#মন_পলাশ ( অষ্টম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১৫>
সেদিন বাড়ি ফিরেও সৌমীর মনটা কেমন উসখুশ করছিল সারাক্ষণ। অর্জুন ঠিক আছে তো! আর জ্বর আসেনি তো ছেলেটার! চিন্তাগুলো কেমন মাথার মধ্যে ঘুরছিল। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল একটা মেসেজ যদি করতে পারতো অর্জুন স্যারকে! ঠিক আছে কি না জিজ্ঞেস করতে পারতো, তাহলে কিছুটা নিশ্চিন্ত হওয়া যেত। কিন্তু ফোনটা হাতে নিয়েও বার বার রেখে দিচ্ছিল সৌমী। হাজার হলেও অফিসের বস। একটা না দেখা দূরত্ব তো সব সময় থাকে। যেচে পড়ে মেসেজ করলে যদি খারাপ ভাবে! কথাগুলো মনে হচ্ছিল বার বার। তবে মা মাঝে মাঝে এসেই কানের সামনে বলছিল,
———” একবার একটা ফোন করে ছেলেটার খোঁজ নিলি না তুই? কাল এত জ্বর ছিল! ”
এই কথায় সৌমী বেশ ক্লান্ত স্বরেই বলছিল,
———-” মা, যাকে ফোন করার কথা বলছো, সে আমার অফিসের বস। তাকে নিজের মর্জি মতন ফোন করা যায় না। অনেক এথিকেটস মেনে চলতে হয়। ”
এই কথায় নন্দিনী নিজে চিন্তা করে বলে উঠেছিল,
———” তোর তো বস। আমার তো কেউ না। আমি তো একটা ফোন করে জিজ্ঞাসা করতেই পারি না কি? ”
এই প্রশ্নে সৌমী বেশ উত্তেজিত হয়েই মা কে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল,
———-” একদম না। স্যার এমনিই খুব কম কথা বলে। ইন্ট্রোভার্ট। কাজের বাইরে কেউ ফোন করলে বিরক্ত হতে পারে। তুমি ভুলেও এইসব ফোন করার কথা ভাববে না। ”
কথাটায় নন্দিনী আর কি বলবে ভেবে না পেয়ে নিজের কাজে চলে গিয়েছিল রান্নাঘরে। তবে সৌমীর মনটা অস্থির হয়েইছিল। আনমনে অকারণে অর্জুনের কথাই ভাবছিল ও।
কিন্তু সেইদিন সৌমীকে অবাক করে হঠাৎ একটা ফোন এসেছিল ওর কাছে অর্জুনের নাম্বার থেকে রাত্রিবেলা। সৌমী তো প্রথমে স্ক্রিনে নাম্বারটা দেখে থমকে গেছিল কয়েক সেকেন্ড। অর্জুন স্যার ওকে ফোন করছে! কোন দরকার পড়লো! না কি শরীর খারাপ লাগছে আবার! কথাটা ভেবেই সৌমী বেশ অস্থির মনে ফোনটা ধরে বলেছিল,
———” হ্যালো স্যার, কি হয়েছে? আপনার শরীর ঠিক আছে তো? ”
এই প্রশ্নে অর্জুন কয়েক সেকেন্ডের ভিড়ে বলেছিল,
———-” হ্যাঁ। ঠিক আছি আমি। ডোন্ট ওরি.. ”
কথাটা শুনে সৌমীর মনটা শান্ত হয়েছিল। ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপনাআপনি বলে উঠেছিল,
———-” যাক বাবা। ”
এই কথায় অর্জুন একটু সময় নিয়ে গুছিয়ে বলেছিল,
———-” তুমি ঠিকঠাক বাড়ি পৌঁছেছিলে তো আজ? মানে কাল সারা রাত জেগে ছিলে! শরীর ঠিক আছে তো? ”
কথাগুলো শুনে সৌমী বেশ অবাক হয়েছিল। অর্জুন স্যার ওর খোঁজ খবর নেয়ার জন্য ফোন করেছে! কথাটা ভাবতে ভাবতেই আলতো স্বরে বলেছিল,
———” হ্যাঁ স্যার। আমি ঠিক আছি। আর বাড়ি তো আপনার গাড়িতেই এসেছি। কোন অসুবিধা হয়নি। ”
কথাটায় অর্জুন আর কিছুটা সময় নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল,
———” তুমি অফিস আসছো তো কাল? একটা প্রজেক্টের হিসেব নিয়ে বসতে হবে তোমার সাথে। ”
এই কথায় সৌমী একটু চিন্তা করে বলেছিল,
———-” হ্যাঁ স্যার। কাল অফিস যাবো আমি। কিন্তু আপনি এতটা শরীর খারাপ থেকে উঠে কালই আবার অফিস আসবেন! দুটো দিন রেস্ট নিলে ভালো হতো না? ”
এই প্রশ্নে অর্জুন অল্প হেসে বলেছিল,
———” আমি বেশিদিন কাজ ছাড়া থাকতে পারি না। তাহলে আমার শরীর বেশি খারাপ লাগে। যাইহোক, কাল দেখা হবে। রাখছি এখন। ”
কথাগুলো বলে অর্জুন ফোনটা কেটে দিয়েছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে অর্জুনের মুখে আলতো হাসি। আসলে এই ফাঁকা বাড়িতে ভীষণ ভাবে ইচ্ছে করছিল কারোর সাথে কথা বলতে। আর জানে না কেন মোবাইলে রাখা সৌমীর নাম্বারটাতেই আনমনে হাত চলে গেল। সেই মুহূর্তে জানতো না কি কথা বলবে! কিভাবে কথা শুরু করবে! কিন্তু সেই একজনের গলার স্বরটা শুনতে খুব ইচ্ছে করছিল, যার কোন ব্যাখ্যা অর্জুনের কাছে নেই। তবে উল্টো দিকে সৌমীর মুখেও আলতো হাসি। যাক, অন্তত মানুষটা কেমন আছে জানতে তো পারলো! মনের অস্থিরতাটা কমলো কিছুটা।
<১৬>
এরপরের দিন অফিসে সৌমীকে ডেকে পাঠিয়েছিল অর্জুন নিজের কেবিনে। বেশ কিছু ফাইল নিয়ে বসেছে ছেলেটা। নতুন প্রজেক্টের বাজেট তৈরি হয়েছে। সেটাই বসে বসে মেলাচ্ছে। সৌমীকেও সেই কারণের জন্যই ডেকেছিল। এরপর ওরা দুজনেই হারিয়ে গিয়েছিল হিসেবের পাতায়। কিন্তু এক দেড় ঘণ্টা হওয়ার পর অর্জুনের হাতে হঠাৎ যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল। ও কাজ থামিয়ে হঠাৎ নিজের একটা হাত চেপে ধরলো যন্ত্রণায়। সৌমী এটা খেয়াল করে বলে উঠলো,
———” কি হয়েছে স্যার? আপনি ঠিক আছেন তো? হাতে লাগছে? ”
এই কথায় অর্জুন কিছুটা ক্লান্ত স্বরে বললো,
———–” হ্যাঁ। হঠাৎ যন্ত্রণা করছে হাতে। বুঝতে পারছি না কেন! ”
এই কথায় সৌমী বেশ চিন্তা নিয়েই বললো,
———-” আপনি হাতের ড্রেসিংটা চেঞ্জ করেছিলেন? ওখান থেকে ব্লিডিং হচ্ছে না তো আবার! ”
এই প্রশ্নে অর্জুন একটু এলোমেলো হয়ে বললো,
———-” না। চেঞ্জ করা হয়নি ড্রেসিং। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আর সময়ই পাইনি আজকে। আসলে এত কাজের চাপ! ”
এই কথায় সৌমী বেশ শাসনের সুরেই বললো,
