মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব-৩৫+৩৬+৩৭

0
384

#মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৩৫
লজ্জা,ভয়,অসস্থি নিয়ে অথৈ বসে আছে মির্জা বাড়ির বসার ঘরে।রিতিমতো সে নার্ভাসন্যাসে ঘামছে।এইভাবে না বলে হুট করে নিজের শশুড়বাড়িতে আসা একটা লজ্জাকর পরিস্থিতি।অথৈয়ের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আরহাম সাহেব হাসলেন।নরম কণ্ঠে নিজের পুত্রবধুর উদ্দেশ্যে বলে উঠেন,’ অথৈ তুমি তোমার নিজ বাড়িতেই এসেছ।বাড়িটা যেমন রোজার, তেমন তোমারও।এইভাবে লজ্জা পাচ্ছ কেন মা?তোমার কি আমাদের জন্যে অসস্থি হচ্ছে?’

অথৈ শশুড়ের মুখে এতো স্নেহময়ী বাক্য শুনে যেন শান্তি পেল।ওর এতোক্ষণের লজ্জা,ভয়,অসস্থি সবটা যেন কোথায় ঘায়েব হয়ে গেল।এই বাড়ির লোকগুলো এতো ভালো কেন?মাঝে মাঝে ভাবে অথৈ। বাড়ির পুত্রবধুদের এতো আদর,যত্ন,স্নেহ আর ভালোবাসা দিতে সচরাচর কোনো ফ্যামিলিদের দেখা যায় না।আর এই বাড়ির লোকগুলো তো রিতিমতো বাড়ির বউদের নিজেদের মেয়ের থেকেও বেশি ভালোবাসেন তারা।অথৈ হালকা আওয়াজে বলে,’ আসলে আংকেল।প্রথমবার এসেছি তো এই বাড়িতে।তাছাড়া আপনার ছেলে যে এইভাবে আমাকে না জানিয়ে এই বাড়িতে নিয়ে আসবে আমি নিজেও বুঝতে পারিনি।’

আরহাম সাহেব কপাল কুচকালেন অথৈয়ের কথায়।তাকে এইভাবে নিজের দিকে তাকাতে দেখে অথৈ বলে,’ কি হলো আংকেল?’

আরহাম সাহেব গম্ভীর স্বরে বলে,’ শশুড়কে কেউ আংকেল বলে?তাহলে কি আমি মেনে নিবো যে তুমি এখনও এই পরিবারের লোকদের আপন করে নিতে পারোনি।নিজেকে এই পরিবারের অংশ ভাবো না।’

অথৈ থতমত খেয়ে গেল আরহাম সাহেবের এহেন কথায়।অথৈ আসলে বুঝতে পারেনি।আর তাছাড়া এইভাবে হুট করে তো বাবা বলে সম্বোধণ করা যায় না।একটু সময় তো লাগবেই।আচ্ছা, তিনি কি রাগ করলেন অথৈয়ের উপর।অথৈয়ের কণ্ঠে স্পষ্ট মন খারাপের আভাস।
‘ আমি সরি। আসলে আমি বুঝতে পারেনি।আপনি কি রাগ করেছেন আং…না মানে বাবা?’

অথৈয়ের মুখে ‘ বাবা ‘ ডাক শুনে আরহাম সাহেব প্রশান্তির হাসি দিলেন।বলেন,’ একটু আধটু রাগ করেছিলাম।তবে এই যে এখন তুমি আমায় বাবা বলে ডাকলে।এখন আর রাগ নেই।’

অথৈয়ের ঠোঁটের কোণেও হাসি ফুটে উঠল।এদিকে আরিয়ান আসল দোতলা থেকে নেমে।সাথে রোজাও আছে।আরিয়ান অথৈয়ের কাছে গিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।অথৈ সালাম দিলো ওকে।আরিয়ান সালামের জবাব দিয়ে বলে, ‘ কেমন আছ অথৈ? বাড়ির সবাই ভালো আছে তোমার।
‘ আলহামদুলিল্লাহ ভালো ভাইয়া।বাড়ির সবাইও ভালো আছে।আপনি কেমন আছেন?’
‘ আলহামদুলিল্লাহ। সরি বোন প্রথম আসলে বাড়িতে।তাও আমি তোমাকে বেশি সময় দিতে পারলাম না।দুপুরে লাঞ্চ করে সময় থাকেই অল্প একটু।তোমায় দেখেই রোজা ছুটে গিয়েছে আমায় ডাকতে।অফিসে চলে যাবো তাই দেখা করে নিলাম।’

আরিয়ানের আদর পেয়ে অথৈয়ের ইহানের কথা মনে পরে গেল।ইহানও তাকে ঠিক এইভাবে আদুরে হাতে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।আরহাম সাহেব আর আরিয়ান অথৈয়ের সাথে আরেকটু কথাবার্তা বলে অফিসে চলে গেল।আতিক মাহাবুব মির্জা তিনি বাড়িতে নেই।কিছু কাজে বাহিরে গিয়েছেন।রোজা ফোন করে তাকে জানিয়েছে অথৈ এই বাড়িতে এসেছে।তিনি এই কথা শুনে পারলে তখনই উড়ে চলে আসেন।তবে রোজা তাকে আস্তে ধীরে আসতে বলেছে।সে আসা না পর্যন্ত অথৈকে যেতে দিবে না এটাও জানিয়েছে।এদিকে সবাই চলে যাওয়ায় বাড়িটা চুপচাপ হয়ে গিয়েছে।অথৈ হাশফাশ করতে লাগল।না পেরে অবশেষে প্রশ্ন করেই বসল,’ রোজা আপু?এতো বড়ো একটা বাড়িতে আপনি এমনভাবে থাকেন কিভাবে?’

রোজা হতাশ কণ্ঠে বলে,’ কি আর বলবো বোন।এইভাবেই আমায় থাকতে হয়।বাড়ির সব কর্তরা চলে যান যার যার কাজে বাহিরে।দাদুর একটু বেশি থাকা পরে বাড়িতে।তবে তার সাথে কি চব্বিশ ঘন্টা গল্প করা যায় বলো?সে তো বয়স্ক মানুষ।তার বিশ্রামের প্রয়োজন হয় এখন বেশি।’

একটু থেমে তারপর আবার অভিমানি গলায় বলে,’ তোমার বড়ো ভাইয়াটাও অনেক খারাপ জানো? বিগত একটা বছর যাবত বলছি।চলো আমরা একটা বেবি নেই।কিন্তু না সেই যে ডাক্তারের কাছে চেক-আপ করিয়ে জানতে পেরেছে আমার নাকি প্রচুর রক্তশূন্যতা।কমপক্ষে এক, দেঢ় বছরের মধ্যে বেবি নিতে না।আগে রিকেভর করবো পুরোপুরি এরপরেই নাকি নিতে বলেছেন।বলো তো?একটা বেবি থাকলে কি আমার এতো একা একা লাগতো?কখনও লাগতো না।এক বছর পেরিয়ে গেছে।আর আমিও পুরোপুরি ঠিক আছি।তবে জনাব মানছেই না।তিনি আরও কয়েকদিন ওয়েট করতে বলেছেন।এই লোকটাকে নিয়ে আমি আর পারি না।আর আমার বাবামশাই,দাদু আর রুদ্রিকও আরিয়ানের কথার তালে তালে সায় দিয়ে যাচ্ছে।উফ!’

রোজা অভিযোগগুলো শুনে মুচকি হাসলো অথৈ। ঠিক কতোটা সুখে রোজা আছে তা তার কণ্ঠ শুনলেই বোঝা যায়।অথৈ নিজেও যে রোজার মতো একজন ভাগ্যবতী।এটা ভাবতেই মনেপ্রাণে আলাদা শিহরণ বয়ে যায়।আল্লাহ্’র দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করে সে।

রোজা আর অথৈ অনেকক্ষণ বসে বসে গল্প করল।ওদের কথার মাঝে হঠাৎ একজন সার্ভেন্ট আসল।সে বলে,’ বড়ো বউমনি ছোটো ভাইজান কফি বানিয়ে ছোটো বউমনিকে দিয়ে তার রুমে পাঠাতে বলেছে।আর ছোটো বউমনিকেই কফি বানাতে বলেছে।’

রোজা সব শুনে মুচকি হেসে বলে,’ হ্যা আপনি যান। ‘

সার্ভেন্ট চলে যেতেই রোজা অথৈয়ের দিকে তাকালো।অথৈয়ের মুখে এক্সপ্রেসন দেখেই রোজা কিটকিটিয়ে হেসে উঠল।এদিকে অথৈ হতবুদ্ধুর মতো বসে।লজ্জায় তার গালজোড়া ফুলে ফেঁপে উঠেছে।এই লোক এতো নির্লজ্জ কেন?এইভাবে কেউ কাউকে এসব বলে?রোজা হাসি দেখে এখন তার আরও বেশি লজ্জা লাগছে।অথৈকে লজ্জা পেতে দেখে রোজা হাসি থামিয়ে বলে,’ থাক আর লজ্জা পেতে হবে না।অভ্যাস করে নেও।যেমনটা আমি করেছি।দু ভাই-ই একরকম তারা।আমারও প্রথম প্রথম আরিয়ানের এইসব কান্ডে যে কি পরিমান লজ্জা লাগতো বলে বোঝাতে পারবো না।তবে এখন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।যখন তুমি পার্মান্যান্টলি এই বাড়িতে এসে পরবে।তোমারও অভ্যাস হয়ে যাবে।এখন চলো তোমায় কিচেনে নিয়ে যাই।ছোটো নবাবজাদা আবার দেরি হলে রেগে যাবে।’

অথৈ মাথা দুলিয়ে রোজার পিছন পিছন রান্নাঘরে আসল।রোজা তাকে কফি বানানোর সব উপক্রম এগিয়ে দিয়েছে।আরিয়ান ফোন করায় সে রুমে চলে গিয়েছে।অবশ্য সে যেতে চাচ্ছিলো না।আরিয়ান বার বার ফোন দেওয়ায় অথৈ জোড় করে পাঠিয়ে দিয়েছে।অথৈ সুন্দরভাবে এককাপ কফি বানিয়ে নিলো।তারপর পা বাড়ালো রুদ্রিকের রুমের দিকে।কিন্তু রুদ্রিকের রুম কোনটা সে তো জানে না।হঠাৎ একজন সার্ভেণ্টকে দেখে তাকে জিজ্ঞেস করলে।সে অথৈকে দেখিয়ে দেয় রুদ্রিকের রুম।অথৈ রুদ্রিকের রুমের সামনে এসে থম মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো।ভাবল অনেককিছু।কোনো একদিন এই রুমটা তার হবে।ভাবতেই অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যাচ্ছে হৃদয় জুড়ে।অথৈ লম্বা শ্বাস ফেলে রুদ্রিকের রুমে প্রবেশ করল।কফিটা নিয়ে টি-টেবিলের উপর রেখে চারদিকে চোখ বোলালো।পুরো রুমটা গ্রে কালারের পেইন্ট করা।রুমের মাঝে রাউন্ড বেড।তার সাথে দুই সাইডে দুটো এটাচ্ড ছোটো টেবিল।একটা ড্রেসিংটেবিল,আলমারি আর একটা সোফাসেট।ব্যস এইগুলোই আছে রুমটায়।তবে রুমটা ভীষণ সুন্দরভাবে ডেকোরেট করা।অথৈয়ের ভীষণ ভালো লাগলো।

‘ রুমটা যেভাবে দেখছ।আমাকেও তো সেভাবে কোনোদিন দেখোনি।অথৈ আ’ইম ফিলিং জেলাস।’

নিরবতার মাঝে হঠাৎ গম্ভীর কণ্ঠস্বরে ভয় পেয়ে গেল অথৈ।আর একটু হলেই তো সে হার্ড এট্যাক করে বসত।অথৈ বিরবির করে রুদ্রিককে বকা দিলো।রুদ্রিকের গম্ভীর গলা ফের শোনা যায়,
‘ আমাকে না বকে।কফিটা নিয়ে ব্যালকনিতে এসো।কফিটা যে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল আছে তোমার?’

অথৈ মুখ ভেংচি কাটলো।তারপর কফিটা নিয়ে এগিয়ে গেল বারান্দার দিকে।যেতেই একরাশ মুগ্ধতা এসে ভর করল ওকে।এতো সুন্দর ব্যালকনি।অনেক বড়ো রাউন্ড শেইপের একটা ব্যালকনি।ব্যালকনিটার একপাশে ছোটো পুরো কাচের তৈরি একটা রুম দেখা যাচ্ছে।একেবারে ছোটো সেখানে শুধু সিংগেল বেডের সমান একটা ফ্লোর বেড বিছানো।রুমটায় স্লাইডিং ডোর দেওয়া।সেটা খোলা তাই সব দেখতে পেয়েছে অথৈ। অপরপাশে ছোটো একটা জানালাও আছে।পুরো ব্যালকনিতে শতো ধরনের ফুল গাছ আছে।অথৈয়ের বেডরুম থেকে ব্যালকনিটাই বেশি ভালো লাগলো।হঠাৎ রুদ্রিকের কথা মনে আসতেই ব্যালকনির চারদিকে চোখ বুলালো অথৈ। কিন্তু রুদ্রিককে কোথায় দেখতে পেলো না।আশেপাশে তাকাতে থাকা অথৈ হঠাৎ নিজের ঘাড়ের কাছে কারো উষ্ণ নিঃশ্বাসের উপস্থিতি টের পেলো।আএ সে কেউটা যে রুদ্রিক ছাড়া কেউ না।তাও ভালোভাবে জানে সে।রুদ্রিক আরেকটু ঘনিষ্ঠ হলো অথৈয়ের সাথে।অথৈয়ের পিঠ গিয়ে লাগল রুদ্রিকের প্রসস্থ,চওড়া বক্ষে।অথৈয়ের শরীর মৃদ্যুভাবে কাঁপছে।এই লোকটা এমনভাবে তার কাছে আসলেই ওর সব এলোমেলো হয়ে যায়।মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে যায়।রুদ্রিক একটু আগেই গোসল দিয়েছে।তাই ওর শরীর ঠান্ডা হয়ে আছে।রুদ্রিক ওর শীতল হাতটি দিয়ে অথৈয়ের হাতে স্লাইড করতে লাগলো।ধীরে ধীরে হাতটি গিয়ে ঠেকল অথৈয়ের ধরে থাকা কফির উপর।রুদ্রিক অথৈয়ের হাত থেকে কফিটা নিয়ে নিলো।চুমুক বসালো কফিটায়। নাহ,পুরপুরি ঠান্ডা হয়ে যায়নি কফি। রুদ্রিক আধঠান্ডা কফিটাকে একনিঃশ্বাসে খেয়ে নিলো।কফির মগটা নাগালে একটা চেয়ার আছে সেখানে রেখে দিলো।এইসবে রুদ্রিকের নজর বিন্দুমাত্র সরে যায়নি অথৈয়ের উপর থেকে।রুদ্রিক ঠোঁট এলিয়ে অথৈয়ের কানে ফিসফিস করে বলে,’ ঠান্ডা হয়ে যাওয়া কফি খাইয়েছ আমায়।বিনিময়ে তোমাকে কি শাস্তি দেওয়া যায় বলো তো?’

গলা শুকিয়ে আসল অথৈয়ের।এই লোক এতো কাছে আসছে কেন ওর?আর এইভাবে কথা বলায় রুদ্রিকের ঠোঁটের স্পর্শ লাগছে অথৈয়ের কানের লতিতে।অথৈয়ের পায়ের তলা শুধু শিরশির করছে।অথৈ কাঁপা গলায় বলে,’ আ…আমার কি দোষ?আপ…আপনাকেই তো খুঁজে পাচ্ছিলাম নাহ।’

বিনিময়ে রুদ্রিক ওর হাতখানা এনে রাখল অথৈয়ের পেটের উপর।শক্ত হাতে চেপে ধরলো।আকস্মিক রুদ্রিকের এহেন কাজে।নিঃশ্বাস আটকে গেল অথৈয়ের।খামছে ধরল ওর পেটের উপরে রাখা রুদ্রিকের হাত।রুদ্রিক অন্যহাতে অথৈয়ের ঘাড়ের চুলগুলো সরিয়ে দিলো।রুদ্রিকের একেকটা স্পর্শে পাগল হয়ে যাচ্ছে অথৈ। তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে মনের মধ্যে।রুদ্রিক অথৈয়ের ঘাড়ে নরম অধরের ছোঁয়া দিতে লাগল।জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে অথৈ। রুদ্রিকের অধরের একেকটা স্পর্শে যেন অথৈয়ের মনে হচ্ছে রুদ্রিক ওর শরীরের সব শক্তি শুষে নিচ্ছে।অথৈ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না।শরীরের ভড় ছেড়ে দিলো রুদ্রিকের উপর।রুদ্রিক বাহুডোরে আগলে নিলো অথৈকে।পর পর পাঁজাকোলে নিয়ে নিলো।অথৈ লজ্জায় চোখ খুলতে পারছে না।মুখ লুকালো রুদ্রিকের বুকের মাঝে।রুদ্রিক অথৈকে কোলে নিয়েই বসে পরল ব্যালকনিতে রাখা একটা বেতের চেয়ারে।অথৈ দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরল রুদ্রিকের। মুখ লুকানো রুদ্রিকের বুকে।রুদ্রিক মাদকতা ভড়পুর কণ্ঠে বলে,’ অথৈ তোমাকে ছাড়া আমি আর থাকতে পারছি না।তুমি কাছে আসলেই আমি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। তোমাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে খুব করে।এতো এতো অপেক্ষা আমি কিভাবে করব অথৈ?’

শেষ বাক্যটা করুন শোনালো রুদ্রিকের।রুদ্রিকের এহেন কথায় চোখ পিট পিট করে তকালো অথৈ। রুদ্রিকের লাল হয়ে যাওয়া চোখজোড়া দেখে বুকের বা পাশটায় ব্যথা অনুভব করল।ঠিকই তো বলে রুদ্রিক।মুখে না বলুক তবে অথৈ জানে রুদ্রিক তাকে প্রচন্ড ভালোবাসে।আর ভালোবাসার মানুষ যদি তার পাশে থাকে।তাহলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা অনেক কষ্টসাধ্য।তা একটু হলেও বুঝতে পারছে অথৈ। আবার তার উপর ও রুদ্রিকের সহধর্মিণী। ওর উপর সম্পূর্ণ অধিকার আছে রুদ্রিকের।কিন্তু লোকটা শুধু ওর কারনে।ও যেন কষ্ট না পায় সেই কারনে নিজের ইচ্ছা,ইমোশন,কষ্ট সব লুকিয়ে রাখে।অথৈয়ের খারাপ লাগছে।ও নিজেও রুদ্রিকের কাছে পার্মানেন্টভাবে এসে পরতে চায়।কারন ও নিজেও যে ভালোবেসে ফেলেছে লোকটাকে।লোকটাকে কষ্ট পেতে দেখতে পারে না ও।ভাবনার মাঝে রুদ্রিকের আদুরে কণ্ঠের ডাক শুনতে পেলো।

‘ অথৈ, শোনো।’

রুদ্রিকের বুক থেকে মাথা সরালো অথৈ। ডাগর ডাগর চোখজোড়া নিয়ে তাকালো রুদ্রিকের দিকে।বলল,’ হুম বলুন।’

রুদ্রিক নেশাকাতর হয়ে দৃষ্টি তাক করে আছে অথৈয়ের ওষ্ঠজোড়ার দিকে।আলতো করে স্পর্শ করলো অথৈয়ের ঠোঁটজোড়া।কেঁপে উঠল অথৈ। চোখ বন্ধ করে নিলো।রুদ্রিক শুকনো ঢোক গিলছে।ভীষণভাবে টানছে ওকে ওই নরম ঠোঁটজোড়া।একটুখানি ছুঁয়ে দিলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে?রুদ্রিক অস্থির গলায় বলে উঠে,’ এখানে যদি আমার অধরের একটুখানি ছোঁয়া ছাপিয়ে দেই তোমায়।তুমি কি খুব বেশি রাগ করবে?’

রুদ্রিকের এহেন কাতর কণ্ঠের আবদার যেন অথৈয়ের হৃদয় নাড়িয়ে দিলো।শিরশিরে অনুভূতিতে ছেঁয়ে গেলো সর্বাঙ্গ।কি বলবে অথৈ?কিভাবে জবাব দিবে?লজ্জা’রা যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে ওকে।অথৈয়ের মৌনতায় রুদ্রিক ব্যাকুল হয়ে বলে,’ প্লিজ অথৈ স্যে সামথিং!’

অথৈ নড়েচড়ে উঠল।রুদ্রিকের গলায় বেধে রাখা হাতদুটোর বাঁধন আরও শক্ত করল।চোখজোড়া বন্ধ করে মুখশ্রীটা উঁচু করে রুদ্রিকের মুখের কাছাকাছি আনলো।আলতো স্বরে বলে উঠল,’ ইয়্যু ক্যান।’

রুদ্রিকের হৃদয় যেন প্রশান্তিতে ছেঁয়ে গেলো অথৈয়ের জবাবে।আলতো হাতে গাল স্পর্শ করল অথৈয়ের।অথৈ নিভু নিভু চোখে তাকালো।রুদ্রিক ফাঁকা ঢোক গিলে নিলো।আস্তে আস্তে ঠোঁট এলিয়ে নিলো অথৈয়ের কাছে।সামান্য একটুখানি অধর ছোঁয়ালো অথৈয়ের অধরে।রুদ্রিকের বক্ষস্থল কেঁপে উঠল।অথৈয়ের ঠোঁটে আলতো ঠোঁটের একটুখানি স্পর্শ করতেই মনে হচ্ছে ওর শরীরে বৈদ্যুতিক ঝটকা লেগেছে।এদিকে অথৈ খামছে ধরে আছে রুদ্রিকের ঘার।লোকটা চুমুও খায়নি। শুধু একটুখানি ছুঁয়ে দিয়েছে ঠোঁটজোড়া দিয়ে।তাতেই যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে অথৈয়ের।অথৈ ঘণ ঘণ শ্বাস নিচ্ছে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে।কিন্তু রুদ্রিক বোধহয় তা হতে দিলো না।অথৈ কিছু বুঝে উঠার আগেই রুদ্রিক এইবার অথৈয়ের ঠোঁটজোড়ায় তার ঠোঁটজোড়া গভীরভাবে স্পর্শ করল।বরফ শীতলতায় ছেঁয়ে গেলো অথৈয়ের তনমন।রুদ্রিক যেন নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে গিয়েছে।সে প্রিয়তমাকে ভালোবাসার স্পর্শ দিতে মত্ত হয়ে উঠেছে।একহাত অথৈয়ের পিঠে আড়াআড়িভাবে রেখে আরেক হাত অথৈয়ের কোমড় চেপে ধরে অথৈকে নিজের আরেকটু কাছে টেনে নিলো।উন্মাদের ন্যায় চুমু খেতে লাগলো অথৈকে।অথৈ কিছুক্ষণ থম মেরে ছিলো।পর পর রুদ্রিকের লাগামহীন স্পর্শে নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে পারলো না।পর পর নিজেও সারা দিতে লাগল রুদ্রিকের সাথে।হাজার হোক লোকটা তার স্বামী।কোন স্ত্রীই বা না চাইবে তার স্বামী তাকে ভালোবাসুক,তাকে সোহাগ করুক।অথৈও চায়,খুব করে চায়।এইভাবে কেটে গেলো কতোক্ষণ কেউ জানে না।দুজনে দুজনার মাঝে এতোটাই হারিয়ে গিয়েছিলো।অথৈ যখন দেখলো যে সে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।তখন ছটফট শুরু করে দিলো।রুদ্রিক যেন হুঁশে নেই।অথৈ জোড় করে অনেক কষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে আনে রুদ্রিকের কাছ থেকে।রুদ্রিকের বুকে কপাল ঠেকিয়ে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে মেয়েটা।রুদ্রিকও হাপাচ্ছে।রুদ্রিক নিজেকে শান্ত করতেই ওর ঠোঁটের কোণে চওড়া হাসি ফুঁটে উঠল।অথৈ যে তার হৃদয়ের ঠিক কতোটা জুড়ে আছে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না রুদ্রিক।রুদ্রিকের মন চায় হৃদয়ের সবটা ভালোবাসা উজাড় করে দিতে মেয়েটার কাছে।মেয়েটা যদি তাহলে তার ভালোবাসার গভীরতা অনুভব করতে পারে।এইযে অথৈকে যে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আছে।এতে যে তার কি শান্তি লাগছে। মনে হচ্ছে সে পরিপূর্ণ। আজীবন ওকে এই বুকের মাঝে আগলে রাখতে চায় রুদ্রিক।হারাতে দিবে না কোনোদিন।খুব,খুব ভালোবাসবে।রুদ্রিক অথৈয়ের চুলের ভাঁজে চুমু খেলো।অথৈ তখনও নিজেকে স্বাভাবিক করতে ব্যস্ত।হঠাৎ রুদ্রিকের একটুখানি দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে করল অথৈয়ের সাথে।রুদ্রিক দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে,’ অথৈ আমার ভালোবাসাগুলো মন থেকে অনুভব করেছ তো?নাকি আরও গভীরভাবে ভালোবাসব?’

অথৈ থম মেরে গেলো।লজ্জায় হতভম্ব সে।হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে ওর।লজ্জায় সর্বমুখশ্রী রক্তিম আভায় ছেঁয়ে গেলো।অথৈ রুদ্রিকের বক্ষে আলতো হাতে আঘাত করে মিনমিনিয়ে বলে,’ অসভ্য লোক।খুব,খুব খুব খারাপ আপনি।’

রুদ্রিক উচ্চস্বরে হেসে উঠল।সেই হাসির মায়াজালে আটকে গেলো অথৈ।রুদ্রিককে সচরাচর এমন প্রাণখোলা হাসি হাসতে দেখা যায় না।তাই অথৈ সে হাসিটা মন ভড়ে দেখলো।রুদ্রিক হাসি থামিয়ে অথৈয়ের গালে হাত রেখে ওর চোখে চোখ রাখল।প্রগাঢ় স্বরে বলল,’ তুমি একটুখানি ছোঁয়ার জন্যে,ভালোবাসার জন্যে যদি আমাকে খারাপ হতে হয় অথৈ। তবে আমি হাজারবার খারাপ হতে রাজি।তুমি আমার থাকলেই হবে।’

অথৈ মুচঁকি হাসলো।লোকটার হুটহাট এমন আবেগঘন কথা অথৈয়ের হৃদয় ভীষণভাবে নাড়িয়ে দেয়।অথৈ জড়িয়ে ধরল রুদ্রিককে।ধীম কণ্ঠে আওড়ায়,’ ভালোবাসেন আমায়?’
‘ ভালোবাসা এই শব্দটা অতি সহজ আবার অতি কঠিন।সে এই শব্দটা বুঝতে সক্ষম হয় বুঝে নেবে সেও ভালোবাসে।বুঝলে প্রিয়,
ভালোবাসাটা পিথাগোরাসের উপপাদ্য নয়,
যে প্রমাণ করতেই হবে।
ভালোবাসাটা রবিঠাকুরের শেষের কবিতার মতো,
যা শুধু উপলব্ধি করতে হয়।এখন বলো তুমি কি আমার ভালোবাসা উপলব্ধি করো না?’

অথৈ রুদ্রিকের বুকে মুখ ঘষে নরম গলায় বলে,’ খুব করে অনুভব করে।একদম হৃদয়ের সবটুকু গভীরতা দিয়ে।’

রুদ্রিক অথৈ দুহাতে জড়িয়ে নিলো।চোখজোড়া বন্ধ করে বলে উঠল, ‘ তোমাকে আমি বলে বোঝাতে পারবো না আমি ঠিক তোমাকে কতোটা চাই অথৈ। আমার চোখে তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নারি।তবে তুমি কতটা সুন্দর তা বলার জন্য আমার এই শব্দগুলি যথেষ্ট নয়। লোকে বলে যে মানুষ নাকি কেবল একবার প্রেমে পড়ে, তবে এটি সত্য হতে পারে না … যতবার আমি তোমাকে দেখি, আমি আবার প্রেমে পড়ে যাই নতুন করে।বলো তো কেন এমন হয় আমার সাথে?’

অথৈ কি বলবে তার কাছেও এ এটার জবাব নেই।তাই সে মৌন হয়ে চুপচাপ পরে রইলো রুদ্রিকের বক্ষপিঞ্জরের মধ্যে।

#চলবে___________________

#মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৩৬
দিনটা ভালোই কেটেছিলো অথৈয়ের।আতিক মাহাবুব খুব জলদিই ফিরে এসেছিলেন।সারাটাদিন বেশ আনন্দে কেটেছিলো ওর।এই বাড়িতে একেবারে আসার পরের দিনগুলো যে এইভাবেই আনন্দময় হয় সেই দোয়া করল অথৈ।তবে রুদ্রিক ওকে চুমু খাওয়ার পর থেকে অথৈ ভুলেও আর রুদ্রিকের কাছে যায়নি।লজ্জায় সে দূরে দূরে থেকেছে।চোখ তুলে তাকায়নি অবদি।রুদ্রিক দু তিনবার কথা বলার চেষ্টা করেছিলো।কিন্তু মেয়েটা অতিরিক্ত লজ্জা পাচ্ছে।এই কারনে রুদ্রিক আর ঘাটায়নি অথৈ। সন্ধ্যার একটু আগে অথৈয়ের বাসা থেকে ফোনকল আসায়।রুদ্রিক অথৈকে তাদের বাড়িতে দিয়ে এসেছিলো।অথৈ নিজের লজ্জাকে ক্ষানিকটা সময়ের জন্যে দূরে সরিয়ে।রুদ্রিককে বলেছিলো,’ বাড়িতে আসুন নাহ।মা খুশি হবে।’

রুদ্রিক তখন শীতল গলায় উত্তর দিয়েছিলো,’ গিয়েই কি লাভ?তুমি লজ্জায় আমার দিকে তাকাচ্ছই না।তোমাদের বাড়িতে তো তোমার টিকিটাও আমি খুঁজে পাবো না যেই অবস্থা দেখছি।সামান্য চুমু খেয়েছি।এতেই লজ্জায় একেবারে পারলে মাটি খুরে তার নিচে চলে যাও।বিয়ের পর যে আমি তোমার সাথে আরও কি কি করব।সেগুলো তোমাকে বললেও তুমি লজ্জায় জ্ঞান হারিয়ে না ফেলো।তাই যাও বাসায় যাও।আর যদি আমাকে তোমাদের বাড়িতে এতোই নেওয়ার শখ থাকে।তাহলে স্বামীকে কিভাবে আদর যত্ন করতে জানো তো?সবটা করতে হবে।কি করবে?তাহলে বলো আমি আসছি।’

রুদ্রিকের একেকটা লাগামহীন বাক্য অথৈ বাকরুদ্ধ।এই লোকটা তাকে অনায়াসে এইভাবে এতোগুলো কথা তাকে নির্লজ্জের মতো বলতে পারলো?অবশ্য কাকে নিয়ে কি ভাবছে অথৈ। রুদ্রিক যে কেমন মানুষ তা এই কয়দিনে বেশ ভালোভাবে বুঝে নিয়েছে ও।অথৈ নিজের লজ্জা ঢেকে মিথ্যে রাগ দেখিয়ে বলে উঠে,’ ছিঃ অসভ্য কোথাকার।যান তো আপনি।বাড়ি চলে যান।’

এই বলে অথৈ হনহন করে বাড়ির ভীতরে চলে গেলো।পিছন থেকে শুনতে পেলো রুদ্রিকের প্রাণখোলা হাসি।অথৈ ফিরে গিয়ে আবার দেখতে ইচ্ছে করল রুদ্রিকের হাসিটা।কিন্তু এখন গেলে যে এই লোক তাকে লজ্জার সাগরে ডুবিয়ে মেরে ফেলবে। এই ভয়ে আর গেলো না।সোজা নিজের রুমে চলে গেলো আগে।বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখে রুদ্রিকের গাড়ি এখনও দাঁড়িয়ে তারমানে লোকটা যায়নি।অথৈ রুদ্রিককে মেসেজ করল,’ বাড়ি চলে যান।আর যদি ভদ্র আর সভ্যভাবে আমার সাথে থাকতে পারেন।তবে আমাদের বাড়িতে আসতে পারেন।’

মিনিট দুয়েক পর মেসেজের রিপ্লাই করল রুদ্রিক।
‘ তুমি আমার কাছে থাকবে, আমার পাশে থাকবে।আর আমি আসলে তো আজ তোমার সাথে আমাকে ঘুমোতেও হতে পারে।আম রেয়েলি ভেরি সরি বউ।তোমার সান্নিধ্যে থাকলে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবো না।আর নিজেকে ভদ্র, সভ্য কোনোকালেই ভাবি না।অন্তত তোমার কাছে তো নাই-ই।তাই বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।ভালো থেকো।হ্যাব অ্যা সুইট ড্রিম উইথ মি।’

মেসেজটা পড়ে অথৈ লজ্জাও পেলো।আবার একরাশ ভালোলাগায় হৃদয় জুড়িয়ে গেলো।অথৈ ছোট্ট করে উত্তর দেয়,’ সাবধানে বাড়ি যাবেন। আল্লাহ্ হাফেজ।’

পর পর অথৈ বারান্দা দিয়ে তাকিয়ে দেখে রুদ্রিকের গাড়ি চলে যাচ্ছে। মুঁচকি হাসি ফুটে উঠে অথৈয়ের। ও সত্যিই খুব ভাগ্যবান। রুদ্রিককে ও স্বামী রূপে পেয়েছে।

ক্লাসরুমে বসে বসেই গতকালকের ঘটনা ভেবে মুচঁকি মুচঁকি হাসছিলো অথৈ। ওকে এইভাবে অহেতুক হাসতে দেখে পিহু দু তিনবার ডেকেছে ওকে।নাহ, এই মেয়ের কোনো হেলদোল নেই।পিহু এইবার জোড়ে জোড়ে অথৈয়ের বাহু ঝাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল,’ ওই ওই ওই।কিচ্ছে তোর?কোন দুনিয়ায় আছস?এইযে আমি তোরে ডাকতেছি।শোনস না?’

আকস্মিক পিহু এমন ঝাকানোতে ভয় পেয়ে যায় অথৈ৷ পর পর নিজেকে সামলে নিয়ে রাগি গলায় বলে,’ বান্দর মাইয়া।এমনে ধাক্কায়তাছস কেন?আমি কি বয়রা?কানে শুনি নাহ?’

আবার প্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,’ এতোদিন তোরে বকতাম এই পিহুর সাথে ঝগড়া করার জন্যে।এখন মনে হচ্ছে তুই যা করছ।একদম ঠিক করছ।এই প্রিয়াইন্না?ওর কানের নিচে খিচ্চা একটা থাবড়া মার তো।’

প্রিয়ান দূর থেকে ফ্লাইং কিস ছুড়ে মারল।মানে এটা যে ‘ বান্ধবী এক মাত্র তুই আমার মনের কথা বুঝতে পারছ।’

কিন্তু আবার ভাবলো।যতোই হোক যেমন হোক এই পিহুকেই তা লাগবে।মরবার আগ পর্যন্ত ওর সাথে থাকতে যায়।এমনে না হোক।অন্তত সারাটাদিন ঝগড়াঝাটি করতেও ওকে চাই প্রিয়ানের।ভেবেই প্রিয়ান মুচঁকি হাসলো।
তারপর পিহুর দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হেসে বলে,’ ঘাড়ে আমার কয়টা মাথা?এইডাড়ে চড়াইলে এই ডায়নি আমার মাথা কেটে রক্ত খেয়ে ফেলবে।’

এদিকে দুই পক্ষের এতো এতো অপমানে রাগে ফোসফাস করছে পিহু। নিজের সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে রাগি গলায় বলে,’ আমি কিছু বলতাছি জা দেইখ্যা তোরা আমারে এমনে অপমান করতাছস?এই তোরে কি আমি খারাপ কিছু বলছি?ভালো মতো ডাকতেছিলাম শোনছ নাই।তাই তো এমনে ধাক্কা দিতে হলো।আর এই তুই প্রিয়ান।আমি আগে তোর সাথে লাগতে যাই তাই নাহ?একটু পরই দেখা যাবে কে কাকে আগে ক্ষ্যাপায়।তোর মাথা আমি সত্যি সত্যি দুই টুকরা করে ফেলমু।’

প্রিয়ান শুকনো ঢোক গিলল পিহুর কথায়।বিরবির করে বলে,’ মাইয়া না জানি আগুন।রাগের তোপে যেমন করতেছে মনে হয় এখনই আমারে ড্রাগনের মতো মুখ থাইকা আগুন মাইরা জ্বালায় ফালাইবো।’

ওদের ঝগড়ার মাঝে রিধি ঢুকে পরল।ও বলে,’ এই অথৈ? কিছু কি ভেবেছিস কালকের বিষয়ে?’

অথৈ ভ্রু-কুচকালো রিধির কথায়।পর পর মনে পরে গেলো গতকাল সে সবাই মিলে একটা ট্যুরের দেওয়ার প্লান করেছিলো ও।কিন্তু রুদ্রিকের ভাবনায় ও এতোই বিভোর গয়ে গিয়েছিলো। যে বিষয়টা ওর মাথা থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিলো।কিন্তু সেখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ওর ভাই।অথৈ হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলে,’ কি আর বলব বল?আমি তো কাল ভাইয়ার সাথে রাগ করে আর কথাই বলিনি।’

আহিদ উঠে দাঁড়ালো।পকেটে হাত গুছে বলে,’ তাহলে চল এখনই কথা বলে আসি। ভাইয়ার বন্ধুরা তো সবাই রাজি।’

‘ হুম চল তাহলে। দেখা যাক উজবুকটা কি বলে।এই রিধি এই গাধার কি দেখে ভালোবাসলি রে?’

অথৈয়ের প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় রিধি।পরপর হালকা হেসে বলে,’ ভালোবাসা তো আর বলে কয়ে হয় না রে অথৈ। কখন?কাকে?কিভাবে? ভালোবেসে ফেলি নিজেরাও উপলব্ধি করতে পারি না।কখন মনটা যে অন্যকারো অধিনে চলে যায়।বুঝতে পারিনি।যদি পারতাম তবে এই বেহায়া মনকে সেই কবেই মনের মাঝে বন্দি করে রাখতাম।তাহলে ভালোবেসে যে আমায় সেই ভালোবাসার আগুনে তিলে তিলে জ্বলতে হতো না।এখন আমি এমন একটা পরিস্থিতিতে আছি যে না পারছি সেই আগুন থেকে বের হয়ে আসতে।আবার না পারছি সেই আগুনে এইভাবে জ্বলে পুড়ে খাঁক হয়ে যেতে।তবে তোর ভাই হয়তো একদিন আমাকে এইভাবে পোড়াতে পোড়াতে ছাই করে নিঃশেষ করে দিবে।’

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে হতাশ শ্বাস ফেলল রিধি।চাপা কষ্টে রিধির বুকটা ফেটে যাচ্ছে।একটু কাঁদলে কি সস্তি পেতো?কিন্তু সে তো কান্না করবে না।দূর্বল হবে না আর সে।ইহানের সাথে করে পিকনিকে গিয়েছিলো ওইদিন ওর সাথে যা হয়েছে। এরপর ও ডিসাইড করে নিয়েছে।ভালোবাসার জন্যে পিছু পিছু ছুটবে না ও আর ইহান যদি ওর ভাগ্যে লিখা থাকে।তাহলে ইহান ওরই হবে।আর না হলে তো করার কিছু নেই।আজীবন এই ভালোবাসার দহনে সে প্রতিনিয়ত জ্বলতে থাকবে।পুড়তে থাকবে।যেদিন দেখতে না পারছে না।সেদিন বিলীন হয়ে যাবে।রিধি চোখের কোণে জমা হয়ে অশ্রুবিন্দুটা মুছে নিলো।অথৈয়ের খারাপ লাগছে রিধির জন্যে।ও ভাবতে পারেনি রিধি এতো কষ্ট পাবে।অথৈ মন খারাপ করে বলে,’ আমি সরি রে। আমি তোকে এইভাবে হার্ট করতে চায়নি।’

রিধি নিজের কষ্টটুকু লুকিয়ে ফেলল।না,তার এইভাবে ইমোশনাল হলে হবে না।নিজেকে সামলাতে হবে।রিধি জোড়পূর্বক হেসে বলে,’ আরেহ তুই কেন সরি বলছিস?আমিই একটু বেশি ইমোশনাল হয়ে গিয়েছিলাম।মন খারাপ করিস না তো।চল এখন যাওয়া যাক।’

ওরা সবাই ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে আসল।বাহিরে আসতেই হঠাৎ আহিদের নজর যায়।একা একা করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকা মাইশার দিকে।এই মেয়ে এইভাবে একা একা দাঁড়িয়ে আছে কেন?আর মুখটাও মলিন দেখাচ্ছে।তবে লাল হয়ে আছে চেহারা,চোখ দুটো যেন নিষ্প্রাণ।মেয়েটা কি অসুস্থ?কিছু কি হয়েছে ওর? আহিদ কি একবার গিয়ে জিজ্ঞেস করবে?কিন্তু কিভাবে যাবে?এখানে বন্ধুরা আছে।না, যতোই হোক মেয়েটার কাছে যেতে হবে।মেয়েটার ওই মলিন মুখশ্রী দেখে মুখের বা-পাশটায় চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে।আহিদ বন্ধুদের উদ্দেশ্যে আমতা আমতা করে বলে,’ ইয়ে মানে।তোরা যা ইহান ভাইয়ার সাথে কথা বলার জন্যে।আমি একটু আসছি।’

রিধি ভ্রু-কুচকে বলে,’ কোথায় যাবি তুই আবার?’
‘ একটু কাজ আছে জরুরি।তোরা যা না।’

অথৈ বলে উঠে,’ আচ্ছা তুই যা তোর কাজে। সমস্যা নেই।আমর ম্যানেজ করে নিবো।’

আহিদ চওড়া হাসে।তারপর নিজ গন্তব্যে চলে যায়।ও যেতেই অথৈ সন্দিহান গলায় বলে,’ ওই আহিদ্দার মাঝে কোনো ঘাপলা আছে। আজকাল ওর মতিগতি অন্যরকম ঠেকছে।’

‘ কিন্তু কি?’ প্রশ্ন করল প্রিয়ান।
অথৈ চোখ ছোটো ছোটো করে বলে,’ সেটাই তো আমাদের জানতে হবে।ও এমন হুটহাট গায়েব হয়ে যায়টা কোথায়? প্রিয়ান পাতা লাগাও, পাতা লাগাও।’

অথৈয়ের এই কথায় পিহু মাথা চুলকে বলে,’ শুনেছি গাছ লাগায়। কিন্তু এই পাতা লাগাবে কিভাবে?এই প্রিয়ান তুই পাতা লাগাতে জানিস?’

রিধি ফিঁক করে হেসে ফেলল।অথৈ দাঁতে দাঁত চিপে বলে,’ তুই ইচ্ছে করে এসব বলিস তাই নাহ?’

পিহু সবকটা দাঁত কপাটি দেখিয়ে হেসে দিলো।অথৈ সহ এইবার বাকিরাও হেসে দিলো।আসলেই বন্ধু মানে তোমার লাইফটা একেবারে সেরা।বন্ধুরা একসাথে থাকলে যেন দুঃখরা কাছেই ঘেষতে পারে না।চারদিকে শুধু হাসির কলরব প্রতিধ্বনিত হতে শোনা যায়।কি যে শান্তি এতে।তাই বন্ধুদের সবসময় আগলে রাখতে হয়।বন্ধুত্বের সম্পর্ক দৃঢ় করতে।তাহলেই না হবে অটুট বন্ধুত্বের বন্ধন।

#চলবে___________

#মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৩৭
মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাইশা।ওর শরীরটা ভালো নেই।দুদিন যাবত জ্বর,ঠান্ডায় ভুগছে।গতকাল ভার্সিটিতে আসেনি।কিন্তু আজ না এসেও উপায় নেই।ইম্পোর্ট্যান্ট ক্লাস আছে আজ।সেটা একদমই মিস দেওয়া যাচ্ছিলো না।তাই তো কোনোরকম শরীরটাকে টেনেটুনে ভার্সিটিতে এসেছিলো।কিন্তু এখন যে আর শরীর একদমই চলছে না।জ্বরটা বোধহয় আবার আসবে।ঘরে প্যারাসিটামল ছিলো সকালে সেটা খেয়ে এসেছিলো তাইতো কষ্ট হলেও ভার্সিটি আসতে পেরেছিলো।কিন্তু এখন যাবে কিভাবে?মাথাটা ভাড় হয়ে আছে।দুপায়ে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও পাচ্ছে না।তাই পাশে একটা পিলার ছিলো সেটার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো।কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পরেই হঠাৎ একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর কর্ণে এসে প্রবেশ করতেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায় মাইশা।ওর সামনে আহিদ চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে।মাইশা আহিদকে দেখে কষ্ট হলেও সোজা হয়ে দাঁড়ালো।জড়ানো কণ্ঠে বলে উঠল,’ আরেহ আপনি?আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।ভালো আছেন?’

আহিদ সালামের জবাব নিয়ে বলে,’ আমি কেমন আছি আপাততো এটা বাদ দেও।বাট তুমি যে ভালো নেই। সেটা বোঝাই যাচ্ছে।’

আহিদের কথায় মাইশা অবাক হলো।একমাত্র আহিদই ওর এই অসুস্থতা সে মুখে বলার আগেই বুঝে ফেলল অনায়াসে।অথচ ওর ক্লোসফ্রেন্ডটাও ওকে বুঝল না।একবার জিজ্ঞেসও করল না ‘ মাইশা তোর কি হয়েছে?এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে?’ অথচ লোকটা ওর কিছু না। শুধু হাতেগোমা কয়েকবার দেখা হয়েছে আর একটু আধটু কথা হয়েছে।সে ওকে দেখেই ও অসুস্থ সেটা বুঝে ফেলল।মাইশা মলিন হেসে বলে,’ ওই গতকাল থেকে একটু জ্বর আর ঠান্ডা লেগেছে।’

আহিদ ভ্রু-কুচকে তাকালো।জ্বর এসেছে।অথচ মেয়েটা এই জ্বর শরীর নিয়েই ভার্সিটিতে এসেছে।কেন এসেছে?কি এমন দরকার যে এতো অসুস্থ শরীর নিয়েও এখানে আসা লাগবে।আহিদের রাগ লাগলো। ও ধমকে উঠে,’ জ্বর এসেছে বাড়িতে বিশ্রাম করবে।এখানে কি?কেন এসেছ?দাঁড়াতেও তো পারছ না ঠিকঠাক।কি এমন জরুরিতলব পরেছে যে তুমি আজ ভার্সিটি আসলে?’

আহিদের হঠাৎ ধমকে মাইশা চমকে গেলো। ওর মা ছাড়া ওকে এইভাবে আর কেউ কখনও শাষন করেনি।মায়ের কথা বলতেই তাকে মাইশার ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করল।কতোদিন হয়ে গেছে মায়ের মুখটা সে দেখেনা।কিন্তু কি আর করার মায়ের কাছে তো চাইলেও আর সে যেতে পারবে না।সে যে আর এই পৃথিবীতে নেই।মাইশার বিষন্নতা ভড়পুর মুখশ্রী দেখে আহিদ দমে গেলো।একটু বেশিই করে ফেললো কি ও?এইভাবে ধমক দেওয়াটা বোধহয় ভালো হয়নি।কি অধিকারে সে ধমকাবে মাইশাকে।এমন কোনো সম্পর্ক তো ওদের মাঝে নেই।আহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,’ সরি একটু অভার রিয়েক্ট করে ফেলেছি।’

আহিদের সরি বলার ব্যাপারটা মাইশার ভালো লাগলো না।তার কেনো জানি আহিদের এই অল্প একটু শাষন করা অনেক ভালো লেগেছে।যেটাকে মাইশা বলে মিষ্টি শাষন।মাইশা দুপাশে মাথা দুলিয়ে বলে,’ আরেহ না।সরি বলছেন কেন?ইটস ওকে।আপনি আমার জন্যে চিন্তা করছেন।তার জন্যেই ওমন কথা বলেছেন।আমি কিছু মনে করিনি।’

এইটুকু কথা বলেই যেন মাইশা হাপিয়ে উঠেছে।তার আর কথা বলতে ভালো লাগছে না।গলাটাও ব্যথা করছে।মাইশা খুকখুক করে কেশে উঠল।মাইশার এহেন অসুস্থতায় আহিদ অস্থির হয়ে যাচ্ছে।কি করবে মেয়েটার জন্যে?ওর তো মাইশার জন্যে কিছু অধিকার নেই।কিছু করতে গেলেও যদি মেয়েটা উল্টাপাল্টা ভেবে বসে।মাইশা আবার চোখ বন্ধ করে পিলারের গা ঘেষে দাঁড়ালো।আহিদের চিন্তা আরও বেড়ে গেলো।মেয়েটার এমন অবস্থা দেখে ওর বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে।এভাবে দেখতে পারছে না ও মাইশাকে।আহিদ হঠাৎ মাইশার কপালে আলতো হাতে স্পর্শ করল।আচমকা কারো স্পর্শে মাইশা কেঁপে উঠে।মনের মাঝে আলাদা শিহরণ বয়ে গেলো।চমকে চোখ খুলে মাইশা তাকিয়ে দেখে আহিদ ওর কপালে স্পর্শ করেছে।এতে যেন মাইশার হৃৎস্পন্দনের গতি কয়েকশগুন বেড়ে গেলো।ধরাস ধরাস করছে বুকটা।এই প্রথম কোনো পুরুষ ওর এতোটা কাছে এসেছে।মাইশা কাঁপা গলায় বলে,’ ক..কি করছেন?’

আহিদ মাইশার কপাল থেকে হাত সরিয়ে নিলো।পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে বলে,’ অনেক জ্বর তোমার গায়ে।১০০ ডিগ্রির উপরে তো হবেই।দাঁড়ানোর শক্তিও পাচ্ছো না।বাড়ি যাবে কিভাবে ভেবেছ?’

মাইশা এখনও ঘোরের মাঝে আছে।আহিদের ওই একটুখানি স্পর্শে মনের মধ্যে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে।মাইশার কোনো রেস্পন্স না পেয়ে আহিদ আবারও বলে,’ মাইশা?তুমি শুনছ আমার কথা?বলছি বাড়ি যাবে কিভাবে?’

একটু জোড়েই বলল আহিদ।এতে ধ্যাণভঙ্গ হয়ে যায় মাইশার।ও ইতস্ততভাবে বলল,’ আই উইল ম্যানেস।আপনি চিন্তা করবেন নাহ।’

আহিদ কিছু বলার জন্যে উশখুশ করছে।কিন্তু কথাটা কিভাবে বলবে ভেবে পাচ্ছে না।ও শুধু এদিক সেদিক তাকাচ্ছে।কিন্তু অবশেষে মনের কাছে হার মেনে বলেই ফেলল,’ মাইশা শোনো?’
‘ জি বলুন?’
‘ তুমি যদি কিছু মনে না করো।তাহলে কি আমি তোমাকে তোমার বাসায় পৌছে দিতে পারি?’

মাইশা অবাক হয়ে তাকালো।আহিদ এতে অপ্রস্তুত হয়ে পরল।
‘ আমি জাস্ট বললাম।বাট তোমার প্রব….’

আহিদের কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে মাইশা নম্র কণ্ঠে বলে,’ হুম যাবো আমি আপনার সাথে।’

মাইশা আহিদের সাথে যেতে রাজি হয়ে গেলো।উপায় নেই না গিয়ে?তার গায়ে আর শক্তি নেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রিকশার জন্যে অপেক্ষা করা।বা গলা উচিঁয়ে রিকশা ডাকা।তাছাড়া রিকশা পেলেও সেটা রিস্কি হয়ে যাবে।একা একা রিকশায় বসবে।যেই হারে মাথা ঘুরাচ্ছে।রিকশা থেকে পরেও যেতে পারে।তখন আরও বিরাট সমস্যায় পরতে হবে ওকে।আর আহিদ লোকটা খারাপ না।সেদিন ওকে কিভাবে হ্যাল্প করল।বিশ্বাস করা যায় লোকটাকে।মাইশা টলতে টলতে করিডোর থেকে নামতে যেতেই নিজের ভারসাম্য হারিয়ে পরে যেতে নিলো।কিন্তু তার আগেই ওকে সামলে নিলো আহিদ।মাইশার উদরে আড়াআড়িভাবে হাত রেখে ওকে সামলে নিয়েছে পরা থেকে।মাইশার যেন নিশ্বাস আটকে গেলো আহিদের ছোঁয়ায়।কাঁপতে লাগল শরীর।দ্রুত আহিদের কাছ থেকে সরে দাঁড়ালো।আহিদ চিন্তিত কণ্ঠে বলে,’ আর ইউ ওকে?’

মাইশা ছোট্টো কণ্ঠে বলে, ‘ হুম ঠিক আছি।’

আহিদ বলল,’ যদি কিছু মনে না করো।তবে বলছি।তুমি আমার হাত ধরে হাটতে পারো।যেভাবে টলছ তুমি।পরে গিয়ে ব্যথা পাবে।’

মাইশা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকালো আহিদের দিকে।তারপর আবার তাকালো নিজের হাতের দিকে।আহিদের হাত ধরবে ও?ভাবতেই বুক কাঁপছে মাইশার।এদিকে মাইশার থেকে কোনো জবাব না পেয়ে হতাশ হলো আহিদ।কিন্তু তার হতাশা দূর করে মাইশা ওকে অবাক করে দিয়ে নিজের হাত বাড়িয়ে দিলো।আহিদ যেন না চাইতেও আকাশের চাঁদ পেয়ে বসেছে এমন মনে হচ্ছে ওর।খুশিতে কি করবে বুঝতে পারছে না।মাইশা যে ওকে এতোটা বিশ্বাস করে নিজের হাত ধরার অনুমতি দিবে ভাবতেই পারেনি।আহিদ কম্পনরত বুক নিয়েই মাইশার নরম তুলতুলে হাতটা ওর হাতের ভাঁজে নিয়ে নিলো।আবেশে মনপ্রাণ ভরে গেলো।আহিদ বিরবির করল,’ এইযে বিশ্বাস করে একটুখানি সময়ের জন্যে নিজেরটা হাতটা ধরাতে দিলে।ইনশাআল্লাহ খুব শীঘ্রই গোটা এই তুমিটাকে আমি এই হাতের মতোই খুব যত্নে আগলে রাখব।তুমি শুধু বিশ্বাস আর ভড়সা করো আমায়।’

মাইশা বুঝতে পারল না আহিদের কথা।তাই প্রশ্ন করল,’ কি বলছেন?শুনতে পায়নি আমি।’

আহিদ জোড়পূর্বক হেসে বলে,’ না কিছু না। ওই আসলে বলছিলাম রিকশায় যাবে না-কি সিএনজিতে?’

মাইশা ভাবলো।আহিদের সাথে এক রিকশায় যাবে বিষয়টা ভীষণ অসস্থিকর লাগবে ওর কাছে।সিএনজিতেই ভালো হবে।সিএনজিতে দুজন মানুষ বসেও অনেকখানি জায়গা ফাঁকা থাকবে।তাই মাইশা বলল,’ সিএনজিই ভালো হবে।’

আহিদ জানতো মাইশা সিএনজির কথাই বলবে।কারন রিকশায় দুজন একসাথে বসল গা ঘেষাঘেষি করে বসতে হবে।আর মাইশা সেভাবে আহিদের সাথে যাবে না।আহিদ আর কোনো কিছু বলল না। মাইশার হাত আগলে নিয়ে সাবধানে হেটে ভার্সিটির বাহিরে আসলো।তারপর একটা সিএনজি ডেকে মাইশাকে আগে বসিয়ে ও নিজে উঠে বসল।যেতে যেতে প্রিয়ানের ফোনে মেসেজ করে দিলো।
‘ প্রিয়ান বাসায় জরুরিতলব পরেছে আমার।বাবা ডেকেছেন। তাই আমি চলে যাচ্ছি।তোরা কি প্লানিং করলি তা রাতে ফোনে কথা বলে জেনে নিবো।’

মাইশার বাসার সামনে সিএনজি থামতেই আহিদ মাইশাকে নামতে সাহায্য করল।মাইশা সৌজন্যমূলক হেসে বলে,’ ধন্যবাদ ভাইয়া।অনেক সাহায্য করলেন আমায়। এই উপকার আমি কোনোদিন ভুলব নাহ।যদি কখনও আপনার কোনো কাজে হ্যাল্প করতে পারি এমন মনে হলে নির্দ্বিধায় আমায় বলবেন।’

আহিদ মুচঁকি হেসে বলে,’ ইটস ওকে।এটা আমার দায়িত্ব’র মধ্যে পরে।একটা অসুস্থ মানুষকে সাহায্য করেছি।মানুষ হয়ে মানুষকে সাহায্য করব এটাই স্বাভাবিক।’

‘ ধন্যবাদ ভাইয়া।এখন আসি তাহলে?’

আহিদ আমতা আমতা করে বলে,’ একা একা যেতে পারবে?নিজের ফ্লাটে।’
‘ হ্যা আমি আমার রুমমেটকে মেসেজ করেছি।আমায় যেনো একটু এসে বাসায় নিয়ে যায়।’

আহিদ যেন সস্থি পেলো।ওর মন চাইলো মাইশা বাসায় না পৌঁছানো পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতে।কিন্তু বিষয়টা দৃষ্টিকটু দেখায়।মাইশা বলল ওর রুমমেট আসবে ওকে এগিয়ে নিতে।যদি এসে দেখে মাইশার সাথে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।তাহলে বিষয়টা অন্যভাবে নিতে পারে।খারাপ ভাববে মাইশাকে।তাই আহিদ চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলো।আহিদ বলল,’ তবে আসি?নিজের খেয়াল রেখো।আর মেডিসিন নিও ঠিকঠাক।’
‘ আচ্ছা।আল্লাহ্ হাফেজ।’

আহিদ সিএনজিতে উঠে বসল।চোখের পলকেই আহিদ চলে গেলো মাইশার সামনে দিয়ে।মাইশা সেদিকে একধ্যানে তাকিয়ে রইলো।ওর কেমন যেন লাগছে।অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে।যেই অনুভুতির নাম কি সে নিজেও জানে না।এর মধ্যে মাইশার রুমমেট এসে পরেছে।এসেই জিজ্ঞেস করে,’ কি হয়েছে মাইশা?শরীর বেশি খারাপ লাগছে?আমি বলেছিলাম আজ ভার্সিটিতে যেও না।’

মাইশা মৃদ্যু হেসে বলে,’ আমি ঠিক আছি আপু।আমার একফ্রেন্ড আমায় বাসায় নামিয়ে দিয়ে গেলো।তুমি একটুখানি হেল্প করো আমায় রুমে যেতে।’
‘ আচ্ছা চলো।’

অতঃপর মাইশা তার রুমমেটের সাহায্যে নিজের ফ্লাটে চলে গেলো।
————
এদিকে প্রিয়ান ভ্রু-কুচকে তাকিয়ে আছে মোবাইলের দিকে।ওকে এমন দেখে পিহু বলে উঠে,’ কিরে?তোর আবার কি হলো?এমন করে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছিস কেন?’

প্রিয়ান মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে নিলো।বলল,’ আহিদ মেসেজ করেছে ও নাকি বাসায় চলে গিয়েছে।আংকেল নাকি জরুরি কাজে ওকে ডেকেছে।’

অথৈ বলল,’ হ্যা,যেতেই পারে এখানে এইভাবে রিয়েক্ট করার কি আছে?’

প্রিয়ান মুখ দিয়ে ‘চ’ শব্দ করে বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,’ আরেহ এতে আমার কি সমস্যা হবে?সমস্যা তো অন্যকিছু।’

পিহু ভাবুক গলায় বলল,’ আব্বু আহিদকে জরুরি কাজে ডেকেছে।কিন্তু আব্বু তো বাড়িতে নেই।সে এখন ইন্ডিয়াতে আছে কাজের সূত্রে।গতকালকেই তো গেলো।’

রিধি পিহুর মুখে এমন কথা শুনে অবাক হয়ে বলে,’ আংকেল আউট ওফ কান্ট্রি থাকলে ও তাহলে মিথ্যে বলল কেন আমাদের কাছে?’

প্রিয়ান শান্ত কণ্ঠে বলে,’ আমার কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে।’

অথৈ প্রশ্ন করল,’ কি সন্দেহ হচ্ছে?’
‘ এই আহিদ আমাদের পিঠপিছে কোনো মেয়ের সাথে প্রেম করছে।’

সবার চোখ কপালে উঠে গেলো।কেউ যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।রিধি চেচিঁয়ে উঠল,’ অসম্ভব! এ হতে পারে না।এমন হলে আহিদ আমাদের আগে জানাতো।’
‘ এক্সেক্টলি আমারও বিলিভ হচ্ছিলো না।বাট আমি নিজ চোখে দেখেছি।’

পিহু বলল,’ কি দেখেছিস?’
‘ একটু আগে আহিদ একটা মেয়ের হাত ধরে ভার্সিটি থেকে বারিয়ে গিয়েছে।’

আহিদের এহেন কথায় যেন আরও চমকে গেলো তারা।সবাই একসাথে চেচাঁলো,’ কিহহহহহ?’

প্রিয়ান সাথে সাথে কানে হাত দিলো।নাক মুখ কুচকে বলে,’ বেত্তমিজের দল।আস্তে চিল্লা।অকালে আমাকে বয়রা করার মিশনে নেমেছিস না কি তোরা?’

ওদের যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না আহিদ এমন কিছু করবে।তাও আবার ওদের না জানিয়ে।মানে আহিদ ভালোবাসতে পারে কাউকে।কিন্তু ওদেরকে না জানিয়ে কোনো রিলেশনে যাবে না আহিদ।এইটুকু ওরা জানতো।কিন্তু প্রিয়ান যা বলছে তাও ফেলে দেবার মতো কথা নয়।প্রিয়ান তো আর মিথ্যে বলবে না।হচ্ছে টা কি ওদের সাথে?পিহু দাঁত দিয়ে নখ কাটছে ভয়ে।ওকে এমন অস্থির আচরণ করতে দেখে প্রিয়ান ধমকে উঠল,’ এমন প্রতিবন্ধিদের মতো করছিস কেন?আর খচ্চরের মতো দাঁত দিয়ে নখ কাটছিস কেন?’

পিহু আহিদের কথায় ক্ষ্যাপে গিয়ে বলে,’ দেখ মাথা খারাপ করিস না।এমনিতেই টেন্সন লাগছে।’

রিধি বলে,’ কিসের টেন্সন?’

পিহু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,’ আহিদ্দা যে প্রেম করতেছে।এইটা বাবা জানলে ওকে তো গুলি করে মারবেই সাথে আমাকেও মারবে।বলবে,
তোর ভাই প্রেম করে বেড়াচ্ছে।তুই কোথায় ছিলি?এসব দেখিসনি?দেখেও আমাকে কেনো জানাসনি?তোদের দুটোকেই আজ গুলি করে দিবো।
এখন আমার কি হবে দোস্ত?ভয়ে এখনই আমি বেহুশ হয়ে যাবো মনে হচ্ছে।’

পিহুর কথায় প্রিয়ানের গলা শুকিয়ে আসলো।ও নিজেও তো পিহুকে পছন্দ করে।পছন্দ করে বললে ভুল হবে।ভালোবাসে ও পিহুকে।এতোদিনে বেশ বুঝতে পেরেছে সেটা।তবে কি এই কথা পিহুর আব্বু শুনলে ওকেও গুলি করে দিবে? নাহ নাহ প্রিয়ান এসব কি ভাবছে।ভয় পেলে চলবে না।ভালোবাসলে মনে কোনো ভয় রাখতে নেই।ভয়কে জয় করতে হবে।আহিদ বিরবির করল,’ শশুড়আব্বাকে তো পরে দেখে নিবো।আগে তার মেয়েকেই ঠিকঠাক পটিয়ে নেই।’

পিহু প্রিয়ানকে বিরবির করতে দেখে বলে,’ কিছু বলছিস?’
‘ হ্যা না কিছু না।’

অথৈ নিজেকে শান্ত করল।স্বাভাবিকস্বরে বলে,’ আপাততো এই টপিক বাদ দে।আমরা আহিদকে কিছুদিন সময় দেই।আমার মনে হয় ও কোনো কারন বশতই আমাদের কাছ থেকে বিষয়টা লুকিয়েছে।তাই ওকে আমরা না ঘাটাই।দেখি কয়েকদিন অপেক্ষা করে যে ও নিজ থেকেই আমাদের কাছে এসে এই ব্যাপারে বলে কি না।যদি দেখিস অনেকদিন হয়ে যাওয়ার পরেও আহিদ কিছু বলছে না।তাহলে আমরা সবাই কি আহিদকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করব ঠিক আছে?আপাততো ট্যুরের বিষয়ে ভাব।ভাইয়া তো রাজি হয়ে গিয়েছে।বাকিদেরও কোনো সমস্যা নেই।আমরা সবাই একসাথে ট্যুরে যাবো।ভাবলেই আমার মনের মাঝে অনেক উত্তেজনা কাজ করছে!’

রিধি দুষ্টু হেসে বলে,’ কি ব্যাপার রিধি আগে তো আমরা একসাথে ট্যুরে গেলে তুই এতোটা খুশি হতিস না।এখন তোকে যেতোটা খুশি দেখাচ্ছে।’

অথৈ আনন্দিত গলায় বলে,’ আরেহ আগে তো মাত্র আমরা পাঁচজন যেতাম।এখন দেখ কতোগুলো মানুষ।যতো বেশি মানুষ একসাথে যাবো ততোই হইহুল্লোড়,আর মজা বেশি হবে।’

পিহু ভ্রু নাচিয়ে বলে,’ হুম হুম! আমরা জানি তো কেনো তুই এতো খুশি।রুদ্রিক ভাইয়ার সাথে ঘুরতে যাবি।একা একা কতো সময় কাটাবি।স্পেশাল মোমেন্ট ইউ নো নাহ?’

রিধির এহেন কথায় অথৈ থতমত খেয়ে যায়।পরক্ষণে কিছু একটা ভাবতেই লজ্জায় ওর গাল দুটো লাল হয়ে যায়।
প্রিয়ান হেসে ওকে দেখিয়ে বলে,’ আরেহ দেখ দেখ।আমাদের অথৈ কিভাবে ব্লাশ করছে রুদ্রিক ভাইয়ের কথা বলতেই।’

অথৈ লজ্জামিশ্রিত হেসে বলে,’ যাহ,কি শুরু করলি তোরা?আমি কি তার সাথে একান্তে হানিমুনে যাচ্ছি না-কি?এমনভাবে বলছিস।’

‘ হুম, হুম,।বুঝি,বুঝি।’

ওরা সবাই নানানভাবে অথৈকে ক্ষ্যাপাতে লাগল।তবে অথৈ আসলেই অনেক বেশি খুশি।ও আর রুদ্রিক ঘুরতে যাবে।সেখানে গেলে একান্তে কিছু সময় কাটাবে।কিছু মিষ্টি মধুর স্মৃতি নিয়ে ফিরে আসবে তারা।এসব ভাবতেই অথৈ আরেকদফা লজ্জা পেলো।হ্যা,ওরা গিয়ে আবার রুদ্রিক আর ইহানের সাথে কথা বলেছে।ইহান এইবার বোনের এককথাতেই রাজি হয়ে গিয়েছে।আর দ্বিমত করেনি।কারন গতকাল থেকেই অথৈ ইহানের সাথে কথা বলছিলো না।এখন যদি আবার দ্বিমত করে তবে দেখা যাবে রেগে ওর দিকে তাকানও বন্ধ করে দিবে।তাই একবাক্যেই রাজি হয়ে যায়।ইহান রাজি মানে বাকিদেরও সমস্যা নেই।সবাই ঘুরতে যাবার জায়গাও নির্ধারণ করে ফেলল।তারা যাবে ভারতের মেঘালয়ে।অথৈয়ের অনেকদিনের স্বপ্ন সে মেঘালয় যাবে।মূলত সাজেক যাবার পর থেকেই তার মেঘালয় যাবার ইচ্ছেপোষণ হয় মনে।আর এখন তা অতিদ্রুত বাস্তবায়ন হবে।সবারই পাসপোর্ট আছে তাই সমস্যা হবে না।রুদ্রিক, ইহান,সাফাত,নীল আর অনিক বলেছে আরও অনেক কাজ আছে মেঘালয় যাওয়ার আগে।সেগুলোর দায়িত্ব তারা নিবে।বেশি না এইতো আর চার-পাঁচদিন পরেই ওরা রওনা হবে।মেঘালয় যাওয়ার সিদ্ধান্তে সবাই বেশ খুশি।কারন বাংলাদেশের প্রায় অনেক জায়গায় তাদের ঘুরাঘুরি শেষ।এবার নাহয় দেশের বাহিরে যাওয়া যাক।অথৈ আরও বলেছে তারা ট্রেনে করে যাবে।মানে ঢাকা থেকে আগে সিলেটে তো যেতে হবে।তাই তারা ট্রেন জার্ণি করেই যাবে।সবাই একসাথে আনন্দ করতে করতে যাবে।ভাবতেই কেমন যেন অতি অতি সুখ সুখ লাগছে অথৈয়ের।

#চলবে_________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।