মন বাড়িয়ে ছুঁই ২ পর্ব-৩০

0
626

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই❤
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ .
#পর্বসংখ্যা_৩০ .
#যবনিকা_পর্ব . ০১ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .

দেখার জন্য তর সইছে না। অপেক্ষা মানছে না। ধৈর্য্য কুলাচ্ছে না। মাহতিমকে দেখার জন্য আকুলিবিকুল করছে মেহনূর। কখন একটুখানি দেখা মিলবে, কখন দু’চোখের তৃষ্ণা মিটাবে, কখন হাতে হাত রেখে মুঠোয় চেপে চুমু খাবে। মুখটার মধ্যে কতটুকু আঘাত লেগেছে, কোথায় ক্ষত লেগেছে, কতখানি কেটেছে উনার। যদি ঠোঁটের আশেপাশে আঘাত লাগে, অসংখ্য চুমু খাবে মেহনূর। যদি মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা হয়, তবে বুকে চেপে আদর করবে ও। প্রতিটা মূহুর্ত্তে-মূহুর্তে তাকে সেবার হাত বাড়িয়ে আবদ্ধ করবে। যখন নার্স এসে বলবে, ‘ আপনি ভেতরে যান, স্যার ডাকছেন ‘, তখন কেমন অনুভূতিতে গা ছমছম করবে? কেমন শিহরণে মৃদ্যু-মৃদ্যু কেঁপে উঠবে? কেমনটা লাগবে ওর? শরীরের মধ্যে দমকা হাওয়ার মতো শিরশির ভাব হবে। এই অপেক্ষায় থাকাটা একপ্রকার আনন্দ। এক না-বলা সুখের মতো। অপেক্ষার পর দু’চোখ ভরে যখন দেখার সুযোগ মিলবে, তখন আত্মায়-প্রাণে-অন্তরে চান্ঞ্চকল্যকর অনুভূতি জাগ্রত হবে। মাহতিমকে আবারও, আরো আকণ্ঠরূপে পাওয়ার-বোঝার ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষায় বশীভুত হবে। মনে-মনে এসব ভাবতে-ভাবতে চোখদুটো খুলল সে। দেখতে পেল, বেসিনের আয়নায় শুকনো-মলিন মুখটা। এই ক’দিনের টেনশনে খুব ম্লান হয়ে গেছে। চোখের সাদা অংশটা খুব লাল। গতরাতে ঘুম হয়নি। রাত জেগে-জেগে বইয়ের পাতায় বুঁদ থেকেছে। যদি এ অবস্থায় উনি দেখেন, তাহলে কি ভীষণ চlটে যাবেন? মুখ ঘুরিয়ে রাlগ দেখাবেন? মুখ ভার করে গম্ভীর সুরে বলবেন, ‘ তোমার কাছ থেকে এমনটা আশা করিনি। কি করেছ নিজের? এই জন্য তোমাকে একা ছাড়ি? ‘ আজ আই.সি.ইউর পন্ঞ্চম দিন চলছে। পুরো পাঁচটা দিন দেখতে-দেখতে চলে গেছে। প্রতিদিন ভোর সকালে উঠা, গোসল করা, হালকা নাস্তা খাওয়া, হাসপাতালের দিকে যাওয়া, সেখানে পৌঁছে অপেক্ষায় থাকা; পরিশেষে রিক্ত মুখে রাত নয়টায় কোয়ার্টারে ফেরা। মানুষটার দেখা আর মিলে না। বিগত তিন ধরে শরীরের উপর ঝlড় বয়ে গেছে। রাত জেগে পড়াটা খুব কষ্টের, তবুও জক্কি পোহাতে হয়েছে। মেহনূর আয়নায় তাকিয়ে নির্লিপ্ত সুরে বলল,

– পাঁচ দিন কেটে গেছে মেহনূর। সময়টা কেটে গেছে তোর। নিজেকে নিয়ে খুব হেলা করেছিস, খুব কষ্ট দিয়েছিস। আর দিস না। চোখদুটো মুছে নিজেকে প্রস্তুত কর। তোর এই অবস্থা দেখলে উনি খুব রাlগ করবে। তুইতো জানিস, পরিস্থিতিটা কেমন ছিল। আল্লাহ্ যেন এমন অবস্থায় কাউকে না ফেলে। যতটুকু পারিস ততটুকুই পরীক্ষায় খাতা তুলে দিবি। মনটা খারাপ করিস না। তুই আগের মতো দুর্বল নেই। আজ তো উনার সাথে দেখা করবি, তাই না? পুরো পাঁচ দিন পর দেখতে পাবি। মনে ভরসা রাখ মেহনূর। আশ্বাসের প্রদীপটা জ্বালিয়ে দে।

মুঠোভর্তি পানি নিয়ে মুখ ভেজাল সে। ট্যাপটা বন্ধ করে আয়নায় তাকালো মেহনূর। মুচকি হাসি দিয়ে আপন সুরে বলল,

‘ সময়টা বদলে গেছে আমার। বদলে গেছে আমার চিন্তাও। একদিন আমি দূর্বল হয়ে চললেও আজ আমি যথেষ্ট কঠোর। শুকরিয়া করছি তাদের, যারা আমাকে ঠকিয়ে গেছে। ধন্যবাদ দিচ্ছি তাদের, যারা আমাকে অপlদস্থ করেছে। মুচকি হাসছি তাঁকে পেয়ে, যে আমার জীবনটা ধন্য করেছে।

ফাইল হাতে মেহনূর বেরিয়ে গেল। পড়নে ছিল আকাশী রঙের শাড়ি। সাদা ব্লাউজটার স্লিভ কনুই অবধি। চুলের গোছা সুন্দর করে আঁচড়ে মাথার ডানদিকে সিঁথি গেঁথেছে। বাঁদিক বরাবর লম্বা বেণী করে বুকের বাঁ-পাশটায় ঝুলিয়ে রেখেছে। সাদামাটা ভূষণে আধঘন্টার ভেতর পরীক্ষার কেন্দ্রে পৌঁছে গেল। ভীড় জমাট গেটটার কাছে স্থির হল মেহনূর। ডানহাতে ফাইল, বাঁহাতের মুঠোতে আঁচল ধরা। চোখের চাহনিটা গেটটার দিকে নিবদ্ধ। আজ যদি উনি সুস্থ থাকত, তবে এই গেটটার কাছে সেই-ই ছেড়ে যেত। হাসিমুখে ভরসার হাতটা কাধে রাখত। কানে-কানে নিচু সুরে বলত, ‘ কোনো ভয় নেই। আমি আছি। আমি জানি তুমি কনফিডেন্সের সাথে পারবে ‘। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, আজ তিনি পাশে নেই। চোখের পাতা বন্ধ করে নিশ্বাস ছাড়ল মেহনূর, আঁচলটা ছেড়ে গেটের দিকে এগুতেই পেছন থেকে সামিক চ্যাঁচিয়ে উঠল,

– অল দ্যা বেস্ট ভাবী। একদম নার্ভাস হওয়া যাবে না। সবকিছু ঠান্ডা মাথায় লিখতে হবে। আমি বাইরেই আছি। তুমি ভালভাবে দিও ওকে? পরীক্ষার খাতায় কুlপাকুlপ লিখে দিবে। বেস্ট অফ লাক।

সামিক মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে মেহনূরকে উৎসাহ দিল। দূর থেকে বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে শুভকামনা জানাল। মেহনূর হাতছানি দিয়ে বিদায় বুঝিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। অসংখ্য পরীক্ষার্থীর মাঝে মিশে গেল মেহনূর। আকাশী রঙের শাড়িটা দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল।

.

বহুদিন পর শহরের মাটিতে পা রাখলেন। কান জ্বালা করা হর্ণ শুনতে পেলেন। চোখের সামনে ব্যস্ত সড়কে গাড়ির প্রlতিযোlগিতা দেখলেন। এরপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে বিশাল বড় হাসপাতালটা দেখতে পেলেন। বয়সটা যেমন বেড়েছে, তেমনি অনেককিছু বদলে গেছে। কেন জানি শহরে আসলে দম বlন্ধ লাগে। ভীড়ের মাঝে মন মানে না। মানুষ দেখলে মনে হয় পাlথর। সুজলা মাথায় ঘোমটা টেনে নিলেন। হাতে থাকা ছোট্ট বাটন ফোনটা টিপে কানে চাপলেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই কারো উদ্দেশ্যে তিনি বললেন,

– হ্যাঁ বাবা, এসে গেছি। কি বললে? চার তলা? আচ্ছা বাবা, আচ্ছা। রাখি তাহলে, আমি আসছি।

কলটা কেটে তিনি গাড়ির দিকে ফিরলেন। সাবা, সুরাইয়া ও শেফালি কথাগুলো শুনে নেমে পরল। মহিমপুর থেকে লম্বা জার্নি করে পৌঁছেছে সবাই। শানাজের অবস্থা, মাহতিমের কথা, মেহনূরের খবর শুনে কেউ একমূহুর্ত থাকতে পারেনি। গাড়ি একটা ভাড়া করে চলে এসেছে তারা। সুজলা ওদের সঙ্গে নিয়ে চতুর্থ তলায় পৌঁছল। আই.সি.ইউ রুমটার কাছটায় দলবদ্ধ সবাইকে দেখে বিনয়ী হাসি দিলেন সুজলা। যেই উনার দৃষ্টিটা চেয়ারে বসা মারজার দিকে পরল, ওমনেই হাসিটা শূন্যে মিলিয়ে পাণ্ডুর হয়ে গেল। কোনো এক জাদুবলেই সুজলা অশ্রুসিক্ত হয়ে মারজার কাছে ছুটে গেলেন। মারজা স্থির রইলেন না। সুজলাকে দেখতে পেয়ে দুহাতে জড়িয়ে নিঃশব্দে ভেঙে পরলেন। সুজলার কাধে কপাল ঠেকিয়ে হুঁ হুঁ করে কাঁদতে লাগলেন। এ যন্ত্রণা শুধু মায়েরা বুঝবে। এ মর্মবেদনা শুধু মায়ের বুকেই বিদ্যমান। মারজার পিঠে সান্ত্বনার হাত বুলিয়ে সুজলা নরম হলেন, আশ্বাস বাণী ছেড়ে বললেন,

– আপা, আপা শান্ত হোন। আর কান্না করবেন না। এই দ্যাখেন, দ্যাখেন না আপা, দ্যাখেন আমরা সবাই এসে গেছি। কেউ বাদ নেই। আল্লাহ্ যেমন বিপদ দিয়েছে, সহি-সলামত উদ্ধার করেছে আপা। শান্ত হোন আপা, চুপ করুন।

মারজা নাক টেনে কিছুক্ষণ পর সুজলাকে ছেড়ে দিলেন। চোখের উপর ওড়না চেপে দু’চোখ মুছে নিলেন। সুজলার দিকে সরল হাসিতে কুশল সেরে স্বাভাবিক হলেন তিনি। সাবা ও সুরাইয়া যেয়ে নীতিদের সাথে কথা জমিয়ে ফেলল। হাসপাতালের নির্জীব অবস্থা ধীরে-ধীরে স্বাভাবিক হতে লাগল। শানাজের অবস্থা আগের চেয়ে সুস্থ বলে আজ তার সেlলাই খোlলার কথা। সুরাইয়া সাবার দিকে টিlপ্পlনী কেlটে বলল,

– দেখলে বুবু, দেখলে? মেহনূর যে আlকাlইlম্মার ঢেঁlকি, গাlধাlর গাlধা, তা দেখতে পেলে? এবার কিন্তু হাতে-নাতে প্রমাণ পেলে। যে জায়গায় ওর বাবুটা নিয়ে আমরা হৈচৈ করতাম, সেখানে শানাজ বুবুর টোনা এসে হাlগু-মুlতু করছে। কবে এই গাlধাটার সুবুlদ্ধি হবে বুবু?

