মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব-১২+১৩

0
866

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_১২.
#ফাবিয়াহ্_মমো.

রাতে সেই চুমুক-ঘটিত ঘটনার পর আর কোনো ঝামেলা হয়নি। মাহতিমের কাছ থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত ইশারা পেয়ে বুদ্ধির দরজা তখনো খুলেনি। কেনো মাহতিম চায়ের কাপে সেই চুমুক স্থানে আঙ্গুলের টোকা মারলো সেটি নিয়ে পুরো রাত ভেবেছে মেহনূর। কিন্তু আফসোস! সে কিছুই ধরতে পারেনি। সকালটা নির্লিপ্তভাবে কেটে গেলে মহিলারা দুপুরের রান্নায় মনোযোগ দিতে চলে যায়। এদিকে সৌভিকরা এসে আঙিনায় বসে আড্ডার মজলিশ বসায়। দুইদল বিভক্ত হয়ে মোবাইলে লুডু খেলার ভান করে গোপন আলাপ শুরু করে। গোল করে পুরো আট মাথা একসাথে লাগিয়ে মোবাইল স্ক্রিনের দিকে দৃষ্টি রাখে। সবাই এমন একটা ভঙ্গি ধরলো যেনো লুডু খেলার জন্য সবাই একত্র হয়েছে এখানে। ফারিন ফিসফিসিয়ে সবার উদ্দেশ্য নিচু স্বরে বললো,

– আজকের প্ল্যান বলো জলদি। আর বিগ ব্রোর জন্য কি মেহনূরই ফাইনাল? ওটাই কি ফিক্সড?

ফারিনের উত্তর শুনে সামিক লুডুর লাল গুটিতে ক্লিক মেরে চাল দিয়ে বললো,

– হু, ওই মেয়েই ফাইনাল। ওটাই ডান।

সামিকের জবাব শেষ হতেই নীতি উদ্বিগ্ন সুরে বললো,

– মেয়েটা কি বয়সে বেশি ছোট হয়ে যায় না? শানাজ হলে মেবি পার্ফেক্ট হয়। কি বলো সবাই?

নীতির বেকুব মার্কা কথায় চটে উঠলো তৌফ। ভ্রুঁ কুঁচকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে। কন্ঠ নিচু করে ক্রুদ্ধভাবে বললো ওকে,

– তোর নাম নীতি না দিয়ে দূর্নীতি দেওয়া উচিত ছিলো! যদি আরেকবার এমন বি-চ মার্কা কথা বলোস, থাপড়ায়া এক্কেবারে কানের চামড়া লাল বানায়া দিমু!

তৌফের উগ্র কথায় বিরক্ত হলো নীতি। নিজেকে সামলে নিয়ে কিন্ঞ্চিৎ পরিমাণে রাগ দেখিয়ে বললো,

– তোমার সমস্যা কি তৌফ ভাই? কথায়-কথায় এমন থাপ্পড় মারার কথা আসে ক্যান? মেহনূর যে বয়সে ছোট সেটা কি তোমরা বুঝতে পারো না? ওই মেয়ে যদি ভাইকে দেখভাল করতে না পারলো তখন তোমরা কি করবা? তাছাড়া মেহনূর যে ভাইয়ার দিকে ওই নজরে তাকায় না সেটা কি খেয়াল করছো?

নীতির কথায় যুক্তি দেখে এবার সৌভিক মুখ খুললো,

– দ্যাখ নীতি, আমরা সবাই জানি মাহতিম কেমন লাইফ লিড করে। ওর জন্য কি ঠিক, কি বেঠিক, এসব নিয়ে আমাদের চিন্তা করে লাভ নেই। আমি নিজেই মাহতিমের সাইড থেকে মেহনূরের জন্য পজিটিভ সাইন দেখেছি। যদিও সাইনটা হেব্বি ছিলোনা, তবুও ফার্স্ট টাইমের জন্য হলেও মাহতিম আনসারীর মধ্যে এমন একটা নেচার দেখাটা বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার। তুই নিজেই একবার ভেবে দ্যাখ, একটা ছেলে কি শুধু-শুধুই কারণ ছাড়া একটা মেয়ের জন্য আরেকজনের উপর শোধ তুলবে? সুরাইয়ার যেই হাল করেছে এ্যাটলিস্ট আমরা সবাই বুঝে গেছি, হি ইজ অন দ্যা লাইন। ও বেহুদা কারণে কারোর প্রতি সদয় হতে চায়না। তোদের সাথে কিছু উলটাপালটা করতে নিলে ও যে কি অবস্থা করে সেটা আর বলার প্রয়োজন মনে করলাম না। জাস্ট এটাই মাথায় রাখ, মাহতিম যেনো ভুলেও এখান থেকে যেতে না পারে। ওর পাসপোর্ট কোনোভাবেই ওর হাতে দিবিনা।

সৌভিকের শাসানো বাণী শুনে সবাই সম্মতি জানিয়ে সভা-ভঙ্গ করলো। ফারিন ও প্রীতি পুকুরপাড়ে চলে গেলো, সামিক চলে গেলো নিজের রুমে। এদিকে নীতি কোনোভাবেই ঠান্ডা হতে পারছেনা, বারবার মন বলছে মাহতিমের জন্য মেহনূর হয়তো ঠিক হবেনা। তবুও নিজের মনকে বুঝ দিয়ে যাচ্ছে মাহতিমের জন্য এটাই সম্ভবত বেটার অপশন হবে। মেহনূর ঠিকই আজ-নয়তো-কাল মাহতিমের প্রতি নরম হয়ে যাবে, মনের মধ্যে যতো ভয়জনিত ভীতি থাকবে সেগুলোও একটু-একটু করে দূর হয়ে যাবে ওর। শানাজের সাথে গল্প করার জন্য নীতি ওর রুমের দিকে যেতে থাকলো। নীতি নিজের মনে যখন এসব নিয়ে চিন্তা করছিলো, তখন হঠাৎ ওর দৃষ্টি সাবার রুমের দিকে আটকে গেলো। সাদা শার্ট পড়ুয়া তরুণ সাবার রুমে ঢুকে দ্রুত ভেতর থেকে দরজা আটকে দিচ্ছিলো। এমন আশ্চর্যজনক দৃশ্য দেখে কয়েক মিনিটের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলো নীতি। কি দেখলো চোখে? সাবার রুমে তরুণ ঢুকে দরজা আটকে দিচ্ছে? বাড়ির মানুষ যদি এই ঘটনা জানতে পারে তাহলে কি কাণ্ড হতে পারে জানা আছে? নীতি কিছু সময়ের জন্য চিন্তাচেতনা হারিয়ে ফেললো। কিছু না ভেবেই সাবার রুমের দিকে দুমাদুম এগুতে লাগলো। অচিন্তনীয় অবস্থায় ফেঁসে গিয়ে শেষমেশ পা থামিয়ে দাড়িয়ে পরলো নীতি। আর সেদিকে এগুলৌনে সে। শানাজের রুমের দিকে পা ঘুরাতেই শানাজের রুমেও আজগুবি ব্যাপার দেখলো। শানাজও অজানা কারনে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। নীতি দুদফায় আশ্চর্য হয়ে বুকভর্তি নিশ্বাস নিলো। সেটা নির্লিপ্তে ছেড়ে দিতেই বন্ধ দরজায় তিনবার টোকা মারলো। প্রায় দুইমিনিট পেরিয়ে গেলো, কিন্তু দরজা আর খুললোনা। নীতি যেই দ্বিতীয়বার কড়া মারা জন্য হাত উঠাবে , ঠিক তখনই খট করে দরজা খুলে গেলো শানাজের। শানাজ কেমন অপ্রতিভ মুখে জোরপূর্বক হাসি পেনে নীতির দিকে তাকিয়ে আছে। নীতি সেটা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখতে থাকলে একপর্যায়ে প্রসন্ন গলায় প্রশ্ন করে,

– তোমার দরজা খুলতে দেরি হলো কেন ?

