মন কেমনের দিন পর্ব-১৩

0
30

মন কেমনের দিন

১৩.
বিছানার এপাশ-ওপাশ করেও ঘুমটা আগের মতো জোড়ালো হচ্ছে না। বা’পাশের বিরাট জানালাটা খোলা। পর্দা মুড়িয়ে রাখা। নিশ্চই মা খুলে রেখে গেছেন? সাদিফ আলতো চোখ মেললো। আবছা চোখে দেখল, বাহিরে বৃষ্টির আগাম বার্তা উৎসবে মেতেছে। অল্পসল্প দেখা পাওয়া আকাশের গায়ে কালো কালো দাগ। কৃষ্ণবর্ণ মেঘ প্রজাদের সে কি দুঃখ! মেঘেদেরও কি দুঃখ হয়? তারাও কি প্রাণপ্রিয়া প্রেয়সীকে একটুখানি দেখবার তৃষ্ণায় উজাড় করা বুকব্যথায় কাতর হয়? হয় বোধহয়। না হলে তাদের এত দুঃখ আসে কোত্থেকে? এ পৃথিবীতে প্রেম-ভালোবাসার চেয়ে বেদনা আর কিছুতে নেই। এ ক’দিনে সাদিফ তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। যে মেয়েটিকে সে এতকাল ছোট্ট বলে হেলাফেলা করছিল সেই মেয়েটির জন্যই এখন তার যাতনায় ঘুম আসে না। খেতে ইচ্ছে করে না। কিছু করতে ভালো লাগে না। ভাবা যায় এসব? এসব আদৌও হচ্ছে ওর সঙ্গে? চোখ বুজে আরেকদফা ঘুমানোর চেষ্টা করলো সাদিফ। মুখে জোড়ে বালিশ চেপে ধরলো। অথচ বাহ্যিক বিরক্তি থেকে শান্তি পেলেও মনের শান্তি তখনো চঞ্চল দুষ্টুমিতে ব্যস্ত। অন্ধকার চোখের পাতায় মানুষীর মুখ ভাসছে। মেয়েটা ইদানিং তার সামনে হাসে কম। আগের মতো বাচ্চা বাচ্চা কণ্ঠে আবদার করে না। তবুও আড়ালে-আবডালে মানুষীকে হাসতে দেখলেই বেহায়ার মতো চেয়ে থাকতো সাদিফ। মানুষীর হাসি দেখতে দেখতে কখন যে তার ঠোঁটের কোণেও দূর্লভ হাসি এঁটে বসতো! ব্যাপারটা কখনো গুরুত্ব দিয়ে খেয়াল করা হয়নি। তবে আজ! এই আধাবেলা সময়ের ঘুমুঘুমু মুহুর্তে হঠাৎ করেই বিষয়টাতে গুরুত্ব দিয়ে ফেলল সাদিফ। এবং পরক্ষণেই মনটা আনচান করে উঠল। নাহ্! ঘুম আর হবে না। মেয়েটাকে চেপে ধরে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকতে পারলে শান্তি মিলতো। মানুষীর কপালে ঠোঁটের ভেঁজা চুমু দিয়ে বিরক্ত করতে পারলে বুকের জ্বালা কমতো।

ঢুলুঢুলু পায়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সাদিফ। বসার ঘরে সালমা সুলতানা বসে আছেন। পাশের বাসার কিছু প্রতিবেশীর সঙ্গে খোশগল্পে মেতেছেন তিনি। প্রায় পনেরো দিন বাদে চট্টগ্রামে এসেছেন। এটুকু গল্প তো করাই যায়।

সেসময় রুম থেকে বের হতে দেখা গেল সাদিফকে। পরনে হাতা কাঁটা টি-শার্ট তার। কুঁচকে বিশ্রী দেখাচ্ছে। ফুলে ফেঁপে আছে বাহুর পেশিযুগল। ঢোলাঢালা গেঞ্জি কাপড়ের প্যান্ট মেঝে ছুঁচ্ছে। মুখের অদলের কথা আর না-ই বললাম! ভাগ্যিস কিছুদিন আগে দাঁড়ি কেঁটেছিল! নয়তো তাকে রাস্তার ভদ্র সভ্য ফকির বললেও কেউ অবিশ্বাস করতো না।
পাশের বাসার রায়মা আন্টি সাদিফকে দেখা মাত্রই হাসি হাসি মুখ করে বললেন, “কেমন আছো সাদিফ বাবা? মাত্র ঘুম থেকে উঠলে?”