সাবা ভ্রুঁদুটো কুঁচকে সুরাইয়ার মাlথায় কlষিয়ে এক চাlট্টি মাlরল। বেশি বকবক করা স্বভাবটা সুরাইয়ার এখনো যায়নি। অথচ, ক’দিন পর ওর নাকি বিয়ে; তাও আবার এলাকার গনমান্য হুজুরের সাথে। সাবা কণ্ঠস্বর নিচু করে চিবিয়ে-চিবিয়ে বলল,

– ওর বাবু, ওর চিন্তা, তোর এত জ্বlলছে কেন? বাড়ি থেকে মlরিচ ডlলে এসেছিস? খুব পোlড়াlচ্ছে? পোlড়া জায়গায় মlলlম লাগাবি?

সুরাইয়া মাথায় হাত বুলাতে-বুলাতে মুখটা ব্যlথাতুর ভঙ্গিতে বলল,

– আমার মাlথা নিয়ে কি পেয়েছ বুবু? কি শুরু করলে? যখন-তখন শlয়তাlনের মতো থাlবlড়া দেও। আমি কিন্তু বড়মার কাছে কlঠিন বিlচাlর লাগাব! তোমাকে নিয়ে আর পারছি না। এসব কিন্তু অসহ্য লাগে বুবু!

সুরাইয়ার কথা শুনে ভ্রুঁ-টা উঁচু করল সাবা। মুখের ভঙ্গি এমন করল, যেন ওর নাlলিশ শুনলে কি-না-কি হয়ে যাবে। সাবার মুখভঙ্গিমা দেখে ঢোক গিলল সুরাইয়া। সে বোকা-বোকা চাহনিতে বলল,

– কি হয়েছে? আমি কি মিlথ্যে বলছি নাকি? আমি সত্যি-সত্যিই বড়মার কাছে বিচার দেব। তুমি আমাকে হুজুরের ভয় দেখাবে না। আমি কিন্তু —

এবার সাবা বুকের কাছে হাত ভাঁজ করল। বাঁ ভ্রুঁটা উঁচু করে ছোট-ছোট চোখে বলল,

– তোর হুজুর দিয়ে আমার কি? আমি কি তোকে একাই শাlয়েস্তা করতে পারব না? কি ভেবেছিস আমাকে? শানাজ বুবুর অবস্থা দেখছিস? দেখেছিস পেlটটা ফেঁlড়ে বেচারির অবস্থা কি করে ছেড়েছে? শহরের নিlর্দlয় ডাlক্তাlরগুলো কি রকম ফাlজিlল হলে সিlজাlর করতে পারে, ভেবেছিস একবার? মেহনূর যদি এই অবস্থায় —

হাতটা খপ করে ধরল সুরাইয়া। সাবাকে থামিয়ে আরেকটু কাছ ঘেঁষে বলল,

– রান্নাঘরের ঘটনাটা মনে আছে বুবু? দুজন চুলার ধারে ছিল, এরপর ভাইয়া রাlজার মতো কোলে নিল, ওকে কোলে নিয়ে দরজায় খিল দিল। মনে আছে তোমার?

সাবা এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিল। ওর বেহুদা গল্প শুনে-শুনে মাথাটা ধরে যাচ্ছে। এমনেই পুরো রাস্তা জুড়ে বকবক করে এসেছে। তার উপর এখন যদি — না, এটা হতে দেওয়া যায় না। সাবা গলা নামিয়ে এমন সুরে বলল যেন কথাটা শুধু সুরাইয়াই শুনুক।

– হ্যাঁ, মনে আছে। আমার এটাও মনে আছে তোর ছ্যা:বলা:মির জন্য আমি তোকে ক:ষিয়ে চ:টির বা:রি লাগিlয়েlছিলাম। এখনো পায়ে সেই চ:টি জুlতাটা আছে। খাবি নাকি? লাlগাlব দুটা? আসার সময় নোংরা-পlচাঁ পাlরা দিয়ে এসেছি। সুরাইয়া, সময় থাকতে শুlধlরে যা। মুখটা যদি বন্ধ না-করিস এখন আচ্ছামত প্যাঁlদাlব।

সাবার শক্ত মুখটা দেখে সুরাইয়া নিমিষের ভেতর চুপসে গেল। ঢোক গিলে ঠোঁটের উপর এমন ভঙ্গি করল, যেন দু’আঙুলে অদৃশ্য কোনো জিপার টেনে মুখ বন্ধ করে ফেলল। সাবা মুখ বন্ধ করার দৃশ্যটা দেখে ফারিনের কাছে চলে গেল। একটু পরেই খবর এল, মাহতিমকে আই.সি.ইউ থেকে শিফট করে নরমাল কেবিনে পাঠান হচ্ছে। অবস্থা এখন উন্নতির দিকে এবং শারীরিক দুর্বলতা বেশ খানিকটা সেরে উঠেছে। ঠিক আধঘন্টার ভেতর বিশাল বড় কেবিনে মাহতিমকে পাঠান হল। সেখানেও নিlরাপlত্তার জন্য দরজার বাইরে দুজন অlস্ত্রধাlরী গাlর্ড লাগিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পর পরিবারের সাথে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হল। সবার আগে মারজা ছেলেকে ওই অবস্থায় দেখে চিৎকার দিতে যেয়ে মুখে কাপড় চাপা দিলেন। ভেতরে ডলা পাকানো চিৎকারটা আঁটকে ছেলের পাশে বসলেন। চোখ খিঁচে তরতর করে পানি ঝরিয়ে যাচ্ছে, মুখে কোনো শব্দ করতে পারছেন না। ছেলের বুকে পরম মমতায় হাত রাখলেন মারজা। আর্দ্র কণ্ঠে বললেন,

– তোর উপর জুlলুlম করব না মাহতিম। তুই যা চাস, যেভাবে চাস, ওভাবেই কর। তোর কোনোকিছুতে আমি অমত করব না। শুধু নিজের বিiপদ ডেকে আমার কlলিlজায় ছুlড়ি বসাস না বাবা। তোর এই অবস্থা দেখলে আমার কlলিlজাটা বেরিয়ে যায়। আমাকে মাফ কর বাপ। আর সহ্য করতে পারতে পারব না।

মায়ের অবস্থা দেখে মিচকি হাসে মাহতিম। কোনো জবাব দেয় না সে। মা-কে বোঝানোর মতো ভাষা এই মূহুর্তে নেই। একে-একে কেবিনের ভেতর সবাইকে দেখতে পায় সে। সুজলার ভেজা চোখের চাহনি দেখে কয়েক মূহুর্ত নির্বিকার চেয়ে থাকে। পুরো বেড ঘিরে সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এরপরই ডান-বামে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নির্দিষ্ট একজনকে খুঁজতে থাকে। মায়ের দিকে চিন্তার ফেলে দৃষ্টি দুর্বল কণ্ঠে শুধায়,

– ও কোথায়?

মারজা কথার মানেটা বুঝে। বুঝার পরও অবুঝের মতো অভিনয় করে বলেন,

– কে কোথায়? সবাই তো এখানে।

মারজার উত্তর শুনে বে-আক্কেলের মতো মাহতিম তাকায়। অন্যদিকে বাকিরা চেপে-চুপে হেসে যাচ্ছে। কোনোমতে হাসি আঁটকে শান্ত-স্বাভাবিক দেখিয়ে যাচ্ছে। মাহতিম একদম ভণিতা না করে জিজ্ঞেস করল,

– আমার বউ কোথায়?

এবার অকপটে বলা দেখে সবাই হো-হো করে হেসে ফেলল। পুরো কেবিন জুড়ে হাসির ফোয়ারা দিগ্বিদিক ছাপিয়ে যাচ্ছে। কেউ-কেউ হাসি থামাতে গিয়ে আবার হেসে ফেলছে। কেউ আর মাহতিমের উত্তর দিচ্ছে না। মাহতিম চোখ খাটো করে গরম চোখে তাকাল। সবার এই অমূলক হাসির চেয়ে মেহনূরকে নিয়ে ভাবনা হচ্ছে। ও কি রাগ করল? ওর কথা রাখেনি বলে অভিমান করে চলে গেছে? পেট ফাটা হাসি শেষে ফারিন ভাইয়ের পাশে বসল। হাসি থামিয়ে শান্তভাবে বলল,

– টেনশন কোরো না ভাইয়া। ভাবী এক্সাম দিতে গিয়েছে। আজ থেকে ভাবীর বোর্ড এক্সাম শুরু। তাই সে সেন্টারে আছে। দু’ঘন্টা পরেই এসে যাবে। ততক্ষণ একটু অপেক্ষা করো, আমরা যাই।

.
মেহনূর ফাইলটা নিয়ে হাসlপাlতালে ঢুকল। চতুর্থ ফ্লোরে এসে শুনল, মাহতিম এখানে নেই। চোখদুটো ছানাবড়া হয়ে গেল। বলে কি! নেই মানে? এরপরই জানতে পারে, মাহতিম এখন তৃতীয় ফ্লোরে, নরমাল কেবিনে। সবাই সেখানে গিয়ে দেখা করে ফেলেছে। তবে কিছুক্ষণ আগে ভিlজিlটিং আওয়ার শেষ। তাই আর ঢুকতে দেওয়া হবে না। মেহনূর কথাগুলো শুনতে-শুনতে সিঁড়ি বেয়েই নিচে নামল, লিফট ধরে নামল না। সে দেখা করবে, যে করেই হোক দেখা করবে! সবাই যেখানে দেখা করেছে, সেখানে ওর বেলায় হবে ‘শেষ’ কেন? তৃতীয় তলায় এসে হাঁপাতে-হাঁপাতে কেবিনটার কাছে আসল। সবাই সেখানে হাসিমুখে বসে আছে। ওয়ান টাইম কাপে করে চা খাচ্ছে। মেহনূরকে অপ্রতিভ অবস্থায় দেখে সবাই চা খাওয়া থামিয়ে দিল। মেহনূরকে কিছু বলবে, তার আগেই মেহনূর অস্থিরভাবে বলল,

