মন নিয়ে কাছাকাছি পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0
575

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
Jerin Afrin Nipa
৩১

মীরার এরকম কাজে তার বাড়ির সকলে হতভম্ব। ইভার বাবা মা হাসলেও তারা হাসতে পারছে না। কারণ মেয়েটা করেছেই একটা গাধামি কাজ। হাসি আসবে কীভাবে? ইভানের মা এই মেয়ের নির্বুদ্ধিতা দেখে বাকরুদ্ধ। ভুলবশত মেহেদি লেগেছে ঠিক আছে। তুই আবার কোন আক্কেলে তা মুছতে যাস? তিনি চাপা গলায় মীরাকে ধমক দিয়ে বললেন,

“ছেলেটার শার্ট নষ্ট করে দিলি।”

বড়মার দিকে তাকিয়ে মীরার গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে,

“আমি কি ইচ্ছে করে করেছি? উনি দেখেছিলেন না আমি পড়ে যাচ্ছি। উনি কেন সামনে থেকে সরে গেলেন না।”

কিন্তু মীরা এই কথাটা বলতে পারলো না। দোষ এখন সবাই তাকেই দিবে। মাহার খেলনা কে নিচে ফেলে রেখেছে এটা দেখবে না। খেলনা পড়ে না থাকলে সে-ও স্লিপ খেত না। দোষ কার কাঁধে চাপানো যাবে মীরা এটা নিয়ে মোটেও ভাবছে না। তার আসল ভাবনা জায়িন ভাই তাকে খেয়ে ফেলবে। মীরা জায়িনের দিকে তাকিয়ে প্রায় কেঁদে ফেলের মতো করে বলল,

“সরি জায়িন ভাই। ইচ্ছে করে করিনি। আপনার শার্ট নষ্ট হয়ে…আপনি শার্ট খুলে দিন আমি ধুয়ে..’

কী বলছে সে এসব? জায়িন ভাইকে শার্ট খুলতে বলছে! মাথাটা পুরো গেছে।

“আমি আপনাকে নতুন শার্ট কিনে…’

“ওয়াশরুমটা কোনদিকে নিয়ে চলো।”

জায়িনের এমন নির্লিপ্ত ভাব দেখে মীরা যথেষ্টই অবাক হলো। জায়িন ভাই তাকে কিছু বলবে না? একটুও বকবে না? অন্তত দু’একটা বকা দেওয়াই উচিত। সে কাজটাই ওরকম করেছে। বড়মা দাঁত চেপে চোখ ইশারা করে জায়িনকে নিয়ে যেতে বলল। মীরার হুঁশ হয়েছে। সে তাড়াতাড়ি করে বলে উঠল,

“আসুন আসুন। আমি ওয়াশরুম দেখিয়ে দিচ্ছি।”

ওয়াশরুমে জায়িন শার্ট পরিষ্কার করলেও মীরা বাইরে দাঁড়িয়ে বকবক করে যাচ্ছে,

“আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি জায়িন ভাই। আপনি কি রাগ করেছেন?”

জায়িন ভেতরে আয়নায় নিজেকে দেখে হাসলো। মীরা একা একাই বলে যাচ্ছে,

“মেহেদির দাগ মনে হয় উঠে যাবে। আর না উঠলেও শার্টটা যদি আপনার খুব প্রিয় হয় তাহলে আপনি আমাকে বকতে পারেন। আমি কিছু মনে করব না।”

জায়িন ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে। মীরা জায়িনকে দেখে চুপ করে গেল। জায়িন সরু চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে কিছুটা ঝুঁকে এসে বলল,

“কিছু ক্ষেত্রে এক প্রিয় জিনিস, আরেক প্রিয় জিনিসের থেকেও বেশি প্রিয় হয়ে যায়।”

মীরা হাঁ করে জায়িনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বুঝতে পারল না কিছুই। জায়িন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল,

“বুঝলে কিছু?”

মীরা দু’পাশে মাথা নেড়ে না জানাল। জায়িন হেসে বলল,

“সময় হলে বুঝবে।”

মীরা যন্ত্রের মতো প্রশ্ন করলো,

“কী বুঝবো?”

“এইযে তুমি আমার পছন্দের শার্ট নষ্ট করে দিলে। এর পরিবর্তে আমি তোমার থেকে কিছু নেব না? কী নিব সেটাই সময় হলে বুঝবে।”

🌸

বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়ই আকাশে মেঘ করেছিল। কয়দিন ধরেই এমন হচ্ছে। আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গিয়ে চারিদিক অন্ধকার করেও বৃষ্টি হয় না। কতক্ষণ উল্টাপাল্টা বাতাস বয়ে সব ঠান্ডা। মীরা আজও তেমনই ভেবেছিল। বৃষ্টি তো হবেই না। শুধু শুধু প্রাইভেট মিস দিয়ে কাজ নেই। তাই ছোট চাচীর বারণ স্বত্বেও ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে পড়ল। প্রচুর বাতাস বইয়ে। গাছের ডালপালা নুইয়ে যাচ্ছে। মেঘাচ্ছন্ন এমন দিনে মীরার ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগে না। বৃষ্টিতে ভেজার আশা নিয়ে কবে থেকে বসে আছে। কিন্তু বৃষ্টি হওয়ারই খবর নেই। রাস্তায় মানুষজন ছোটাছুটি করে নিজেদের গন্তব্যে পৌঁছুচ্ছে। মীরা ব্যাগ বুকের সাথে চেপে ধরে দৌড় লাগাল। বাতাসের সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করছে এমন একটা ভাব। মুবিন ভাইদের বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ঝিরিঝিরি ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে লাগল। মীরা খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠল। দাঁড়িয়ে পড়ে দু’হাত মেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে এবছরের প্রথম বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে মাখল। প্রাইভেট থেকে ফেরার সময়ও বৃষ্টি থাকলে ভিজে বাসায় ফিরবে। এটা ভেবেই দৌড়ে গেটের ভেতর ঢুকে পড়ল। এটুকু জায়গা আসতে আসতেই মোটামুটি ভিজে গেল। জাম কালারের জামায় যেখানে যেখানে বৃষ্টির ফোঁটা পড়েছে সেটুকু কালো রঙ হয়ে গেছে। মাথার চুলও হালকা ভেজা। মীরা হাত দিয়ে চুল থেকে পানি ঝাড়তে ঝাড়তে কলিংবেল চাপছে। একবার, দু’বার, তিনবার। তারপরও কেউ দরজা না খুললে বিরক্ত হয়ে কলিংবেলের সুইচে চাপ দিয়ে ধরে রাখল। মীরা নিচু হয়ে পায়জামার নিচের দিকটা দেখছিল। ময়লা লেগে গেছে। তখনই দরজা খুলে গেল। কে দরজা খুলেছে এটা না দেখেই মীরা বলল,

“উফ, এত দেরি হলো কেন আন্টি?”

আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু চোখ তুলে সামনের দিকে তাকিয়ে তার সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল। আন্টি না। জায়িন ভাই দরজা খুলেছে। মীরা অপ্রস্তুত হাসল। ইনি কবে এসেছে? সেদিন শার্ট নষ্ট করার ঘটনাই তো এখনও পুরোপুরি ভুলেনি।
জায়িন ভাবলেশহীন মুখে দরজায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মীরাকে দেখে তার চেহারায় কোন ভাবান্তর হলো না। বরং এভাবে কলিংবেল চাপায় একটু বিরক্ত হয়েছে বলে মনে হলো। মীরা জায়িনের হাতের নিচ দিয়ে উঁকি দিয়ে ভেতরের দিকে দেখল। মনে মনে ভাবল, ইনি এভাবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে আমি ভেতরে যাব কীভাবে?
জায়িন দরজার সামনে থেকে সরছে না দেখে গলা পরিষ্কার করে মীরাই হালকা স্বরে বলল,

“একটু সরুন জায়িন ভাই। আমি ভেতরে যাব।”

জায়িন সরে দাঁড়ালে মীরা ভেতরে চলে এলো। রান্নাঘর, মুবিন ভাইয়ের ঘরের দিকে উঁকি দিয়ে আন্টি মুবিন ভাইকে খুঁজছে। মীরা উঁকি ঝুকি চালিয়ে যাওয়ার সময় জায়িন দরজা লাগিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে রুমে চলে গেল। জায়িন চলে গেলে মীরা জোরে মুখ মোচড় দিয়ে ভেঙিয়ে বলল,

“কথা বললে হায়াত কমে যাবে!”

রান্নাঘর থেকে কোন শব্দ আসছে না। আন্টি কি বুঝেনি সে এসেছে? মুবিন ভাই রুমে কী করে? বেরিয়ে এসে দরজা খুললো না। মীরা গলা ছেড়ে ডাকতে যাচ্ছিল। কিন্তু জায়িন ভাই বাড়ি আছে মনে পড়তে ধীরে ডাকল। এই লোক আবার শব্দদূষণ সহ্য করতে পারে না।

“আন্টি। ও আন্টি…

নিজের ঠিক পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে মীরা ঝট করে পেছনে ফিরল। জায়িনকে দেখে ভয় পেয়ে বুকে হাত দিয়ে বলে উঠল,

” ওরে বাবা!”

জায়িন শান্ত চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে হাতের তোয়ালে এগিয়ে দিল। এই মেয়ের কোন আচরণেই এখন আর সে বিরক্ত হওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। কারণ এই মেয়ের প্রতিটা উদ্ভট আচরণে বিরক্ত হওয়ার শুরু করলে তার বিরক্ত হওয়ার ক্ষমতা লোপ পেতে খুব বেশি সময় লাগবে না। বৃষ্টিতে ভিজে আসার কী দরকার ছিল? মীরা প্রথমে বুঝতে পারল না। তাই জিজ্ঞেস করল,

“কী করব এটা দিয়ে?”

“বৃষ্টিতে ভিজে এসেছ খেয়াল নেই?”

কথা না যেন চাবুকের বাড়ি। জন্মের সময় মুখে মধু দিলে এই অবস্থা হতো না। হাহ! মীরা সংকোচে তোয়ালেটা নিল। মাথা মুছতে মুছতে মুবিন ভাইয়ের রুমের দিকে হাঁটা ধরল। আর তখনই পেছন থেকে গমগমে গলায় শুনতে পেল।

“মুবিন আজ সকালে মা খালামনিকে নিয়ে নানার বাড়ি গেছে।”

বাংলা কথা। তবুও মীরার কাছে চায়নিজ বলেই মনে হলো। সে বুঝতে না পেরে আবার জিজ্ঞেস করল,

“মুবিন ভাই বাড়িতে নেই?”

জায়িনের চেহারায় স্পষ্ট হতাশা দেখা গেল। সে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে কিচেনের দিকে এগোতে লাগল। মীরার কথার উত্তর দিল না। মীরা জায়িনের পেছন পেছন আসতে আসতে আবার জিজ্ঞেস করল,

“আন্টিও বাড়িতে নেই? ওরা কেউ বাড়িতে নেই?”

“মুবিন আজ সকালে মা খালামনিকে নিয়ে নানার বাড়ি গেছে। এই একটা কথার পরও কি আরও প্রশ্ন থাকার কথা?”

লোকটার ভাব দেখে মীরার গা জ্বলে যাচ্ছে। এক কথা দুই বার বললে সমস্যা কি? মানুষ বুঝতে না পারলে জানতে চাইবে না? আশ্চর্য! ইনি এমন কেন? কেমন রোবটের মতো আচরণ করে। স্বাভাবিক মানুষের মতো কোন কথা বলতে পারে না কেন? মীরার ঠেকা পড়েছে উনার সাথে কথা বলতে। মুবিন ভাই বাড়িতে নেই এখন আর এখানে একমিনিটও থাকার প্রশ্নই আসে না। আজকের পড়া ছুটি। মীরা দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এসে, যাবার আগে এই লোকটাকে বলে যাওয়ারও প্রয়োজন মনে করল না। সে দরজা খুলতে নিলে গুরুগম্ভীর সেই গলা শুনে থামতে হলো।

“বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।”

মীরা নাক ফুলিয়ে বলল,

“আমি যেতে পারব।”

“সাথে ছাতা আছে?”

“না। কিন্তু আমি ভিজে চলে যাব। আসার সময় বৃষ্টিতে ভিজে ফেরার জন্যই ইচ্ছে করে ছাতা আনিনি।”

“বৃষ্টি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আবির অপেক্ষা করতে বলেছে।”

মীরা মনে মনে ভাবল, হায় আল্লাহ! এ কোন জ্বালা! আবির ভাই আবার কোত্থেকে জানলো সে ছাতা ছাড়া এসেছে। বৃষ্টি কখন থামে কে জানে। এতক্ষণ মীরা এখানে অপেক্ষা করবে? এই লোকের সাথে? অসম্ভব। ইনি নিজে তো একটা কথাও বলবে না। মীরা কথা বললে তাকেও মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে বসিয়ে রাখবে। না বাবা তার থেকে চলে যাওয়াই ভালো। মীরার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। সে বলল,

“আপনাদের একটা ছাতা দিন। আমি কাল এসে দিয়ে যাব।”

“ছাতা নেই।”

চলবে…

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
Jerin Afrin Nipa
৩২

ছাতা নেই! মীরা বিড়বিড় করল, আল্লাহ তুমি কি আমাকে কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছ! ছাতা আবার থাকে না কীভাবে? নিশ্চিত আছে। কিন্তু উনি জানেন না। মীরা দরজার কাছ থেকে ফিরে এলো। জায়িন এখনও কিচেনে কী করছে কে জানে। মীরা কিচেনের দিকে মুখ বাড়িয়ে বলল,

“ছাতা মনে হয় আছে। আপনি জানেন না। আন্টিকে কল দিন। আন্টি বলে দিবে ছাতা কোথায় আছে।”

মীরা কথাটা বলে অপেক্ষা করল। অনেকক্ষণ পরেও কোন জবাব না পেয়ে সে ব্যাগ সোফার উপর রেখে কিচেনে এসে ঢুকলো। জায়িন কফি বানিয়ে মগে ঢালছে। মীরা কিচেনের সামনে থেকে বলল,

“জায়িন ভাই, আন্টিকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করুন। ছাতা আছে মনে হয়।”

জায়িন মীরার দিকে শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে মীরা চুপ মেরে গেল।
সে কিচেন থেকে বেরিয়ে এসেছে। এই লোকের সাথে এক কথার বেশি দুই কথা বললেই কেমন কটমট করে তাকায়। শয়তান লোক। মীরা ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে পড়ল। আসার সময় দোয়া করছিল যেন বৃষ্টি হয়। এখন দোয়া করছে তাড়াতাড়ি যেন বৃষ্টি থেমে যায়। জায়িন কফির মগ হাতে বেরিয়ে এসেছে। মীরা সোফার উপর পা তুলে বসেছিল। জায়িনকে দেখে তাড়াতাড়ি করে পা নামিয়ে নিল। মীরা নখ কামড়াতে কামড়াতে ভাবছে, জায়িন ভাই একবার ঘরে যাক। প্রথম সুযোগেই মীরা এখান থেকে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু জায়িন রুমে গেল না। কফিতে চুমুক দিতে দিতে মীরার পাশের সোফায় আরাম করে বসে পড়ল। হায় আল্লাহ! ইনি কি এখন এখানেই বসে থাকবে? জায়িন সময় নিয়ে কফি খাচ্ছে। কিন্তু মীরার ঘড়িতে সময় যে আটকে আছে। একেকটা সেকেন্ড একেক বছর মনে হচ্ছে।
দু’মিনিট নীরবতার পর মীরা ধীর গলায় বলল,

“জায়িন ভাই, আমি চলে যাই? বৃষ্টিতে ভিজলে আমার কিছু হয় না। আবির ভাই শুধু শুধু টেনশন করে।”

“মীরা যত বাহানাই দেক, যা কিছুই বলুক। ভুলেও তুই ওকে বৃষ্টির মধ্যে বেরুতে দিবি না। মাথায় এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়লেও ওর ১০০° জ্বর এসে যায়। এটা তোমার ভাইয়েরই কথা।”

মীরা ফোঁস করে দম ফেলল। আবির ভাই তাকে ভালো ভাবেই ফাঁসিয়ে দিয়েছে। এই লোক তো মনে হচ্ছে তাকে পাহারা দিয়ে রেখেছে।
সময় কাটছে না। ইনি মজা করে কফি খেলেও মীরা শুধু মুখে বসে আছে। ভয়ে ভয়ে টিভির রিমোট নিয়ে টিভি ছেড়ে দিল। কয়েকটা চ্যানেল ঘুরিয়েও ভালো কিছু না পেয়ে একটা হিন্দি মুভিই দেখতে লাগলো। আগে কখনও দেখেনি। সময় কাটানোর জন্য মাঝখান থেকেই মুভি দেখা শুরু করেছিল। কিছুক্ষণ দেখে মজাই লাগছিল। কিন্তু হঠাৎ করে একদম অপ্রত্যাশিত ভাবে নায়ক নায়িকার চুমাচাটির সিন শুরু হয়ে গেলে মীরার চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইল। সে ভাবতেই পারেনি এখন এমন কিছু হবে। মীরা রিমোট খুঁজে হুড়মুড়িয়ে টিভি অফ করে দিল। কী লজ্জা কী লজ্জা! জায়িন ভাইও কি এসব দেখেছে? লজ্জায় সত্যি সত্যিই মীরার ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। সে চোখ বন্ধ করে জায়িনের দিকে তাকাল। দূর কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না। ধীরে ধীরে একচোখ খুলল। না, জায়িন ভাই মনে হয় দেখেনি। কারণ তিনি মনোযোগ সহকারে ফোন চাপছে। মীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। বিড়বিড় করে বলল,

“যাক বাঁচা গেল। উফ আল্লাহ।”

মীরা মনে মনে শপথ করল, আজকের পর কোন মানুষের সামনে টিভি দেখতে বসবে না। দেখা মুভিও দেখবে না। আসলে টিভি দেখাই ছেড়ে দিবে সে। জায়িন ভাইও যদি টিভির দিকে তাকিয়ে থাকতো তাহলে কী লজ্জাটাই না পেত! কোনোদিন উনার সামনে আসতে পারত না।
জায়িন ফোন থেকে মুখ তুলে দেখল মীরা টিভি বন্ধ করে বসে আছে।

“কফি চলবে?”

জায়িন ভাইয়ের সামনে থাকলে মীরা কি কানে কম শুনে? নাকি উনার মুখের বাংলা কথাও বুঝতে পারে না। একটা কথা দুই তিনবার জিজ্ঞেস করতে হয়। এতে উনি বিরক্তও হয়। এবারও জায়িন ভাই কী বলল মীরা বুঝতে পারল না। কথাটা তাকে বলেছে কি-না এটাও বুঝলো না। উনার মুখের দিকে হাবার মতো তাকিয়ে আছে। ওকে এরকম ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে জায়িন ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইল। মীরা তখনও উত্তর দিতে পারল না। জায়িন স্পষ্ট বিরক্ত হলো। পরিষ্কার গলায় ঝরঝরে উচ্চারণে জিজ্ঞেস করল,

“কফি খাও?”

মীরা মাথা নাড়ল। জায়িনের ভ্রু কোঁচকাতে দেখে সাথে সাথে বলে উঠল,

“কফি খাই না। চা খাই।”

“হু।”

জায়িন নিজের খালি মগ নিয়ে উঠে যাচ্ছে দেখে মীরাও উঠল। জায়িনের পেছনে পেছনে কিচেন চলে এলো। অবাক হয়ে দেখতে লাগল জায়িন ভাই ছেলে হয়েও কিচেনে কোন জিনিস কোথায় আছে সব জানে। কত দক্ষ হাতে গ্যাসে চায়ের পাতিলে পানি বসিয়ে দিল। আর মীরা এখন পর্যন্ত রান্নাঘর কোনদিকে এটাই বলতে পারবে না। রান্নাঘরে কোন জিনিস কোথায় রাখা আছে বলবে তো দূরের কথা। জায়িন ভাই তাকে চা বানিয়ে খাওয়াবে। সে অপদার্থের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে? তাই সাধারণ মানবতা থেকে বলল,

“আমি সাহায্য করি? কী সাহায্য লাগবে বলুন।”

“চা পাতা কোথায় আছে দেখো।”

হায় হায়! জায়িন ভাইয়ের যে স্বভাব, মীরা ভেবেছিল সে সাহায্য করার কথা বললে জায়িন ভাই বলবে, না থাক। তোমার সাহায্য করতে হবে না। তুমি গিয়ে সোফায় বসে টিভি দেখো। কিন্তু ইনি তো সাহায্য চাচ্ছেন! মীরা তো এবার ফেঁসে গেল। চা পাতা কোথায় আছে কে জানে। আন্টি কতদিন চা করে খাইয়েছে। কিন্তু চা পাতার খোঁজ তো সে রাখেনি৷ মীরা পেঁচা মুখ করে এই ড্রয়ারে, ওই তাকে চা পাতা খুঁজে যাচ্ছে। পাচ্ছে না তো কোথাও। জায়িন ভাইকে বলবে, পাচ্ছি না। জায়িন আড়চোখে মীরাকে দেখছে। হাসি পেলেও হাসছে না।

“কী হলো, পাওনি?”

মীরা ঠোঁট ফুলিয়ে মিনমিন করে বলল,

“পাচ্ছি না জায়িন ভাই।”

“ভালো করে দেখেছ?”

“হ্যাঁ। সব জায়গায় খুঁজেছি। আন্টি কোথায় রেখেছে পাচ্ছি না। চা খেতে হবে না। আপনি রেখে দিন। এমনিতেও আমি এত চা খাই না।”

মীরা জায়িনের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। জায়িন হঠাৎ পেছনে ফিরলে মীরা চুপ হয়ে গেল। জায়িন ওকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে উপরের একটা তাক থেকে চা পাতার কৌটো বের করে আনলো। এটা চা পাতার কোটা! মীরা তো এটা দেখেছেই। কিন্তু বুঝতে পারেনি। সে লজ্জিত মুখে বলল,

“এই কৌটৌটা বুঝতে পারিনি।”

জায়িন সুন্দর করে কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই চা বানিয়ে ফেলল। এবং হাতপা না পুড়িয়ে কাপেও ঢাললো। মীরা আশ্চর্য হয়ে ওকে নিপুণভাবে কাজ করতে দেখেছে। মীরাকে চা ঢালতে দিলে এতক্ষণে গরম চা ফেলে নির্ঘাত হাতপা পুড়িয়ে বসে থাকত। জায়িন চায়ের কাপটা মীরার দিকে এগিয়ে দিল। মীরা এই প্রথম জায়িনের সামনে মন থেকে আন্তরিক ভাবে হাসল। কিচেন থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে চায়ে চুমুক দিয়ে মনে মনে প্রশংসা না করে পারল না। এই চায়ের প্রশংসা না করলে চা তাকে অভিশাপ দিবে। এত সুন্দর চা বানিয়ে খাওয়ানোর জন্য জায়িন ভাইকে একটা ধন্যবাদ দিতেই হয়। মীরা পিছন দিকে ঘুরে বলতেই যাচ্ছিল,

“ধন্যবাদ ভাইয়া।”

এমম সময় হঠাৎ কানে তালা লাগিয়ে আশেপাশেই মনে হয় কোথাও বজ্রপাত হলো। সাথে সাথে ইলেক্ট্রিসিটিও চলে গেল। এতো জোরে বাজ পড়ায় মীরা ভয় পেয়ে হাত থেকে চায়ের কাপ ফেলে দিল। গরম চা পায়ের উপর পড়তেই যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল। সবকিছু ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেছে। মীরা কিছুই দেখতে পারছে না। আবারও পরপর কয়েকটা বজ্রপাত হলো। মীরা কানে হাত দিয়ে কেঁদে ফেলে ডাকল।

“জায়িন ভাই! জায়িন ভাই! কোথায় আপনি?”

অন্ধকারের মাঝেই দু’টো হাত মীরার হাত ধরল। মীরা তখন থরথর করে কাঁপছে। সে জায়িনের হাত শক্ত করে ধরে ফেলল। জায়িন ওর ভয় কমাতে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,

“আমি এখানেই আছি। ভয় পেয়ো না। আলো জ্বালিয়ে দিচ্ছি।”

জায়িনের দুই হাতই মীরা শক্ত করে ধরে রেখেছে। মেয়েটা ভয় পেয়ে কবুতরের বাচ্চার মতো কাঁপছে। জায়িন একটা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আরেক হাতে মীরাকে ধরে রেখে কিচেনে মোমবাতি খুঁজছে। অনেক খোজাখুজি করেও মোমবাতি পেল না। জায়িন মীরাকে নিয়ে অন্ধকারেই কিচেন থেকে বেরিয়ে এলো। ড্রয়িংরুমে এসে মীরা সোফার সাথে ধাক্কা খেল। একে তো পায়ে গরম চা পড়ে প্রচণ্ড জ্বালা করছে। তার উপর সোফার সাথে বেশ জোরেই নখে বাড়ি খেল। মীরা অস্ফুটে কেঁদে উঠল। জায়িন অন্ধকারে মীরার মুখ দেখতে না পারলেও মীরা কষ্ট পাচ্ছে ঠিকই বুঝতে পারল। ড্রয়িংরুমে সোফার উপরেই তার ফোনটা রেখে গিয়েছিল। জায়িন অন্ধকার হাতড়ে ফোন খুঁজছে। এরকম সময় ঠিক আরেকটা বজ্রপাত হলো। এবং এটা যেন জায়িনদের ছাঁদেই হলো এত প্রচন্ড শব্দ হয়েছে। মীরা ভয়ে বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলল। সজ্ঞানে থাকলে সে হয়তো এরকম কাজ কোনোদিনও করতো না৷ কিন্তু এই মুহূর্তে লাজলজ্জা, বোধবুদ্ধি ভুলে মীরা জায়িনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থরথর করে কাঁপতে লাগল। ওর এরকম আচরণে জায়িনও স্তব্ধ হয়ে গেল। নড়াচড়া করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে। এদিকে মীরা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে জায়িনকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। জায়িন পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

“আমার ভয় লাগছে। জায়িন ভাই আমার ভয় লাগছে। প্লিজ আলো জ্বালুন।”

অজান্তেই জায়িনের একটা হাত মীরার পিঠে উঠে এলো। মৃদু হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করতে লাগল।

“ভয় নেই মীরা। আমি আছি তো। তোমার কোন ভয় নেই।”

চলবে

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
Jerin Afrin Nipa
৩৩

ভাগ্য জায়িনের সহায় হলো। মীরার সামনে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যাওয়ার আগেই জায়িনের ফোন বেজে উঠল। ফোনের ওইটুকু আলো দিয়েই জায়িন ড্রয়িংরুমটা দেখে নিল। মীরাকে নিয়েই এগিয়ে গিয়ে ফোন হাতে নিল। আবির বোনের চিন্তায় অস্থির করে জায়িনের কল করছে। জায়িন কল তুললো। আবিরের উত্তেজিত কন্ঠ শোনা যাচ্ছে।

“জায়িন মীরা তোদের ওখানেই তো? ওকে বৃষ্টিতে একা বেরুতে দিছসনি তো?”

জায়িন শান্ত গলায় জবাব দিল,

“মীরা আমার কাছেই আছে। ওর কিছু হয়নি।”

“থ্যাংক গড! বাহিরে যে পরিমাণ ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। আমরা এটা ভেবে ভয় পাচ্ছিলাম মীরা হয়তো রাস্তায় কোথাও আটকা পড়েছে। রাত হলেও ওকে আসতে দিস না। ঝড় কমলে আমি এসে নিয়ে যাব। ওকে একটু দেখিস ভাই। বাজ পড়লে মীরা ভীষণ ভয় পেয়ে যায়।”

“হুম।”

আবির কল কেটে দেওয়ার পরও মীরা জায়িনকে ছাড়ছে না। সে আগের মতোই আষ্ঠেপৃষ্ঠে জায়িনকে ধরে রেখেছে। মীরার দ্রুত চলা একেকটা শ্বাস-প্রশ্বাস জায়িনের বুকে বাড়ি খাচ্ছে। মাথাটা একটু নিচু করতেই মীরার চুল থেকে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ নাকে এসে লাগলো। নিশ্চয় শ্যাম্পুর ঘ্রাণ। বুকের বাঁ পাশে ঠিক যেখানটায় হৃদয়ের অবস্থান, জায়িনের শার্টের ওই অংশ মীরার হাতের মুঠোর ভেতর দলা পাকানো। মেয়েটা কি তার ভেতরের উথালপাতাল অনুভূতির আন্দোলন টের পাচ্ছে? জায়িনের হাসফাস লাগছে। বাইরে তীব্র বাতাস গাছগাছালি উড়িয়ে নিয়ে গেলেও জায়িন এই ঘরের ভেতর পর্যাপ্ত বাতাস পাচ্ছে না। জায়িন চোখ বন্ধ করে নিয়ে গভীর ভাবে দম টানলো। বাইরের ঝড়ের সাথে তার নিজের ভেতরও একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এই ঝড় প্রকৃতির ঝড়ের থেকেও ভয়ংকর রুপ ধারণ করার আগে কিছু করতে হবে। জায়িন নরম গলায় মীরাকে ডাকল।

“মীরা! মীরা, একবার চোখ খুলে দেখো। ভয়ের কিছু নেই। মীরা!”

না। মীরা নিজেও ঘোরের মধ্যে আছে। এভাবে কাজ হবে না ভেবে জায়িন শক্ত হাতে মীরাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওর দুই বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে হুঁশে আনতে চাইল।

“মীরা, আলো এসেছে। এখন আর ভয় পেতে হবে না। মীরা!”

জায়িনের কঠিন গলায় ধমক খেয়ে মীরার হুঁশ ফিরেছে। সে নিজের করা কাণ্ডের কথা মনে করে ভয়, লজ্জা, অস্বস্তিতে জায়িনের দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারল না। লজ্জায় কুঁকড়ে গেছে বেচারি। জায়িন ওর বাহু ছেড়ে দিল। এবং মীরাকে কিছুই না বলে কোথাও চলে গেল। জায়িন যেতেই মীরা ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। এটা কী করেছে সে? তাকে দিয়ে এটা কী হয়ে গেল! জায়িন ভাই তাকে কী ভাবছে? মীরা কেন বুঝলো না। নিশ্চয় জায়িন ভাই তাকে বাজে ভাবছে। লজ্জায়, নিজের উপর ঘৃণায় মীরার চোখে পানি এসে গেছে। সে দু’হাতে মুখ ঢেকে হুহু করে কেঁদে ফেলল। সে তো জানে, ইচ্ছে করে এটা করেনি সে। ভুল করে হয়ে গেছে। কিন্তু জায়িন ভাই কি বুঝবে?
পায়ে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পেতে মীরা ভয় পেয়ে ছিটকে সরে যেতে নিল। কিন্তু ততক্ষণে সে বাধা পেলো। মীরা বিস্ফোরিত চোখে জায়িনকে দেখতে লাগল। জায়িন একহাতে তার পা ধরে আরেক হাতে বরফ ঘষে দিচ্ছে। মীরা ভুলেই গিয়েছিল তার পায়ে গরম চা পড়েছে। ব্যথাটাও এতক্ষণ ছিল না। কিন্তু জায়িন ভাই ভুলেননি! তিনি মীরার পায়ে বরফ লাগিয়ে দিচ্ছে। অস্বস্তিতে মীরা ছটফট করতে লাগলে জায়িন কঠিন চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে ধমক দেওয়া গলায় বলল,

“সমস্যা কি? চিংড়ি মাছের মতো এরকম ছিট পারছো কেন?”

মীরা গলা দিয়ে কোন শব্দই বের করতে পারল না। অনেক চেষ্টার পর চিউচিউ করে বলল,

“আপনি আমার পা ধরছেন…

ওকে কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে জায়িন রাগী চোখে দেখল। ব্যস। মীরা এতেই আবারও কথা হারিয়ে ফেলল। বরফ লাগানো শেষ হলে জায়িন মীরাকে বসিয়ে রেখে রুম থেকে মলম নিয়ে এলো। এবার মীরার পায়ে লাগাতে নিলে মীরা পা সরিয়ে নিয়ে অসহায় মুখে বলল,

” আপনি আমার পা ধরছেন। আমার পাপ হবে। আপনি দিন। আমি নিজে লাগিয়ে নিতে পারব।”

জায়িন মীরার কথায় কানই দিলো না। উল্টো নিজেই মলম লাগিয়ে দিতে দিতে প্রশ্ন করল,

“পাপ হবে কেন?”

“আপনি আমার বড় না!”

“পাপ হবে না। আর হলেও, তুমিও আমার পা ধরে পাপ কাটাকাটি করে নিও।”

জায়িন ভাইকে সে সবসময় বদমেজাজি, গোমড়ামুখো বলে আসত। কিন্তু এই গোমড়ামুখো লোকটার ভেতরেই যে আরেকটা কত ভালো মানুষ লুকিয়ে আছে তা এতদিন দেখতে পারেনি। আজকের জন্য মীরা সত্যিই জায়িন ভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। সে অন্য দিকে তাকিয়ে হালকা গলায় বলল,

“ধন্যবাদ।”

“কেন?”

“বরফ ও মলম লাগিয়ে দেওয়ার জন্য।”

“শুধু একটা ধন্যবাদে কাজ হবে?”

মীরা এতক্ষণ অন্য দিকে তাকিয়ে থাকলেও এই কথা শুনে চকিতে লোকটার দিকে তাকাল। জায়িন মীরার দিকেই তাকিয়ে ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি রেখে বলল,

“আরও তো অনেককিছু করেছি। চা বানিয়ে খাইয়েছি। অন্ধকারে ভয় পাওয়া থেকে বাঁচিয়েছি। ওসবের জন্য ধন্যবাদ দিবে না?”

এই লোকের কথা শুনে মীরা হতভম্ব, বাকরুদ্ধ। সুযোগের ব্যবহার করে তাকে এভাবে খোঁচা মারছে! এমনিতেই তো সে নিজের কাজে লজ্জিত। এখন কি তা মনে করিয়ে দিয়ে আরও লজ্জা দিয়ে মেরে ফেলতে চাচ্ছে? আচ্ছা অধিক লজ্জায় কি মানুষ মারা যেতে পারে? তাহলে নির্ঘাত পৃথিবীতে আজই তার শেষ দিন। এত লজ্জা নিয়ে কিছুতেই সে বাঁচতে পারবে না।

মীরা অর্ধভেজা শরীরে আবিরের পেছনে বাড়ি ঢুকতেই বড়মার ক্রোধের সামনে পড়তে হলো। মীরা জানে এটা বড়মার রাগ না। তার জন্য বড়মার অস্থিরতা, চিন্তা। বাইরে এখনও সমান তালে বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। জায়িন ভাইদের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেট পর্যন্ত আসতে আসতেই ভিজে গেছে। গাড়িতে বসে পুরো পথ আবির ভাই বকাঝকা করেছে। এখন বাড়ি ফিরে বড়মা!

“কাকে জিজ্ঞেস করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলি তুই? কার অনুমতি নিয়ে গিয়েছিলি?”

মীরা মুখ ভোতা করে দাঁড়িয়ে রইল। বড়মা উত্তর না পেয়ে আরও রেগে যাচ্ছে।

“আজকে পড়া দেখাচ্ছিলি? সারাবছর যে মেয়েকে ঠেলে ধাক্কিয়ে প্রাইভেটে পাঠানো যায় না সে মেয়ে আজ ঝড়তুফান মাথায় নিয়ে পড়তে চলে গেল!”

ছোট চাচীও আজ মীরার বিপক্ষে বলছে।

“কেন গিয়েছে জানেন না ভাবী? বাড়িতে থাকলে কি বৃষ্টি হলে ভিজতে দিতাম? ইচ্ছে করে এমন দিন দেখেও প্রাইভেটে গেছে যেন রাস্তায় বৃষ্টি শুরু হলে ভিজে আসতে পারে।”

ভেজা কাপড়ে মীরার শীত লাগছে। সে কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই ধমক খেলো। মীরা ঠোঁট উলটে আবিরের দিকে দেখলো। যতই হোক আবিরকে তো বোনকে বাঁচানোর জন্য কিছু বলতেই হবে।

“মামী ওর বিচার তো এখনও কিছুই হয়নি। সব বিচার বাকি আছে। আগে ওকে রুমে গিয়ে কাপড় পালটে আসতে দাও। তারপর লম্বা সময় নিয়ে বিচার বসবে।”

দু’জনই দেখল সত্যিই মীরা ভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটা দেখে আরও ধমক দিল।

“এখন ভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? জ্বর বাধাতে? জ্বর এলেও তো আমাদেরকেই ভোগাবি। রুমে গেলি না এখনও!”

মীরা চ্যাল চ্যালিয়ে রুমে চলে গেল। যাক বাবা, আবির ভাই এযাত্রায় বাঁচিয়ে দিয়েছে। মীরা চেঞ্জ করে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। এতক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেলেও প্রকৃতিতে এখনও রেশ লেগে আছে। ঠান্ডা হাওয়াও দিচ্ছে ভীষণ। মীরা অন্যমনস্ক হয়ে মাথা মুছতে মুছতে দূরের দিকে তাকিয়ে আছে। অন্ধকারে কিছু দেখা না গেলেও এমনিই তাকিয়ে থাকা। মাথা মুছতে মুছতে মীরা মনে করছে আজ কী কী হয়ে গেল। জায়িন ভাইও তাকে মাথা মোছার জন্য এরকম একটা তোয়ালে দিয়েছিল। বিকেলের পর থেকে যা যা ঘটে গেছে তা মীরার কল্পনার বাইরে ছিল। সে যদি জানত মুবিন ভাই বাড়িতে নেই তাহলে কি জীবনে ওখানে যেত? আর গিয়েছিল ঠিক আছে। জায়িন ভাইদের একটা ছাতা থাকলে কি এসব কিছু হতো? না সে ওখানে থাকত, না ওই ঘটনা গুলো ঘটতো। ছাতা ছাড়া চলে এলেও বাড়িতে এসে বকাও খেতে হতো না।

“সব দোষ আপনার জায়িন ভাই। আপনি আবির ভাইয়ার কথা শুনে আমাকে জোর করে আটকে রেখেছেন।”

কনকনে ঠান্ডা বাতাসে মীরার শীত লেগে যাচ্ছে। সে ব্যালকনি থেকে রুমে ফিরে এলো। এখনও ইলেক্ট্রিসিটি আসেনি। কোথায় কোন তার টার ছিড়ে গেল না তো? বিদ্যুতের খুঁটি পড়ে গেলে আজ রাতে আর কারেন্ট আসবে বলে মনে হয় না। ঘরের জানালা খোলা ছিল। পর্দাগুলো বাসাতে উড়ছে। মীরা সব জানালা বন্ধ করে দিল। বৃষ্টির কয়েক ফোঁটা মাথায় পড়েছিল বলেই মনে হচ্ছে সর্দি লেগে গেছে। অলরেডি কয়েকবার হাঁচিও দিয়ে ফেলেছে। আজকের ঠান্ডা আবহাওয়া দেখেই মীরা কম্বল নামিয়েছে। এখন তার কিছু করার নেই। নিচে গেলেই বকা খাবে। তাই মীরা বিছানা উঠে পড়ল,

“চল ভাই মীরা, খিচুড়ি খাওয়ার ওয়েদারে তোর কপালে আছে বকা। তাই বকা খাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে খাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়।”

গায়ে কম্বল টেনে দিয়ে মীরা শুয়ে পড়ল। কয়েকবার এপাশ ওপাশ করে কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমঘুম ভাব এসে গেল। পুরোপুরি ঘুম চলে আসার আগেই আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে।

চলবে..