#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৭০
দুই বন্ধু দাঁড়িয়ে কথা বলছে। মীরা বিরক্তি নিয়ে তাদের কথা শুনছে। আবির ভাই তাকে সাইকেল চালানো শেখাতে এনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বন্ধুর সাথে রসের আলাপ জুড়ে দিয়েছে।
“কবে এসেছিস শালা?”
“তিন চার দিন হলো।”
“তবুও দেখা করলি না! ডাক্তার হওয়ার আগেই দাম বেড়ে গেছে তোর। পুরোপুরি ডাক্তার হলে তো বন্ধুদের চিনবিই না।”
“তুই কী করছিস?”
মীরা আর এদের ঢঙের কথাবার্তা শুনতে পারল না। অধৈর্য হয়ে সে নিজে নিজেই শেখার চেষ্টা করতে লাগল। মীরা যে নিঃশব্দে চলে গেছে এটা আবির খেয়াল করল না।
“বোনকে সাইকেল চালানো শেখাচ্ছি। শীতের সকালে কোথায় কম্বল মুড়িয়ে ঘুমাব তা না। ধরে বেঁধে সাইকেল চালানো শেখাতে নিয়ে এসেছে। বাতাসে চাপাচোপা জমে গেছে।”
“তোর বোন?”
“মামাতো বোন। জেএসসিতে গোল্ডেন এপ্লাস পাওয়ায় বাপের থেকে সাইকেল নিয়েছে। এখন চালানো শেখানোর দায়িত্ব আমার উপর পড়েছে।”
ওদের কথাবার্তার এপর্যায়ে মীরার চিৎকার শোনা গেল। আবির দেখল মীরা পাশে নেই। কিছুটা দূরে চোখ গেলে মীরাকে সাইকেল নিয়ে রাস্তার নিচে পড়ে থাকতে দেখল। আবির ছুটে মীরার কাছে চলে গেল। ওর পেছনে জায়িনও এসেছে। আবির তাড়াহুড়ো করে মীরার উপর থেকে সাইকেল সরিয়ে নিল। উদ্বিগ্ন হয়ে মীরার পাশে বসে বলল,
“ব্যথা পেয়েছিস?”
মীরা দু’হাতে পা ধরে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমার পা ভেঙে গেছে আবির ভাই। আমি আর কোনদিন সাইকেল চালাতে পারব না।”
“ব্যথা পেয়েছিস নাকি সেটা বল। সাইকেল চালাতে পারবে না ভেবে কাঁদছে। গাধা!”
“আমি হাঁটব কীভাবে? কে আমাকে স্কুলে নিয়ে যাবে? আমি কি বাকি জীবন ল্যাংড়া হয়ে বাঁচব?”
“এক চড় দেব। সামান্য ব্যথাতে কেউ ল্যাংড়া হয় না।”
“কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমি ল্যাংড়া হয়ে গেছি। দেখো, হাঁটতে পারছি না। দাঁড়াতেও পারছি না।”
“তোকে একা একা কে সাইকেল চালাতে বলেছে? পুরোপুরি না শিখেই পণ্ডিতি করতে হবে।”
“তুমি তো কথা বলছিলে। কতক্ষণ অপেক্ষা করতাম? তোমাদের গল্প শেষই হচ্ছে না। আমি কি করব? তুমি আবার আমাকেই বকছো?”
কান্নারত সেই মেয়েটার দিক থেকে কোনভাবেই চোখ সরাতে পারল না জায়িন। হাতমোজা পরা হাতে গাল বেয়ে পড়া চোখের জল মুছছে। শীতেই হোক বা কান্নার কারণে নাকের ডগাটা পাকা টমেটোর মতো লাল হয়ে গেছে। ভেজা চোখের পাপড়ি মিটমিট করে তার দিকে তাকাল একবার। সাথে সাথেই আবার চোখ সরিয়ে নিল। কিন্তু সেই একটু চাওয়াই জায়িনের জীবনে শীতকালেও বসন্ত এনে দিয়েছিল।
মরিচে কামড় লেগে গেলে মীরা দু-হাত ঝেড়ে সমানে ফোঁপাতে লাগল। ঝালের চোটে কথা বলা যাচ্ছে না। তবুুও বলল,
“ওরে আল্লাহ! আমি ক্লাস নাইনে থাকতেই আপনি আমাকে চেনেন! তখন থেকেই পছন্দ করতেন?”
মীরা বিস্ময় ধরে রাখতে পারছে না। ঝাল লাগায় তার চোখে পানি এসে গেছে। জায়িন দ্রুত দোকান থেকে পানি কিনে এনে মুখ খুলে মীরাকে দিল। মীরা পানি খেয়ে কিছুটা ঝাল কমিয়ে আবার প্রশ্ন করতে লাগল।
“তাহলে আমি মুবিন ভাইয়ের কাছে পড়ার সময় আপনি এমন ভাব করতেন কেন যে আপনি আমাকে চেনেন না? আমাকে আপনাদের বাড়িতে দেখে আপনার তো আরও খুশিতে নাচা উচিত ছিল। পছন্দের মানুষটাকে রোজ দেখতে পারবেন। আপনি তো খুশি হলেনই না। উল্টো আমাকে দেখেই কেমন মুখ কালো করে রাখতেন। কেন? আমি আরও আপনার ভয়ে মুবিন ভাইয়ের কাছে পড়া ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। আপনারা বাড়িতে থাকলে জোরে কথাও বলতাম না। কী বাজে লোক আপনি দেখেছেন? আমাকে দেখে মনে মনে ঠিকই লাড্ডু ফুটতো। কিন্তু আমার সামনে হুতুমপেঁচার মতো মুখ বানিয়ে আমার হার্ট অ্যাটাক করিয়ে দিতেন। আপনার সাথে তো আমার প্রেম করাই উচিত হয়নি।”
মীরা ছেলেমানুষি রাগ দেখে জায়িন হাসছে। ওকে হাসতে দেখে মীরা আরও রেগে বলল,
“একদম হাসবেন না। আপনার মনে হয় আমাকে ভয় দেখিয়ে আপনি খুব সোওয়াবের কাজ করেছেন?”
“আমি কি কোনদিন তোমাকে কিছু বলেছি? নাকি তোমাকে বকেছি। তাহলে কীভাবে ভয় দেখালাম?”
“ভালো করে কথা না বলে। কঠিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে। আপনি তো আমার জোরে কথা বলাও পছন্দ করতেন না।”
“যেদিন তোমাকে প্রথম আমাদের বাড়িতে দেখেছি সেদিনের ধাক্কাটা সত্যিই অনেক বড়ো ছিল। আমি খুশি হবো নাকি অবাক হবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। দুনিয়ায় এত মানুষ থাকতে তোমাকে আমার ভাইয়ের কাছেই পড়তে আসতে হলো! বাড়িতে থাকা দিনগুলো আমি ভীষণ ভাবে উপভোগ করতে লাগলাম। পড়তে এসে মা’র সাথে তোমার অর্থহীন সব গল্প ঘরে বসে আমি মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। আনমনে হেসেও ফেলতাম। মুবিনের সাথে তোমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে আমি খুশি হতে পারতাম না। আশ্চর্যের কথা, না? নিজের ভাইয়ের উপরও জেলাস হতাম। তোমার মনে আছে একদিন গলিতে কয়েকটা কুকুরের জন্য তুমি যেতে ভয় পাচ্ছিলে। আমি ব্যালকনি থেকে দেখে সাথে সাথে নেমে গেলাম। সরাসরি তোমাকে সাহায্যের কথা বলতে পারলাম না। কিন্তু তোমার সামনে দিয়েই গেলাম যেন তুমি আমার সাথে সাথে আসতে পারো। এই ঘটনার কথা তোমার নিশ্চয় মনে আছে।
তুমি পায়ের নখ উলটে গেটের সামনে বসে কাঁদতে লাগলে। সেদিনও তোমার কান্না দেখেই আমি তোমার কাছে গিয়েছিলাম। তোমার পা থেকে রক্ত পড়ছে দেখে আমার কী হলো বুঝতে পারলাম না। তুমি কী ভাববে সেটা না ভেবেই কোলে নিয়ে ফ্ল্যাটে চলে এলাম। আমি পা ব্যান্ডেজ করে দেওয়ার সময় চোরা চোখে সংকোচ নিয়ে বারবার তুমি আমাকে দেখছিলে। রিমুর জন্মদিনে শাড়ি পরে যাওয়া। তোমার চোখা হিল দিয়ে আমার পা আহত করা। এরকম আরও অসংখ্য ঘটনা আছে। যেগুলো তোমার হয়তো মনে নেই। কিন্তু আমার সব মনে আছে।”
মীরা কী বলবে বুঝতে পারছে না। সে কথা হারিয়ে ফেলেছে। শুধু ফ্যালফ্যাল চোখে জায়িনের দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষটা কোনদিনও তাকে বুঝতেই দেয়নি। এত সুন্দর করে অনুভূতি গুলোকে নিজের ভেতর লুকিয়ে রেখেছে।
“তখনই আমাকে কেন বলেননি আপনি আমাকে ভালোবাসেন।”
“ভালোবাসতাম না। পছন্দ করতাম। সেই পছন্দই ধীরে ধীরে ভালোবাসার রুপ নিয়েছে।”
“পছন্দের কথাই কেন বলেননি?”
জায়িন মীরার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। এই প্রশ্নের সৎ উত্তর সে কোনদিন দিতে পারবে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলল,
“আমি চাইনি এই ভালোলাগা ভালোবাসায় পরিণত হোক মীরা। যতটা সম্ভব নিজেকে তোমার থেকে দূরে রাখতে চেয়েছি। তোমাকে ভালোবাসা আমার হাতে ছিল না। আবার তোমাকে ভালোবাসা থেকে নিজেকে আটকানোর ক্ষমতাও আমার ছিল না।”
মীরা এখনও অপেক্ষা করছে।
“কী হলো বলুন। ভালো লাগার কথা তখন বলেননি কেন?”
“কারণ তখন তুমি ছোট ছিলে। নাইন টেনে পড়ুয়া কোন পিচ্চি মেয়ের সাথে আমি প্রেম করতে চাচ্ছিলাম না।”
“যাহ! নাইন টেনে পড়ুয়া মেয়েকে আপনার কাছে পিচ্চি মনে হয়?”
“অবশ্যই। তুমি নিজেকে অনেক বড় মনে করলেও আমার কাছে তোমাকে এখনও পিচ্চিই মনে হয়।”
“আপনি আমাকে পিচ্চি বলছেন? খোঁজ নিয়ে দেখেন। আপনার দাদী আমার বয়সেই আপনার বাবার মা হয়েছিল। হুহ্!”
মীরা কথাটা সহজভাবে বললেও জায়িন সেটার অন্য মানে করে মীরার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। একটু ঝুঁকে কানে কানে ফিসফিস করে বলল,
“এখন তুমিও কি এই বয়সে আমার বাচ্চার মা হতে চাও?”
মীরার কান ঝাঁঝাঁ করে উঠল। যেন কানে গরম কিছুর ছ্যাঁকা লেগেছে। জায়িন কোনদিনও এসব কথা বলে না। আজকে ওর এমন কথা শুনে বেচারি লজ্জায় আধমরা হয়ে গেল। কোনভাবেই আর জায়িনের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারল না।
….
অনেক দেরি হয়ে গেছে। মাহিমা হয়তো এতক্ষণে তাকে ছাড়াই বাড়ি ফিরে গেছে। আজ কপালে শনি আছে। এত সাহস দেখানোও উচিত হয়নি। মীরাকে অতিরিক্ত টেনশন করতে দেখে জায়িন বলল,
“আচ্ছা তুমি টেনশন করো না। আমরা এক্ষুনি ফিরে যাব। রিকশা পেয়ে গেলে পাঁচ মিনিটও লাগবে না।”
“রিকশাই তো নেই।”
এমনিতেই সময়ের খেয়াল ছিল না। তার উপর রাস্তায় একটাও খালি রিকশা নেই। যতগুলো আসছে উপরনিচ বোঝাই করা মানুষ। আজকের মতো দুঃসাহস মীরা জীবনে কখনও দেখায়নি। বাড়িতে গিয়ে কী জবাব দিবে এটা ভেবেই হাতপা কাঁপছে। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়ে মীরার দুঃশ্চিতার পাল্লা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিল। আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটা নেই। ঝলমলে রোদের মাঝেও বড়বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে লাগল। মীরা অসময়ের এই বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আজকে আমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।”
একটু দাঁড়ানোর পর একটা রিকশা পেলেও লোকটা বৃষ্টির জন্য নিয়মিত ভাড়া থেকেও দ্বিগুণ বেশি ভাড়া চাচ্ছে। মীরার মেজাজ আগে থেকেই বিগড়ে ছিল। লোকটার এই লোভী মনোভাব দেখে বলল,
“আপনি তো ভীষণ বাজে লোক। বৃষ্টি শুরু হয়েছে এখনও দু’দিনও হয়নি। এর মধ্যেই আপনার ভাড়া বেড়ে গেছে! এই বৃষ্টি এক্ষুনি থেমে যাবে। কিন্তু আপনার চরিত্র সবসময়ই এখন থাকবে।”
“না পুষাইলে যাইবেন না। আমি তো জোর করমি না। এত কথা কইতাছেন কেন?”