– আমি ভেতরে যাব। ভেতরে কে আছে? সৌভিক ভাই, ভেতরে কে আছে? নার্স? ডাক্তার? কেউ কি আছে? ডেকে বলুন আমি দেখা করতে চাই।

সৌভিক কেবল মাত্র চায়ে চুমুক দিচ্ছিল। মেহনূরের পাগলপ্রায় অবস্থা দেখে উদ্বেগের সুরে বলল,

– ভাবী কাম ডাউন। একটু বসুন, একটু জিরিয়ে নিন, আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলছি।

মেহনূর অপেক্ষা করতে রাজি নয়। সে এখনই দেখা করতে চায়। ওর কপাল-মুখ-গলা ঘেমে একাকার, মুখটা রlক্তিlম হয়ে গেছে। মেহনূরকে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় দেখে সৌভিক বাক্য ব্যয় করল না। ওকে আশ্বস্ত করে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গেল। সুজলা ওকে ঠান্ডা হতে বললেন। নিজের আঁচল দিয়ে সমস্ত ঘাম মুছিয়ে দিলেন। শেফালি পানির বোতল এগিয়ে পানি খাইয়ে দিল। মেহনূরকে শান্ত করে, স্থির করে, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলল। একটু পরেই ভেতর থেকে একজন ইনটার্ন ডাক্তার এসে জানাল,

– আসুন। সমস্যা নেই। স্যার এখনো ঘুমাননি। আপনি ভেতরে যেতে পারেন।

দুরুদুরু পায়ে কেবিনটার কাছে গেল মেহনূর। ডাlক্তাlরটা প্রাইভেসির জন্য বাইরে রয়ে গেল।ডানহাতে দরজার হ্যান্ডেলটা ধরে এক মোচড় মাlরল মেহনূর, ক্যাচ করে প্রশস্ত দরজাটা খুলল। বুকের ভেতরটা ধুকপুক গতিতে চলছে। শরীরটা ঠান্ডা হয়ে আসছে। চোখের দৃষ্টি পরিষ্কার টাইলসে রেখে ভেতরে পা বাড়াল সে, রুমটায় ঢুকে যেতেই হ্যান্ডেলটা ছেড়ে দিল। ভারী দরজাটা আপনা-আপনি বন্ধ হতেই নিস্তেজ পরিবেশে আবদ্ধ হল। মেহনূর তখনও নতচোখে তাকিয়ে আছে, চোখ তুলে বেডের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। সুস্থ একটা মানুষকে বিদায় দিয়েছিল। তাঁর করুণ অবস্থা কিভাবে সহ্য করবে?

‘ – ও মেহনূর, ‘

আকুল ভরা কণ্ঠে ডেকে উঠল মাহতিম। অপেক্ষা-প্রতীক্ষা-আশায় থাকা অভিব্যক্তিগুলো তার দুর্বল কণ্ঠে ফুটে উঠল। আদরমাখা কাতরমিশ্রিত ডাকটা শুনে মেহনূর রুখে থাকতে পারল না। ফ্লোর থেকে ঝাপসা দৃষ্টি তুলে বেডের পানে চাইল। চোখে-চোখ পরতেই ঠোঁট উলটে ফাইলটা ছেড়ে দিল মেহনূর। দুহাতে মুখ ঢেকে ফ্লোরে বসে পরল। যেটুকু মনোবল নিয়ে চোখ তুলার সাহস দেখিয়েছিল, সব শেষ, সব নিঃস্ব। পুরো পাঁচ দিনের যন্ত্রণাকে মুক্ত করল মেহনূর। সকলের কাছে নীরব থেকে-থেকে যেই যন্ত্রণা কাউকে বুঝতে দেয়নি, যেই দlগ্ধ-ভগ্ধ হৃদয়ের একেকটি চিৎকার নিজের ভেতরে সংগোপনে রেখেছিল, সেই গোপন কুঠির প্রতিটি মর্মবেদনা আজ খুলে দিল মেহনূর। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চার দেয়ালের মাঝে ওর অজস্র নিরবতা চারধারকে বিদীর্ণ করে দিল। হাউমাউ করে কাঁদতেই আর্দ্র সুরে বলল,

– আপনি আমার কথা রাখলেন না। কোন কথাই শুনলেন না। আমি কি করব? কোথায় যাব? আপনাকে সুlস্থভাবে ছেড়েছিলাম, কি হাল করে আমার সামনে আসলেন। কি হাল করেছেন? মাথায় সেlলাlই লাগিয়ে শুয়ে আছেন, হাতে স্যাlলাইন — আমি এসব কিভাবে দেখব? ইয়া আল্লাহ্! এই দৃশ্য আমি আম্মার বেলায় দেখিনি, আপনার বেলায় কিভাবে সহ্য করব?

নির‍্যুত্তর মুখে মাহতিম তাকিয়ে আছে। ইচ্ছে করছে, এক্ষুণি মেহনূরকে তুলে বুকে আবদ্ধ করতে। ওর গালে-ঠোঁটে গভীর চুমু খেয়ে খুব করে বলতে, ‘ তুমি শান্ত হও মেহনূর। কেঁদো না। দ্যাখো, আমি সুস্থ। দ্যাখো, তোমাকে কতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছি। এতখানি শক্তি কোথায় পেলাম? আমার কিচ্ছু হয়নি মেহনূর। কিচ্ছু হয়নি দ্যাখো। এইতো সামান্য একটু ইন্ঞ্জুlরি হয়েছে, এটা কিছুদিনের ভেতর সেরে যাবে ‘। কথাগুলো ঠোঁটের কাছে এসেও বেরুলো না, মাহতিম কিছুই বলতে পারল না। দুর্বলতার কাছে জোর খাটিয়ে আকুল সুরে ডাকল,

– আসো না লক্ষ্মী। আমিতো উঠতে পারছি না।

কথাটা বলতে গিয়েই চোখ খিঁচুনি দিল মাহতিম। সেলাইয়ের জায়গায় চিলিক দিয়ে উঠেছে। ব্যথাটা প্রশমনের জন্য খুব ধীরগতিতে নিশ্বাস নিতেই কানে সুক্ষ্ম শব্দ পেল। চোখ মেলার পূর্বেই ডান গালটায় তপ্ত আঙুলের ছোঁয়া অনুভব করল। খুব মোলায়েম স্পর্শে গাল ছুঁয়ে দিচ্ছে। মাহতিম কোমল হাতটাকে ঠোঁটে ছোঁয়ার জন্য বদ্ধ চোখে মুখটা ডানে ফেরাল। হাতের গরম-নরম তালুতে দু’ঠোঁট প্রগাঢ়ভাবে চেপে দিল। কিছু সময় ওভাবেই কাটাল মাহতিম। একটুক্ষণ পর চোখ খুলে দেখল, মেহনূর পাশে বসে রক্তিম চক্ষু মেলে চুপ হয়ে আছে। ফোলা-ফোলা চোখের কোটরে এক স্তুপ নোনাজল। সামান্য টোকাতে পরার জন্য প্রস্তুত। মাহতিম ব্যাlন্ডেজ মোড়ানো ডানহাতটা কম্পনরত অবস্থায় উপরে তুলল। মেহনূরের গালটা ধরে মুখটা নামিয়ে ওর কপাল স্পর্শ করল, নিচু সুরে বলল,

– জ্বর বাঁধিয়েছ, তাই না?

মেহনূর কিয়ৎকাল তাকিয়ে থেকে ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে মাথা নাড়ল। আস্তে করে বলল,

– সেদিনের মত সারিয়ে দিবেন?

মাহতিম ওর আবদার শুনে হাসল। মাথার যন্ত্রণা ভুলে দুষ্টু ঠোঁটে বলল,

– এখনই কমাই আসেন। আমার চাদরটার নিচে ঢুকে পরেন।

মেহনূর এভাবে অকপটে বলা দেখে লজ্জামিশ্রিত চোখে ঈষৎ হেসে ফেলল। চোখ নিচু করে বলল,

– মাথায় সেlলাlই লাগিয়ে, পা একটা ভেlঙে এখনো অসlভ্যতা করছেন?

মাহতিম দু’ঠোঁট প্রসার করে ঝলমলে হাসি দিল। ওর হাতটা টেনে উন্মুক্ত বুকে চেপে ধরল। চোখ বন্ধ করে নিচু সুরে বলল,

– তোমাকে আমি যেতে দেব না। তুমি আমার কাছেই থাকছ। আমার এই সিঙ্গেল বেডে তুমি শোবে, আমার পাশে তুমি ঘুমাচ্ছ। জুতা খুলে উঠ। দুটো ঘন্টা তোমার বুকে ঘুমোতে চাই। একটু শান্তি চাচ্ছি মেহনূর। দরজাটা লক করে এসো।

চলমান .

#FABIYAH_MOMO .

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ .
#যবনিকা_পর্ব .
#ফাবিয়াহ্_মমো .

কেবিনটা লক করল। এসিটা বাড়িয়ে দিল। চো খদুটো নিচু করে এগুতে লাগল। পাদুটো বেডটার কাছে অসুস্থ মানুষটার দিকে যাচ্ছে। হৃৎস্পন্দন আজও ঢিপঢিপ করে ছুটছে। বুকের বাঁ-পাশটা ভীষণ অস্থির-উচাটন। এসির নিম্ন তাপমাত্রায় খুব শীত-শীত লাগছে। দেহের উপর হিম বাতাস বয়ে যাচ্ছে। অনবরত ঢোক গিলছে মেহনূর, কিন্তু লাভ হচ্ছে না। গলাটা বারবার শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। একটু আগে যে কাণ্ডটা করেছে, এটা একদম ভালো করেনি। আবারও সে পুরোনো দিনের মতো বোকামি করে ফেলেছে। কে বলবে মেহনূর এখন বুদ্ধিমতি হয়েছে? কাজটা তাকে বোকার পর্যায়ে ফেলে দিয়েছে এখন। তার দিকে যেই চোখদুটো এখন আঁটকে আছে; সেটা এতই ধারালো, এতই তীক্ষ্ম, ওই দৃষ্টি যেন বুক ফালিফালি করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। এঁফোড়-ওঁফোড় করতে একটুও দেরি করবে না সে। শরীরটা কি পরিমাণে দুর্বল তার, তবুও চাহনির মধ্যে কি মারাত্মক তেজ! কপালের বাঁদিকটা খুব জ:খ:ম, সেlলাই পরেছে চারটা, ক্ষlতের জন্য পুরো মাথা ব্যান্ডেজে ঢাকা। কিন্তু চোখের দিকে তাকালে এমন দাপুটে কিছুর অনুভব হয়, তাকে দুর্বল-আহত সার্ভাইভাল কোনো পেশেন্ট ভাবা মস্ত বড় ভুল। থাবার মতো প্রশস্ত বাঁ-হাতের উলটো পিঠে স্যালাইনের সূঁচ ঢোকানো। কিন্তু হাতের দিকে তাকালে মনে হয় যেন কিছুই হয়নি, পুরোপুরি সুস্থ। মেহনূর চুপ করে বেডের কাছে গিয়ে স্বল্প জায়গাটুকুতে বসল। জুতাজোড়া খুলে সাদা চাদরটার নিচে পা-জোড়া তলিয়ে দিল। এখনো বুকটা কাঁপছে। ভয়টা জোঁকের মতো কামড়ে ধরেছে ওকে। আড়চোখে একবার দেখার চেষ্টা করল মেহনূর, কিন্তু ভয় ও লজ্জার কাছে নতশীর হয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। ব্যাপারটা রাগত ব্যক্তির দৃষ্টি এড়ালো না। সে দেখছে, সে নীরবে-নীরবে সবই দেখে যাচ্ছে। ওই কথাটা শোনার পর একদম খামোশ সে। সামান্যতম শব্দ করেনি মাহতিম আনসারী। মেহনূর তাকে মুখের উপর বলে দিয়েছে, ‘ এটা আপনার কোয়ার্টার না, এটা কেবিন। এখানে লক করে ঘুমানো যাবে না। আগে সুস্থ হোন, ঠিক হোন, তারপর ঘুমাবেন। আপনি নরমাল হন নি, আপনি অসুস্থ। কথা বুঝেছেন?’ ব্যস, এইটুকুই ছিল কথা। কিন্তু, কথাটা যে হিতে-বিপরীতে যাবে মেহনূর আন্দাজ করতে পারেনি। এখন চরম ভয় কাজ করছে। কথাটার নীচে অদ্ভুত কিছু যুক্তি পেয়ে মাহতিম প্রচণ্ড খেপে আছে! মেহনূর এটাও জানে, চূড়ান্ত পর্যায়ের রাগকে সামাল দিতে চুপ হয়েছে সে। তাঁর সামাল দেওয়া রাগটা ঠিক পানির মতো বলা চলে। পানিটা যেমন দেখা যায় না, শুধু বোঝা যায়, তার অবস্থাও এই রকমের। মাহতিম কি ইন্ঞ্জুরির জন্য কুৎlসিত হয়ে গেছে? তাকে কি ভlয়াবহ কোনো প্রাlণীর মতো দেখাচ্ছে? কি কারণে এটা বলল মেহনূর? মেহনূর কি জানেন না, তার একটা অর্ডাlরে সবকিছু ফাঁকা হতে বাধ্য! চাইলে এক্ষুনি পুরো ফ্লোlর কlবlজা করার ক্ষমlতা রাখে! মাহতিম গম্ভীর মেজাজে প্রশ্ন করল মেহনূরকে। কণ্ঠে দুর্বলতা থাকলেও যথাসম্ভব কাট-কাট সুরে বলল,

– মেহনূর আফরিন, এ্যাlক্সিlডেন্টে আমার ফেসটা যদি ন:ষ্ট হত, আমার সাথে সংসারটা তুমি করতে না? তিনটা বছর আগে যেভাবে নিlষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়ে ফেলে গিয়েছিলে, ওরকম কিছু ঘটাতে নাকি? আবারও সবকিছু ফেলে-ছুঁড়ে পালিয়ে যেতে? জবাব দাও। চুপ করে থাকবে না। যদি চুপ থাকার ইচ্ছে হয় এক্ষুণি কেবিন থেকে বেরিয়ে যাবে।

দারুণ অবাক হয়ে দৃষ্টি ঘুরালো মেহনূর। এগুলো কেমন প্রশ্ন? কেমন কথা? রাগের বহিঃপ্রকাশ দেখি চৌহদ্দি পেরিয়ে গেছে। মেহনূর দুই ভ্রুঁ এক করে আশ্চর্য হয়ে তাকাল। সম্পূর্ণ কথাকে খারিজ করে অবাক সুরে বলল,

– সংসার করব না মানে? আপনি কি যা-তা বলছেন? পুরোনো কথা এই মূহুর্তে টানা হচ্ছে কেন?

মাহতিম কি নিয়ে ভয় পাচ্ছে স্পষ্ট বলেনি সে। রাগটা কতদূর চড়েছে বুঝতে দেয়নি ওকে। তার ধারণা, এই অবস্থায় তাকে কুৎসিত কিছু দেখাচ্ছে। এমনই কুৎসিত, যেটা কাঁ:টাছেঁ:ড়া কোনো হিংlস্র পlশুর মতো; অথবা মিlশরীয় সভ্যlতার ন্যায় কাপড়ে মোড়া ভlয়ানlক মমি। এমন উদ্ভট ধারণা কোত্থেকে আসলো তা অজানা। কিন্তু, অসুস্থতার সময় বিক্ষিপ্ত চেতনা সবকিছু টালমাটাল করে দিতে সক্ষম। কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল, সেটাই একজন মানুষ ধরতে-বুঝতে পারে না। মুখটা আয়নায় দেখেনি সে, তাই অদ্ভুত কিছু ধারণা তার মস্তিষ্কের ভেতর বাজেভাবে ঘুরছে। মেহনূর তখনও অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। তিন বছর আগে অবশ্যই সে পাlপ করেছে। যার খেসারত প্রতিটি সেকেন্ডে-সেকেন্ডে দিতে হয়েছে। মোল্লাবাড়ির চার দেয়ালের ঘরটুকুই জানে মেহনূর কতটা ভাঙচুর অবস্থায় ছিল। কিছুক্ষণ আগে যে কথাগুলো মানুষটাকে বলেছে, সেটাও ভুলবশত বলা, ইচ্ছা করে বলেনি। যেভাবে বলার দরকার ছিল, ওভাবে বোঝাতে পারেনি। ডাক্তার এসে যদি দরজায় ‘ ঠকঠক ‘ করে বসতো, তখন কেমন অবস্থায় পরতে হত? নার্স-ডাক্তার আড়ালে-আবডালে তাদের নিয়ে হাসাহাসি করত। ব্যাপারটা একদিকে যেমন লজ্জাকর অবস্থা হত, তেমনি হত বিব্রত দশা। মেহনূর চুপ করে খালি পাশটায় শুয়ে পরল। মানুষটাকে আর চটানো যাবে না। তাঁকে শান্ত করা প্রয়োজন। বালিশে মাথা রেখে রাগত মানুষটার দিকে ফিরল। ততক্ষণে মাহতিম বাঁদিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলেছে, তার চৌকস দৃষ্টিজোড়া পূবের জানালায় আঁটকে আছে। মেহনূর নিঃসংকোচে তার মুখটা ধরে নিজের দিকে ফেরাল। খোঁচা-খোঁচা সূঁচের মতো গালটা আঙুলে ছুঁয়ে হালকা গলায় বলল,

– রাগ করছেন কেন? আপনাকে ছেড়ে যাব ভাবছেন? যাব নাতো। জীবনের এই পর্যায়ে এসে ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্ন উঠে? আপনার মুখ যদি নষ্ট হতই, আমি মুখ দিয়ে কি করব? ভাবছেন, ভয়ে পালাব? আচ্ছা যদি ধরি, আজ আমার ক্যাlন্সাlর ধরা পরল, আম্মার মত আমিও কিছুদিনের ভেতর চলে যাব, তখনও কি আপনি আমায় ছুঁ:ড়ে দিতেন?

মাহতিম চড়া মেজাজে বলল,

– প্রশ্নই আসে না। বিয়ের পর যদি রোগ ধরা পরতো, আমি ভেবেই নিতাম আমার পাlপের বোঝা তোমার উপর দিয়ে যাচ্ছে। এখানে তো ফেলে-ছুঁড়ে-পালিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। বিয়ে করেছি মানে তুমি আমার সব। এর বাইরে কোনো সত্যই আমি মানতে রাজী নই। সমাজের রীতিনীতি জাlহান্নাlমে যাক! আজ হাসবে, কাল তালি দিবে, এদের কথায় আমি বাঁচা ছেড়ে দেব? তুমি যে ডাক্তারদের চিন্তায় অতগুলো কথা বলেছ, এটা দেখেই অবাক হচ্ছি। কেন ওদের পাত্তা দেওয়া লাগবে? মানুষ কি ভাবছে তা নিয়ে আমি কেন ভাবব? কি দরকার?

মেহনূর আরেকটু কাছে গেল। রাগটা এখনো পড়েনি। অন্যভাবে বললে নাকের ডগায় রেখেছে রাগটা। মুখটার খুব কাছাকাছি গিয়ে মেহনূর গা ঘেঁষে শুলো। নন-শেভড্ গালটা ধরেই মৃদু গলায় বলল,

– বুঝতে পেরেছি তো। আর করব না। এবার রাগটা কমান। মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা করবে। সহ্য করতে পারবেন না। আপনি যে বলতে-বলতে কতকিছু বলে ফেলেছেন জানেন? তাহলে ধরে নিন, আমারও পাlপের খেসারত আপনার উপর দিয়ে যাচ্ছে। যখন আমরা দুঃখ পাওয়া ভুলে যাই, তখন নিয়তি আমাদের প্রিয়জনকে দুঃখ দিতে আসে। যাতে তাদের কষ্ট দেখে আমরা দুঃখ পাই। তাদের যন্ত্রণায় হাহাকার করে উঠি। আমরা কোনোদিন বুঝতেই পারি না আমাদের ভুলের জন্য তারা কষ্টগুলো পাচ্ছে। কথাগুলো কে বলেছে জানেন? আপনার এই বুকটার মধ্যে থাকা খুব কাছের কেউ বলেছে। মনে করুন।

মেহনূর বুকের বাঁদিকটায় হাত রাখল। সন্তর্পণে জায়গাটা বুলিয়ে দিচ্ছে সে। প্রশ্নটা ছুঁড়ে নির্মল চোখে তাকালে মাহতিমের রোষাবিষ্ট চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসে। কিছুকাল নীরব থেকে ম্লান সুরে জানায়,

– বাবা বলেছিল।

মেহনূর কথাটা চুপচাপ শুনলো। বুকভর্তি নিশ্বাস ছেড়ে সবটুকু দূরত্ব ঘুঁচিয়ে দিল। বালিশ থেকে ব্যান্ডেজে মোড়া মাথাটা আস্তে করে তুলল। মাহতিম সবটা অনুভব করছে, কিন্তু বাঁধা দিল না সে। তারও উৎকণ্ঠিত প্রাণটা আসন্ন আদরটুকুর জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। কখন মেহনূর তাকে কোমল শয্যায় জড়িয়ে ধরবে, ছোট-ছোট চুমুতে আদর করবে, টুপ করে তার অধরদুটোয় সিক্ত ছোঁয়া রাঙিয়ে দিবে। কথাগুলো ভাবতেই-ভাবতে মাহতিম ওর দিকে সম্পূর্ণ ঘুরে গেল। মেহনূর আর দেরি না করে অসভ্যটাকে উষ্ণ কুঠিতে বুকটার মধ্যে জড়িয়ে ধরল। মাথায় একটুও ব্যথা পেতে দেল না। চাদরটা টেনে দিল সে। আদুরে কায়দায় আবদ্ধ করে তাকে কঠিনভাবে আগলে রেখেছে। চোখ বন্ধ করে ক্ষণটুকু রন্ধ্রে-রন্ধ্রে অনুভব করছে মেহনূর। এভাবে বুকটার মাঝে জড়িয়ে রাখার আনন্দে অন্তরটা শীতল হয়ে যাচ্ছে। আর কখনো একা ছাড়বে না মেহনূর। আর কোনোদিন দুঃখ পেতে দিবে না। সেদিন রাতে যখন জাফর উদ্দিনের ছবিটা চিনল, সেদিন আরো একটা খাম মেহনূর পেয়েছিল। মাহতিম সেটা সবার থেকে আড়াল করে রাখে। কখনো দেখতে দেয়নি সে। খামটার ভেতর চার পৃষ্ঠার চিঠি ছিল, চিঠিটা লিখেছে সে। চিঠিটা লিখতে কত যন্ত্রণা হয়েছে উনার, তার প্রমাণ ছিল শুকিয়ে যাওয়া ফোঁটাগুলো। টুপ-টুপ করে ঝরে পরা অশ্রুগুলো আজও চিঠির পাতায় সীলমোহর রেখেছে।

ভাই মাহদি,

চিঠির শুরুতে মরহুম লেখার সাধ্য নেই। রাত এখন তিনটা বাজে, আমি ঘুমাতে পারিনি। পরলোকে চলে গেলি ভাই। আর জীবনেও তুই দেখা দিবি না। সবসময় শুনে এলাম ছেলের কাধে বাবার লাশ থাকে, বুকের ভেতর দুঃখ নিয়ে খাটিয়া ধরে। আমার বেলায় সবই উলটো হয়ে গেল। নিজের ভাই, আমার সন্তানের মতো মানুষটাকে কাধে নিলাম। আমার অন্তরটা ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো হয়ে যাচ্ছিল। দুনিয়াবি কোনোকিছুই আমার সহ্য হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল আমার সব চলে গেছে। আমি একেবারে নাই হয়ে গেছি। আমার ডানকাধের উপর তোর খাটিয়া ছিল মাহদি, আমি ভাবতেই পারি না ভাই। তোকে সাড়ে তিনহাত মাটির নিচে কিভাবে রেখে এলাম? ওই অন্ধকারে তুই কিভাবে আছিস? একা, অন্ধকার, মাটির নিচে কিভাবে ….

হঠাৎ নড়েচড়ে উঠল মাহতিম। সাথে-সাথে সম্বিৎ ফিরে পেল মেহনূর। চিঠির কথাগুলো আনমনে মুছে গেল ওর। পুরোনো ভাবনা থেকে ফিরতেই তাড়াতাড়ি চোখ মুছতে লাগল। মাহতিম সুক্ষ্মভাবে নাক টানার শব্দটা শুনতে পেয়েছে। মেহনূর কি তবে কাঁদছে? কাঁদার তো কথা না। কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে আস্তে করে শুধাল,

– তোমার কি ঠান্ডা লেগেছে?

প্রশ্ন শুনে মেহনূর মুখ নিচু করল। চোখদুটো মুছে ফেলেছে সে, অশ্রুর শেষ চিহ্নটুকু ডলে মুছেছে। প্রত্যুত্তরে মেহনূর কোমল স্বরে বলল, ‘ উহুঁ, করছে না। এমনেই নাক টেনেছি। ‘ মাহতিম ভাবলো মিথ্যে বলেছে ও। সত্যিই বোধহয় ঠান্ডা লাগছিল। কাঁপতে থাকা হাতটা নাড়িয়ে কোনোমতে ওর পিঠটা চাদরে ঢেকে দিল। দুর্বল হাতটা সারা পিঠময় ছুঁয়ে-ছুঁয়ে বলল, ‘ ঘুমাও লক্ষ্মী। এক্সামের জন্য গতরাতে ঘুমাওনি আমি জানি। চিন্তাগুলো আমার কাছে রেখে এবার একটু ঘুম দাও। আমি ডিসচার্জ পেলে সবকিছু গুছিয়ে দিব। টেনশন কোরো না। আমি আছি তো? আমার কাছে সব রেখে দাও। ‘ মেহনূর হাসল। বিহ্বল নয়নে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে ঘুম-ঘুম মুখটার প্রতি খুব মায়া কাজ করল। একটু ছুঁয়ে দিলে কেমন হয়? খুব রাগ করবে? ঠোঁট নামিয়ে ছোট-ছোট চুমুতে পুরো মুখটা ছুঁয়ে দিল মেহনূর। দু’চোখের পাতায় সবটুকু ব্যাকুলতা দিয়ে আদর করল সে। আবারও উষ্ণ ডোরে মিলিয়ে নিল একমাত্র মানুষটাকে। হঠাৎ মৃদু স্বরে খুবই আস্তে-আস্তে বলল মাহতিম,

– আমাকে একটু ভালোবাসো মেহনূর।

চোখ মেলে হাতটা শিথিল করল মেহনূর। আবারও আহত মুখটার পানে তাকাল। ঠোঁটজোড়া খুব বেশি-ই শুকিয়ে গেছে। কপালটাও ব্যান্ডেজে ঢাকা। আজ অবধি যেটা দেখতে পায়নি মেহনূর, সেটাই স্বচক্ষে দেখতে পেয়ে মিটিমিটি হাসল। ঠোঁটের উপর ছোট-ছোট দাড়িগুলো দেখা যাচ্ছে। দু’গাল জুড়েও ক্ষুদ্রাকার দাড়িগুলো হয়েছে। সবসময় তো ক্লিন শেভেই দেখতে পেল, আজ এই প্রথম যেন অন্য মায়াও দেখে নিল। সেইযে প্রথম দিনকার কথা, উপর থেকে এক ঝলক ক’জন অতিথির আগমন দেখল। তাদের মধ্য থেকে সবচেয়ে ফর্মাল গেটআপে থাকা কালো শার্ট-প্যান্ট পরা পুরুষটা, যার পুরো বেশভূষায় ছিল অন্যরকম এক আধিপত্য। আজ তার মুখটা নিজের বুকটার মধ্যে দেখে মেহনূর অবাকই হল। বিশ্বাসই হচ্ছে না কতগুলো দিন কেটে গেছে। কত প্রহর, কত বেলা, কত অসময়ের মূহুর্ত দু’জন একসাথে এক ছাদের নিচে কাটিয়েছে। আজ তাকে ছাড়া মেহনূর কোনোকিছু ভাবতেই পারে না, অথচ বিয়ের প্রথম দিনগুলোতে কত দূরে-দূরেই না থাকত। মেহনূর তখন বোকাই ছিল বটে, নতুবা এমন পুরুষের সান্নিধ্য কিভাবে ঠুকরে দিয়েছে? মেহনূর এসব ভাবতে-ভাবতে কখন যে অশ্রুসিক্ত হয়ে গেছে, নিজের আবেশীভুত সত্তার কাছে টের পায়নি সে। পুরোনো দিনের স্মৃতিগুলো ভাবলে মনটা আর্দ্র হয়ে যায়। মেহনূর তন্দ্রাচ্ছন্ন মুখের দিকে সম্পূর্ণ ঝুঁকে গেল, তার শুষ্ক ঠোঁটদুটো আদুরে মায়ায় নিজের ওষ্ঠাধরে গুঁজে নিল। চোখ বন্ধ করে আপ্রাণ আশ্লেষে চুমু খেল মেহনূর। সিক্ত করল শুষ্ক ঠোঁটজোড়া।

দুটো ঘন্টা শেষ হতে আর কিছু সময় বাকি আছে। দেখতে-দেখতে দুটো ঘন্টা পার হলেও কেউ বিরক্ত করল না ওদের। দরজায় ‘ টুকটুক ‘ জাতীয় শব্দ করে জাগাতে এল না কেউ। সবাই কেবিনের বাইরে হাস্যমুখে বসে আছেন। আছেন নিজেদের খোশগল্পে বুঁদ। নিত্যদিনকার হাসি-হাসি আনন্দগুলো সবার সাথে ভাগাভাগি করে যাচ্ছেন, সঙ্গে চলছে টুকটাক আমোদ। সবার চিন্তা-চেতনায় এটুকু হুঁশ অবশ্যই ছিল, সময়টা এবার তাদের হোক। একটু থাকুক তাদের মতো।

.

একদিন, দুইদিন, তিনদিন; এমনই করে সময় যেতে লাগল। নিঃশব্দে বহু সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। দেখতে-দেখতে হারিয়ে গেল মাসের-পর-মাস। যা একসময় ভবিতব্য ছিল, তা চোখের সামনে এসে হাজির। সবার মন থেকে অতীতের দিনগুলো মুছে যাচ্ছে। তারা নতুনত্ব নিয়ে আবারও নিজেদের তৈরি করছে। আগামীর জন্য সুন্দরভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই। গোটা দুই মাস সুড়সুড় করে চলে গেছে। কখন, কিভাবে চলে গেছে বুঝতে পারেনি কেউ। সময়ের নিঃশব্দ পথচলায় আজ ব্যস্ত হয়েছে সবাই। প্রাত্যহিক জীবনের প্রতি ঝুঁকে পরেছে তারা। শুধু মাহতিম আপন নিরালায় আবদ্ধ হয়ে আছে। পুরোটা সময় শুধু শোয়া-আর-শোয়া। ডাক্তার তাকে তিন মাসের জন্য বেড রেস্ট দিয়েছে। তার হাঁটা-চলা সম্পূর্ণ নিষেধ। যে ব্যক্তি কখনো একদিনের জন্য রেস্ট নিত না, আজ সে দিনের-পর-দিন রেস্টে পরে আছে। গাড়িটা যখন উলটে গেল, তার পা-টা ছিল এক্সিলেটরে। যার দরুন পা’টা খুব ইঞ্জুর্ড হয়েছে। অবশ্য প্রথম-প্রথম তারা বলেছিল পা’টা ভেঙে গেছে, সেটা আসলে সঠিক নয়। ভাঙেনি, তবে চোট লেগেছে। মাথার ব্যান্ডেজটা অবশ্য খুলে দেওয়া হয়েছে। এখন শুধু কপালের বাঁ-পাশটা সাদা ট্যাপে আঁটকানো। হাসপাতাল থেকে চারদিনের মাথায় ডিসচার্জ পেয়েছে শানাজ। ছেলে ও বউকে নিয়ে সৌভিক বাড়িমুখো হয়েছে। অফিসের ব্যস্ততা শেষে একবার বন্ধুকে দেখে যায় সৌভিক, সময় না পেলে ভিডিও কলে যোগাযোগ সেরে নেয়। মারজা এখন মাহতিমের সাথে কোয়ার্টারে থাকেন। ছেলে ও বৌমার সাথে কোয়ার্টারে থেকে গেছেন। আনসারী নিবাসটা বহুদিন যাবৎ খালি পরে আছে। কেউ নেই ওখানে। ‘ যাবেন যাবেন ‘ করে যাওয়াও হচ্ছে না। কিছুদিনের মধ্যে অবশ্য শীতকালীন অবকাশ শুরু হবে। তখন যেয়ে ঘুরে আসবেন বলে মনোকামনা। শরীরটা এখন আগের চেয়ে সুস্থ, শুধু পা-দুটো যা একটু ব্যথা করে। তৌফ সদ্য একটা প্রাইভেট সেক্টরে জব পেয়েছে। বেশ মোটা অংকের মাইনে পেয়ে এবার যেন বিয়ের পালা। ফারিনকে পছন্দ করার কথাটা সবাই কম-বেশি জানে, তবুও রাখ-ঢাক না-রেখে বন্ধুকে খোলাখুলি বলবে। প্রথম বেতনটা পেয়েই মাহতিমের কাছে প্রস্তাব পাঠাবে তৌফ। সিয়াম নিজের বিচার-বুদ্ধি খাটিয়ে বেশ ভাল একটা পর্যায়ে চলে গেছে। সফটওয়্যার ইন্ঞ্জিনিয়ার হিসেবে তার জুড়ি বেশ। নীতি ও প্রীতি ছুটি কাটিয়ে প্রবাসে ফিরে গেছে। তবুও ব্যস্ততা শেষে সকলের সাথেই কনফারেন্স কলে যোগাযোগ করে। একেক প্রান্ত থেকে সবাই যখন যুক্ত হয়, তখন মনে হয় সবাই কত কাছে। হৈচৈ, আড্ডা, টুকটাক আলাপ আরো কত কি! কলের ডিউরেশন হয় ঘন্টার-পর-ঘন্টা। ছোট্ট শোয়েব এখন দু’মাসের বাচ্চা। পিচ্চিটা সেদিনই মায়ের কোল জুড়ে এলো, আর আজ কিনা দু’মাস হয়ে গেল। তারিখটা মার্কার পেনে কেটে দিল মেহনূর। আজ রবিবার। টিlভির পর্দায় সকাল থেকে ব্রেকিং নিউজ যাচ্ছে। ভয়ে টিভিটা অন করেনি সে। পাসের সংখ্যাটা দেখলে নিজেকে তুচ্ছ মনে হয়। পরীক্ষাগুলো কিভাবে দিয়েছে একমাত্র আল্লাহ্ পাক জানেন। কেমন পরিস্থিতির মধ্যে দিতে হয়েছে সেটাও অজানা নয়। একদিকে মাহতিম, অন্যদিকে পরীক্ষা। মাহতিমকে কোয়ার্টারে আনার পর টেবিলে বসতে চাইত না। বসলেই মনে হত, এই বুঝি উনার কিছু লাগবে। এখনই বুঝি পানি খাবেন, ঔষুধের সময় হয়ে গেছে, এখন ওঠা যাক। মাথায় মলম দিতে হবে, পা-টা দেখে আসা লাগবে, এরকম আরো কত-শত চিন্তা ঘুরঘুর করত। মাহতিম এসব আদিখ্যেতা দেখে দারুণ রেগে যেত। তাকে কেউ পঙ্গুর মতো ট্রিট করুক এটা সে কখনো চাইত না। কদাচিৎ ব্যবহারগুলো মেনে নিত সে, কিন্তু একটা পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে মেহনূরকে ধমক লাগাত। কাজ হত একটু, কিন্তু যা তা-ই। মেহনূর আগের চেয়ে অনেক বদলে গেছে। ছোট-ছোট বিষয়ে যেমন জড়তা নিয়ে থাকত, এখন সেগুলো কেটে গেছে। মারজার সাথে, তৌফের সাথে, নীতির সাথে প্রায় সকলের সাথে মেয়েটা নিঃসকোচে কথা বলে। তবে কথা বলার ক্ষেত্রে আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠে। প্রতিটা কথা ছেঁকে বিচার-বুদ্ধি দিয়ে মেপে তারপর কথা বলে মেহনূর। আগের মতো চুপচাপ স্বভাবটা কমে গেছে। মাহতিম চারিদিকে আনন্দময় পরিবেশ দেখে মনে-মনে হাসে। সে শেষপর্যন্ত পেরেছে। এত-এত সাধনার পর চুপচাপ গুটিয়ে থাকা মেয়েটাই তার জন্য সব। তার বুকের একমাত্র সঙ্গী। তার ক্লান্ত মনকে শান্ত করার মানুষ। কবে তার জীবনে অপ্রত্যাশিতভাবে মেয়েটা এসে পরল, সেটা নিয়ে আজও ভাবতে হয়। মেয়েটা তার থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত স্বভাবের, তবুও ওর প্রতি দুর্বলতা বেশি। চোখের কাছে, হাতের কাছে, বুকের পাশটায় না-পেলে সবকিছু বড্ড শূন্য-শূন্য লাগে। শুধু ‘ আমার বউ ‘ বলা দুষ্টু মাহদিটাই পাশে নেই। সময় কত দ্রুত চলে যায়। কেন জানি সমুদ্র খুব টানে। মনে হয়, সমুদ্রের পানি ছুঁলেই মাহদিকে স্পর্শ করা যাবে। টুপ করে ডেকে বসবে, ‘ ভাইয়া, তোমাকে মিস করি। ‘ গলা জড়িয়ে কাধে লুকানো মুখটা আজও খুব মনে পরে। নিষ্পাপ হৃদয়ের ডাকটা রি-রি করে কানে বাজে। মন থেকে হতোদ্যম শ্বাসে বেরিয়ে আসে, ‘ মাহদি, তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে রে ভাই। একবার দেখা দিবি? স্বপ্নের মধ্যে হলেও ভাইয়াকে একবার দেখা দে। ‘

ডিপার্টমেন্ট থেকে ছুটি মন্ঞ্জুর করেছে। ছুটিটা অশোক সেন মন্ঞ্জুর করে দিয়েছেন। মাহতিমের ছুটি কাটাতে ভাল লাগে না। একটা সময় ছুটির জন্য খুব অসহায় ছিল, কিন্তু তখন সুযোগ বলতে সুযোগ ছিল না। মাহতিম অবশ্য চালাক, একাধারে দুই-দুইটা সাইড আবারও সামলে চলছে সে। ডিপার্টমেন্টের টুকটাক কাজের পাশাপাশি বেড রেস্টও করছে। এ নিয়ে অশোক সেন জানতে পারার পর খুব দ্বিমত পোষণ করেন। কিন্তু, মতামত নিয়ে মাহতিমের কাছে টিকতে পারেন তিনি। শক্ত যুক্তির কাছে হার মেনে পিছিয়ে পরেন মিঃ সেন। জোহরের আযান দিচ্ছে। দুপুর বোধহয় একটা। বিছানার হেড সাইডে পিঠ ঠেকিয়ে কাজ করছে মাহতিম। কোলের উপর ল্যাপটপ, ডানহাতে রিং প্যাঁচানো নোটপ্যাড। একটা গুরুত্বপূর্ণ কেসের ব্যাপারে সূত্র খুঁজছে। তিনদিন হল কেসটা হাতে পেয়েছে সে। আরেকটা হাই প্রোফাইল কেস নিয়ে মাথা খাটানোর সময় এসেছে। এতে প্রয়োজন ধৈর্য্য, সঙ্গে দরকার সাহস। কেসটা অন্য কোনো প্রোফেশনাল টিম বা লিডারের কাছে কেন গেল না বুঝতে পারছে না মাহতিম। এটা কি তবে সফলতার চিহ্ন? সে কি তবে উচ্চ থেকে আরো উচ্চপদস্থ কিছু হতে যাচ্ছে? ঠোঁটের কোণে পুরোনো দিনের মতো বাঁকা হাসি ঝুলাল। মনে-মনে নিজের কাছে স্বগোতক্তি করে বলল, ‘ আনসারী, ইউ আর গেটিং এ্যা প্রোমোশন ভেলি স্যুন। জাস্ট ওয়েট এ্যান্ড ওয়াচ্। খেলা তো শুরু করতেই হবে। ‘। হাতের ডানপাশ থেকে মোবাইলটা বেজে উঠল তখন। সাইলেন্ট ফোনটা বিপ্ বিপ্ করে কাঁপতেই হাতে তুললো ওটা। ল্যাপটপে সজাগ দৃষ্টি রেখে ফোনটা কানে চাপলো সে,

– হ্যালো,

ফোনের অপর প্রান্ত থেকে উদ্বেলিত সুর ভেসে এল,

– স্যার, মlরার জন্য রিকুয়েস্ট করছে।

জবাবটা দাম্ভিকতার স্বরে দিল,

– করুক।

আবারও দুশ্চিন্তার কণ্ঠে বলল,

– হাতে-পায়ে ধরে মাফ চাইছে।

একই স্বরে জবাব দিল মাহতিম,

– চাক।

একটু থেমে ফের শুধাল,

– স্যার, খাবারের স্টক শেষ। এখন কি করব?

মাহতিম প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে সশব্দে দম ছাড়ল। মেজাজটা হাইপারের দিকে যাচ্ছে। লক্ষণ ভাল না। নিজেকে অতিদ্রুত বশে আনা লাগবে। গম্ভীরতা বজায় রেখে সুস্থির কণ্ঠে বলল,

– ডাস্টবিন থেকে খাবার তুলো, ওটা আনো, খাবারের স্টক ফিলাপ করো। কথা ক্লিয়ার? ইউ নো, হোয়াট আই মিন। এই টপিকে আর বাড়তি প্রলাপ শুনব না। ওভার এ্যান্ড আউট।

ফোনটা কেটে দিল মাহতিম। এই প্রসঙ্গে কথা বলতে একদম ইচ্ছে করে না ওর। পুরো মুডটার বারোটা বাজাতে এই একটা টপিকই যথেষ্ট। শেষের কথাগুলো ওয়াকি-টকি স্টাইলে বললেও ওপাশের ব্যক্তি যখন কল করে, এভাবেই বলতে হয় তাকে। মেজাজেটা আবারও —

‘ – আমি আসব? ‘

মাহতিম মুখ তুলে দরজার দিকে চাইলো। এক্ষুনি রাগটা দমন করা প্রয়োজন। দরজা একটু ফাঁক করে মেহনূর উঁকি দিয়ে আছে। ও কি বুঝে গেছে? ওর সামনে কিছুই বলা যাবে না। মেহনূর কাঙ্ক্ষিত জবাব না-পেয়ে আবারও ইতস্তত সুরে বলল,

– আমি কি আসতে পারি? আপনি কি ব্যস্ত আছেন?

মাহতিম চোখ বন্ধ করে আসার ইঙ্গিত দিল। ও শোনেনি। এই ছোট-ছোট কায়দাগুলো মাহতিমকে বড্ড খুশি করে। যদিও নিজের রুম, তবুও ওকে ব্যস্ত দেখলে জিজ্ঞাসা ঢোকাটা মেহনূরের ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র শিষ্টাচার। মেহনূর কাঁচুমাচু ভঙ্গীতে কাছে এসে বসল। হালকা একটা ঢোক গিলে চিন্তিত চোখদুটো ওর দিকে তুলল, ভয়ার্ত কণ্ঠে ধীরে-ধীরে বলল,

– আজকে কি হবে জানেন? মনে আছে?

মাহতিম মুচকি হাসল। বাঁহাত বাড়িয়ে মেহনূরকে কাছে টানল। মাথাটা ওর কাঁধে রেখে কোমরটা সন্তর্পণে জড়িয়ে আলতো সুরে বলে,

– রেজাল্ট দিবে না?

মেহনূর কাধে থাকা মাথাটার সাথে নিজের গালটা ঠেকিয়ে দিল। ডান হাত দিয়ে চুলের ফাঁকে-ফাঁকে আঙুল চালিয়ে বলল,

– না জানি কি করেছি। খারাপ করলে বকবেন? বকবেন না হ্যাঁ? আমি তো ওরকম ভাবে পড়তে পারিনি। কত ঝামেলা —

কথাগুলো শুনতে পেল মাহতিম, কিন্তু মনোযোগ অন্যদিকে গেছে। ল্যাপটপে সে আঙুল চালাচ্ছে। মস্তিষ্কের ভেতর থেকে দশ ডিজিট ও ছয় ডিজিটের সংখ্যাগুলো খটাখট শব্দ করে বসাল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই ল্যাপটপটা এক টান দিয়ে মেহনূরের দিকে ঘুরিয়ে দিল। ওর কাধটার মাঝে আবারও মুখ ডুবিয়ে কোমরটা দু’হাতে জড়িয়ে ধরল। এহেন কাণ্ডে মেহনূর কিছুই বলল না। অন্যসময় হলে বলত, ‘ মা, আসছে। ছেড়ে দিন ‘। আজ বিলক্ষণ চিন্তার মূহুর্তে মাহতিমকে দৃঢরুপে বাহুপাশে রেখেই দিল। সাদা শার্টের উপর দশটি আঙুল চেপে বলল,

– কিভাবে বুঝলেন এই মূহুর্তে আপনার কাছে এটাই চাইতে এসেছিলাম?

মাহতিম পিঠের উপর চাপ পেয়ে আরেকটু মিলিয়ে গেল। তার শক্ত বুকটার মাঝে নরম দেহটা শক্তভাবে দু’হাতের বেড়িতে চেপে ধরল। কণ্ঠে পরিস্ফুট আনন্দ টেনে হাস্যমুখে বলল,

– ল্যাপটপে তাকান ম্যাডাম। কঙ্গোরেচুলেশান।বাজিটা জিতে গেছেন। আপনাকে কিভাবে আদর করব বলুন? কিভাবে করলে এই অধমটার মনে শান্তি মিলবে?

মেহনূর হতভম্বের মত পিটপিট চোখে তাকাল। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। উজবুকের মতো ল্যাপটপের দিকে তাকাতেই বিদ্যুৎবেগে বিশাল বড় হা করে ফেলল। চোখের চাহনি ছানাবড়া হয়ে পিঠের দশটি আঙুল বলশূন্য হতে লাগল। পরিস্থিতি আন্দাজ করে মাহতিম আরো কঠোরভাবে আড়ষ্ট করে ধরলে তৎক্ষণাৎ মেহনূর গলা উঁচু করে হিমশিম নিশ্বাসে খেল। আঁটকে আসা নিশ্বাসটা বুকে চেপে নিজেকে ধাতস্থ করল মেহনূর। স্ক্রিনটা একটু-একটু করে ঝাপসা হয়ে আসছে। আর দেখতে পাচ্ছে না সে। ঠিক তখনই নিচের অধর কামড়ে ভেজা দৃষ্টিতে বলল,

– আপনি খুশি?

হাতজোড়া মন্থর করল মাহতিম। মেহনূরকে ঢিলেভাবে ধরল। কাধের উপর নিবিড়ভাবে ঠোঁট বুলিয়ে বলল,

– আমার চাইতে খুশি আর কেউ হয়নি মেহনূর। তোমার রেজাল্টে আমি প্রচণ্ড বেশি খুশি। যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তুমি গেছ, সেটা আর কেউ বুঝুক বা না-বুঝুক আমি বুঝি। আমার বউ, আমার লক্ষ্মী মেহনূর, তুমি তোমার যুদ্ধে সফল হয়ে গিয়েছ। আর কোনোদিন পিছু ফিরে দেখো না। মানুষ সফলতার গল্প শোনে, ব্যর্থতার দুঃখ বুঝবে না।

NAME : MEHNUR AFRIN
RESULT : PASSED
GPA : 5.00
.

ফারিন মুখ ভার করে বসে আছে। বিছানার উপর দু’হাত মেলে চোখের সামনে ধরেছে। দুটো হাত ভর্তি করে মেহেদি কাল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিপত্তি বেঁধেছে বরের নামটায়। রাতে কোন স্টাইলে যে ঘুমিয়েছে, এখন সকালে উঠে দেখে Touf নামটা ouf হয়ে আছে। এটা যদি তৌফ দেখে তখন কি যে বলবে! কেমন বিশ্রী একটা ব্যাপার যে হবে! নাক কুঁচকে প্রচণ্ড রেগেমেগে তৌফ বলবে, ‘ তুই আমার নামটাকে কি করলি ফারিন! তাউফ হলেও চলত, তা না! ওই জায়গায় ওউফ বানিয়ে ফেললি? ‘ এখন কি করবে ফারিন? নাম লেখার জায়গাটা এত ছোট্ট করেছে যে, খোঁচা মেরে সংশোধন করার উপায়টা পযর্ন্ত নেই। কিন্তু এই অবস্থায় তো থাকা যাবে না। কি করা উচিত? ঠিক তখনই মেহনূর ট্রে-তে করে সকালের নাস্তা এনে হাজির। হাসিমুখে ছোট ননদের দিকে ফিচেল হেসে ট্রে-টা বিছানার উপর রেখে বলল,

– যাক বাবা, শেষমেশ উঠে গেলে। আমি তো দু’বার এসে ফিরে গিয়েছি। এখন চট করে নাস্তাটা খেয়ে ফেলো তো। আমি নিচে যাচ্ছি হ্যাঁ? কোনোকিছুর দরকার হলে ডেকে দিও ঠিক আছে?

ননদের গালটা ছুঁয়ে মেহনূর বসা থেকে উঠতে নিল। ওমনেই বিচলিত ফারিন এক লাফ দিয়ে মেহনূরের আঁচলটা টেনে অস্থিরচিত্তে আঁটকাল। চিন্তিত সুরে বলল,

– ভাবী, দাঁড়ান, প্লিজ দাঁড়ান। আমি খুব বিপদের মধ্যে আছি। এই দেখুন। কি করব বলুন? তৌফ ভাই যদি এই অবস্থা দেখে আমাকে ঠাটিয়ে মারবে।

মেহনূর বোকা বনে ফারিনের দিকে তাকাতেই ওর মেলে দেওয়া হাতদুটোর দিকে চাইল। ভ্রুঁ কুঁচকে ছোট-ছোট চোখ করে দেখতেই হঠাৎ বিস্ফোরণ চাহনিতে মেহনূর বলে উঠল,

– নামে ভুল! কেমন অবস্থা এটা? এটা তো ঠিকও করা যাবে না। তৌফ ভাইয়া কাল বারবার ফোন দিয়ে এই নামের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে। এখন? আচ্ছা দাঁড়াও দেখি। মেহেদির কোনটা কোথায় রেখেছ?

মেহনূর চটজলদি উঠে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গেল। ওখান থেকে জিনিস এলোমেলো করে খুঁজতেই ফারিন দু’হাতের দিকে নজর বুলিয়ে বলল,

– ভাবী এটা কি বেশি-বেশি হচ্ছে না বলো? নাম নিয়ে এত বেশি সতর্ক করার মানে আছে? আম্মু-আব্বুর জেনারেশনে তো এসব শুনিনি। আমার বেলায় কেন এত লাফালাফি-ঝাঁপাঝাঁপি করা হচ্ছে?

মেহনূর জিনিস সরাতে-সরাতে বলল,

– কারণ, তোমরাই এসব কালচার অনুসরণ করতে-করতে টেনে এনেছ। আমাদের দেশে আগেও এই প্রথা ছিল, কিন্তু এত কড়াকড়ি ভাবে ছিল না। দিলে দাও, না দিলে নেই। কাল ব্যানারে দেখলাম মেহেদির জায়গায় ইংরেজিতে ‘ মেহেন্দি ফাংশন ‘ লেখা। আমি যতটুকু জানি, সরল ভাষায় একে ‘ মেহেদি ‘ বলে, আর আন্ঞ্চলিক সুরে বলে ‘ মেন্দি ‘। এখানে মেহেন্দি শব্দটা তোমাদের জন্য এসেছে না?

ভাবী একদম ভুল বলেনি। ঠিকই বলেছে সে। সভ্যতা যত এগুচ্ছে, তত কঠিনের দিকে যাচ্ছে। কি হবে সামনে? মেহনূর অবশিষ্ট মেহেদির কোনটা পেয়ে ফারিনের কাছে বসল। ওর ডানহাতটা টেনে কিভাবে ভুলটা ঠিক করা যায় সেই উপায় ঠাওরাচ্ছে। এমন সময় ত্রস্তপায়ে দুমদাম গতিতে কেউ ঘরে প্রবেশ করল। কানে বোধহয় ফোন চেপে কথা বলে যাচ্ছে। বিছানার দিকে দুটো শপিং ছুঁড়ে ফেলে আবারও যেতে-যেতে ব্যস্ত গলায় বলল,

– এ্যাই ফারিন? তোর পাশের জনকে বলে দিবি শাড়িটা পরে নিতে। যদি ইচ্ছে না হয়, ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিতে বলিস।

মেহনূর আঁতকে উঠার মতো দরজার দিকে তাকালো। কেউ নেই। ততক্ষণে মানুষটা চলে গেছে। ফারিন প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ভাবীর দিকে শুধাল,

– ভাবী, কাহিনি কি? ভাইয়া কি রেগেমেগে বোম হয়েছে নাকি? তুমি কি কিছু করেছ?

