#মন_কারিগর🩷 [অন্তিম পর্ব]
~আফিয়া আফরিন
গত সপ্তাহে কলকাতা যাওয়ার কথা ছিল রাফি আর জুহির। যদিও রাফির গানের রেকর্ডিং ছিল, কিন্তু সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এইবার জুহিকে নিয়েই যাবে। জুহিও আর বারণ করে নাই। কোনো দ্বিমত বিহীন রাজী হয়ে গেল। কিন্তু সমস্যা বাঁধল যাওয়ার আগ মুহূর্তে। জুহির পাসপোর্টে সমস্যা থাকার কারণে আগের দিন তা বাতিল করতে হলো।
সায়রা হকও বলেছিলেন, ‘বিয়ের পর তোমাদের যেহেতু হানিমুনে কোথাও যাওয়া হয় নাই। তাই এই সুযোগে দু’জনে গিয়ে ঘুরে এসো।’
কিন্তু শেষ মুহূর্তে সব তালগোল পাকিয়ে গেল। জুহি খেপল রাফির উপর।
বলল, ‘যাও যাও, নিজেই গিয়ে ঘুরে আসো। আমার আবার দরকার কি? নিশ্চয়ই তুমি কিছু করছ। কত শখ ছিল একটু ঘুরব, সবকিছুতে পানি ঢেলে দিছ।’
রাফি অসহায়ের মত বলল, ‘আমি কি করলাম? আমার দোষ কোথায়? যেটাই করি না কেন সেটাতেই আমার দোষ। পান থেকে চুন খসে গেলেও আমার দোষ।’
‘অবশ্যই তোমার দোষ। সবকিছুর মূলে তুমি। কী ভেবেছ আমি বুঝি না কিছু? হুঁ?’
রাফি কিছু বলে না। সে জানে, জুহি যা বলছে সমস্তটাই অভিমান থেকে। আর জুহি বলেও ইচ্ছে করে। একটু শাসনে রাখতে চায়। কারণ জুহির এই অবাধ্য শাসন রাফির অধিক প্রিয়। আর এই প্রিয় জিনিস কাছে পিঠে না থাকলে, ভালোবাসার টান অন্যদিকে চলে যাবে।
অবশেষে রাফির যাওয়ার দিন চলেই এল। মা-বাবা এবং জুহির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
জুহির হঠাৎ মনে হল, তার একবার যাওয়া উচিত। সে বাসা থেকে বের হওয়ার মুহূর্তেই আহসানুল হক বললেন, ‘এই সময় কোথায় যাচ্ছ মা?’
আচমকা এহেন প্রশ্নের উত্তর দিতে জুহির উত্তর দিতে বেশ বেগ পেতে হল। সে আমতা আমতা করে বলল, ‘বাবা রাফি একটা জিনিস ভুলে রেখে গেছে, সেটাই দিয়ে আসতে এয়ারপোর্ট যাচ্ছি।’
‘ছেলেটা এত বড় হয়েছে আক্কেল জ্ঞান যে কবে হবে কে জানে? প্রতিবার কোথাও যাওয়ার মুহূর্তে এই অকাজ করে। একবার ঘড়ি ফেলে যাবে, নয়ত মানিব্যাগটাই রেখে চলে যাবে। তা তুমি একলা যেতে পারবে মা?’
‘হ্যাঁ বাবা, আমার কোন সমস্যা হবে না। আসছি।’
‘আচ্ছা মা, সাবধানে যাও। গিয়ে একটা ফোন করে জানিয়ে দিও যে ওখানে পৌঁছেছ।’
জুহি সম্মতি জানিয়ে রওনা হলো। রাফি সময়ের বেশ কিছু আগেই ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে, তাই এয়ারপোর্টে ঢুকতেই তাকে পাওয়া গেল। জুহি তৎক্ষণাৎ তার সামনে গেল না। আড়াল থেকে কিছুক্ষণ দেখল। সময় করে বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিল, সে এয়ারপোর্ট এসে পৌঁছেছে।
একবার ভেবেছিল, দূর থেকে দেখেই চলে যাবে। কিন্তু পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করল। নিজের প্রতি নিজেই বিরক্ত হয়ে উঠল। আপনমনে বলল, ‘দুনিয়া উল্টে গেলেও যেই আমি সব সময় নিজের সিদ্ধান্তে অটুট থাকতাম। সেই আমি কিনা একটা মানুষের লোভে গিরগিটির মতো পাল্টি খাচ্ছি!’
তার ঠিক দশ মিনিট বাদে জুহি রাফির সামনে গিয়ে উপস্থিত হলো। রাফি প্রথম দশায় ভূত দেখার মতো চমকে উঠল।
নিজেকে সামলে কোনরকম বলল, ‘তু-তুমি? তুমি এখানে?’
জুহি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘কেন আসতে পারি না বুঝি? এটা কি তোমার বাপের সম্পত্তি?’
‘না তা কেন হবে? কিন্তু হঠাৎ করে তুমি চলে এলে? আমার সাথে আসলেই পারতে। একা একা আসার দরকার ছিল না তো।’ রাফি বিস্ময় নিয়ে বলল।
‘তোমার সাথে আসার দরকার হলে তখন তোমার সাথেই আসতাম। আমি এখানে এসেছি নিজের কাজে। বাই দ্যা ওয়ে, কে কে যাচ্ছে তোমার সাথে?’ রাফির ডানে বায়ে চোখ বুলিয়ে বলল জুহি।
সেই মুহূর্তের রাফি সবার সাথে জুহির পরিচয় করিয়ে দিল। তারপর দুজনে মিলে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলল। রাফি বারবার জুহিকে এখানে আসার কারণ জিজ্ঞেস করলে জুহির একই উত্তর- আমি আমার একটা প্রয়োজন মেটাতে এসেছি।
রাফির ফ্লাইট এর সময় হলে সে আরেকবার জুহির কাছে বিদায় নিল। জুহি কড়া গলায় বলল, ‘খবরদার! নিজের ঘর ছেড়ে অন্য দিকে যাওয়ার চেষ্টাও করবে না। একদম জানে মেরে দিব!’
রাফি কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে বলল, ‘যথাজ্ঞা মেরি জান। আপনার প্রতিটি কথা যেমন আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি এবং বর্তমানে করে যাচ্ছি…. ঠিক সেরকম ভবিষ্যতেও করিব। আপনি চোখ বন্ধ করে আমার উপর বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারেন। আমি কখনও আপনার বিশ্বাসের অমর্যাদা করিব না। বাড়ি ফিরে যান, সাবধানে যাইবেন। মা-বাবার খেয়াল রাখিবেন। আমার অপেক্ষা করিবেন, আমি খুব শীঘ্রই ফিরব।’
জুহি হাসতে হাসতে উচ্ছ্বলতায় ফেটে পড়ল। ওখানে তো মনভরে হেসেই নিয়েছে, ফেরার পথেও তার হাসির থামাথামি নেই। রাফির কথাটা ভীষণভাবে মনে ধরেছে।
রাফি যাওয়ার পরবর্তী দিনগুলোও খুব একটা খারাপ কাটছিল না। সবাইকে নিয়ে মামা বাড়ি ঘুরে এসেছে আরও একবার। মামা-মামী প্রচুর আদর করল জুহিকে। জুহি বলল, ‘বিয়ের পর দেখি আমার আদর যত্ন দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ব্যাপার কি বলতো? এমনটা আগে জানলে তো বিয়েটা আগেই সেরে ফেলতাম।’
তারা কেউ জবাব দেয় না উত্তরে হাসে। পরিবারে নতুন হিসেবে যুক্ত হয়েছে মাহিদের বউ তারিন। বর্তমানে সে শশুর বাড়িতেই আছে। মামী পরিকল্পনা করেছেন, বউকেও খুব শীঘ্রই ছেলের কাছে পাঠিয়ে দিবেন। দুজনে দুই প্রান্তে আছে, ব্যাপারটা মোটেও ভালো না।
সব মিলিয়ে দিনগুলো ভালো কাটল। মামীও তার আদরের ভাগ্নির সুখটা দেখল। সে কিছুটা সন্ধিহান ছিল সায়রা হককে নিয়ে। কিন্তু তার সমস্ত দ্বিধা এক নিমিষেই কেটে গেল। মন ভরে মেয়েটার জন্য দোয়া করলেন। এইজন্যই বোধ হয় বলে, সব ভালো যার শেষ ভালো তার। চার দিনের মাথায়ই জুহি আর তার শশুর শাশুড়ি ফিরে এল। জুহির অফিসের কার্যক্রমও ঠিকঠাক চলতেছে। গতমাসে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল, যেটায় জুহি নিজের সাহসিকতার জন্য পুরষ্কার অর্জন করেছে।
জাহিনের কাছ থেকে নিজের বাবার খোঁজখবরও নেয় মাঝেসাঝে। ভালোই আছেন তিনি। জুহির কথা বলেন খুব। নিজের অপরাধের জন্য খুব করে আফসোসও করেন। জুহি অপরাধবোধ রাখতে মানা করে। বলে, তার আর কোনো অভিযোগ বা অভিমান নেই।
মিতার সাথে মাঝে মাঝে দেখা সাক্ষাৎ হয়। মিতা রাফির অসুখের খোঁজখবরই বেশি নেয়।
তার ধারণা, হুট করে রাফি একদিন জনসম্মুখে নিজের পাগলামি প্রকাশ করবে। এতদিন সে রাফির পিছনে অকারণে দৌড়ানোর ফলে রাফিও একদিন তার পেছনে লাঠি নিয়ে দৌঁড়াবে। এসব কথা সে অবশ্য জুহিকে বলেছে। জুহি সব শোনে আর হেসে কুটিকুটি হয়।
রাফি ফিরে এল পরের সপ্তাহেই। নিজের কাজ শেষ হওয়ার পর সে আর এক মুহূর্তও ওখানে থাকে নাই। মূল কথা, থাকতে ইচ্ছে করে নাই। জুহিকে দেখার ভীষণ ইচ্ছে জেগেছিল, কিন্তু জুহি ভিডিও কলেও দেখা দেয় নাই। বলেছে, ফিরে এসো। সামনাসামনি চোখ ভরে দেখ, আমি মানা করব না।
রাফিও ফিরে এসে তাই করেছে। জুহিকে চোখের সামনে বসিয়ে রেখে পাক্কা ৫২ মিনিট তার দিকে চেয়ে থেকেছে। জুহি তো বিরক্ত হয়ে গেছিল রাফির পাগলামিতে। কিন্তু নিষেধ করার অবকাশ ছিল না। ওই যে রাফিকে বলেছিল!
আর রাফি ও! জুহির বলা কথা অক্ষরে অক্ষরে মনে রাখে। সুদে আসলে সব ফেরত নেয়।
রাফি আসার পরদিন আদনান আর প্রান্ত এল দেখা করার জন্য। জুহি ওদের দেখে হাসতে হাসতে বলল, ‘ভাই আপনারা কি এখনো মিতার ভয়ে চোরের মত লুকিয়ে লুকিয়ে আসেন?’
আদনান সহসা উত্তর দেয়, ‘উহু। আপনি কিনা কী করেছেন? এখন ও আমাদের দেখলে উল্টো দৌড়ায়। তবে, একটা দিক ভালো ছিল যে আমাদের পেছনে কোনো একটা মেয়ে দৌঁড়াত। এখন তো সেটাও হচ্ছে না ভাবী।’
প্রান্ত নিজেকে শ্রাগ করে বলল, ‘শালা আমাদের সিঙ্গেলই মরতে হবে। কপালে কেউ নাই। থাকলে এতদিন ঠিক গতি হতো। রাফি, শালা নিজে বিয়েশাদী করে সুখে শান্তিতে সংসার করছে। আর আমরা?’
রাফি বলল, ‘তো সিঙ্গেল মরবি না তো চৌদ্দগুষ্টি নিয়ে মরবি? আশ্চর্য। মানুষ তো সিঙ্গেল ই মরে। আর মর না হয় বেঁচে থাক, শালা আমার সংসারে নজর দিস কেন?’
প্রান্ত সেন্টিমার্কা হাসি হেসে সকলের দিকে তাকাল। জুহিও ঠোঁট চেপে হাসছিল। উত্তরের আশায় আদনানের দিকে তাকালেও সে ধুর ছাই করে বিদায় করল। প্রান্ত আরেক দফা বুঝল যে, এরা নিজেদের মধ্যে পচানোর সুযোগ পেলে কেউ ছাড় দেয় না।
.
