মন কেমনের দিন
১৫.
কোকিলের মধুর ডাক হৈ-হুল্লোড়ে খুব কমই শোনা যাচ্ছে। বলা নেই কওয়া নেই, কেউ তাকে পাত্তা দিচ্ছে না বুঝে সেও চুপ হয়ে গেছে দু’তিনবার ডেকেই। সন্ধ্যাবাতির হলদে আলো পরে আছে রাস্তার দু’ধার গেঁষে। ফেরিওয়ালার হাঁক শোনা যাচ্ছে, “এই হাড়ি-পাতিল! হাড়ি-পাতিল! এই হাড়ি-পাতিল!”
টিভিতে বাংলা সিনেমা চলছে। শাবানা-আলমগীরের বহু পুরোনো সিনেমা। এ বাড়িতে সচরাচর পুরোনো সিনেমা দেখা হয় না। বড় চাচা এলেই যা একটু ভাগ্য খুলে। তিনি এসেছেন আজ প্রভাতের একটু পরপরই। খেয়ে-দেয়ে জবরদস্ত ঘুম শেষে রঞ্জনের পাশে এসে বসেছেন। বসার ঘরে তখন মোটামোটি সবাই-ই ছড়িয়েছিটিয়ে বসে আছে। দৃষ্টি টেলিভিশনে চলমান একটা নতুন বাংলা নাটকের পানে। হাকিম ভূঁইয়া বহুক্ষণ জোড় করে টেনে টেনে নাটকটা দেখবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু নাহ্! হচ্ছে না। নাটক যতই এগোচ্ছে ততই কপালে বলিরেখা ফেলে তপ্ত দুপুরের ন্যায় চড়াও হচ্ছে মেজাজ। এটা কোনো নাটক হলো? নাটকের ‘ন’ আছে এখানে? নায়ক-নায়িকার তুনুমুনু ছাড়া তো তিনি আর কিছু চোখে দেখছেন না। কি আশ্চর্য! আর চরিত্র কোথায়? চরিত্রদের ভূমিকা কোথায়? ছোঁ মেরে রঞ্জন থেকে রিমোট হাতিয়ে নিলেন হাকিম ভূঁইয়া। সেকেন্ডের মাঝেই শাবানা-আলমগীরের একটা সিনেমা লাগাতেই রঞ্জনের বিরক্ত কণ্ঠ, “এইটা কেমন কথা আব্বু? কি সুন্দর নাটকের মোড় আসছিল! ঘুরাইলা কেন?”
হাকিম ভূঁইয়া মহা বিরক্তি নিয়ে বললেন, “ওইটা কোনো নাটক হইলো? প্রেম ভালোবাসার নামে আলগা পীড়িতি! আরে নাটক-সিনেমা তো ছিল আমাদের সময়! শাবনূর, সালমান শাহ্, মৌসুমী, শাবানা, আলমগীর! আহা! মনে পরলেই নিজেকে যুবক যুবক মনে হয়। তোরা কি বলিস? কথায় কি ভ্যাজাল আছে?”
অতিশয় আশাপূর্ণ চোখদুটো ছোট ভাইদের দিকে তাক করা। জ্বলজ্বল চোখ দুটোর তোপের মুখে পরে বড় ভাইজানের বিপরীতে গেল না কেউই। নিশ্চুপে মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিল। তাদের এসব নাটক-সিনামা নিয়ে অতশত আগ্রহ নেই। একটা দেখতে পারলেই হলো।
রঞ্জন মুখটাকে একটুখানি করে কিছু পলক চেয়ে চেয়ে দেখল শাবানার সিনেমা। সিনেমাটা বহু জনপ্রিয়ই বলা চলে। ওইযে? সেলাই মেশিনের একটা বড়োলোকি সিনেমা আছে না? ওটা। রঞ্জন ছোট বেলায় অনেকবারই দেখেছে। এক সিনেমা এতবার দেখতে ভালো লাগে? সে বিরক্ত কণ্ঠে কৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করলো, “তোর অডিশনের কি খবর? কবে দিতে যাবি?”
সিঙ্গেল সোফার একটাতে মানুষী পা গুটিয়ে বসে আছে। সেই সোফায় শরীর ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে বসে মন্ত্রমুগ্ধ নজরে টিভি দেখছে কৃষ্ণ। একটু সময় নিয়ে উত্তর দিলো, “শনিবারে।”
“কি বলিস! মানুষীর বিয়ে তো শুক্রবারে। ম্যানেজ করবি কিভাবে সব?” মেজ চাচার উদগ্রীব কণ্ঠ।
কৃষ্ণ জবাব দিতে সময় নিল। টিভির পর্দায় শাবানার দু:খ কষ্ট দেখাচ্ছে। আহারে! কি কষ্ট মহিলার! কি বেদনাময় কান্না! কৃষ্ণর যেন একটু কান্না কান্নাই পেল। নাক টেনে বলল, “সমস্যা নাইকা। এই ছেড়ি বিয়ার পর বিদায় নিলে আমিও এক লগে বিদায় নিমু। একলগে বাড়ি ছাড়ুম।”
“কি বললি তুই?”
সেসময় রান্নাঘর থেকে মুড়িমাখা নিয়ে আসছিলেন শায়লা খাতুন। কৃষ্ণের কথা শুনতেই তেড়ে এলেন। দানবীয় হাতে কান মলে একাকার কান্ড ঘটিয়ে ধমকে উঠলেন, “বিদায় নিমু কিরে? এই বেয়াদব! বিদায় কি? তোদেরকে কি বিদায় দেওয়ার জন্য এত কষ্ট করে মানুষ করেছি? কথা বলিস না কেন? উত্তর দেয়!”
ঝকঝকে দাঁতের পাটি বের করে ভ্যাবলাদের মতো হাসলো কৃষ্ণ। মশকরার সুরে বললো, “আমি তো মজা করতে আছিলাম চাচিহ্।”
“হ্যাঁ! জীবনটাকে তো ছেলেখেলা ভেবে রেখেছিস!”
রোষপূর্ণ দৃষ্টি ফেলে শায়লা খাতুন চলে এলেন বাকি জায়েদের কাছে। কৃষ্ণর তখন সিনেমা থেকে মনোযোগ সরে গেছে। সে এবার রঞ্জনকে খোঁচালো, “ভাই, তুমি যে আমার সুন্দর সুন্দর কেশ কাইট্টা দিলা, কাজটা কি ঠিক করছো? লোকে তো এহন আমার উপ্রে থুতুও ফেলবার চাইতেছে না।”
দু:খ দু:খ কণ্ঠ। অভিনয় হলেও কণ্ঠে মর্মান্তিক কাঁপনের স্বতঃস্ফূর্ত আভাস। যেন কি নিদারুণ কষ্টেই না আছে ছেলেটা! রঞ্জন অবশ্য সে কষ্টের ধার ধারলো না। বিরক্ত চোখে তাকালো। কৃষ্ণ তারচেয়েও দ্বিগুণ আফসোস নিয়ে বলল, “এইভাবে তাকাইও না তো! বুকে ব্যথা হয়। কেশবতী মাইয়া মানুষগো থেইকাও আমার চুল আছিল ঘন, কালো, অপ্সরীগো মতোন। মাইনষে আমার গায়ের রঙের পয়লা চুল দেইখা পাগল পাগল হইয়া যাইতো। সেই চুলের তুমি কি করলা? কাইট্টা ফেললা। এহন যদিও ছোট ছোট গজাইছে। তবুও! চামচিকা মুখটা তো ঠিক হইতেছে না ভাই। আমারে টিভিতে দেইখা তো নারী সমাজ ছেহ্, ছেহ্ করবো।”
কথাটা শেষে মিছেমিছি চোখের জল মুছতে ভুললো না কৃষ্ণ। ক্রন্দন সুরে ফের বলল, “আমার রুপের আগুনে নারী সমাজ ঝাপ দিয়া মরবো দেইখাই তুমি হিংসার জ্বালায় কাজটা করছো, তাই না রঞ্জন ভাই?”
না চাইতেও মুখের অদল পালটে গেল রঞ্জনের। নিয়ন্ত্রণহারা হয়ে বিকৃত হলো ভাব-ভঙ্গি। নিমেষহীন বিষ-তাচ্ছিল্যে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, “যেই না তার চেহারা, নাম তার পেরায়া!”
