মন কেমনের দিন
১৪.
নিকষকৃষ্ণ আঁধারের একফোঁটা। এখানে ল্যাম্পপোস্ট বলতে কিছু নেই। রাস্তায় বাতি জ্বালানোর মতো গরজ কাউকে খুব একটা করতে দেখা যায় না। যারাও বা করে, সংখ্যায় নগণ্য। লম্বা, মোটাসোটা গাছের মগডালে বেঁধে রাখা হয় হলদে রঙের গোলগাল বাল্ব। মানুষীদের বাড়ির বাল্বটাও মৃদু মৃদু জ্বলছে। সুদূর থেকে ধেয়ে আসা মিষ্টি রোদ্দুরের মতো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে সাদিফের কপাল, চুল, কাঁধের একাংশ। মানুষী তখন শ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে আছে। প্রগাঢ় অনুভূতি সিক্ত হয়ে বাকহারা হয়ে গেছে যেন! সাদিফ ঝুঁকে আছে তার দিকে। হাতদুটো মুঠোয় পুরে থেমে থেমে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছে। থামছে। আবার ছোঁয়াচ্ছে। একেকটা স্পর্শ এত গাঢ়, স্পর্শকাতর! মানুষীর সহ্য হতে চাইলো না। মৃদু আর্তনাদের মতো শোনালো কম্পনরত কণ্ঠস্বর, “থামুন, সাদিফ!”
ওষ্ঠের গাঢ় স্পর্শের দৃঢ়তা বাড়িয়ে সাদিফ সরে এলো তক্ষুণি। কিন্তু মানুষীর মোলায়েম হাত ছাড়লো না। ধরেই রাখলো। সাদিফের চোখে মুখে তখন কি যেন ঘুরঘুর করছে। লহু হাসি ঠোঁটে এঁটে এক দৃষ্টে চেয়ে চেয়ে দেখছে প্রাণপ্রিয়াকে। লোকটার এই দৃষ্টিকে কি বেহায়া বলে না? আলবাদ বলে! লোকটার এই তুমুল পরিবর্তন মানুষীকে যেমন হতবাক করছে তেমনি বুকের শিহরণটুকুও অস্বীকার করবার জো নেই। কল্পনায় তো এমন সাদিফকেই চাইতো সে। যে তাকে পাগলের মতো ভালোবাসবে। তাকে একপলক দেখার জন্য ছুটে আসবে ঠিক এভাবে। কিন্তু তাই বলে এত সহজে গলে পানি হয়ে যাওয়াও ঠিক নয়। লোকটা তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। থেমে থেমে কেঁপে উঠা কণ্ঠে মানুষী তাই রাগ দেখাতে চাইলো, “এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন আপনি? চোখ সরান! সরাচ্ছেন না কেন? কেন এমন পাগলামো করছেন?”
সাদিফ ঠোঁট কামড়ে হাসে। জিজ্ঞেস করে, “বেশি পাগলামি করছি?”
জবাবে মানুষী মাথা দোলানো মাত্রই সাদিফের হতাশ কণ্ঠস্বর, “অথচ আমি নিজে পাগল হইনি মানুষী। তুই বানিয়েছিস।”
মানুষীর কি যে হলো! হঠাৎই ডুকরে উঠলো সে। কান্নার ফোঁয়ারা একটু একটু করে ধেয়ে আসলো এত বিশ্রী তাড়া নিয়ে! সাদিফ থেকে নিজের হাত ছাড়াতে চাইলো। অথচ লোকটা দিচ্ছে না। এখনো ত্যাড়ামো করছে। রাগে দু:খে নখ বিঁধিয়ে দিলো মানুষী। ধারালো নখের আঁচড়ে ক্ষত-বিক্ষত করে দিলো সাদিফের হাতের পিঠ। আহাজারি করে উঠলো, “আমি এতকাল আপনার এমন ছোঁয়াই চাইতাম, সাদিফ ভাই। চাইতাম আপনি যেন আমার দিকে একটু ভালোবেসে তাকান, একটু ভালোবেসে কথা বলুন। কিন্তু এখন, এই মুহুর্তে আপনার হঠাৎ পরিবর্তন আমার চোখে বিঁধছে। আপনি সত্যিই সাদিফ তো? অভিনয় করছেন না বলুন? যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, বিশ্বাস করুন.. আমি সহ্য করতে পারবো না। আপনাকে পাওয়ার আশা আমি বহু আগেই ছেড়ে দিয়েছি। এখন মাঝপথে আমাকে ছেড়ে চলে গেলে আমি পাগল হয়ে যাবো। সত্যি বলছি! একবার অভ্যাস হয়ে গেলে আমি আর থাকতে পারবো না। আপনাকে ছাড়া আমি থাকবো কিভাবে বলুন?”