কথাটা শুনে শানাজের মুখ যেনো অপ্রস্তুত হয়ে উঠলো। নিজেকে যথাসাধ্য ভাবে স্বাভাবিক করে ঠেলেঠুলে হাসি টেনে বললো,

– আসলে কুচি ঠিক করছিলাম তো, এজন্য দরজা লাগিয়েছিলাম।

উত্তরটা সম্পূর্ণ বেখাপ্পা লাগলো নীতির কাছে। যে মেয়ে অন্যসময় দরজা খোলা রেখে শাড়ি বদল করে, সেই মেয়ে সামান্য কুচি ঠিক করার জন্য দরজা লাগিয়ে দিবে এটা কেমন রহস্য-রহস্য লাগলো। তার উপর শানাজের চেহারাও কেমন চোরের মতো কাঁচুমাচু করছিলো। নীতি কিছু বলবে তার আগেই শানাজ ‘ জরুরী কাজের ‘ অজুহাতে মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলো। দুবোনের রুমের ভেতর কিছু যে কাহিনী রটছিলো সেটা আচঁ করতে পারে নীতি। চুপিসারে সাবার রুমের দিকে এগিয়ে চারপাশে সর্তক দৃষ্টিতে দেখে নিলো। কেউ এই মূহুর্তে ওকে দেখছে কিনা সেটা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলো। ডানে-বায়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে বন্ধ দরজায় কান রাখলো নীতি। ডানকানের কর্ণকুহরে এমন একটা শব্দ এলো তৎক্ষণাৎ চমকে উঠে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো সে। বুকের উপর হাত রেখে জোরে-জোরে নিল্বাস নিতেই তাড়াতাড়ি দৌড় লাগিয়ে মাহতিমের রুমে এসে পৌছঁলো। মাহতিম তখন খাটের উপর দুহাত এবং ফ্লোরের সাথে পা ঠেকিয়ে ননস্টপ ভঙ্গিতে পুশআপ-ক্ল্যাপ করছিলো। রুমের ভেতর হুড়মুড় করে নীতি ঢুকে পরলে চকিত ভঙ্গিতে কপাল কুঁচকে ওর মুখের দিকে তাকালো মাহতিম। সাথে-সাথে মাহতিম পুশআপ থামিয়ে সোজা হয়ে দাড়িয়ে পরলো। উন্মুক্ত গায়ে দ্রুত টিশার্ট জড়ানোর জন্য খাটের উপর থেকে খুলে রাখা টিশার্টটা নিলো। নীতির হাপানো অবস্থা দেখে কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন ছুড়েঁ বললো,

– কি হয়েছে? হাপাচ্ছিস কেন? পানি খাবি?

নীতি ওই অবস্থায় হাটুতে দুহাত রেখে মেঝের দিকে তাকিয়ে ‘ না ‘ বোধকে ইশারা করলো। মাহতিম টিশার্টটা গায়ে জড়াতেই চুলে ব্যাকব্রাশ করা অবস্থায় নীতির দিকে এগিয়ে গেলো। নীতি তখন হাপানি শেষ করে একটু ধাতস্থ হয়ে সোজা হয়ে দাড়াঁলো। মাহতিমের দিকে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে সবকিছু খুলে বললো। সবকিছু শুনতে-শুনতে কপালের ভাঁজ আরো কুঁচকে আসছিলো মাহতিমের। নীতিকে চুপ থাকতে বলে দ্রুত রুম থেকে পাঠিয়ে দিলো ওকে। ঘটনা আরো তলিয়ে দেখার জন্য চিন্তা করতে থাকলো সে। সাবার ঘটনাতে নিশ্চয়ই বিরাট অজানা রহস্য আছে। সাবা কালরাতেও সন্দেহজনক কাজ করেছে। এ বিষয়ে যদিও বাড়ির মানুষ কেউ জানেনা। কিন্তু সবার অগোচরে নির্ঘাত খারাপ কিছু হচ্ছে! কালরাতে কেনো কান্না করলো ও? সাথে কি সৌভিকের সাথে কোনো সম্পর্ক ছিলো?

গ্রাম্য-প্রকৃতি বিকেলের দিকে শান্ত হয়ে গেলো। পাখিদের কলরব গাছের ডালে-ডালে বেড়ে উঠলৌ। আকাশ হয়ে উঠলো রোমাঞ্চকর, চারপাশ হয়ে উঠলো আরো সুন্দর-মনোহর-মনোরম ভঙ্গিতে শীতল। মোল্লা বাড়ির সামনে যেই মেঠো পথের রাস্তা রয়েছে সেখান দিয়ে গ্রামের মানুষ অনাগ্রহ ভঙ্গিতে চলাচল করতে লাগলো তখন। কিছু মানুষ বাজার নিয়ে বাড়ির দিকে ছুটছিলো। বারান্দা থেকে দূরের পুকুরটা তখন স্পষ্টরূপে দেখা যাচ্ছিলো। পুকুরের পানিতে শুভ্র বর্ণের পাতিহাঁসগুলো কোমলচিত্তে সাতাঁর কাটছিলো। দোতলার মস্ত বারান্দায় দাড়িয়ে মাহতিম সে দৃশ্যগুলো শান্ত ভঙ্গিতে দেখছিলো। ঠান্ডা মৃদ্যু বাতাসে গা এলিয়ে মনের সব ক্লান্তি যেনো দূর হয়ে যাচ্ছিলো কাঠের রেলিংয়ে দুহাত ফেলে সেই বাতাসে গা ছেড়ে চোখ বন্ধ করলো মাহতিম। কানে শোঁ-শোঁ করে বাতাসের প্রতিধ্বনি শোনা গেলেও মনের মধ্যে সুক্ষ আচেঁ দারুণ কিছু মূহুর্ত ভাবতে লাগলো। আনচান করে বুকের মধ্যে, কোথাও যেনো উশখুশ করে উঠলো কিছু তীব্র আকাঙ্ক্ষার প্রতি। চোখের মানসপটে ভেসে উঠলো কেশবতী বালিকার ছবি। কিন্তু সেই ভাবনার রেশ কেটে দিয়ে রুমে প্রবেশ করলো মারজা। পেছন থেকে ‘ মাহতিম ‘ ডাক দিতেই রুমের দিকে ফিরে তাকালো মাহতিম। রেলিং থেকে হাত সরিয়ে চলে গেলো রুমের ভেতরে। মারজা ছেলের বিছানায় এসে নম্রভাবে বসলেন। মাহতিম পা চালিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় উঠে পরলো, মায়ের কোলে মাথা ছেড়ে আলস্য ভঙ্গিতে শুলো। সুন্দর দৃষ্টিজোড়ার চোখদুটো বন্ধ করে নিলো। মারজা আঙ্গুলের ডগায় ছেলের চোখের পাপড়ি বুলিয়ে ওর চুলের মধ্যে আঙ্গুল চালনা করতে লাগলেন, ছেলের মুখের পানে দৃষ্টি দিয়ে মুগ্ধ-নয়নে বিভোর হচ্ছিলেন। ক্লিন শেভ করা গালটায় দুহাত রেখে মাথা নুয়ে টুপ করে ছেলের কপালে স্নেহের এক চুমু বসিয়ে দিলেন। মাহতিম চোখ বন্ধ করা অবস্থায় মায়ের অকস্মাৎ কাজে মৃদ্যু ভঙ্গিতে হেসে দিলো। সেই হাসিটা সুন্দরভাবে বজায় রেখে মায়ের একটা হাত টেনে নিজের গালে চেপে ধরলো । সরল গলায় শান্ত ভঙ্গিতে মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
– বাড়ি কবে যাবে মা? অনেক দিন তো হয়ে গেলো। এবার কি বাড়ি ফেরা উচিত না? আমার যে ছুটি শেষ হয়ে আসছে। বাসায় কিছু সময় কাটানোর সুযোগ না পেলে কাজে মন লাগাতে পারবো না।

মারজা বেশ উদাস ভঙ্গিতে হতাশার নিশ্বাস ছাড়লেন। শ্রান্ত চক্ষুদুটো বিছানাঘেষা জানালার বাইরে ফেলে বিকেলের আকাশে তাকালেন। অনেকক্ষন যাবৎ চুপটি থাকার পর হঠাৎ নিরবতা চ্ছিন্ন করে অন্যমনষ্ক ভঙ্গিতে বললেন,
– তুই কি বিয়ে করবি না মাহতিম? এভাবেই সারাজীবন একা থাকবি? এবার তো নিজের দিকটা দ্যাখ। নিজেকে নিয়ে একটু চিন্তা কর। আর কতো একা থাকবি?

মায়ের উদাস গলার কন্ঠ শুনে চট করে তাকালো মাহতিম। মায়ের মুখটা ভীষণ করুণ দেখালো তখন, দৃষ্টিদুটো কেমন নিগূঢ় বিষণ্ণতায় ছেয়ে ছিলো তাঁর।গালের উপর থেকে মায়ের হাতটা টেনে ঠোঁটের উপর আনলো মাহতিম, চোখ বন্ধ করে হাতের তালুতে নিজের উষ্ণ ওষ্ঠ ছুয়িঁয়ে দিলো। সেই শক্তিহীন, লাবণ্যহীন, কুচঁকানো চামড়ার হাতটা নিজের দুহাতের মাঝে আকঁড়ে ধরলো। নিচু স্বরে আক্ষেপ ভঙ্গিতে মারজার দিকে তাকিয়ে বললো,

– বিয়ে নিয়ে তর্ক করতে চাইনা মা। এই ব্যাপারটার জন্য একদম ফোর্স করো না। তুমি এসব ব্যাপারের জন্য আমাকে একা ছেড়ে দাও। আমি সত্যিই এই মুহুর্তে বিয়ের জন্য আগ্রহী নই।

মারজ ছেলের বিমত ভাব দেখে তৎক্ষণাৎ জানালা থেকে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন। মাহতিমের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে কপাল কুচঁকে জিজ্ঞাসা করলেন,