সেইবার যেহেতু জুহির আর কলকাতায় যাওয়া হলো না, তাই রাফি সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার পরবর্তী গান হবে যে সিনেমায় সেটা শুটিং দেখাতে জুহিকে নিয়ে যাবে। সেই জন্য অবশ্য আরও একমাস অপেক্ষা করতে হলো। অবশেষে এল সেই জুহির অন্তিম মুহূর্ত। মান-অভিমানের পর্ব তখন শেষ দু’জনের মধ্যেকার। ভালোবাসা দোপাট্টা উড়ে গিয়ে নিজের জয় দেখিয়েছে।
শরতের যৌবনে ফুলে ফুলে সেজে উঠেছে প্রকৃতি। শিশিরভেজা শিউলি ফুল অনুপম সৌন্দর্য নিয়ে ঘাসের বুকে স্নিগ্ধ হাসছে, নদীর কিনারে বালির চরে হেসে ওঠে কাশবন। আকাশে-বাতাসে, দূর্বাঘাসে শরৎরানি তার স্নিগ্ধ পরশ বুলিয়ে দেয়। বিস্তর গগনে সামিয়ানার ন্যায় মেঘ করেছে। জুহি যখন প্রকৃতি বিলাসে মাতোয়ারা ঠিক তখনই রাফির কণ্ঠ কানে ভেসে এল।
‘জূহি এখনো কি রেডী হও নাই? আকাশ মেঘ করে আসছে, আমরা কি আজ শুটিং সেটে পৌঁছাতে পারব না?’
‘আসছি।’ বলে জুহি বারান্দা হতে ঘরে পা রাখল। অপলকহীন চোক্ষে রাফির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। রাফির অবশ্য হেলদোল নেই, সে নিজের মতো করে কী সব আগডুম-বাগডুম বলে যাচ্ছে তখন থেকে।
সাদা রঙের হাওয়াই শার্ট, কালো রঙের প্যান্ট পরিহিত উজ্জল শ্যামলা রঙের ছেলেটাকে দেখে খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করল জুহির। অগোছালো চুলগুলো অবিন্যস্তভাবে কপালে লেপ্টে রয়েছে। জুহি এগিয়ে গিয়ে রাফির চুলগুলো ঠিক করে দিল আর বলল, ‘এত অগোছালো কেন তুমি? আর কত বললে একটু সভ্য মানুষ হবে শুনি?’
রাফি জুহির দিকে এক পলক তাকাল। ব্যস, ওই এক পলকের চাহনিতেই তার মুহূর্তটা থমকে গেল কিছুক্ষণের জন্য। ব্যস্ততা ভুলে গেল এক নিমিষেই। নারীর মোহনীয় কোমলতা, কিন্তু জুহির মোহনীয় যেনো তার ভাবগাম্ভীর্যেই প্রতিবার প্রকাশ পায়। আয়তাকার নেত্রপল্লবখানি কী গভীর! কতটা ভালোবাসা লুকায়িত রয়েছে ওই নেত্রপল্লবে, রাফি সেই ভালোবাসার পরিমাপ উদ্ধার করতে পারে না। কি নাম দেবে রাফি তার প্রিয়তমাকে? মায়াদেবী নাকি মায়াবতী! শব্দ ভাণ্ডারে শব্দের আনাগোনা থেমে যাবে, তবুও রাফি তার ভালোবাসার মানুষটির জন্য নতুন করে শব্দ আবিষ্কার করে যাবে। সমস্যা কী?’
.
প্রকৃতির নিবিড় আলিঙ্গনে বাঁধা রাঙামাটির প্রতিটি বাঁক। সবুজ অরণ্যে ঢেকে গেছে পাহাড়, কাপ্তাই হ্রদে বয়ে চলছে স্রোতধারা। আবহাওয়া জনিত কারণে আজকের শুটিং দুপুরের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল।
এই সিনেমায় দুটি একক গান এবং একটি যৌথ গানের কাজ শেষে সে জুহিকে নিয়ে এসেছে স্বচক্ষে শুটিং দেখাতে।
সবাই বিদায় নেওয়ার ফলে ভিড় আংশিক কমে গেল। পরক্ষণেই ভিড় বাঁধল রাফিকে দেখে। রাফি হাস্যোজ্জ্বল চাহনীতে সবার আবদার পূরণ করল।
সবার আবদার মেটানো হয়ে গেলে জুহি জিজ্ঞেস করল, ‘গায়ক সাহেব এইবার আমার আবদার কি পূরণ করা যাবে?’
‘অবশ্যই ম্যাডাম। একবার শুধু আপনার আবদারের কথা বলে দেখুন, সাথে সাথে পূরণ হয়ে যাবে।’
‘পাহাড়ে উঠব।’ ওই দূরের ফুরোমন পাহাড়ের দিকে ইশারা করে বলল জুহি।
রাফির আলোকিত চোখ মুখ দপ করে নিভে গেল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘আবহাওয়ার অবস্থা দেখেছ তুমি? এরমধ্যে পাহাড় উঠবে? উহু, এটা সম্ভব নয়।’
‘প্লিজ রাফি!’ অনুনয়ের সুরে বলল জুহি।
‘এসব কথায় রাফির মন গলে না। আজকে যে কোন মুহূর্তে বৃষ্টি হতে পারে, ওখানে তো যাওয়া যাবেই না।’
তবুও জুহি ছোট বাচ্চাদের মত বায়না ধরল।
রাফি কোমল গলায় ধমক দিয়ে বলল, ‘মাথায় কি বুদ্ধি-সুদ্ধি নাই? কি পাগলামি শুরু করছ? আশ্চর্য!’
জুহি গাল ফুলিয়ে বলল, ‘ও আচ্ছা এখন আর আমাকে ভালো লাগে না তাইনা? মাথায় বুদ্ধি নাই তো আমার। বলি যে, বুদ্ধি দিয়ে তোমার কাজ কি? বেঁচে খাবা?’
রাফি মুখ ঘুরিয়ে নির্লিপ্তভাবে বলল, ‘না।’
জুহি আর বায়না করল না কথাও বলল না, নির্বিকার শান্ত চোখে প্রকৃতি পরখ করছে। শিশিরভেজা শাপলা, শিউলি আর কাশের গুচ্ছ সোনারোদে ঝিকিমিকি করে।
দুজনে হাঁটতে হাঁটতে নদীর কাছাকাছি চলে এল। হাওড়ে অসংখ্য শাপলা ফুলের সমাহার। কী একচ্ছত্র রাজত্ব সৃষ্টি করেছে তারা হাওরের বুকে। রাফি একবার ফুটে থাকা শাপলা ফুলের দিকে তাকাল আরেকবার জুহির দিকে। হাওরের স্বচ্ছ পানির বুকে শুভ্র শাপলার পাগল করা হাসি প্রেয়সীর হৃদয়কাড়া হাসির মতোই মনে হয়।
নির্মল পানিরাশি সাগরের সঙ্গে মিলনের উদ্দেশ্যে বয়ে যায়। ছলাৎ ছলাৎ শব্দ কর্ণাধারে আঘাত হানছে।
জুহি অন্যরকম কণ্ঠে শুধাল, ‘আজকের দিনের কথা তোমার মনে আছে রাফি?’
রাফি সন্ধিহান দৃষ্টিতে তাকাল। তবে আজকের দিনের কথা কি জুহিরও মনে আছে? ওষ্ঠকোণে হাসি প্রসারিত হলো। তবে মুখে স্বীকার করল না আজকের দিনটার কথা
প্রশ্নের পিঠে পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘না তো। কি আজকের দিন।’
রাফি ভেবেছিল জুহি রাগ করবে, আজকের দিনটা কেন মনে নেই সেটা নিয়ে একগাধা কথা শুনিয়ে দেবে। কিন্তু রাফির ভাবনা ভুল প্রমাণিত করে জুহি খিলখিল করে হেসে উঠল। তারপর হাসি থামিয়ে বলল, ‘আজকের দিনের শরতের সমীরণে অপরাহ্নের মধ্যভাগে প্রথম একটা ছেলের সাথে আমার সাক্ষাত হয়েছিল। ছেলেমানুষী চেহারা, চোখে-মুখে কেমন উদাস ভাব, মাথাভর্তি ঝাকড়া চুল, তার অর্ধেক আবার কপালে লেপ্টে রয়েছে; সেদিন সেই ছেলেটাকে আমার একেবারেই পছন্দ হয় নাই। দেখে মনে হয়েছিল ছেলেটার দিন-দুনিয়া সম্পর্কে কোনো হেলদোল নেই। আমার সেই সবচেয়ে অপছন্দের ছেলেটিকে যে আমার মনের কারিগর বানিয়েছি, সেটা কি ওই ছেলেটা জানে?’
‘প্রথম দেখায় এক অকৃত্রিম ভালোলাগা যে ছেলেটিকে ছুঁয়ে দিয়েছিল, তা কি ওই মেয়েটা জানে? তাদের সেই ভালোলাগা কি অভূতপূর্ণভাবে ভালোবাসায় রূপ নিল! আর তারপর, তারপর প্রণয়ে।’
জুহি রাফির একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় তুলে নিল। তারপর তার নেত্রে দৃষ্টি স্থাপন করে গভীর আকুতি ভরা কন্ঠে বলল, ‘প্রার্থনা করি সেই ছেলে মেয়েটির প্রণয় দীর্ঘস্থায়ী হোক। একে অপরের প্রতি তাদের মনোবাসনা পূর্ণ হোক।’
‘হ্যাঁ হোক।’ রাফি আচ্ছন্ন কণ্ঠে বলল।
শরতের নির্মল আকাশে খন্ড খন্ড সাদা মেঘ ভেসে অদূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। শারদীয় চাঁদের জোছনা ভেজা বিমূর্ত সন্ধ্যারাত অপূর্ব। নদীর বুকে মাঝি ভাটিয়ালি গান গেয়ে পালতোলা নৌকা ছাড়ে মনের আনন্দে। দুকূলে সবুজ বনরাজি, আর রাফির বক্ষস্থলে বিচরণ করা জুহি যেন স্বর্গপুরি। শরতে প্রকৃতিতে যেমন হিমলয়ের পাদদেশ এবং রাশিয়া বিভিন্ন জায়গা থেকে ছুটে আসে অতিথি পাখিরা, তেমনি কোনো এক রূপ কথার জগত থেকে জুহির মনে এসে হানা দিয়েছে তার রাজকুমার। মেঘ ভেসে যেতে যেতেই মাথার ওপরে বৃষ্টি তার আলতো ছোঁয়া দিয়ে দিল। জুহি হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি স্পর্শ করল। মুহূর্তেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি যুগলদ্বয়কে ভিজিয়ে দিল।
রাফি ভালোলাগায় মত্ত হয়ে বলল, ‘মুর্হুতটা অনুভব করতে পারছ জুহি?’
জুহি তাৎক্ষণিক ভাবে কোনো প্রত্যুত্তর করল না। রাফির ভেজা চুল থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ার দৃশ্যটায় মনোযোগ স্থাপন করেছে।
রাফির বক্ষস্থলে মাথাটা এলিয়ে দিল জুহি। তারপর বলল, ‘তুমি সাথে থাকলে প্রতিটা মুহূর্ত আমি এভাবে অনুভব করে যেতে পারি।’
রাফি অধর প্রসারিত করে হাসল। জুহির মেঘরাঙা নেত্রপল্লবে লজ্জা ভর করেছে।
গোধূলিলগ্ন মূর্ছা যাচ্ছে। সাগর ক্রমশই যেন রাত এবং রাতের চাঁদটাকে আপন বক্ষ পিঞ্জরে আবদ্ধ করে নিল। স্বচ্ছ সমুদ্র কিষাণির শাড়ির আঁচল ভিজিয়ে কখনো অবারিত সবুজের বুক চিরে বয়ে যায় দূরে-বহু দূরে। আহা! সমুদ্রের কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থেকে বৃষ্টি স্পর্শ করে যাওয়ার মত এমন যুগল বোধহয় পৃথিবীর বুকে খুব কমই দেখা যায়— খুব কম।
এমন অফুরন্ত ভাবে বেঁচে থাকুক পৃথিবীর সকল শুদ্ধতম ভালোবাসা।
.
.
.
সমাপ্ত।