#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ .
#পর্বসংখ্যা_১২ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .
দম ফুরিয়ে আসছে। বুকে প্রচণ্ড চাপ লাগছে। চোখের দৃষ্টিও ঘোলা-ঘোলা। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গ যেন ব্যথায় মশগুল। মেহনূর যাওয়ার পর স্বস্তি পাচ্ছে না। অব্যক্ত যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে মাহমুদা। চিৎকার করে কাউকে ডাকার অবস্থা শূন্য। সমস্ত শরীর ব্যথা, গলা রুক্ষ, কণ্ঠনালী শুষ্ক। ক্যান্সারের জীবানু দেহের সর্বত্র যেন ছড়িয়ে গেছে। এখন আগের মতো স্বাভাবিক নেই। টপটপ করে চোখের কোণ বেয়ে পানি ঝরছে। ঘনিয়ে আসছে সময়। নাস্তার ট্রে নিয়ে দরজা ঠেললো সাবা। হাসিমুখে ভেতরে ঢুকতেই থমকে গেলো সে। বিছানার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হাতের ট্রেটা প্রচুর ঠকঠক করে কাঁপছে। এক চিৎকার দিয়ে সবাইকে ডাকতে নিলো, চিৎকারের জন্য মুখও খুললো, কিন্তু অবস্থা দেখে থেমে গেলো সাবা। দ্রুত ট্রেটা নিয়ে টেবিলে রাখলো সে। বিছানায় বসে ত্রস্তভঙ্গিতে মাথায় হাত ছুঁয়ে বললো,
– ছোটমা, ছোটমা খুব লাগছে? হঠাৎ কি হলো? ছোটমা চোখ খুলুন। বন্ধ করবেন না। আমি.. আমি এক্ষুণি আম্মাকে ডেকে আনছি। ছোটমা শুনতে পাচ্ছেন তো? ও ছোটমা দয়াকরে —
অবস্থা বেগতিক! সাবা কথা শেষ করলো না। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব দ্রুতবেগে ঘর থেকে বেরুলো। এবার সত্যি-সত্যিই চিৎকার দিয়ে সবাইকে ডাকলো। অস্থির কন্ঠে গলার স্বর উঁচিয়ে সুজলাকে ডাকলো,
– আম্মা, তাড়াতাড়ি বের হও। ঘর থেকে বের হও!
সাবার উচ্চকন্ঠ শুনে সুজলা ভারী চমকে গেলেন। এমন করে তো সাবা কখনো ডাকে না। কোনোদিন গলা উঁচাতে দেখেনি। বিপদের আশঙ্কা বুঝে তাড়াতাড়ি চোখ থেকে রিডিং-গ্লাসটা খুললেন। দ্রুত মাথায় ঘোমটা টেনে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ভ্রুঁ কুঁচকে সাবার দিকে তাকাতেই অশনি ভয়ে শুধালেন,
– কিছু হয়েছে? ওমন করে গলা ফাটাচ্ছিস কেন?
সাবা অস্থির ভঙ্গিতে মায়ের দিকে তাকালো। ওর কপাল-মুখ ঘেমে একাকার। দু’দফা শঙ্কার ছাপ চোখের মনিতে স্পষ্ট। রান্নাঘর থেকে ছুটে এলো শেফালি। হাতদুটোতে মাছ কুটার এঁটো। সাবাকে অদ্ভুতভাবে কাঁদতে দেখে ব্যস্তভাবে জিজ্ঞেস করলো,
– ওই ছেড়ি চিল্লাস ক্যা? ভালা কইরা আসল কথা ক। কপালের ঘাম মুছি নে।
সাবা দ্রুত ঢোক গিললো। কপালটা ব্যতিব্যস্ত কায়দায় মুছতেই মাহতিম চলে এলো। সিঁড়ি দিয়ে দ্রুতবেগে নামতেই কৌতুহল চোখে তাকালো। সাবা ডানহাতের উলটোপিঠে চোখ ডলতেই ভীতকণ্ঠে বললো,
– ছোটমার অবস্থা ভালো না। শ্বাসকষ্ট..শ্বাসকষ্ট উঠেছে। হাত-পা দাপাচ্ছে। আমি খাবার দিতে গিয়ে —
কথাটা শেষ করতে পারলো না। পুরো কথা শেষ না করতেই মাহতিম ঝড়ের বেগে দৌঁড় দিয়েছে। ধাম্ করে দরজা খুলে ঘরের ভেতর ঢুকেছে। শেফালিও কোনোকিছু পরোয়া করলো না। মাছের এঁটো হাতেই ‘ হায় আল্লাহ্ ‘ বলে চিৎকার মেরে উঠলো। সাবার কথাগুলো কর্ণগোচর হতেই সুজলা বিস্ফোরণ চাহনিতে থম মেরে গেলেন। ডানহাতের মুঠো থেকে রিডিংগ্লাসটা থপ্ করে পরে গেলো। চর্তুদিকের সবকিছু বানোয়াট, মিথ্যা, ভেলকিবাজি মনে হলো। সত্য-মিথ্যার দোলাচলে তিনি যেন বোধশক্তি হারিয়ে ফেলছেন। যেই সংসারটা তিন বউ মিলে গড়লেন, তিন নারীর হাতে ঠুনকো সংসারের আনন্দলীলা ফুটলো, ত্রয়ীর পরিচালনায় সমস্ত দুঃখ-কষ্ট লাঘব হলো, আজ সেই ত্রয়ীতে বিচ্ছেদের গ্রাস হানলো। সুজলা ধীরে-ধীরে পা ফেলে কাঙ্ক্ষিত ঘরে গেলেন। কানে হৈচৈ-শোরগোলের মাতম চলছে। দরজার সীমানা ডিঙিয়ে প্রবেশ করলেন ঘরে। চোখ ফেললেন বিছানার দিকে। শেফালি সেখানে বিছানায় মুখ গুঁজে মেঝেতে বসে আছে। সাবার কোলে মাহমুদার রুগ্ন মাথা। মাহতিমের দু’হাতে রুগ্ন দুখানা হাত। সুজলা পা টিপে-টিপে খুব কাছে আসলেন। মাহতিম কিছুটা সরে বসতেই সুজলা শান্তভাবে বসলেন। মাহমুদা ফ্যাকাশে চোখে তাকিয়ে আছে। আদৌ স্পষ্টভাবে দেখছে কিনা কে জানে। সুজলা হাত বাড়িয়ে মাহমুদার চিবুক ছুঁয়ে বললেন,
– ডাক্তার এসে যাবে ছোটবউ। কোনো চিন্তা কোরো না। নাতী-নাতনীর ঘরটা দেখে যেতে হবে না? এভাবে চলে গেলে চলবে? এতোদিন ধৈর্য্য ধরেছো, আর কটা দিন সবুর করো। তোমার মেয়েকে আমার কাধে কেন ঝুলাচ্ছো? ঝুলিয়ে যেও না। আমি কি এতো শক্ত আছি? দেখোনা বয়স বেড়ে গেছে? আজ ছুঁড়ি থেকে বুড়ি হয়ে গেছি। তুমিও যদি আমার কাধে দায়িত্বের বোঝা চাপাও, আমি একা-একা আর কতো দেখবো?
