মন পলাশ পর্ব-১২

0
68

#মন_পলাশ ( দ্বাদশ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<২৩>
অর্জুন সারা রাত ঘুমোতে পারেনি কিছুতেই। সারাক্ষণ সৌমীর মুখটা চোখের সামনে ভাসছিল যেন ওর। তবে পরেরদিন সকাল হতে অর্জুন নিজে গিয়েছিল সৌমীদের বাড়ি। সৌমী তো ভীষণ অবাক হয়েছিল অর্জুনকে এই সময়ে এখানে দেখে! তবে অর্জুন প্রথমেই বলে উঠেছিল,
———-” আমার তোমার সাথে আলাদা করে কিছু কথা আছে। ”
এই কথায় সৌমী কিছুই ঠিক বুঝতে পারেনি। অর্জুনকে কিছু জিজ্ঞাসা না করেই নিয়ে এসেছিল নিজের ঘরে। সেই মুহূর্তে অর্জুন কাঁপা স্বরে বলেছিল সৌমীকে,
———-” অ্যাম সরি সৌমী। আমি তোমায় বিয়েটা করতে পারবো না। ”
এই কথায় সৌমী স্থির হয়ে গিয়েছিল কয়েক সেকেন্ড। তারপর নিজের মনেই বলে উঠেছিল,
———” মানে! কি বলছো তুমি! ”
এই কথায় অর্জুন একটু সময় নিয়ে বলেছিল,
———-” আমাদের বিজনেস পার্টনার অমিত রায়চৌধুরী কাল অফিসে এসে আমাকে শর্ত দিয়েছে, হয় আমি ওনার মেয়ে তিলোত্তমাকে বিয়ে করবো, না হলে উনি আমাদের কোম্পানির সাথে সমস্ত রকম বিজনেস রিলেশন ভেঙে দেবেন। এটা হলে আমাদের কোম্পানির একটা হিউজ লস হবে। সৌমী,এই কনস্ট্রাকশন কোম্পানিটা বাবার একমাত্র স্বপ্ন ছিল। আমি এই কোম্পানির ফিউচার নিয়ে কোন রকম রিক্স নিতে পারবো না। আই অ্যাম রিয়েলি সরি.. আমার সত্যি কিছু করার নেই। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও প্লিজ.. ”
শেষ কথাগুলো বলতে বলতে অর্জুনের গলাটা ধরে এসেছিল কেমন। গলার কাছে একটা কান্না জমেছিল হঠাৎ। কিন্তু এরপর অর্জুন আর সৌমীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। লজ্জায় অপরাধবোধে ওর সাথে চোখ মেলাতে পারছিল না ঠিক। চলে গেছিল ঘরটা খালি করে।
কিন্তু সৌমী কিরকম পাথরের মূর্তির মতন দাঁড়িয়েছিল এক জায়গায়। মনে হচ্ছিল কেউ এতদিন ধরে ওর মনটার সাথে খেলে ওকে ছুঁড়ে ফেলে দিল মাঝ রাস্তায়। সবটা শেষ করে দিল এক মুহূর্তে! একবারও সৌমীর কথাটা ভাবলো না! কথাগুলো মনে হতেই চারিদিকটা আবছা হয়ে এলো সৌমীর। চোখে জল জমলো অবিশ্রান্ত ভাবে।
সেদিন যখন কথাটা রুক্মিণী জানতে পেরেছিল ওর শরীরটা ছেড়ে দিয়েছিল হঠাৎ। এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল অর্জুন! একবার আলোচনা অব্দি করলো না ওর সাথে! আর এত কিছুর পর কি মুখ দেখাবে রুক্মিণী নন্দিনীকে! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সারাদিন কেটে গিয়েছিল। সেদিন রাত্রিবেলা এরপর রুক্মিণী নিজে এসেছিল অর্জুনের ঘরে। ভীষণ ক্লান্ত স্বরে বলেছিল ও,
———-” খুব বড় ভুল করলি তুই। আজ হয়তো বুঝছিস না। কিন্তু একদিন তোকে ভীষণ আফসোস করতে হবে। ”
কথাগুলো শুনে অর্জুন নিজে থেকে বলে উঠেছিল,
———–” আমার কাছে আর কোন রাস্তা ছিল না মা। এই বিজনেসটা বাবার স্বপ্ন ছিল। তিলোত্তমার বাবার কথায় রাজি না হলে বিজনেসে অনেক বড় লস হয়ে যেত! ”
কথাটায় রুক্মিণী বেশ রেগেই এবার বললো,
———–” তা বলে বিজনেসের নাম করে ব্ল্যাকমেল করে বিয়ে করবে মেয়েটা তোর সাথে! আর কিছু বলার নেই আমার। যা ঠিক মনে হয় কর। তবে এরপর আমার যা ঠিক মনে হবে আমি করবো। ”
কথাটা বলেই রুক্মিণী চলে গিয়েছিল। কিন্তু মায়ের কথাগুলো কানে বাজছিল অর্জুনের। শেষ কথাটা মা কি বলে গেল! কি করবে মা!