মানুষীকে কাঁদলে আদুরে লাগে। অভিযোগ করলে অভিমানিনীর অভিযোগে ইদানিং বুক ব্যথা হয় সাদিফের। কান্নারত আদুরে চেহারায় হাঁসফাঁস করে সমগ্র মন, মস্তিষ্ক। শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গ বিষ ব্যথায় ধমক দিয়ে উঠে, “নির্বোধ বালক! মেয়েটাকে আর কত কাঁদাবে? আর কত ভাবে তোমাকে বোঝাতে হবে তুমি ওকে ভালোবাসো?”
মানুষীকে বুকে টেনে নিতে নিতে সাদিফ নিরবে উত্তর দেয়, “আর বোঝাতে হবে না। আমি বুঝি। আমি বুঝি এখন, অভিমানিনীকে ছাড়া আমার আর চলবে না।”
আলতো হাতে মানুষীর চোখের পানি মুছে দিলো সাদিফ। চেয়ে দেখলো, মেয়েটার কান্না থেমেছে। গালের মধ্যভাগে লাল আবরণ জেঁকে বসেছে একটু রয়েসয়েই। পাপড়িগুচ্ছ ভেঁজা, আষ্টেপৃষ্টে জড়ানো। হাত বাড়িয়ে পাপড়িগুলো ছুঁয়ে দিলো সাদিফ। থেকে থেকে নিশ্বাস নেওয়া মানুষীকে ফিসফিসিয়ে বলল, “তুই এভাবেই আমার জন্য কাঁদ মানুষী। আমি নিষ্ঠুরই ঠিকাছি। তুই আমার জন্য কাঁদছিস, ব্যাপারটা আমাকে আনন্দ দেয়।”
মানুষী নাক টেনে বলল, “আমার কান্না আপনাকে আনন্দ দেয়? আপনি এত ইতর!”
“হ্যাঁ, আমি ইতরই। আর ভালো হতে পারবো না। ভালো ছিলাম বলেই তোকে দু:ক্ষ দু:ক্ষ কাঁদিয়েছি। এখন খারাপ হয়ে সুখ সুখ কাঁদাবো। তুই কিন্তু রাগ করিস না মানুষী। তোকে আবার রাগে মানায় না।”
________
সময় কত দ্রুত এগিয়েছে মানুষীর জানা নেই। শীতের আমেজ এখন একদমই নেই। গ্রীষ্মের রাজত্বে আশপাশ গুমোট হয়ে আছে। ছন্নছাড়া একটা ভাবও লক্ষ্য করা যায়। সব ছেড়ে ছুড়ে কোনো শীতলতাকে জড়িয়ে ধরার ভাব, আকাঙ্ক্ষা, একটুখানি ইচ্ছা। পরীক্ষা দিয়ে তখন মাত্রই কলেজ থেকে বেড়িয়েছে মানুষী। মোড়ের কাছে কৃষ্ণকে দেখেই এগিয়ে এলো। কৃষ্ণ হাসিমুখে শুধালো, “কিরে, পরীক্ষা কিরম দিলি?”
মানুষীও হেসে উত্তর দিলো, “ভালোই।” তারপর একটু থেমে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি আজকে এখানে হঠাৎ? কোনো কাজে এসেছিলে?”
“হ। বন্ধুর লগে দেখা করবার আইছিলাম। ভাবলাম তোরে নিয়া একলগে বাসায় যাই।”
“ভালো করেছ।”
বলতে বলতে পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো ওরা। কৃষ্ণ বলল, “তোর পরীক্ষা শ্যাষ? না আরও আছে?”
“শেষ। কেন?”
“তাইলে তো তোর বিয়ার আর বেশি দিন নাই। পরীক্ষার পরেই না তোরে বিয়া কইরা নিয়া যাইবো?”
মানুষী চোখ ছোট ছোট করে বলল, “কে বলেছে তোমাকে এসব?”
“কে কইবো? আমি কি কিছু জানি না নাকি? তোর মতো আপদের বিয়ার দিন, তারিখ সব মুখস্ত আমার।”
কৃষ্ণর বত্রিশ পাটি দাঁত নেই। আছে তেত্রিশটি। হাসলেই ঠোঁটের কোণ ঘেঁষে থাকা গাজ দাঁতটিও মিটিমিটি হাসে। দেখতে সুন্দর লাগে। কিন্তু মানুষীর তা এই মুহুর্তে মোটেও সুন্দর লাগলো না। বিদঘুটে স্বাদ গলায় ঠেকলো খুব বাজে ভাবে। গম্ভীর গলায় প্রশ্ন ছুড়লো, “তোমার গানের অডিশন কবে, ভাইয়া? ঢাকায় যাচ্ছো কখন?”
