মন পলাশ পর্ব-১৪ এবং শেষ পর্ব

0
73

#মন_পলাশ ( শেষ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<২৭>
তবে অর্জুন সেইদিন ফিরে যায়নি। দাঁড়িয়েছিল অনুষ্ঠান বাড়ির এক কোণায়। নিজেকে চরম শাস্তি দিচ্ছিল আজ। একদিন সৌমীকে মাঝপথে ছেড়ে চলে যাওয়ার শাস্তি। আজ ওর আশীর্বাদ নিজের চোখে দেখবে। দেখবে সৌমীকে অন্যের হয়ে যেতে। এই কষ্টটা পাওয়ারই যোগ্য অর্জুন। এইসবই ভাবছিল। এর মধ্যে ছেলের বাড়ি থেকে সব লোক এসে হাজির। পার্থ সুন্দর একটা পাঞ্জাবি পড়ে বেশ সেজে এসেছে অনুষ্ঠানে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আশীর্বাদের অনুষ্ঠান শুরু হবে। অনেক লোকের ভিড়, হাসি মজায় মেতে আছে সন্ধ্যেটা। এই সময়েই একটা ঘটনা ঘটলো। হঠাৎ রান্নার জায়গায় শর্ট সার্কিট। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই আগুনের ধোঁয়া ছড়িয়ে গেল সমস্ত অনুষ্ঠান বাড়িতে। প্রথমে কেউ কিছু না বুঝলেও ধোঁয়া আসছে দেখে সবার মধ্যেই ভয় ছড়িয়ে গিয়েছিল। আগুন আগুন চিৎকার উঠেছিল সেই ভিড়ে। আর নিমেষের মধ্যে খাবারের জায়গা থেকে আগুনটা ছড়িয়েও গিয়েছিল অনুষ্ঠান বাড়ির ভিতরে। সবাই যেভাবেই হোক পালিয়ে এই বাড়িটা থেকে বেরোবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু অর্জুনের চোখ খুঁজছিল শুধু একজনকে। সৌমী। মেয়েটা তো যেদিকে আগুন লেগেছে সেই দিকেরই একটা ঘরে ছিল। সৌমী ঠিক আছে তো! কথাটা ভেবেই অর্জুন সৌমীর ঘরের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওর ঘরের কাছে এসেই পাটা থমকে গেছিল। আগুন ধোঁয়ার মধ্যে অন্ধকারে সৌমী চিৎকার করছে ভয়ে। বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেও বেরিয়ে আসতে পারছে না। অর্জুন সেই মুহুর্তে ছুটে গেছিল সৌমীর কাছে। আগুনের হল্কা, কালো ধোঁয়ার ভিড়ে অর্জুন কোন মতে গিয়ে পৌঁছেছিল সৌমীর কাছে। সৌমী সেই সময় অর্জুনকে সামনে দেখে কিরকম স্থির হয়ে গিয়েছিল। নিজের মনেই বলে উঠেছিল,
———” অর্জুন! তুমি এখানে? ”
অর্জুন সৌমীকে আগলে ধরে বলেছিল,
———” থ্যাঙ্ক গড তুমি ঠিক আছো। আমি তোমাকে কিছু হতে দেব না সৌমী। চলো এখান থেকে। ”
কথাটা বলেই অর্জুন সৌমীকে আগলে ধরে এগিয়ে গিয়েছিল দরজার দিকে। তারপর কোনভাবে আগুনের হল্কা থেকে সৌমীকে বাঁচিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল বাইরে। কিন্তু এর মধ্যে অর্জুনের নিজের শরীরের বেশ কিছু জায়গা জ্বলে গিয়েছিল। কালো ধোঁয়ায় শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। কিন্তু ছেলেটার যেন এইসব কিছু অনুভবই হচ্ছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল যেভাবেই হোক সৌমীকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু এর মধ্যেই নিচের হলের ঝাড়বাতির দড়িতে আগুন লেগে গিয়েছিল। আর ঝাড়বাতিটা এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল নিচে। অর্জুন সৌমী সেই সময় ঝাড়বাতির নিচেই দাঁড়িয়ে ছিল। সৌমী ভয়ে জড়িয়ে ধরেছিল অর্জুনকে। কিন্তু অর্জুন সেই সময় কোন রকমে সৌমীকে নিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। ঢালের মতন ওকে জাপ্টে ধরেছিল নিজের মধ্যে। কিন্তু সৌমীকে বাঁচাতে পারলেও নিজেকে বাঁচাতে পারেনি