ঘুমে জর্জরিত সাদিফের এই মিষ্টি সৌজন্যতা বড় তেঁত ঠেকলো। মুখশ্রী কুঁচকে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলালো সে। সবিনয়ে উত্তর দিল, “জি।”
“তা শুনলাম বিয়ে করছো! কিছু তো বললে না আন্টিদের। নাকি আমরা পর হয়ে গেছি?”

চোখ-মুখ কুঁচকে সাদিফ বলতে চাইলো, “আশ্চর্য! আপনারা আবার আপন হলেন কবে থেকে?”

অথচ অধরে মেকি হাসি ফুঁটিয়ে বলল, “আপনাদের আমার বলতে হবে কেন আন্টি? খবর তো আপনারা নিজেরাই জোগাড় করে ফেলেন। আপন না হলে কি আজকাল মানুষ এত খবরাখবর রাখে?”

বলে আর দাঁড়ালো না সাদিফ। পায়ে জোড় পাচ্ছে কম। ঘুমটা সেই যে গেল, ভেবেছিল আর আসবে না। কিন্তু এখন অসভ্যের মতো চোখের পাতা ভারি করে দিচ্ছে। সাদিফ কি আরেকটু ঘুমিয়ে নিবে? সঙ্গে সঙ্গেই সালমা সুলতানার ডাক শোনা গেল, “এই সাদিফ! কই যাস? নাস্তা খাবি না?”

সাদিফের তন্দ্রাঘোরে নেতিয়ে যাওয়া কণ্ঠ, “ঘুম আসছে। ভাইয়ার সাথে ঘুমাবো।”

__

রঞ্জনের টাক মাথায় খোঁচা খোঁচা চুল গঁজিয়েছে। এসব মাথা হাতাতে বড্ড ভালো লাগে সাদিফের। এর আবার কিছু গুণও আছে। চুলকানি জায়গায় ঘষা লাগালে আরাম আরাম লাগে। ভাইয়ের পাশে শোয়ার আগে কয়েকবার হাতের তালু ঘষে নিলো সাদিফ। এত্ত চুলকাচ্ছিল!

“কি সমস্যা তোর বেয়াদব? পেরতের মতো মাথায় হাত ঘেষতেছিস কেন? ইছ! তোর হাতে ঘাম! সর এনতে!”

রঞ্জনের চেঁচামেঁচি গায়ে মাখলো না সাদিফ। সরলো না একদমই। বরং মাথায় আরেকদফা হাত ঘষে হাত-পা তুলে দিলো রঞ্জনের শরীরে। বড় একটা হামি দিয়ে বলল, “ঘুম আসছে না।”
“তো? আমি কি করব?”
“ঘুম পাড়িয়ে দে।”
“তোর কি মাথা ঠিক আছে? পাছায় লাত্থি দিলে ঠিক হবি?”

সাদিফ জবাব দিচ্ছে না। আরেকটু শক্ত করে ধরে পেটের কাছটায় কাতুকুতু দিচ্ছে। রঞ্জন চোখ গরম করে তাকালো। ক্ষীণ নড়লো চড়লো। তার কাতুকুতু লাগছে। ভীষণ কাতুকুতুয় দম বন্ধ হয়ে আসছে। মেজাজটা চড়ে উঠছে তিরতির করে! এমনিতেও মাথার দানবিয় ছোঁয়ায় ছিঁটকে ভিঁটকে উঠেছিল। সাধের ঘুম তাই হয়ে ওঠেনি।

“কি সমস্যা খুলে বল ফাজিল! বাচ্চাকালে তোর পাছায় যে বাঁশের বারি দিয়েছিলাম, ভুলে গেছিস?”

