#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ .
#পর্বসংখ্যা_২৪.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
বলিষ্ঠ হাতদুটো শক্ত করে জড়িয়ে আছে। ঘুমের মধ্যে ঘন-ঘন নিশ্বাসগুলো স্পষ্ট অনুভব করছে। একটু নড়তে চাইলো মেহনূর, কিন্তু হাতদুটোর জন্য পারলো না। নিদ্রালু মুখটা দেখে খুব মায়া লাগলো। এই মায়ার কোনো ব্যাখ্যা নেই। দেখলেই মনেহয় একটু ছুঁয়ে দেই। একটু বিশেষ ভাবে আদর করি। একটু কাছে টেনে তাকে উষ্ণতার চাদরে ঢেকে দেই। ওই মুখটায় যেন বিশেষ কিছু আছে। একবার তাকালে চোখদুটো চুম্বকের মতো আঁটকে যায়, বুকের ভেতরটা শীতল হয়; নরম অনুভূতিতে প্রাণটা শিরশির করে। মানুষটা আজও বুকের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে। কি শান্তি, কি নির্ভার, কি দুঃখহীন নিশ্চিন্তের ঘুম! ঘুমন্ত চেহারায় ছেয়ে আছে পবিত্রতার লালিমা। সে যে পাষাণ নয়, সে যে মুক্ত পাখির মতো নিষ্পাপ। চুলের ফাঁকে-ফাঁকে আঙ্গুল গুঁজে মাথাটা বুলিয়ে দিলো মেহনূর। সমস্ত শরীর যেন উদ্বেলিত হলো ওর। ঠোঁটদুটোর পানে দৃষ্টি দিয়ে মনটা কেমন চনমন করে উঠলো। বালিশ থেকে মাথাটা কিন্ঞ্চিত তুলে ঠোঁটে টুপ করে চুমু খেলো। ঠোঁটে উষ্ণ পরশ পেয়ে তন্দ্রার ঘোরটা সামান্য পাতলা হলো মাহতিমের, নিভু-নিভু চোখে মেহনূরের দিকে তাকালো। প্রচণ্ড ঘুমের হাতছানিতে নেত্রপল্লব বুজে আসছে, তবুও মাথা উঠিয়ে ঘুমঘুম কন্ঠে বললো, ‘ তুমি আবারও ঘুমের মধ্যে চুমু — ‘। শব্দটা আর বলতে পারেনি সে। সেই মূহুর্ত্তেই মেহনূর ঠোঁটের উপর আঙ্গুল চাপা দেয়। চট করে দুহাতে মাথাটা বুকে জড়িয়ে ধরে। মেহনূর চোখ বন্ধ করে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘ আমি বুঝতে পারিনি গো। আর করবো না। আমি ভুলে গেছিলাম। এবারের মতো ক্ষমা চাই ‘। ঘুমের মধ্যে আদর পাওয়াটা মাহতিমের ঘোরতর অপছন্দ। সে বলেই দিয়েছে, কখনো আদর দিলে জ্ঞানে-সজ্ঞানে দিও। বিছানার চারিদিকে ফিনফিনে পর্দা দেওয়া। জানালার গরাদ দিয়ে পাতলা হাওয়া ঢুকছে। বাইরে এখন বৃষ্টি নেই। ছাদ ধুয়ে পানি পরার শব্দটা ঝর্ণার মতো হচ্ছে। প্রকৃতির মায়ায় কোথায় যেন বিষণ্ণ কন্ঠে কোকিল ডেকে উঠলো। সেই সুরে তাল মেলালো কান্নারত কুকুর। চমকে তাকালো মেহনূর! এমন লাগছে কেন? কেমন যেন অস্থির-অস্থির ভাব! এ সময় কোকিল ডাকে?সাঁঝের বেলায় কুকুর কাঁদে? নাতো, কিছুই ঠিক লাগছে না। প্রচণ্ড অদ্ভুত লাগছে। এ কেমন অনুভূতি? ইচ্ছে করছে মাহতিমকে কোথাও লুকিয়ে রাখতে। কিন্তু এমন অনুভূতি হবার কারণ কি? মস্তিষ্কটা এমন উদ্ভট-উদ্ভট ভাবছে কেন? কেন তাকে চিন্তার প্রতিযোগিতায় ছেড়ে দিচ্ছে? এটা কি আগাম কিছুর ভয়, নাকি সাধারণ কোনো চিন্তা?
– হার্টবিট ফার্স্ট। পালস রেট ওয়ান ফোর্টি। নিশ্বাস স্বাভাবিক না।
মেহনূর চরমভাবে হতবাক! হকচকিয়ে ঘুমন্ত মুখের দিকে বিষ্ময় দৃষ্টিতে তাকালো। ঘুমুঘুমু কন্ঠে কথাগুলো উচ্চারণ করেছে মাহতিম। কি সাংঘাতিক কারবার! এখনো তার চোখের পাতা তন্দ্রার ঘোরে বন্ধ, অথচ ঠাস-ঠাস করে উর্বরমস্তিষ্কে কিসব কথা বললো! মেহনূর নিজের ব্যতিব্যস্ত অবস্থাকে শান্ত করে উজবুক সুরে বললো,
– আপনি ঘুমাননি?
মাহতিম ঘুমন্তাবস্থার ভেতর ক্ষুদ্র কন্ঠে বললো,
– ভেঙেছে।
মেহনূর ভীতুর মতো সিলিংয়ের দিকে তাকালো। একটা ঘুমন্ত ব্যক্তি কিনা হার্টবিট গুণে-গুণে সবটা আঁচ করেছে। এমন উদ্ভট কৌশল দেখে মেহনূর কিংকর্তব্যবিমূঢ়। গোয়েন্দার মতো আশ্চর্যজনক ব্যবহার দেখে মেহনূর চোরের ভঙ্গিতে ঢোক গিললো। এই লোকের কাছে যতবার কিছু লুকোতে চেষ্টা করেছে, ততবারই বাজেভাবে ধরা খেয়েছে। তাই বলে এবারও? এবারও যে এরকম কিছুর মুখোমুখি হবে, তা যে চিন্তাই করা যায়নি। মেহনূর সরল চোখে প্রশ্নাত্মক কন্ঠে শুধালো,
– আপনার কি গো/য়েন্দার শিক্ষাও গুলে খাওয়া শেষ? সুস্থ মানুষের মতো ঘুমাতে দেখলাম, আর এখন কিনা তাগড়া ব্যক্তির মতো জেরা করছেন?
মাহতিম সেই প্রসঙ্গে গেলোই না। নিজের অনুমান করা থিসিসের উপর স্থির থেকে বললো,
– তোমার কোন্ জায়গাটায় ঘুমাচ্ছি নিশ্চয়ই বুঝতে পারার কথা। যেখানে কান রেখে শুয়ে আছি, সেখানে স্টেথোস্কোপ ছাড়াই হার্টবিট বলতে পারবো। তোমার বুকের একেকটা হিংস্র ধুকপুকনি আমার শরীরে তাল ঠুকছে মেহনূর। এখানে একটু আদর দিলে কি তোমার ছোট্ট হার্টটা শান্ত হবে?
এমন কথা শুনে মেহনূর চাপা উত্তেজনায় কুণ্ঠিত হলো, মুখে কিছুই বললো না। কম্বলটা টেনে মাহতিমের মাথাটা ঢেকে দিলো। বাইরে থেকে কনকনে শীতের মতো হাওয়া আসছে। সেটা ফ্যানের বাতাসে একীভূত হয়ে হিম অবস্থা ছড়িয়ে দিলো। মেহনূর আরো শক্ত ভাবে, আরো আড়ষ্ট হয়ে জড়িয়ে ধরলো তাকে। কন্ঠস্বর নরম করে বললো,
– কিছুই করতে হবে না। আজ তো আমার কাছে আছেন, কাল যখন ঢাকা যাবেন তখন কিভাবে থাকবো? প্রতিদিন আপনার জন্য ভোর পাঁচটায় উঠাটা অভ্যেস হয়ে গেছে। আপনার জিনিসগুলো হাতের কাছে রাখা, আপনার জন্য চটপট নাস্তা বানানো, দরজায় দাঁড়িয়ে আপনাকে বিদায় দেওয়া, এসব যে আমার রুটিন হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় ফিরে আপনার ঘামার্ক্ত শার্টটা খুলে নেওয়াটা আমার এমন কর্তব্য হয়ে গেছে যে, একদিন যদি এটা থেকে বন্ঞ্চিত হই, মনেহয় ‘ কি যেন করিনি, কি যেন করিনি ‘।
মাহতিম নড়েচড়ে উঠতেই মাথা থেকে কম্বলটা সরে গেলো। আবারও মুখ তুলে আধো-আধো নজরে মেহনূরের দিকে তাকালো। একটু হাসি দিয়ে গাঢ় হয়ে বললো,
– তুমি না-থাকলে আমার অবস্থাটা অন্ধকার হতো মেহনূর। যে দুটো বছর দূরে ছিলাম, আমার কি যে কষ্ট হয়েছে। না-ছিলো আমার খাওয়া-দাওয়ার প্রতি নজর, না-ছিলো শরীরের প্রতি মনোযোগ। যেদিন থেকে তুমি এলে, আমার সবকিছু দুহাতে সাজিয়ে-গুছিয়ে দিলে।
মেহনূর শুকনো মুখে হাসলো। ডানহাত বাড়িয়ে মাহতিমের গালে-কপালে হাত বুলিয়ে দিলো। দ্বিধাহীন চোখে সরল ভঙ্গিতে বললো,
– আমার সবটুকু ঐশ্বর্য যেদিন আপনার দরবারে তুলে দিলাম, সেদিনই আপনার সত্তাটা নিজের করে নিয়েছি। আজ কাজের উছিলায় দূরে যাচ্ছেন, দয়াকরে আমার সুস্থ মানুষটাকে ফিরিয়ে দিবেন। আমি আর কিছুই চাইবো না, আর কোনোকিছুর জন্য অনুরোধ করবো না। ভেবে নিন, আপনার কাছে এটাই আমার জীবনের সর্বশেষ আবদার। আমার আবদারের ঝুলি আজীবনের জন্য তুলে নিলাম। আর কোনোদিন এই মুখে কিছু চাইবো না।
মেহনূর চোখ সরিয়ে ডানদিকের জানালায় তাকালো। এইটুকু কথা বলতে-বলতে কেন চোখ দিয়ে দরদর করে পানি ছুটলো, সে কিছুই জানে না। শুধু অনুভব করলো তার বুকের ভেতর এই সামান্য কথাটা গভীরভাবে দাগ কেটেছে। বারে-বারে মুখ দিয়ে এমন কথা বেরুচ্ছে যেটা অশনি দিকের সূত্র। সন্ধ্যার আধো-আধো অন্ধকারে রুমটা আলোহীন। শান্ত আকাশটার দিকে তাকিয়ে বালিশটা নিরবে-নিরবে ভিজে যাচ্ছে। হঠাৎ মৌনভাবে গলা ও ঘাড়ের মাঝে মুখ নামালো মাহতিম। ঠোঁটটা ওর কানের কাছে রেখে শ্রাব্য-সীমায় বললো,
– তুমি আমার কাছে চাইবে, আমি দেবো। এভাবে আবদারের ঝুলি তুলে নিলে তো কষ্ট পাবো। মনে করবো, তোমার আবদার শোনার জন্য বোধহয় আর বাঁচবোই না।
মেহনূর দু’চোখ খিঁচে ফুপিয়ে উঠলো। দাঁত দিয়ে ঠোঁটটা এমন ভাবে কামড়ে ধরলো, দাগ বসে যাচ্ছে নিচের ঠোঁটে। নাকটা দমকে-দমকে ফুলে উঠছে তখন। চোখের পাপড়ি ভিজে স্রোতের মতো দু’প্রান্ত দিয়ে ঝরছে। গলা দিয়ে স্বর বেরুচ্ছে না, তবুও আঁটকে-আঁটকে বহু চেষ্টায় বললো,
– আমি আবারও বলছি, আপনি নোমানকে নিয়ে যান। যদি তাও সম্ভব না-হয়, আমার কোনো সিকিউরিটি গা/র্ড লাগবে না, আপনি তাদের নিয়ে যান; তাও যদি ব্যর্থ হয়, আপনি পরিচিত কাউকে সঙ্গে রাখুন। আপনার শত্রুর চেয়ে আমি আপনাকেই বেশি ভ/য় পাই। আপনি কারোর কথা শুনেন না। এইযে আমি গা/ধা/র মতো চেঁচিয়ে যাচ্ছি, আপনি তবুও —
মাহতিম ঠোঁটে ‘ শ ‘ জাতীয় শব্দ করে থামিয়ে দিলো। আস্তে করে ওর পিঠের নিচে ডান হাত, মাথার নিচে বাঁ-হাতটা গলিয়ে দিলো। বিছানা ও বালিশ থেকে সন্তপর্ণে নিজের দুহাতের মধ্যে রুদ্ধ করলো। ভেজা গালটায় নিজের সুক্ষ্ম সূঁচালো গাল চেপে বললো,
– কেঁদো না, চুপ কর। যদি তোমার মনেহয় আমার সঙ্গে কেউ থাকলে তুমি নিশ্চিন্তে থাকবে, তাহলে আমি মানুষ নিচ্ছি। টেনশন কোরো না। আমার জুনিয়র কাউকে বলে দিচ্ছি, ও এসে যাবে। তুমি ঠান্ডা হও লক্ষ্মী। আমিতো বেশি দিনের জন্য যাচ্ছি না। এইতো তিনদিন, তারপর ঠিক এসে পরবো।
.
‘ মালিবাগ ‘, ঢাকার ব্যস্ততম জায়গা। অসংখ্য মানুষের কিলবিল উপস্থিতি। অগণ্য গাড়িতে ঘিন্ঞ্জি এক এলাকা। সেখানে নিশ্বাস নিলে দম যেন আঁটকে আসে, ঠিক এতোটাই বিষা/ক্ত বাতাস। ধূলোয়-ধূলোয় পথঘাট অন্ধকার। মানুষের হৈচৈয়ে সদাসর্বদা সরব। এমনই একটি জায়গায় দিনক্ষণ স্থির করেছে। সেখানে দেখা করবে দুই প্রান্তের দুই মানুষ। আজ কেউই জানে না, সামনে কি অপেক্ষা করছে। কারোর জ্ঞাতব্যে নেই, কি ধরনের উ/গ্র পরি;কল্প;নার শি/কার হবে। নৃ;শং/সভাবে কিছু করার জন্য ওত পেতেছে একদল। ক:লু-ষিত চিন্তা নিয়ে অপেক্ষা করছে তারা। কখন শি!কারের জালে পা ফেলবে জ/লজ্যা/ন্ত শি/কার। এতোটাই নি/ষ্ঠু/র পরিচয় দেবে যে, মানুষের ক/লি/জা শুদ্ধ কেঁ/পে উঠবে। দেহের প্রতিটি অঙ্গ এমনই ভাবে ক্ষ/তবী/ক্ষ;ত করবে যে, নূন্যতম চেনার অবশিষ্টটুকু রাখবে না। খবরের পা;তায়-পা;তায় উঠবে লো/মহর্ষ/ক শিরোনাম। এই ক্রু/র/তা মানুষের সুস্থ চিন্তাকে দুলিয়ে দিবে। ভ/য় ধরাবে মনে-মনে। তাদের ভাবতে বাধ্য করবে, হিং/স্র পশুর চেয়ে হিং/স্র মানুষ বিপ-দজ্জ/নক।
ভোরের আলো ফুটে দিক-দিগন্তে ছড়ালো। জেগে উঠলো মফস্বলবাসী। সর্বপ্রথম জাগ্রত হলো পাখ-পাখালি। চক্ষু কপাট মেললো মেহনূর আফরিন। পুরো রুমটায় আলোয়-আলোয় ঝিকিমিকি করছে। সূর্যের তেজালো রশ্মি দেয়ালে-দেয়ালে ছেয়ে আছে। মাথার উপর ফ্যান ঘুরার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। এখনো পর্দা ঘেরা শয্যায় শুয়ে আছে মেহনূর। আলস্যপরায়ণ দেহটা যেন আরেকটু ঘুম চাচ্ছে। দুটো মিনিটের জন্য চোখজোড়া বন্ধ করলো। সুন্দর মূহুর্তগুলো স্বচ্ছ হাসিতে রোমন্থন হচ্ছে। বৃষ্টিস্নাত কাণ্ডটার কথা চিন্তা করলেই কান গরম হয়ে যায়। অথচ, কাল একটুও লজ্জা করেনি। মনে হয়েছে, আরেকটু যদি স্নেহাদর দেওয়ার সৌভাগ্য থাকতো, সবটুকুই বিলিয়ে দিতো মেহনূর। পুরো একটা বিকেল, পুরো একটা রাত, দুটো প্রাণ মিলেমিশে এক ছিলো। যাকে এতোদিন হাসিখুশিরূপে সচ্ছল ভঙ্গিতে দেখেছে, তার এই প্রণয়ী আচরণ ছিলো রোমান্ঞ্চকর। মেহনূর চোখ খুলে ডানপাশে তাকালো, দেখলো সে নেই। আজ বিচলিত হলো না; বরন্ঞ্চ,এই সময় মুখোমুখি হবার লজ্জায় প্রাণপণে লুকাতে চাইলো। বিছানা থেকে নেমে শাড়ি হাতে বাথরুমে গেলো। শাড়িটা পরে গামছায় চুল ঝারতে-ঝারতে বেরিয়ে এলো মেহনূর; কিন্তু একি! এখনো রুম খালি? হঠাৎ কি যেন ভাবনায় চুল ঝারার হাতটা থেমে গেলো। কপালে ঈষৎ কিছু ভাঁজ ফেলে ওভাবেই দৌঁড় লাগালো! গামছাটা ফ্লোরে ফেলে চটজলদি বিছানার বালিশ উঠালো, আলমারির দ্বার খুললো, খাটের তলায় নজর দিলো। ট্রাভেল ব্যাগটা নেই!ণ থমথমে দৃষ্টিতে চোয়াল ঝুলিয়ে উঠে দাঁড়ালো মেহনূর। হতভম্বের মতো ড্রেসিং টেবিলের সামনে গেলো সে। আয়নায় দেখা যাচ্ছে, স্বচ্ছ গ্লাসটার নিচে কাগজ চাপা। মেহনূর চোয়াল ঝুলানো অবস্থায় কাগজটা হাতে নিলো। ওখানে পরিচিত অক্ষরে লেখা,
‘ মন খারাপ কোরো না। কল এসেছে, চলে যেতে হলো। সারারাত তো অত্যাচার করলাম, তাই ঘুম ভাঙ্গালাম না। থাকো তাহলে, আসি।
আনসারী . ‘
কাগজটা রেখে দিলো মেহনূর। উনি চলে গেছেন। মুখ ভার করে নিচে নামলো সে, দেখতে পেলো বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে। তিনি এসে নাস্তার জন্য ডাকলে মেহনূর গেলো না। সোজাসুজি প্রথম বাক্যে বললো,
– উনি কখন বেরিয়েছেন?
বৃদ্ধা অকপটে বললো,
– মেলা দেরি হয় নাই, ইট্টু আগে বাইর হইছে। বেশি হইলে আধা ঘন্টা হইবো।
ইশ! আধঘন্টা? কেন এমন হলো? মেহনূর হাপিত্যেশের সুরে বললো,
– আমি খাবো না, আমি বাসায় যাবো।
কথাটা বলেই মেহনূর বিদায় নিলো। এখানে একবিন্দু থাকতে ইচ্ছে করছে না। বাইরে আগে থেকেই গাড়ির ব্যবস্থা করা ছিলো, তাতে চুপচাপ উঠে পরলো মেহনূর। গাড়িটা স্থিরতা ভেঙ্গে চলতে শুরু করলে মেহনূর মুখ ফিরিয়ে বাড়িটা দেখতে লাগলো। বিষাদের অনলে বুকটা দুমড়ে-মোচড়ে আসছে। একবার যদি ডেকে দিতো? কানের কাছে শুধু একবার ‘ ও মেহনূর ‘ বলতো? দেয়নি। মেহনূর চোখ বন্ধ করে মাথা ঘুরিয়ে সামনে তাকালো। হঠাৎ সামনের সিট থেকে অনবরত ফোন বাজছে। ড্রাইভ করছে নোমান। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ কম মেহনূরের, তবুও ফাঁকে-ফাঁকে শুনলো, ‘ জ্বী, জ্যাম? আচ্ছা, ঠিকআছে ‘। ফোনটা রাখতে দেরি, হঠাৎ গাড়িটা এমন স্পিডে হাঁকালো, মেহনূর ভয়ে-উত্তেজনায় কপাল কুঁচকে বললো,
– নোমান ভাই, স্পিড বাড়ালেন কেন? এক্ষুণি স্পিড কমান। কি শুরু করলেন আপনি? কথা শুনতে পাচ্ছেন না? আপনাকে স্পিড কমাতে বলেছি না?
প্রচণ্ড স্পিডে গাড়ি ছুটছে। নোমান শুনেনি। এক্সিলেটর দুর্দান্তগতিতে বাড়ছে। দুপাশের জানালা দিয়ে শাঁ শাঁ ধ্বনিতে বাতাস হানছে। মেহনূর আবার চেঁচালো, ফলাফল শূন্য। নোমানের এই আমূল পরিবর্তন দেখে মেহনূর নির্বাক! ওই কলটা কার ছিলো? খারাপ চিন্তাটা বদ্ধমূলভাবে জেঁকে ধরছে। মানুষের উপর তিল পরিমাণ ভরসা করা যায় না। মেহনূর হাত মুঠো করে শক্তভাবে বসলো। ড্রাইভ করতে-করতেই আরেকদফা কল আসলো। এরপর যে কাণ্ডটা হলো, তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলো না। নোমান একহাতে ড্রাইভ করতে-করতে ফোনটা পিছু বাড়িয়ে দিলো। তাড়াহুড়ো কন্ঠে বললো,
– ম্যাম, ধরুন। কলটা আপনার।
মেহনূর ভয় বিদীর্ণ করে ফোনটা হাতে নিলো। কৌতুহল চোখে আশেপাশে দেখতে পেলো, আচানক স্পিড কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে স্ক্রিনে লেখা ‘ M.A.B. ‘. মেহনূর ঢোক গিলে ফোনটা কানে চেপে বললো,
– হ্যা-হ্যালো,
আমতা-আমতা সুরটা সিগন্যাল দিতেই কর্তৃত্বপূর্ণ গলাটা ভেসে এলো,
– দেখোতো আশেপাশে আছি নাকি।
মেহনূর চরমভাবে ছটফট করে উঠলো। ডানে-বামে পাগলের মতো তাকাতে লাগলো। কোথাও দেখতে না-পেয়ে ফোন ধরা অবস্থায় বললো,
– কোথায়? দেখছি না, একটু হাত বের করুন।
বলতে-বলতে মেহনূর পিছু ফিরে তাকালো। তাদের গাড়ির পিছু-পিছু অসংখ্য গাড়ি আসছে। কিন্তু কোনটা সেই আকাঙ্ক্ষী গাড়ি? মেহনূর হন্যে হয়ে নিরুপায় গলায় বললো,
– এখনো দেখছি না। আপনি কি মজা করছেন? কোথায় আছেন? কোন গাড়ি?
একটু থেমে মাহতিম বললো,
– ওহহো, এখনো দেখোনি? দাঁড়াও।
বুকটা প্রচণ্ডরূপে ধুক-ধুক করছে! কানে এখনো ফোনটা ধরা। কখন-কোনদিক ছুটে আসে মেহনূর জানে না। হতবিহ্বল হয়ে অস্থিরচিত্তে নিশ্বাস নিচ্ছে। হঠাৎ হর্ণ বাজাতে-বাজাতে ছুটে এলো গাড়ি। মেহনূর ধড়ফড় করে ডানদিকে তাকালো! এক মূহুর্ত্তের জন্য সবকিছু স্থির! শুধু ধুকপুক-ধুকপুক হৃদ ছন্দটা শোনা যাচ্ছে। চোখের পলক নিশ্চলভাবে জানালার বাইরে গেঁথে গেছে।চলন্ত গাড়ির ড্রাইভিং সিটে স্বয়ং মাহতিম আনসারী বসে। গায়ে আজ নেভি শার্টটা ফর্মাল গেটআপে পরা। বুকের উপর তেরছা ভাবে সিটবেল্ট লাগানো। মাথার চুল আজও জেল দিয়ে সেট।কানে কালো ব্লু-টুথ। মেহনূর মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে ধীর গলায় বললো,
– পাশের শূন্য সিটে চলে আসি?
দৃষ্টি ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকালো মাহতিম। স্টিয়ারিং ধরা অবস্থায় দুষ্টু হাসিতে বললো,
– আসেন, আবার ফিরে যাই?
মেহনূর পালটা হাসিতে নিশ্বাস ছাড়লো শুধু। দূর থেকে মাহতিম বাঁ-হাত উঁচিয়ে কিছু একটা দেখালো। তার কবজির কাছে গোল হয়ে রক্ত জমে আছে। চোখে-মুখে দুষ্টু হাসি টেনে নিঃশব্দে ঠোঁট নাড়িয়ে বললো,
– ট/র্চার,
রাতের ঘটনা স্মরণ করতেই চোখ নামালো মেহনূর। ইশ! এই কাজটা কখন করলো? এখন যে এটা নিয়ে প্রচুর খোঁটা শোনাবে। হঠাৎ ফোনের ওপাশ থেকে ঠান্ডা সুরে বললো, ‘ আসি, নিজের খেয়াল রেখো ‘। চট করে দৃষ্টি তুললো মেহনূর, তাদের গাড়িদুটো আর পাশাপাশি নেই। রাস্তাটা দু’দিকের দুই সড়কে ভাগ হয়ে গেছে। মেহনূর সিটে গা হেলিয়ে ফোনটা কোলে নামিয়ে ফেললো। হৃদয়ঙ্গম অনুভূতিতে চক্ষুজোড়া মুদিত করে বললো,
তোমারই বিহনে ফেঁসেছি আমি। রেখেছি তোমায় নয়নে। হৃদয়মৃণালে রেখেছি তোমায়, ছুঁয়ে দিয়েছি ক্ষণেক্ষণে। ভুলে গিয়েছি নিজের দুঃখ কথা, তুলে দিয়েছি আমার হাসি। মাঝে-মাঝে তোমায় কাছে পেলে, ভুলে যাই দিগ্বিদিক।
#FABIYAH_MOMO .
#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ .
#পর্বসংখ্যা_২৫ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .
অস্থিরতা কাজ করছে। মনে-মনে ভয় হচ্ছে। বারবার পিছু তাকাচ্ছে মেহনূর! কেন এমন হচ্ছে? কেন মনেহচ্ছে খারাপ কিছু হবে? চোখদুটো একটা সেকেন্ডের জন্যও বন্ধ হচ্ছে না। মাহতিমকে বিদায় দেওয়ার পর থেকে স্বস্তি পাচ্ছে না। নোমান এখন ড্রাইভে, গন্তব্য এখন কোয়ার্টারে। কেন জানি মনেহচ্ছে কিছুই ঠিক নেই। কেন এটা মনেহচ্ছে তা অবশ্য জানা নেই। কিছু হারানোর ভয়, কিছু ফেলে আসার চিন্তা, কিছু না-পাওয়ার হিসাব সবকিছু চুরমার করে দিচ্ছে। কিছু খুইয়ে ফেলার উৎকন্ঠায় মন-প্রাণ ছটফট-ছটফট করছে। গাড়িটা যত ফুল স্পিডে এগুচ্ছে, ততই মনেহচ্ছে খারাপ কিছু হবে। দুশ্চিন্তায় আর টেকা যাচ্ছে না, তৎক্ষণাৎ নিরুত্তেজ হয়ে চোখ বন্ধ করলো মেহনূর। লম্বা-লম্বা গভীর দম নিয়ে বুক ফুলিয়ে ছাড়লো। আজ কি চরম কিছু হবে? গাড়িটা ঘুরাতে বলবে? সেই মফস্বলের দিকে যেতে বলবে? মেহনূরকে দুশ্চিন্তায় দেখে প্রশ্ন করলো নোমান,
– ম্যাম কিছু হয়েছে? আপনাকে সুস্থ লাগছে না। আপনি কি ঠিক আছেন?
সিটে গা হেলিয়ে সব শুনলো মেহনূর। চোখের পাতা তখনও বন্ধ, নিশ্বাসের গতি তখনও উত্থাল। চোখের কালো পর্দার কাছে দৃশ্যমান হলো সৌম্য পুরুষটা। চলমান গাড়িটার ভেতর রোমন্থন করলো একেকটি স্মৃতি। ওই ফিনফিনে পর্দা ঘেরা রাজকীয় শয্যায় ছিলো ওই ব্যক্তি। পুরোটা দিন, পুরোটা বিকেল, পুরোটা রাতজুড়ে ছিলো পাশে। একটা মূহুর্ত্তের জন্যও কাছ ছাড়া করেনি ওকে। যেন একেকটি ন্যানো সেকেন্ড খুব দামী, খুব মহামূল্যবান। এই সময়গুলো হারাতে চায়নি মাহতিম। ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে যখন বললো, ‘ আই লাভ ইউ ‘, তখনই ওর ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে কেঁপে উঠে। যখন হাতের-ভাঁজে-হাত রেখে শক্ত করে ধরলো, তখন একটুও ভয় লাগেনি মনে। মানুষটার প্রতি বিশ্বাসের-সম্মানের-ভালোবাসার ডোরটা এতো অটুট ছিলো যে, একটা পলকের জন্যও চিন্তা লাগেনি। তবে আজ কেন তাঁর প্রতি দূর্বল হয়ে যাচ্ছে? আকস্মিকভাবে চিন্তার দুনিয়ায় বাধা পরলো। হঠাৎ কানে ব্রেক কষার চরম শব্দ হলো! সামান্য ঝাকুঁনি খেয়ে গাড়িটা থামতেই তৎক্ষণাৎ চোখ খুললো মেহনূর। যতটা স্বাভাবিকভাবে চোখ মেলে তাকিয়েছিলো, ততটাই অস্বাভাবিক হারে চোখদুটো বড়-বড় করে তাকালো। বিষ্ময়ের চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছে মেহনূর চিৎকার দিলো,
– ইয়া আল্লাহ্!
গেটের কাছে সচল এ্যাম্বুলেন্স। একটা স্ট্র্যাচারটা ধরাধরি করে তিনজন ওয়ার্ড বয় কাকে যেন নিয়ে যাচ্ছে। তাড়াহুড়ো করে এ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে ঢুকিয়ে হা করা দরজাটা ঠাস করে লাগালো। সাইরেনের গা ছমছম করা শব্দে মেহনূর কাঠ-কাঠ চোখে ঢোক গিললো। এখনো বুঝতে পারেনি কোয়ার্টারের কাছে কি হচ্ছে। এ্যাম্বুলেন্সটা একবিন্দু দেরি না-করে দ্রুতগতিতে চলে গেলো। তখনই আসল দৃশ্যটা দেখতে পেলো সে, কোয়ার্টার থেকে পরপর দুটো গাড়ি বেরুচ্ছে। একটা গাড়ির জানালা তখন খোলা ছিলো, সেখান দিয়ে নীতির কান্নারত মুখটা দেখতে পেলো। এবার নোমানও ভয় জড়িত কন্ঠে অস্থিরভাবে বললো,
– ম্যাম, মনে হচ্ছে খারাপ কিছু হয়েছে। সিচুয়েশন ভালো না, কি করবো?
মেহনূর এতোক্ষন যাবৎ পুরোপুরি স্থির ছিলো। চোখের সামনে অপ্রত্যাশিত কিছু দেখতে পেয়ে হতবাক! নোমানের কথায় সংবিৎ পেয়ে স্বাভাবিক হলো মেহনূর, তাড়াতাড়ি গাড়ি চালাতে বলে নোমানের ফোনটা হাতে নিলো। অতিদ্রুত কন্টাক্ট লিস্ট থেকে খুঁজে-খুঁজে তৌফের নাম্বারে ডায়াল করলো। গাড়িটা তখন ভয়ানক স্পিডে ছুটতেই বাজতে থাকা কলটা রিসিভ হলো,
– হ্যালো, হ্যালো তৌফ ভাইয়া? আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? আমি মেহনূর বলছি। আপনারা কোথায় যাচ্ছেন? আমি, আমি আপনাদের পেছনে আছি। ব্যাপারটা কি হয়েছে? বাইরে এ্যাম্বুলেন্স কেন?
গাড়িটা সিয়াম চালাচ্ছিলো। সিয়ামের পাশে তৌফ বসে ছিলো। মেহনূরের কথা শুনতে পেয়ে ওমনেই হড়বড় করে জানালা দিয়ে মুখ বাড়ালো। সত্যি-সত্যিই মেহনূরের গাড়িটা আসছে দেখে তৌফ আশ্চর্য হয়ে বললো,
– হায়হায় রে সর্বনাশ! এইটা কি! ভাবী আপনার গাড়িতে এতো স্পিড ক্যান? গাড়ির স্পিড কমাতে বলেন। মাহতিম দেখলে নোমানরে গলা টিপে ধরবো। তাড়াতাড়ি কমাতে বলেন।
মেহনূর কথাটা পরোয়া না-করে বললো,
– আসল কথাটা বলুন। কে অসুস্থ হয়েছে? আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে তৌফ ভাই। দয়াকরে ঘটনাটা বলুন।
চুপ রইলো না তৌফ। মেহনূরের তাগাদা দেখে বলতে বাধ্য হলো। শানাজ সকালের দিকে কোয়ার্টারে আসে। ইচ্ছে ছিলো মেহনূরকে সারপ্রাইজ দিবে, কিন্তু এসে দেখে মেহনূর নেই। সকালের নাস্তাটা কোনোরকমে খেয়ে শুতে যায়। কিন্তু ঘন্টাখানেক পরে এমন যন্ত্রণা শুরু হয়, সহ্য করতে না-পেরে সবাইকে ডাকতে থাকে সে। এদিকে সবাই কোয়ার্টারের পেছন সাইডে আড্ডা দিচ্ছে। শানাজের হাঁক-ডাক শুনতে পায়নি কেউ। পাশের ঘর থেকে মারজা তখন চিৎকার শুনতে পান। বিছানা থেকে তাড়াহুড়ো করে নামতে যেয়ে শাড়িতে পা আঁটকে মারাত্মকভাবে জখম হন। ফ্লোরের শক্ত পাটাতনে আঘাত লেগে মাথা থেকে অনর্গল রক্তের ফোয়ারা ছুটে। ওইসময় জুসের ক্যান আনার জন্য ফারিন তখন ঢুকছিলো, ওমন মর্মান্তিক শোরগোল শুনে আতঙ্কিত হয়ে ছুটে যায় সে। দৃষ্টিজোড়া তরমুজের মতো গোল-গোল করে থমকে যায়, প্রচণ্ড ভয় পেয়ে হা করা মুখে হাতচাপা দেয়। একদিকে মারজার রক্তাক্ত অবস্থা, অন্যদিকে শানাজের প্রসববেদনা। এক ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন হয়। তাড়াতাড়ি ইমার্জেন্সী কলে এ্যাম্বুলেন্স আসে, দুজনকেই হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পুরো ঘটনা শোনার পর মেহনূর। ফোন কেটে দেয়। মাথাটা মৌমাছির মতো ভোঁ-ভোঁ করছে। একি বিপদ হলো! একি হলো মাবুদ! কন্ঠরোধ হয়ে আসছে! দৃষ্টি ঘোলা যাচ্ছে। মেহনূর ঠোঁট কামড়ে শক্ত হয়ে গেলো। যতটা শক্ত হলে কান্না চাপা যায়, ততটা কসরত করলো সে।
.
রাস্তায় জ্যাম চলছে। তার উপর সাংঘাতিক গরম। মাথার উপর অরুণ চাকাটা উত্তপ্ত। গাড়ির এসিটা আরেকটু বাড়িয়ে দিলো। স্টিয়ারিংয়ে ডানহাত রেখে তবলার মতো আঙ্গুল নাড়াচ্ছে সে। অপেক্ষা করছে কখন জ্যাম ছুটবে। আশেপাশের গাড়িগুলো পিপীলিকার মতো ঠেকছে। এই শহুরে যানজট কখন ছুটবে, তার হদিশ নেই। ডানপাশের জানালা দিয়ে ডানে তাকালো মাহতিম। থেমে থাকা প্রাইভেট গাড়ি দেখতে-দেখতে হঠাৎ এক জায়গায় দৃষ্টি আঁটকে গেলো। সাথে-সাথে চোখজোড়া ছোট করে তাকালো। সতর্ক হলো মাহতিম। স্টিয়ারিংয়ে তবলা বাজানো হাতটা তখনও চলছে, এমন একটা অভিনয় করছে, যেন কিছুই দেখেনি, কিছুই বোঝেনি। লোকটার চাহনি স্বাভাবিক না, যেন পৈশাচিক ক্রুরকর্মের জন্য মুখিয়ে আছে। কিছু দূর আগেই মাইক্রোবাসটা থেমে আছে। খোলা জানালা দিয়ে যেই মাস্তান মুখটা দেখা যাচ্ছে, সেই লোকটা চোরাদৃষ্টিতে এদিকেই তাকাচ্ছে, দু’আঙ্গুলের ফাঁকে নিকোটিন চেপে সেও নাটক করছে। ওই লোকটা হয়তো ভাবতেও পারেনি, ইতিমধ্যে সে ধরা খেয়েছে। কালো সানগ্লাসের নিচে একজোড়া তীক্ষ্মদৃষ্টি তাকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখছে। লোকটা কালো কুচকুচে ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট চেপে ধরলো, একটান নেওয়ার সুযোগে আবার কাঙ্ক্ষিত গাড়িটায় চাইলো। বিড়বিড় করে পাশের জনকে শোনালো,
– অহন কিছু করতে যাইস না, ধৈইর্য্য ধর। আlকাম একটা ঘটায়া কাiইট্টা পlরোন যাইতো না। হাlলাlরে ধইরা আচ্ছামতো মlলlম লাগামু, হেরপর ওস্তাদের কাছে সাlপ্লাlয় দিমু, ঠিকাছে?
পাশেরজন চ্যাপ্টা কাঁচের বোতলে দেlশি পlদাlর্থ খেতে-খেতে বললো,
– হুন ব্যাডা, মাথা কইলাম গরম করিস না। আগে ওস্তাদের কাছে নিমু। ওস্তাদে যদি হুকুম দেয়, তখনই কlরাতের কাম করমু। তার আগে কেউ টাlচও করমু না।
সিগারেট ফুঁকা লোকটা কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললো,
– হাlলাlর পো হাlলা প্যাঁlচ লাগাইতে যাlস ক্যা? ভালা কতা হজম হয় না? এই হাlলাlয় নাটের গুরু জানোস না? পুরা একলাই একশো! লগে কেউ আহে নাই কইলাম। যদি আমগোর কপাল খারাপ হইয়া থাহে, তাইলে মনে কর জিiন্দা থাlকোনের উপায় নাই। ধlরা পরলে আজীবনের লাইগা লাlশ মুইছা দিবো।
দূরদৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে মাহতিম। লোকটা পাশের জনকে ধমকের সুরে বলছে। বাঁ-কানের ব্লুটুথে তর্জনী চেপে স্টিয়ারিংটা দুহাতে ধরলো। জ্যাম ছুটে যাচ্ছে। যেই দেখলো, রাস্তা রেডি হচ্ছে, ওমনেই চতুরতার সাথে গাড়ি টানলো মাহতিম। বাস-ট্রাক-সিএনজিকে টেক্কা দিয়ে কৌশলের সাথে ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে ছুটাতে লাগলো। ডানদিকের সাইড মিররে দৃষ্টি দিলো সে, ওই মাইক্রো গাড়িটা হন্য হয়ে ধরাশায়ী করতে চাইছে। দৃশ্যটা দেখে আবারও সামনে তাকালো মাহতিম। মাথাটা একদম ঠান্ডা করে ক্রমে-ক্রমে স্পিড বাড়াতে লাগলো। ব্লুটুথের সংযোগটা পেয়ে যেতেই প্রথম বাক্য বললো সে, বেশ কর্তৃত্বের সাথে কাট-কাট ভঙ্গিতে বললো,
– ফলো করছে।
তথ্যটা জানালো সে । ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি চুপচাপ শুনলো। ভদ্রলোকের নাম অশোক সেন। হেড অফিসের বিশেষ একজন কর্মকর্তা। ভদ্রলোক কথাটা শোনার পর কিছুক্ষণ নীরব রইলেন। কালক্ষেপণ সেরে প্রশস্ত গলায় বললেন,
– আনসারী, এখনো সময় আছে। আমি তোমাকে হারাতে চাই না।
গুরুতুল্য ব্যক্তির কাছে এরকম কথা শুনে হালকা হাসলো মাহতিম। অশোক সেন প্রচণ্ড রাগী একজন মানুষ। ডিপার্টমেন্টের প্রত্যেকটা সদস্য তাঁর কাছে মিনমিন করে। হেড অফিসের একজন গণমান্য লোক হিসেবে তাঁর সম্মানটা প্রচুর। তাঁর সামনে প্রত্যেকটা সোলজার ক্লিন-কাট ডিসিপ্লিন মানতে বাধ্য। সামান্য ভুলচুক হলে একদম ছাড় দেন না। এমনই একজন কঠিনীভূত লোকের কাছে মাহতিম বেশ প্রিয়। প্রথম-প্রথম মাহতিমকে এতো অপমান করতো, যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। আজ সেই মাহতিমের জন্য কিনা ভদ্রলোক টেনশন করছে। মাহতিম নির্ঝঞ্ঝাট কন্ঠে হাসি দিয়ে বললো,
– কিছু পাওয়ার জন্য কিছু হারাতে হয়। মিথ্যাকে সামনে আনার জন্য যদি আমাকে সরতে হয়, আমি রাজি। বহু বছর ধরে চলতে থাকা নৈiরাজ্য আমি মানবো না। এই সত্য উদঘাটন করতে গিয়ে অনেকেই পিছিয়ে গেছে, অনেকেই কালের গর্ভে আজ মৃjত। আমার দেlশেlর মানুষ ভালো নেই। তাদের চোখে আর ধূlলো লাগাতে দিবো না। আজ আমার জন্য যদি দেlশেlর একধাপ উন্নতি হয়, তাও হোক! কিন্তু ওlদের আlসল চেহারা আমি বেlর করেই ছাlড়বো। সত্যের ক্ষlমতা হাতে নিয়েছি, এর জন্য যদি নিজেকেই বlলিlদান দিতে হয়, তাও দেবো, কিন্তু দূtর্নীতিবাtজদের মুtখে কাiলি বসিয়ে যাবো। আমি ওয়াসিফ পূর্বের মতো পরাজয় স্বীiকার করবো না। আমি উনার মতো মহৎ নই। একবার যেহেতু কাlদায় হাlত ডুবিয়েছি, সেখান থেকে একটা-একটা করে সবগুলোকে টেlনে আনবো। আমি ওlদের কাউকেই ভlয় পাই না।
মাহতিমের অন্তর্মুখী জেদটা প্রবল। একবার যখন রোখে চাপে, তখন কার্যসিদ্ধির আগ পযর্ন্ত থামে না। অশোক সেন তেমনই কিছুর আভাস পেলেন। তিনি বুঝে গেছেন, থামাবার কোনো পথ নেই। আনসারী এখন দুর্বার-দুর্জয়-দুমর্দ চিন্তায় আছে, এ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া অসম্ভব। অশোক সেন ভারী গলায় তেজঃপূর্ণ স্বরে বললেন,
– লাইফটা রিlস্কে রেখে যে কাজে নেমেছো, আই হোপ তাতে তুমি সফল হবে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, তুমি যেন আমাদের কাছে ফিরে এসো।
মাহতিম এর পরিপ্রেক্ষিতে বাঁকা হাসি দিলো। ঠিক কেমন শুকনো একটা হাসি, আজ সেই হাসিতে দাম্ভিকতার রোষ নেই। স্টিয়ারিং ধরা বাঁ-হাতটায় চোখ রাখলো সে। কবজির রক্তিম গোল চিহ্নটায় হাসি ছুঁড়ে তাকালো। মলিন দৃষ্টিতে মনে-মনে বললো,
– ইতিহাস পুনরাবৃত্তি ভালোবাসে। সেদিন দুঃখের অনলে দগ্ধ ছিলো মন। আজ বlদlলার আlগুlনে বিlক্ষিlপ্ত আমার চেতনা। তুমি রাগ কোরো না মেহনূর। আমাকে ভুল বুঝো না।
.
একটানা পাঁচটা ঘন্টা কেটে গেলো। এই পাঁচটা ঘন্টা যেন শূলের মতো বিঁধছিলো। কোনো শান্তি নেই, কোনো ভরসা নেই, কোনো আশ্বাস নেই; ছিলো শুধুই ভয়। হাসপাতালের দোরগোড়ায় প্রতিটা মানুষ ছিলো চিন্তায়। অবশেষে চিন্তার দুয়ারে প্রবেশ করলো ডাক্তার। তিনি ডেলিভারি রুম থেকে সমস্ত কার্যক্রম সমাপ্ত করে বেরুলেন। ঠোঁটে সন্তুষ্টির হাসি এঁটে নার্সের দিকে ইশারা করলেন। সবার বুকে তখন ধ্বক-ধ্বক শব্দ হচ্ছিলো, একইসাথে অসংখ্য তাল ঠুকছিলো। সবাই উন্মুখ হয়ে নার্সের দিকে তাকালো। নার্সের কোলে সাদা কাপড়ে প্যাঁচানো ছোট্ট পুত্তলি। সেই পুত্তলির মতো জিনিসটা থেকে একটুখানি মুখটা বেরিয়ে আছে। সৌভিক দূর থেকে ওই মুখের দিকে তাকিয়ে বাক্য ভুলে গেছে। নার্সের কাছে গিয়ে দুহাত বাড়ানোর সাহস নেই। মেহনূর স্তব্ধ চাহনির মতো একপা করে এগিয়ে গেলো, নার্সের কোল থেকে দু’হাত বাড়িয়ে ছোট্ট পুত্তলির মতো মানুষটাকে কোলে নিলো। সদ্য জন্মানো অতিথির মুখটা দেখে চাপা উচ্ছাসে হাসলো মেহনূর। তার চোখ থেকে অঝোরে পানি পরছে। আহা, শানাজ বুবুর ছেলে! মেহনূর খুশিতে-আনন্দে পাগলপ্রায় হয়ে কপালে আলতো চুমু খেলো। মেহনূরকে আমেজের ন্যায় হাসিখুশি দেখে তৌফরা সবাই হুড়মুড় করে ছুটে এলো। কয়েকটা সেকেন্ড অসংখ্য চোখ ঘুরঘুর করে ছোট্ট অতিথিকে দেখলো। এরপরই এমন উল্লাসে মেতে উঠলো যে, এতোক্ষন যাবৎ যেই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা ছিলো, তা প্রায় ভুলেই গেলো। মেহনূরের কোল থেকে নীতির কোলে, নীতির থেকে সিয়ামের, সিয়ামের থেকে ফারিনের, এমন করে সবার কোলে-কোলে ঘুরতে গিয়ে নবাগত অতিথি কেঁদেই দিলো। এবার তেলে-বেগুনে ক্ষেপে উঠলো সৌভিক। এতোক্ষন রোবটের ভূমিকায় স্থির ছিলো ঠিকই, কিন্তু ছেলের কান্না শুনে আচমকাই রেগে গেলো। তড়িঘড়ি করে সবকিছু ভুল বাবার ভূমিকায় আসীন হলো। ছেলেকে কোলে নিয়ে চুপ করালো সৌভিক। কান্না থামা ছেলের দিকে হাসতে-হাসতে কথা শুরু করলো।
শানাজ এখন সুস্থ। ডেলিভারিটা নরমালে হয়নি। বাংলাদেশের তথাকথিত নিয়মের মতো হয়েছে। এজন্য একটু রক্ত সংকটে পরেছিলো। অন্যদিকে মারজার অবস্থাও ভালো। আশঙ্কামুক্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছেন তিনি। মাথার ডানপাশে বারি লেগে তিন ইন্ঞ্চির মতো ফেটে যায়, সেখানে অবশ্য সেলাই দেওয়া হয়েছে। মাসখানেকের ভেতর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবেন। হাসপাতালে দেখভালের জন্য শুধু নীতি-সিয়াম-সাবির থাকলো। বাকিরা সবাই তল্পি-তল্পা গুটিয়ে কোয়ার্টার মুখো হলো। রাতে অবশ্য শানাজের পাশে সৌভিকের কাকীমা থাকবেন, তাই নবাগত বাচ্চাকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। নয়টার ভেতর পৌঁছে গেলো সবাই। বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে যার-যার রুমে ফিরে গেলো। সদর দরজায় লক লাগিয়ে নিজের রুমে ফিরলো মেহনূর। সুইচ টিপে বাতি জ্বালাতেই একরাশ নিরবতা আঁকড়ে ধরলো। প্রতিটি দেয়াল যেন জানান দিচ্ছে, ‘ মাহতিম ঘরে নেই, মাহতিম ঘরে নেই ‘। দরজাটা চাপিয়ে নিজেকে পরিচ্ছন্ন করলো মেহনূর। শাড়িটা পালটে চুলটা মুছতে-মুছতে সোফায় বসলো। টি-টেবিলের উপর থেকে রেখে যাওয়া ফোনটা তুললো, ফোন বন্ধ, চার্জ নেই। টেবিলের কাছে চার্জার সেটিংসে ফোন ঢুকালো মেহনূর। ঘড়িতে তখন পৌণে দশটা বাজে। ফোনটা বাংলা বইয়ের উপর রাখতেই হঠাৎ ডায়েরির দিকে নজর পরলো। কি ব্যাপার? ডায়েরিটা ফুলে আছে কেন? ডায়েরিটা টেনে দেখলো, সেখানে একটা কলম ঢুকানো। তার চেয়ে অবাক করা বিষয়, সেখানে মাহতিমের লেখা। মেহনূর চটপট ভঙ্গিতে ডায়েরি তুলে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোলের উপর ডায়েরি মেলে পড়তে লাগলো,
রাগ কোরো না লক্ষ্মী। তোমার ডায়েরিতে এজন্য লিখেছি, কারণ আমার কোনো ডায়েরি নেই। তোমার সুন্দর-সুন্দর লেখাগুলোর পাশে আমার লেখাটা খুবই বেমানান লাগছে। কিন্তু কথাগুলো না-জানিয়ে গেলে ভেতরে-ভেতরে চাপ ফিল করবো। তুমি কথাগুলো পড়ার পর পৃষ্ঠাটা ছিঁড়ে দিও।
মেহনূর, আজ দুটো কথা জানাতে তোমার ডায়েরিতে কলম ঘুরাচ্ছি। প্রথমেই তোমার কাছে ক্ষমা চাই। হয়তো ভাবছো কেন ক্ষমা চাচ্ছি। তুমি আমাকে যেভাবে বিশ্বাস করো, তোমার অন্ধ বিশ্বাসকে আমি ভালোবাসি। আজ আমি এমন পর্যায়ে আছি, যেখান থেকে তোমার প্রতি ভিড়তে পারবো না। আমার ভালোবাসার প্রতি অক্ষুন্ন বিশ্বাস, তুমি আমাকে বুঝবে, তুমি আমার কথাগুলো উপলব্ধি করতে পারবে। আজ যেই কথাগুলো এই পৃষ্ঠায় লিখে যাচ্ছি, সেগুলো অশ্রু না-ফেলে শান্ত মেয়ের মতো পড়বে। তুমি আমার জন্য ওই মেহনূর হয়ে যাও, যখন তুমি কলেজ থেকে বেরিয়ে প্রতিবাlদী আচরণ করেছিলে। তুমি সেদিনের মতো শক্ত হও, যখন তোমার দিকে এ্যাপ্রোচ করা সত্ত্বেও তুমি নিজের অনুভূতিকে প্রকাশ করোনি। আমি হাতে একটা কেস নিয়েছি। এটার সুরাহা আমাকেই করতে হবে। কেউ যেচে এসে নিজের বিlপlত্তি ডাকে না, কিন্তু আমি ডেকেছি। আমি যখন কথাগুলো লিখছি, তখন তুমি আমার সামনে গুটি পাকিয়ে ঘুমাচ্ছো। আর যখন এটা পড়ছো, আমি পাশে নেই। পরীক্ষাগুলো ঠিকমতো দিও। আমার চিন্তায়-চিন্তায় বিভোর থেকো না। মায়ের দিকে একটু খেয়াল রেখো। গিঁটে ব্যথা উঠলে আমার মা-টা খুব কষ্ট পায়। পায়ে একটু তেল মালিশ করে ঘুম পাড়ালে মন্দ হয় না। ফারিনটা পাটিশাপটা পিঠা খুব পছন্দ করে। একদিন আমার কাছে তোমার গুণের কথা শুনে খেতে চেয়েছে। কতদিন থাকবে তা তো জানি না। তুমি এর মধ্যে একদিন সময় করে ইচ্ছাটা পূরণ করে দিও। আমার কোয়ার্টারটা তোমার জন্য বরাদ্দ থাকবে। যদি মনেহয় আমার মতো স্বার্থপরের জন্য এখানে থাকবে না, তাহলে কোয়ার্টারটা ছেড়ে দিও, আমি কষ্ট পাবো না। নিজের দিকে খেয়াল রাখার চেষ্টা করো। তোমাকে অসুস্থ দেখতে পারি না। বেডরুমটা শূন্য খাঁ খাঁ করছে, তাই না? (ক্ষমা চাই)
M. Ansari .
চলমান .
#FABIYAH_MOMO .