মেহনূর ঠোঁট উলটে ফেলল। অর্থ, ‘ আমি তো কিছুই জানি না ‘। মহা ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে বিয়ের আয়োজন শুরু হল। আজ সন্ধ্যায় তৌফ ও ফারিনের বিয়ে। কনেপক্ষের বিয়েটা কনভেনশন হল থেকে আয়োজিত হবে, বরপক্ষেরটা অবশ্য বাড়িতে। ফারিন ইচ্ছে করে বিয়ের লেহেঙ্গা ধবধবে সাদা নিয়েছে, সজ্জাটা করেছে পার্শ্ববর্তী বন্ধু দেশের মতো। ফারিনের বাবা-মা দেশে এসে যতখানি আয়োজন করত, তার চেয়ে বেশি আয়োজন করেছে মাহতিম। ছোট বোন ফারিন এবং বন্ধুতুল্য ভাই তৌফের বিয়েতে কোনোকিছুর কমতি রাখেনি। শুধুমাত্র পরিবারের মানুষ মিলে শামিল হয়েছে। বিরাট বড় হলটা আলিশান ভাবে সাজানো, চর্তুদিকে চোখ ধাঁধানো সজ্জা। আভিজাত্যের ছোঁয়া যেন প্রতিটি কোণায়-কোণায় লেগেছে। চর্তুপাশে আনন্দের উচ্ছাস যেন ছড়িয়ে পরেছে। কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে অন্য একটা তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছছে মাহতিম, বাথরুম থেকে বের হয়ে চটপট কাজ করছে। বিছানার উপর সাদা রঙের কারুকার্যপূর্ণ পান্ঞ্জাবী, একপাশে কালো চামড়ার ঘড়ি, আরেক পাশে লিস্টির কাগজ। প্যান্টটা পরে দ্রুত আয়নার সামনে দাঁড়ালো। ভেজা চুলগুলো ডানহাতে ঝেড়ে বাঁ কবজিতে ঘড়ি গলিয়ে ফেলল, ছিদ্রের মধ্যে ঘড়ির আঙটা ঢুকাতেই হঠাৎ খট করে দরজার খুলার আওয়াজ হচ্ছে। ঘড়িটা পরতেই কি যেন আন্দাজ করে স্থির হল মাহতিম, ওমন সময় মিষ্টি-নরম-আদুরে সুরে রিনিঝিনি কণ্ঠে বলল,

– আমি কি আসব?

ঘড়ি পরা অবস্থায় মাহতিম চট করে আয়নায় তাকাল। আয়নায় প্রতিবিম্ব হওয়া উঁকি দেওয়া ছোট্ট মুখটা দেখে সম্মোহন চোখে হাত নামিয়ে ফেলল। দরজাটা পুরোপুরি খুলে আজ্ঞার অপেক্ষা না-করে মেহনূর প্রবেশ করে ফেলেছে। পড়নে তারই দেওয়া লাল পেড়ে সাদা শাড়ি। কানে ঝুলছে লাল পাথরের সোনালি ঝুমকা, কপালে বসেছে গোলাকার টিকলি। দু’হাত ভর্তি করে চুড়ি পরেছে, হাঁটার মৃদু-মৃদু পদক্ষেপ চুড়ির শব্দ হচ্ছে। রিন-ঝিন শব্দ তুলে নেভি পান্ঞ্জাবীটা হাতে তুলল, মাহতিমকে ধরে-ধরে ড্রেসিং টেবিলের মাঝারি টুলটার উপর দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বলল,

– হুঁ, এবার পড়ুন।

মাহতিম ওর অবস্থা দেখে মুখ উঁচু করে তাকিয়ে আছে। তার হাইটকে টেক্কা দিয়ে কমপক্ষে ক’ফুট লম্বা হয়েছে। ওর হাত থেকে পান্ঞ্জাবীটা ছোঁ মেরে নিতেই গমগম সুরে মাহতিম বলল,

– সামনে থেকে সরো।

মেহনূর উদ্বিগ্ন দৃষ্টি দিয়ে আড়ষ্ট ভাবে বলল,

– করলামটা কি? আবারও উদ্ভট আচরণ?

মাহতিম পান্ঞ্জাবীটা পড়তে-পড়তে বলল,

– প্রশ্নটা নিজেকে করো। তুমি কেন অদ্ভুত আচরণ করছ? কেন করছ? কি জন্যে করছ? আছে জবাব? কাল থেকে জিজ্ঞেস করছি কি হয়েছে, তুমি আমায় কিছুই বলছ না। এখন যাও সামনে থেকে। কোনো কৈফিয়ত দেবে না।

মেহনূর দিশেহারা দৃষ্টিতে ঢোক গিলল। একটু আগের ঘটনাটা মনে পড়তেই চিন্তিত হলো সে। মেহনূর সবকিছু দেখাশোনা করতেই হঠাৎ পেছন থেকে ডাক দিল। ‘ এ্যাই মেহনূর? শোন তো! ‘ মেহনূর চট করে পিছু ফিরে তাকাল। শানাজ বুবু শোয়েবকে কোলে নিয়ে ডাকছে। মেহনূর তড়িঘড়ি করে এগিয়ে যেতেই শানাজ চাপা কণ্ঠে বলল,

– চlড় খেতে চাচ্ছিস? তোকে কতবার বলব একটু সাবধানে হাঁট! এখন কি ফড়ফড় করে হাঁটার সময়? পা পিছলালে কি সর্বনাশটা করবি? তুই কি গাধা হয়ে যাচ্ছিস? আমি এক্ষুনি ভাইয়ার কাছে যাব! কথাগুলো না বলা পযর্ন্ত শান্তি পাব না। যতক্ষণ পযর্ন্ত পেটে রাখব, ক:ল:জে শুদ্ধো খাঁ খাঁ করবে।

মেহনূর মুখ কালো করল। ডানে-বাঁয়ে কেউ দেখছে কিনা সেটা লক্ষ করে শানাজের নিকটে এসে বলল,

– আস্তে বলো বুবু। বিয়েবাড়িতে দৌঁড়-ঝাঁপ হবে এটাইতো স্বাভাবিক। তুমি দয়াকরে আজকের মত ক্ষ্যামা দাও। কথা দিচ্ছি বুবু, আর এরকম করব না। এরপর থেকে দেখে-দেখে হাঁটব। দরকার পরলে হাঁটবই না। তবুও উনাকে বোলো না প্লিজ।

শানাজ কড়া চোখে তাকাল। শোয়েব মায়ের উচুঁ স্বর দেখে টুকটুক চোখে তাকিয়ে আছে। শিশুসুলভ কর্মকাণ্ডের মতো পুচকে-পুচকে আঙুলগুলো মুখে ভরে খাচ্ছে। তার বুঝি ধারণা, ‘ আম্মু কি বলছে? খালামনিকে বকছে কেন? ‘ শানাজ দম্ভভরে রাগ দেখিয়ে বেশ রাগত স্বরে বলল,

– তুই আজকের মধ্যে জানাবি! কথা শুনেছিস? আজকের মধ্যে মানে, আজকের মধ্যেই! তোর যদি কিছু হয় মাহতিম ভাইয়া আমাকে কুlটিকুlটি করবে। তোর বরকে আমি যথেষ্ট ভয় পাই। ভালভাবে বলছি মেহনূর, ভালভাবে শুনিস। ভাইয়াকে আজকের ভেতর জানাবি। আল্লাহর ওয়াস্তে আর গাঁইগুঁই করিস না। বেচারাকে জানিয়ে দে।

আজকের ভেতর কিভাবে জানাবে? মেহনূর কথাটা বলার জন্য বিশেষ দিন রেখেছে। সেদিনই বলবে, যেদিন মানুষটার জন্মদিন। মারজার কাছ থেকে তথ্যটা নিয়ে কাজে লাগাবে সে। কিন্তু এখন? চিন্তার সুঁতা কেটে চমকে উঠল মেহনূর। তার হাত ধরে অনবরত ঝাঁকাচ্ছে মাহতিম। ‘ কি হয়েছে? মেহনূর কথা বলছ না কেন? ‘। সংবিৎ ফিরে পেয়ে মেহনূর নিজেকে সামলাল। শানাজের কথাটা ভাবতে গিয়ে কখন বেখেয়ালে চলে গেছে ভাবতে পারেনি সে। আর দেরি করা চলবে না। যা বলার এখনই বলতে হবে। মেহনূর সঙ্গে আনা ছোট্ট চিরকুটটা মাহতিমের হাতে গুঁজে দিল। মাহতিম ভ্রুঁ কুঁচকে কিছু বলবে, তৎক্ষণাৎ টুল থেকে নেমে পালিয়ে গেল মেহনূর। কিছু বলার সুযোগই দিল না সে। দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে ফারিনের রুমে আসে। ফারিনের রুমটা খালি, ওকে নিচে নেওয়া হয়েছে। এতটুকু এসে মেহনূর বড্ড হাঁপাচ্ছে। বুক উঠা-নামা করা নিশ্বাসে মুখ দিয়ে দম ফেলছে। শরীরটা আগের মতো জক্কি পোহাতে পারে না। সামান্য একটু কাজেই হাঁপিয়ে উঠে। উনি যদি চিরকুটটা খুলে, মন দিয়ে পড়ে, তাহলে কেমন অবস্থা হবে? দৃশ্যটা কল্পনা করতেই লজ্জায় মিশে যায় মেহনূর। কেমন অনুভূতি হবে? যখন জানবে ওই সুখবর, কি করবেন উনি?

‘ আমার মধ্যে ছোট্ট একজন বেড়ে উঠছে। সে ছোট-ছোট হাত-পা নিয়ে বড় হবে। ক’দিন পর আপনি তাকে ছুঁতে পারবেন আনসারী সাহেব। আপনি কি খুশি? ‘

কিছুক্ষণের ভেতর বিয়েটা শেষ হয়ে যায়। হালাল দম্পতি হিসেবে আবদ্ধ হয় ফারিন ও তৌফ। এদিকে মাহতিম নিখোঁজ। কোনোখানেই তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফারিনের বিদায়ের বেলায়ও খুঁজে পেল না। হুট করে কোথায় গুম হল সে? কোথায় গেল মাহতিম? মূহুর্ত্তের ভেতর বিচিত্র অবস্থার সৃষ্টি হল। অদ্ভুত আশঙ্কায় ফারিন অস্থির। তাড়াতাড়ি পরিবেশটা ঠান্ডা করার জন্য সৌভিক চট করে মিথ্যে সাজিয়ে বলল,

– মাহতিম কাছেই আছে। ওকে একটা জিনিস আনতে পাঠিয়েছি। তুই টেনশন করিস নাতো। গাড়িতে উঠ্। কাল রিসেপশন না? কালকে তো দেখা হচ্ছে।

বিদায়ের পালা শেষ। কিন্তু মাহতিম এল না। সবাই সৌভিকের কথাকে বিশ্বাস করে ফেলল, কিন্তু কল্পনাও করেনি ওটা মিথ্যে ছিল। নিঃশব্দে সময় পেরিয়ে রাত হল, বারোটা বাজল, মধ্যরাতের সময় হল। ভূতুড়ে ভেলকির মতোই মাহতিম গায়েব হয়ে আছে। মেহনূর জানতেও পারল না, চিরকুটটা আদৌ পড়তে পারেনি সে। তার আগেই নিচ থেকে ডাক চলে আসে। যে ডাক শোনার পর একটা সেকেন্ড দাঁড়াতে পারেনি মাহতিম! চটজলদি কাগজটা পান্ঞ্জাবীর পকেটে নিয়ে চলে যায় সে।

চলমান .