মায়ের কথা শুনে সাবা ঠোঁট কামড়ে কেঁদে ফেললো। শেফালি এখনো বিছানা থেকে মুখ গুঁজে আছে। ঘোমটা দেওয়া মাথাটা দমকে-দমকে কাঁপছে। হাতদুটো মেঝেতে ফেলে রেখেছে। মাছের আঁশটে গন্ধ নাকে লাগছে। খোলা জানালা দিয়ে হুরহুর করে এক পশলা বাতাস এলো। দূরের কোনো পুষ্পকুন্ঞ্জ থেকে মিষ্টিমধুর গন্ধ টেনে আনলো। মৃত্যুপুরীর চারিদিকে অবলীলায় ছড়ালো। মাহতিম শান্ত হয়ে আছে। হাতের মুঠোয় মাহমুদার কঙ্কালসার হাতদুটো স্নেহার্দ্রে বুলাচ্ছে। বিয়ের পর থেকে আজ অবধি শ্বাশুড়িকে রাগতে দেখেনি। মনেও পরে না কোনোদিন উচ্চস্বর শুনেছে। এতো আস্তে-আস্তে কথা বলতো যে, কোনো পাষাণও যদি তার কথা শুনতো, তবে পাষণ্ডের মনটাও বুঝি মোমের মতো গলে যেতো। চরিত্রের বিচারে কোনোদিন ঝগড়া করতে দেখেনি। রুক্ষ মেজাজে থাকেনি। কারোর প্রতি আক্ষেপ করেনি। এক টুকরো পবিত্র হাসি সবসময় ঠোঁটে থাকতো। যতবার মাহতিম কাছে আসতো, কথা বলতে এগিয়ে যেতো, মাহমুদা মিষ্টি হাসিতে কপালে-মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করতো। যেদিন শুনতে পেলো মাহমুদা ভয়ানক অসুখে আক্রান্ত, সেদিনই চোখের পাতা ভারাক্রান্ত হয়ে বুজে এলো। এমন নরম মনের মানুষটার এই পরিণতি হবে, মাহতিম যেন মানতেই পারেনি। অনেকভাবে চেষ্টা করেছে মানুষটার আরোগ্য লাভের জন্য। নানাভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে বিদেশি ডাক্তারদের খোঁজ নিয়েছে। কিন্তু, সবার মুখে সেই একটাই কথা, রোগী মিরাকেল ছাড়া বাঁচবে না। তবুও তো হার মানেনি। টাকা থেকে শুরু করে যা প্রয়োজন, সবই সাধ্যমতো দিয়েছে। আজ সবকিছুর পরিপন্থীতে এরকম অবস্থা দাঁড়াবে কে জানতো? মাহতিম নিরব চাহনিতে তাকালো। হাসি দিয়ে বললো,
– আপনি আমাকে ঠকিয়ে দিলেন। আমার সৌভাগ্যের খাতায় জামাই আদরটা জুটলো না। আপনার হাতে জামাই আদরটা দিলেন না মা। এ বাড়িতে তিনবার আসার সুযোগ হলো। প্রথমবার এসেছিলাম আপনার বাড়ির অতিথি হয়ে। দ্বিতীয়বার আসলাম জামাই হিসেবে। কিন্তু, এইবার যে আপনি ধোঁকা দিবেন, বুঝতে পারিনি। যদি জানতাম আপনার মনে-মনে এমন গুবলেট চলছে, তাহলে কাজ ফাঁকি দিয়ে চলেই আসতাম। কোনোভাবেই পাঁয়তারা করতে দিতাম না। এতোদিন বাইরের মানুষকে ট্যাকেল দিলাম। এখন ভেতরের মানুষই ধোঁকা দিয়ে বসলো।
মাহতিম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ নিচু করলো। পাশ থেকে সুজলা মৌন হয়ে আছেন। খোলা জানালার দিকে লালচক্ষুতে তাকিয়ে আছেন। এতোক্ষন যেটা টের পাননি, সেটা অনুমান করা মাত্র শান্ত গলায় বললেন,
– মেজোবউ,
সাড়া দিলো না শেফালি। বিছানায় এখনো মুখ ডুবিয়ে আছে। সাবা ভেজা চোখে নাক টেনে শেফালির দিকে তাকালো। আর্দ্র গলায় ডাকলো,
– মেজোমা? আম্মা ডাকে।
কোনো হেলদোল নেই শেফালির। যেমন ছিলো, তেমনই রইলো। সুজলা আবার গলা বাড়িয়ে বললো,
– কলপাড় থেকে হাত ধুয়ে এসো। মাছের এঁটো হাতে বসে থেকো না।
বেশ জোর দিয়ে বললেন সুজলা। সম্ভবত সেই প্রেক্ষিতে শেফালির হুঁশ ফিরে এলো। বিছানা থেকে মুখ তুলে দ্রুত বসা থেকে উঠলো। দরজার বাইরে যেতেই হঠাৎ মাথা ফিরিয়ে বললো,
– মেহনূর কই?
উত্তরের জন্য পিছু তাকালো মাহতিম। চোখ-মুখ ফোলা শেফালির দিকে শান্তভাবে বললো,
– বাড়িতে নেই। সুরাইয়ার সাথে কলেজে গিয়েছে। প্র্যাকটিক্যাল খাতা সাইনের জন্য ডেট ছিলো। সাইন করিয়ে এসে পরবে।
সবাই জানতো সময়টা চূড়ান্ত। যেকোনো মূহুর্তে কিছু একটা ঘটবে। এরপর সব ঠান্ডা-শূন্য-বিলীন। মাহতিম নিজেকে স্থির রেখে প্রতি মূহুর্তের জন্য সজাগ থাকলো। ডাক্তার এসে মাহমুদার পালস্ দেখে নিলো। চোখদুটোর অবস্থা অনেকক্ষণ ধরে পর্যবেক্ষণ করলো। এরপর শূন্যমুখে ঘর থেকে বেরিয়ে শেষ উত্তরটা জানিয়ে দিলো। নির্বাক রইলো সবাই। মুখে কোনো সাড়া নেই। সাবা ওজু করতে কলপাড়ে গেলো, শেফালি গেলো গোসল করতে, সুজলা গেলেন সুরাইয়াকে ফোন দিতে। পুরো ঘরের মধ্যে শুধু মাহতিম রইলো। মাহমুদার কাছে বসতেই বহুকষ্টে ঠোঁট নাড়ালো মাহমুদা। ক্ষীণ স্বরে বললো,
– বাবা…
মাহতিম চটপট ভঙ্গিতে এগিয়ে গেলো। ডানহাতটা খুব জোর দিয়ে দুহাতের মধ্যে নিলো। ফিসফিস কন্ঠটা স্পষ্ট শোনার জন্য মাথা ঝুঁকিয়ে বললো,
– আমি শুনতে পাচ্ছি মা।
চোখ বন্ধ করলো মাহমুদা। মুখ দিয়ে লম্বা নিশ্বাস ছাড়তেই রুগ্ন সুরে বললো,
– তোমাকে বিশ্বাস করি মাহতিম। জীবনে তুমি অনেক বড় হও। তোমার ঘরে যেন সব সুখ আসুক। মারজা ভাবীকে দেখে রাখিও। আমাকে মাফ করে দিও বাবা। তোমাকে ঠকাইনি। আমি রোগী মানুষ, আমিই আগাছার মতো অন্যের উপর চলি। তোমাকে আপ্যয়ন করতে পারলাম না।
মাহতিম মাথা নিচু করে ফেললো। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। মাহমুদার দিকে তাকানোর ক্ষমতা তার নেই। দুহাতের মুঠোয় থাকা হাতটা চোখের কাছে তুললো। মাহতিম বন্ধ চোখে ধাতস্থ হয়ে বললো,
– যেদিন আপনার অসুখের রিপোর্ট পড়লাম, আমি স্বাভাবিক থাকতে পারিনি। কি করলে আপনি সুস্থ হবেন শুধু সেটাই চিন্তা করেছি। আপনার মেডিকেল রিপোর্টের কপি পড়ার পর শুধু মেহনূরের মুখটা ভেসেছে। আমি চাইলে আপনার মেয়েকে এখান থেকে ফিরিয়ে নিতে পারতাম। কিন্তু আপনার জন্য আগাইনি। মেহনূর আপনার আশেপাশে থাকলে আমার চিন্তা কম হতো। অন্তত মনে-মনে এটুকু স্বস্তি থাকতো, আপনার মেয়ে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে আপনার দেখাশোনা করছে। আপনার মতো মানুষকে আমি হারাতে চাই না।
মাহমুদা পাণ্ডুর মুখে হাসলো। জলপূর্ণ চোখে হাসি এঁটে তাকালো। একটা অদ্ভুত শান্তির ছায়া সারা মুখে ছড়িয়ে আছে। চেহারায় যেনো অব্যক্ত জৌলুসের দীপ্তি। মাহতিম তাকিয়ে থাকতে-থাকতে ভাষা হারিয়ে ফেললো। রোগাক্রান্ত শেষযাত্রার মানুষটার মুখে অদ্ভুত তৃপ্তি। মাহমুদা বেশ তাগদের সাথে মাহতিমের হাতে চাপ দিলো। ছোট্ট স্বরে বললো,
– গর্ভে মেয়ে ধরেছিলাম। সেই মেয়েকে দিয়ে ছেলে পেয়েছি। ভালো থেকো বাবা। তোমাকে সবসময় বিশ্বাস করি।
প্রদীপের শেষ তেলটুকু যেন নিঃশেষ হয়ে এলো। খুবই ধীরগতিতে চোখের পল্লব নামালো। শরীরের সমস্ত বন্ধন আস্তে-আস্তে আলগা করলো। মাহতিম মূঢ়ভঙ্গিতে ওই মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার চোখের পাতা একমূহুর্ত্তের জন্যও নড়লো না। দুহাতের ভেতর যে জীর্ণ হাতটা একটু আগে চাপ দিয়েছিলো, সেটা সন্তর্পণে চাপহীন হচ্ছে। খসখসে ঠোঁটদুটো নিঃশব্দে কিছু আওড়ালো, শেষবাক্য উচ্চারণ হতেই থেমে গেলো নড়াচড়া। আজীবনের জন্য সবকিছু থেমে গেলো।
.