– এখানে তোর সমস্যাটা কোথায় মাহতিম? উলটো তোর বউ খোঁজার জন্য তোর মামীকেও কাজে লাগিয়ে দিয়েছি। মাহতিম, তুই একটাবার হ্যাঁ বল, আমি তোর জন্য সব থেকে সুন্দরী, গুণবতী, রূপসী বউ এনে দিবো। তুই শুধু সম্মতি দে মাহতিম। আর একা থাকিস না। অন্তত এইবার বিয়েটা করে আমার জন্য মেয়ে দিয়ে যা। আমার মেয়ে পালার শখটা পূরণ কর মাহতিম। তুই তো ছুটি কাটিয়ে চলেই যাবি, এদিকে আমার দিকটা কি কখনো চিন্তা করেছিস? ভেবেছিস আমি কেমন করে একা বাড়িতে থাকি? মাহদির জন্য পুরো সময়টা ছেড়ে দিলেও আমার মন তো সেই কবে থেকেই মেয়ের প্রতি আটকে আছে। এবার অন্তত হ্যাঁ বলে দে মাহতিম। তুই একবার হ্যাঁ বললেই আমি খবর পাঠিয়ে তোর মামীর সাথে সবকিছু পাকা করে ফেলবো।

মাহতিম কোনো উত্তর দিলো না। হামেশার মতোই চুপ করে রইলো। কিন্তু চুপের রেশ বেশিক্ষণ না যেতেই হঠাৎ বিগলিত কন্ঠে সে বললো,

– মা আমার বউ নিয়ে এতো এক্সাইটেড কেন? আমার বয়স কি চোখে দেখেছো? আমার সাথে যেগুলো পড়তো, সেগুলো পচিঁশের মধ্যেই বিয়ে করে এতোদিনে দুবাচ্চার বাপ পযর্ন্ত হয়ে গেছে। এই তথ্য যদি বাইরে পাচার করি কোনো ভদ্রঘরের মেয়ে কিন্তু আমার জন্য আসবেনা। বাকিটা রইলো আমার স্ট্যাটাস আর ক্লাস, সেগুলো দেখে বিয়ে করার জন্য অবশ্যই মেয়ের কমতি হবেনা। কিন্তু তুমিতো জানো আমি এসবে অভ্যস্ত না। ওইসব মেয়ে দেখলে আমরা মুখ কম, হাত চলবে বেশি। এজন্য বলছি আমাকে এসবের টেনো না। আমি যথেষ্ট ভালো আছি।

মারজা ছেলের কথা শুনে কঠিন কিছু বলবেন অমনেই দরজা দিয়ে হুড়মুড় করে মাহদি এসে ঢুকলো। বিছানার কাছে এসে মায়ের সামনে দাড়িঁয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
– মা, মা তুমি কি একটু আসবে? নানাভাই ডাকছে।

মারজা ওর অস্থিরতা দেখে কিছুটা বিচলিত হলেন। প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে চট করে জিজ্ঞাসা করতেই জানতে পারলেন হান্নান শেখ এক আত্মীয়ের বাড়িতে নেওয়ার জন্য মারজাকে ডাকছেন। মারজা চটপট সেই ডাকে সাড়া দিয়ে সুজলার সাথে বাইরে চলে গেলেন। এদিকে মাহমুদাও মেহনূরের খালাকে দেখতে একসাথে বেরিয়ে গেলেন। জানিয়ে এশারের পরপরই বাড়ি ফিরে আসবেন।

বিছানায় শুয়ে চুল ছেড়ে বই পড়ছে মেহনূর। বাইরে আছরের আযানটা শেষ হতেই সুরাইয়া এসে ঢুকলো। মেহনূর বই থেকে চোখ না সরিয়ে সুরাইয়ার উদ্দেশ্যে বললো,

– তোমার কি কিছু লাগবে বুবু?

সুরাইয়া বেণী দুলিয়ে বিছানায় বসে বললো,

– লাগলেও তোর থেকে অনুমতি নেইনা, এটা তুই ভালো করেই জানোস। তুই আবার চুল ছাড়ছোস ক্যান? তোরে না চুল বাইধা রাখতে বলছে?

মেহনূর বই থেকে চোখ সরিয়ে সুরাইয়ার দিকে তাকালো। চুলে হাত দিয়ে চেক করতেই শান্ত সুরে বললো,

– বুবু চুল যে এখনো ভেজা, আমি তো ভেজা চুল বাধতে পারিনা। ভেজিআচুল বাধলে ঠান্ডা লাগে। আম্মা চুল বাধতে না করে দিছে।

সুরাইয়া ছোট্ট সুরে ‘ ওহ্ ‘ বলে মেহনূরকে জোর করে নিচে নিয়ে গেলো। মেহনূর যেতে না চাইলেও জোর খাটিয়ে ডান কবজি ধরে নিয়ে যেতে লাগলো। মেহনূর বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, এই প্রশ্নের জবাবে একবারও মুখ খুললো না সুরাইয়া। উঠোনের দিকে গোয়ালঘরে গিয়ে মৃদ্যু ধাক্কা মেরে ভেতরে ঢুকিয়ে দিলো ওকে। গোয়ালঘরে ঢুকে ‘ বুবু তুমি এখানে ‘ বলে প্রশ্নটা যেই করবে ওমনেই পেছন থেকে দরজা লাগিয়ে ছুটে পালালো সুরাইয়া। গোয়ালঘরের ভেতর একদম অন্ধকার অবস্থা। মেহনূর দরজায় কয়েকবার সজোরে ধাক্কা দিলো কিন্তু কেউ সেটা শুনলো না। একচালা এই গোয়ালঘরের ভেতর কেবল দুটো জানালা আছে। মেহনূর অন্ধকার ঘুচানোর জন্য যেই জানালার দিকে এগুবে তখনই ফট করে পেছন থেকে আলো জ্বলে উঠলো। কেউ ওর পেছনে দাড়িয়ে আগুনের আলো ধরিয়েছে। মোমবাতির শিখার মতো সরু লম্বা আলো দপদপ করে জ্বলছে। কিন্তু কে ঢুকেছে এই ঘরে সেটা বুঝতে পারলো না মেহনূর। পেছনে ফিরে যেই তাকালো ওমনেই দুচোখ বিশাল বড় হয়ে আকস্মিক ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো। কন্ঠরোধ হয়ে বুক ধড়াস-ধড়াস করতে লাগলো ওর। পানির তেষ্টায় বুক, গলা শুকিয়ে খাঁ খাঁ করে তোলপাড় শুরু করলো। মেহনূর ছোট থেকেই যার সঙ্গ অপছন্দ করে সেটা ছিলো তরুণ। তরুণের হাব-ভাব কোনোকালেই সঠিক ছিলো না। বিশেষ করে ওর হাত দেওয়ার অভ্যাসটা ভালো না। সুযোগ পেলেই পিঠে হাত রেখে খারাপভাবে চালনা করতে থাকে, পায়ের উপর পা উঠিয়ে সুড়সুড়ি দিতে থাকে, নানাপ্রকার ফাজলামির বাহানায় শরীরের বিভিন্ন জায়গায় টাচ করার চেষ্টা করে। এসব কথা কাউকে বলা যায়না, সহ্য করা যায়না, স্মৃতি থেকেও মুছেনা। দিনের-পর-দিন খারাপ অভিজ্ঞতা নিয়ে মন গুমরে থাকে। তরুণ লাইটার জ্বালিয়ে মেহনূরের দিকে বিশ্রী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শরীরের প্রতিটি ভাঁজে-ভাঁজে দূরবীনের মতো দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে। মারাত্মক লালসাগ্রস্থ চাহনিতে মেহনূরকে গিলে খাচ্ছে। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা অপ্রতিভ ভঙ্গিতে কামড়ালো, এরপর জিহবা দিয়ে নিচের ঠোঁটটা বিশ্রী কায়দায় ভিজিয়ে নিলো। সবই যখন মেহনূরের চোখের সামনে ঘটছিলো তখন ভয়জনিত কন্ঠে মেহনূর নিচু স্বরে আওড়ালো,

– আ-পপনি এখানে কেন ভা-ভাইয়া?

তরুণ একটা বিশ্রী হাসি দিয়ে দুপাটি দাঁত বের করলো। লাইটারটা অন-অফ করতেই পা চালিয়ে আসতে লাগলো। মেহনূর ওই অবস্থা দেখে প্রচণ্ড ভয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিলো। কি করা উচিত এখন? চিৎকার দিলেও শব্দ বাইরে যাবেনা। আপাতত বাড়ির কেউই কোনো শব্দ শুনতে পাবেনা। তরুণ ততক্ষণে মেহনূরের একেবারে সামনে এসে হাজির। লাইটারটা ডানহাতে আকঁড়ে মেহনূরের ভয়ার্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে হাসছে। মেহনূর সহজে এই নোংরা মানুষটার সামনে পরেনা, কিন্তু যখন পরে তখন এই মানুষটা কিছু না করে ছাড়েনা। তরুণ আবার মেহনূরের আপাদমস্তক দেখে নিলো, চুম্বকের মতো দৃষ্টিটা মেহনূরের গলার সেই তিলের উপর আটঁকে ছিলো। মেহনূরের দিকে বাম হাতটা এগিয়ে ওর কাধে রাখলো তরুণ। হাসি দিয়ে মিথ্যা সৌজন্যতার অভিনয় করে বললো,

– পড়াশোনা কেমন চলছে মেহনূর? সব ঠিকঠাক?

প্রশ্ন করছে ঠিকই কিন্তু মেহনূর এদিকে দাঁত শক্ত করে খিচ মেরে আছে। উত্তরের জন্য কুকঁড়ে গিয়ে বারবার কথা গুলিয়ে ফেলছে। তরুণ ওর কাধের উপর পাঁচ আঙ্গুল দিয়ে দিচ্ছে, বেহায়ার মতো গলার সেই তিলের উপরও আঙ্গুল ছুয়াঁচ্ছে। এমন বীভৎস আচরণে নিজের গলায় ফাঁস লাগাতে ইচ্ছে করছে মেহনূরের। তরুণের অসভ্য হাতের ছোঁয়া লেগে গা যেনো নর্দমার মতো হয়ে যাচ্ছে। তরুণ চুপ থেকে আবার উপদেশ ভঙ্গিতে বললো,

– ছাই কালার শাড়ি পরলে সাদা কালার ব্লাউজ পরবা। কালো কালার ব্লাউজ কিন্তু একটুও মানায় না। সাদা কালার পরলে একদম ফকফকা সুন্দর লাগে। মেহনূর, তুমি না হাতা একটু ছোট করবে কেমন? এই বয়সেই দাদিদের মতো ব্লাউজের হাতা পরা লাগবেনা।

কথাটুকু শেষ করতেই কাধ থেকে হতয় সরালো তরুণ। আটকে রাখা দম যেনো ছাড়তে পারলো মেহনূর। বাইরে থেকে ওকে যতটা শান্ত দেখাচ্ছিলো, ভেতরের অবস্থা ততই করুণ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে ওর। চোখের বাধ যেকোনো সময় ভাঙার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। তবুও নিজেকে যথাসাধ্য সামলে নিয়ে তরুণের আচরণ সহ্য করে যাচ্ছে। তরুণ এবার যেই জায়গায় হাত দিলো পুরো শরীর যেন বিষযুক্ত কাটার মতো ফুটে উঠলো ওর! মাথার ভেতর ঝিমঝিম করে ঝিঁঝি পোকার শব্দের বাজ পরলো! শিরা-উপশিরা টান-টান ভঙ্গিতে সমস্ত শরীর বিদ্যুতের মতো ঝিমিয়ে উঠলো। মেহনূরের পায়ের উপর বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে নাড়াচাড়া করছিলো তরুণ, সেই সাথে নানা কথার মুখরোচক প্রসঙ্গ তুলে পিঠের দিকে হাত রেখে দিয়েছিলো। তরুণের ধূর্ত ইচ্ছা ছিলো ব্লাউজের বোতাম খুলে লালসার প্রবৃত্তি এখুনি মিটিয়ে খেলতে, কিন্তু মেহনূর তখনই চোখ খিচুঁনি মেরে কেদেঁ উঠলো। মেহনূর দুহাতে শাড়ির আচঁলটা মুষ্টিবদ্ধ করে ধরেছিলো, হুহু করে ফুপিয়ে কেদেঁ উঠলে তরুণ বোতাম খোলার ইচ্ছাটা তখনই ত্যাগ করলো। সাথে-সাথে লাইটটারের গ্যাস সাইডটা বন্ধ করে ব্যাটারি লাইট জ্বালালো। জ্বালিয়ে সেটা মেহনূরের পেছনে চৌকির উপর রেখে দিলো। মেহনূরের কান্নার সুযোগ নিয়ে ওর দুগালে নিজের দুহাত রাখলো তরুণ। মেহনূর ওই মূহুর্তে আবারও ওকে বৃথা চেষ্টায় ধাক্কা দিয়ে ওকে সরাতে চাইলো কিন্তু তরুণের থাবার মতো হাতের জন্য পারলো না। তরুণ বিভিন্নভাবে কান্না থামানোর জন্য তোষামোদ করতে লাগলো ওকে,

– কাদঁছো কেন মেহনূর? আমি তো তোমার ভাইয়া হই সোনা । ভাইয়া ধরলে কিচ্ছু হয়না। তুমি না লক্ষ্মী মেয়ে? কান্না বন্ধ করোতো, লোকে শুনলে খুব খারাপ বলবে। চুপ করো সোনা, আমি তোমাকে কতো আদর করি, কতো ভালো মেয়ে তুমি। ভালো মেয়েরা কাঁদে না মেহনূর।

তরুণ নানাভাবে বোঝাতে লাগলো, চুপ করানোর জন্য নানা কথা শোনালো। কিন্তু মেহনূর এদিকে থামলো না। কান্নার জন্য নাক লাল হয়ে র-ক্ত জবার মতো রঙ ধারণ করেছে, ঠোঁটদুটোও ক্রমশ লাল হয়ে উঠেছে ওর। থরথর করে কাপঁছেও ওষ্ঠজোড়া। তরুণ ওর মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ ওর ঠোঁটদুটোর প্রতি উন্মাদ হয়ে উঠলো। ভয়ঙ্করভাবে ছুইঁয়ে দেওয়ার জন্য গাল ধরে এগুতে লাগলো। কিন্তু মেহনূর এবার পাগলের মতো ছুটাছুটি করতে লাগলো ছাড় পাওয়ার জন্য, প্রচণ্ড অস্থিরতায় নাশ হয়ে তরুণকে ধাক্কা মেযে জানালার দিকে ছুটে গেলো। এদিকে তরুণ নাকে ব্যথা পেয়ে মাটিতে পরে গিয়েছিলো, নাকের নিচে ঠোঁটের উপর হাত দিতেই রক্তের উপস্থিতি টের পেলো। মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলো মেহনূর জানালায় বসে দু-পা উঠিয়ে জানালার বাইরে ফেলার চেষ্টা করছিলো। তরুণ যেই চেচিঁয়ে ওকে ডাক দিয়ে উঠবে তখনই মেহনূর জানালার মাধ্যমে বাইরে বেরিয়ে গেলো।তরুণ তাড়াতাড়ি নাকে রুমাল চেপে সেই জানালা টপকে বেরুলো। কিন্তু মেহনূরকে আর নাগালে পেলো না ও। রাগে-ক্ষোভে সুরাইয়াকে ইচ্ছেমতো গালিগালাজ করতে লাগলো। নিজের এই রূপ ঢাকার জন্য দ্রুত বাড়ির বাইরে বাজারে চলে গেলো তরুণ।

মেহনূর তীব্ররূপে হাপাঁতে-হাপাঁতে শেষমেশ কাশতে শুরু করেছে। হাটুঁতে হাত রেখে মাটির দিকে নুয়ে আছে। মুখ হা করে নিশ্বাস নিতেই হঠাৎ ভক করে বমির ঢেকুর উঠলো। অন্যদিকে কলপাড়ে হাত-মুখ ধুতে এসেছিলো মাহতিম। কিন্তু দূর থেকে মেহনূরের ওমন কাহিল অবস্থা দেখে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। মেহনূর লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে ঠান্ডা করার প্রক্রিয়ায় ছিলো, কিন্তু বারবার হাপানি রোগীর মতো শ্বাসটান উঠলে মাহতিম আর সেই দৃশ্য দেখার জন্য দাড়িয়ে থাকলোনা। দ্রুত বড়-বড় পা ফেলে এগিয়ে গেলো মেহনূরের দিকে। কাছে গিয়ে ওর উদ্দেশ্যে কিছু জিজ্ঞেস করবে তখনই মেহনূর মাথা নুয়ে ভকভক বমি করে দিলো। মাহতিম ওর অবস্থা আশ্চর্য হয়ে গেলো। নাক-মুখ লাল হয়ে শরীর যেনো কনকন শীতের মতো কাঁপছে ওর। মাহতিম প্রশ্ন করতে গিয়েও শেষমেশ গিলে খেলো কথাটা। মেহনূরের জন্য পানি এনে চটপট মুখে পানি দিতে বললো। মেহনূর মুখ ধুয়ে কুলি করতেই চোখ শান্ত মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে, প্রচণ্ড অসাড়-ক্লান্ত-বিষণ্ণ লাগছে। মাহতিম ওর অবস্থা দেখে কোমল কন্ঠে বললো,

– তোমার কি হয়েছে? হঠাৎ এখানে এসে বমি করলো কেন? জ্বর এসেছে?