“সামনের সপ্তাহে।”
“ভালো। আমি সামনের সপ্তাহতেই বিয়ে করব। খবরদার! তুমি আমার বিয়েতে থাকবে না।”
কৃষ্ণর এত হাসি পেল তখন! হাসতে হাসতে পেট চেপে ধরলো ও, “আচ্ছা! থাকুম না। তুই বরং আমারে পার্সেলে কইরা খানা পাঠাই দিছ।”
_______
বিয়ে নিয়ে মানুষীর তেমন কোনো জল্পনা কল্পনা কোনো কালেই ছিল না। সাদিফের সাথে কিছুতেই বিয়ে হবে না— এমন একটা বদ্ধ ধারণা ছিল তার। সেই বদ্ধ ধারণা পালটে যখন সত্যি সত্যি বিয়ের আমেজ পুরো বাড়িতে যক্ষের ধনের মতো এঁটে বসলো, খুশিতে মানুষীর পাগল পাগল হয়ে যাবার কথা। কিন্তু তেমন কিছু আসলে হচ্ছে না। বাড়িতে সবাই এ বিয়ে নিয়ে প্রচন্ড ব্যস্ত। মেজ চাচা ইতোমধ্যে দলবল নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে চলে এসেছেন। বড় চাচাও শহর থেকেই উপদেশ দিচ্ছেন একটার পর একটা। অথচ সব ভেতরে ভেতরে। আপাদ দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে, সব ঠান্ডা, নিরব, নিস্তব্ধ। প্রান্ত, ধুতরা, মিতা একটু হৈ-হুল্লোড় না করলে মানুষীর যে আর ক’দিন বাদে বিয়ে, এ খবর কারো মাথাতেই আসে না। মানুষীরও তাই। পরীক্ষা শেষে তার এখন সারাদিন ঘুম পায়। সকালে উঠে ঘুম। দুপুরে ভাত খেয়ে ঘুম। বিকালে ঘুম। রাতে আবার ঘুম! অবশ্য ঘুমটা হয় সাদিফের কলের মাধ্যমে। আবার ঘুম ভাঙ্গেও সাদিফের কলের আওয়াজেই!
মানুষী তখন সবে সবে দুপুরের ভাত খেয়ে ঘুমানোর জন্য বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। সাদিফের কল এখনো আসেনি। লোকটার নতুন নতুন চাকরি হয়েছে। বেশি একটা সময় মানুষীকে দিতে পারে না। কলে ওই এক-দু মিনিটের ছোট্ট কথোপকথন! মানুষী ডায়াল লিস্টে গিয়ে সাদিফকে কল লাগালো। স্ক্রীনে ইতর নামটা ভাসছে। একটু পরেই রিসিভ হলো কলটা, “হ্যাঁ, বল।”
কথাটা পছন্দ হলো না যেন। মানুষী চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল, “হ্যাঁ বল মানে কি?”
“কি বলার জন্য কল দিয়েছিস?”
“আপনি কি ব্যস্ত?”
“হ্যাঁ।”
“কথা বলবেন না?”
“বলব।”
মানুষী অভিমানের সুরে শুধায়, “ব্যস্ত হলে কথা বলবেন কিভাবে?”
“এখন যেভাবে বলছি। তুই আমাকে বিরক্ত করবি। আমি বিরক্ত হবো।”
মানুষী কিছু সময় কথা বললো না। কান খাড়া করে শুনলো, ল্যাপটপে লাগাতার টাইপিংয়ের শব্দ। টুকটুক! টুকটুক! লোকটা কি কিছু টাইপ করছে? একটু বেশিই ব্যস্ত? মানুষী ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল, “আমি পরে কথা বলব তাহলে। এখন রাখি?”
সঙ্গে সঙ্গে সাদিফের গমগমে উত্তর, “না। অফিসে চাপ বেশি। কাজটাজ ভালো লাগছে না। নেহায়েত তোকে বিয়ে করতে হবে বলে! তুই কথা বল। আমি শুনবো।”
মানুষী মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল, “আপনি এখানে আসবেন কবে?”
“এখানে একটু কাজ আছে। বিয়ের আগের দিন ছাড়া আসতে পারবো না।”
“তাহলে বিয়ের শপিং? আমি একা একা করবো?”
“করতে হবে। আমি শাড়ি এখান থেকে কিনবো। নিজের পছন্দের। লাল রঙের জামদানি কেমন হবে?”
টাইপিং রত আঙুলগুলো থামালো সাদিফ। সামনে ল্যাপটপের তীব্র আলোয় চোখদুটো কেমন ঝাপসা হয়ে এলো হঠাৎই! নিগূঢ় গলায় সাদিফ ভদ্র মানুষের মতো শুধাল, “আমি তোর জন্য শাড়ি পছন্দ করে আনলে তুই রাগ করবি না তো, মানুষী?”
ফোনের ওপাশে থাকা মানুষী জবাব দিতে পারলো না। মাথা নাড়ালো একবার! দু’বার! বারবার! না, সে রাগ করবে না। কিছুতেই না। কিন্তু হায়! তার এই উচ্ছ্বাস, মাথা নাড়ানো কি সাদিফ দেখতে পারছে? একদমই না।
_______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা