মন বলেছে পর্ব-০২

0
50

#মন_বলেছে
#তাহিরাহ্_ইরাজ

[২]

নিশিরাত। আসমানে ঝলমলে চাঁদ। নিজ ঘরে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে শয়ন। বালিশে ঠেকিয়ে রাখা তার দামী স্মার্টফোনটি। ভিডিও কলে একমাত্র পরানের টুকরোর সঙ্গে খোশগল্পে লিপ্ত সে। সহসা শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছালো অভব্য কণ্ঠস্বর,

” শোয়াইন্না। অ্যাই শোয়াইন্না। ”

নিজের নামের এমন চরম সর্বনাশ শুনে এক লাফে উঠে বসলো শয়ন। অনুসন্ধানী চোখ দু’টো মার্বেলের মতো তিড়িং বিড়িং এদিক ওদিক ঘুরিয়ে নিলো। কোথা থেকে তার এমন সুন্দর, অর্থবহ নামের শ্রাদ্ধ করা হচ্ছে?

” অ্যাই শোয়াইন্না। শোয়াইন্না। কোথায় মুখ লুকিয়ে আছেন? সামনে আসুন বলছি। আমি কিন্তু… ”

ওরে বাবা গো। ইফানা’কে কষ্ট করে আর শব্দ খরচ করতে হলো না। একদম আকস্মিক ভূতের মতো চোখের ঠিক সামনেই হাজিরা দিলো শয়ন। মুখোমুখি, কলিজা লাগালাগি করে তাদের জানালা দু’টো। ফলস্বরূপ রাতবিরেতে গলাকা’টা ভূত দেখার মতো আঁতকে উঠলো মেয়েটা। ভয়ার্ত অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বুকে মিথ্যে থু থু ছিটিয়ে বড় করে এক শ্বাস ছাড়লো। প্রাণ বায়ুটা আরেকটু হলেই বোধহয় টাটা বাই বাই হতো। এভাবে কেউ হুট করে উদয় হয়? বোধবুদ্ধিহীন লোক একটা। শয়ন তো ক্যাটক্যাটিয়ে হাসছে। কোনোমতে হাসি চেপে কৌতুকপূর্ণ কণ্ঠে বলে উঠলো,

” কি গো! তোমার আর বোধবুদ্ধি হলো না বলো। রাতবিরেতে এভাবে কেউ কলিজার নেইবারকে ডাকে? একদম কলিজায় লাগে যে। এই যে এখানে। ”

বুকের বাঁ পাশে হাত দিয়ে কলিজার ভুল ঠিকানা দেখাচ্ছে শয়ন। ইফানা চোখমুখ খিঁচে বললো,

” আপনার এই আহ্লাদে কলিজা কেটে কালা ভুনা করা দরকার। এত ঢঙ পারেন কি করে? বিরক্ত লাগে না? ”

শয়ন মনোমুগ্ধকর এক হাসি উপহার দিলো,

” না গো। লাগে না। ”

” অ্যাই মিয়া কথায় কথায় এত গো গো করবেন না তো। কিসের এত গো? আমি কি আপনার বউ লাগি? ”

ইফানা কোমরে দু হাত স্থাপন করে দাঁড়িয়ে। নাকের ডগায় এক টুকরো লালিমা। পড়নে তার সুতির লং টপস্ এবং পাটিয়ালা প্যান্ট। ওড়নায় আবৃত চুল, দেহের উর্ধাংশ। শয়ন দৃষ্টি হটিয়ে প্রসঙ্গ বদলাতে বললো,

” পুঁচকে মেয়ে অপ্রাসঙ্গিক কথা বাদ দাও তো এবার। এটা বলো যে রাতদুপুরে আমার নামের পিণ্ডি চটকাচ্ছিলে কেন? কি হয়েছে? ”

ইফানার এবার চট করে আসল কথা মনে পড়লো। এই রে। সে তো আসল কথা ভুলে এতক্ষণ ভুল লাইনে চলছিলো। ধ্যাৎ! তৎক্ষণাৎ ইফানা জবাবে বললো,

” হ্যাঁ। এবার মনে পড়েছে। ”

শয়ন একগাল হেসে বলল,

” কি মনে পড়েছে গোওও? ”

‘গো’ শব্দে জোর দিয়ে বললো ছেলেটা। ইফানা চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো,

” ফাউল লোক একটা। ”

” শুধু তোমারই জন্য। ” জনপ্রিয় গানটার সুর তুলে বেসুরো গলায় গেয়ে উঠলো শয়ন।

ইফানা আঙ্গুল তাক করে বলে উঠলো,

” আপনি…! ”

রাগটা চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে নিলো মেয়েটা। কোনোমতে মাথা নেড়ে একটুখানি, সামান্য একটুখানি শান্ত হলো। আঙ্গুল নামিয়ে বললো,

” আপনি রনিকে কি করেছেন? বাচ্চা ছেলেটা মারাত্মক ভয় পেয়েছে। ঠিক কতক্ষণ কেঁদেছে জানেন? ”

” ওলে বাবা লে। বাবুটা ভয় পেয়েছে? ভয় পেয়ে চৌদ্দ গুষ্টিতে বিচার তো ঠিকই দেয়া হয়ে গেছে। তা কি করেছি আমি? যেটা স্বয়ং আমি নিজেই জানিনা? ”

” একদম নাটক করবেন না শয়ন ভাই। আপনি যে কি চিজ সেটা আমার খুব ভালো করেই জানা আছে। ”

” তো খেয়ে নাও। ”

” কিহ্? ”

হতবিহ্বল নজরে তাকিয়ে ইফানা। ঠিক বোধগম্য হলো না কথাটা। শয়ন দুষ্টুমির হাসি উপহার দিয়ে আরো কাছে এলো নিজ জানলার। চোখে চোখ স্থির দুজনার। মধ্যবর্তী দূরত্ব আরো ক্ষীণ। ফিসফিসিয়ে বললো শয়ন,

” খেয়ে নাও। চি–জ পিজ্জা। ”

ইফানা রাগে গজগজ করছে একদম। একটা লোক। একটা লোক এতটা ফালতু ঠিক কি করে হতে পারে? হাউ ম্যান? হাউ?? ইফানার এই রাগান্বিত বদন, আরক্ত মুখভঙ্গি সবটাই বিনোদন দিচ্ছে শয়নকে। মিটিমিটি হাসছে ছেলেটা। বিনিময়ে ইফানা হুমকি বার্তা শুনিয়ে দিলো ওকে,

” আপনি না রনি থেকে শত হাত দূরে থাকবেন। বাচ্চা একটা ছেলে। আপনার আতঙ্কে দিনে দিনে শুকিয়ে পাটকাঠি হয়ে যাচ্ছে। ”

” হা হা হা। হাসালে গো। তোমার কলিজার টুকরা ভাতিজা হাতি ছিলইবা কবে? যে এখন শুকিয়ে পাটকাঠি হচ্ছে? হা? ওটা তো জন্মসূত্রে শুঁটকি। ”

” ও.. ও শুঁটকি হলে আপনি কি? আপনি তো আস্ত এক জলহস্তী। খায়দায় আর খালি ভুসভুস করে ঘুমায়। অসহ্যকর! ”

আর কথা না বাড়িয়ে মুখ ঝামটা মে’রে জানলায় পর্দার আস্তরণ টেনে দিলো ইফানা। আড়াল হলো শয়ন। ইফানা জানালা হতে সরে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে শ্রবণ পথে পৌঁছাচ্ছে নাটুকেপনা,

” ওগো লেডি জলহস্তী! কোথায় যাচ্ছো একাকী ছেড়ে? দেখা দাও না। দাও না গো। ”

রবির মিঠে কিরণে আলোকিত ধরিত্রী। ছুঁয়ে যাচ্ছে দেহমন। বিশাল বড় জায়গা জুড়ে অবস্থিত সে উদ্যান। গাছগাছড়ায় ভরা। গাছের পাতার ফাঁক গলিয়ে মাটি ছুঁয়ে রয়েছে রোদ্দুর। বিভিন্ন শ্রেণী পেশার লোকজন জমায়েত হয়েছে সেখানে। বেশিরভাগ মাঝবয়সী এবং বয়স্ক লোক। তরুণ প্রজন্মের ছেলেপেলেও রয়েছে অবশ্য। এখানে আগত মানুষগুলোর মূল উদ্দেশ্য একটাই। শরীরচর্চা বা ব্যায়াম। উদ্যানের একাংশে পাতলা ম্যাট পেতে ইয়োগা ( Yoga ) করছে কেউ কেউ। কেউ আবার দুর্বল শরীরে জগিং করতে দৌড়ে চলেছে গোল গোল করে উদ্যান জুড়ে। কোথাও কোথাও একসাথে বেশ কয়েকজন জমায়েত হয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে গল্পের আসর বসিয়েছে। এতসব লোকের ভীড়ে উল্লেখযোগ্য দুই বয়স্ক ব্যক্তি। অলিউল সাহেব এবং মোতালেব সাহেব। দু’জনের বয়স একদম পিঠাপিঠি। ৮২ ও ৮৩. যথেষ্ট বয়স হয়েছে তাদের। তবে এখনো যথেষ্ট বলবান এই দুই বুড়ো। লাঠি হাতে ঘুরে বেড়ায়। হাঁটতে পারে না ঠিকঠাক গতিতে। তবুও ভাব দেখাতে সকাল সকাল জগিংয়ে হাজির। দু’জনেই ওয়াকিং স্টিকের সহায়তায় চলাফেরা করেন। লাঠি দুটোর ডিজাইনও একদম সাদৃশ্যপূর্ণ। হুবহু এক।

এই মুহূর্তে জন দশেকের সঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দুই বুড়ো। সকলে তাদের নির্দেশক এর নির্দেশক্রমে শরীরচর্চা করে চলেছে।

‘ ওপরে হাত ওঠাও। ‘

নির্দেশ পেতেই সকলে তৎক্ষণাৎ দুই হাত ওপরে তুললো। অলিউল সাহেব লাঠি নিয়েই ওপরে হাত তুললেন। এতে জমিনে ভারসাম্য বজায় রাখা কিছুটা মুশকিল হয়ে গেল। ওনার এমন কাণ্ড দেখে নিঃশব্দে হেসে উঠলেন মোতালেব সাহেব। নিজের ওয়াকিং স্টিক দেহের সঙ্গে হেলান দিয়ে হাত তুললেন উনি।

‘ ডানে নাও। ‘

নির্দেশ পাওয়া মাত্র সকলে তাদের ডান হাত, ডান দিকে ছড়িয়ে দিলো। এতেই ঘটলো বিপত্তি। অলিউল সাহেবের ডান হাতটা বেঘোরে আঘাত খেলো মোতালেব সাহেবের দেহে। তৎক্ষণাৎ তেঁতে উঠলেন মোতালেব সাহেব,

” এই বুড়ো! আমাকে মা`রলে কোন সাহসে? ”

অলিউল সাহেব হতবাক!

” আমি? আমি মা’রলাম কোথায়? হাতটা সামান্য লেগেছে এতেই মা’রা হয়ে গেল? ”

” কি? সামান্য লেগেছে? আমার বাম হাতটা ফুঁটো করে ছেড়েছো আবার মিথ্যা বলা হচ্ছে? ”

অলিউল সাহেব হেসে উঠলেন একথা শুনে।

” অ্যাই বুড়ো। তোমার ওটা ব্যাডা মাইনষের শরীর না তুলার বস্তা? সামান্য গুঁতো লাগতেই ফুটো? হা হা হা। ”

সঙ্গী বাকিরা এতক্ষণ হতাশ নয়নে এদের রোজকার নাটক দেখছিল। সহসা অলিউল সাহেবের কথা শুনে বাকিরাও হো হো করে হেসে উঠলো। মোতালেব সাহেব রেগে গেলেন এতে। তেড়ে মে’রে একদম সন্নিকটে দাঁড়ালেন। অলিউল সাহেব বিন্দুমাত্র দমে গেলেন না। চোখে চোখ স্থির রেখে বললেন মোতালেব সাহেব,

” ক্ষমা চাও। ”

” কেন? অপরাধ কি? ”

” আমাকে আঘাত করেছো। ”

” অনিচ্ছাকৃত ছিল। অতটাও জোরে লাগেনি। ”

” লেগেছে। ব্যথা পেয়েছি। ”

” তো মলম লাগাও ভাইইই। ”

বলেই ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে আরেকদিকে হাঁটা আরম্ভ করলেন অলিউল সাহেব। পেছন হতে ক্ষ্যা’পা ষাঁড়ের মতো ফোঁস ফোঁস করছেন মোতালেব সাহেব,

” অ্যাই বুড়ো অ্যাই। ক্ষমা না চেয়ে কোথায় পালানো হচ্ছে? বুড়ো বদ একটা। ক্ষমা চাও বলছি। ”

কে শোনে কার কথা? অলিউল সাহেব ততক্ষণে পগার পা। মোতালেব সাহেব বৃদ্ধ দু পায়ে তাড়াও করেছিলেন কয়েক কদম। তবে লাভের লাভ তো হলোই না। উল্টো ওনার বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শরীরটা মারাত্মক হাঁপিয়ে উঠলো। বাবা রে! কি দৌড় করালো বুড়োটা! উফ্! শ্বাস লাফালাফি করছে যেন। জোরে জোরে শ্বাস প্রশ্বাস নিলেন মোতালেব সাহেব। অতঃপর পিছু ঘুরে ওনার শরীরচর্চা সাথীদের বললেন,

” দেখলে তোমরা দেখলে। বুড়োটা কিভাবে আমাকে মে’রে পালিয়ে গেল। দেখলে? ”

কে কি দেখবে ভাই? হতাশ, বিরক্ত হয়ে পাবলিক এতক্ষণে নিজ নিজ কামে পা দিয়েছে। এই দুই বুড়োর রোজকার নাটক আসলেই হতাশার। দু’টো একসাথে হলেই হাউকাউ বেঁধে যায়। একজন আরেকজনকে দেখতেই পারে না। আল্লাহ্ জানেন কিসের এত দ্বন্দ্ব এদের? এতই যখন দ্বন্দ্ব তখন ঘুরেফিরে এক জায়গাতেই মেলে কেন? দূরত্ব বজায় রাখতে পারে না? একই প্রশ্ন তাদের আশপাশে বসবাসরত প্রতিটি জীবের। তবে অজানা উত্তর।

ডুবন্ত এক অপরাহ্ন। আকাশের বুকে লালচে রঙা আদর। কলোনির খেলার মাঠে সমাগম হয়েছে প্রায় পনেরো বিশেক আণ্ডাবাচ্চা। নিজেদের মতো খেলছে তারা। কেউ ক্রিকেট তো কেউ অন্য কোনো খেলা। দশ, বারো বছর বয়সী বাচ্চারা মিলে ক্রিকেট খেলছিল। স্বল্প দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছোটোখাটো ফ্রক পড়ুয়া আদুরে অবয়বের গুলুমুলু দেখতে পিচ্চি রিনি এবং তার তিনজন বান্ধবী। বড় ভাইয়াদের খেলা বেশ উপভোগ করছে তারা। ক্রিকেট এর ‘ক’টাও না বোঝা বেবিসেটগুলো চারছক্কা হৈ হৈ দেখে লম্ফঝম্প দিচ্ছে। হাততালি দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। রনি বেশ কিছুক্ষণ ধরে নিজের খেলা বাদ দিয়ে এ লক্ষ্য করে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে উপলব্ধি হয়েছে তার। গাপ্পেন ওর ক্রিকেট খেলা বেশ এনজয় করছে। বাহ্। খুশির খবর। এই তো সুবর্ণ সুযোগ। রিনি সোনাটার সোনার চেয়েও দামী মনটা আরো একবার জয় করার। নিজের ভাবনায় নিজেই গর্বিত হলো রনি। দাঁত কেলিয়ে আগত মূহুর্ত কল্পনা করে হেসেও নিলো। অতঃপর হাফ শার্টের কলার এভারেস্ট’সম উঁচু করে মস্ত এক সোয়্যাগ নিলো। হেলেদুলে এলো বড় ভাইদের নিকটে। সে কি হাঁটার স্টাইল! আহা হা! সাউথের প্রভাস, মহেশ বাবু ফেল। ডাহা ফেল। রনি এসে দাঁড়িয়েছে। গলা ঝেড়ে ভাইদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলো। ও মা গো। এতে হলোটা কি? এক বড় ভাই বল হাতে বিরক্তিকর অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বললো,

” ওই রনি। কাকতাড়ুয়ার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে সরে দাঁড়া। বল করবো। ”

রনি আচানক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। বড় ভাই এসব বলছে কি? সে খেলতে এসেছে। কাকতাড়ুয়া হতে নয়। রিনি তো গোল গোল চোখে তাকিয়ে তার একান্ত বপ্পেনের দিকে। বপ্পেন! সে এখানে খেলার মাঝখানে কি করছে? রনি নিজ ভাবনায় ডুবে। সরছে না দেখে ব্যাটার ভাইটা ওকে ধমকে দিলো,

” এই রনি। সর তো সামনে থেকে। ”

চকিতে হুঁশ ফিরলো রনির। হাসি হাসি মুখ করে বললো সে,

” ভাইয়া আমাকেও নেও না। আমিও খেলবো। ”

বড় ভাইয়েরা একযোগে হেসে উঠলো। যেন শতাব্দী সেরা জোকসটা মাত্র শুনলো তারা। এদের হাসিতে রনি কেমন অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। মৃদু কণ্ঠে বললো,

” আমিও খেলবো। ”

” অ্যাই কি খেলবি রে তুই? এটা তোর ওই দৌড়ঝাঁপ নয়। ক্রিকেট খেলা। বুঝলি ক্রিকেট। খেলতে জানিস? ”

আমসক্তের মতো মুখটা শুকিয়ে এতটুকু হলো। রিনি পানে তাকিয়ে দেখলো রিনি ছোট ছোট মায়াবী চোখে এদিকেই তাকিয়ে। রনি এক বুক সাহস সঞ্চয় করে গর্বিত কণ্ঠে বললো,

” হ্যাঁ, আমি খেলতে পারি। জানি। ”

বড় ভাইরা কথাটা শুনে কেমন ব্যঙ্গাত্মক হাসলো। বোলার ভাইটা ব্যাটারকে বললো,

” ওই শফি, ব্যাটটা একে দে তো। আমিও দেখি কতদূর ছক্কা হাঁকাতে পারে। ”

সশব্দে হেসে উঠলো ক্রিকেট খেলতে থাকা বড় ভাইয়েরা। রনি সেসবে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। সে ক্রিকেট খেলবে যে। আরো একবার শিশু প্রিয়তমার মনটা জয় করে নেবে। রনি খুশিমনে অগ্রসর হলো। ব্যাটার ওর হাতে তুলে দিলো ব্যাট। ওরে বাবা! ব্যাটের ভারে অর্ধেক নুয়ে গেল বাচ্চা ছেলেটা।

” হা হা হা। ”

হেসে উঠলো বাকিরা। রনি বোকা হাসি উপহার দিয়ে ব্যাটটা হাতে নিলো সর্বোচ্চ শক্তি খরচ করে। চেহারা বিকৃত হয়ে যাচ্ছে ব্যাটের ভারে। ধুর ব্যাঙ। এতো ভারী কেন?

ব্যাট হাতে প্রস্তুত আমাদের রনি মিয়া। একঝলক তাকালো রিনি সোনার দিকে। রিনি উৎসুক দৃষ্টিতে ওর দিকেই তাকিয়ে। চওড়া এক হাসি উপহার দিলো রনি। রিনিও হালকা হাসলো। লাজে রাঙা বধূ হয়ে যাচ্ছে বাবুটা। কি যে শরম! রনি দ্য ব্যাটার প্রস্তুত। বল হাতে দুর্নিবার গতিতে ছুটে আসছে বোলার। এসেছে এসেছে একদম সন্নিকটে এসেছে। ছুঁড়ে মে`রেছে বল। দুরুদুরু বুকে ব্যাট সজোরে চালিয়ে দিলো রনি। ও মা! বল ব্যাটে তো লাগেই নি। পাশ কাটিয়ে একটুর জন্য স্ট্যাম্পে আঘাত করতে যাচ্ছিল। হয়ে যেতো আউট। ওদিকে বেচারা ব্যাট! ডানাকাটা ব্যাট… উড়ছে আকাশে। নিজের এমন শোচনীয় পারফরম্যান্সে লজ্জায় লাল হয়ে গেছে রনি। সকলের বিদ্রুপাত্মক হাসিতে টলমলে অক্ষিযুগল।

” বলদ! ”

” কিচ্ছু পারে না। ”

” এসেছে আবার ক্রিকেট খেলতে। ”

” বলের বদলে ব্যাটই ছক্কা মে°রেছে। হা হা হা। ”

” হা হা হা। ”

বড় ভাইরা একেকজন একেকরকম মন্তব্যের মাধ্যমে ব্যঙ্গ করছে ওকে। রনির শিশুসুলভ, সরল মনটা আর সহ্য করতে পারলো না। এক ছুটে দৌড়ে পালালো সেই মাঠ হতে। কাঁদতে কাঁদতে পালিয়েছে বাচ্চাটা। গাপ্পেন রিনি অসহায় চোখে তাকিয়ে। খুব জোরসে কান্না পাচ্ছে তার। বপ্পেনের মনটা খারাপ কেন? খুব কষ্ট পেয়েছে কি সে?

তমসাচ্ছন্ন রাত্রি। উন্মুক্ত জানালা গলিয়ে কক্ষে প্রবেশ করছে চাঁদের মোহনীয় দ্যুতি। ছিমছাম, পরিপাটি সে কক্ষটি। ঘরের মাঝ বরাবর ডাবল বেড। সুন্দর এক বিছানা বিছিয়ে রাখা সেথায়। বেডের ডান পাশে বিশালাকার জানলা বরাবর স্টাডি টেবিল। টেবিল হতে স্বল্প পাশে কাবার্ড। দেয়ালের বাম পাশে পাশাপাশি অবস্থিত বড়সড় দু’টো বই ভর্তি বুকশেলফ। তার পাশে ড্রেসিং টেবিল। দরজার পাশে অবস্থিত ওয়াশরুম। দেয়ালে দেয়ালে কৃত্রিম ক্ষুদ্রাকৃতির গাছ দৃশ্যমান। রয়েছে ওয়াল পেইন্টিং। গোলাপী থিমে সজ্জিত এই পরিপাটি কক্ষটি। দেখলেই বোঝা যায় এটা কোনো পড়ুয়া মেয়ের ঘর।

বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে বসে ইফানা। হাতে জীববিজ্ঞান দ্বিতীয় পত্র বইটি। মনোযোগের সহিত বইয়ে মগ্ন সে। শ্যাম মুখশ্রীতে গাম্ভীর্যের ছাপ। পড়ার সময় একটুও অমনোযোগীতা সহ্য নয় তার। পড়ছিল মেয়েটি। মাঝেমধ্যে বিছানায় রাখা খাতায় কিছু নোট করে নিচ্ছিল। খচখচ করে চলছিল কলম। ঠিক তখনই….

চলবে।