মেহনূর ধীরে-ধীরে মাথা তুলে মাহতিমের দিকে ঝাপসা দৃষ্টি রাখলো। মাথাটা ভোঁ ভোঁ করে চরকীর মতো ঘুরপাক খাচ্ছিলো। শরীর গুলিয়ে প্রচণ্ড খারাপ লাগছিলো। একটুও কথা বলার শক্তি পাচ্ছিলোনা, আজ ইচ্ছে করছে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে, এই অসভ্য লোকটাকে সবিস্তারে সব খুলে বলতে, কিন্তু শরীরের সায় যেনো একটুও পেলোনা মেহনূর। আধো-আধো চাহনিতে পলক ঝাপটাতে লাগলো ও। মেহনূরের ওমন অপ্রতিভ অবস্থা দেখে মাহতিম একটু এগিয়ে আসলো। কিন্তু অবাকের বিষয় হলো মেহনূর একদম ভয় পেলোনা, একপা-ও পিছিয়ে গেলো না, ওকে দেখে থরথর করে কাপঁলোনা। কেমন নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো মাহতিমের দিকে। মাহতিম আরেকটু এগিয়ে ওর মুখের পানে শান্ত দৃষ্টি ফেলে তাকালো। মেহনূর এবারও ওর এগুনো দেখে চমকে উঠলোনা। দানবীয় দেহের সুউচ্চ লম্বার মানুষটা আসলেই খুব লম্বা। তার সামনে দাড়ালে নিজেকে একদম এইটুকুনি লাগে। ওই প্রশস্ত বুকটার দিকে তাকালে মনেহয় আস্তো একটা রাজ্য যেনো গোগ্রাসে রাখতে পারবে। মাহতিম ওই ভঙ্গিতেই ওর উদ্দেশ্যে শান্ত সুরে বললো,

– খারাপ লাগছে? কোলে তুলবো?

মেহনূর এ প্রশ্নের জবাবে ‘ হ্যাঁ ‘, ‘ না ‘ কিছুই বললো না। চোখের পাতা হিংস্রভাবে বন্ধ হয়ে আসছে ওর। চিন্তার চাকাও যেনো কাজ করছেনা। মাহতিম ওর নিরুত্তর অবস্থা দেখে নেভি ব্লু শার্টের স্লিভদুটো কনুইয়ে তুলে ফেললো। ওর ঘাড়ের নিচে হাত ঢুকিয়ে দুহাটুঁর নিচে হাত রেখে কোলে তুলে নিলো। মেহনূর চোখ বন্ধ করে সমস্ত ভর মাহতিমের বাহুর উপর ছেড়ে দিলো। বন্ধ চোখজোড়ার দিকে একপলক তাকালো মাহতিম। প্রচণ্ড উৎকন্ঠায় ওর বুকের ভেতরটা যেনো ধসে এলো। সাথে-সাথে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিজেকে শক্ত করলো সে, মেহনূরের মুখের দিকে একদম যাবেনা। পথিমধ্যে তৌফের সাথে দেখা পেলে তৌফ আশ্চর্যে চক্ষুতারা বিরাট বড় করে তাকিয়ে রইলো। মাহতিম ওকে সংক্ষিপ্ত ঘটনা বলতেই রাস্তা ক্লিন কিনা সেটা দেখতে বললো। তৌফ সবকিছু চেক করে মাহতিমকে নিশ্চিন্তে যেতে বললো। মাহতিম সোজা আঙিনা পেরিয়ে সিড়ি ধরে মেহনূরের রুমে গিয়ে থামলো। ওকে বিছানায় শুইয়ে দরজাটা ভেতর থেকে খিল তুলে আটঁকালো। পুনরায় ফিরে এসে মেহনূরের কাছে এসে বসলো সে। মেহনূর ততক্ষণে যেনো গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গিয়েছে। ওর ম্লান মুখটার দিকে তাকালো মাহতিম। একটু এগিয়ে গেলো ওর মুখের দিকে, চিকন-চিকন আঙ্গুলগুলো ধরার জন্য আবারও মন ব্যকুল হয়ে উঠেছে। নিজেকে কঠোরভাবে সংযত করে ওর মাথায় হাত রাখলো মাহতিম। ধীরে-ধীরে কপাল থেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো ওর। মেহনূরের মুখের দিকে তাকিয়ে অন্যমনষ্ক ভঙ্গিতে বললো,

– তোমার শরীরে তো জ্বর নেই। কিন্তু বমিটা করলে কেনো? তোমার অবস্থা দেখে মনেহচ্ছে কেউ তোমাকে গলা টিপে ধরেছিলো।

মাহতিমের কন্ঠ শুনেই হোক বা অন্য কোনো কারনে, মেহনূর কিছুক্ষণ পর ঘোরের মধ্যে অনবরত বলতে লাগলো,

– বমি পাচ্ছে, বমি করবো। বমি পাচ্ছে,

মাহতিম ওর কথা অস্থির কন্ঠে বললো,

– বমি করবে? তুমিতো হুঁশে নেই। তুমি চোখ খুলো তো, তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?

মেহনূরের গালে আলতো থাপ্পড় দিয়ে চেতনা ফিরানোর চেষ্টা করছে মাহতিম। মেহনূর এতে চোখটা পযর্ন্ত খুললোনা! একপর্যায়ে মেহনূর আবার বিড়বিড় করে উঠলে মাহতিম ওর গালে মৃদ্যু থাপ্পর দেয়া বন্ধ করলো। ওর ডান গালে গাঢ় করে হাত রেখে মাহতিম ওর মুখের উপর ঝুকঁলো। মেহনূর ঘোরের মধ্যেই বলে উঠলো,

– তরুণ ভাইয়া গায়ে হাত দিও না। বমি পাচ্ছে। আম্মা, বমি পাচ্ছে। আমার বমি পাচ্ছে।

– চলবে

#FABIYAH_MOMO

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_১৩.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

অচেতন মেহনূরের মুখ থেকে এমন ভয়াবহ শব্দ শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো মাহতিম!নিজের কানদুটো পযর্ন্ত ঝিঁঝি করে বাজছে। কি শুনলো সে? মেহনূরের গায়ে তরুণ হাত দিয়েছে? আচ্ছা নামটা কি সে ঠিক শুনেছে নাকি ভুলভাল শুনলো? এমন একটা পরিস্থিতি হলো মাহতিম তখন স্বাভাবিক চিন্তা-চেতনাও যেনো গুলিয়ে ফেললো। বারবার কল্পনায় ভাবতে লাগলো তরুণ ওকে বাজেভাবে স্পর্শ করছে, মেহনূর তাতে ছটফট করছে, ছাড় পাওয়ার জন্য ছুটাছুটি করছে, তরুণ আরো হিংস্র হয়ে ছোঁয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে, এদিকে মেহনূর চেচাঁমেচিও শুরু করে দিয়েছে —! এরপর আর ভাবতে পারলো না মাহতিম! তড়াক করে ওর পাশ থেকে উঠে দাড়াঁলো। শরীরের ভেতর রক্তের স্রোত টগবগ-টগবগ করে ফুটছে এখন। এখুনি যেনো আগ্নেয়গিরির লাভা উদগিরণ হবে। মেহনূরের রুম থেকে রাগান্বিত মেজাজে বেরিয়ে গেলো সে। সিড়ি ধরে হনহন করে নামতেই ঘুমঘুম চোখে কলপাড়ের জন্য বাইরে যাচ্ছিলো নীতি। মাহতিমের ওমন ক্রুদ্ধভঙ্গির মেজাজ দেখে চোখ কচলানো থমকে গেলো। চকিত দৃষ্টি ছুঁড়ে মাহতিমের দিকে ছুটে গেলো ও। মাহতিম তখন নীতির পাশ কাটিয়ে দ্রুতবেগে সিড়ি ধরে নিজের রুমের জন্য যেতে লাগলো। পেছন থেকে ওর হাব-ভাব দেখে শঙ্কিত মুখে ছুট লাগালো নীতি। পিছন-পিছন দৌড়ে যেতেই প্রশ্ন করতে লাগলো ওকে,

– মাহতিম ভাই! ভাই, দাড়াও! ভাইয়া কি হয়েছে? ভাইয়া আস্তে চলো!এভাবে দৌড়াচ্ছে কেনো? জবাব দাও!

নীতির প্রশ্নমালা চলতে থাকলো ঠিকই,রাগে ভষ্ম হওয়া মাহতিম সেটার একটা উত্তর দিলো না। রুমে ঢুকে কাঠের আলমারি খুলে এমন একটা বস্তু বের করলো সেটা দেখে নীতি একদম বিস্ফোরণ চাহনিতে চিল্লিয়ে উঠলো,

– খবরদার ভাইয়া, এটা বের করো না! আমরা এখন শহরে নেই, এটা গ্রাম! এখানে এসব জিনিস বের করো না ভাইয়া। কি হয়েছে, আমাকে বল। আমি সব হ্যান্ডেল করছি ভাইয়া, ফর গড সেক তুমি ঠান্ডা হও। ভাইয়া ঠান্ডা হও। আমি আছিতো, নীতি সব ঠিক করবে। তুমি আমাকে খুলে বলো।

নীতির অস্থির চাউর দেখে মাহতিম কঠোর দৃষ্টিতে একপলক তাকালো। একেবারে ওর চোখে-চোখ রেখে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

– তোকে যদি কেউ মলেস্ট করার চেষ্টা করে ওই সময় আমার কি করা উচিত? এই মূহুর্তে কোনো পাল্টা প্রশ্ন করবিনা! একদম কাট-কাট আন্সার দিবি। ইন্সটেন্ট উত্তর দে এখন!