জায়িন লোকটার ব্যবহারে রেগে গেলেও এখানে ঝামেলা করতে চাইল না। সে গলার স্বর শান্ত রেখে বলল,
“আমরা যাব না। আপনি চলে যান।”
“দেখলেন বৃষ্টির দিনে রিকশাওয়ালা গুলো কেমন ডাকাত হয়ে যায়। এতটুকু পথ দেড়শো টাকা ভাড়া চাচ্ছে। টাকা কি গাছে ধরে? তার উপর আবার ব্যবহার দেখেছেন!”
“আচ্ছা তুমি রাগ করো না।”
বৃষ্টি থামার কোন নাম নেই। এতক্ষণ আকাশে সূর্য ছিল। এখন পুরো আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গিয়ে শীতল বাতাস দিচ্ছে। ভাগ্য করে একটা সিএনজি পেয়ে গেল। এখন রিকশায় গেলে ভিজতে হবে। তাই জায়িন মীরাকে নিয়ে সিএনজিতে উঠে পড়ল।
“আপনার ফোনটা দিন তো।”
জায়িন পকেট থেকে ফোন বের করে দিল। মীরা অভ্যস্ত হাতে নিজের নামের অক্ষর গুলো তুলে লক খুলে ফেলল। মাহিমার নাম্বারে কল করলে মাহিমা দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“কোথায় তুই? তোর জন্য কি আমিও মরব? কখন গেছিস? আমি আর এক মিনিটও দাঁড়াব না।”
” বৃষ্টি শুরু হয়েছে আমি কী করব? ইচ্ছে করে কি দেরি করছি? পৌঁছে গেছি একটু দাঁড়া। আমি মেলার গেটের সামনে। তুই কোথায়?”
“কোথায় থাকব? বৃষ্টিতে ভিজছিলাম তাই একটা দোকানে দাঁড়িয়েছি। তুই তাড়াতাড়ি আয় মীরা। আমার ভীষণ ভয় করছে। আজকের কাজটা আমাদের মোটেও ঠিক হয়নি। এভাবে সবাইকে টেনশন দেওয়া উচিত হয়নি। বাড়িতে হয়তো এতক্ষণে মরাকান্না লেগে গেছে। মামা, ভাইয়ারা পুলিশের কাছে চলে গেলেও অবাক হবো না। সব তোর জন্য হয়েছে। তুই এই বুদ্ধিটা না দিলে আমি জীবনেও এমন করতাম না।”
“হ্যাঁ এখন সব দোষ আমার। তুমি তো সাধু। আমি যখন বুদ্ধিটা দিয়েছিলাম তখন নেচে নেচে রাজি হয়ে গিয়েছিলি কেন? না করতে পারলি না।”
মীরা ঝগড়ায় ব্যস্ত ছিল তখন জায়িন সিএনজি থেকে নেমে নিয়েছিল। একটু পরেই সে ছাতা মাথায় ফিরে এলো। জায়িন ছাতা কিনতেই গিযেছিল। সিএনজি থেকে নেমে দোকানে যেতে যেতেই সে অনেকটা ভিজে গেছে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা শার্টে লেগে এখন শার্ট গায়ের সাথে লেপটে আছে। মীরা আজ সাদা রঙের একটা সুতির শাড়ি পরেছে। শাড়িটা অত বেশি পাতলা না হলেও ভিজে গেলে নিশ্চয় গা দেখা যাবে। জায়িন সেটা চাচ্ছে না। তাই নিজে ভিজে ছাতা কিনে এনেছে। মীরা এতক্ষণে মাহিমার সাথে ঝগড়া শেষ করে জায়িনের জন্য অপেক্ষা করছিল। জায়িন ফিরে আসতেই মীরা অসন্তুষ্ট গলায় বলল,
“আপনি ছাতা কিনতে গিয়েছিলেন! এখন ছাতা কেনা জরুরি লাগল?”
“অবশ্যই। নেমে এসো।”
মীরা জায়িন এক ছাতার নিচে দাঁড়াল। মীরা ভিজে যাবে এই আশঙ্কায় জায়িন ছাতাটা বেশি করে মীরার দিকে ধরল। সে নিজে একপাশ ভিজে যাচ্ছে। তাতে সমস্যা নেই।”
“আপনি তো ভিজেই যাচ্ছেন। আরেকটু ভেতরে আসেন।”
“মাহিমা কোথায় জানা আছে?”
“কোন দোকানে নাকি দাঁড়িয়েছে। আবার কল করে দেখি।”
“দাঁড়াও।”
জায়িন ফোন বের করার সময় মীরা এক কাজ করল সে পাশাপাশি না দাঁড়িয়ে জায়িনের সামনে চলে এলো। তার পিঠ জায়িনের ভেজা বুকের সাথে লেগে আছে। এক মুহূর্তের জন্য জায়িনের হাত থেমে গিয়েছিল। সে মাথা নিচু করে দেখতে চাইলে মীরার মাথায় চুলই দেখল। নিঃশব্দে হাসল সে। ফোন বের করে মাহিমাকে কল করল। মীরা অপেক্ষা করছিল মাহিমাকে কখন খুঁজে পাবে। কখন এই ছাতার বৃষ্টি থামবে। আর কখন সে বাড়ি যাবে। বাড়ি যাবার কথা মনে হতেই গলা শুকিয়ে গেল। আজ শুধু বকা না মারও খেতে পারে। কেউ বাঁচাতে পারবে না। জায়িন কানে ফোন ধরে রেখেছে। রিং হচ্ছে। কী যেন হলো, হঠাৎ মীরা ঝট করে এদিকে ফিরে জায়িনের বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলল। মীরার এমন কাজে জায়িন যথারীতিই চমকেছে। তাৎক্ষণাৎ বেচারা জিজ্ঞেসও করতে পারল না কী হয়েছে। মীরা নিজে নিজেই বিড়বিড় করছে। জায়িন বিস্ময়ের ধাক্কা সামলিয়ে গলায় জোর এনে জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে মীরা?”
“আবির ভাই!”
চলবে
#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৭১
আবির! কোথায় আবির? মীরা তার ছোট্ট দেহটি জায়িনের বুকে লুকিয়ে ফেলতে চাচ্ছে। আজ সত্যি সত্যিই তার কপালে শনি নাচছে। নইলে এত সাহস দেখাতে যেত না। আবির ভাই দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। জায়িন মীরার কথা শুনে আবিরকে খুঁজছে। মীরা ভয়ার্ত গলায় চাপা ধমক দিয়ে বলল,
“ছাতাটা নিচু করুন না। আমি মরলে আপনি খুশি হবেন?”
জায়িন মীরার ভয় পাওয়ার কারণ বুঝতে পারছে। কিন্তু একদিন না একদিন সবাই তো জানবেই। কতদিন লুকিয়ে রাখা যাবে?
“একদিন সবাইকে জানাতে হবে মীরা। সেই দিনটা আজ হলে সমস্যা কী?”
“আমি জানি না। আমার ভয় করছে। মনে হচ্ছে বাড়িতে যদি মেনে না নেয়। আমাকে আপনার সাথে দেখা করতে না দেয়। রুমে আটকে রাখে। ফোন নিয়ে নিলে আপনার সাথে কথা বলতে না পারলে তো আমি মরেই যাব।”
“তুমি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছ। মেনে না নেওয়ার তো কারণ নেই।”
“আমার যতগুলো ক্লাসমেট বাড়িতে ধরা খেয়েছে কারো রিলেশনই মেনে নেয়নি। সবার বাবা মা’ই অনেক রাগ করেছে।”
“তোমার পরিবারের সবাই অনেক ভালো। আর উনারা আমাকে পছন্দও করেন।”
“এটাই যা একটু স্বস্তি।”
মীরা মাথা উঁচিয়ে আবিরকে খুঁজছে। আবির মনে হয় চলে গেছে। মীরা আর দেরি করল না। এই সুযোগে মাহিমাকে খুঁজে পেয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। মাহিমার অবস্থাও ভয়ে কাহিল।
“আমার ভীষণ ভয় করছে রে মীরা। আজ আমরা দু’জনই মরব।”
“কবর খুঁড়ে রেখেছে। আমরা গেলেই জানাজা।”
“কেন যে এত সাহস দেখাতে গেলাম?”
“নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার কথা সবসময় শুনে এসেছি। এবার নিজেরাই মারলাম।”
বৃষ্টি এখনও থামছে না। বরং আকাশ আরও অন্ধকার হয়ে ভারি বর্ষণ হচ্ছে। বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে দু’জনের পা চলছে না। দু’টো পা দু’মণ ওজনের পাথর মনে হচ্ছে। ছাতা থাকার পরেও বৃষ্টির ছাঁটে দু’জনই আধ ভেজা। মাঝে মাঝে দমকা বাতাসে দাঁতে দাঁতে বাড়ি লাগছে। মাহিমা মীরার হাত ধরে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
“জীবনে শেষ বারের মতো আজকে কোনভাবে বাঁচিয়ে নিস মীরা। সারাজীবন তোর চাকরানী হয়ে থাকব। শুধু আজকে বাঁচিয়ে নিস।”
মীরা বলল,
“আমাকে বাঁচাবে কে? নিজে বেঁচে থাকলে তো তোকে বাঁচাতে পারব।”
বাড়িতে এলে সবাই বকবে এই ভয় পাচ্ছিল ওরা। ভেবেছিল আজ হয়তো কপালে মারও আছে। কিন্তু ওদের ভাবনার মতো তেমন কিছুই হলো না। বরং উল্টোটা ঘটল। ওদের দু’জনকে দেখেই ছোট চাচী, বড়মা কাঁদতে কাঁদতে বুকে জড়িয়ে নিলেন। কপালে, গালে অজস্র চুমু দিতে দিতে বললেন,
“কোথায় গিয়েছিলি তোরা? আর একটু হলে আমাদের জীবন চলে যেত। হারিয়ে গিয়েছিলি ভালো কথা। তোরা কি বাড়ির পথ চিনতি না? সাথে সাথে কেন ফিরে আসিসনি।”
মীরা মাহিমা নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করল। কেউ ওদের বকছে না। সবাই ওদের চার পাঁচ বছরের বাচ্চা মনে করছে। যেন ওদের হারিয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। ওরা যে নিজেদের ইচ্ছেতে কোথাও যেতে পারে এটা কারো মনেই আসছে না। তনি সব বিষয় নিয়ে মীরাকে বকাবকি করলেও আজ সে-ও ভয় পেয়ে গিয়েছিল।
“তোদেরকে কত খুঁজেছি। পেছন থেকে কোথায় চলে গিয়েছিলি?”
ওরা কিছু বলার আগেই আবির বাড়ি ফিরল। বৃষ্টিতে ভিজে পাগলের মতো দুই বোনকে খুঁজেছে। আবিরকে কাক ভেজা অবস্থায় দেখে ইভদ বলল,
“ওরা ফিরে এসেছে। তুমি আসার একটু আগেই ফিরেছে।”
“ওহ।”
“আমি তোমার ভাইকেও কল করে বলে দেই। ও হয়তো এখনও ওদের খুঁজছে।”
ইভা ইভানকে কল করতে চলে গেল। বড় মামী আবিরকে বলল,
“বাবা তুই আর ভেজা কাপড়ে থাকিস না। জ্বর এসে যাবে। তাড়াতাড়ি কাপড় পাল্টে নে।”
আবির একবার দুই বোনের দিকে তাকিয়ে ওদের কোন প্রশ্ন না করে উপরে চলে গেল। মীরা ভয়ে আবিরের সাথে চোখ মেলাতে পারল না। তার মন বলছে আবির তাকে জায়িনের সাথে দেখে ফেলেছে। বড়মা, ছোট চাচী দুই মেয়েকে সহিসালামত বাড়ি ফিরতে দেখেই খুশি। তনি নানান প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেও আগে ওদের ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। পুরোপুরি না ভিজলেও ভেজা কাপড়ে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে। মীরা মাহিমার হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলল,
“আজকের কাজটা একদম ঠিক হয়নি। আমি কসম কাটছি আর জীবনে এমন কোন কাজ করব না। আমাদের জন্য সবাই কত টেনশন করেছে।”
“হুম। আমরা ভেবেছিলাম সবাই হয়তো বকবে। কিন্তু সবাই আমাদের দেখে কত খুশি হয়েছে দেখেছিস? সবার ভালোবাসার মূল্য আমরা মিথ্যা বলে, ঠকিয়ে দিতে পারি না।”
“চল দু’জন প্রমিজ করি, এখন থেকে ভালো মেয়ে হয়ে থাকব। আর মিথ্যা বলে কোথাও যাব না। কাউকে টেনশনও দিব না।”
…..
“তুই যে মেয়েটাকে ভালোবাসিস তাকে কি আমি চিনি?”
আবিরের এই প্রশ্নে জায়িন ওর দিকে তাকাল। আবির মজা করছে না বুঝতে পেরে জায়িনও সিরিয়াস হলো। সে বন্ধুর থেকে আর লুকিয়ে রাখতে চাইল না। তাই একটু সময় নিয়ে বলল,
“হুম।”
“সম্পর্কের কত বছর গড়াল?”
“এক।”
“আমার থেকে লুকিয়ে রাখার কারণ? যদিও এই প্রশ্নটা করার অধিকার আমার নেই।”
“তুইও আমাকে ভুল বুঝবি!”
“ভুল বুঝতাম বন্ধুত্বটা যদি সলিড হতো। এখন তো.. যাকগে আমার কাছে স্বীকার করেছিস এতেই সন্তুষ্ট।”
আবিরের রাগ করাটা জায়েজ। কারণ জায়িন তার একমাত্র বেস্টকে জানায়নি। আবির এতটা রাগ হয়তো করত না যদি না মেয়েটা মীরা হতো। ওর বোনের সাথেই সম্পর্ক করে ওকেই অন্ধকারে রেখেছে। আবির উঠতে নিল। জায়িন ওর হাত ধরে ফেলে বলল,
“কোথায় যাচ্ছিস?”
“কাজ আছে।”
“কথা শেষ করে যা।”
“শেষ।”
“আমার উপর তুই রাগ করতেই পারিস। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব..
জায়িন বলার আগেই আবির তার মনের কথা বুঝে নিল। সামান্য হেসে বলল,
“বন্ধুত্ব শেষ এই কথাটা বলে দিলেও যে বন্ধুত্ব শেষ হবে না তা আমিও জানি। তাই তো বলছি না। বন্ধুর কাছে এক্সপেকটেশন অনেক বেশি ছিল। তাই হয়তো কষ্ট লাগছে।
ভাবতাম তোর ব্যক্তিগত সব কথা জানার অধিকার আমার আছে। যেমন আমার সব কথা তুই জানিস। হ্যাঁ, তুই কখনও নিজে থেকে জানতে চাসনি। আমিই বলেছি। তোর থেকেও এমনটা আশা করা আমারই বোকামি ছিল।”
আবির চলে গেলে জায়িন অনেকটা সময় থম মেরে বসে রইল। তার সবথেকে কাছের বন্ধুটাই তাকে ভুল বুঝেছে।
মীরা কলে জায়িনের কন্ঠ শুনেই বুঝে ফেলল। আজকে জায়িনের কন্ঠ অন্য রকম লাগছে। সে দূর থেকেই বেশ বুঝতে পারছে কোন কারণে হয়তো জায়িনের মন খারাপ।
“আপনার কি মন খারাপ?”
“হয়তো।”
“অনেক বেশি।”
জায়িন উত্তর করল না। জায়িনের মন ভালো নেই শুনেই মীরা অস্থির হয়ে পড়ল।
“কেন মন খারাপ?”
“আমার সবথেকে কাছের বন্ধুটা আমার উপর রাগ করেছে।”
“কে? আবির ভাই? আপনার সবথেকে কাছের বন্ধু তো আবির ভাইয়াই।”
“হুম।”
“কেন রাগ করেছে? আবির ভাই তাহলে সেদিন আমাদের দেখে ফেলেছিল! আমার মনে হয়েছিল আবির ভাই আমাদের দেখে ফেলেছে। কিন্তু কিছু তো জিজ্ঞেস করেনি।”
দুইটা দিন ধরে মীরা এই কথাটা ভেবে ভেবেই অস্থির হচ্ছিল।তার সাথে আবির ভাইয়ের আচরণে কোথায় যেন একটু পরিবর্তন এসেছে। মীরা ঠিক বুঝতে পেরেছে। কিন্তু সাহস করে জিজ্ঞেস করতে পারেনি।
“আবির ভাই কী বলেছে? অনেক রাগ করেছে?”
“কিছু বলেনি। এটাই তো খারাপ লাগছে। আমার উপর আবিরের অধিকার খাটানোই আমার সবথেকে বেশি ভালো লাগত। এই ব্যাপারে ও কিছুই বলেনি। আমি ওর থেকে লুকাবো আশা করেনি।”
“এখন আমরা কী করব?”
“বুঝতে পারছি না।”
“আবির ভাই কি আমাদের সম্পর্ক মানবে না?”
“বলতে পারছি না।”
জায়িন কাছে থাকলে দেখতে পেত মীরার চোখ জোড়া কেমন টলমল করছে। এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে এমন।
….
এক সমস্যা সমাধান হওয়ার আগেই জায়িনের জীবনে আরেক সমস্যা দেখা দিল। আবিরের সাথে কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারছে না। ছেলেটা তার কলই তুলছে না। দ্বিতীয় সমস্যাটা বাবা তৈরি করল। তার বিয়ের কথা উঠেছিল। কিন্তু জায়িন বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে বাবা তাকে মেয়ে দেখতে যেতে বলছে। এমনকি তাকে জিজ্ঞেস না করেই রবিবারে মেয়েদের বাড়িতে যাওয়ার কথা দিয়ে ফেলেছে। মা’র কাছে এই কথা শুনে কিছুটা রাগ ও বিরক্তি নিয়ে বলল,
“আমি তো বলেছিলাম এখন বিয়ে করব না।”
সুমনা বাপ ছেলের নাটক আর নিতে পারছে না। বাপ বলে, ছেলে বিয়ে করবে। বয়স হয়েছে। ছেলে বলে, এখন বিয়ে করবে না। ক্যারিয়ার গোছাবে। মাঝখান থেকে স্বামীর রাগ, ছেলের বিরক্তি সব তাকে সহ্য করতে হয়।
“এই কথাটা আমাকে না বলে তোর বাপকে গিয়ে বল।”
“তুমি বাবাকে বলে দিও। বিয়ের জন্য এত তাড়া কিসের? কয়েকটা বছর যাক।”
“আমি কি তোর আর তোর বাপের কবুতর? তোর খবর তোর বাপের কাছে, তোর বাপের খবর তোর কাছে ঠোঁটে ঝুলিয়ে নিয়ে আসব? আল্লাহ জবান দিয়েছে। নিজেরা কথা বল। আমাকে বাবা তোদের বাপ ছেলের নাটক থেকে মুক্তি দে।”
…..
মীরা ফোঁস করে বড় একটা দম ফেলে বলল,
“আবির ভাই সব জেনে গেছে। সেদিন আমাকে জায়িন ভাইয়ের সাথে দেখে ফেলেছে।”
কথাটা শুনে মাহিমা বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
“বলিস কি! ভাইয়া তোকে কিছু বলেছে?”
“আমাকে কিছু বলেনি। কিন্তু বন্ধুর সাথে রাগ করেছে।”
“কী বলিস! জায়িন ভাই ভাইয়ার এত ভালো বন্ধু। স্কুল থেকে একসাথে আছে। তবুও রাগ করেছে!”
“তুইও তো প্রথম জেনে রাগ করেছিলি। ভাই বোন দুইটাই একরকম। চার মাস পরে কেন বলেছি এজন্য মুখে তেলের পিঠা দিয়ে এক সপ্তাহ কথা বলিস নি। আবির ভাই তো একবছর পরে জেনেছে। তবুও আমরা জানাইনি। নিজে থেকে জেনেছে। রাগ করারই তো কথা।”
“হুম। কিন্তু এখন কী হবে?”
“জানি না রে। জীবনটা পানির মতো সহজ হলে কতই না ভালো হত! ”
” জায়িন ভাই এত ভালো বন্ধু হওয়া স্বত্বেও ভাইয়া তোদের সম্পর্ক মেনে নেয়নি। আমার আর মুবিন ভাইয়ের সম্পর্ক তো তাহলে জীবনেও মেনে নিবে না।”
“আমারটা মেনে না নিলে তোরাটাও না মানুক।”
“কী হারামি রে তুই! ভাইয়া তোকে জায়িন ভাইয়ের সাথে দেখেছে মানে আমি যে তোর সাথে ছিলাম না এটাও দেখেছে। এই মীরা, ভাইয়া আমার আর মুবিন ভাইয়ের ব্যাপারটাও জেনে যায়নি তো?”
“আল্লাহ করুক জেনে যাক।”
মাহিমা ভয়ে আবোলতাবোল বলতে লাগল,
“আল্লাহ, এখন আমি কী করব? ভাইয়া আমাকে মেরেই ফেলবে। মা জানলে আমার হাড্ডি একটাও আস্ত থাকবে না।”
“আল্লাহ আমাদের ভাই গুলোকে এত চালাক বানিয়েছেন কেন? মাথা ভর্তি ব্রেইন দিয়ে রেখেছে। একটু কম চালাক হাবাগোবা টাইপ বানালে কী হতো? বোনেরা যে একটু লুকিয়ে প্রেম করবে সেটা হতে দিবে না।”
চলবে
বিঃদ্রঃ বানান ভুল ক্ষমা করবেন।