মন কারিগর পর্ব-৩২+৩৩

0
250

#মন_কারিগর🩷 [পর্ব-৩২]
~আফিয়া আফরিন

বেলা পেরোবার কিছুক্ষণ পরেই জুহির কর্ণকুহরে ফের পায়ের আওয়াজ ভেসে এল। হ্যাঁ, আওয়াজটা তো ক্রমশ এইদিকেই আসছে। জুহি সচেতন হল। সে লক্ষ্য করেছে তাকে সর্বক্ষণ পাহারা দিয়ে রাখে এক ব্যক্তি। ওই লোকটা সকাল থেকে এখনো আসে নাই এই ঘরে। মনে মনে ভেবেছে হয়ত, মেয়েটা অজ্ঞান আছে কি আর করতে পারবে? কিন্তু আদতে ব্যাপারটা তা নয়। জুহি অজ্ঞান হয়ে থাকার ভান করে পুরো ব্যাপারটা পরিলক্ষিত করছিল। সে উঠে দাঁড়িয়ে লাঠিটা নিয়ে ফের দরজার পাশে দাঁড়াল। কাঁপা কাঁপা হাতে অপেক্ষা করতে লাগল বাহিরের মানুষটির ভিতরে আসার। অবশেষে দরজার ছিটকিনি খুলে গেল। জুহি দেখতে পেল সেই মধ্যবয়সি লোকটিকে, যে তার অসহায়ত্বের কথা বলে জুহিকে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। আর কিছু ভাবতে পারল না জুহি। একপাশ থেকে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে আঘাত করল লোকটির মাথায়। লোকটি কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হতেই জুহি দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে দিল। লোকটি পুরোপুরি অচেতন হয়ে যায় নাই। কিন্তু জুহি তাকে পুরোপুরি অচেতন করার জন্যই পরপর কয়েকটা বাড়ি দিল তার মাথায়। লোকটি যখন একেবারে লুটিয়ে পড়ল তখন জুহির ওষ্ঠকোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। তৎক্ষণাৎ হাতের লাঠি ফেলে লোকটার প্যান্টের পকেট সার্চ করতেই একটা ফোন পেয়ে গেল। একটা চাপা নিঃশ্বাস ফেলে ডয়াল করল বহু প্রতীক্ষিত ফোন নাম্বারে।
প্রথমবারেই ফোন রিসিভ হল। জুহি হন্তদন্ত হয়ে বলল, ‘রাফি! আমি জুহি।’

কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চল হয়ে রইল ঐপাশটা। পরক্ষণেই গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে উঠল, ‘জুহি জুহি, তুমি? কোথাও আছ তুমি? তুমি জানো, টেনশনে সবার কী অবস্থা হয়েছে? কোথায় গেছ তুমি? তোমার ফোন নাম্বার কেন বন্ধ রেখেছ? কোথায় আছ বলো না, প্লিজ! আর কতো শাস্তি দেবে আমাকে? আমি একটু শান্তি চাই জুহি। প্লিজ আন্ডারস্ট্যান্ড মি দিস টাইম!’
জুহি সামান্য হাসল, খুব সামান্য। পরক্ষণেই চোখমুখ কঠিন হয়ে এল। বড্ড শান্তিতেই তো ছিল। কে তার শান্তির জীবনে নজর দিল, তাকে তো একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতেই হবে। কে তার থেকে রাফির ভালো থাকা কেড়ে নিতে চাচ্ছে, জানতেই হবে।
জুহি পড়ে থাকা লোকটার দিকে চেয়ে দেখল, অচেতন হয়ে রয়েছে। জুহির কিছু করতে হলো না, লোকটি খুকখুক কাশির মাধ্যমে জানান দিল তার জ্ঞান আছে। জুহি চোখের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে
চোখ মেলে তাকাল। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে।
জুহি যথাসম্ভব নিজেকে শক্ত রেখে জিজ্ঞেস করল, ‘আমাকে এখানে আনার উদ্দেশ্য?’

লোকটি ওষ্ঠকোণে বক্র হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘আমি বলব? মেয়ে তুমি যে এতটা বোকা জানা ছিল না। এখনো বুঝতে পারছ না তোমাকে এখানে ধরে নিয়ে আসার উদ্দেশ্য?’

‘না পারছি না।’

লোকটি ফের হেসে উত্তর দিল, ‘এখন না পারলেও আজ রাতে ঠিকই বুঝে যাবে। রাতে তোমাকে সহ আরো বেশ কয়েকটা মেয়েকে চট্টগ্রাম পাচার করা হবে।’ এটুকু বলেই তিনি ক্ষীণভাবে হাসতে লাগলেন।

জুহি বিস্মিত হল। তবে বিস্ময় চেপে রেখে বলল, ‘তো আপনাদের এই পাচারকারী দলের মূল হোতা কে? আমাদের সাবেক চেয়ারম্যান সাহেব নাকি?’

লোকটা হাসির থামিয়ে কুটিল চাহনি নিক্ষেপ করল। লম্বা লম্বা কয়েকটা শ্বাস ফেলল। মাথায় আঘাতটা বেশ ভালোই পেয়েছে। সে বলল, ‘এইতো ঠিক বুঝতে পারছ। একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলছিলে তোমরা। প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, নারীদের স্বাবলম্বী করার উপায়, তাদের নিয়ে হইচই একটু বেশি হয়ে গেছিল কিনা! ইশশশ, নিজের দোষে আজ নিজের এত বড় সর্বনাশ। তোমাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যারা আছে, আমাদের নেক্সট টার্গেট তারা। একে একে সব যাবে আর তোমাদের চেষ্টাও বিফলে যাবে।’

জুহি হাসল। বলল, ‘সেই সুযোগটা পেলে তো!’
লোকটি কিছু না বুঝে অবুঝের মত চেয়ে রইল। আর জুহি অপেক্ষা করতে লাগল। অপেক্ষার প্রহর বোধহয় শেষ হলো না। তার আগেই এই দলের কয়েকজন লোক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল।
এসেই বলল, ‘পুলিশ এসেছে। আমাদের পালাতে হবে। আর যে করেই হোক, সাথে করে এই মেয়েটাকেও নিতে হবে। চেয়ারম্যান সাহেবের অর্ডার, যেকোনো পরিস্থিতিতে যেন এই মেয়েটা হাতছাড়া না হয়।’
একজন এগিয়ে এসে জুহির হাত ধরল। আরেকজন পেছন থেকে মুখ বাঁধল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অতর্কিত আক্রমণে জুহির আর কিছুই করার রইল না। ওরা জুহিকে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে জঙ্গলের রাস্তায় এগিয়ে গেল। ইতিমধ্যে পুলিশ ঘেরাও করেছে চারিদিক। জুহি জঙ্গলের ফাঁকফোকর দিয়ে দেখতে পাচ্ছে কয়েকজনকে। মুখ বাঁধা, এই অবস্থায় চিৎকারও করা যাবে না। তবে, সৃষ্টিকর্তা কোনো না কোনো পথ তো খোলা রাখেন-ই। জুহির পায়ের কাছে কয়েকটা ভাঙাচোরা টিনের টুকরো ছিল। সেগুলোকেই পায়ের সাহায্য ছুঁড়ে দিল সামনে থাকা রডের উপর। খানিক শব্দ হতেই কয়েকজন পুলিশ এই দিক ফিরে তাকাল। জুহিকে দেখতে পেয়েই এগিয়ে এল। রাফিও আশেপাশেই ছিল, আওয়াজ পেয়ে সেও এগিয়ে এল। জুহিকে দেখতে পেয়ে যেনো এই দিনের বেলাতেই সে আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেছে। লোকসমাজ পরোয়া না করে সকলের সামনে জুহিকে জড়িয়ে ধরল। ঠিক সেইভাবে, যেভাবে একদল মেঘ এসে পুরো আকাশটাকে জড়িয়ে ধরে। এত মানুষ জনের মধ্যে নিজেকে সামলাল রাফি, নয়ত বোধহয় সত্যি বাচ্চাদের মতো করে কেঁদেই ফেলত।
জুহি তাল সামলাতে না পেরে পেছনে থাকা গাছটাকে এক হাতে আঁকড়ে ধরল। ফিসফিস করে বেশ স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘মিস করছিলে বুঝি? এই আজকে না তোমার রেকর্ডিং ছিল, তুমি যাও নাই?’