মাহতিমের কথা শুনে মুখের বুলি হারিয়ে ফেললো নীতি। মাহতিম তখনও রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে। নীতি কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ধীর কন্ঠে প্রত্যেকটা শব্দ থেমে-থেমে বললো,

– তুমিতো তাকে মে-রেই ফেলবে।

কাঙ্ক্ষিত এবং যোগ্য জবাব পেয়ে তৎক্ষণাৎ নিজের কঠোর দৃষ্টি নীতির উপর থেকে সরিয়ে ফেললো মাহতিম। হাতে থাকা চকচকে সিলভার রঙের ভারী বস্তুটা দ্রুতগতিতে টিশার্ট উঠিয়ে পেটের বাঁ-পাশে প্যান্টের সাথে গুঁজে রাখলো। আবার দৃষ্টি তুলে নীতির স্তম্ভিত মুখের পানে কাঠিন্য সুরে বললো,

– তুই সামনে দেখে মুখটা খারাপ করলাম না, কিন্তু তরুণের বাচ্চাকে আমি ছাড়বো না! ওই শালার ইতরামি যদি না ছুটিয়েছি দেখিস! ওর কারেন্ট এক্কেবারে নিভিয়ে দেবো। ওর আসল জায়গায় যদি মেইন কাজ না সারছি, আমি ওর —

মুখ থেকে বাজে কথা ছিটকে আসার পূর্বেই তড়িঘড়ি করে থামিয়ে দিলো নীতি। মাহতিমের একদম সামনে দাড়িয়ে ভীত অবস্থায় নিজেকে শান্ত করে জোর খাটিয়ে বললো,

– আমরা কিন্তু শহরে না ভাইয়া। তোমার এই ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হবে, তুমি কিন্তু এই মূহুর্তে কোনোপ্রকার সিনক্রিয়েট করতে পারবেনা। আমরা এখন জমিদার বাড়িতে আছি। এই বাড়ির নাম-ধাম যদি একটু এদিক-ওদিক হয়, তাহলে কেমন ভয়াবহ অবস্থা হবে একবার ভেবে দেখো। তুমি আপাতত ঠান্ডা হও, জাস্ট রিল্যাক্স! আমি জানি তুমি এইসব নষ্টালজিক ব্যাপারগুলো নিতে পারো না। কিন্তু ভাইয়া কে মলেষ্ট হয়েছে? কার জন্য তুমি তরুণের উপর তেড়ে যাচ্ছিলে? তরুণ কি করেছে?

একটু আগের ঘটনাগুলো আবার মনে পরলো মাহতিমের। ওমনেই রাগের চোটে টেবিলের পায়ে জোরে একটা লাত্থি মারলো! সেই লাত্থির কারণে কাঁচের গ্লাসটা খাড়া থেকে কাত হয়ে নিচে গড়াতে যাচ্ছিলো। নীতি তাড়াতাড়ি টেবিলের কাছে সেই গ্লাসটা ধরে সোজা করে রাখলো। রাগে নিশ্বাসের গতি বেড়ে গেছে মাহতিমের। কয়েক পা পিছিয়ে ধড়াম করে বিছানায় বসে পরলো সে। মুখটা দুহাতের তালুতে ঢেকে রাগ সংবরণের চেষ্টায় আছে। তরুণকে যদি এই মূহুর্তে সামনে পায় ওর শরীরের চামড়া উঠিয়ে তেজ মিটিয়ে দিবে! গলায় দড়ি বেঁধে চামড়া খসিয়ে জিপের পেছনে ছুটাবে! ওর জন্য যখন উত্তপ্ত মস্তিষ্কে উপর্যুক্ত শাস্তির চিন্তা করছিলো, তখনই চিন্তার জালে ছেদন করে নীতি বলে উঠলো,

– ভাইয়া তরুণ কার সাথে বাজে কাজ করেছে? কাকে মলেস্ট করে —

প্রশ্নটা সম্পূর্ণ করতে পারলো না নীতি, পথিমধ্যে মাহতিমের তেজালো কন্ঠ এসে থামিয়ে দিলো ওকে। সেই তেজালো কন্ঠেই চিবিয়ে-চিবিয়ে বললো,

– মলেস্ট করেনি! শালা শয়তানটা সুযোগে কোপ মেরেছে। মেহনূরকে মেবি একা পেয়েছে, ওমনেই শয়তানের জিহবা টসটস করে উঠেছে। কুত্তার মতো পেটাতে পারতাম! মারতে পারতাম হারামজাদাকে! উফ, এই মূহুর্তে কি উচিত? তাড়াতাড়ি বল কি করা উচিত?

প্রচণ্ড উত্তেজনায় টগবগ করে উঠলো মাহতিম। রাগের চূড়ান্ত অবস্থা ওর চোখে-মুখে পরিদৃষ্ট। এই মূহুর্তে সত্যিই নিজেকে সামলাতে পারছেনা ও! কোনোভাবে তরুণকে একবার হাতের মুঠোয় এনে কেঁচে ফেলবে একদম! নীতি পরিস্থিতি ওমন গরম দেখে দ্রুত মাহতিমের উদ্দেশ্যে অস্থির ভঙ্গিতে বললো,

– ভাইয়া? ভাইয়া দেখো, আগে নিজেকে কন্ট্রোল করো। বেশি উত্তেজিত হয়ো না, এইসময় বাড়িতে কেউ না থাকলেও ওই বজ্জাত শেফালী কিন্তু ঠিকই ঘাপটি মেরে আছে। যদি উঁচুনিচু কিছু ঘটিয়ে ফেলো সম্পূর্ণ দায়ভার মেহনূরের উপর এসে পরবে। এসব ঘটনায় কিন্তু মেয়েরা বেশি ভিক্টিম হয়। তাই সাবধান করে দিচ্ছি ভাইয়া, নিজেকে ঠান্ডা করো।

মাহতিম ওর কথার মাঝে দাড়ি বসিয়ে আদেশসূচকে বললো,

– তুই ওর রুমে যা এক্ষুনি, ওর অবস্থা কেমন সেটা দ্যাখ। আমি যা করার নিজের মতো করেই করবো। শয়তান তো জানেনা এই মাহতিম কি জিনিস। ওর মতো দশটা কুত্তাকে পায়ের নিচে মাড়াতে আমার টাইম লাগবেনা!

নীতি টান-টান পরিস্থিতির ভেতর শুষ্ক গলায় ঢোক গিললো। গলাটা স্বল্প ভিজিয়ে সম্মতির সুরে মাথা দুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। মেহনূরের রুমের দিকে আসতেই সৌভিকের কানে কথাটা দিয়ে গেলো। সৌভিক প্রথমে রাগে ক্ষেপে উঠলে পরক্ষণে মাহতিমের চিন্তায় সবকিছু গুলিয়ে ফেলে। তাড়াতাড়ি তৌফ ও সিয়ামের কানে কথাটা পেড়ে ফেলে। ওরা দুজনও বাকরুদ্ধ অবস্থায় দুমিনিট হা করে তাকিয়ে থাকে। এরপর মাহতিমের রুমের দিকে একসঙ্গে তিনজন ছুট লাগায়। নীতি মেহনূরের রুমে ঢুকার আগে বুদ্ধি করে প্রীতি ও ফারিনকে সবকিছু বলে দেয়। এদিকে শানাজ দরজা চাপিয়ে ঘুমাচ্ছে দেখে ওকে আর ডাকে না। সুরাইয়া এখন কোথায় আছে সেটা কেউ জানেনা। নীতি, প্রীতি, ফারিন একসাথে তিনজন মেহনূরের রুমে আসলো। বিছানায় চোখ বন্ধ করা অবস্থায় মেহনূর চেতনাশূন্য হয়ে আছে। তিনজন সেই দৃশ্য দেখে নিজেদের মুখের পানে কিছুক্ষণ চাওয়া-চাওয়ি করে। চোখের ইশারায় কিছু সায় বুঝিয়ে বিছানার কাছে চলে আসে। নীতি ওর মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে বসে। প্রীতি রুমে গিয়ে নিজেদের লাগেজ থেকে গ্লুকোজের বয়াম খুলে একটা ফ্লাক্সভর্তি গ্লুকোজের পানি নিয়ে আসে। ফারিন একটা গামছা নিয়ে সেটা ভিজিয়ে এনে মেহনূরের হাত ও পায়ের তালু মুছে দেয়। প্রীতি চামচে করে গ্লুকোজের পানি ধরলে নীতি ওর ঠোঁট ভেদ করে সেটা খাইয়ে দেয়। প্রীতি ফ্লাক্সের ছোট কাপ থেকে চামচ দিয়ে গ্লুকোজ নিতেই ক্ষুদ্ধ স্বরে বলে,

– এই বাড়ির মানুষগুলো খুবই আজব আপু। মা এদিকে মেয়ের খেয়াল রাখেনা, দাদা বাড়ির গোপন খবর জানেনা, শেফালীর আকাম কারোর চোখে দেখেনা। আবার আজকে দেখো, তরুণের মতো খবিশও সাহস পেয়ে গদগদে হয়ে ওর গায়ে হাত দিয়েছে। আচ্ছা সব ঘটনা মেহনূরের সাথেই কেনো ঘটে আপু? কি এইটার রিজন?