সেদিন এই ভাবনার ভিরেই রাতটা কেটে গিয়েছিল। কিন্তু পরেরদিন সকাল সকালই রুক্মিণী চলে এসেছিল নন্দিনীদের বাড়ি। আজ রুক্মিণী প্রায় হাত জোড় করে বলে উঠেছিল নন্দিনীকে,
————-” পারলে তুই আমাকে ক্ষমা করিস। আজ আমার ছেলের জন্য আমি তোর সামনে চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারছি না। ”
এই কথায় নন্দিনী সঙ্গে সঙ্গে রুক্মিণীর হাতটা ধরে বলেছিল,
———–” তুই এইভাবে বলছিস কেন! আর যা হয়েছে সেটাতে তোর তো কোন দোষ নেই। আর সত্যি কথা বলতে কি আমাদের অবস্থার সাথে তোদের অবস্থার কোন মিল ঘটে না। তাই এই সম্পর্কটা না হয়েই হয়তো ভালো হয়েছে। ”
এই কথায় রুক্মিণী খুব দৃর গলায় বললো,
———–” আমি টাকা দিয়ে না, কারোর মানসিকতা দিয়ে লোক বিচার করি। আর আমার মনে হয় সৌমীর মতন ভালো মেয়ে আমি হাজার খুঁজলেও পেতাম না, আর পাবোও না। আমার ছেলের ভাগ্য খারাপ যে ও সৌমীকে পেয়েও হারিয়ে ফেললো। কিন্তু এর জন্য সৌমীর জীবন থেমে থাকবে না। আমি কথা দিচ্ছি তোকে, ওই ডেটেই সৌমীর বিয়ে হবে। আর ভীষণ ভালো ছেলের সাথে বিয়ে হবে। পাত্র খোঁজার দায়িত্ব আমার। ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল রুক্মিণী। নন্দিনী যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল এইসব শুনে। কিছুই ঠিক বলতে পারেনি রুক্মিণীকে। তবে কথাটা নিজের ঘরের দরজার আড়াল থেকে সৌমীও শুনেছিল। কিন্তু ও নিজেও আজ না করেনি এই কথায়। মনে হচ্ছিল যদি অর্জুন ওকে ছেড়ে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করতে পারে, তাহলে সৌমী কেন পারবে না! লাভ ক্ষতির হিসেবের শুরু তো অর্জুন করেছিল! এক মুহূর্তে ভেঙে দিয়েছিল সম্পর্কটা। তাহলে সৌমী কেন পারবে না!

<২৪>
এইসবের পর কটা দিন কাটিয়ে সৌমী অফিস গিয়েছিল। আসলে অর্জুনের মুখোমুখি কোনভাবেই হতে ইচ্ছে করছে না আর। সেদিন এই ভাবনার ভিড়েই ভীষণ এলোমেলো মন নিয়ে এসেছিল অফিস। তবে সেদিন অফিসে আরেকজনও ছিল। তিলোত্তমা নিজের এনগেজমেন্ট এর শপিং করে এসেছিল অর্জুনের কাছে। কোন পারমিশন ছাড়াই অর্জুনের কেবিনে ঢুকে বেশ একসাইটেড হয়ে দেখাচ্ছিল নিজের ল্যাহেঙ্গা, অর্জুনের শেরওয়ানি। তবে অর্জুন এই সময় প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে বলেছিল ওকে,
————” এটা আমার কাজের জায়গা। এখানে আমি এইসব ল্যাহেঙ্গা শেরওয়ানি দেখতে আসিনি। তুমি প্লিজ যাও। পরে কথা হবে। ”
এই কথায় তিলোত্তমার ইগো হার্ট হয়েছিল ভীষণ। ও বেশ অস্থির স্বরে বলে উঠেছিল,
————” কেন দেখবে না তুমি এইসব! কিসের এত কাজ! তুমি বোঝো না আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি! তোমার জন্য আমি কি কি করতে পারি! ”
কথাগুলো বলতে বলতেই তিলোত্তমা ভীষণ কাছে চলে এসেছিল অর্জুনের। ওকে অকারণে আঁকড়ে ধরেছিল হঠাৎ। অর্জুন এই মুহূর্তে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেছিল। ও নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে উঠেছিল,
———” তিলোত্তমা প্লিজ ছাড়ো আমাকে। কি করছো এইসব! ”
এই কথায় তিলোত্তমা যেন আরো এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। ও অর্জুনের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে জোর করে অর্জুনকে আরো বেশি আঁকড়ে ধরেছিল নিজের মধ্যে। এই সময়েই সৌমী একটা ফাইল নিয়ে ভীষণ দরকারে এসেছিল অর্জুনের কেবিনে। ও কিছু না বুঝেই দরজায় নক করে ‘ মে আই কম ইন ‘ বলে দরজাটা খুলে ঢুকে এসেছিল কিছুটা, আর সামনের দৃশ্য দেখে স্তব্দ হয়ে গিয়েছিল কয়েক সেকেন্ড। অর্জুন তিলোত্তমা যেন একে অপরের মধ্যে হারিয়ে আছে! তবে অর্জুন সৌমীকে দেখেই নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে তিলোত্তমাকে ছাড়িয়ে নিয়েছিল নিজের মধ্যে থেকে। তবে তিলোত্তমার সৌমীকে দেখে পারদ চড়ে গিয়েছিল যেন। ও চিৎকার করে বলে উঠেছিল,
———–” হাও ডেয়ার ইউ.. বসের কেবিনে ঢোকার আগে পারমিশন নিতে হয় জানো না? ”
কথাটা শুনে সৌমী চমকে উঠে বলে উঠলো,
———-” সরি.. আমি আসছি। ”
কথাটা বলেই সৌমী জোরে পা চালিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল ঘরটা থেকে। কিন্তু অর্জুন যেন এইসব দেখে এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল নিজে। সৌমী কি ভাবলো ওর সম্পর্কে! কথাটা ভেবেই অর্জুন চেঁচিয়ে বলে উঠেছিল,
———” সৌমী, দাঁড়াও প্লিজ..”
কথাটা বলতে বলতেই তিলোত্তমাকে প্রায় অদেখা করে সৌমীর সাথে কথা বলার জন্য বেরিয়ে এসেছিল কেবিন থেকে। কিন্তু সৌমী আজ ওর কথায় না থেমে এগিয়ে যাচ্ছিল নিজের মনে। যা দৃশ্য দেখেছে, এরপর অর্জুনের সাথে ওর আর কোন কথা বাকি নেই। তবে অর্জুন এই মুহূর্তে সৌমীর হাতটা পিছন থেকে টেনে ধরে ওকে থামালো। তারপর অস্থির স্বরে বলে উঠলো,
———” সৌমী দাঁড়াও। তুমি যা দেখেছো সেটা ঠিক নয়। আমি! ”
ওর কথাটাকে শেষ না হতে দিয়েই সৌমী বলে উঠলো,
———-” আপনি আপনার উড বি ওয়াইফের সঙ্গে কি করছেন না করছেন সেটা আমাকে এক্সপ্লেন করার তো কিছু নেই স্যার। বরং আই অ্যাম সরি.. আমি আপনাদের পার্সোনাল স্পেসে ঢুকে পড়েছিলাম। ”
কথাগুলো বলেই সৌমী চলে যাচ্ছিল। কিন্তু অর্জুন এই মুহূর্তে থমকে বলে উঠলো,
———” তুমি আমাকে স্যার বলছো কেন? ”
এই কথায় সৌমী একবার স্থির দৃষ্টিতে তাকালো শুধু। তারপর নিজের হাতটা জোর করে ছাড়িয়ে চলে গেল অর্জুনের সামনে থেকে।
সেই মুহূর্তে অর্জুনের মনে হলো খুব দামী একজনকে হারিয়ে ফেলেছে। খুব বড় ভুল করে ফেললো কি অর্জুন!

সেদিন এরপর সৌমী নিজের ডেস্কে এসে প্রথমেই নিজের রেজিগ্নেশন লেটার টাইপ করেছিল। আর এই অফিসে চাকরি করা সম্ভব না। অর্জুনের মুখোমুখিই আর কোনদিন হতে চায় না সৌমী। কথাটা ভেবেই অফিস ছুটি হওয়ার পরে ও এসেছিল অর্জুনের কেবিনে। অর্জুন সেই মুহূর্তে সৌমীকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল,
———” সৌমী তুমি? কোন দরকার ছিল? ”
এই কথায় সৌমী রেজিগ্নেশন লেটারটা টেবিলে রেখে বললো,
———–” আমি রিজাইন করলাম। এমনিতেও নোটিশ পিরিয়ডের তিন মাস শেষ হয়ে গেছে। আর এই অফিসে আমার থাকার দরকার নেই।”
কথাটা শুনে অর্জুনের যেন ধাক্কা লাগলো কেমন। ও থমকে থাকা স্বরে বললো,
————” তুমি চলে যাবে অফিস ছেড়ে! ”
এই কথায় সৌমী আর কথা না বাড়িয়ে বললো,
———-” আসছি স্যার। এন্ড অল দ্যা বেস্ট ফর ইওর নিউ লাইফ.. ভালো থাকবেন। ”
কথাগুলো বলেই সৌমী চলে গিয়েছিল সেদিন। কিন্তু অর্জুন কিরকম স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল যেন। বুকে ভাঙ্গা কাঁচ বিঁধছিল হঠাৎ। এত যন্ত্রণা আগে কখনো হয়নি। সৌমী সত্যি কেমন হারিয়ে যাচ্ছে ওর জীবন থেকে! ধীরে ধীরে আবছা হয়ে যাচ্ছে। আর অর্জুন কিছু করতে পারছে না।

তবে এর দুদিন বাদে একটা ঘটনা ঘটলো। অর্জুন সকালে অফিস বেরোনোর সময় থমকে গেল ড্রইং রুমে এসে। মা ঘটক মশাই এর সাথে কথা বলছে। হাতে কতগুলো ছেলের ছবি। বেশ মনোযোগ দিয়েই মা দেখছে তাদের। ঘটক মশাই এর কাছে শুনে নিচ্ছে কোন ছেলে কি কাজ করে, ফ্যামিলি কেমন। এইসব দেখে অর্জুন বেশ অবাক হয়েই মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল,
———” এসব কি? কার জন্য ছেলে দেখছো তুমি? ”
এই কথায় রুক্মিণী এক কথায়ই উত্তর দিল,
———” সৌমীর জন্য। ”
কথাটা শুনে অর্জুন কেমন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল কয়েক সেকেন্ড। তারপর নিজের মনেই বলে উঠলো,
———-” সৌমীর জন্য ছেলে দেখছো মানে! ”
এই কথায় রুক্মিণী বেশ কঠিন স্বরে বললো,
————” এতে এত অবাক হওয়ার কি আছে! আমি আর নন্দিনী ঠিক করেছি তোর সাথে যেই ডেটে বিয়ে ঠিক হয়েছিল সৌমীর, সেই ডেটেই বিয়ে হবে ওর। ছেলে আমি খুঁজে দেব। ”
কথাটায় অর্জুন বেশ উত্তেজিত হয়ে বলেছিল,
———–” এসব কি বলছো তুমি! এরকম যার তার সাথে সৌমীর বিয়ে দেয়া যায় না কি! আর সৌমী জানে এইসব? ও রাজি এরকমভাবে বিয়ে করতে?”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বললো অর্জুন। তবে রুক্মিণী এবার বেশ কঠিন স্বরে বললো,
———–” সৌমী রাজি। আর যার তার সাথে কেন বিয়ে দেব সৌমীর! এই শহরে ভালো ছেলের অভাব নেই। আর তোকে এইসব নিয়ে ভাবতে হবে না। সৌমীকে নিয়ে ভাবার জন্য আমরা আছি। তুই বরং তোর বিজনেস, তিলোত্তমা এইসব কিছু নিয়ে ভাব। ”
কথাগুলো বলে কেমন মুখ বন্ধ করে দিয়েছিল রুক্মিণী অর্জুনের। তবে এরপর রুক্মিণী ঘটকের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে গেলেও অর্জুনের মনে যেন ঝড় উঠেছিল একটা।
চলবে