চোখ বুজে থাকা সাদিফ হাসতে হাসতে শুধায়, “এই শহরে বাঁশ কই পাবি?”
“ভুল বললি। এই শহরে ভাতের অভাব থাকলেও বাঁশের অভাব নেই।”

সাদিফ কিছু সময় কোনো কথা বলল না। হাসছে তখনো। নির্মূল, স্নিগ্ধ হাসি! তারপর কেমন করে যেন নিশ্বাস ফেলে বলল, “মানুষীকে অনেক মনে পরে, ভাইয়া।”

চোখ বুজে একমনে হাসতে থাকা সাদিফকে কিছুক্ষণ চুপ করে দেখলো রঞ্জন। ভাইটা তার জন্ম থেকে সুন্দর। সেও সুন্দর, সুদর্শন। কিন্তু সাদিফের মতো না। এককালে দাদাভাইয়ের সাদা-কালো একটা ছবি পেয়েছিল সে। সাদিফ অবিকল দাদাভাইয়ের মতো হয়েছে।

রঞ্জন জিজ্ঞেস করল, “ঝগড়া হয়েছে?”
“না।”
“তাহলে?”
“ওকে কয়েক ঘণ্টা দেখতে না পেলেই ওর কথা মনে পরে।”

কপাল কুঁচকে বিশ্রী একখানা গালি আওড়ায় রঞ্জন। সাদিফকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলে, “দূরে যা বেয়াদ্দপ! গা ঘেষবি না। দূর হ!”

সাদিফ শুনলো না। আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল, “সমাধান দে আগে।”

রঞ্জন তপ্ত নিশ্বাস ফেলল, “দেখা করে আয়।”
“সত্যি যাবো?”
“হ্যাঁ। এখন ছাড়।”

সাদিফ এবারও ছাড়লো না। বুকের ভারি পাশটা হঠাৎ করেই গ্যাসবেলুন হয়ে গেছে। শক্ত পাথর নেতিয়ে গিয়ে উড়ছে হাওয়ায়। ঘুমের আর বাঁধা নেই। তন্দ্রা ঘোরে ডুবুডুবু সাদিফ ডিমানো স্বরে বলল, “নাহ্। তোকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমাবো। তুইও ঘুমিয়ে যা ভাইয়া। ভাইয়ের আদর আর কতদিনই-বা পাবি? বিয়ের পর তোকে আর জড়িয়ে ধরব না।”

______

রাত তখন ক’টা হবে? এগারোটার এপাশ বোধহয়। পড়ালেখা শেষে মাত্রই ঘুমাতে নিচ্ছিল মানুষী। ওমনি! টুংটাং শব্দে সাদিফের মেসেজ, “উঠানের আম গাছের নিচে আয় ভূতনী। তোর সাথে দেখা করতে আসছি।”

মানুষী প্রথমে ভাবলো, সে যাবে না। যাবেই বা কেন? কথার কোনো শ্রী নেই, ভালো মন্দের ধাঁচ নেই! দেখা করতে আসছি! এ আবার কেমন কথা? প্রেমিকার সঙ্গে কেউ এভাবে কথা বলে? অসন্তোষে মুখের স্বাদ তেঁত ঠেকল মানুষীর। শব্দ করে মোবাইলটা টেবিলের ওপর রেখে আবারও বিছানা গোছাতে লাগলো। মনে মনে পণ করলো, সে যাবে না। ওই নিষ্ঠুর লোকটার সঙ্গে দেখা করতে কিছুতেই সে উঠানে পা রাখবে না! কিন্তু মগজের নিরীহ পরামর্শ কেউ কি কখনো শুনেছে? গুরুত্ব দিয়েছে? মন-মস্তিষ্কের লড়াইয়ে মনই সর্বদা জয়ী।