নীতি ব্যস্ত ভঙ্গিতে একনজর প্রীতির দিকে তাকালো। খাওয়ানোর জন্য মেহনূরের ঠোঁটে চামচ কাত করতেই শান্ত স্বরে বললো,

– মেয়েটার দিকে ঠিকমতো তাকিয়ে দ্যাখ, তাহলেই আসল ঘটনা বুঝবি।

নীতির এমন কথায় আগা-মাথা কিছুই বুঝলো না প্রীতি। তবুও বড়বোনের কথায় মান্য করে মেহনূরের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো। মেহনূরের দিকে নিবিড় চাহনিতে তাকিয়ে থাকলে পাশ থেকে ফারিন বলে উঠে,

– মেয়েটা যে একটু বেশিই সুন্দর এটা তুমি দেখো না? একটা মেয়ে যে ওর সৌন্দর্য্য দেখে হিংসা করতে পারে এটুকু বুঝো না? ওর বোনগুলোর মধ্যে সুরাইয়া এক নাম্বার ফাজিল। ওই মেয়েকে দেখলে জুতিয়ে মারতে ইচ্ছে করে।

ফারিনের কথা শেষ হতেই প্রীতি তীক্ষ্মদৃষ্টি ফেলে ভাবুক চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে,

– আচ্ছা ফ্রক পরিয়ে দিলে কি সত্যিই ওকে বাচ্চা লাগবে? মাহতিম ভাই কি তখন কন্ট্রোল অপশনে থাকতে পারবে? আমার কিন্তু মেয়েটার ফেস মারাত্মক লাগে।

প্রীতি কথাটুকুর ইতি টানবে ওই মূহুর্তেই চট করে ফারিন বলে উঠে,

– সবাই যে এই সময়টায় ঘুমায় এটারই সুযোগ নিয়েছে। তরুণ তো দেখি ডেন্ঞ্জারাস টাইপের চালাক! ওর চালাকি কি কেউ ধরতে পারলো না?

নীতি এবার মুখ খুলে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

– মুখে যদি নকল চেহারা পরে থাকে তাহলে ভালো মানুষরা অবশ্যই ঢপ খাবে। শেফালী মামী ছাড়া সবাই কিন্তু ভালো মনের মানুষ। সবাই যথেষ্ট সহজ-সরল। অন্য দশটা গ্রামের মহিলার মতো উনাদের মনে অতো ঘুরপ্যাঁচ নেই। কিন্তু যা কাহিনী ঘটানোর এই জমিদার বাড়িতে শুধু শেফালী মামীই করে। আর নিজের মেয়েটাকেও খারাপভাবে এক্সপার্ট বানিয়েছে। দেখলি না? কিভাবে মাহতিম ভাইয়ের কাছে চিঠি গুঁজে দিয়েছে। এগুলাকে থাপড়ানো উচিত। হান্নান নানা যদিও সহজ মনের মানুষ কিন্তু আমার মনেহয় তিনি অবশ্যই সবকিছু টের পাচ্ছেন, অথচ মুখে কিছু স্বীকার করছেনা। বাড়ির মধ্যে যদি কলহ সৃষ্টি হয় সেটা কিন্তু বাইরের গ্রামবাসীরা ভালো নজরে দেখবেনা।

নীতির যুক্তিপূর্ণ কথা শুনে দুজন চুপ করে থাকলো। কিছুক্ষণের মধ্যে মেহনূর চোখ খুলে সম্বি ফিরে পেলে স্বাভাবিক অবস্থায় একটু-একটু করে চেতন ফিরে এলো ওর। তবুও দুদফা বমি করলো আবারও। শানাজ ততক্ষণে ঘুম থেকে উঠে গেলে প্রথম কয়েক মিনিট মূর্খের মতো তাকিয়ে রইলো শানাজ। তারপর ধীরে-ধীরে যখন সম্পূর্ণ ঘটনা জানতে পারলো সে মূহুর্তে আর স্বাভাবিক রূপে থাকলোনা ও। গর্জে উঠেই হোক বা গালির চোটে, তরুণের গুষ্ঠি তখন শানাজ একদম চোটপোট করে দিচ্ছে। সাবা এই ঘটনা জানার পর ভয়ে কেমন গুটিয়ে গেলো। কিন্তু সুরাইয়া তখনও লাপাত্তার নজিরে রইলো। শেফালী ঘুম থেকে মাগরিবের আযানের সময় উঠলেন। আঙিনায় এসে যখন সুনশান নিরবতা দেখলেন, সেই সঙ্গে যখন বাড়ির ভেতর ওমন সন্ধ্যার অন্ধকারে বাতিহীন অবস্থা ছিলো, তখন শুধূ মেহনূরের রুমেই আলো জ্বালানো হয়েছিলো। আবার সেখান থেকেই অনেকগুলো স্বরের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিলো। শেফালী মাথায় ঘোমটা টেনে মোটা শরীরটা নিয়ে সিড়ি ধরে মেহনূরের রুমের দিকে এগুতে লাগলো। ক্রমেই যখন পা এগিয়ে রুমের এসে দাড়ালো, তখন সাদা পর্দা সরাতেই রুমভর্তি সকলকে যেনো একত্রে দেখতে পেলো। শেফালীকে আচমকা দরজার সমুখে দেখে পিনপতন নিরবতায় চুপ গেলো সবাই। মেহনূরকে বিছানার মাথার সাইডে পিঠ লাগিয়ে বসতে দেখা যাচ্ছিলো। চুলগুলোও কেউ সুন্দর করে ফ্রেন্ঞ্চ বেণী করে দিয়েছে ওর। মাথার সবগুলো চুল পেছনে টেনে মোটা একটা বেণী ঝুলছে। কপালের কাছে মাথার শুরু-প্রান্তে ছোট-ছোট চুলগুলো ছেয়ে আছে। মলিন-উদাস-বিষণ্ণতায় ঢেকে থাকা উজ্জ্বল-লাবণ্য-সুন্দর মুখটা একটু যেনো তর্জমা করে দিয়েছে কেউ। সবই শেফালী খুটিয়ে খুটিয়ে দরজার দ্বারপ্রান্তে দাড়িয়ে পরোখ করছিলো। শেফালীকে ওমনভাবে তাকাতে দেখে সাবির সৌভিকের দিকে সুক্ষ্ম ইশারা করলো। সেই ইশারার ইঙ্গিত ধরে সৌভিক তৎক্ষণাৎ হাসি দিয়ে বললো,

– মেজো মামীর আগমন কি করে হলো? আসেন মামী। আসেন দু’কাপ চা খেয়ে গল্প করি।

শেফালী ওর কথা শুনে সৌজন্যতার খাতিরে হাসি দিলো। তাও হাসিটা কুশ্রী লাগলো। মনে-মনে নাক ছিটকালো সৌভিকরা, কিন্তু মুখের ভাবে সেটা একটুও প্রকাশ করো না। শেফালীর দিকে নমনীয় কন্ঠে শান্ত ভঙ্গিতে বললো শানাজ,

– মেজো মা, আপনার কি কিছু দরকার?

শেফালী এবার নিরবতার সুতো কেটে বললেন,

– ঘরে যে বাত্তি জ্বালাইতে হয় এইটা কি মনে থাকেনা? ঘরদোর তো আন্ধার হই গেছে। এট্টু পর আব্বা আসি দেখলে গজগজ করবে।

