#মন_তরঙ্গের_প্রান্তরে
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ২
আমার জীবনের অর্ধ শতাধিক সময়ই কেটেছে হোস্টেলে। তাই, বাড়ি সামনাসামনি হওয়াতে মেহমেদের সঙ্গে সেভাবে দেখা হতো না। আমি এক চোখ অপেক্ষা নিয়ে বসে থাকতাম। এই বুঝি ভুলে ভালেও এক পলকের জন্য এক মুহূর্তের জন্য যদি আমাদের দেখা হয়? কিন্তু সেভাবে আমাদের দেখা হতো না। কালে ভদ্রে কস্মিনকালে তাঁকে সেভাবে দেখতাম না। এত সুদর্শন একজন পুরুষের আমাকে নিয়ে ভাবার সময়ই বা কোথায়? কিন্তু, আমার মন কেন যেন সেদিন মানলো না। হুট করেই হোস্টেল থেকে ছুটি ম্যানেজ করে ছুটলাম বাড়িতে। বিষ্ময়কর বিষয় হলো এলাকায় পা মাড়াতেই গাড়ি থেকে শুভ্র সাদা পোশাকে আমার প্রেমিক পুরুষের আগমন! আমি লজ্জায় মাথা নামিয়ে ফেললাম।তাড়াতাড়ি পাশ ঘেঁষে বাড়িতে চলে এলাম।
মেহমেদকে দেখলেই আমার হৃদকম্পন এত অস্বাভাবিক গতিতে বেড়ে যায় কেন? এটাই কী আসলে প্রেমের পড়ার অনুভূতি? এমনটাই বুঝি হয় প্রথম প্রনয়ে?
আমাকে হঠাৎ এভাবে বাড়িতে ফিরতে দেখে দাদিন এবং বাবা দুজনেই কিছুটা চমকিত। আমি নিজেও অবশ্য চমকিত। দুপুরে খাবার টেবিলে বাবা তো কথা প্রসঙ্গে দাদিনকে বলেই বসলেন মেহমেদের কথা। সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল এই মেহমেদের প্রসঙ্গটা আসলেই আমার খাবার খাওয়া থেমে গেল। হাত দুটো থরথর করে কাঁপতে লাগলো। আমি নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেলাম। এই মেহমেদ জুবায়ের নামক মানুষটির নাম শুনলেই আমি এতটা ক্ষীণ এতটা কমজোর হয়ে পড়ি কেন?
আমাদের বাড়িতে বাবার ঘরে একটা বড় ফ্রেমে দেয়ালের পূর্ব দিকে একজন নারীর ছবি টানানো। অদ্ভুত বিষয় প্রথম দেখায় ছবির নারীটিকে আমি অর্থাৎ লাবণ্য মনে হলেও সেটি আসলে আমি না। ছবিতে থাকা নারীটির গালের বাম পাশে কালো কুটকুটে একটা তিল মালা ফুটে রয়েছে। আমার গালে কোনো তিল নেই। এদিকটার কারণে ছবির নারীটিকে সম্পূর্ণ রূপে ঠিকভাবে আমি বলা চলে না। নারীটি সত্যি বলতে ছবিতে যতটা সুন্দর বাস্তবে ঠিক ততটাই সুন্দর! সামনাসামনি তো আরো বেশিই সুন্দর! খুব ছোটবেলায় দেখেছিলাম তাঁকে। সেভাবে ঠিক মনে নেই। কিন্তু, তিনি যে চোখ ধাঁধানো সুন্দরী তা যে কেউ দেখেই বলে দিতে বাধ্য।
আমার বারান্দায় বেশ কিছু গাছ আছে। অনেকটা ঝুলন্ত ভাবে দেয়ালে জুড়ে আছে তাঁরা। আমার পরিবর্তে দাদিন এগুলোর দেখাশোনা করেন। দাদিন শুধু আমার না; বাবার লাগানো গাছ গুলোরও দেখাশোনা করেন। অনেকদিন বাড়িতে আসা হয় না বলে গাছ গুলোর সেভাবে যত্ন করা হয় না। গাছগুলোর যত্ন করবো দেখে হাত দিতেই রশি ছিঁড়ে নিচে গিয়ে পড়লো! আমি ওপর থেকেই কোনো এক ভদ্রলোকের চিৎকার শুনতে পেলাম। দৌড়ে নিচে নামতেই দেখলাম তিনি কোনো যেনতেন ব্যাক্তি নন। তিনি মেহমেদ জুবায়ের! অন্য সময়ে তাঁকে দেখে আমার বুকটা আনচান আনচান করলেও;আজ তাঁর বিপরীত ঘটলো। আমার ইচ্ছে হলো দম ফাটিয়ে হাসতে। কিন্তু সৌজন্যতার খাতিরে সেটা পারলাম না। মুখে কাঠিন্যতা রেখেই তাঁর সামনে গেলাম। বেচারার সাদা ইউনিফর্মে সাদা ভেজা মাটি দিয়ে তলিয়ে গেছে। বেচারা যে প্রচন্ড লজ্জা এবং অস্বস্তি পরেছে তা আর বলতে বাকি নেই। হায়রে! টব রে! এত মানুষ মাথা এত মানুষের শরীর থাকতে তুই এই একটাই মানুষ খুঁজে পেলি দুনিয়াতে? ছিহ! তোর কী একটুও লজ্জা লাগলো না এমন বেগানা একজন পুরুষ মানুষের গায়ে হামলিয়ে পড়তে?