———” স্যার, আজকের দিনটা আপনার রেস্ট নেয়া উচিত ছিল। একদিন কাজ বন্ধ রাখলে কিছুই হতো না। শরীরটা তো সবার আগে। যাইহোক, ফাস্ট এড বক্সটা কোথায়? আমি ড্রেসিংটা চেঞ্জ করে দিচ্ছি। ”
কথাটায় অর্জুন বাধ্য ছেলের মতন ড্রয়ার থেকে ফাস্ট এড বক্সটা বার করে দিল সৌমীকে। এরপর শার্টটা খুলে হাতটা বার করতেই সৌমী থমকে গেল। ঠিকই ধরেছিল। সাদা ব্যান্ডেজটা রক্তে লাল হয়ে গেছে। মনে হয় অনেকক্ষণ ধরেই ব্লিডিং হচ্ছিল। কথাটা ভাবতে ভাবতেই সৌমী ধীরে ধীরে ব্যান্ডেজটা খুললো, আর খুব কাছ থেকে দেখলো কাটা জায়গাটা। সৌমী সেই মুহূর্তে নিজের মনেই বলে উঠলো,
———” ইশ! এতটা জায়গা কেটে গেছে! আর আপনি এই অবস্থায় এতক্ষণ ধরে কাজ করে যাচ্ছিলেন চুপচাপ! ”
অর্জুন এই প্রশ্নের কি উত্তর দেবে ঠিক বুঝতে পারছিল না। তবে কেন জানে না সৌমীর মুখে ওর জন্য যেই চিন্তা আর উদ্বেগ ছিল, সেটা দেখতে বেশ ভালো লাগছিল। মেয়েটার মনটা খুব নরম। অন্যের কষ্ট দেখতেই পারে না! এই কথাটাই মনে হচ্ছিল অর্জুনের এই মুহূর্তে। আর ড্রেসিং করার সময় সৌমীর আলতো স্পর্শ ভীষণ ভালো লাগছিল ওর। অর্জুন এই সময় নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সৌমীর দিকে।
যাইহোক, সেদিন তবে এরপর একটা ঘটনা ঘটলো। ড্রেসিং করা প্রায় শেষই হয়ে গিয়েছিল সৌমীর, তখনই হঠাৎ অর্জুনের কেবিনে এসে হাজির তিলোত্তমা। ও সৌমীকে দেখে নিজের পারদ ভীষণ চরিয়েই বললো,
———-” কি ব্যাপার! তুমি কি করছ এইসব? ”
এই কথায় সৌমীর হয়ে অর্জুনই বলে উঠলো,
———-” সৌমী আমার হাতে ড্রেসিং করে দিচ্ছিল। কিন্তু কি ব্যাপার? তুমি হঠাৎ এখানে? ”
এই প্রশ্নে তিলোত্তমা সাথে সাথেই বলে উঠলো,
———” তোমার এক্সিডেন্ট এর ব্যাপারে আজই শুনেছি আমি। তাই এসেছিলাম দেখা করতে। কিন্তু অর্জুন , তুমি আর কোন লোক পেলে না নিজের ড্রেসিং করানোর জন্য! এই মেয়েটা কি নার্স না কি! ও কি বোঝে ড্রেসিং এর? আমার মনে হয় সব বিষয়ে সবার ওস্তাদি দেখালেও চলে না। ”
কথাগুলো সৌমীকেই শুনিয়ে বলেছিল তিলোত্তমা। সৌমীর ভীষণ খারাপ লেগেছিল সেই মুহূর্তে। ও এরপর থমকে থাকা গলায়ই বলে উঠেছিল,
———” সরি স্যার। আপনি চাইলে ড্রেসিংটা চেঞ্জ করে নিতে পারেন। আমি আসছি। ”
কথাটা বলেই সৌমী কেবিনটা খালি করে চলে গেছিল অর্জুনের কিছু বলার আগেই। তবে অর্জুনের এবার বিরক্ত লাগছিল তিলোত্তমার ওপর। যাকে যা খুশি তাই বলে দেয়াটাই যেন এই মেয়েটার স্বভাব! কথাটা ভাবতে ভাবতেই অর্জুন বেশ কঠিন গলায় বলেছিল,