কৃষ্ণ মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিমায় বলল, “ধুর! আমি পেয়ারা হইবার যামু ক্যান? আমি হইলাম স্ট্রবেরি।”
“স্ট্রবেরি চাইখা দেখছোত হালা তুই জীবনে? কেমন রঙ দেখতে বল।”
“ক্যান? লাল না? মাঝে দিয়া কেমন কেমন গোটা গতরে।”
রঞ্জন কিছু বলতে নিচ্ছিল, হাকিম ভূঁইয়া ধমক দিয়ে উঠলেন, “সিনেমা দেখছি তো আমি! এত কথা কিসের?”
দেখা গেল ধমক খেয়ে দু’মিনিট চুপ থাকলেও পরক্ষণেই আবার ফিসফিসিয়ে ঝগড়া শুরু করে দিল দু’জনে। সোফায় বসে থাকা মানুষী তাদের দেখে হাসলো মিটিমিটি। নজর ঘুরিয়ে এ ঘরের প্রত্যেককেই দেখলো। চাচারা সব টিভির পর্দায় জোঁকের মতো চেয়ে আছেন। দৃষ্টি ভুলেও সরছে না। চাচিরা আবার টিভি দেখার ফাঁকে ফাঁকে গল্প করছেন। মুখ চেপে হাসছেন। অনাদরে পরে থাকা থালি থেকে মুঠোয় পুরে মুড়িমাখা নিচ্ছেন একটু পর পর। একপাশে বসে থাকা প্রান্ত, মিতা আর ধুতরা শুরু থেকেই বিয়ে নিয়ে জল্পনা-কল্পনায় মেতেছে। কি জামা পরবে, কিভাবে সাজবে, চুলটা কিভাবে বাঁধবে! বুকে চাপা পাথরটা আস্তে আস্তে সরে এল। নিশ্বাসে কেমন আদর আদর ঘ্রাণ। কি প্রশান্তিময় আপন আপন ছোঁয়া! তবুও একটা শূণ্যস্থান থেকে যায়। এসময়, এক্ষণে সাদিফ নামক ইতরটা থাকলেই দেওয়ালের ভাঙ্গা অসম জায়গাটা সমতল হয়ে যেত।
_____
সাদিফের কাজ-টাজ করতে তেমন ভালো লাগে না। ঋতু বৈচিত্রের মতো ইম্পোর্টের সিজনাল ছোটখাটো ব্যবসাতেই দারুণ শান্তি। ব্যবসা মন্দা কখনো হয়নি বলে টাকাপয়সা ওতে প্রচুর আছে। সে ছোট থেকে চট্টগ্রামে বড় হয়েছে। এখানকার ছেলেদের আবার চাকরিতে বড়ই অনীহা। চাকরি মানে অন্যের গোলাম খাটা। তারচেয়ে হালাল উপার্জন ব্যবসাই শ্রেষ্ঠ। সাদিফের মন-মস্তিষ্কে এ ধারণাটা গেঁথে গেছে বাচ্চাকাল থেকেই। তবুও চাকরি করতে হচ্ছে। বিরক্ত লাগলেও সহ্য না করে উপায় নেই। মানুষীকে পেতে হবে না তার? বউ বানিয়ে ইতরামি করতে হবে না?
সময় তখন চলন্ত স্রোতের মতো। কোথা থেকে শুরু হয়ে কোথায় গিয়ে থামছে, জানা নেই। জীবনের রেলগাড়িতে ক্লান্ত যাত্রীর মতো মাত্র বাসায় ফিরেছে সাদিফ। গোসল নিয়ে ডাল-ভাত খেয়েছে দু’টো। আজকে বুধবার। রাত ফুরিয়ে হবে বৃহস্পতিবার। বৃহস্পতিবার শেষে হবে শুক্রবার। তার আর মানুষীর অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়ের আশ্চর্যজনক শুক্রবার! ভাবলে বিস্ময় কাটাতে কষ্ট হয়। বিমূঢ়তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে উত্তাল ঢেউয়ের স্রোতে গা ভাসায়। ফিসফিসিয়ে বলে, “কখনো ভেবেছিলে, সুখ এভাবেও আসবে?”
সত্যি বলতে সাদিফ কিছুই ভাবেনি। যেদিন থেকে মানুষীকে ভালোবেসেছে, মেয়েটার চুপিচুপি অভিমান দেখেছে— ঠিক সেদিন থেকে চেষ্টা চালিয়ে গেছে সে। জয় কিংবা মুখ থুবড়ে নিচে পরার আশংকা করেনি। চেষ্টা করার আগেই যদি ভয় জেঁকে বসে, সফলতা বুঝি হাতে ধরা দেবে? ক্লান্ত শরীরটা টেনে টেনে বিছানায় এলালো সাদিফ। পায়ে ব্যথা করছে। আসার সময় সিঁড়িতে উষ্ঠা খেয়েছে। বুড়ো আঙুল ফুলে একাকার! সাদিফ সিলিংয়ের দিকে তাকালো। হাত বাড়িয়ে একপাশে ফেলে রাখা শপিং ব্যাগটা বুকে জড়িয়ে নিল ক্ষণেই। অফিস শেষে সে শাড়ির দোকানে গিয়েছিল। লাল জামদানি কেনার কথা হলেও কিনেছে বেনারসি। কল্পনার জগতে তার মানুষীকে এই শাড়িটিতেই অপরুপা লাগছিল। বাস্তবে সেই অপরুপা নারীটিকে দেখার লোভ কিছুতেই সামলাতে পারেনি সাদিফ। আনচান করা দুরুদুরু মনটা শাড়ি কিনেই ফিরেছে বসবাসের কুঠিরে।
বন্ধ চোখ মেলল সাদিফ। মোবাইলে সময় দেখে নিলো একবার। এগারোটা বেজে দু মিনিট। মানুষী নিশ্চয় ফোনকলের অপেক্ষা করছে? লজ্জাপতী পাতায় ন্যায় তার অভিমানিনী করছে নিশ্চিত। সে তো চেনে! ঠোঁটের কোণে প্রাণোচ্ছল হাসি এঁটে সাদিফ কল লাগালো মানুষীকে। ওপাশ থেকে কণ্ঠ ভেসে এলো লহমায়, “হ্যালো।”
সাদিফ ভেবে পায় না, এ মেয়েটা তাকে এত পাগল বানালো কখন? প্রেমে উন্মাদ তো সে কখনো ছিল না। এই সুখময় অধঃপতন হলোটা কবে? গাঢ় হাসি ভুলিয়ে সাদিফ গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা চালাল। জিজ্ঞেস করল, “ঘুমাসনি কেন এখনো?”
“আপনার ফোনের অপেক্ষা করছিলাম।”
আহা! সেই পুরোনো দিনের কথা মনে পরে গেল সাদিফের। মেয়েটা ঠিক এভাবেই লজ্জা পেয়ে পেয়ে কথা বলত।
“অপেক্ষা করবি কেন? আমি বলেছিলাম আমি ফোন করব?”
“আমি জানতাম আপনি করবেন।”
“যদি না করতাম?”
এ কথার জবাবে কিয়ৎক্ষণ চুপ থাকলো মানুষী। সাদিফকে বোঝার চেষ্টা করলো। উত্তর দিবে না ভেবে সাদিফের পরবর্তী কথা শোনার অপেক্ষায় রইলো। কিন্ত লোকটা নিশ্চুপ। বরাবরের মতোই। বাধ্য মানুষী নিয়ন আলোর ঘরটাকে একপলক দেখলো। কেমন নিশপিশ করছে শরীর। দৃঢ় গলায় উত্তর দিল, “আপনি করতেন সাদিফ ভাই। অবশ্যই করতেন, করবেন। আমার সঙ্গে কথা না বলে আপনি থাকতে পারবেন?”