রাফি মুখ তুলে বলল, ‘আমি বেঁচে আছি এটাই কি বেশি নয়!’
জুহি আর কথা বাড়াল না। পুলিশ ফোর্স ওখানে থাকা সবাইকে এরেস্ট করল।
জুহিকে নিরাপদে দেখে সকলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল এবং এ বাড়ি ও বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিল।
জাহিন জুহিকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা তোমাকে এখানে এরা কেন নিয়ে এলো? তোমার সাথে এদের কি?’

‘এটা আমাদের চেয়ারম্যান সাহেবের কাজ জাহিন ভাই। উনি একটা নারী পাচার চক্রের সাথে জড়িত।’

জাহিন অবাক হয়ে বলল, ‘তাই? আমরা একেবারের জন্য টেরও পেলাম না।’
পেছন থেকে পুলিশ ইন্সপেক্টর রাকিবের গলার আওয়াজ ভেসে এল।
‘সে খুব কুটবুদ্ধিসম্পন্ন লোক। আমরা এই দলের অনেককে এরেস্ট করেছি এর আগে, কিন্তু কখনো মূলহোতার কাছে পৌঁছাতে পারিনি। আজকে জানতে পারলাম নাটের গুরু আমাদের চেয়ারম্যান সাহেব। আমি পুলিশ ফোর্স পাঠিয়েছি ওনাকে এরেস্ট করার জন্য। থ্যাংকস জুহি, আমাদের এতদিনের মিশন টা আজ তোমার জন্য পূরণ হল। থ্যাংকস এ লট!’

ওরা সবাই রাকিবের সাথে থানায় গেল, ওখানে যাবতীয় কিছু কাগজপত্রে সই করে সোজা হাসপাতালে এল। জুহির মাথার আঘাত টা খুব বেশি গাঢ় নয়, তবুও ডাক্তার তাকে বেড রেস্টে থাকতে বলল।
জুহি বাড়ি ফিরে আসার পর আরেকদফা তাকে নিয়ে আনন্দের হইচই হল। সায়রা হক বললেন, ‘আমার ছেলেটা তো ভেবেছিল আমি তোমাকে কী না কী বলেছি, যার কারণে তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে গেছো। রাফিটা এতো পাগলামি করছিল জানো না! ভাগ্য ভালো, আল্লাহ মুখ তুলে চেয়েছে।’

শ্বশুরমশাই বললেন, ‘রাফি একটু ছেলেমানুষ স্বভাবের ছেলে এটা ঠিক। কিন্তু আমি এর আগে কখনো ওকে এরকম পাগলামি করতে দেখি নাই। এই কিছু সময়ে কষ্ট ওকে একদম চেপে ধরেছিল।’
জুহি কেমন একটু লজ্জা পেল। কী দরকার ছিল রাফির ওমন পাগলামি করার? ছেলেটাকে প্রথম যেদিন দেখেছিল, সেদিনই বুঝেছিল এই ছেলে শুধু গায়ে-গতরেই বড় হয়েছে মাথায় বুদ্ধি কিছুই নেই। আজ তার প্রমাণও পেল জুহি।
একটু আগে তো মাহিদও বলছিল, ‘রাফির না এখন বিয়েটা করা একদম উচিত হয় নাই। এই ছেলে তো পুরোই পাগল, একে তো আমি আগে যথেষ্ট ম্যাচিউর ভেবেছিলাম। ও যদি পারত, সবার সামনে বসে হাত-পা ছড়িয়ে কান্না করত। ভাগ্যিস তোর খোঁজ পাওয়া গেল। নাহলে আমি শিওর, এই ছেলে এখন হাসপাতালে ভর্তি থাকত। এই নড়বড়ে হৃদপিণ্ড নিয়ে এই ছেলেটা গায়ক কিভাবে হলো বুঝলাম না। তারপর পুলিশের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করেছে।’
জুহি ঘরে এসে রাফিকে গালে দু’হাত গুঁজে আপনচিত্তে বসে থাকতে দেখল। নিজে গিয়ে পাশে বসল। তারপর শান্ত গলায় বলল, ‘কি ব্যাপার মন খারাপ নাকি? সবাই ওইখানে গল্প করছে আর তুমি এখানে একা বসে কি করছ?’

‘সবার মাঝে আমার থেকে কাজ কি?’

‘তাও ঠিক। তুমি সবার মাঝে থেকেই বা কী করবে? এই আজকে পুলিশটাকে দেখছ? দেখতে কি সুন্দর না! ইশশশ, কেনো যে আমার সাথে আগে পরিচয় হলো না তার!’ মজার ছলে বলল জুহি। ফিরে পাওয়া এবং ফিরে আসার আনন্দে সে সত্যি উচ্ছাসিত।

রাফি থমথমে গলায় প্রশ্ন করল, ‘কেন আগে পরিচয় হলে কি করতে?’

জুহি নির্বিকার ভাবে হাতের আঙ্গুলে চুল পেঁচাতে পেঁচাতে বলল, ‘কি করতাম মানে? সোজা বিয়ের পিঁড়িতে গিয়ে বসতাম। ইশশশ, কেন যে আগে তার দেখা পেলাম না?’
রাফি মুখে কিছু না বলে আড়চোখে বেশ কয়েকবার তাকাল জুহির দিকে। জুহি হাসি হাসি মুখ করে বসে আছে, ছোট বাচ্চাদের মতো দুই পা নাড়াচ্ছে, আবার আঙ্গুলে চুল পেঁচাচ্ছে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে বেশ শান্তিতে আছে। রাফি যদিও জানে, যদি কথাগুলো তাকে ফাজলামি করেই বলেছে তবুও বুকের মধ্যে এক ধরনের চাপা কষ্ট অনুভব হচ্ছে। প্রিয় মানুষের মুখে অন্যকারো নাম, অন্য কারো প্রশংসা; এসব শোনা আর বুকের মধ্যিখানে স্বজরে ছুড়ির আঘাত করা সমান।
রাফি বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। তারপর জুহির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি বাহিরে যাচ্ছি তুমি আমারে আর কল দিবা না। আমার গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে, আমি চাইনা আমার সেই কাজের মধ্যে কেউ আমাকে বিরক্ত করুক।’

জুহি শুধাল, ‘এই সময় কই যাচ্ছ তুমি?’

‘সব প্রশ্নের জবাব তোমাকে দিতে হবে? আমার খবরাখবর তোমার না রাখলেও তো চলবে। যাও না যাও, যার কাছে শান্তি পাবে তার কাছে যাও।’
জুহিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রাফি উঠে দাঁড়াল এবং হনহন করে চলে গেল।

জুহি মুচকি হেসে বলে আপনমনে বলল, ‘ঝগড়া করার মুডে আছি, ভাবলাম সাহেব রেগে গিয়ে কয়েকটা কথা শোনাবে। পাল্টা আমিও কিছু বলব। কিন্তু, কিন্তু সাহেব তো আমার সব পরিকল্পনা বাতিল করে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেল। ইশশ এই কয়েকদিন কত মিস করেছি আমাদের ঝগড়াঝাঁটির মিষ্টি মুহূর্তগুলো।’
কিছুক্ষণ বাদে জুহি উঠে ফোন করল জাহিনকে। বিস্তারিত সব খবর তার কাছ থেকেই জেনে নিল। এলাকার বেশ ভালো পদে থাকা কিছু মানুষ এই নারী পাচার চক্রের সাথে জড়িত অনেক আগে থেকেই। বিগত কিছুদিন আগে হঠাৎ করে উধাও হয়ে যাওয়া দুটো মেয়ের সন্ধানও পেয়েছে পুলিশ ফোর্স। জুহি সব শুনে চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
.
.
.
চলবে……

#মন_কারিগর🩷 [পর্ব-৩৩]
~আফিয়া আফরিন

কাউকে ভালোবেসে তার সাথে সারা জীবনের মতো জড়িয়ে গেলে, নিজেকে হারিয়ে ফেলারও একটা ভয় থাকে। যে মানুষগুলো খুব যত্নে খুব ভালোবেসে আগলে রাখে, তাদের কাছ থেকে বোধহয় এত সহজে দূরে সরে যাওয়া যায় না!
জুহির জীবনের এই কয়েক ঘন্টা তার কয়েক বছরের মত কেটেছে। প্রিয়মানুষ হারানোকে যে বেশ ভয় পায় মেয়েটা। জীবনটা শুরু হওয়ার আগে পর পর কতগুলো মানুষ হারিয়ে গেল। কিন্তু রাফিকে সে যে কোন কিছুর মূল্য নিজের কাছে রাখতে চায়, এই মানুষটাকে হারিয়ে ফেললে জুহির হয়ত নিজের জীবনের কাছে চাওয়ার আর কিছুই থাকবে না। আর নিজের জন্য কিছু চাওয়ার না থাকলে কি বেঁচে থাকা সম্ভব? জীবনে কিছু পরিসর বোধহয় এমনই কঠিন থাকে!

রাফি উদ্দেশ্যহীন পার্করোডে ঘুরছিল। ফোনটা হাতে নিয়েও কাঙ্ক্ষিত ফোন নাম্বারে একটা ফোনকলের তৃষ্ণায় সে ক্লান্ত পথিকের ন্যায় ভবঘুরে। অবশেষে কী মনে করে যেনো ফোনটা করেই ফেলল। যদিও মন বলছিল, ‘না রাফি ফোন করিস না। জুহিকে জুহির মতো থাকতে দে। ও যখন ফোন করে তোর কোনো খোঁজখবর নেয় নাই, তাই তুইও নিবি না।’
কিন্তু ইচ্ছেশক্তি বলছিল অন্য কথা। ‘জুহি তো তোকে বিনা প্রকাশে ভালোবাসে‌। ও তোকে জেলাসফিল করানোর জন্য ওসব বলেছে‌। তুই চিনিস না তোর জুহিকে? এই এত বড় একখান দুনিয়ায় তুই ওকে না চিনলে আর কে চিনবে বলতো?’
রাফি তার মনকে প্রাধান্য না দিয়ে এই বেলায় ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিল। ফোন করল জুহিকে।
রাফির ফোন পেয়ে আনমনে হেসে উঠল জুহি। এ যেন কিশোরীদের মত প্রাণোচ্ছল হাসি! যেই হাসিতে রাখাল বাঁশি বাজায়। যেই হাসিতে জল্লাদের নৃশংসতা আটকে দেয়। যেই হাসিতে গোছানো মানুষটার জীবনটাও এলোমেলো হয়ে যায়। যেই হাসিতে এক ধ্যানে চলা পথিকও তার পথ হারায়!
জুহি ফোন রিসিভ করতেই রাফি যথেষ্ট গম্ভীর গলায় বলল, ‘তোমার মামা মামীর সাথে একবার কথা বলে নিও তারা খুব চিন্তায় ছিলেন।’

‘হুঁ বলেছি তো।’

‘ওহ আচ্ছা। ডাক্তার বোধহয় তোমাকে রেস্ট করতে বলেছিলেন? খাওয়া দাওয়া হলে ওষুধ খেয়ে রেস্ট করো।’

‘আচ্ছা।’ জুহি নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিল।
রাফি আর বলার মত কিছুই খুঁজে পেল না। এভাবে একপাক্ষিক কথা বলা যায় নাকি? আশ্চর্য! জুহি কেন তাকে ভালো মন্দ কিছু জিজ্ঞেস করছে না? একটাবার ও কেন বলছে না, বাড়ি এসো। তোমার অপেক্ষায় আছি। কতটা সময় তোমার কাছ থেকে দূরে ছিলাম, কত কথা জমা হয়েছে জানো!
জুহি এসব কিছু বলল না ঠিকই তবে রাফিকে বাড়ি ফিরে আসতে বলল। রাফি জানাল তার কাজ শেষ করে সে ফিরবে।
ফোন রেখে জুহি আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, কী মনে করে। নিজের চোখের চোখ রাখতেই কেমন অধর জোড়া লাজে রাঙা হয়ে উঠল। একটু আগেই রাফি তাকে বড় মুখ করে বলে গেল, যাতে সে কাজের সময় ফোন দিয়ে বিরক্ত না করে। আর এখন? নিজেই ফোন দিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে। ওইতো মিস করছিল যে, অথচ মুখে স্বীকার করতে পারছে না। আশ্চর্য রকমের তারছেঁড়া মানুষ। অবশ্যই এরকম একটা তারছেঁড়া টাইপের মানুষ জীবনে না থাকলে জীবনটা একদম বোরিং!
.
ঘরের ভেতর বসে থাকতে ভালো লাগছিল না। তাই জুহি আশেপাশে বেশ ভালোভাবে পরখ করে রান্নাঘরে এলো। ডাক্তার রেস্টে থাকতে বলার পরেও, মা যদি দেখে সে রান্নাঘরে এসে উঁকি ঝুঁকি মারছে তাহলে খুব বকবে। তবে এই যাত্রায় আর রক্ষা পাওয়া গেল না। সায়রা হক জুহিকে দেখে এগিয়ে এলেন। বললেন, ‘তোমাকে না ডাক্তার রেস্টে থাকতে বলেছে তো রান্নাঘরে কি করছ?’
পেছন থেকে হুট করে কারো কথার আওয়াজে জুহি চমকে উঠল। পেছন ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘এমনি আসছিলাম মা।’

‘ঘরে যাও মা, এতো ছোটাছুটি করো না।’

‘আপনি রান্না করবেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমি সাহায্য করি?’

‘উহু, একদম না। আজকের দিনটা অন্তত এসব থেকে দূরে থাকো। এমনিতেই তোমার উপর দিয়ে কত বড় একটা ধকল গেল।’

‘কিছুই হয় নাই আমার। আপনারা বেশি বেশি চিন্তা করছেন। আমাকে দেখেন, আমি দিব্যি সুস্থ আছি। কিছু হলে এরকম নরমাল থাকতে পারতাম আপনিই বলেন মা? আপনি, বাবা, আপনার ছেলে একটু বেশিই চিন্তা করেন।’

‘চিন্তা করব না বলছ? সন্তানের জন্য বুঝি মা-বাবা চিন্তা ব্যতীত কখনো থাকতে পারে? কী একটা দিন গেল আমাদের উপর দিয়ে। দোয়া করি, শত্রুরও যেনো এমন দিন না আসে।’

জুহি আবেগে আপ্লুত হল। ধরা গলায় বলল, ‘মাত্র এই কয়দিনে আপনারা আমায় এত ভালবেসে ফেললেন? ঋণী হয়ে গেলাম তো, তবে এই ঋণ কখনো শোধ করব না। শুধু নিজের ভাগ্যের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব, আমায় একটা পরিবার দেওয়ার জন্য।’

‘তোমাকে ভালো না বেসে পারা যায়! আমিও ভাগ্যের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব, শেষ বয়সে আমায় একটা মেয়ে দেওয়ার জন্য।’ সায়রা হক জুহির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন।
জুহি হাসল। জীবনটা কত সুখের সেটা অনুভব করার চেষ্টা করল। জীবন আমাদের একটা সময় একেবারে নিঃস্ব করে দেয় হয়ত বা সেই জীবনটাকেই পুনরায় হঠাৎ করে পূর্ণ করার মাধ্যমে চমকে দিয়ে।

রাফি বাড়ি ফিরে এল রাত দশটার একটু আগে। এসে গভীর মুখেই রইল। দরকারেও জুহির সাথে কোনরূপ উচ্চবাচ্য করল না।
রাতে ঘুমানোর আগে জুহি চুল বাঁধতে বাঁধতে রাফিকে জিজ্ঞেস করল, ‘মুড অফ নাকি তোমার?’

‘না। আই এম ওকে!’

‘দেখে তো তা মনে হচ্ছে না। মুখটা ঐ রকম বাংলার পাঁচের মত বানিয়ে রেখেছ কেন? একদম বাজে লাগতেছে দেখতে। কি অবস্থা হয়েছে চেহারার? চুলগুলো একদম কপালের ওপর লেপ্টে রয়েছে, চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। দেবদাসও তো পার্বতীর শোকের নিজের এই অবস্থা করে নাই। তো তুমি কার শোকে নিজের এই অবস্থা করে রেখেছ?’

‘কারো না।’

‘ওহ আচ্ছা। এই জানো, আজকে পুলিশ ইন্সপেক্টর এসেছিল। যাওয়ার সময় আমার কত প্রশংসা করে গেল। বললেন, আমার জন্যই নাকি নারী পাচার চক্রের গ্যাংটাকে ধরা গেল।’

‘ওহ আচ্ছা, ভালো তো।’ চাপা রাগ রাফির কন্ঠে।

‘শুধু ভালো? তোমার কি হয়েছে বলো তো? বাই দ্যা ওয়ে, আর ইউ ফিল জেলাস?’

রাফি এতক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়েছিল। এইবার চোখ তুলে জুহির চোখে চোখ রাখল। স্পষ্ট কণ্ঠে বলল, ‘সব সময় জেলাস ফিল হয় না জুহি, সামটাইম ইট হার্টস! ব্যাপারটা সত্যি আমার খুব বাজে লেগেছে। এতোটাই ছোটো মনে হচ্ছে নিজেকে। বারবার মনে হচ্ছে আমাকে বিয়ে করে তুমি হয়তো অশান্তিতে আছো। সত্যিই কি এমন কিছু জুহি?’

জুহি বেশ কিছুক্ষণ নির্বিকার থাকার পর ওষ্ঠ্যদ্বয়ে অবজ্ঞার হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘তুমিও আমায় বুঝলে না রাফি।’

‘কিভাবে বুঝব বলো? তুমি কখনো বোঝার সেই সুযোগটা দাও আমাকে? নিজেকে তো একটা শক্ত খোলসের মধ্যে আটকে রেখেছ। সেই খোলস থেকে একটাবার বের হয়ে দেখো, জীবনটা কত সুন্দর!’

জুহি রাফির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর বলল, ‘তাকাও আমার দিকে।’
রাফি তাকাল। পুনরায় জুহির চোখে চোখ রাখল। কী সর্বনাশা সেই দৃষ্টি! গলা শুকিয়ে এল তার। পরপর কয়েকবার ফাঁকা ঢোক গিলল।
জুহি ভণিতা বিহীন জিজ্ঞেস করল, ‘ভালোবাসো?’

