহী মাথা তুলে মাকে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘বাবা কোথায়!’

– ‘এখানেই আছে তোর শ্বশুর শ্বাশুড়ির সাথে কথা বলছে।’

– ‘আর ভাই?’

– ‘চলে আসবে এক্ষুণি! চিন্তা করিস না।’

প্রাহীর ফ্রেন্ডরা আসলো। রাতুল, তুলি, শোয়াইব এসে ওর সাথে দেখা করলো। প্রাহী শোয়াইব কে বলে উঠলো,
– ‘তন্নি কোথায়!’

শোয়াইব গা ঝেড়ে বললো,
– ‘আমি কিভাবে জানবো?’

প্রাহী মুচকি হেসে বললো,
– ‘আচ্ছা! সারাদিন প্রায় একসাথে থাকিস, ও এখনও কেন আসলো না জানিস না!’

রাতুল শোয়াইবের কাঁধে হাত রাখলো,
– ‘জানে কিন্তু না জানার ভান করছে আর কি!’

– ‘চুপ থাক।’

তুলিদের কথার মাঝেই তন্নি আর শিমলা আসলো। শোয়াইব আড়চোখে তন্নির দিক তাকিয়ে ওদের সাথে কথাবার্তা বলতে লাগলো। আকসাদ এসে একফাঁক ওদের খোঁজখবর নিয়ে গেলো।

– ‘তা বাসর রাত কেমন কাটলো!’

তুলির প্রশ্নে প্রাহী হকচকিয়ে উঠলো,
– ‘এটা আবার কেমন প্রশ্ন?’

– ‘আরে বল না! তোর তো বিয়ে গেছে! এখন তুই আমাদের আইডিয়া দিবি! কিভাবে কি হবে না হবে…।’

– ‘চুপ থাক!’

তুলি প্রাহীর রাগকে আপাতত পাত্তা দিলো না,
– ‘বল না?’

প্রাহী অসহায় চোখে তুলির দিক তাকিয়ে রইলো। এই মেয়ের লজ্জা বলতে কিছুই নেই? তুলি প্রাহীর চেহারা দেখে হুট করে বললো,
– ‘তোদের মাঝে কি কিছুই হয়নি!’

প্রাহী চোখ অন্যদিক ঘুরাতেই তুলি যা বোঝার বুঝে ফেললো,
– ‘তাইলে তোরা করেছিস টা কি? কাবাডি খেলেছিস নাকি?’

– ‘কিসব বাজে বকছিস!’

তুলি এবার হতাশ হয়ে প্রাহীকে বললো,
– ‘তোরা কি শুধু ঘুমিয়েছিস তাহলে!’

প্রাহী আর কিছু বলার আগেই শিমলা এসে ওদের খাবারের টেবিলে নিয়ে গেলো। কারণ এখন প্রাহী আর আকসাদের ফটোশ্যুট হবে। শিমলা যাওয়ার আগে প্রাহীর অস্বস্তিতে ঘেরা মুখটার দিক একবার তাকালো। শিমলা কিছু বলতে যেয়েও বললো না ততক্ষণে আকসাদ চলে এসেছে!

বউভাতের অনুষ্ঠান প্রায় শেষের দিক! শিমলা আর তাইয়ান মিলে কারা কারা এখনও খাবার খাইনি এইটা নিয়ে কথা বলছিলো৷ তাইয়ানের ফোন আসাতে ও ফোনে কথা বলতে বলতে অন্যদিকে চলে গেলো। শিমলা একটু হাঁটতেই কারো বুকের সাথে বাড়ি খেলো। একটু পিছিয়ে যেতেই থাকলো নক্ষত্র ওর সামনে বুকে হাতগুজে দাঁড়িয়ে।

– ‘দেখে হাঁটতে পারেন না!’

নক্ষত্র ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
– ‘আমি না হয় পারিনা! তুই দেখে চলতে পারিস না!’

শিমলা ভাবলো এর সাথে এখন কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠানে তর্ক বিতর্কের ইচ্ছা ওর নেই! পাশ কাটিয়ে যেতেই নক্ষত্র বলে উঠলো,

– ‘ওই ছেলেটা কে?’

শিমলা ভ্রু কুঁচকালো,
– ‘কোন ছেলেটা?’

নক্ষত্র দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তাইয়ানকে ইশারা করে বললো,
– ‘ওইযে ওই বিড়াল টা?’

– ‘বিড়াল বলছেন কেন? ও কি বিড়াল নাকি!’

শিমলার কথায় নক্ষত্র বিড়বিড়ালো। শিমলা কিছুই বুঝতে পারলোনা!

– ‘ওই ছেলের সাথে এত কথা! পছন্দ টছন্দ করিস নাকি!’

শিমলা নাক মুখ কুঁচকে বললো,
– ‘পছন্দ মানে! কাজিন কাজিনের সাথে কথা বলতেই পারে! এটা নিয়ে বাড়তি চিন্তাভাবনা করছেন কেন?’

নক্ষত্র এক ভ্রু উপরে তুললো,
– ‘আচ্ছা! শুধু কাজিন!’

– ‘উল্টোপাল্টা কথা বলবেন না একদম!’

– ‘বললে কি করবি!’

– ‘আমাদের বাড়ির পাশে জমিলা নানী আছে না! একদম বুডি মহিলা! সামনের দাঁত নেই! উনি তো নাকি বিয়েই করেনি শুনলাম। উনার সাথে আপনার বিয়ে দিয়ে দিব! তারপর ওই বুড়িকে নিয়ে আপনার ওই ভাঙ্গা বাইকে ঘুডে বেড়াবেন আর ফটফটর করবেন।’

বলেই ঝামটা মেড়ে শিমলা চলে গেলো। নক্ষত্র পিছন হতে রেগে চিল্লিয়ে বললো,

– ‘ওই তোর কত বড় সাহস! আমার বাইককে ভাঙ্গা বাইক বলিস!’

,
,
,
,
,
,
,
,
,
,
,
,

প্রাহীরা এখন শিমলাদের বাড়িতে। এতদিন প্রাহী ওর মা-বাবার সাথেই ছিলো। বউভাতের পর পর আকসাদ ওকে ওর বাবা-মার কাছে রেখে ওর পাসপোর্ট, ভিসা সব কিছু রেডি করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। প্রাহী এতদিন নিজেকে সামলেছে, নিজেকে নিজে বুঝিয়েছে, সব মেয়েরাই বিয়ের পর বাবা-মায়ের থেকে দূরে সরে যায়! সেখানে ও না হয় যে মানুষটাকে বিয়ে করেছে তার উপর আস্থা করে একটু বেশীই দূরে গেলো! যেতে যেহেতু হবেই সেখানে নিজেকে সামলে আগাম দিনের জন্য নিজেকে তৈরি করাই ভালো!

শিমলাদের বাড়িতে আজ সবাই এসে উঠেছে! প্রাহীর বাবা-মাও সেখানে। একমাত্র মেয়ে চলে যাবে থাকতে তো হবেই! প্রাহীর বন্ধু-বান্ধবরাও এসেছে! সবার সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে প্রাহী রুমে যেয়ে দেখলো আকসাদ লাগেজে কাপড় চোপড় গোছাচ্ছে। প্রাহী যেয়ে আকসাদের হাত থেকে কাপড়গুলো নিয়ে বললো,

– ‘আপনি যান আমি গুছাচ্ছি!’

– ‘ইটস্ ওকে প্রাহী আমি…।’

– ‘আপনি যেয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন! আমি করছি তো!’

আকসাদ মাথা নেড়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। প্রাহী প্রায় সব গুছিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে শিমলার ঘরের সামনে গেলো। ভিতরে ঢূকে দেখলো মেয়েটা নেই! বারান্দায় যেয়ে দেখলো শিমলা আকাশের দিক চেয়ে বসে আছে। কারো অস্তিত্ব টের পেতেই পাশে ফিরে প্রাহীকে দেখে কিছুটা চমকালো!

– ‘তুই এখানে?’

প্রাহী হালকা হেসে ওর পাশে বসে বললো,
– ‘কেন আসতে পারিনা?’

শিমলা মাথা নাড়লো!

– ‘অবশ্যই! গোছগাছ শেষ তোদের!’

– ‘হ্যাঁ শেষ! তোর কি মন খারাপ?’

শিমলা মাথা নেডে বললো,
– ‘না তো! মন খারাপ হতে যাবে কিসের জন্য?’

প্রাহী নরম দৃষ্টিতে শিমলার দিক চেয়ে বললো,
– ‘কিছুদিন ধরেই দেখছি তোর মুখের আবির্ভাব টা আর আগের মতো নেই! আমিও জিজ্ঞেস করে আর করে উঠতে পারিনি। বিয়ের মধ্যে আর কথা বলা হয়ে উঠেনি তোর সাথে। কিছু হয়েছে! আমাকে বল?’

শিমলা জোড়পূর্বক হেসে বললো,
– ‘কিছুই হয়নি! তুই চলে যাবি এজন্য খারাপ লাগছে!’

প্রাহী টলটল চোখে শিমলার দিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো,
– ‘আমি জানিনা আমি কিভাবে ওদেশে তোদের ছেড়ে থাকবো। যতোই নিজেকে বুঝাচ্ছি ততোই আরও খারাপ লাগারা আমায় জেঁকে ধরছে! আশেপাশের মানুষগুলোর থেকে এত দূরত্ব মেনে থাকতে পারব কি না জানিনা। আমার কেমন যেন লাগছে শিমলা! আ…আমি তোদের ছেড়ে…।’

শিমলা প্রাহীর পিঠে হাত বুলিয়ে বললো,
– ‘পারবি! চিন্তা করিস না! সময়ের সাথে সাথে দেখবি সব কিছু ঠিক হয়ে গেছে! আস্তে আস্তে দেখবি কিভাবে তুই সবকিছুর সাথে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিস! তখন তোর কাছে আমাদের ছেড়ে থাকতে কষ্ট লাগলেও যাদের সাথে থাকবি সেই মানুষগুলোকে দেখে আবার তোর মন ভালও হয়ে যাবে! তুই ঠিই মানিয়ে নিবি দেখে নিস! ইনশাআল্লাহ!’

প্রাহী চোখ মুছে আরও কিছুক্ষণ শিমলার সাথে কথা বলে উঠে দাঁড়ালো। কিছুদূর এগিয়ে আবার পিছন ফিরে শিমলার চোখে চোখ রেখে বললো,

– ‘আমি জানিনা শিমলা তুই কি নিয়ে এত কষ্টে আছিস! আমি তোকে চিনি! তোর চোখমুখ দেখেই আমি বুঝতে পারছি তুই ভালো নেই! বলতে চাচ্ছিস না বলে জোর করবো না! কিন্তু একটা কথা বলবো! কোনোদিন যদি তোর মনে হয় তোর এই কষ্টগুলো আমার সাথে শেয়ার করবি তাহলে করিস! আমি কান পেতে সেদিন তোর কথা শুনবো। আর এই কষ্টগুলো সরিয়ে যদি কেউ একটু সুখ তোকে উপহার দেয় তাহলে সেটা গ্রহণ করেনিস! অবজ্ঞা করিস না!’

শিমলা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,
– ‘সেই সুখ বরণ করে নিলেই বুঝি আমার কষ্টগুলো মুছে যাবে!’

প্রাহী স্নিগ্ধ হেসে বললো,
– ‘মুছে যাবে। বা হয়তো এই মন খারাপের দাগটাও তোর অন্তরে থাকবে না!’

শিমলা প্রাহীর দিক তাকিয়ে রইলো। প্রাহী হেসে নিজ ঘরের দিক চললো। শিমলা প্রাহীর কথাগুলো ভাবতে লাগলো। আজ ও চাইলেই পারতো আকসাদকে নিয়ে যে ওর অনুভূতিগুলো ছিল তা বলে দিতে! কিন্তু ও বলেনি! কিছু কথা নীরবে আড়ালে থাকাই শ্রেয়! কি লাভ বলে! যেখানে মিলনই ঘটেনি!

চলবে,,,

#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ৩৭(কি হচ্ছে!)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী

– ‘এত ঠান্ডা কেন!’

প্রাহী আপাতত বিলাসবহুল বাড়ির একটি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে। কানাডায় আজকে ওর তৃতীয় দিন। এখানে এখন বাংলাদেশের মতো গরম নেই। এখানকার আবহাওয়া এখন ঠান্ডা। আর কয়েকদিন বা এক মাস বাদেই এখানে তীব্রভাবে ঠান্ডা পড়ে যাবে।প্রাহী এখানে এসেছে পর থেকে রুম থেকেই বের হয়নি। প্লেন জার্নিতে যে কয়বার ও বমি করেছে কোনো হিসেব নেই! বাংলাদেশ থেকে দুবাই এ আসার পর আট ঘন্টার জন্য যখন প্লেন থেমেছিল শরীর বেশ দূর্বল হয়ে যাওয়ায় তখন আকসাদ ওকে নিয়ে সরাসরি সেখানকার হাস্পাতালে নিয়ে ওকে চেকআপ করায় টানা ছয় ঘন্টা সেখানে রেস্টের পর আবার ওরা রওনা হয়। জীবনের প্রথম প্লেন জার্নি যে ওর এমন হুলস্থুল হবে সেটা ও ভাবেনি! এখানে আসার পর মাথাব্যথায় বেচারি দুইদিন রুম থেকে আর বের হতে পারেনি। আকসাদ আর ওর মাও ওকে আর বের হওয়ার জন্য জোর করেনি! শীতল হাওয়া গায়ে লাগতেই প্রাহী কুঁকড়ে গেলো! ওর পড়নে এখন ক্রিম কালারের পাজামা সেট। আকসাদ ওকে বারবার বলেছিল ভারী কিছু পড়তে। ও পড়েনি! রুমে তো ওর স্বাভাবিকই লাগছিলো! এজন্য আকসাদের কথায় তেমন পাত্তা দেয়নি! কিন্তু এখন বারান্দায় এসে ঠান্ডার ভাব টা ও এখন হারে হারে টের পাচ্ছে! একজোড়া উষ্ণ হাতের আলিঙ্গনে প্রাহী চোখ বন্ধ করে ফেললো। হাতজোড়ার মালিক ওর গায়ে মোটা একটা চাদর জড়িয়ে দিয়েছে। প্রাহী পিছন ঘুরতেই শক্তপোক্ত একখানা বুকের সাথে ধাক্কা খেলো। দেখলো আকসাদ ওর দিকে নিচু হয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে,

– ‘এত রাতে ঠান্ডায় এখানে এভাবে কেন এসেছো?’

প্রাহী ছোট গলায় বললো,
– ‘জানতাম না আপনার দেশে যে এত ঠান্ডা পড়েছে!’

আকসাদ প্রাহীকে নিজের সাথে জড়ালো,
– ‘আমার দেশ! এটা এখন আপনার দেশও ম্যাডাম!’

– ‘হু! সিটিজেনশিপ আগে পেয়ে নেই!

– ‘সেটা পেয়ে যাবে দ্রুতই‌! মাথা ব্যাথা কমেছে!’

– ‘হ্যাঁ অনেকটাই! আপনাদের বাড়ির সামনে ওটা কি? লেক?’

আকসাদ প্রাহীকে সামনে ফিরিয়ে ওর কাঁধে থুতনি রাখলো,
– ‘হুম! তোমায় নিয়ে বের হবো! এখানে অনেক লেক,পার্ক,অনেক সুন্দর স্পট আছে। ইউ উইল এঞ্জয়!’

প্রাহী মাথা নাড়ালো। আকসাদের বুকে হেলান দিয়ে ভিনদেশী আকাশের অসাধারণ অর্ধচন্দ্র চাঁদের দিক তাকিয়ে রইলো। একই চাদরের নিচে দুজন নিস্তব্ধভাবে রাতের পরিবেশটা এঞ্জয় করছে! প্রাহীর অগোছালো খোপার চুলগুলো কপাল, আর ঘাড় জুড়ে পড়ে আছে। আকসাদ নিঃশব্দে নিজের হাত দ্বারা চুলগুলো সেখান হতে সরিয়ে প্রাহীর নরম কাঁধে নিজের ঠোঁট ছোয়ালো। খোলা কাঁধে আকসাদের পুরু ঠোঁটের স্পর্শে প্রাহী কাঁধটা নাড়া দিয়ে উঠলে আকসাদের স্পর্শ গিয়ে ঠেকলো প্রাহীর ঘাড়ে। প্রাহীর ঘাড়ে নাক দিয়ে গভীর শ্বাস নিয়ে সেখানে ঠোঁটের গাঢ় ছোঁয়া দিতে লাগলো। ঘাড়ে ঠোঁটের ভিজে ছোঁয়া আর প্রবল স্পর্শে প্রাহী জড়িয়ে থাকা আকসাদের হাতের উপর নিজের হাত চেপে ধরলো। ঘাড়ে আরও কিছু ঠোঁটের স্পর্শ ফেলে আকসাদ প্রাহীকে নিজের দিক ঘুরালো। প্রাহীর নিচু মুখ দু’হাতের ভাজে নিজের মুখ বরাবর আনলো। বন্ধ চোখের পাতায় হালকা ফুঁ দিতেই প্রাহী পিটপিট করে চোখ মেলে চাইলো। সামনে থাকা মানুষটা ওর দিকে নেশালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! প্রাহী দূর্বল চোখে সেই চোখজোড়ার দিক তাকিয়ে রইলো৷ আকসাদের ঘন ঘন নিশ্বাস ওর চোখেমুখে বারি খাচ্ছে। আকসাদ এর নজর প্রাহীর চোখের দিক থেকে ওর কম্পনরতো পাতলা ঠোঁটজোড়ায় এসে নজর ঠেকলো! আকসাদ নিজের হাতের বুড়ো আঙুল দ্বারা প্রাহীর নিচের ঠোঁটে হালকা ঘষতেই প্রাহী কেঁপে উঠে আকসাদের হাতের উপর নিজের হাত রাখলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নরম ঠোঁটজোড়ার কাঁপনী কিছুক্ষণ অবলম্বন করে নিজের ঠোঁটখানা এগিয়ে নিয়ে গেলো সেই নরমঠোঁটগুলোকে গভীরভাবে ছুঁতে! নিজের ঠোঁটের উপর আকসাদের গভীর নিঃশ্বাস অনুভব করতেই প্রাহী চোখ বুঝেতেই তীব্র আওয়াজে প্রাহী আর আকসাদ দুজনেই চোখ মেলে একে অপরের দিক তাকিয়ে আশেপাশে তাকালো। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় সোনালী পশমধারী বেশ বড়সড় একটা গোল্ডেন রেট্রিভার ঘেউঘেউ করে একনাগাড়ে গলা উঁচু করে কিছু একটার দিক তাকিয়ে ডেকে যাচ্ছে। প্রাহী আকসাদের দিক ফিরে জিজ্ঞেস করলো,

– ‘এটা আপনাদের কুকুর?’

– ‘না এটা রিচার্ড আংকেল দের রেট্রিভার!’
কুকুরটার দিক তাকিয়েই আকসাদ জবাব দিলো।

– ‘রিচার্ড আংকেল কে?’

– ‘বাবার ফ্রেন্ড। পাশের ওই হোয়াইট কালারের বাড়িটাই উনাদের!’
আকসাদের ইশারা অনুযায়ী প্রাহী সেই বাড়িটা দেখলো। অন্ধকারে তেমন কিছু দেখা গেলো না!

– ‘কুকুরটাকে কি বেঁধে রাখেনা?’

– ‘না। রিড পোষা কুকুর। টেম করা।’

প্রাহী মুচকি হাসলো,
– ‘ওর নাম রিড?’

– ‘হু!’

প্রাহী আকসাদের দিক ফিরে উৎফুল্লভাবে বললো,
– ‘ওকে কি ধরা যাবে!’

আকসাদ প্রাহীর দিক তাকিয়ে শান্তস্বরে বললো,
– ‘হু যাবে! তুমি ধরবে!’

– ‘হ্যাঁ!’

– ‘আচ্ছা ধরো। আমি নিয়ে যাব! এখন ঘুমাবে এসো! রাতের ঔষধ টা বাকি আছে তোমার।’

আকসাদ প্রাহীকে কোলে তুলে নিলো। রাস্তায় তাকাতেই দেখলো রেট্রিভারটা পশমগুলো নেড়ে নেড়ে গা দুলিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। আকসাদ কিছুক্ষন সেদিক তাকিয়ে প্রাহীকে নিয়ে ঘরের ভিতর গেলো।

– ‘আমি যেতে পারব সমস্যা নেই! আমাকে নামান!’

– ‘আমারও বউয়ের নিছক ওজন দু’হাতে নিতে কোনো সমস্যা নেই!’

,
,
,
,
,
,
,
,
,
,
,

রাতে ঠান্ডা লাগলেও সকালের রোদটা প্রাহী বেশ উপভোগ করছে! সকালের নাস্তা সেরে আকসাদের সাথে বেড়িয়েছে প্রাহী। প্রথমেই আকসাদ ওকে নিয়ে ‘ইউনিভার্সিটি ওফ টরোন্টো’ তে নিয়ে গেছে। আকসাদের বোন আয়সুন এখানে ভর্তি হয়েছে বিধায় আকসাদ প্রাহীকে এখানেই ভর্তি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও প্রাহীকে জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে ছিলো ওর এখানে পড়ার ইচ্ছে আছে কি না! এদিকে মস্ত বড় দালান,নীলচে আর পুরাতন সোনালী রাঙা ইউনিভার্সিটির
বিশাল মাঠ,প্রান্তর, পরিবেশ দেখে বিমোহিত হয়ে আছে! বার বার আকসাদকে জিজ্ঞেস করছে, ‘আকসাদ আমি কি এখানে পড়তে পারব! আমাকে কি এলাউ করবে এখানে পড়তে উনারা!’

আকসাদ প্রাহীর দিক হেসে আর প্রশ্ন করলো না৷ সোজা ওকে নিয়ে অফিস রুমে যেহে প্রাহীর প্রিভিয়াস ইউনিভার্সিটির সকল পেপার, আর ট্রান্সফরমেশন এর জন্য এপ্লাই করে দিলো। তারপর প্রাহীকে নিয়েই প্রফেসর ‘রেইন’ এর রুমে গেলো। প্রফেসর রেইন এই ইউনিভার্সিটির রিসার্চার প্লাস সিনিয়র প্রফেসর। এছাড়াও উনি আকসাদের এক্স প্রফেসরদের মধ্যে একজন! আকসাদ উনার আন্ডারে প্রায় অনেক রিসার্চের পেপার করেছে। ওই থেকেই প্রফেসর রেইনের সাথে ওর সম্পর্ক অনেকটা স্যার স্টুডেন্ট এর সম্পর্কের থেকে অনেকটাই আন্তরিকতার দিক এগিয়ে গেছে! প্রফেসর রেইনের ঢুকতেই রেইন বিশাল দাঁতের হাসি দিয়ে উঠে দাঁড়ালো,

– ‘ওয়েলকাম! হোয়াট এ সারপ্রাইজ!’

আকসাদ আলতো হেসে মাথা নেড়ে বললো,
– ‘ক্যান উই টেক এ সিট!’

প্রফেসর রেইন হাসলো,
– ‘ডোন্ট বি সো ফরমাল!’

আকসাদ হেসে প্রাহীকে নিয়ে বসলো৷ প্রাহী অবাক চোখে রেইনের চেম্বার দেখতে থাকলো। বইখাতা,ফাইল, কাঁচের গ্লাসের জিনিস দিয়ে পুরো কেবিন সাজানো!

– ‘সাথে এটা কে! গার্লফ্রেন্ড?’

আকসাদ একগাল হেসে বললো,
– ‘নো স্যার! ওয়াইফ!’

রেইন বড় বড় চোখে তাকালো,
– ‘আরে ব্যাটা! কি বলো! বিয়ে করে ফেলেছো! কবে কখন কিভাবে! জানালেও তো না! আমি তোমার বিয়ে খাব বলে অনেক এক্সাইটেড ছিলাম ইউ নো!’

আকসাদ শ্বাস ফেলে বললো,
– ‘আমারও অনেক ইচ্ছে ছিলো আপনাদের সবাইকে ইনভাইট করার আমার বিয়েতে। কিন্তু কিছু কারণবশত তা হয়ে উঠেনি! বাট সুন আমি একটা পার্টির এরেঞ্জমেন্ট করবো অনলি ফর মাই ওয়েডিং! সেখানে চিফ গেস্ট হিসেবে না হয় আপনাকে নিমন্ত্রণ করলাম আর আরেকজনকে!’

প্রফেসর রেইন দ্রুত মাথা নেড়ে বললেন,
– ‘শিউর! আই উড লাভ টু! দিস টাইম আমি মিস করতে চাইছি না! বাঙালি খাবার দাবার পার্টিতে রেখো! আর খিচুড়ি আর বিফ যাতে থাকে! আই লাভ দিস ডিশ! ইউ নো!’

আকসাদ হেসে বললো, ‘অবশ্যই! অবশ্যই! থাকবে!’

– ‘বাই দ্য ওয়ে! ওয়াইফ তো অনেক সুইট! চয়েজ ইজ গুড হুহ্!’

– ‘এজ ওলয়েজ!’

– ‘তা নাম কি?’

আকসাদ প্রাহীর দিক তাকাতেই প্রাহী নরম আওয়াজে বললো,
– ‘প্রাহী!’

– ‘শুধু প্রাহী!’
আকসাদ প্রাহীর দিক ইশারা করে বললো,
– ‘নো! মিসেস প্রাহী!’

– ‘ইয়াহ্! নাও ইটস্ ফাইন!’

প্রাহীর দিক ইশারা করে কথা বলায় ও অস্বস্তিতে চোখ নামিয়ে রাখলো। কিন্তু রেইন লোকটাকে ওর বেশ পছন্দ হয়েছে! সাদা চামড়ার, মাথায় হালকা চুল ওয়ালা, চোখে মোটা চশমার লোকটা কি স্বাচ্ছন্দ্যে ওদের সাথে কথা বলে যাচ্ছে! আবার দু’একটা বাংলা কথাও কি সুন্দর করে বলছে!

– ‘প্রফেসর একটা হেল্প লাগবে!’

– ‘হ্যাঁ বলো না!’

– ‘আমি আমার ওয়াইফকে এখানে টান্সফার করাতে চাচ্ছিলাম। কাগজপত্র সব জমা দিয়েছি কিন্তু ক্যান ইউ ডু ফেভার!’

প্রফেসর রেইন সাথে সাথেই উত্তর দিলো,
– ‘ওফ কোর্স! তা আকসাদের ওয়াইফ মিসেস প্রাহী! কি নিয়ে পড়তে চাচ্ছো?’

‘আকসাদের ওয়াইফ প্রাহী’ ডাকায় ও বেশ লজ্জা পেলেও স্বাভাবিকভাবেই বললো,
– ‘বিবিএ নিয়ে পড়ছিলাম! সেটা নিয়েই এগোতে চাচ্ছি!’

– ‘দ্যাটস নাইস! আমি ওর কাগজপত্র গুলো দেখবো। এন্ড আই উইল সেন্ড ইউ এ মেইল যদি দরকার পড়ে তো!’

– ‘থ্যাংকস প্রফেসর!’

– ‘মেনশন নট! জলদি পার্টি থ্রো করে আমাকে ইনভাইট দাও!’

আকসাদ হেসে আরও কিছু কথা বলে প্রাহীকে নিয়ে বেড়িয়ে এলো। গাড়িতে বসে আকসাদ প্রাহীকে আগে শপিং মলে নিয়ে গেলো। সেখানে যেয়ে বাসায় পড়ার জন্য প্রাহীর কম্ফোর্টেবেল অনুযায়ী পাজামা সেট, আর কিছু জ্যাকেট সোয়েটার কিনে দিলো। প্রাহী ট্রায়াল রুমে যেয়ে এক একটা জামা গায়ে দিয়ে এসে আকসাদকে দেখাচ্ছে। আকসাদ হতাশার শ্বাস ফেললো, এই মেয়ের গায়ে সব ঢোলাঢালা হচ্ছে! অথচ ওর সাইজের জামাই ওকে নিয়ে দিচ্ছে তাও যেনো এই জামা ওর শরীরে লাগছেনা! এই চিকন-পাতলা শরীর নিয়ে ও আকসাদের আদর কিভাবে সামলাবে! ভাবতেই আকসাদ আরও হতাশার শ্বাস ফেলে প্রাহীকে জামাকাপড়গুলো কিনে দিয়ে গাড়িতে উঠলো। ভার্সিটির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কুইন্স পার্কের ওখানে প্রাহীকে সহ আকসাদ নামলো। পাশেই এক ক্যাফেটেরিয়াতে ঢুকে দুজন মিলে স্যান্ডউইচ আর কফি ওর্ডার করে তা খেয়ে কফি হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো ওরা। প্রাহীর যথেষ্ট খিদে লেগে গিয়েছিলো! তাই ও আর মানা করেনি আকসাদকে ক্যাফেটেরিয়াতে আনার জন্য! কফি হাতে বেরোতেই আকসাদ প্রাহী কিছুক্ষণ উইন্স পার্কের ওখানে বসলো। প্রাহী অবাক দৃষ্টিতে আশপাশ টা দেখছে! তার মধ্যে কিছু মেয়ে হাত, পা খোলা রেখে শর্টস পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রাহী ওদের দেখে লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এতদিন টিভিতে এসব দেখলেও বাস্তবে দেখতে ওর কেমন যেন লাগছে! অথচ ওরা কি সহজে হাঁটাচলা করছে। প্রাহী মিনমিনে গলায় আকসাদকে বললো,

– ‘ওদের কি শীত করেনা! এভাবে হাত-পা বের করে হাঁটছে যে!’

আকসাদ প্রাহীর কথা শুনে জোড়ে হেসে দিলো,
– ‘না প্রাহী এটা ওদের কাছে নরমাল! তীব্র শীত ছাড়া ওরা নিজেদের কভার করেনা!’

প্রাহী ঠোঁট গোল করে ‘ওওও’ জানালো। আকসাদ প্রাহীর দিক ঝুঁকে কানেকানে বললো,
– ‘তুমিও এভাবে খোলামেলাভাবে চলবে। বাট শুধু আমার সামনে!’

– ‘কিসব বলছেন!’

প্রাহী গাল লাল করে সামনে তাকালো। আকসাদ প্রাহীর গালে হালকা চুমু দিয়ে বললো,
– ‘ইয়েস সত্যি বলছি!’
প্রাহী দ্রুত গাল ধরে আশেপাশে তাকালো! কেউ দেখলো না তো!

,
,
,
,
,
,
,
,
,
,
,

আকসাদ ধীর গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে। কারণ তার পাশে থাকা রমণী বেশ উৎসুক দৃষ্টিতে বাইরের প্রকৃতি এঞ্জয় করছে বিধায় ও গাড়িটা স্লো মোশনেই চালাচ্ছে। প্রাহী জানালার বাইরে দিয়ে বড় বড় চোখে এক একটা স্ট্যাচু, পার্ক, মস্ত বড় কারুকার্যিত দালান দেখে ‘ওয়াও’ বলে যাচ্ছে! এক হাতে কফি আর অন্য হাতে আকসাদের বাহুতে হাত দিয়ে বারবার বলছে, ‘দেখুন আকসাদ! কি সুন্দর না!’

আকসাদ মুগ্ধ চোখে প্রিয়তমার হাসিহাসি মুখখানা দেখতে ব্যস্ত! হঠাৎ সামনে থেকে একটা সাদা ‘ক্রাইসলার’ গাড়ি দ্রুত ওদের দিক এগোতেই আকসাদ জোড়ে ব্রেক টেনে নিজের ব্ল্যাক ‘ডোজ চার্জার’ কারটায় স্পিড নিয়ে বাঁকাভাবে চালালো। আচমকা গাড়ির স্পিড বেড়ে যাওয়ায় প্রাহীর হাত থেকে কফিটা পড়ে গেলো। কি হচ্ছে ও কিছুই বুঝতে পারছে না! ও কোনো রকম আকসাদের হাতে হাতে রেখে বললো,
– ‘আ…আকসাদ প্লিজ! গাড়িটা আস্তে চালান!’

এদিকে আকসাদের নজর সামনের ‘ক্রাইসলারের’ দিক স্থির! যা ওদের দিক তেড়ে আসতে ব্যস্ত!,,,

চলবে,,,

#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ৩৮(কি হবে!)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী

-‘আ…আকসাদ প্লিজ! গাড়িটা আস্তে চালান!’

এদিকে আকসাদের নজর সামনের ‘ক্রাইসলারের’ দিক স্থির! যা ওদের দিক তেড়ে আসতে ব্যস্ত! আকসাদ দ্রুত নিজের ব্ল্যাক চার্জার গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে এগিয়ে নিয়ে সজোরে থামলো। এদিকে অপর পাশের সাদা ক্রাইসলারের গাড়িটাও জোড়ে ব্রেক কন্ট্রোল করে আকসাদের গাড়ির পাশে থামলো। পাশাপাশি দুটো গাড়ি থামতেই আকসাদ সাথে সাথে গাড়ির দরজা খুলে নামতেই বিপরীত গাড়ি হতেও দপাটে একজন বেড়িয়ে এলো। গাড়ির দরজা বন্ধ করে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আকসাদের দিক তাকিয়ে তীক্ষ্ণ বাঁকা হাসি ছুঁড়তেই আকসাদ দ্রুত তার সামনে যেয়ে দাঁড়ালো! চোয়াল শক্ত করে হিসহিসিয়ে সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে জিজ্ঞেস করলো,

– ‘হাও ডেয়ার ইউ?’

ঠোঁটের হাসিটা আরও বাঁকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে প্যান্টের পকেটে হাত রেখে সামনের ব্যাক্তি আকসাদের কাছাকাছি উল্টো জিজ্ঞেস করলো,

– ‘হাও আর ইউ মাই ফ্রেন্ড!’

আকসাদ নাকের পাটা ফুলিয়ে বললো,
– ‘তোর মাই ফ্রেন্ডের গুষ্টি কিলাই!’

সামনের ব্যাক্তি চওড়া হেসে বললো,
– ‘হোয়াটস রং! সংঘর্ষমূলক প্রতিযোগিতা এর আগে আরও হয়েছে!’

– ‘বাট দিস টাইম আ’ম নট এলোন! আমার ওয়াইফ আছে সাথে!’

আকসাদ দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো। ততক্ষণে গাড়ি থেকে প্রাহী নেমে এসেছে । আকসাদ ও তার সামনে দাঁড়ানো অপর ব্যাক্তির কোনো কথাই ও শুনেনি! প্রাহী এবার অপরিচিত ব্যাক্তির দিক ভালোভাবে লক্ষ্য করলো। ডার্ক নেভি ব্লু শার্ট সাথে ব্ল্যাক প্যান্ট,মাথায় হ্যাট পরিহিত শুভ্র চামড়ার এক শ্বেতাঙ্গ ব্যাক্তি সটান হয়ে আকসাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে! আকসাদের মতোই বলিষ্ঠ টানটান শরীর নিয়ে ওর দিক বাঁকা হেসে চেয়ে আছে! প্রাহী ভ্রু কুঁচকে সেই ব্যাক্তির দিক আরেকবার আকসাদের দিক তাকালো! এদের দু’জনকে দেখতে একই রকম লাগছে যে! আকসাদের মতোই সাদা চামড়া, সিল্কি চুল, আর ফেস কাটিংও একই রকম! শুধু ওই ব্যাক্তি যথেষ্ট ফরমাল লুকে আছে এই যা! আর আকসাদ নরমাল গেটআপে রয়েছে! নইলে দুজনের মধ্যে অনেক মিল! উনি কি আকসাদের কাজিন নাকি!

আকাশকুসুম চিন্তাভাবনার মাঝে দেখলো আকসাদ এবং ওই ব্যাক্তি দুজনেই ওর দিকে তাকিয়ে আছে! শ্বেতাঙ্গ সেই মানুষটা এবার প্রাহীর দিক ভ্রু উঁচিয়ে ইশারা করতেই আকসাদ হেঁটে প্রাহীর পাশে এসে ওর কাঁধ জড়িয়ে নিজের কাছে এনে বললো,

– ‘মিট মাই ওয়াইফ! মিসেস আকসাদ হোসেন প্রাহী!’

সামনের ব্যাক্তি প্রাহীর দিক ফিরে মাথার হ্যাট খুলে মুখে হাসি বজায় রেখে ওকে উদ্দেশ্য করে বললো,

– ‘হ্যালো মিসেস প্রা…।’

বলে থেমে আকসাদের দিক তাকিয়ে সেই ব্যাক্তি এক ভ্রু উঁচু করে জিজ্ঞেস করলো,

– ‘আমার ভাবী বলা উচিত রাইট?’

আকসাদ গম্ভীর স্বরে জবাব দিলো,

– ‘অবশ্যই!’

বাঁকা হেসে সেই ব্যাক্তি প্রাহীর দিক তাকিয়ে এবার বললো,
– ‘হ্যালো প্রাহী ভাবী!’

প্রাহী অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! ও কিছুই বুঝতে পারছে না এখানে কি হচ্ছে! চোখের পলক ফেলে একবার আকসাদের দিক তাকাচ্ছে তো আরেকবার সেই অপরিচিত ব্যাক্তির দিক তাকাচ্ছে! আকসাদ প্রাহীর মনোভাব বুঝতে পেরে ওকে বললো,

– ‘প্রাহী! এটা আমার চাইল্ডহুড ফ্রেন্ড ‘ভিঞ্চি ব্রোলিন’।’

প্রাহী কিছুক্ষণ আকসাদের দিক তাকিয়ে এবার সম্মুখে দাঁড়ানো ‘ভিঞ্চি’ নামক ব্যাক্তির দিক তাকাতেই সে বলে উঠলো ,

– ‘প্রাহী ভাবী! আপনি যা গেস করছেন সেটা সত্যি!’

প্রাহী বোকার মতো তাকাতেই সেই ব্যাক্তি দুই গাল হেসে বললো,

– ‘আমি আর আকসাদ শুধু ফ্রেন্ড না! আমরা কাজিনও!’

প্রাহী আকসাদের দিক তাকাতেই আকসাদ মাথা নেড়ে বললো,

– ‘হ্যাঁ প্রাহী! ভিঞ্চি আমার খালাতো ভাই! ওর মা আর আমার মা দুজন আপন বোন! বিয়ের সময় ওরা থাকতে পারেনি! কারণ ভিঞ্চির বাবার শরীরটা ভালো ছিলনা! এজন্য বাংলাদেশে খালামণিরা আসার সুযোগ করতে পারেনি!’

প্রাহী এবার সবটা বুঝতে পেরে নিশ্চিত হলো! এতক্ষণ ধরে ও আসলে এটাই ভাবছিলো যে দুজনের চেহারায় অনেকটা মিল রয়েছে! হয়তো এরা পরস্পরের আত্নীয় হবে! আর ওর ধারণা সঠিক হলো! প্রাহী ভিঞ্চি নামক মানুষটার দিক চেয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,

– ‘আসসালামু আলাইকুম!’

ভিঞ্চি হেসে বললো,

– ‘ওয়া আলাইকুমাস সালাম!’

আকসাদের দিক তাকিয়ে ভিঞ্চি ভ্রু কুঁচকালো,

– ‘ভাবী তো অনেক ছোটো!’

– ‘তো?’

আকসাদের ত্যাড়া জবাবে ভিঞ্চি হাসলো,
– ‘তো মানে! তুই তো অনেক বড়! বুড়ো হয়ে এমন বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করেছিস!’

আকসাদ কপাল কুঁচকে বললো,
– ‘বুড়ো মানে! এমনভাবে বলছিস যেন আমার ত্রিশ পেরিয়ে গেছে!’

– ‘হতে কতক্ষণ!’

– ‘চুপ শালা!’

আকসাদের ধমকানোর আওয়াজে ভিঞ্চি সেদিক ভ্রুক্ষেপ না করে প্রাহীর দিক তাকিয়ে বললো,

– ‘ও কি আপনাকে বাল্যবিবাহ করেছে ভাবী!’

প্রাহী অপ্রস্তুত চাহনী দিলো! এত বড় বড় লোকের মাঝে ওকে দেখতে ছোটো লাগলেও ও তো আর এতো ছোটো নয়! বয়স তো কবেই ওর আঠারো পেরিয়ে গেছে! প্রাহী নিঃশব্দে মাথা নাড়ালে ভিঞ্চি হাফ ছেড়ে বললো,

– ‘যাক! তাহলে ঠিক আছে! যদিও আঠারোর নিচে হলেও মনে হয় ধরেবেঁধে বিয়েটা করে নিতোই! রাইট?’

আকসাদের দিক ইশারা করে কথাটা বলে উঠলো ভিঞ্চি। আকসাদ এবার বিরক্তিসূচক দৃষ্টিতে ভিঞ্চির দিক চেয়ে বললো,

– ‘এখানে কি করছিস তুই?’

কাঁধ দুলিয়ে ভিঞ্চি জবাব দিলো,
– ‘একটু চমক দিতে এলাম!’

– ‘হয়েছে চমক দেওয়া! তোর চমকের ঠেলায় আমার বউ হতভম্ব হয়ে ওর কফি ফেলে দিয়েছে! স্টুপিড।’

ভিঞ্চি তৎক্ষনাৎ প্রাহীর দিক চেয়ে বললো,
– ‘তাই নাকি! নো প্রব্লেম ভাবীকে আমি কফি নিয়ে দিচ্ছি? চল।’

প্রাহী সৌজন্যমূলক হাসি হেসে বললো,
– ‘না না তার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি কফি খেয়েছি।:

– ‘আরেকবার না হয় খেলেন! ধরে নিন এটা আমার পক্ষ থেকে ট্রিট ওকে!’

আকসাদের দিক তাকিয়ে এবার ভিঞ্চি বললো,
– ‘ভাবীকে নিয়ে আয়! আমি এগোচ্ছি!’

বলেই মাথায় হ্যাটটা দিয়ে ভিঞ্চি নিজের শুভ্র গাড়িটায় উঠে সামনে এগোলো। আকসাদ এবার প্রাহীকে গাড়িতে বসতে বলে নিজেও গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিলো। প্রাহী সিট বেল্টটা লাগিয়ে আকসাদকে বললো,

– ‘আপনি উনাকে আটকালেন না কেন! আমি তো একবার কফি খেয়েছিই?’

আকসাদ গাড়ি চালাতে চালাতে বললো,
– ‘অসুবিধে নেই প্রাহী! এই সুযোগে তোমার সাথে ওর আলাপ টাও হয়ে যাবে! আর ঘুরাও হবে! আপাতত যেখানে যাচ্ছি অনেক সুন্দর প্লেস ওটা! গেলে ভালো লাগবে তোমার!’

প্রাহী আর কিছু বললো না। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলো।

,
,
,
,
,
,
,
,
,
,
,
,
,
,
,

‘কজি কফি রুম’স’ নামক রেস্টুরেন্টে আপাতত প্রাহী,আকসাদ আর ভিঞ্চি একসাথে বসে! এটা আকসাদ আর ভিঞ্চির পছন্দের কফিশপ! প্রায় সময় ওরা এখানে এসে আড্ডা দেয়! এখানকার লাটি, আর ক্যাপেচিনোটা অনেক মজার! আকসার আর ভিঞ্চি নিজেদের জন্য ক্যাপেচিনো আর প্রাহীর জন্য লাটি অর্ডার করেছে। ভিঞ্চি আকসাদের দিক তাকিয়ে বললো,

– ‘আমি তো জানতাম এবার দেশে গিয়ে শুধু এনগেজমেন্ট সেরে আসবি! একদম বিয়ে করে নিয়ে চলে আসবি, এটা ভাবিনি !’

আকসাদ প্রাহীর দিক আড়চোখে চেয়ে বললো,
– ‘এমনে হলেও বিয়ে করতে হতো ওমনে হলেও করতে হতোই! তাই একবারে বিয়ে করে নিয়ে চলে এসেছি!’

– ‘সো এডভান্স হা! বাই দ্য ওয়ে!’

প্রাহীর দিক চেয়ে ভিঞ্চি আকসাদকে ইশারা করে বললো,
– ‘এ যে আপনার উপর এত্ত দিওয়ানা ছিলো জানতাম! কিন্তু পাগলামীর সীমা এভাবে ছাড়িয়ে যাবে ভাবিনি?’

প্রাহী লজ্জায় চোখ নত রাখতেই আকসাদ বললো,

– ‘তোর বেলায় দেখবো! কি করিস!’

ভিঞ্চি শ্বাস ফেলে বললো,
– ‘আমার সময় আসতে দেরী আছে! এই প্রাহী ভাবী আপনার কোনো বোন নেই!’

প্রাহী মাথা নাড়ালো ‘না’ বোঝালে ভিঞ্চি হতাশার সুর টেনে বললো,

– ‘আমার ভাগ্যে বউ জুটতে দেরী আছে! ভাবী মেয়ে দেখবেন আমার জন্য বুঝলেন!’

প্রাহী মিষ্টি হাসতেই অর্ডারকৃত কফি ওদের টেবিলে এসে পৌঁছাতেই যে যার কফি হাতে নিয়ে তাতে চুমুক দিলো।

– ‘কফি ভালো লেগেছে ভাবী!’

প্রাহী হেসে বললো,
– ‘হুম অনেক টেস্টি!’

– ‘যাক! আমার ট্রিট দেয়া সার্থক তাহলে!’

বলে ভিঞ্চি হাসলো। আকসাদ কফিতে সিপ দিয়ে প্রাহীর দিক তাকাতেই দেখলো প্রাহী রেস্টুরেন্টের এক পাশে গার্ডেনের দিক চেয়ে আছে। বিভিন্ন রকম ফুল আর গাছ গাছালি দিয়ে গার্ডেন টা সাজানো! আকসাদ প্রাহীর হাতে হাত রেখে বললো,

– ‘গার্ডেনে যাবে!’

প্রাহী চোখের ভাষায় ‘হ্যাঁ’ বোঝাতেই আকসাদ ওকে বললো,

– ‘তাহলে যাও! এখন আপাতত ফাঁকা আছে ওদিকটা। ঘুড়ে এসো!’

– ‘আচ্ছা!’

প্রাহী কফি হাতে নিয়ে গার্ডেনের দিক গেলো। বাহারি রঙের অনেক ফুল এখানে! ছোটো ছোটো লাল,হলুদ,সাদা ফুল পুরোটা জায়গা জড়িয়ে রয়েছে! সবগুলো ফুলের নাম ও জানেনা! এর মধ্যে অর্কিড ফুলটাই ও কেবল চিনেছে! সাদা আর গোলাপীর মিশেলে একটা অর্কিড ফুল ছিড়ে প্রাহী কানে গুজে বাকিফুলগুলো ছুঁয়ে দেখতে লাগলো। আকসাদ বসে থেকে এই দৃশ্য দেখে মুচকি হেসে কফিতে চুমুক দিলো।

– ‘জয়েন করছিস কবে থেকে!’

ভিঞ্চির প্রশ্নে আকসাদ প্রাহীর থেকে নজর সরিয়ে ওর দিকে ফিরলো,

– ‘কাল থেকে!’

ভিঞ্চি কফির কাপ টেবিলে রেখে মুখে সিরিয়াসভাব এনে বললো,

– ‘হাতে তেমন সময় কিন্তু নেই! যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে!’

আকসাদ কফির মগের দিক চেয়ে! নিজের মনের মধ্যে অনেককিছুই চলছে ওর! কিন্তু কিভাবে কি করবে ও বুঝে উঠতে পারছেনা! ভিঞ্চি আকসাদের দিক চেয়ে বললো,

– ‘কুল ডাউন! কি হবে না হবে এটা নিয়ে ভেবে লাভ নেই!আমাদের এবার একটু ডিসকাশন দরকার! সমাধান তো একটা না একটা বেড়োবেই রাইট!’

আকসাদ মাথা নাড়লো,
– ‘তা তো অবশ্যই! কিন্তু তোর এত তাড়া হঠাৎ!’

ভিঞ্চি হালকা শ্বাস ফেলে বললো,
– ‘কারণ আমার প্রমোশন হয়েছে!’

আকসাদ উদ্রেক কন্ঠে বললো,
– ‘তাই নাকি! লেফটেন্যান্ট!’

– ‘ইয়েস!’

আকসাদ হেসে বললো,
– ‘ট্রিট কই?’

ভিঞ্চি ভ্রু উঁচিয়ে শুধালো,
– ‘বিয়ে করে নিয়েছিস! দাওয়ার দিয়েছিস! আবার আমার কাছে ট্রিট চাস! এইযে ট্রিট দিচ্ছি! এটাই এনাফ!’

– ‘বিয়ের দাওয়াত না পেলেও ট্রিট পেয়ে পাবি! বাট তোকেও বেশ বড়সড় একটা ট্রিট দিতে হবে! এই কফিতে কাজ হবেনা!’

ভিঞ্চি বুকের মাঝে হাত ভাজ করে বললো,
– ‘আচ্ছা! দেখা যাবে!’

– ‘আকসাদ আপনার ফোনটা দিন না! ফুলগুলোর ছবি তুলবো!’

আকসাদ প্রাহীকে নিজের ফোনের লক খুলে দিতেই ও সেটা নিয়ে চলে গেলো। ভিঞ্চি এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে মাথার হ্যাট হাতে নিয়ে বললো,

– ‘আমি আজ আসি! দেখা হচ্ছে তাহলে?’

– ‘হু খুব শীঘ্রই!’

আকসাদ ভিঞ্চি প্রাহীর দিক এগোলো। ভিঞ্চি প্রাহীকে খোলা হাসি দিয়ে বললো,

– ‘আসি তাহলে ভাবী!’

প্রাহী তড়িঘড়ি করে বললো,

– ‘আমাদের সাথে বাসায় চলুন না! দুপুরে আমাদের সাথে লাঞ্চ করবেন?’

– ‘শিউর! কিন্তু আজ না, অন্য কোনো একদিন ভাবী! আজ তাড়া আছে!’

– ‘আসবেন কিন্তু! আর কফির জন্য ধন্যবাদ!’

– ‘ধন্যবাদ দিতে হবে না সুইট ভাবী! তা তোরা হানিমুন কবে যাচ্ছিস!’

প্রাহী ভিঞ্চির কথায় কুনো চোখে আকসাদের দিক তাকাতেই ও বললো,

– ‘কবে যাচ্ছি তা জানিনা। আপাতত তুই যা! তোর না দেরী হচ্ছে হু!’

ভিঞ্চি হেসে আকসাদ এর সাথে হাত মিলিয়ে ওকে আর প্রাহীকে বিদায় জানিয়ে রেস্টুরেন্ট হতে বেড়িয়ে গেলো। আকসাদ প্রাহীর দিক ঘুরে বললো,

– ‘ওই সাদা যে ফুল গাছ টা দেখছো! ওটাকে বলে ট্রিলিয়াম ফুল! ওর পাশে যেয়ে দাঁড়াও তোমার ছবি তুলে দিচ্ছি!’

– ‘আপনি তুলবেন না!’

– ‘হু তুলবো! আগে তোমাকে কয়েকটা ছবি তুলে দেই মাই ফ্লাওয়ার?’

প্রাহী লাজুকভাবে হেসে আকসাদের কথামতো ফুল গাছের পাশে দাঁড়াতেই আকসাদ ওর ছবি তুলে দিয়ে নিজেও ওর সাথে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে কিছুক্ষণ সময় কাঁটিয়ে বাড়ির দিক রওনা হলো।

,
,
,
,
,
,
,
,
,
,
,
,
,
,
,

আলোর ঝাপটা চোখে পড়তেই প্রাহী পিটপিট করে চোখ খুললো। সকাল হয়ে এসেছে! নাকে ‘সিনামনের’ তীব্র সুগন্ধী লাগতেই প্রাহী ধীরে উঠে বসলো। গায়ের উপর কম্বলটা ভালোভাবে জড়ালো! রাতে তেমন শীতে লাগেনি কিন্তু এখন একটু শীত লাগছে! ঘুম জড়ানো চোখে প্রাহী সামনে তাকাতেই ওর সব ঘুম উবে গেলো! অবাক দৃষ্টিতে তাকাতেই দেখলো…

চলবে,,,