অর্জুন। ঝাড়বাতির কাঁচগুলো এসে বিঁধে গিয়েছিল ওর শরীরে। অর্জুন যন্ত্রণায় কাতরে উঠেছিল। কিন্তু তারপরই সৌমীর মুখটা খেয়াল হয়েছিল। মেয়েটা ভয়ে কেমন কাঁপছে। অর্জুন এটা দেখেই নিজেকে কোনভাবে সামলেছিল। তারপর সৌমীকে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল দরজার দিকে। অন্ধকার, কালো ধোঁয়া, আগুনের হল্কা কোন রকমে পার করে বেরিয়ে এসেছিল বাইরে। সৌমী অর্জুনকে একসাথে বেরোতে দেখেই বাইরে দাঁড়ানো লোকের ভিড় ঠেলে রুক্মিণী আর নন্দিনী এগিয়ে এসেছিল। নন্দিনী দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরেছিল সৌমীকে। রুক্মিণী কাঁপা স্বরে বলে উঠেছিল,
———” তুই ঠিক আছিস তো? কিছু হয়নি তো? ”
এই কথায় সৌমী নিজের মনেই বলে উঠেছিল,
———-” ঠিক আছি আমি। অর্জুনের জন্যই! ”
কথাটা বলেই ও অর্জুনের দিকে ফিরে তাকিয়েছিল, আর খেয়াল করেছিল ওর রক্তাক্ত চেহারাটা। কিন্তু অর্জুন আর এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। চারিদিকটা হঠাৎ অন্ধকার হয়ে এসেছিল সামনে, আর অর্জুন সেন্সলেস হয়ে পড়ে গেছিল মাটিতে। দৃশ্যটা দেখে রুক্মিণী চিৎকার করে উঠেছিল। সৌমী দৌড়ে গিয়ে অর্জুনকে আগলে ধরেছিল নিজের মধ্যে। অনেক করে জাগানোর চেষ্টা করেছিল ওকে। কিন্তু ছেলেটা কোন সাড়া দেয়নি।
এরপর অর্জুনকে সাথে সাথেই হসপিটালে শিফ্ট করা হয়েছিল। অনেকটা কালো ধোঁয়া ও ইনহেল করেছে, তাই দম আটকে এসেছে, শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে সেই জন্য। তার সঙ্গে শরীরের নানা জায়গায় কাঁচ বিঁধে কেটে গেছে, পুড়ে গেছে আগুনে। সব মিলিয়ে অবস্থা বেশ খারাপ। অক্সিজেন দিতে হচ্ছে ওকে। সৌমী এই দৃশ্যটা যখন অর্জুনের কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে দেখেছিল, নিজেকেই ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছিল। ওকে বাঁচাতে গিয়েই ছেলেটার আজ এই অবস্থা! অর্জুন একবারও আজ নিজের কথা ভাবেনি। শুধু সৌমীর ভালো খারাপ চিন্তা করে গেছে। সেই সময় হসপিটালে পার্থ আর ওর ফ্যামিলিও এসেছিল। কিন্তু সৌমী এই মুহুর্তে নিজে থেকেই পার্থকে বলে উঠেছিল,
———” আই অ্যাম সরি.. কিন্তু আমি তোমাকে বিয়েটা করতে পারবো না। আমি ভালোবাসি অর্জুনকে। এতদিন ধরে অনেক মিথ্যা বলেছি নিজেকে। কিন্তু আর সম্ভব না। ”
কথাগুলো বলতে বলতে সৌমীর চোখে জল চলে এসেছিল। কিন্তু পার্থ এই মুহূর্তে নিজের মনেই বলে উঠেছিল,
———” শুধু তুমি অর্জুনকে না, অর্জুনও তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে। নইলে ওইভাবে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারতো না। ইউ গাইজ ডিসর্ভ টু বি উইথ ইচ অদর.. আমাদের বিয়েটা হলে অনেক বড় ভুল হয়ে যেত। ”
কথাগুলো বলে পার্থ আর দাঁড়ায়নি। বেরিয়ে গিয়েছিল হসপিটাল থেকে।
এরপর চব্বিশ ঘন্টা সৌমী অপেক্ষা করেছিল হসপিটালে। কখন অর্জুনের জ্ঞান ফিরবে! রুক্মিণী তো এই সময় নিজেকে সামলাতে পারছিল না কিছুতেই। অর্জুনকে এইভাবে আই.সি.ইউ তে দেখে বুক কাঁপছিল ওর। ছেলেটা এই কদিন কম কষ্ট তো পায়নি! সৌমীর এই বিয়েটা তো ওকে শেষ করে দিয়েছিল ভিতরে ভিতরে। কথাগুলো বার বার মনে হচ্ছিল। নন্দিনী এই সময় রুক্মিণীর সাথে ছায়ার মতন ছিল। বার বার বুঝিয়ে যাচ্ছিল, কিচ্ছু হবে না অর্জুনের। ঠিক ফিরে আসবে ও। খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে।
এইভাবেই একটা গোটা দিন পার করে অবশেষে অর্জুনের জ্ঞান ফিরেছিল পরেরদিন সন্ধ্যেবেলা। ডাক্তার এসে এটা জানিয়ে বলেছিল যে কেউ একজন এখন অর্জুনের সাথে দেখা করতে পারবে। সেই সময় রুক্মিণী নিজে থেকেই বলে উঠেছিল সৌমীকে,
———-” তুই যা প্রথমে। এখন তোকেই ওর সব থেকে বেশি দরকার। ”
এই কথাটায় সৌমী কিছু বলতে পারেনি। স্থির পায়ে এগিয়ে গিয়েছিল অর্জুনের কেবিনে। এই সময় অর্জুন ভীষণ ক্লান্ত শরীরে শুয়ে ছিল চোখ বন্ধ করে। ওর হাতে মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। সৌমীর এই দৃশ্য দেখেই চোখ দুটো ভিজে এসেছিল। ও আলতো পায়ে এবার অর্জুনের কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর কপালে হাত ঠেকিয়ে ছিল। অর্জুন এই সময় সৌমীর স্পর্শে চোখ খুলে তাকিয়েছিল। ও সৌমীকে দেখেই ভীষণ অস্থির হয়ে বলেছিল,
———-” তুমি ঠিক আছো তো? কোথাও লাগেনি তো? ”
এই কথায় সৌমী কিরকম থমকে গিয়েছিল। এতটা যন্ত্রণার মধ্যেও অর্জুন শুধু ওর কথা ভেবে যাচ্ছে! কথাটা ভেবেই সৌমী অর্জুনকে শান্ত করে বলেছিল,
———-” তুমি প্লিজ আর এইসব নিয়ে ভেবো না। আমি ঠিক আছি। ”
এই কথায় অর্জুন যেন কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিল। কিন্তু এবার সৌমী অর্জুনের হাতটা শক্ত করে ধরে বলেছিল,
————” আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ মনে হয়েছিল সব কিছু শেষ হয়ে যাবে! ”
এই কথায় অর্জুন স্থির স্বরে বলেছিল,
————” আমাদের মধ্যে তো এমনিতেও সব কিছু শেষ। ”
কথাটা শুনে সৌমী অর্জুনকে থামিয়ে বলেছিল, ———–” কিচ্ছু শেষ হয়নি আমাদের। পুরো গল্পটাই বাকি। আমি বিয়েটা ভেঙে দিয়েছি অর্জুন। ”
এই কথায় অর্জুন ভীষণ অবাক হয়ে বলেছিল,
———-” কি! তুমি বিয়ে ভেঙে দিয়েছ! ”
কথাটায় সৌমী ভেজা স্বরে বলেছিল,
———-” হ্যাঁ। আমার পক্ষে সম্ভব না আর নিজেকে মিথ্যে বলা। আমি ভালোবাসি তোমাকে। কাল তুমি সেন্সলেস হয়ে যাওয়ার পর আমার সবটা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ মনে হয়েছিল তোমাকে হারিয়ে ফেলছি! ”
কথাগুলো বলতে বলতে সৌমী কেঁদে ফেলেছিল। এই সময় অর্জুন সৌমীকে শান্ত করার জন্য ওকে আলতো করে জড়িয়ে ধরেছিল নিজের মধ্যে। তারপর আলতো স্বরে বলেছিল
———-” কিচ্ছু হয়নি আমার। ঠিক আছি একদম আমি। ”
এই কথায় সৌমী নিজের মনেই বলে উঠেছিল,
———-” আরেকবার শুরু করা যায় না? নতুন করে? আমাদের দুজনের গল্প। ”
কথাটা শুনে অর্জুনের মুখে আলতো হাসি। ও আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল সৌমীকে। মনে হয়েছিল অনেকদিন বাদে বুক থেকে যেন একটা বড় পাথর নামলো। কাউকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণাটা শেষ হলো অবশেষে। কথাটা ভেবেই ও সৌমীর কপালে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়েছিল সেই মুহূর্তে। নিঃশব্দে বোঝাতে চেয়েছিল ভালোবাসি।

আমাদের জীবনের গল্পগুলোও হয়তো এরকম! যেখানে মনে হয় শেষ, সেই মুহূর্ত থেকেই হয়তো একটা নতুন শুরু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। বাস্তবের ভিড়েও রূপকথারা লুকিয়ে আছে।
( সমাপ্ত )