সিয়াম একচুলও শেফালীকে সহ্য করতে পারছেনা। ঝাড়ু এনে যদি ঝাটের মতো বিদায় করা যেতো তাহলে সিয়াম দেদারসে সেটাই করতো। কিন্তু ভদ্রতার খাটিরে সেটা করতে পারছেনা। সৌভিক মনে-মনে ভয় পাচ্ছে যদি হুট করে মাহতিম এ ঘরে ঢুকে, না-জানি এই মহিলা বিবিসির দশটার খবর রটাতে থাকে। মাহতিম এখন না আসলেই চলে। এদিকে মেহনূর চুপচাপ নতমুখে বসে থাকলে পাশ থেকে ওর হাতটা শানাজ মুঠোয় চেপে ধরে। একটুখানি দৃষ্টি তুলে আড়চোখে শানাজের দিকে তাকাতেই দেখলো শানাজ শেফালীর দিকে তাকিয়ে আছে। শেফালী সকলের দৃষ্টিতে যখন অস্বস্তিতে ফাসঁলো, তখন বাধ্য হয়ে নামাজের উছিলায় নিচে চলে গেলো। সবাই হাঁফ ছেড়ে বাচঁলেও মেহনূর মনের ক্যানভাসে যেই বিভীষিকা ঘটনার চিত্র এঁকে ফেলেছিলো, সেটা মুছে বড় দুঃসাধ্য ওর জন্য। কিন্তু ফারিনের কথায় চিন্তাচেতনা থেকে সৎবিৎ ফিরে পেতেই ফারিনের মুখ থেকে শুনলো, তরুণ নাকি এখনো বাড়িতে আসেনি। ও যদি বাড়িতে ফিরে তাহলে কোনদিক থেকে যে হিংস্র হামলা ঝাঁপিয়ে পরবে সেটা ওরা জানেনা। মাহতিম নাকি নিজের রুমের ভেতর কাউকে ঢুকতে দিচ্ছেনা। দরজা যদিও আটকানো না, কিন্তু ওর বিধিনিষেধ অমান্য করা কারোর পক্ষেই সম্ভব না। সবই চুপচাপ শুনছিলো মেহনূর, সবাই চা-নাস্তার খাবারগুলোতে মুখিয়ে থাকলে মেহনূর একটা কিছুও মুখে তুললো না। শানাজ অনেকক্ষণ পর নিজের চাপা উদ্বেগ প্রকাশ করে ফেললো। তীব্র উৎকন্ঠায় জর্জরিত হয়ে বললো, এই ঘটনার কথা বড়দের মধ্যে কাউকে জানাতে না। শানাজের মা অর্থাৎ সুজলা জানলে আর কখনোই ওদের স্কুল-কলেজ যেতে দিবেনা। পথেঘাটে মানুষ ছি ছি করবে এসব ঘটনা সুজলৃর নিশ্চয়ই পছন্দ বেনা। হান্নান শেখও বাড়ির বাইরে পা ফেলতে দিবেনা। মেহনূরের মা যদিও সাদাসিধে মহিলা, কিন্তু এসব ঘটনা শুনলে তিনিও ঠান্ডা মেজাজে থাকবেননা। সবাই একমনে শানাজের কথা শুনলো কিন্তু পথে-পথে নীতি, সৌভিক, ফারিন, সামিক দফায়-দফায় বাধা দিয়ে প্রতিবাদী হওয়ার জন্য রুখতে বললো। কিন্তু শানাজ সেসব কথা মানতে নারাজ। এটা মূলত শহর নয়, এটা একটা গ্রাম। এ গ্রামে একবার দূর্নাম রটে যায়, আর সেটা যদি বাড়ির ভেতর থেকেই ঘটে তাহলে মান-সম্মান সব ধূলিসাৎ হতে একসেকেন্ড লাগবেনা। জমজমাট আলোচনা দীর্ঘসময় নিয়ে শেষ করলো শানাজ। প্রতিটি পয়েন্ট সুন্দর এবং যুক্তি দিয়েই বুঝালো। সঙ্গে এটাও বুঝালো মাহতিমকে থামতে। ও যেনো তরুণের গমনে কোনো গণ্ডগোল না করে। তরুণকে বিদায় করার জন্য চোরা পথ অবলম্বন করা লাগবে। ওর মতো ধুরন্ধর ব্যক্তকে সোজা করার জন্য ধূর্ত পরিকল্পনা প্রয়োজন। এদিকে মাহতিম তরুণকে পেটানোর জন্য, মারার জন্য যেভাবে গর্জে উঠেছে সেটা এই মূহুর্তেই থামানো অত্যাবশ্যক। কেউ কোনো পথই বের করতে পারলো না, কারোর কোনো বুদ্ধিও এখানে থামানোর কাজে আসলোনা। ঘন্টা আধা পেরিয়ে গেলে সবাই নিরুপায় হয়ে নিরুদ্যম ভঙ্গিতে বসে থাকলো। কিন্তু বুদ্ধির আসল এবং মোক্ষম সূত্রটা কেবল তৌফের মাথায় আসলো। তৌফ সবাইকে মারাত্মক ভাবে চমকে দিয়ে বললো,

– শুনো এ্যাটেনশন, আমি যা বলি, যেভাবে বলি, সবই প্লিজ মনযোগ দিয়ে শুনবে। আমার মাথায় একটা সলিড-প্রুফ টিকলি এসেছে। এটা যদি খাটাতে পারি, আমার কলিজা-গুরদা সব বলছে, মাহতিম আনসারী মাস্টবি-ডেফিনটলি-সিরিয়াসলি কুপোকাত হবে!

তৌফের এমন প্যাঁচমুখো কথা শোনে সিয়াম ওর পিঠে জোরে একটা কিল বসালো। ব্যথার জন্য তৌফ ফরফর করে সবার সামনে অশ্রাব্য গালি দিলো। শেষে লজ্জায় নিজেকে আড়াল করতে যেয়ে মূল কথায় ফিরলো।

– আমাদের কাছে চাবি আছে, জাস্ট তালার কাছে গিয়ে চাবিটা একটু মোচড় মারা লাগবে। ব্যস, এতেই আমাদের অসাধ্য সাধন হয়ে যাবে শিওর।

তৌফ কথাটা এমন ভঙ্গিতে বললো সবাই ওর ভ্রুঁ নাচানো দৃষ্টি ধরে আসল ব্যক্তির দিকে তাকালো। একমূহুর্ত ওভাবেই নিরবতা কাটলো, কিন্তু পরক্ষণেই সমস্বরে ‘ সলিড আইডিয়া ‘ বলে জোরে হুল্লোড় তুললে, মেহনূর তখন তীব্র শব্দের জন্য বাধ্য হয়ে দুকানে হাত চাপা দিয়ে চোখ কুচঁকে ফেললো। কয়েক ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যে মেহনূর চোখ খুলে দেখলো সবাই ওর দিকে হাসি-হাসি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মেহনূর বোকা-বোকা চাহনিতে ডানে-বামে সবার দিকে দৃষ্টি দিয়ে কান থেকে স্লো-মোশনে হাত নামিয়ে ফেলছে। উজবুকের মতো তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ মৃদ্যু স্বরে থেমে-থেমে বলে,

– আ-মার দি-দিকে তাকিয়ে আ-ছো কেনো?

মেহনূর আটকতে যাওয়া কথা শুনে সবাই নিজেদের মধ্যে চাওয়া-চাওয়ি করলো। পরক্ষণে তৌফ ঢোক গিলে বললো,

– তুমি যদি ভাইয়ের কাছে একবার যেয়ে থামতে বলো, তাহলে ভাই কোনো হাঙ্গামা করবেনা। তুমিতো বুঝতেই পারছো আমি কি বলতে চাইছি?

মেহনূর আবারও কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,

– আপপনাদের কথা না শুনে ওই লোক আমার কথা শুনবে?

মেহনূরের বোকার মতো কথা শুনে সবাই মিটিমিটি হাসলো। কিন্তু এখনই কিছু ভেঙ্গে না বলে নিজ থেকে বুঝার জন্য সুযোগ রেখে দিলো। তৌফ সবার তরফ থেকে উত্তর প্রস্তুত করে বললো,

– মানে, ঘটনা হয়েছে কি, তুমিতো এখানে ভিক্টিম। এ্যাটলিস্ট তুমি যদি ভিক্টিম হয়ে আনসারী মশাইকে থুক্কু মাহতিম ভাইকে এখনই কিছু করতে না বলো, তাহলে তোমাদের জন্যই ভালো হবে। নাহলে ভাইসাব যে কাহিনী করতে পারে, সেই কাহিনী যদি এই গ্রামের মধ্যে ঘটে যায়, তাহলে পরদিন যুগান্তর পত্রিকায় এটা হেড শিরোনাম দেখতে পারবা। মাহতিম ভাইজান তো ভালো মানুষ না, এটা তো আমরা নেংটাকাল থেকেই জানি। এজন্য তোমাকে সাবধান করতেছি জলদি ভাইকে থামাও। বাড়ির সবার ফিরতে কিন্তু বেশি টাইম নেই। আমরা এদিকে শেফালী মামীকে টেক্কা মারতেছি। যাও, যাও উঠো। আর বসে থেকো না। তোমার শরীরে এখন আমাদের চেয়েও বেশি পাওয়ার। এই নীতি ছাগলের বাচ্চায় তোমাকে এক লিটার গ্লুকোজ খাইয়ে দিছে। এখন উঠো, শাড়ি ধরো, আর ভাইয়ের রুম দৌড় লাগাও।

মেহনূর আবারও সবার দিকে উজবুকের মতো তাকালো। এখন ওই তরুণের জন্য মাহতিমের রুমে যাওয়া লাগবে? তাও কিনা একা-একা যেতে হবে? কি বলবে মাহতিমকে? কিভাবে গুছিয়ে বলবে এসব কথা? যতবার মাহতিমের সামনে স্বাভাবিক চেতনা নিয়ে হাজির হয়েছে, ততবারই চেতনার নাম-নিশানা পাল্টে দিয়ে অস্থির অবস্থায় কাঠ-কাঠ হয়ে গিয়েছে মেহনূর। এবার এই ভয়াবহ অস্থিরতার জন্য দেহ থেকে প্রাণ বের হয়ে যায় কিনা, কে জানে?

– ‘ চলবে ‘

#FABIYAH_MOMO