আধারে তখন টইটম্বুর আশপাশ। মোবাইলের লাইট জ্বালিয়ে আস্তেধীরে এগোচ্ছে মানুষী। আমগাছের একপাশে সাদিফকে দেখা মাত্রই থমকে গেল। কতদিন হবে? পনেরো কি বিশদিন? সময়টা মনে নেই। তবে মনে হচ্ছে, আজ বহুদিন বাদ পুরনো সাদিফকে দেখতে পাচ্ছে মানুষী। গম্ভীর, হাসিহীন সাদিফ। যার একটা সরু নাক আছে, পাতলা বেগুনি ঠোঁটের কম্পনে দারুণ রাগ আছে, ঘন ভ্রুয়ের একটু নিচে ছোট ছোট চোখের সে কি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি! মাথার চুল আর গালের দাঁড়ি উভয়ই ছেটে রাখা। লোকটা ফর্মাল ড্রেসাপে এসেছে। পরনের সাদা শার্ট আষ্টেপৃষ্টে জড়ানো। হাতাটা কনুই অব্দি গোটানো। সঙ্গে নেভি ব্লু প্যান্ট। টাই-টা ঝুলে আছে গলা থেকে অনেকখানি নিচে। মানুষী জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেঁজাল। আড়ষ্ট কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো, “আপনি এভাবে এসেছেন কেন?”
“কিভাবে?”
“ফর্মাল ড্রেসাপে। কাঁধের পাশটা ভিঁজে আছে দেখছি! বৃষ্টিতে ভিঁজেছেন, তাই না? বাইকে করে এসেছেন?”

সাদিফ একটু করে এগোলো। মানুষীকে দেখলো আগাগোড়া। শীত কমলেও হিমেল হাওয়ার বিকল্প নেই। মেয়েটা গাঁধার মতো সোয়েটার-শাল ছাড়া চলে এসেছে।

হাত বাড়িয়ে মানুষীর গালের ময়লাটা ফেলে দিল সাদিফ। মানুষী পিটপিট চোখে তাকালো। পাত্তা দিলো না সে। গালে হাত বুলাতে বুলাতেই বলল, “চাকরির ইন্টারভিউ থেকে এসেছে।”
“চাকরির ইন্টারভিউ? কেন?”
“আব্বু বলেছে তোকে বিয়ে করতে হলে চাকরি-বাকরি করতে হবে। সিজনাল ব্যবসায় চলবে না। বুঝতে পারছিস তোকে পেতে আমার কত খাটতে হচ্ছে?”

দীর্ঘশ্বাসটা জোড়েসোড়েই ফেলল সাদিফ। মানুষীকে দেখিয়ে। যেন বোঝাতে চাইলো, মানুষীর জন্য সে ভীষণ কষ্টে আছে। কষ্টে মরে টরে গেলেও যেতে পারে। তা দেখে কপট রেগে গেল মানুষী। গাল থেকে সাদিফের হাত ছাড়িয়ে বলল, “আপনাকে আমি বলেছি খাটতে? নিজেই তো বিয়ে করতে মরিয়া হয়ে যাচ্ছিলেন।”

সাদিফ ঠোঁট কামড়ে তাকালো। একটু চুপ থেকে বলল, “তুই কি চাস? হবো না?”
“নাহ্।”

কণ্ঠ কি কাঁপলো? কাঁপলো বোধহয়। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মানুষী। সাদিফকে মোটেও নিজের দূর্বলতা বোঝানো যাবে না। থমথমে গলায় সে ফের বলল, “আপনি এখন চলে যান। আপনার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।”
“মিথ্যে কথা।”
“সত্যি কথা।”
“তাহলে চলে যা।”
“আপনি আগে যান। তারপর যাবো।”

পরপরই আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো, সাদিফ মুচকি হাসছে। ইতর লোকটাকে এত মানায় হাসিটা! এগিয়ে এসে একটু ঝুঁকলোও সে। কপালে চটপট অধরের উষ্ম ছোঁয়া এঁটে কোমলস্বরে জিজ্ঞেস করলো, “তুই আমার কি, মানুষী?”

মানুষীর জবাব নেই। সে ঠিকঠাক নিশ্বাস নিতে পারছে না। হৃদযন্ত্রের ডিপডিপ শব্দের পিঠে সাদিফের প্রশ্নটা ফিঁকে পরে গেছে। সাদিফ আবার বলল, “তুই আমার এক টুকরো রোদ, এক টুকরো বৃষ্টি আর এক টুকরো বেদনা। বেদনা কেন বলতো? কাউকে নিয়ে বেশি সুখে থাকতে নেই। সুখের ছোঁয়ায় কৃত্রিমতা থাকে। তুই অকৃত্রিম মানুষী। তোকে নিজের করে পাওয়া আমার অকৃত্রিম বাসনা।”

________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা