#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৭৩ [শেষ]
জায়িন যখন শুনেছে আবির এসেছে, তখন সে খুশি হয়ে নিজেই আবিরের সাথে দেখা করতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই আবির তার ক্যাবিনে চলে আসে। জায়িন জানত আবির কখনও তার উপর রাগ করে থাকতে পারবে না। এক দু’দিনের অভিমান ছিল। কিন্তু রাগ, উঁহু। জায়িন নিজের চেয়ার ছেড়ে বন্ধুর দিকে এগিয়ে গিয়ে দু-হাত মেলে হাসি মুখে ওকে জড়িয়ে ধরতে চাইল। কিন্তু তার আগেই আবির জায়িনের কলার ধরে ফেলল। আবিরের এমন আচরণে জায়িন হতবাক। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। আবির রাগী গলায় বলল,
“কী ভেবেছিস তুই? তোর যা খুশি তা করে যাবি তোকে কেউ কিছু বলবে না! অন্তত আমার বোনের সাথে অন্যায় করে তুই পার পেয়ে যাবি না। এটা তো মাথায় রাখা উচিত ছিল।”
“কী হয়েছে তোর? কী বলছিস এসব? মাথা ঠিক আছে তোর?”
“মাথা এখন খারাপ হবে। বন্ধু হয়েছিস বলে ছাড় পাবি ভাবিস না। চৌদ্দ গোষ্ঠীর নাম ভুলিয়ে দেব শালা তোর।”
“আবির পাগলামি পরে করিস। আগে বল কী হয়েছে? আমি কী করেছি?”
“কী করেছিস বুঝতে পারছিস না, না?”
“আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না।”
জায়িনের সত্যকে লুকিয়ে যাওয়া দেখে আবির আরও রেগে গেল। সম্পর্কের কথা লুকিয়েছে ঠিক আছে। এখন তার সাথে মিথ্যাও বলছে। জায়িন কিছু বুঝে উঠার আগেই আবির ওর পেটে ঘুসি মারল। জায়িন ঘুসি খেয়ে বাঁকা হয়ে গেছে। দম আটকে দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা হজম করে অবিশ্বাস্য চোখে আবিরের দিকে তাকাল।
“আগে তো কথা লুকাতি। এখন মিথ্যা বলাও শুরু করেছিস। আমার সাথে তেড়িবেড়ি চলবে না। মেরে মাথা থেকে ভূত নামিয়ে দেব।”
“ভাই তুই মার, কাট। যা খুশি কর। কিন্তু আগে আমার অপরাধ কী সেটা তো বলে নে।”
“প্রেম করার সময় আমার বোন। বিয়ে করার সময় বাপের পছন্দ করা মেয়ে! শালা তোর এমন অবস্থা করব যে বিয়ের নাম শুনলেই আতঙ্কে কেঁপে উঠবি। আমার বোন তোর জন্য কেঁদেকেটে অসুখ বাঁধিয়ে বিছানা ধরেছে। আর তুই মজা করে বিয়ে করতে যাবি? দরকার পড়লে তোকে গুম করে দেব। তবুও তোর বিয়ে অন্য মেয়ের সাথে হতে দিব না।”
আবিরের রাগের কারণ এবার বুঝতে পারল জায়িন। সে পেট থেকে হাত ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। আবির এখনও ফুঁসছে। জায়িন বলল,
“এটাই কর ভাই। তবুও যেভাবে হোক আমার বিয়ে আটকা।”
জায়িনের কথা শুনে আবিরের ভ্রু কুঁচকে গেল।
“মানে?”
“মানে আমিও তোর বোনকে ছাড়া অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করতে পারব না। তার থেকে ভালো নিজেই গুম হয়ে যাই।”
আবির এখনও জায়িনের কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। কিন্তু তার রাগ কিছুটা ঠান্ডা হয়েছে।
“তুই সত্যিই বিয়ে করতে চাস না?”