———” সৌমীকে ওইভাবে না বললেও পারতে। ও আমাকে হেল্প করছিল জাস্ট। আর কারোর কথা শোনার জন্য তো সৌমী এই অফিসে কাজ করে না! ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বললো অর্জুন। তবে তিলোত্তমা স্থির হয়ে গেল হঠাৎ। অর্জুন ওকে কথা শোনালো এই মেয়েটার জন্য! আজ অব্দি কখনো অর্জুন এতটা কঠিন গলায় কথা বলেনি ওর সাথে! সব এই সৌমীর জন্য। কথাটা ভেবেই সৌমীর ওপর রাগটা যেন বেড়ে গেল কয়েক গুণ।
তবে সেদিন সৌমীর নিজেরও বেশ খারাপ লাগছিল। কেন যেচে পড়ে ড্রেসিং করতে গেল! শুধু শুধু অতগুলো কথা শুনতে হলো ওই তিলোত্তমা ম্যাডামের কাছ থেকে। এই কথাগুলোই ভাবছিল অফিস শেষে বেরিয়ে, সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে। তখনই খেয়াল করলো অর্জুনের গাড়িটা বেরিয়ে গেল সামনে থেকে। আজ গাড়িতে অর্জুন একা নেই। সাথে ওই তিলোত্তমা। দৃশ্যটা দেখে সৌমী কয়েক সেকেন্ড চলতে চলতে থেমে গেছিল হঠাৎ। অর্জুন স্যার আর তিলোত্তমা ম্যাডাম একসাথে ফিরছে! অবশ্য সেদিন পার্টিতেও দেখেছিল তিলোত্তমা সারাক্ষণ অর্জুনের সাথে সাথেই ছিল। কত গিফ্ট নিয়ে এসেছিল ও রুক্মিণী কাকিমার জন্য! তাহলে কি দুজনে বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড! কথাটা ভাবতেই বুকের ভিতরটা হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠেছিল সৌমীর। তবে সঙ্গে সঙ্গেই ও নিজের মনে বলে উঠেছিল ‘ ঠিকই আছে। এরাই তো ভালোবাসবে একে অপরকে। দুজনের স্ট্যাটাস এক, এত বড়লোক! অর্জুন আর তিলোত্তমাকেই তো মানাবে একসাথে। কথাটা ভেবেই সৌমী এগিয়ে গেল নিজের রাস্তায়। যদিও জানে না কেন একটা হালকা মন খারাপের রেশ রয়েই গেল মনে।
কিন্তু সেদিন আসল ঝামেলায় পড়েছিল অর্জুন। তিলোত্তমা তো একদম আঠার মতন লেগেছিল ওর সাথে। শেষে বলে কি না গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে, লিফ্ট দিতে! বিজনেস পার্টনারের মেয়ে বলে মুখের ওপর না ও করতে পারেনি। তাই এত হাতের যন্ত্রণা নিয়েও তিলোত্তমার বকবক শুনতে শুনতে ওকে গাড়িতে লিফ্ট দিতে হলো। তবে যাওয়ার সময় রাস্তায় সৌমীকে যেতে দেখে চোখটা আটকে গেছিল অর্জুনের। হঠাৎ মনে হচ্ছিল গাড়িটা যদি থামিয়ে সৌমীর সাথে ফেরা যেত! ওর হালকা শাসন, আলগোছে চাহুনির কথাও জানে না কেন মনে হলো আনমনে। তবে আজ মেয়েটার সাথে এই তিলোত্তমা যেরকম ব্যবহার করেছে, তাতে নিশ্চয়ই খুব খারাপ লেগেছে সৌমীর! এদিকে সৌমীর সাথে যে আলাদা করে কথা বলবে, সেই সুযোগও পেল না আজ অর্জুন। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই বাকি রাস্তাটা কাটিয়ে দিল ছেলেটা নিঃশব্দে, চলন্ত কলকাতাকে দেখতে দেখতে।
চলবে।