সেদিন থেকে আমি মেহমেদের নাম দিলাম মাটি মানব। এই মাটি মানবের কারণেই আজ আমার এই দশা। আমি যে কিনা কখনো কোনো ছেলে মানুষের দিকে ফিরেই তাকাইনি। সে কিনা এভাবে একজন মানুষের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি? আমি সব সময় মেহমেদ নামক ব্যাক্তিটির জন্য আমার বুকের ভেতরে এমন কিছু অনুভূতি টের পাই। যেসব অনুভূতির স্বাদ আমি আগে কখনো পাইনি। প্রিয় মেহমেদ জুবায়ের, আপনি কী জানেন একজন তরুনীর নির্বিগ্ন মনে আপনার প্রভাব ঠিক কতটা?
চলবে…
#মন_তরঙ্গের_প্রান্তরে
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ৩
দিন দিন নিজের প্রতি কেমন যেন উদাসীন হয়ে পরছি আমি। সবকিছুতে নিজেকে না বরং মেহমেদকে খুঁজে পাই আমি। ব্যাপারটা আজকাল এমন দাঁড়িয়েছে যে আমি এদিক তাকালেও মেহমেদ। আর ওদিকে তাকালেও মেহমেদকে দেখতে পাই। মাঝেমধ্যে বলতে ইচ্ছে হয়,
” হে আমার প্রেমিক পুরুষ! হে আমার প্রিয় মাটি মানব। নিজেকে বাদ দিয়ে এদিকেও একটু দৃষ্টি দাও। তোমায় না পেয়ে এক যুবতী নারী যে ভেতর থেকে দুমড়ে মুষড়ে যাচ্ছে। ”
কিন্তু এসব কথা মনের ভেতরেই আঁটকে থাকে। মুখ ফুটে বলতে পারি না।
বিকালে আজ আবার হোস্টেলে চলে যাওয়ার কথা। সবকিছু তৈরি ঠিকঠাকই ছিল। মাঝ থেকে বাবা বেঁকে বসলেন। বাড়িতে আমার অবস্থান আরো দুটো দিন বাড়লো। হোস্টেলে সচারাচর বন্ধু ও বান্ধবদের সঙ্গেই খেতে বসা হয়্ তবে বাড়ির ব্যাপারটা একেবারে ভিন্ন। দুপুরে বাবা সেভাবে সবসময় বাড়ি থাকেন না। দাদীন একাই থাকেন বাড়িতে এই সময়টায়। দাদীন নিজেই আজ বাড়ি ফিরেছেন সকাল বেলা। তিনি কাল ছিলেন আমার বড় চাচা আব্দুল কালামের বাড়িতে। আমার চাচাতো বোন আবিরা-র বিয়ের সমন্ধ এসেছিল। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আবিরা প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দিয়েছে। এটা নিয়েই দাদীনের সকাল থেকে এত হুলস্থুল। খাওয়ার পাতেও দাদীন একই কথা বাবার সামনেও তুলে ধরলেন। বাবা কিছুই বললেন না। তবে, আমি স্বাভাবিক ভাবেই বললাম,
” সবার তো আর সকলের প্রতি টান বা ভালোবাসা থাকে না। সবাই কী আর ভালোবাসতে পারে? অচেনা অজানা একটা মানুষের সঙ্গে তো হুট করেই সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে না।”
দাদীন কিছু বললেন না। তবে, বাবা কেমন যেন চমকে উঠে আমার দিকে তাকালেন। আমার প্রতি বাবার এত বিষ্ময় দেখে আমিও চমকে উঠলাম। বাবা এক ঘোরে আমার দিকে বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন।
বাবা প্রচন্ড নিশ্চুপ নির্বিগ্ন একজন মানুষ। ভেতর থেকে যে কেউই বলবে তিনি একজন কঠিন মানুষ। কিন্তু, আমি জানি আমার বাবা কতটা নরম হৃদয়ের একজন মানুষ। আমার বাবা সম্পর্কে করা প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর আমি হয়তো দিতে পারবো। তবে, আমার মাকে নিয়ে করা কোনো প্রশ্নের জবাব আমার নিকট নেই। শেষ কবে তাঁকে দেখেছি তাও মনে নেই। কিছু কিছু আবছা স্মৃতি মনে আছে।
বাড়িতে আসার পর থেকে আমার অবস্থান শুধু ঘর আর বারান্দা। সময় সাপেক্ষে মাঝেমধ্যে ছাঁদেও যাই। কিন্তু এবার আসার পর থেকে একবারও ছাঁদে যাওয়া হয়নি। ভেবেছিলাম আজ ছাঁদে উঠবো। পরিকল্পনা মোতাবেক ছাঁদে গিয়ে আমি তাজ্জব! মেহমেদ নিজের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে! আমি চমকে উঠে একপাশে সরে গেলাম। গভীর ভাবে দেখলাম মেহমেদকে। আচ্ছা, আমি যেভাবে মেহমেদকে এত খুঁটে খুঁটে গভীর বা দেখি কিংবা বিশ্লেষণ করি। মেহমেদও কী আমায় নিয়ে সেরকম কিছু ভাবে? মেহমেদ তুমি কী আদৌও জানো? লাবণ্য নামক এক তরুনীর জীবনের ঠিক কতটা অংশ জুড়ে তুমি আছো?
আমার জীবনের সবকিছু শুরু থেকেই কেমন যেন অগোছালো ছিল। এবার আমার জীবনে আরেকটা বড় ঝড় নেমে এলো। যে-ই ঝড়ে আমি ভেঙেচুরে চুরমার হয়ে গেলাম!
রাতে দাদীমার সঙ্গেই ঘুমিয়ে ছিলাম। একেবারে পাশাপাশি দাদীমার শরীরে মুখ ডুবিয়ে ঘুমের অঁতলে ডুব দিয়েছিলাম। কে জানতো? এটাই যে দাদীমার সঙ্গে আমার শেষ ঘুম। সকালে আমি ঘুম থেকে উঠলেও দাদীমা উঠলেন না। তাঁর শরীরে হাত দিতেই চমকে উঠলাম সারা শরীর বরফের মতো ঠান্ডা। নাকে হাত দিয়ে দেখলাম কোনো শ্বাস নিচ্ছেন না। আমার চিৎকারে বাবাও দৌড়ে এলেন।
ডক্টর মৃত ঘোষণা করলেন দাদীমাকে। আমার জীবনে মায়ের পর মাতৃসম যে-ই মানুষটি ছিল তাঁকেও আমি হারিয়ে ফেললাম চিরতরে। আমি ভেতর থেকে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম৷ বাবাকে কী সান্ত্বনা দেবো? আমি নিজেই তো নিজেকে বোঝাতে পারছিলাম না। বাবা আরো বেশি ভেঙে পড়লেন। সারাজীবন নিজেকে তিনি শক্ত মানুষ হিসেবেই সকলের কাছে তুলে ধরেছিলেন। এবার তিনি দমে গেলেন।
আমিও আর এরপরে হোস্টেলে যাইনি। ডিপার্টমেন্ট হেডকে বিস্তারিত জানিয়ে হল ছেড়ে চলে এলাম। বাবাকে একা রেখে হোস্টেলে থাকা সম্ভব ছিল না। প্রতিদিন ক্লাসেও যেতাম না এরপর থেকে। সপ্তাহে দুইদিন বা তিনদিন যেতাম। বাবাকে একা থাকতে দিতাম না। বাবাও নিজের প্রতি একটু উদাসীন হয়ে পরলেন। তাঁর সব খেয়াল কণাগুলো এবার আমার ওপরে এসে জমলো। হঠাৎই আমার বিয়ের জন্য পাত্র দেখতে শুরু করলেন। সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়ে বসলেন মেহমেদের বাবা আলতাফ আংকেল।
চলবে…