“মীরাকে ছাড়া অন্য কোন মেয়েকে বিয়ের কথা আমি ভাবতেও পারি না।”
“তাহলে কাল মেয়ে দেখতে যাচ্ছিস কেন? তুই মেয়ে দেখতে যাচ্ছিস এটুকু শুনেই মীরা খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।”
“মেয়েটাকে বাবা পছন্দ করেছে। আমি না।”
“তাহলে আঙ্কেলকে না করছিস না কেন তুই?”
“চেষ্টা করেছি। কিন্তু..
“চেষ্টা করেছি মানে কি? তুই মীরাকে পছন্দ করলে আঙ্কেলকে মীরার কথা জানাচ্ছিস না কেন? নাকি তুই মীরার সাথে শুধুমাত্র টাইম পাস করার জন্য…
“আবির প্লিজ। তুই অন্তত এই কথা বলিস না। আমি কেমন তা তোর থেকে ভালো কেউ জানবে না।”
“তাহলে আঙ্কেলকে বলতে বাধা কোথায় তোর?”
জায়িন উত্তরহীন ভাবে অনেকক্ষণ আবিরের দিকে তাকিয়ে রইল। আবির নিজেও বুঝতে পারছে না জায়িন তার থেকে কী লোকাচ্ছে। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে জায়িন নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল। আবিরও মুখোমুখি চেয়ারটায় বসল। নরম গলায় জিজ্ঞেস করল,
“কী লোকাচ্ছিস?”
“হু?”
“তুই সবটা বলছিস না। কিছু তো লোকাচ্ছিস? আঙ্কেলকে নিয়ে কোন সমস্যা? আঙ্কেল কি মীরাকে পছন্দ করে না?”
জায়িন বন্ধুর দিকে তাকিয়েই রইল। জবাব দিতে পারল না। ওকে নিশ্চুপ দেখে আবির রেগে বলল,
“বোবা লেগে আছিস কেন? তোকে আমাদের বাড়িতে যে হারে পছন্দ করে তাতে সম্বন্ধ নিয়ে গেলে নাচতে নাচতে তোর সাথে মেয়ে বিয়ে দিয়ে দিবে। মামা মামীদের দিক থেকে সমস্যা না তাহলে। সমস্যা যদি থেকেই থাকে তাহলে সেটা তোর পরিবারের। আন্টি মীরাকে অপছন্দ করতে পারে না। তাহলে কি আঙ্কেল?”
জায়িন সামান্য একটু মাথা নাড়ল। আবির জায়িনের দিকে ঝুঁকে এসে বলল,
“আঙ্কেল আমাদের পরিবার পছন্দ করে না। ভাবীর বিয়ের সময়ই ক্যাঁচাল লাগাতে চেয়েছিল। তোর বাপের সমস্যা কী? মীরাকে কেন পছন্দ না উনার?”
আবির কথা শেষ করার আগেই তার ফোন বেজে উঠল। ফোনে আবির কী শুনলো জায়িন জানে না। কিন্তু আবির এক মুহূর্তও দেরি না করে সাথে সাথে উঠে চলে গেছে। কিন্তু জায়িন কপাল চেপে ধরে সে অবস্থাতেই বসে রইল। মীরাকে বাবার পছন্দ না করার কারণ জায়িন জানে। সে চাইলেই বাবাকে জানিয়ে দিতে পারে, বাবার পছন্দ করা মেয়ে সে বিয়ে করবে না। সে মীরাকে বিয়ে করবে। কিন্তু জায়িন এটা করতে গিয়েও একটা জায়গায় থেমে যায়।
(অতীত…)
জায়িন একটু পরপর চোখ খুলে মাথা উঁচিয়ে দেখছে মা ঘুমিয়ে পড়েছে কি-না। মা ঘুমিয়ে পড়লে সে বাইরে খেলতে যাবে। মুবিন মা’কে জড়িয়ে ধরে মুখ হা করে ঘুমাচ্ছে। জায়িন শেষবার মিটমিট করে চোখ খুলে মা’কে দেখে নিল। বেশি নড়াচড়া না করে নিঃশব্দে উঠার চেষ্টা করছিল। এমন সময় পাশের ঘরে কিছু একটা শব্দ পেল। ওই ঘরে তো বাবা আছে। জায়িন আবার ঘাপটি মেরে শুয়ে পড়ল। স্কুল থেকে ফিরে দুপুরের এই সময়টা তাকে ঘুমাতে হয়। আজ বাবাও বাড়িতে আছে। তাই মা’র কথা অমান্য করে খেলতে যাওয়ার সাহস হয়নি। পাশের ঘর থেকে আর শব্দে পাওয়া যাচ্ছে না। জায়িন ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে বাইরে যাওয়ার আগে বাবার ঘরে উঁকি দিল। বাবা বিছানার উপর চেয়ার তুলে সেটার উপর দাঁড়িয়ে ফ্যানের সাথে মা’র শাড়ি বাঁধছে। জায়িন তখন এতটাও ছোট না যে, এই দৃশ্য দেখে বাবা কী করতে যাচ্ছে বুঝতে পারবে না। আবার এতটা বড়ও না যে এটা বুঝতে পারবে এই পরিস্থিতিতে তার কী করা উচিত। জামান হোসেন জীবনের কাছে হেরে গিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। স্ত্রীর স্বর্ণ গহনা বিক্রি করে জমানো কিছু টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিল। কিন্তু তিনি মানুষ চিনতে ভুল করেছিলেন। যাদের বন্ধু ভেবে বিশ্বাস করেছিল, তারাই তাকে নিঃস্ব করে পথে বসিয়ে দিয়েছে। ধারদেনায় গলা পর্যন্ত ডুবে আছে। তিনি জানেন না কাল সন্তানদের মুখে খাবার কোত্থেকে তুলে দিবেন। চোখের সামনে অন্ধকার দেখছেন তিনি। তার মতো মানুষের মরে যাওয়াই উচিত। সুমনা বারণ করেছিল, তোমার বন্ধুদের আমার সুবিধার মনে হয় না। চোখ বন্ধ করে কাউকে বিশ্বাস করো না। তিনি তা-ই করেছেন। এখন স্ত্রীর সাথেও চোখ মেলাতে পারছেন না। জামান হোসেন চোখ বন্ধ করে মনে মনে দুই ছেলের কাছে ক্ষমা চাইল। তিনি পায়ের তলা থেকে চেয়ার ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার আগেই জায়িন ঘরে ঢুকে পড়ল। জামান হোসেন ছেলেকে দেখে থমকে গেলেন। জায়িন বোকার মতো বাবাকে দেখছে। কাঁদো কাঁদো গলায় বলছে,
“বাবা, তুমি কী করছো বাবা?”
জামান হোসেন ছেলের নিস্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। হু হু করে কেঁদে ফেললেন। বাবাকে কাঁদতে দেখে জায়িনের চোখ দিয়েও পানি পড়তে লাগল। সে ধরা গলায় আবার বলল,
“তুমি কী করছো বাবা? আমি তোমার কথা শুনি না বলে তুমি রাগ করেছ? আমি দুপুর বেলা আর খেলতে যাব না। মুবিনকেও আর মারব না। আর দুষ্টুমি করব না। তোমার সব কথা শুনব।”
জামান হোসেন চেয়ার থেকে নেমে ছেলেকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন। জায়িন তখনও ভয়ে কাঁপছে।
“তুমি যা বলবে আমি তা-ই করব। তোমার সব কথা শুনব। তোমাকে একটুও বিরক্ত করব না। প্রমিজ বাবা। আমি ভালো ছেলে হয়ে যাব।”
জামান হোসেন কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
“আমাকে তুই ক্ষমা করে দিস বাবা। আমি কী করতে যাচ্ছিলাম এটা! এই স্বার্থপর দুনিয়ায় তোকে একা রেখে কীভাবে নিজের মুক্তির কথা ভাবছিলাম? আমি তোর জন্য বাঁচব বাবা। তোদের জন্য লড়াই করে যাব। আমাকে তুই ক্ষমা করে দিস। তোর বাবা বেঁচে থাকতে কখনও তোদের কোনকিছুর অভাব বোধ করতে দেব না।”
(বর্তমান…)
জায়িন দু-হাতে মুখ ঢেকে টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে। বাবার কথা সে অমান্য করতে পারবে না। মানুষটা তার জন্যই বেঁচে আছে। সে কীভাবে এই মানুষটাকে কষ্ট দিবে? মীরাকে ভালোবাসা থেকে নিজেকে কতভাবেই তো আটকাতে চেয়েছে। কিন্তু তারপরও কেন ভালোবেসে ফেলল।
“কেন, কেন? বাবাকে আমি কষ্ট দিতে পারব না। মীরাকে কষ্ট দেওয়ার কথা আমি ভাবতেও পারি না। আমি কী করব? এখন কী করব আমি?”
….
মীরার জ্বর এতটাই বেড়েছে যে ওকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। চিন্তায় চিন্তায় সবাই অস্থির হয়ে পড়েছে। হুট করে মেয়েটার কী হয়ে গেল? পুরো বাড়ি মাথায় তুলে রাখা মেয়েটা একটা গোটা দিন ধরে বেহুশ হয়ে পড়ে আছে। ছোটবেলা থেকে মীরার এত বড় অসুখ কখনও হয়নি। তাই সবাই আরও বেশি চিন্তা করছে।
আবির মামা মামীদের কষ্ট পেতে দেখে মনে মনে বলছে,
“তোমাদের মেয়ের এই অবস্থার জন্য যে দায়ী তাকে আমি ছাড়ব না মামী। আমার বোনটা তোর জন্য কষ্ট পেলে তোকেও আমি ভালো থাকতে দেব না।”
জায়িন মীরার সাথে কথা বলার জন্য ছটফট করছে। কিন্তু সে মীরাকে কল করতে পারছে না। মীরার সামনে কীভাবে দাঁড়াবে সে? মীরাকে কী বলবে?
জায়িন বাড়ি ফিরেও শান্তি পাচ্ছে না। ভীষণ অস্বস্তি লাগছে তার। রুমের ভেতর দম বন্ধ হয়ে আসছে। তাই সে খোলা হাওয়ার জন্য ছাঁদে চলে গেল। জায়িন সিগারেট খায় না। অভ্যাস নেই। কিন্তু আজ সন্ধ্যার পর থেকে কয়েকটা সিগারেট শেষ করে ফেলেছে। তবুও তার অস্থিরতা কমছে না। ছাঁদে অনেকটা সময় কাটিয়ে জায়িন নেমে এলো। রুমে যাওয়ার পথে বাবার সাথে দেখা হয়ে গেল। জামান হোসেন এই সময় ছেলেকে বাইরে থেকে আসতে দেখে বললেন,
“কোথাও গিয়েছিলে?”
“ছাদে ছিলাম।”
“ওহ।”
জামান হোসেন ছেলেকে দেখছেন। কয়েকদিন ধরেই ছেলের আচরণ তিনি লক্ষ করছিলেন।
“হসপিটালে কিছু হয়েছে?”
“না তো। কেন জিজ্ঞেস করছো?”
“না। তুমি যেন কেমন অস্থির থাকো। তাই ভাবলাম।”
বাবা ঠিকই তার অস্থিরতা ধরতে পেরেছে। বাবাকে কি সে বলে দিবে? আজ না বলতে পারলে আর কখনও বলা হবে না।
“জায়িন, তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও?”
জায়িন মাথা নাড়ল। জামান হোসেন তীক্ষ্ণ চোখে ছেলেকে লক্ষ করছেন।
“হাঁটতে যাবে?”
জায়িন বাবার পাশাপাশি হাঁটছে। কিন্তু সে বুঝতে পারছে না বাবাকে কীভাবে বলবে।
“হসপিটালে সবকিছু কেমন চলছে?”
“ভালো।”
“কাল আমরা যাচ্ছি তাহলে?”
“হু? বাবা আমার তোমাকে কিছু বলার আছে।”
“হ্যাঁ বলো।”
জায়িন দাঁড়িয়ে পড়ল। তার অস্থির লাগছে। বাবা কথাটা শুনে কী বলবে? বাবা যদি তার উপর রেগে যায়। যদি রাজি না হয়। জামান হোসেন ছেলের কাঁধে হাত রেখে মৃদু হেসে বললেন,
“এই মুহূর্তে তুমি আমাকে বন্ধু মনে করতে পারো।”
“আমি একটা মেয়েকে পছন্দ করি।”
“শুধুই পছন্দ?”
“না। ভালোবাসি।”
“কতটুকু?”
“কতটুকু জানি না। কিন্তু আমার মনে হয় ওকে ছাড়া আমি ভালো থাকতে পারব না।”
“তুমি কি ওই মেয়েটাকে বিয়ে করতে চাও?”
“হুম।”
“এখন কি আমার থেকে অনুমতি চাইছো?”
“হ্যাঁ।”
“যদি আমি না করি? বলি মেয়েটাকে তুমি ভুলে যাও।”
“হয়তো কখনও ভুলতে পারব না। কিন্তু আমি তোমার অবাধ্যও হবো না।”
….
জায়িন বাবাকে বলে দিয়েছে। কিন্তু বাবা তাকে কিছুই বলেনি। এমনকি মেয়েটা কে এটাও জিজ্ঞেস করেনি। মুবিন এসে তাকে রেডি হতে তাগাদা দিয়ে গেল। আজ শুধু দেখাদেখি পর্বই হবে না। বিয়েও ঠিক করে ফেলা হবে। জায়িন বুঝতে পারছে না সে কী করবে। মীরার কথা মনে পড়ে বুকের ভেতরটা ভেঙেচুরে যাচ্ছে। জামান হোসেন নিজে তৈরি হয়ে ছেলেদের ডাকলেন।
“কোথায় তোমরা? আর কতক্ষণ লাগবে? তাড়াতাড়ি এসো।”
মুবিন বেরিয়ে পড়েছে। বাবাকে দেখে বলল,
“আমি ভাইয়াকে নিয়ে আসছি।”
“তাড়াতাড়ি করো।”
মুবিন জায়িনের রুমে গিয়ে দেখে জায়িন এখনও তৈরি হয়নি। জানালার সামনে উদাস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।
“আরে ভাই, তুমি এখনও তৈরি হওনি? ভাবী তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। বেচারিকে অপেক্ষা করানো কি ঠিক হবে? তাড়াতাড়ি চলো।”
“আমি যাব না।”
“যাবে না মানে? তোমার বাপ যাচ্ছে। তুমি যাবে না কেন?”
“মুবিন বিরক্ত করিস না। আমার ভালো লাগছে না।”
“ভাবীকে দেখলেই সব ভালো না লাগা দূর হয়ে যাবে। এভাবেই চলো তুমি। রেডি হতে হবে না। বাবা দাঁড়িয়ে আছে।”
গাড়িতে বসে জায়িন অসহায় চোখে বাবার দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু বাবা একবারও তার দিকে দেখছে না। জায়িন গাড়ি থেকে নেমে অবাক হলো। এটা তো হসপিটাল। তারা এখানে কেন এসেছে? জামান হোসেন ছেলের পাশে এসে বললেন,
“এখানে একটা জরুরি কাজ আছে। চলো।”
হসপিটালে কী কাজ থাকতে পারে? জায়িন ভেবে পেল না। তার এতকিছু ভাবতে ইচ্ছেও করছে না। মীরার কাছে ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে।
জায়িনের জন্য এই ধাক্কাটা সামলানো সহজ ছিল না। বাবা মীরাকে দেখতে এসেছে! মীরা হসপিটালে এটা সে জানতোই না। মীরাদের পরিবারের লোক জায়িনদের এখানে দেখে স্বাভাবিক ভাবেই আশ্চর্য হলো। জামান হোসেন মীরার সামনে এসে দাঁড়ালেন। হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন,
“কেমন আছো তুমি?”
মীরা জায়িনের থেকে চোখ ফিরিয়ে এনে দূর্বল গলায় বলল,
“ভালো। আপনি কেমন আছেন আঙ্কেল?”