দুপুরের শেষ ভাগ। উদীয়মান সূর্যটা মধ্যগগণ ছেড়েছে। কিছুটা পশ্চিমাকাশে হেলে গিয়েছে। কড়া রোদের তাপটা কম এখন। সুরাইয়া ও মেহনূর কলেজ থেকে ফিরলো। রসায়ন দ্বিতীয় পত্র খাতাটা সাইন করাতে বেশ জক্কি পোহাতে হয়েছে। ম্যাডামকে খুঁজে-খুঁজে ক্লাস শেষ হবার জন্য অপেক্ষা করেছে। ওরা ক্লাসের বাইরে যখন সাইনের জন্য অপেক্ষা করছিলো, তখন সুরাইয়ার বাটন ফোনে কল এসেছিলো। সুরাইয়া অবশ্য স্বাভাবিকভাবে কলটা ধরলেও সুজলার কন্ঠে তেমন কিছুই বুঝতে পারেনি। নেটওয়ার্কের ঘ্যাড়ঘ্যাড় শব্দের জন্য সব অস্পষ্ট বলা চলে। কেবল ‘ তাড়াতাড়ি আয় ‘ কথাটা শুনতে পেয়েছিলো। সেটা নিয়ে তত চিন্তা হয়নি ওর। বাড়িতে ফেরার পর দুজন অবাক হলো। সুরাইয়া ভাড়া চুকিয়ে মেহনূরের দিকে তাকালো, আরেকবার তাকালো মানুষভর্তি বাড়ির দিকে। মেহনূরও সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। সুরাইয়া খুচরা টাকাটা ব্যাগে পুরতেই তাজ্জব গলায় বললো,
– কেমন-কেমন যেন লাগছে না? ফাঁকা বাড়িতে এতো মানুষ কেন? কিরে মেহনূর, কিছু কি জানোস?
মেহনূর বাড়ির দিকে দৃষ্টি রেখে ‘ না ‘ সূচকে মাথা দোলালো। স্পষ্ট করে জানালো সে কিছুই জানে না। অসংখ্য প্রশ্নের ঝুলি নিয়ে বাড়িমুখো হলো। মেহনূর হাতের প্র্যাকটিক্যাল খাতাগুলো সুরাইয়ার হাতে দিলো। মুখে বললো,
– খাতাগুলো ধরো বুবু।
সুরাইয়া চকিতে মেহনূরের দিকে তাকালো। ওর কন্ঠ মলিন কেন? কি হলো এখন? খাতাগুলো নিতেই মেহনূর যন্ত্র-মানবের মতো আঙিনায় এলো। চোখের সামনে ফুপিয়ে-ফুপিয়ে শেফালি কাঁদছে। মেহনূর নির্বোধের মতো তাকিয়ে থাকতেই আশেপাশের মানুষজন দুপাশে চেপে মাঝ বরাবর রাস্তা দিলো। মেহনূর ডানে-বামে মানুষের উপস্থিতি দেখতেই পা চালিয়ে এগুলো। শেফালির অবস্থা দেখে আসল রহস্য তিরোধান করতেই বুকটা কামড়ে এলো মেহনূরের। বৈদ্যুতিক শক লাগার মতো কয়েক পা পিছিয়ে গেল মেহনূর। পেছন থেকে দ্রুত ধরে ফেললো সুরাইয়া। সেও বড়-বড় চক্ষুতে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। শেফালি মেঝেতে বসে কপাশ চাপড়াচ্ছে। সুরাইয়া খুব শক্ত করে মেহনূরের বাহুদুটো ধরলো। ঢোক গিলে পেছন থেকেই বললো,
– চ-চ-চল মেহনূর।
সুরাইয়া ঠোঁট ভিজিয়ে মেহনূরের হাত ধরলো। সরু কবজিটা পাঁচ আঙ্গুল ধরতেই কাঙ্ক্ষিত রুমটার দিকে চললো। সেখানে আরো ভীড়। প্রচুর মানুষে গিজগিজ। সুরাইয়া ভেতরে ঢুকতেই দাঁড়িয়ে পরলো। পেছন-পেছন টেনে আনা মেহনূরের হাতটা ছেড়ে দিলো। সুরাইয়ার পেছন থেকে বেরিয়ে এলো মেহনূর। বিছানার দিকে তাকাতেই জমাটবদ্ধ অশ্রুটা গাল বেয়ে ঝরলো। সটান হয়ে শুয়ে থাকা দেহটা চাদরে ঢাকা। মুখটাও চাদর টেনে ঢেকে দিয়েছে। পাশেই সুজলার শক্তমূর্তি ভেঙেচুড়ে ধ্বংস। অবুঝ শিশুর মতো হাউমাউ করে কাঁদছেন। এরকম কান্না এতো বছরের মধ্যে দেখেনি মেহনূর। সাবাকেও ওরকম শোকের কান্নায় দেখেনি। মাহতিম ঘরে নেই। লোকজন নিয়ে দাফনকার্য দেখতে বেরিয়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দাফন করতে হবে। মেহনূর অশ্রুপূর্ণ চোখে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো। একজন প্রতিবেশী মহিলা সরে গেলে সেদিকে উঠে বসলো। চাদরের ফাঁক গলে পরিচিত হাতটা বিছানায় পরে আছে। মেহনূর টলমল চোখে সেই হাত ছুঁতেই দাঁত শক্ত করলো। কি ঠান্ডা হাত! এতো ঠান্ডা কোনো মানুষের হাত হয়? বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে। সকালেই এই হাতটা ছুঁয়ে-ছুঁয়ে কতো যত্ন করলো। সেই হাত এতো ঠান্ডা? মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো। তৎক্ষণাৎ চোখ খিঁচালো মেহনূর। মাথা ঘুরছে। কি যেন আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে আসছে। চোখ খুলতে চাইলো, কিন্তু পারলো না। শ্রবণেন্দ্রিয় যেন সুরাইয়ার ‘ মেহনূর ‘ ডাকটা শুনতে পেলো। চোখের পাতা টেনেটুনে খুললো মেহনূর। ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখতে-দেখতেই চোখের সামনে আঁধার ঘনিয়ে এলো। মনেহচ্ছে সে পরে যাচ্ছে। ধপ্ করে একটা শব্দ বুঝতে পারলো। এরপর কোনো জ্ঞান নেই। কেউ যেন ইচ্ছে করে চোখের পর্দাদুটো টেনে দিলো। বুঝতে পারলো না সৎবিৎ নেই।
.
আধঘন্টার ভেতর সব বন্দোবস্ত করলো মাহতিম। জানাজার নামাজে জমায়েত হলো বহু পুরুষ। এক ডাকে মোল্লাবাড়ির ছোটবউয়ের জন্য অসংখ্য মানুষ হাজির। পুরো দাফনকার্যের জন্য একটুও দেরি হয়নি। গ্রামের বুজুর্গ লোকগুলো বেশ অমায়িক আচরণ করলো। গ্রাম্য মহিলাদের মুখে-মুখে শোনা গেলো মৃতব্যক্তির সুনাম। সবার তনুমনে শোকের ছায়াটা আলোড়িত হয়েছে। চোখ ভিজেছে মাহমুদার জন্য। মানুষের কুড়ানো সম্মান বুঝি চলে যাওয়ার পর মুখরিত হয়। প্রতিটি স্তরে-স্তরে তার সুলভ আচরণ নিয়ে মানুষ দুঃখ করে। মাহমুদার গমনে সবচেয়ে ভেঙ্গে পরেছে সুজলা। কেউ উনার কান্নাকাটি থামাতে পারেনি। খবর শুনে চলে আসছে শানাজ। কিন্তু ফোনের মধ্যেই কেঁদে দিয়েছে সে। লাশ বেশিক্ষণ রাখার উপায় ছিলো না। ধর্মীয় মোতাবেক দ্রুত দাফনের জন্য ব্যস্ত ছিলো মাহতিম। যেই মহিলাটা তারই কাছে জীবনের শেষ মূহুর্ত কাটিয়েছে, তাকে কষ্ট দেওয়াটা কঠিন। মেহনূর এখনো সংজ্ঞাহীন। ডাক্তার এসে দেখে গেলেও ঘুমের সূঁচ দিয়েছে। শোকের ধাক্কাটা নিতে পারবে না সে। ইতিমধ্যে মোল্লাবাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছে সবাই। তৌফ থেকে শুরু করে সবাই ছুটে আসছে। শুধু বাদ যাচ্ছে প্রীতি ও মারজা। মারজাকে এখনো জানানো হয়নি। তাকে দেখাশোনার জন্য প্রীতি থেকে যাচ্ছে। সূর্য যখন ডুবে গেছে, তখন বাড়ি ফিরলো মাহতিম। মাথার টুপিটা পকেটে ঢুকিয়ে ঘরমুখো হলো। সাদা পান্ঞ্জাবীর স্লিভদুটো গুটিয়ে মেহনূরের খোঁজ নিলো। জানতে পারলো মেহনূর জেগেছে। কিন্তু কথা বলেনি কোনো। মাহতিম মেহনূরের কাছে গেলো। সাবা শিউরের কাছে বসে-বসে পানিপট্টি করছে। মাহতিম দরজা থেকেই জিজ্ঞেস করলো,
– ওর কি জ্বর?
সাবা নাক টেনে কান্না চোখে তাকালো। মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়িয়ে দিলো। মাহতিম ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকের জবাব পেয়ে মেহনূরের কাছে এসে বসলো। মেহনূর চোখ বন্ধ করে আছে। পেটের উপর দুহাত রাখা। বুক পযর্ন্ত কাঁথা টেনে রেখেছে।এখনো হালকা নীল শাড়িটা পরে আছে। সারাদিনে কাপড় বদলায়নি। মাহতিম ওর দুহাতের উপর হাত ছুঁয়ে দেখলো। কি সাংঘাতিক! জ্বরের মাত্রা খুব বেশি লাগছে। এতো তাপমাত্রা নিয়েও চুপ করে আছে? মাহতিম বেশ চিন্তায় পরে গেলো। লক্ষণ ভালো না। ধাক্কাটা বেশ ঠান্ডা ভাবে নিয়েছে। এরকম হয়ে থাকলে মেহনূর তো স্বাভাবিক হতে পারবে না। বেশ উদ্বেগের সাথে জিজ্ঞেস করলো মাহতিম,
– জ্বরটা চেক করেছো?
সাবা একটু সামলে নিয়ে বললো,
– না, ভাইয়া। ঘরে থার্মোমিটার নেই। যেটা ছিলো ওটা ভেঙ্গে গেছে।
মাহতিম আবার প্রশ্ন করলো,
– তোমার কি মনেহয় জ্বরটা স্বাভাবিক?
সাবা ‘ না ‘ ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বললো,
– খুব বেশি। কি করবো ভাইয়া? বাড়ির মধ্যে সব তছনছ। আম্মাই নিচে বিলাপ করে কাঁদছে। ছোটমার যাওয়াতে এতো কষ্ট পাবো ভাবতে পারিনি ভাইয়া। এতোদিন ছোটমা যেমনই ছিলো, আমাদের সাথেই ছিলো। কিন্তু আজ থেকে কি করে নিজের মনটাকে বুঝ্ দিবো? ওই বিছানাটা খালি পরে আছে। কেউ নেই। প্রতিদিন সকাল-বিকাল আমরা সবাই ও-ঘরে ঢুঁ মারতাম। ছোটমার কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করতাম। আজ থেকে কাকে এসব বলবো? বিছানার দিকে তাকালেই কান্না পায়। কেউ নেই।
মাহতিম কথার বদলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে সাবার উদ্দেশ্যে বললো,
– দুটো কাজ দিবো, করবে?
পকেট থেকে ফোন বের করলো মাহতিম। নিজের জিমেইল একাউন্টটায় ঢুকতে-ঢুকতে প্রসন্ন কন্ঠে বললো,
– বড়মাকে উপরে আসতে বলো। যদি না-আসে; বলবে, আমি ডেকেছি।
সাবা ডানহাতের উলটোপিঠে চোখ মুছে তাকালো। বসা থেকে উঠে দাঁড়াতেই মাহতিম দ্বিতীয় কাজটা বললো,
– গা মুছিয়ে ওর শাড়িটা বদলে দাও। এই মূহুর্তে কোনো প্রশ্ন কোরো না। কাজদুটো এক্ষুণি কমপ্লিট করবে। আমি আশেপাশে আছি। কোনো সমস্যায় পরলে আমাকে ডাক দিবে। কথা বুঝেছো?
মাহতিম ফোনের কিবোর্ডে আঙ্গুল চালাতে থাকলো। কথামতো সাবা কোনো প্রশ্ন করলো না। চুপচাপ নিচে চলে গেলো। মেহনূরকে এভাবে রাখা যাবে না। যার জন্য এতোদিন এ বাড়িতে রেখেছে, আজ সে নেই। আর মোল্লাবাড়িতে রাখা চলবে না। সময় ঘনিয়ে এসেছে। মাহতিম দ্রুত একটা এ্যাপ্লিকেশন লিখে মেইল পাঠিয়ে দিলো। সেন্ড বাটনে ক্লিক করতেই এক কপি নোমানকেও পাঠালো। নোটিফিকেশনে M.A.B. দেখেই হোক, বা ভক্তির চোটে, নোমান সাথে-সাথে চেক দিলো। চা খেতে-খেতে মেইল পড়তে লাগলো। বেশ ফুরফুরে মেজাজে পরতেই বড় চুমুক দিলো সে। যেই চতুর্থ লাইনটা পড়লো, ফস করে সমস্ত মুখভর্তি চা ঝর্নার মতো ছেড়ে দিলো। কি ছিলো ওটা? চতুর্থ লাইনটা আবার পড়লো নোমান। আশ্চর্যে স্তব্ধ হয়ে গেলো।
Hello, just to inform you that I’m applying immediately for the private cottage offered by you. May my application be accepted as soon as possible. All formalities should be mailed from Head Office. I’m canceling my leave for two days. In that compulsion, let my request be speedily approved without any fuss. I’m returning to the field. Hopefully, my personal facilities will be very good. I want to tighten my personal security.
M. Ansari .
চলমান .
#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ .
#পর্বসংখ্যা_১৩ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .
তোড়জোড় শুরু হলো চলে যাওয়ার। সবাই যারপরনাই অবাক! এমন অদ্ভুত সিদ্ধান্ত মানা যাচ্ছে না। শোকের ছায়া এখনো কাটেনি। বাড়িতে পৌঁছেছে সবাই। শানাজরা বাড়িমুখো। মাহতিমের অবস্থা খুবই ব্যগ্র। কি নিয়ে তাড়াহুড়ো করছে কেউ জানেনা। মেহনূরকে রেডি করাচ্ছে সাবা। তাই রুমটা ভেতর থেকে বন্ধ। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে মাহতিম। ফোনে কথা বলছে নোমানের সাথে। নোমান যেন ঠিকঠাক মতো গাড়ি নিয়ে পৌঁছে, সেটাই বারবার উর্ধ্ব গলায় বলছে। কপালে অসংখ্য ভাঁজ নিয়ে হাজির হলেন সুজলা। চোখে বিষ্ময় ফুটিয়ে আশ্চর্য কন্ঠে বললেন,
– মাহতিম তুমি চলে যাচ্ছো? এ অবস্থায় কিভাবে কি? আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না। মাত্র কয়েকঘন্টা আগে লাশ দাফন হলো। এরই মধ্যে চলে যেতে চাচ্ছো?
মাহতিম ব্যাপারটা ঠান্ডা ভাবে সামলালো। ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে সুজলার দিকে শান্ত মেজাজে বললো,
– খারাপভাবে নিবেন না বড়মা। আমাকে এই মূহুর্তে যেতে দিন। আমি খুব স্বার্থপরের মতো বিহেভ করছি সেটা বুঝতে পেরেছি। আমার এখানে থাকা খুবই প্রয়োজন। কিন্তু তার থেকেও বেশি প্রয়োজন ওর দিকটা ভাবা। কোনোভাবেই ওকে একা ছাড়তে পারবো না। আর সম্ভব না বড়মা। আপনি নিজেই যেখানে শোক সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন, সেখানে ওর অবস্থাটা একবার ভেবে দেখুন। আমি হয়তো নির্দয়ের মতো আচরণ করছি। কিন্তু, আমার কাছে কোনো উপায় নেই।
একমূহুর্ত্তের জন্য থমকে গেলেন সুজলা। ধাক্কাটা নেওয়ার জন্য স্থির চোখে তাকালেন। চোখের পানিটা আঁচলের শেষপ্রান্ত দিয়ে মুছে শোকাতুর কন্ঠে বললেন,
– তাহলে ওকেও নিয়ে যাচ্ছো?
মাহতিম আসল ব্যাপারটা বুঝলো। কিছুটা নরম হয়ে, প্রসন্ন চোখে সুজলার দিকে তাকালো। একদফা নিশ্বাস ছেড়ে বিমর্ষ গলায় বললো,
– একা ছাড়ি কিভাবে? এতোদিন যার কথা চিন্তা করে এ বাড়িতে রেখেছিলাম, উনি তো নেই। শেষপর্যন্ত চলেই গেলেন। আমার দায়িত্ব যতোই বড় হোক বড়মা, বউ তো এভাবে ফেলে যাবো না। ওর মানসিক অবস্থা ভালো নেই। শরীর যথেষ্ট খারাপ। ওকে আমার সাথে যেতে হবে। ওর ব্যক্তিগত থাকার জন্য সব ব্যবস্থা করা শেষ। ও আমার সঙ্গে যাচ্ছে। আপনি মন ছোট করবেন না। ছুটি পেলেই আপনার কাছে নিয়ে আসবো।
শেষ কথাটা মোলায়েম সুরে বললো। তাতে লাভ হিসেবে সুজলা ঠিকঠাক বুঝলেন কিনা জানে না। কিন্তু যাওয়ার ব্যাপারে কোনোরূপ আপত্তি জানাননি। মাহতিমকে প্রশ্নবিদ্ধ করলো না কেউ। যদিও তৌফের মনে-মনে অসংখ্য প্রশ্ন কিলবিল করছিলো, ঘুরপাক খাচ্ছিলো নানা উদ্ভট চিন্তা, তবুও সে মাহতিমকে চেনে। বন্ধুকে চিনতে কোনোদিন ভুল হয়নি তার। মাহতিমের ব্যস্ত হবার প্রবণতা খুব ভাবাচ্ছে। কেন মাহতিম রাতের মধ্যে যেতে চাচ্ছে? ঘটনা কি স্বাভাবিক, নাকি স্বাভাবিকের আড়ালে লুকিয়ে আছে রহস্য? তৌফ ব্যাপারটা নিয়ে দলবলের সাথে আলোচনায় বসলো। সিয়াম উদ্বিগ্নের সাথে বললো,
– তোরা ওকে আটকাস না। ও যেতে চাচ্ছে যাক। দুজনের কোয়ান্টিটি টাইম দরকার। ওরা খুব অল্প সময় পেয়েছে। ওই টুট টুট মার্কা ফিল্ডের জন্য শা::লা নিজের বউয়ের দিকে নজর দিতো না। আমার রাগটা কোথায় হচ্ছে জানিস? হারা:মখো:রটা আমাদের কিচ্ছু বলেনি! তৌফ, ও পেটে এতো কথা লুকিয়ে রেখেছে যে, তুই-আমি চিন্তাও করতে পারবো না।
সিয়ামের কথাকে গ্রাহ্য করলো না তৌফ। সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে এমন একটা বেখাপ্পা কথা বললো, সবাই ওর দিকে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো। দূরে কোনো জায়গায় ফাঁকাদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তৌফ। সেদিকে দৃষ্টি রেখে আনমনা কন্ঠে বললো,
– ক্লিয়ার লাগতাছে না। যোগাযোগ করলো কেন? এই কাজ কেন করতে যাইবো? ওর দরকারটা কোন্ জায়গায়?
তৌফের অন্যমনষ্ক ভাব দেখে আহাম্মক হলো সবাই। নিজেদের মধ্যে চাওয়া-চাওয়ি করে ফের তাকালো তৌফের দিকে। কয়েক জোড়া চোখ তখন কৌতুহলে দপদপ করছে। তৌফের সেই খচখচানির কথাটা শুনতে চাচ্ছে। ফারিন প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তৌফের বাহুতে হাত রাখলো। ডান বাহুতে মৃদ্যু চাপ দিতেই সংবিৎ পেলো তৌফ। চট করে চমকে উঠতেই ডানদিকে ফারিনের দিকে ফিরলো।একপ্রস্থ ঝাঁজালো বাক্য ছুঁড়ে বললো,
– পি:শাচের মতো তাকায় আছোস ক্যান? কাম:ড়া-কা:মড়ি করবি নাকি?
ফারিন কথাটা আমলে নিলো না। অন্যসময় হলে সেই লেভেলে ধমকে উঠতো। আজ বেশ শীতল মেজাজে তৌফের বাহুটা চাপ দিয়ে বললো,
– তুমি কিছু লুকাচ্ছো তৌফ ভাই। মিথ্যে বোলো না। আমার দিকে তাকিয়ে সত্য বলো।
ধরা পরার ভঙ্গিতে ঢোক গিললো তৌফ। নিজেকে আড়াল করার জন্য মিথ্যা হাসি দিয়ে বললো,
– আরে ধুরো, আমি আবার কিছু লুকামু? আমার কাছে লুকালুকির কিছু আছে?
ফারিনও নাছোড়বান্দা। তৌফের মিথ্যাকে পাত্তা দিলো না। আরো পোক্তভাবে জেরার জন্য শক্ত ভঙ্গিতে বললো,
– তুমি কিসের যোগাযোগের কথা বলেছো? এটাও বলেছো ‘ ক্লিয়ার না ‘। এখানে কি ক্লিয়ার লাগছে না? কি নিয়ে জগাখিচুড়ি পাকাচ্ছো তৌফ ভাই? তুমিও কি মাহতিম ভাইয়ার মতো ছলচাতুরি শুরু করলে? কি লুকাচ্ছো তুমি?
ফারিন শেষ প্রশ্নটা ক্ষেপাটে সুরে বললো। তৌফ ওর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে সবার দিকে তাকালো। সবাই যে ওর দিকে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে আছে, সেটা বুঝতে পারলো সে। তৌফ নিচের ঠোঁটটায় জিভ বুলাতেই নীতি বলে উঠে,
– প্লিজ তৌফ ভাই, তোমার পায়ে পড়ি, দয়াকরে ভণিতা বন্ধ করো। তোমার ফেসে একদম বোঝা যাচ্ছে তুমি কিছু লুকাচ্ছো। তুমি যা লুকাচ্ছো, সেটা যে সিরিয়াস কেস সেটাও আমরা বুঝতে পারছি।
নীতির কথাকে টান মেরে সিয়াম নিজের দিকে ঘুরালো। মুখের ভাষা তুঙ্গে চড়িয়ে উগ্র মেজাজে বললো,
– তোর কি পশ্চাদদেশে বিষছোঁড়া হইছে? সামান্য একটা কথা বলতে কুতাকুতি শুরু করছোস ক্যান? ভালোভাবে বলা যায় না? তোরে যে সভ্য মানুষের মতো জিগাইতেছে, এতো মোচড়া-মোচড়ি লাগাইলি ক্যান?
ঝাড়িটা খেয়েই সোজা হলো তৌফ। একদম বিজ্ঞের মতো গম্ভীর চোখে তাকালো। ভাব-সাব এমন, যেনো অংকের মাস্টার জটিল ক্যালকুলেশন নিয়ে বসেছে। গলাটা খাঁকাড়ি দিয়ে দরজার দিকে একপলক তাকালো। ভেজানো দরজা দেখে আশ্বস্ত হয়ে একটু কাছে ঝুঁকে এলো। গলার স্বর যথাসম্ভব নিচু করে বললো,
– আমার আব্বাজানের কাছ থেকে ইনফো জানছি। এই ইনফো কিন্তু যেমন-তেমন ইনফো না। একদম গভীর ফাঁদের ইনফো। চেষ্টা করবি এইসব তথ্য যেনো লিক্ না-হয়। তোদের কি ঢাকাইয়া গ্যান্ঞ্জামের কথা মনে আছে?
সবাই একযোগে স্মৃতি ঘাঁটতে লাগলো। মনে করতে লাগলো পুরোনো কোনো ঘটনা। ‘ ঢাকাইয়া গ্যান্ঞ্জাম ‘ নামে অনেক ঘটনাই তো অহরহ ঘটে।। কিন্তু তার মধ্যে বহুল আলোচিত ঘটনা কোনটা? সামিক ভাবতে-ভাবতে চট করে তাকালো। বিস্ফোরণ চোখে তাকিয়ে বললো,
– তুমি কি উনার কথা বলছো নাতো? ওইযে বনানীতে…
‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে মাথা দোলালো তৌফ। ভারী নিশ্বাসটা শব্দ করে ছাড়লো। সবার দিকে তাকাতে-তাকাতে মোদ্দাকথায় ফিরলো,
– বয়সটা বাড়ছে। কিন্তু তেজ.. তেজ আর কমেনাই। এখনো ভাই কথা বললে বারুদের মতো লাগে। কথার যা ধার! আমার আব্বা পযর্ন্ত ওই ব্যক্তিরে সম্মান দিয়া চলে। এবার বুঝ ব্যাটা, ওই লোকের ভিতরে কি আগুনই না-আছে। কোনো পলিটিক্সের সাথে যুক্ত নাই, কোনো দলরেও সার্পোট-টার্পোট করে না। এক্কেবারে নিরপেক্ষ মানুষ। অথচ, পলিটিক্সের নেতারা উনার কাছে ধর্না দেয়। ব্যাপারটা বুঝতে পারছোস কেউ?
নীতি দুই-ভ্রুঁ কুঁচকে বেশ অবাক হয়ে বললো,
– আমিতো দেশে থাকি না। দেশের খবরও জানি না। কিন্তু তুমি যার কথা বলছো, সে কি পলিটিক্স করতো?
তৌফ ফিকে হাসিতে গর্বের ভঙ্গিতে বললো,
– করতো মানে? চুটায়া পলিটিক্স করতো। পুরা ঢাকার আন্ডারে যতো ক্যাম্পাস আছে, সব উনারে একনামে চিনে। এখনো ক্যাম্পাসে গেলে পোলপান সালাম ঠুকবো। যেই ডেন্ঞ্জারাস পাবলিক ছিলো, উনিশ-বিশ করলেই খা:লা:শ।
তৌফ কথাটা বলেই ডানহাত দিয়ে গলা বরাবর ছুড়ির চালানোর ভান করলো। বুঝিয়ে দিলো মানুষটা কত ভয়ংকর ছিলো। চোখের সামনে আবছা একটা মূর্তি কল্পনা করলো নীতি। ভয়ে ঢোক গিললো সে। পাষাণের মতো মুখ চিন্তা করতেই সব জল্পনা ভস্ম করলো তৌফ। নিজের মোবাইল থেকে কথিত মানুষটার ছবি বের দিলো,
– এই যে, এই লোকের কথা বলছি। নে ধর্।
ভয়ের শিহরণটা পিঠ বেয়ে নামলো নীতির। আবারও ঢোক গিললো একদফা। এরকম ভয়ংকর পলিটিশিয়ানকে একদম দেখতে চায় না। সাথে-সাথে মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো। নাকোচ সুরে বললো,
– না, না সরাও। আমি দেখবো না। ওসব লোকদের চেহারা খুব ভয় করে। দেখলেই বুকটা ধ্বক-ধ্বক করে। সরাও তো। আমি দেখবো না, দেখতে চাই না।
নীতি ছবিটা দেখতে না-চাইলেও সাবির সেটা দেখলো। ফোনটা হাতে নিয়ে পর্যবেক্ষণশীল চক্ষু দিয়ে বললো,
– তৌফ ভাই কি ফাজলামি করছো? তুমি এটা কার ছবি ধরিয়ে দিলে? ইনিতো কোনো পলিটিশিয়ান না।
ফিক করে মুচকি হাসলো তৌফ। সোফায় সাহেবী ভঙ্গিতে গা-টা ছেড়ে দিলো। পায়ের উপর পা তুলে এটিটিউট ভঙ্গিতে বললো,
– ওই বয়লার ইলিশ, তুই দেশে থাকোস? চিনিস কাউরে? শা:লা মফিজ চুপ থাক্।
মুখের উপর দমিয়ে দিলো তৌফ। ততক্ষণে নীতি সরুচোখে মোবাইলের স্ক্রিনে দেখছে। অল্পক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই মোবাইলটা নিজের হাতে নিলো। খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে যত দেখছে, ততই আশ্চর্য হচ্ছে সে। এই চেহারার সাথে কল্পনার চিত্র মিলছে না। কোনোভাবেই যায় না। সিনেমায় যেমন কাঁটাওয়ালা ভয়াল মুখ দেখে, মনে-মনে সেরকম কিছু ভেবেছে। কিন্তু এ যে ভিন্ন চিত্র! নীতি কিছুটা অদ্ভুত সুরে, অদ্ভুত কন্ঠে বললো,
– আন-ম্যারিড?
তৌফ হো-হো করে ঘর কাঁপিয়ে হাসলো। নীতির মনে-মনে কিসের ঘন্টা বেজেছে সেটা বুঝতে পারলো। কিন্তু আফসোস, তৌফের থামে না। হাসতে-হাসতে লুটোপুটি অবস্থা। নীতি মহাবিরক্ত হয়ে ভ্রুঁ কুঁচকে বললো,
– এজন্যেই তোমাকে কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। সবসময় বেহুদা কারণে হিহি করতে থাকো। এখন কি হিহি করার সময়? বাড়ির মানুষগুলো শুনলে কি ভাববে?
বেশ জক্কির সাথে হাসি থামালো তৌফ। একটু শান্ত হয়ে হাসির দমক কাটিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
– নজর দিস না ছা:গল। উনি ম্যারিড। দুই বাচ্চার বাপ। ছেলেমেয়ে দুইটাই আছে। বাংলাদেশের মোস্ট ইনফ্লুয়েন্সিয়াল( lnfluential ) ব্যক্তিদের মধ্যে ইনি একজন। বিদেশের মাটিতে প্রচুর নামডাক হইছে। আর এইজন্যই তুই…
শেষ কথাটা ঠিক সাবিরের দিকে তাকিয়ে বললো,
– তুই উনারে পলিটিশিয়ান হিসাবে না, বিজনেসম্যান হিসাবে চিনছোস। এবার বুঝছোস হিসাব?
তৌফ কথার প্রসঙ্গটা আবারও ঘুরিয়ে নিলো। কানে যে কথাটা এসেছে, সেটা ধীরেসুস্থে বলতে শুরু করলো,
– সৌভিকের ভাষ্যমতে, মাহতিমের ফোন ট্যাপ হইতো। যেটাই বলতো, যার সাথে বলতো, সব রেকর্ড হইতো। এইসব কু:ত্তা:র মতো কাম কে করছে জানোস? ওই ডা:ই:নি বে:টি। বে:টির তেল এতো বেশি যে, মাহতিমের পিছে মানুষ লাগাইছে। মাহতিমও কম না, ওয়ও ধা:ন্দাবা:জি কম দেখায় নাই। ওয় যে কি কি করছে, আব্বা না আমারে বললে আমি জানতামই না। পুরো কথা মন দিয়া শোন্। ওয় প্রথমে সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে। কমবেশি সবার সাথেই ঝামেলা বাঁধায়। আমার সাথেও বেহুদা কারণে রাগ দেখাইছিলো, কেন দেখাইছিলো তখন বুঝিনাই। এখন বুঝছি। ওই ঝামেলার পর থেকে আমি নিজ থেকে ওর সাথে কন্টাক্ট করতাম না। করতে চাইলেও ওই ঝামেলার গা:লিগুলা মনে পরতো। আস্তে-আস্তে কাজের প্রেশারে পরলাম। ওর সাথে যোগাযোগ কমাইলাম। ওর সাথে সবাই রাগ কইরা থাকলো। কেউই ওরে ফোন দিলো না। এদিকে ফোন দিলেও বন্ধ থাকতো। আবার, মেহনূরের ঘটনা নিয়াও সবার মনে-মনে ক্ষো:ভ ছিলো। ওর সাথে যখন যোগাযোগ কইমা যায়, তখন এদিক দিয়াও রাস্তা একটা ক্লিয়ার হয়। ওইটা আমরা কেউই বুঝিনাই। রজনী যেই ফাঁদটা পাতছিলো, ওইখানে কিছুই ধরা পরে না। বে:টির মন থেকে সন্দেহ দূর হয়। ভাবে, মাহতিম এখন একা। মেহনূরের সাথেও যোগাযোগ নাই, আমাদের সাথেও মিলবন্ধন নাই, তার মানে রাস্তা ফাঁকা। সব তছনছ হইয়া গেছে। অথচ, মাহতিম বাবাজি তলে-তলে আকাম কইরা গেছে। ছোট মামীর চিকিৎসা থিকা শুরু কইরা যাবতীয় খরচ একটা ব্যাংক একাউন্ট থিকা যাইতো। আর এই একাউন্ট ওরও না, ওয়াসিফের পূর্বের ছিলো। এইবার বল্, কেউ কি ভুল কইরাও ওয়াসিফ পূর্বরে ঘাঁটাইতে যাইবো? কারোর কি ওই সাহস আছে? পূর্ব এমন একখান মাল রে ভাই, ক্ষমতায় না থাইকাইও ক্ষমতা লাগাইতে পারবো। মাহতিম দেশে ছিলো না ঠিকই, অথচ ওর বুদ্ধি দ্যাখ কোন্ লেভেলে গেছে। একেবারে ওয়াসিফ পূর্বরে ধইরা সব ধামাচাপা। রজনীর মতো পাবলিক টাকা ফালায়া কাজ করায়, আর পূর্ব ভাই কাজ দিয়া কাজ সারায়। কতো বড় কাহিনি হইছে একবার ভাব্? এই ঘটনা আব্বামশাই আমারে বলতে চায়নাই। আমিই টিপ্পা-টিপ্পা, খুচায়া-খুচায়া, কঠোর সংগ্রামের পর বাইর করছি।
‘ ওয়াসিফ পূর্ব ‘। একসময় বেশ আলোচিত ছিলো। ঢাকার সেই উত্তাল কাহিনি এখনো স্মরণীয়। প্রতিটা খবরে-খবরে যার নামে হেডলাইন থাকতো। এখন সে নিরস্ত অবস্থায় থাকে। নিরপেক্ষ সাধারণ জনগণের মতো চলে। পরিবার নিয়ে দেদারসে দিন কাটাচ্ছে। অমানুষিক কষ্টভোগের পর সে আবারও স্বাধীন। ক্ষমতার চাবিকাঠি আবারও তার মুঠিতে। কবজা করেছে কিছু অনৈতিক সিস্টেম। এখনো তার আদর্শে দাগ লাগেনি। টাকার জোরেই হোক, বা কিছু জনগনের আশ্বাসে, সে এখনো নিজের শক্ত নীতিতে বলিয়ান। রাজনীতির কার্যকলাপে আর যুক্ত নেই। ছেড়েছে সরকারি দল। সবকিছু থেকে দূরে থাকলেও মানুষের প্রতি দায়িত্ব কমেনি। আজ বেড়েছে বহুগুণে। জীবনের একটা সময় খুব ভরসা করতো। ভরসা করতো রাজনীতির মূল নীতিতে। কিন্তু পদে-পদে সে সংজ্ঞা বদলে গেছে। হারিয়ে গেছে মনুষ্য-ধর্ম। ঢুকেছে অরাজকতার গ্রাস। যেই গ্রাস থেকে মুক্তি পাওয়া কোনোদিন সম্ভব না। জীবনের দুঃখগুলো আমৃত্যু স্মৃতিপটে থাকবে। স্মরণে থাকবে সেই সব কালো অধ্যায়। যেই অধ্যায়ের প্রতিটি পাতায় কষ্ট ছিলো, দুঃখ ছিলো, হেরে যাওয়ার বেদনা ছিলো, আত্মসম্মানের ধ্বংস ছিলো। চোখ বুজলেই সেই দিনগুলো ধরা দেয়। কত বীভৎস ছিলো, কি যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি ছিলো। ওয়াসিফ পূর্ব আজও সেদিনের কথা স্মরণ করে। বেলাশেষে কোনো এক ক্লান্ত মূহুর্তে জেলের দিনগুলো মনে পড়ে। মনে পড়ে একমাত্র প্রেয়সী, একমাত্র নারী, একমাত্র সঙ্গীর সেই কঠোর বিশ্বাস। পূর্ণতা কবির, তুমি বড় বেহায়াই ছিলে। নাহলে ওয়াসিফ পূর্বের মতো হেরে যাওয়া কাঙ্গালকে তুমি ছেড়ে দিতে, ভুলে যেতে, হয়তো অন্য কারো সংসারে পাড়ি জমাতে।
.
অফিশিয়াল গাড়িটা প্রস্তুত। দুটো লাগেজ তোলা শেষ। নোমান ড্রাইভিং সীটে বসে আছে। রাত এখন সোয়া আটটা। গুড়ুম-গুড়ুম গর্জনে মেঘ ডাকছে। মাঝে-মাঝে আকাশ চিড়ে ভয়ঙ্কর স্ফুলিঙ্গ হচ্ছে। বাতাসও ছেড়েছে খুব। মনেহচ্ছে বৃষ্টি হবে। উঠানের কোণায়-কোণায় মানুষের জটলা। বেশিরভাগ সেখানে গেরস্থ মহিলারা। সবার মুখে-মুখে শোকের বুলি হচ্ছে। তার চেয়েও বেশি আলোচনা হচ্ছে মাহতিমের যাওয়া নিয়ে। এমন একটা দূর্ভোগ সময়ে কি করে চলে যাচ্ছে? কেউ-কেউ এটা নিয়ে ঘোর আপত্তি জানাচ্ছে। কেউ-কেউ ব্যাপারটা নিয়ে যুক্তি বাক্য আওড়াচ্ছে। কেননা, সবাই আজ-নয়তো-কাল শোক কাটিয়ে উঠবে। ভুলে যাবে আজকের এই ব্যথা। মেহনূর পুরোপুরি জ্বরাক্রান্ত। দেহের তাপমাত্রা ভয়াবহ আকারে বাড়ছে। কমার কোনো নাম-গন্ধ নেই। মাহতিম আর দেরি করলো না। দু’হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিলো। বাড়িভর্তি মানুষের সামনে ওই অবস্থায় নিচে নামলো। গাড়ির দিকে যেতে-যেতেই তুমুল বাতাস ছেড়েছে। আকাশে বিদ্যুপৃষ্টের আভাস। নোমান সীট থেকে নেমে দ্রুত দরজা খুলে দিলো। বসের দিকে আশঙ্কাজনক কন্ঠে বললো,
– স্যার, ওয়েদারটা ভালো লাগছে না। আপনি কি রিস্ক নিবেন?
মাহতিম সীটে বসতে-বসতেই স্বভাবসূচকে উত্তর দিলো,
– ওয়েদারের সাথে কি রোমান্স করবো? রিস্কের কথা আসছে কেন? তোমার যদি সমস্যা থাকে এক্ষুণি বলে দাও। আমি মাঝ রাস্তায় কোনো সিন-ক্রিয়েট চাই না।
নোমান তৎক্ষণাৎ জিভ কামড়ে ‘ না ‘ সূচকে বললো,
– ছিঃ ছিঃ স্যার। আমি ওটা মিন করিনি। আপনিতো ম্যামকে নিয়ে যাচ্ছেন, তার উপর ম্যামের খুব জ্বর। যদি অবস্থা ক্রিটিক্যাল হয়, তখন তো মেডিকেল সার্ভিস পাবো না।
মাহতিম কোনো কথাই বললো না। শুধু চোখ ঘুরিয়ে নোমানের দিকে চাইলো। তাতেই নোমান ভিড়মি খেয়ে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে সীটে গেলো। সুজলা-সহ বাকিরা সবাই এসে গেছে। তীব্র বাতাসে ধূলো উড়ছে। সেই অবস্থায় বিদায় জানালো মাহতিম। সুজলার হাতটা শক্ত করে ধরলো। ভরসাজনক কন্ঠে শান্তভাবে বললো,
– যেকোনো প্রয়োজনে শুধু একবার কল করবেন।বাকিটা আমি দেখে নিবো। আপনি কোনো ব্যাপারে টেনশন করবেন না। এখনো আপনার দায়িত্ব কমেনি। আমার শ্যালিকা দুটো অবিবাহিত আছে। তাদের কথা চিন্তা করে মুখে খাবার নিবেন। শরীরে প্রতি অবহেলা করবেন না। আমি পৌঁছে আপনাকে ফোন দেবো। কোনো ভয় নেই।
এবার দৃষ্টি ঘুরালো শেফালির দিকে। মৃদ্যু হাসি দিয়ে বললো,
– আপনাকে মেজোমা বলবো, নাকি মেজো মামী? আপনি যে এভাবে কাঁদবেন আমার জন্য নতুন ছিলো। নিজেকে শক্ত করুন। ওভাবে হাউমাউ করে কাঁদতে নেই। শুনেছি মৃত মানুষের কষ্ট হয়। আপনিও শরীরের প্রতি যত্ন নিবেন। অসুখ-বিসুখ হলে কিপ্টেমি করবেন না। আমাকে কল দিবেন। আপনার সাথে তো পুরোনো সম্পর্ক, মনে আছে না?
বিদায়ের পালাক্রমে তৌফের দিকে তাকালো। চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিলো, ‘ সব দেখে রাখিস। আমি আসছি ‘। তৌফও চোখ বন্ধ করে আশ্বস্ত করলো। বুঝিয়ে দিলো, ‘ কোনো টেনশন নেই। আমরা আছি ‘। স্থির গাড়িটা স্টার্ট দিলো নোমান। ইন্ঞ্জিন চালু হতেই মৃদ্যু-মৃদ্যু কাঁপছে। জানালার বাইরে সবার শোকাহত চেহারা দেখতে-দেখতে গাড়িটা শোঁ করে ছুটলো। একটা চাপা নিশ্বাস ছাড়লো মাহতিম। তাকালো মেহনূরের দিকে। গাড়ির রুফ-টপ লাইটের মৃদ্যু আলোয় লালচে মুখটা দেখা যাচ্ছে। ঠোঁটদুটোর মাঝে সরু ফাঁক, ফাঁকটুকু দিয়ে জ্বরের কাতরানো দমটা বের হচ্ছে। চোখের দু’কোণা দিয়ে কিছু সময় পরপর অশ্রু পরছে। সীট থেকে টেনে কোলে বসালো মাহতিম। মাথাটা বুকের বাঁদিকটায় আগলে ধরলো। মেহনূরের তপ্ত গালটা পাণ্ঞ্জাবী ভেদ করে বুকে লাগছে। পুরো শরীরটা অতিমাত্রায় গরম। এসিটা অফ করে জানালা খুলে দিলো। দু’হাতের ভেতর মেহনূরকে জড়িয়ে রেখে মাথাটা পিছে হেলালো মাহতিম। তখনই বুকের কাছে ঘুমন্ত মাথাটা নড়চড় করে উঠলো। তড়াক করে চোখ মেললো মাহতিম। ওর ডানগালটায় হাত রেখে আলতো সুরে বললো,
– খুব খারাপ লাগছে?
মেহনূর আধবোজা দৃষ্টিতে তাকালো। শুকনো গলায় ঢোক গিলে ফিসফিস করে বললো,
– পানি,
ত্রস্তভঙ্গিতে পানি জোগাড় করলো মাহতিম। বাঁহাতে মেহনূরকে আগলে রেখে ডানহাতে পানিভর্তি বোতলটা এগিয়ে দিলো। ঠোঁটের কাছে কাত করতেই কয়েক ঢোক পানি খেলো মেহনূর। বোতলটা মুখভর্তি করতেই মেহনূর আবার বলে উঠলো,
– কোথায় যাচ্ছেন?
মাহতিম মুখ নিচু করলো। মেহনূরের কাছাকাছি মুখ এনে হালকা হাসিতে বললো,
– আমার নেভি ফিল্ডের কাছে। তোমাকে এখন থেকে আমার কাছেই রেখে দিবো। কোত্থাও যেতে দিবো না। শুধু তুমি আর আমি থাকবো।
চোখ বন্ধ করে গভীর নিশ্বাস নিলো মেহনূর। গলা আবার ভিজিয়ে নিভু-নিভু চাহনিতে বললো,
– এবার আপনি মিথ্যে বললে আমি অনেক দূরে চলে যাবো। আমাকে কোথাও খুঁজে পাবেন না।
জ্বরের ঘোরে প্রলাপ শুনে মিচকি হাসলো মাহতিম। গরম নাকের ডগাটায় ছোট্ট চুমু বসিয়ে বললো,
– আমাদের দুই থেকে তিন হতে হবে না? আজীবন কি দুই-ই থেকে যাবো?
আধবোজা চোখদুটো আবার বন্ধ করলো। ঠোঁটের কোণে লজ্জার এক চিলতে হাসি ফুটতেই চক্ষুকোল ঘেঁষে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়ালো। ওর ডানগাল থেকে হাত সরালো মাহতিম। চোখের দু’কোণা মুছে নম্র গলায় বললো,
– তোমার কোলজুড়ে ছোট্ট আদরটা চলে আসবে মেহনূর। তোমাকে আধো-আধো কন্ঠে পাগল করার জন্য আসবে।
কপালে ছোট্ট চুমু খেয়ে মুখ তুললো মাহতিম। ওর চুলের অরণ্যে শ্রান্তির নির্যাসে আঙ্গুল বুলাতে লাগলো। মেহনূরও কিছুটা আরামবোধে তন্দ্রায় ডুবে গেলো। নোমান স্লো ভাবে গাড়ি চালাচ্ছে। মনোযোগটা একদম ড্রাইভের দিকে। মাহতিম স্বাভাবিকভাবে সামনে তাকাতেই হঠাৎ লেফট-মিররে থমকে গেলো। চোখ স্থির করে তৎক্ষণাৎ ভ্রুঁ কুঁচকালো মাহতিম! লেফট-মিররে ওটা কি? গাড়ির পেছনের দৃশ্যটা বাঁদিকের মিররে ফুটে উঠেছে। পেছন থেকে ধাওয়া করছে দুটো বাইক! শান্তভাবে ঢোক গিললো মাহতিম। সিচুয়েশনটা নরমাল লাগছে না।
চলমান .
#FABIYAH_MOMO .