‘কেনো জানিনা খুব নিঃসঙ্গ লাগছিল নিজেকে। এইতো ঘটনার আগের মুহূর্তে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা মানুষটাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বুকের ভিতর একদল লুকিয়ে থাকা কষ্ট প্রচন্ড কান্না হয়ে দু’চোখ ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। তুমি কাছে ছিলে না বলে শূন্যতাও ইচ্ছামতো তার নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে দিয়েছে। তোমাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না, বুকের বা’পাশটায় কী চিনচিনে তীব্র ব্যথা। তারপর যখন তোমাকে দেখতে পেলাম, মনে হল আমি যেন সহস্র যুগ অতিক্রম করে এসেছি। শেষ বিকেলের পাহাড়ের কিনার ঘেসে ছুটে আসা একদল মেঘের মত আলতো করে তোমায় ছুঁয়ে দিলাম। বুঝলাম, তুমি আছ বাস্তবে। আমি আবার তোমায় ফিরে পেয়েছি‌। ক্ষুদ্র এই জীবনে আমার সকল দ্বিধা উড়ে গেল। সংকুচিত হয়ে থাকা বুকের পাঁজর ধীরে ধীরে নিজের অবস্থানে ফিরে গেল। এটাকে যদি ভালোবাসা বলা হয়, তাহলে আমি তোমাকে সহস্রবার ভালোবাসি। আর আমার মনে হয়, আমি বোধহয় এভাবে তোমায় ভালবাসতে বাসতেই কোন একদিন হারিয়ে যাব!’

‘এতো ভালোবাসা ছেড়ে দূরে যাওয়ার সাধ্য আমার নেই। তুমিও যেওনা কখনো রাফি!’

‘যাব না তো। আমি যে সারা পৃথিবী ঘুরে এসে কেমন তোমার শহরেই আটকে যাই! তোমার মায়ায় পড়ে যাই বারবার!’

‘এই মায়া সারাজীবন স্থায়ী হোক।’

‘আগে কথা দাও, আমার সামনে কারো এতো সুনাম করবে না। জানো, বুকের ভেতরটা একদম ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়?’

‘দুষ্টুমিটা বোধহয় একটু সিরিয়াস পর্যায়ে চলে গেছে তাইনা? আর কখনো ভুল করেও এমন মজা করব না। তবে জানো তো, জেলাসি ভালোবাসার একটা অংশ।’

‘আমার এসব দরকার নেই। আমি এমনিতেই তোমাকে ভালোবাসি। খোলা বিস্তর গগন দেখে যেমন মানুষ মুগ্ধ হয়, আমিও ঠিক তোমায় দেখে সেরকম মুগ্ধ হই। বসন্তে কোকিলের ডাক যেরকম মানুষের সবচেয়ে প্রিয়, তুমিও ঠিক সেরকম ভাবেই আমার সবচেয়ে প্রিয় অধ্যায়। শ্রাবণ দিনের বৃষ্টির ধারায় ধুলি ধূসারিত পথ প্রান্তরের স্বচ্ছতাকে মানুষ ভালবাসে, আমিও ঠিক ওমনি করেই তোমায় ভালোবাসি!’

জুহি স্নিগ্ধকণ্ঠে নতমস্তকে বলল, ‘আর বিনা প্রকাশে আমি তোমাকে তোমার চেয়ে বেশি ভালবাসতে পারি!’
রাফি জুহির চিবূক স্পর্শ করে নেত্রে নেত্র স্থাপন করল। নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস মিশে গেল।
রাফি কোমল স্বরে শুধাল, ‘আত্মসমর্পণ করলে তবে?’
সহসা জুহির হাস্যোজ্জ্বল মুখখানিতে একরাশ লজ্জা এসে ঘিরে ধরল। সে অর্ধ নিমীলিত নেত্রে সলজ্জ স্বরে জবাব দিল, ‘তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি, এরচেয়ে বড়ো কোনো আত্নসমর্পন আমার পৃথিবীতে আবার হয় নাকি!’
.
.
.
চলবে…..

[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা— ১৩০০