“আমার ছেলে ভালো নেই। ও ভালো না থাকলে আমিও ভালো থাকি না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমরা দু’জনই ভালো হয়ে যাব।”
জামান হোসেনের কথা কেউ বুঝতে পারছেন না। মীরার বাবা বললেন,
“ভাই সাহেব আপনি বসুন।”
“আজ তো আমি বসতে আসিনি ভাই সাহেব। আজ আমি একটা চাওয়া নিয়ে এসেছি।”
“চাওয়া?”
“হ্যাঁ। আপনার মেয়েটাকে আমার চাই। ওকে আমি আমার ছেলের বউ রুপে আমার মেয়ে করে নিতে চাই। আমার এই চাওয়াটা রাখলে তবেই আমি বসবো।”
জায়িন ঝট করে বাবার দিকে তাকাল। তার বিশ্বাস হচ্ছে না। বাবা সত্যিই মীরাকে তার জন্য চাচ্ছে! তার মানে বাবা আগে থেকেই জানত সে মীরাকে পছন্দ করে। বায়েজিদ সাহেব একটু থতমত খেয়ে গেলেন। কারণ হাসপাতালে কেউ বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসেন তার জানা ছিল না। মাহিমা দু’পা পেছনে গিয়ে মুবিনের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“হাসপাতালেও বিয়ের কথা হয়?”
“ডাক্তারের বিয়ের কথা হচ্ছে। আমার তো মনে হয় ডাক্তার রোগীর বিয়েটাও হাসপাতালেই হওয়া উচিত।”
বায়েজিদ সাহেব কিছু বলছেন না দেখে জামান হোসেন বললেন,
“আমার ছেলে আপনাদের পছন্দ না-ও হতে পারে। কিন্তু আপনার মেয়েকে আমার পছন্দ হয়েছে। এখন আপনি না চাইলেও আপনার মেয়েকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাব। আপনি বাধা দিতে পারবেন না। মীরা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেই আমি বরযাত্রী নিয়ে আপনাদের বাড়িতে যাব।”
এখানে যা হচ্ছে জায়িন নিজের চোখে দেখে, নিজের কানে শুনেও বিশ্বাস করতে পারছে না। বাবা এভাবে তাকে সারপ্রাইজ দিবে জায়িন কল্পনাও করেনি। কিন্তু মীরা জায়িনের উপর রাগ করেছে। তাই সে বলল,
“কিন্তু আঙ্কেল, আমি আপনার ছেলেকে বিয়ে করব না।”
জামান হোসেন চিন্তিত মুখে বললেন,
“কেন মা? আমার ছেলেটাকে কি তোমার পছন্দ না? জীবনের প্রথম আমার ছেলে আমার কাছে কিছু চেয়েছে। ও আমার কাছে তোমাকে চেয়েছে। ওর এই চাওয়াটা আমি অপূর্ণ রাখতে পারব না। তুমি রাজি হয়ে যাও মা। আমার ছেলে তোমাকে অনেক ভালো রাখবে।”
“উঁহু। আপনার ছেলে আমাকে কীভাবে ভালো রাখবে? আপনি জানেন উনি আমাকে পছন্দ করেন। তবুও আপনার কথাতে উনি অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গিয়েছিল। আপনি রাজি না হলে উনি আমাকে ভুলে যেত। এমন একটা মানুষকে আমি কেন বিয়ে করব? আপনি বললে তো বিয়ের পরও উনি আমাকে ছেড়ে দিবেন।”
“কে বলেছে? এই জায়িন, এদিকে আয়। তুই নাকি আমার কথাতে মীরাকে ভুলে যেতে চেয়েছিলি? এত বড় সাহস তোর! আজ থেকে তুমি আমার কোন কথা শুনবি না। আমার বৌমা যা বলবে তা-ই শুনবি। মনে থাকবে?”
জায়িন বাবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“তুমি যা বলবে।”
জামান হোসেন চোখ পাকিয়ে বললেন,
“কী বললি?”
জায়িন তার ভুল ঠিক করে নিয়ে বলল,
“তোমার বৌমা যা বলবে।”
সমাপ্ত