লুকিয়ে রাখা হাসিটা যত্ন ছাড়া হলো হঠাৎ! প্রগাঢ়তা নিয়ে কাঁপলো খুব। কথা বলতে দিলো না। এই সুখ সুখ অনুভূতি এত দারুণ! এত স্পষ্ট! হাত দিলেই যেন ছুঁতে পারবে। হাত বাড়িয়ে হাওয়ায় কি যেন ছোঁয়ার চেষ্টাও করলো সাদিফ। দৃষ্টি সিলিংয়ে রেখে বলল, “তুই একটা বেয়াদব, মানুষী।”
“কিহ্?” প্রেম প্রেম যুগলের মাঝে এই আগামাথাহীন কথাটা বড়ই বেমানান ঠেকলো মানুষীর। চিল্লাতে গিয়েই বহু কষ্টে দমালো নিজেকে। তেঁতে ওঠা কণ্ঠে চওরা রাগ নিয়ে বলল, “কিসের মাঝে কি সাদিফ ভাই? স্বভাবে ইতরামি গেল না আপনার? এজন্যই আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাইনি। ইতরের সাথে আবার সংসার কিসের?”
সাদিফের অল্প অল্প হাসির আওয়াজ শোনা গেল, “আচ্ছা! তবে বিয়ে করছিস কেন? করিস না। তোকে বিয়ে করতে আমি মরে যাচ্ছি না।”
“এই যে মুখের সামনে একটা মিথ্যা কথা বলে দিলেন! যেন আমি জানি না! নির্লজ্জের মতো সবাইকে ধরে ধরে যে ‘বিয়ে দাও! মানুষীর সঙ্গে বিয়ে না হলে আমি মরে যাবো’ বলে নাটক রচিয়েছেন গ্রামের সবাই জানে।”
“তাই নাকি! ভুল ভাবছিস। কান্নাটা আমি অন্য মেয়ের জন্য করেছিলাম। সে মেয়ে আবার ভালো না বুঝলি? চরিত্রে দোষ দেখে ছেড়ে দিয়ে নিজেই কষ্ট পাচ্ছিলাম। সত্যি কারের ভালোবাসা তুই কি বুঝবি? পরে আম্মু পরামর্শ দিল, ‘মানুষী তোকে কলিজা, ফুসফুস দিয়ে ভালোবাসে। মেয়েটাকে করুণা করে তুই বিয়েটা করে ফেল।’ আমি যেহেতু মাম্মাস গুড বয়—তাই করব ভেবেছি।”
দূর থেকে ছেলেপেলের আড্ডা শোনা যাচ্ছে। তীব্র কণ্ঠস্বরের জ্বালায় কথা বলা দুষ্কর। সাদিফ এই বাসায় ওঠার পরের দিনই এ ঝামেলার মুখোমুখি হয়েছিল। বাড়িওয়ালার ছেলে সনামধন্য এক কলেজের ছাত্র। রাতবিরেতে সময়ের জ্ঞানহীন হয়ে গলা ফাঁটিয়ে আড্ডা দেয়। দু’বার নালিশ করেও ফলাফল শূণ্য। জানালা লাগিয়ে সাদিফ মনে মনে ভাবলো, বিয়ের পর মানুষীকে এখানে রাখা যাবে না। বাবার বাসায় রাখাটাও যাচ্ছে না। অফিস থেকে দূরে হয়ে যায়। জরুরি তলবে একটা বাসা না খুঁজলেই নয়। সাদিফ আনমনা স্বরে বলল, “তোর জন্য শাড়ি তো কিনে ফেলেছি মানুষী। তোদের কি বাকি শপিং শেষ?”
একটু আগের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যকর কথায় মানুষীর রাগ তখনো কমেনি। গম্ভীর, রুঢ় গলায় সে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ।”
“চুড়ি লাল কিনেছিস তো? আসলে আমিই কিনতাম। শুধু শুধু টাকা নষ্ট। তাই আব্বুকে বলে দিয়েছি কিনে দিতে।”
মানুষী বুদ্ধীমান মেয়ে। সাদিফের এসকল কথা যে শুধু এবং শুধুমাত্র তার গা জ্বালানো কথা, তা সে বুঝে। বুঝেও রেগে যাওয়া বোকামো বিধায় রাগ সংবরণের অসাধ্য পরিশ্রম করলো ও। রয়েসয়ে, সে কথার ধারই ধারল না। কথা ঘুরিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “আপনি এখানে আসছেন কবে? কালকে না?”
“হ্যাঁ। সকালে রওনা হবো।”
“বাসে আসবেন কিন্তু। আবহাওয়া ঠিক নেই। আজকেও বৃষ্টি হলো। আপনার বোধহয় সর্দি হয়েছে। বাইকে ভুলেও আসবেন না।”
সাদিফের ত্যাড়া কণ্ঠস্বর, “তোর কথায়?”
“হ্যাঁ, আমারই কথায়। কথা না শুনলে বিয়ে ক্যানসেল।”
“আহারে! যেন আমি ক্যানসেল করতে দিচ্ছি তোকে! শুন মানুষী, অনেক বিরক্ত করেছিস আমাকে। তুই যে মানুষ না, সেটা তোর নাম শুনেই বোঝা যায়। মানুষ কি ঘটা করে নিজের নাম মানুষ রাখে? তোর এই নিজেকে মানুষ প্রমাণ করার চেষ্টাটাই সন্দেহ জনক।”
মানুষী অতিষ্ঠ হয়ে এবার ধমকে উঠল, “আপনি চুপ করবেন? ভালো কথা আপনার মুখ দিয়ে বের হয়না?”
“কেন? আমার জ্বালানো তোর ভালো লাগছে না?”
মানুষী জবাব দেয় না। ফোনটা কেটে দেয়। এই ইতর লোকের সাথে কথা বলাও বেকার।
________
পরেরদিন সকালে হুলস্থুল কান্ড ঘটে গেল৷ সাদিফ বিয়ের শাড়ি কিনবে বললেও সে কথার পাত্তা আসলে বাড়ির কেউই দেয়নি। বড় চাচা কোত্থেকে এক শহুরে দোকানের মালিককে বস্তা সহ শাড়ি নিয়ে হাজির করেছেন। তখন বিকাল বিকাল সন্ধ্যা। এত সুন্দর সুন্দর শাড়ির মাঝে মানুষীর একটাও মনে ধরছে না। সকল সৌন্দর্যতা ছাপিয়ে তার কেন যেন বারবার মনে হচ্ছে, সাদিফের আনা শাড়িটাই সবচে’ সুন্দর হবে। ওই শাড়িতেই মানুষীকে সবচে’ মানাবে। এ কথা মিতাকে একবার বলেছেও সে। বিনিময়ে মিতা প্রকান্ড এক ধমক দিয়ে বুঝিয়েছে, “তুই একটা পাগল।”
আসলেই কি তাই? হতে পারে।
হাতে থাকা মোবাইল স্ক্রীনে একবার সময় দেখল মানুষী। লোকটা সেই ভোরের বাসে উঠেছে। এখন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। এখনো এলো না কেন? অপেক্ষাইবা এত গাঢ় হচ্ছে কেন? ভাবনার অকূল পাথারেই কেমন চিৎকার-চেঁচামেচির কণ্ঠ শুনতে পেল মানুষী। চাচাদের কণ্ঠ। সিঁড়ি দিয়ে হন্তদন্ত পায়ে নামছেন তাঁরা। বাড়িভর্তি তখন মেহমান, কাজের লোক, বিয়ে বাড়ি সাজানো ছেলেপেলে! রঞ্জন আর কৃষ্ণ এসব সামলাতে সামলাতে হাঁপিয়ে উঠছে। এসময় বড় চাচার ডাকে দু’জনেই দৌড়ে এলো। কি হয়েছে জানতে চাইলেই হাকিম ভূঁইয়ার রুদ্ধশ্বাসময় কণ্ঠস্বর, “সাদিফের বাসে ডাকাতি পরেছে রঞ্জন। অবস্থা.. আমার ছেলেটা!… তুই গাড়ি বের কর রঞ্জন। সদর হাসপাতালে যেতে হবে।”
কঠোর মানুষটাকে কেউ কোনোদিন কাঁদতে দেখেনি। গ্রামের প্রভাবশালী হাকিম ভূঁইয়া আজ হাউমাউ করে কাঁদছেন। কি আশ্চর্য! এ কান্না না খুশির হওয়ার কথা ছিল?
______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা