#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_১৬.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
মাহতিম আর চেঁচাতে পারলো না, ওমনেই ওর মুখ কেউ চেপে ধরলো! আবছা অন্ধকারে চোখের সামনে যাকে দেখতে পেলো, তাকে দেখে চরম বিষ্ময়ে তাকিয়ে রইলো। কয়েক সেকেন্ড কোনো শব্দ হলো না, পিনপতন নিরবতায় সবকিছু শান্ত হয়ে থাকলো। মাহতিম যখন চুপ মে-রে গেলো, তখন ওর মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিলো মেহনূর। ওর ডানহাতটা যেভাবে কাছে টেনেছিলো তেমনিভাবে টেনে চোখের সামনে এনে দেখতে লাগলো। মাহতিম এখনো বিশ্বাস করতে পারছেনা, মেহনূর ওর রুমে এসেছে! ওর হাত টেনে পর্যবেক্ষণ করছে! যেই চিন্তাটা কখনো স্বপ্নেও ভাবা যায় না, যেই মেয়ে ওকে দেখতেই পারেনা, সেই মানুষটা নাকি ওর রুমে এসেছে। মেহনূর চুপচাপ হাতটা দেখে সঙ্গে করে যে স্টিলের ছোট বাটি এনেছিলো, সেটা টেবিল থেকে নিয়ে নিলো। গাঢ় কিছু তরল জাতীয় পানি সেই ছোট বাটিটায় ছিলো। মেহনূর আচঁলের খুট থেকে রুমাল বের করে সেটা ওই গাঢ় লেপনে চুবিয়ে নিলো। সামান্য নিংড়ে নিয়ে রুমালটা ওর হাতের উপর আলতো করে বুলাতে লাগলো। মাহতিমের ইচ্ছে করছে নিজের গালে একটা চড় মারতে, মানে আসলেই কি মেহনূর ওর কাছে এসেছে? নাকি রাতদুপুরে বেহুদা মার্কা স্বপ্ন দেখছে? এটা যদি স্বপ্ন হয়েই থাকে তাহলে হাতের তো পরিচর্যা করতে আসবেনা, লুকোচুরি করে দেখা দিয়ে চুপচাপ পালিয়ে যাবে। মাহতিম একদৃষ্টিতে মেহনূরের দিকে তাকিয়েছিলো, মেহনূর সেটা আড়চোখে বুঝতে পেরে হালকা একটু কেশে উঠলো। সেই কাশিতে মাহতিম যখন সম্বি ফিরে পেলো তখন চট করে অন্যদিকে দৃষ্টি সরিয়ে ফেললো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত কন্ঠে বললো,
– তুমি আমার রুমে কি জন্য এসেছো? শুধুমাত্র হাত দেখার জন্য এলে? এই রাতের বেলা একটা অবিবাহিত পিচ্চি মেয়ে আমার মতো ব্যাচেলার ছেলের রুমে শুধু হাত দেখতে এসেছে?
উদ্ভট ধরনের প্রশ্ন শুনে মাহতিমের দিকে একপলক তাকালো মেহনূর। এরপর দৃষ্টি ফিরিয়ে আবারও কাজে মনোযোগ দিলো। এদিকে উত্তরের জন্য মাহতিম তাগাদা দিয়ে বললো,
– কি হলো? তোমাকে প্রশ্ন করেছি না? জবাব দিচ্ছো না কেনো? কেনো হাত দেখার জন্য এই রুমে এসেছো?
দ্বিতীয়বার তাগাদা খেয়ে হাত থামালো মেহনূর। মাহতিমের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে নিচু কন্ঠে বললো,
– ছ্যাঙ্গা কিটটার জন্য আপনার হাতটা অনেকখানি ফুলে গেছে। যেহেতু আমার জন্যে আপনার এই দশা, তাই আমি বাধ্য হয়েছি এখানে আসতে।
উত্তরটা শুনে মনে-মনে অকারণে হাসলো মাহতিম। ঠোঁটে একপ্রস্থ হাসি ঝুলিয়ে বাঁহাতটা উলটো করে মাথার নিচে ঢুকিয়ে শুলো। মেহনূরের দিকে তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি দিয়ে বললো,
– তোমার জন্য তো শুধু হাতে সমস্যা না, আরো নানা জায়গায় সমস্যা হয়েছে। কত জায়গায় যে খারাপ অবস্থা হয়ে গেছে, সেটা তো বলা যায় না। তো, তুমি কি সেগুলোর জন্য কিউর সিস্টেমের দায়ভার নিবে?
কথাটা ফাজলামি নাকি সত্যি, সেটা বুঝতে পারলো না মেহনূর। অবুঝের মতো তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললো,
– আপনি কি বলতে চাইছেন একটু বুঝিয়ে বলবেন? আমি আপনার কথা বুঝিনি।
কথাটা শুনে চাপা ভঙ্গিতে হেসে দিলো মাহতিম। মাথাটা ধীরগতিতে ডানেবামে দুলিয়ে ‘ কিছু না ‘ বুঝালো। ইশারাটুকু বুঝে মেহনূর চুপচাপ ওর হাতে চুনের পানি ঘষে দিতে লাগলো। ছ্যাঙ্গা জাতীয় কিট বা শুয়োপোকার জন্য হাতের তালু ফুলে লাল হয়ে আছে। এজন্যই লোকটা খেতে আসেনি। মেহনূর বুঝতেই পারছেনা লোকটা কিভাবে এই জ্বালা-যন্ত্রনা মুখ বুজে সহ্য করছে। কয়েক বছর আগে এই কিটের জন্য ওর পা আক্রান্ত হয়েছিলো সেদিন চিৎকার করে বাড়িঘর উঠিয়ে ফেলেছিলো মেহনূর, অথচ এই অসভ্য লোকটা সামান্য আর্তনাদও করলো না। মেহনূরের দিকে সেইযে সামান্য শিউরে উঠলো, এর চেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখালোনা। মাহতিম মিটিমিটি হাসিতে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে আছে। মাথার মাঝখানে ওই চকচকে চিকন সিঁথিটা ওকে সম্মোহন করছে, চুলগুলো বাঁদিকে এনে সামনে ছেড়ে রেখেছে মেহনূর, লম্বা চুলগুলো স্তুপাকারে কোলের উপর জমিয়ে রেখেছে। নরম হাতদুটো দিয়ে মাহতিমের হাতটা খুব সাবধানে ছুঁয়ে চলছে। মাহতিম ক্ষণিকের জন্য চোখ বন্ধ করলো, খুবই অল্প সময়ের জন্য চোখের পাতা বুজে নিলো। একটু আগে ঠোঁটের উপর যার হাত ছিলো, সেটা ভাবতেই এখন আশ্চর্য লাগছে। বিশ্বাস করা যায় না, মেহনূর কিনা ওর রুমে এসেছে। মাহতিমের চোখ বন্ধ করা দেখে মেহনূর এই ফাঁকে ওর মুখের দিকে তাকালো। শান্ত মুখটা কেমন নির্মল-নিষ্পাপ-নিখুঁত লাগছিলো। কতটুকু নিখুঁত হলে একটা মানুষের মুখ এতোটা ঘোরাবেশ লাগতে পারে। মেহনূর তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি নামিয়ে ফেললো, শেষ টাচটা সম্পন্ন করে দ্রুত যাওয়ার জন্য চিন্তা করছিলো। কিন্তু তখনই মাহতিম চোখ বন্ধ অবস্থায় নম্র কন্ঠে বললো,
– তোমার এই শান্ত, চুপচাপ স্বভাবটা আমার ভালো লাগে।
এইটুকু কথার মধ্যে কি ছিলো মেহনূর জানেনা, কিন্তু শোনার পরপরই ওর গা কেমন কাটা দিয়ে উঠলো, হাত থামিয়ে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে মাহতিমের দিকে তাকালো। মনেহচ্ছে একটু আগের চাহনিটা মাহতিম দেখে ফেলেছে। মাহতিম খুবই শান্ত ভঙ্গিতে চোখ খুলে ওর দিকে তাকালো, মাথার নিচ থেকে হাত সরিয়ে সোজা হয়ে বসলো। মেহনূরের দিকে পুনরায় দৃষ্টি ফেলে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
– নোট :- তোমার স্বভাবের প্রশংসা করেছি, ব্যক্তিগত পছন্দের কথা বলিনি। তুমি এখন যেতে পারো। আমার হাত নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবেনা। তোমার গিল্টি ফিল করার কোনো কারণ নেই। রুমে যেয়ে শুয়ে পরো। গুড নাইট।
সোজা হয়ে যেভাবে বসেছিলো, কম্বল টেনে চুপচাপ উপুড় হয়ে শুয়ে পরলো মাহতিম। ডানহাতটা মাথার কাছে বালিশের উপর রেখে দিলো। চোখ বন্ধ করে পিঠ পর্যন্ত কম্বল টেনে নিলো। মেহনূর বিমূঢ় অবস্থায় বসে থাকলেও শেষে স্টিলের বাটিটা তুলে বিছানা থেকে উঠে দাড়ালো। মাথা নিচু করে দুহাতে ধরা স্টিলের বাটিটার দিকে তাকিয়ে চলে যেতে থাকলো। দরজার বাইরে পা রাখবে, ওমনেই পেছন থেকে মাহতিম বলে উঠলো,
– পাঁচটা দিন সহ্য করো, এরপর আজীবনের জন্য চলে যাচ্ছি। আমার মতো অসভ্য মানুষ তোমাদের বাড়ির চৌকাঠায় পা ফেলবেনা। সার্ভিসের জন্য ধন্যবাদ।
কথাটা শুনে পা থামিয়ে ফেললেও মাথাটা পিছনে ঘুরালো মেহনূর। ক্ষীণ দৃষ্টিতে মাহতিমের দিকে তাকিয়ে থেকে কেমন করুণ ভঙ্গিতে নিশ্বাস ছাড়লো। মেহনূর মাথা ঘুরিয়ে দরজা খুলে বাইরে চলে গেলো। মাহতিম যদি একবার দরজার দিকে তাকাতো, তাহলে মেহনূরের মলিন হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে আজও বাঁকা হাসি দিতো।
.
ঘুম থেকে খুব সকাল-সকাল উঠলো মাহতিম। গায়ে টিশার্ট জড়িয়ে হাই তুলতে-তুলতে রুমের বাইরে পা রাখলো। বারান্দা পেরুতেই সৌভিকের রুম থেকে ডাক পরলো। আরেকবার হাই তুলে সৌভিকের রুমের দিকে তাকাতেই সেখানে যাওয়ার জন্য পা চালালো। সৌভিক তখন ফ্লোরে বসে লাগেজ খুলে শার্ট বের করছিলো। মাহতিম ওর পাশ কাটিয়ে এলোমেলো বিছানায় যেয়ে বসলো। সৌভিক একনজর দৃষ্টি মাহতিমের দিকে তাকালো, এরপর লাগেজের চেইন লাগাতেই সরল সুরে বললো,
– ছুটিটা কোনোভাবে বাড়ানো যায় না?
মাহতিম ছুটির প্রসঙ্গ শুনে কিছুটা কৌতুহলবোধ করলো। সৌভিকের দিকে বিষ্ময় সূচক দৃষ্টি দিয়ে প্রশ্ন গলায় বললো,
– ছুটি বাড়িয়ে কি হবে? চৌদ্দদিন যে দিয়েছে এটাই তো লাক।
সৌভিক এবার পূর্ণদৃষ্টিতে মাহতিমের দিকে তাকালো। লাগেজ ছেড়ে উঠে এসে বিছানায় গিয়ে বসলো। হালকা একটু কেশে প্রস্তুত গলায় বললো,
– তুই সবার কাছে মিথ্যা বললেও আমার কাছে কিছু লুকাসনি দোস্ত। তুই অন্তত আমার কাছে সত্যিটা বল, তুই কি সত্যিই এখান থেকে শূন্য হাতে ফিরতে চাস?
মাহতিম ওর কথার প্যাঁচটা বুঝতে পারলেও চুপ করে রইলো। এই প্রসঙ্গে কথা বলতে একটুও ভালো লাগছেনা ওর। সৌভিক ওর মূঢ় অবস্থা দেখে আবার প্রশ্ন করে বসলো,
– মাহতিম প্লিজ, এতোদিন ধোকায় রেখেও কি শান্তি পাসনি? তুই কি আমার কাছে কথাটা শেয়ার করবি? আর কতো টালবাহানা করবি দোস্ত? এদিকে তো সময় নেই।
মাহতিম এবার সৌভিকের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে হালকা গলায় বললো,
– কোনো এ্যাঙ্গেলেই যায় না।
এ কথাটুকু শুনে তৎক্ষণাৎ ভ্রুঁদ্বয় কুঁচকে এলো সৌভিকের। দারুণ বিষ্ময় নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললো,
– তুই কেনো এ কথা ভাবছিস? ওর পাশে নিজেকে রেখে কখনো দেখেছিস? দোস্ত তুই আউট সেক্টরটা ভেবে চিন্তা করছিস কেন?মাহতিম আমার দিকে তাকা! তুই ওর সাইড থেকে নেগেটিভ কিছু পেয়েছিস? পাসনি রাইট? প্লিজ ছুটি বাড়া দোস্ত, এ্যাটলিষ্ট এক সপ্তাহ আরো গ্রান্টেড কর।
মাহতিম মৃদ্যু গলায় বললো,
– সম্ভব না। ওর জন্য আমার মনে কিছুই নেই। শুধু-শুধু ওর মতো মেয়ের জন্য নিজের দায়িত্বের সাথে হেলাফেলা করার মানে হয়না।
সৌভিকও চট করে বলে উঠলো,
– তাহলে কাল রাতে ধাক্কা মেরে বের করে দিলি না কেন? কেনো বললি না ‘ বেরিয়ে যাও ‘? অন্য সময় তো ঠিকই ধমকানি দিয়ে তাড়িয়ে দেস, তাহলে কাল কি হয়েছিলো?
সৌভিকের উত্তেজিত অবস্থা দেখে মাহতিম নিজেকে সংযত করে বললো,
– কাল রাতেও তোরা ছ্যাঁচড়ামি করেছিস?
সৌভিক সে কথার সূত্র ধরে গমগম গলায় বললো,
– আমার কথা কাটবি না মাহতিম! আমি এক নাম্বার সারতে নিচে যাচ্ছিলাম, তখনই ওকে রুমে ঢুকতে দেখছি। তুই আমাকে এটা বল, ওর প্রতি যদি ফিলিং নাই থাকে, বারবার হেল্প করতে যাস ক্যান?
– এমনেই যাই। মানুষের হেল্প কি করা উচিত না?
– খুঁজে খুঁজে কি দুনিয়ার মধ্যে ওকেই নজরে পরে? আচ্ছা শানাজ যে সেদিন বালতি হাতে তোর চোখের সামনে দিয়ে গেলো, তখন হেল্প করলি না কেনো?
– শানাজকে হেল্পের জন্য অবশ্যই জিজ্ঞেস করেছিলাম। ওর হেল্পের দরকার হয়নি, তাই না করে দিয়েছে। এতে চিল্লানোর কি হলো?
– তুই তো মেহনূরের বেলায় কোনো ফর্মালিটিস করিস না, ওর ব্যাপার আসলেই ‘ মাই প্রোপার্টি ‘ ভেবে কাজ করে দিস। তাহলে ওর বেলাতেই চেন্ঞ্জ কেন? শেফালী মামীর জন্য তুই সুরাইয়াকেও টাইট দিয়েছিস, তরুণকেও যে রাতের বেলা পিটিয়ে বাড়ি থেকে বের করেছিস সবই আমরা জানি। তোর আচরণ, তোর কথাবার্তা, তোর পার্সোনালিটি সবই ওর প্রতি এডিক্টেড মাহতিম। তুই যতোই আমাদের সামনে অস্বীকার করে চলতে থাক, লাভ নেই। শুধু একটা কথাই মাথায় রাখবি, আমাদের অগোচরে মেহনূরের ব্যাপারে যা যা তথ্য কালেক্ট করেছিস, সেগুলোও সাবির এসে আমাদের কানে জানিয়ে গেছে। তুই যখনই কারো ব্যাপারে ইন্ট্রেস্টেড হোস, তখনই ওর ব্যাকগ্রাউন্ড হাতাপিতা করে ফেলিস। এবারও বাদ রাখিসনি। আমরা মুখে ঘাস দিয়ে চলিনা মাহতিম, তোর সব রুলস রেগুলেশন আমরা জানি। তুই শুধু একবার মুখে বল, তুই ওকে পছন্দ করিস। আমরা আর কিছুই বলবো না।
মাহতিম বিছানা থেকে উঠতেই তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
– যদি বলি তোরা যা ভাবছিস সব মিথ্যা, তখন কি করবি?
সৌভিক গরম মেজাজে কিছু বলবে ওমনেই নিজেকে সামলে নিয়ে চুপ করে রইলো। মাহতিম ওর অবস্থা দেখে আলতো একটা হাসি দিয়ে বললো,
– আমার ব্যাপারটা আমাকেই হ্যান্ডেল করতে দে বন্ধু। নেশা সবসময় ধীরেসুস্থেই করতে হয়। নাহলে মনেও নেশা লাগেনা, দেহেও নেশা ভর করেনা।
সৌভিক শুধু আহাম্মকের মতো তাকিয়ে রইলো। মাহতিম এমন একটা জবাব দিয়ে চুপ করিয়ে দিবে, ভাবতেও পারেনি সৌভিক। ভেবেছিলো আজই মাহতিমের পেট থেকে খুচিয়ে-খুচিয়ে সব সত্য শুনে ফেলবে, কিন্তু সেটার পরিবর্তে মাহতিম এমন পাল্টা এ্যাকশন দেখাবে, কে জানতো?
মাহমুদা ও সুজলা কলপাড়ে বসে বড় একটা বোলের ভেতর শাঁকপাতা ধুচ্ছিলো। সিলভারের বোলটার ভেতর সুন্দর করে পাতা ধুতেই হঠাৎ কে যেনো পিছে এসে দাঁড়ালো। দুজনেই মনের কৌতুহল ঘুচাতে ধোয়া বাদ দিয়ে পিছন ফিরে তাকালো। তাকাতেই সাথে-সাথে মাহমুদা মাথায় ঘোমটা টেনে নিলো, অপরদিকে সুজলা হাসিমুখে বললো,
– মাহতিম বাবা, বাইরে থেকে আসলে নাঈই? কিছু কি দরকার?
গাঢ় বেগুনি রঙের শার্ট পড়েছে মাহতিম। উত্তরটা শুনে দুহাতের স্লিভ তুলতে লাগলো। সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে কলপাড়ের অন্য সাইড দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। চাপকলের হ্যান্ডেল ধরে জোরে চাপ দিতেই বললো,
– জ্বী মামী, নানার সাথে একটু বাইরে গিয়েছিলাম। আমার আপাতত কিছু দরকার নেই। কিন্তু আপনাদের সাথে একটু জরুরী কথা বলার ছিলো।
মাহতিম চাপকলের পানিতে হাতের কনুই পযর্ন্ত ধুচ্ছিলো। এদিকে সুজলা ও মাহমুদা নিজের মনেই ভাবতে লাগলেন মাহতিম কি নিয়ে এখন কথা বলবে। মাহতিম হাতদুটো ঝেড়ে কলপাড় থেকে বেরিয়ে আসলো। বাইরে দাড়িয়ে রুমাল দিয়ে হাত মুছতেই শান্ত কন্ঠে বললো,
– আপনারা সাংসারিক কাজে খুবই ব্যস্ত থাকেন এটা আমি বুঝে গেছি। কিন্তু নিজেদের মেয়ের প্রতি এতোটা উদাসীন হলে চলেনা মামী। আশাকরি আপনারা আমার কথাটা বুঝতে পেরেছেন। আপনাদের পিঠ-পেছনে যে কীর্তিকাণ্ড রচনা করা হয়, সেগুলো একটু চোখ-কান রেখে দেখবেন। আমি চর্তুদিকেই লক্ষ করেছি, সবই আমি নিজ চোখে, নিজ গুণে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি। কিন্তু সবশেষে এটাই বুঝেছি, আপনারা দুজনই শেফালী মামীর হাতের নাটাই। উনি আপনাদের ভালোই কন্ট্রোল করে বেড়ায়। সুরাইয়া বাদে বাকি তিনজনের কপালে কি কি শনি যায় সেগুলো একটু পরোখ করে দেখবেন। বিশেষ করে ছোটজনের দিকে একটু চোখটা লাগিয়ে রাখবেন। যাইহোক মামী, শাঁকটায় একটু মরিচ বেশি দিয়েন, আমি আবার ঝাল ছাড়া শাঁক খেতে পারিনা।
অনেকগুলো কথা বলে মাহতিম বাড়ির দিকে চলে গেলো। সুজলা ও মাহমুদা কিছুক্ষণ স্থির নয়নে তাকিয়ে থাকলেন। এতোগুলো কথা, এতোগুলো চাপা সত্য, এতোগুলো অজানা তথ্য দুদিনের এই মাহতিম এসে বুঝিয়ে গেলো? সুজলা চোখ ফিরিয়ে মাহমুদার দিকে তাকালেন, মাহমুদাও দৃষ্টি তুলে সুজলার দিকে প্রশ্নসূচকে তাকালেন। দুজন একসঙ্গে ঢোক গিলে আবারও কাজে মনোযোগ দিলেন। কিন্তু পূর্বের মতো স্বস্তির নিশ্বাসে কাজ করতে পারলেন না। মাথার মধ্যে চিন্তার ঘূর্ণিপাকে শুধু একটাই কথা বাজছিলো, ‘ সুরাইয়া বাদে বাকি তিনজনের কপালে কি কি শনি যায় সেগুলো একটু পরোখ করে দেখবেন ‘। মাহমুদা একদম মিইয়ে যাওয়া ভঙ্গিতে চুপ হয়ে গেলে সুজলা ওনার দিকে তাকিয়ে বললেন,
– মাহমুদা, ওই ফকিন্নি বুঝি আর শুধরাবে না।
মাহমুদা কিছু বললেন না। কিন্তু মুখ নিচু মনে-মনে ঠিকই বললেন,
– ওই মহিলা আমার মেয়েটারে শান্তি দিলো না।
.
সারাদিনের মধ্যেও মাহতিমের দেখা পায়নি মেহনূর। কালরাতে যখন পাঁচদিন পরে চলে যাওয়ার কথাটা বললো, কেনো জানি খারাপ লাগছিলো ওর। দুপুরের খাবার শেষ করে দাদাভাইয়ের সাথে দেখা করতে নামলো। আজ হান্নান শেখ কাজ থেকে ফুরসত পেয়েছেন বলে নিজের রুমে নাকি বিশ্রাম নিচ্ছেন। মেহনূর হড়বড় করে বিছানা থেকে নেমে আয়নার সামনে দাড়ালো। এলোমেলো চুলগুলো পেঁচাতে-পেঁচাতে একটা খোপা করে নিলো। হালকা নীলের শাড়িটা ঠিকঠাক করে নিলো। শাড়িটা নীল হলেও পাড়টা সাদা ওর। মেহনূর রুম থেকে বেরিয়ে সোজা দাদাভাইয়ের রুমের দিকে চললো। মাহতিম অপজিট দিকের বারান্দায় দাড়িয়ে কফি খাচ্ছিলো, আঙিনার দিকে দৃষ্টি দিয়ে ভাইবোনদের ক্যারম খেলা দেখছিলো। মেহনূর যখন সিড়ি ধরে নিচে নামছিলো তখন বিপরীত দিকে বারান্দার দিকে একটুও নজর পরেনি। কিন্তু দূর থেকে মাহতিমের শান্ত চাহনি হঠাৎ মেহনূরের দিকে পরলো। বারান্দার রেলিংয়ে ডানহাত রেখে বাঁহাতে কফি খাচ্ছে মাহতিম, চোখের সম্পূর্ণ দৃষ্টি তখন মেহনূরের দিকে স্থির হয়ে আছে। হালকা নীল রঙের শাড়ি পরেছে দেখে বেশ বিরক্ত বোধ করলো। এই মেয়েটা এমন সাদামাটা ধরনের শাড়ি পরে কেনো? বাকি বোনগুলো তো ঠিকই রঙবেঙরের শাড়ি পরে সেজেগুজে বেড়ায়, আর এই গাধা কিনা সাদামাটা হয়ে ঘুরে। মেহনূর আঙিনা পেরিয়ে হান্নান শেখের রুমে ঢুকলো। হান্নান শেখ ইজিচেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে ছিলেন। মেহনূর পেছন থেকে মৃদ্যু সুরে বলে উঠলো,
– দাদাভাই ঘুমিয়েছেন?
হান্নান শেখ তড়িঘড়ি করে চোখ মেলে পিছনে তাকালেন। প্রিয় নাতনীকে অনেকদিন পর সামনে পেয়ে প্রাণখোলা হাসি দিলেন। মেহনূর সেই হাসি দেখেই পা এগিয়ে দাদাভাইয়ের পাশে বিছানায় উঠে বসলো। দাদাভাইয়ের দিকে সহাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– দাদাভাই, রমিজ চাচা বই দিয়ে যাচ্ছে না কেনো? আমারতো সবগুলো বই পড়া শেষ। এখন আমার সময় কাটানোর জন্য বই লাগবে। তুমি কি একটু চাচাকে খবর পাঠাবে?
হান্নান শেখ আবারও মিষ্টি করে হাসলেন। হাতের ইশারায় কাছে ডেকে বললেন,
– দাদু কি শরৎচন্দ্রের বইগুলোও পড়ে ফেলেছো?
মেহনূর ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে মাথা নাড়িয়ে বললো,
– সব পড়া শেষ।
হান্নান শেখ যেমন সাহিত্য প্রিয় মানুষ, তেমনি অনুভূতিপ্রবণ ব্যক্তি। তার মধ্যে সহজ-সরল অভিব্যক্তি বোঝানোর ক্ষমতাটা মারাত্মক সুন্দর। অতি যে যথেষ্ট রসিক প্রিয় মানুষ এ কথা পুরো গ্রাম জানে। কিন্তু কাজৃর বেলায় সাংঘাতিক কঠোর হয়ে যান তিনি। হান্নান শেখ নাতনীর জন্য মজা করার ছলে বললেন,
– দাদু, নভেলের মতোই নাতজামাই আনি? দেখতে একদম হিরের টুকরো হবে, আচরণ হবে মাশাআল্লাহ চমৎকার। কি বলো দাদু? খোঁজ লাগাবো?
কথাটা বলেই হান্নান শেখ ফোকলা দাঁতে হাসতে লাগলেন। মেহনূর প্রথমে কপট রাগ দেখালেও শেষে বিছানা থেকে উঠে দাদার গলাটা পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। দাদার সাদা চকচকে অল্পখানি চুলের মাঝে থুতনি বসিয়ে দিলো। একহাতে গলাটা জড়িয়ে অন্যহাতে পরম স্নেহে হান্নান শেখের দাড়ি বুলাতে লাগলো। নম্র কন্ঠে বললো,
– তুমি আমাকে যেখানে তুলে দিবে আমি সেখানেই যেতে ইচ্ছুক রাজি দাদুভাই। তোমার কথার উপর আমার কোনো অমত নেই। আমিতো জানিই, তুমি আমাকে এখনই বিদায় দিবেনা। তুমি আমাকে আরো বহুদিন নিজের কাছে রেখে দিবে। এখন শুধু শুধধু আমার সাথে মস্কারা করছো।
হান্নান শেখ নিবেদিত হাসিতে রুমময় ছড়িয়ে দিলেন। বাইরে থেকে হান্নান শেখের নরম হাসির কলোরব শুনে ক্যারোম খেলা সহসা থেমে গেলো সবার। সবাই হান্নান শেগ।খের দরজার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পরক্ষণে নিজেদের মধ্যে চাওয়া-চাইয়ি করে বলে,
– কিরে নানার হাসি না? নানাভাই হাসছে?
ফারিনও অবাক কন্ঠে বিষ্ময় দৃষ্টিতে বলে,
– নানাকে এতোদিন এমন ভাবে হাসতে দেখিনি। উনি কি একটু বেশি খুশী?
সবার মধ্যে যখন আলোচনার ঝড় উঠলো, তখন মাহতিম বারান্দা থেকে পানির বোতল কাত করে সবগুলার মাথায় পানি ঢালতে লাগলো। মাথায় পানি পরশ পেয়ে সবগুলো হুড়মুড়িয়ে তুখোড় গালি দিতে থাকলো। তৌফ সাথে-সাথে পানি ঝাড়তেই বললো,
– ওই শালা! ইউরিন পরতাছে, ইউরিন পরতাছে ! সর সৌভিক সর, ওই আমিতো ভিইজা যাইতাছি। সর ভাই!
সিয়াম এদিকে হুলস্থুল গোলক বাঁধিয়ে বললো,
– ওরে বা*! উপ্রেরতে কোন্ ঝর্ণার পানি পরে!
সিয়ামের কথা শেষ হতেই সবাই একসঙ্গে উপরের দিকে তাকালো। ওমনেই দেখলো মাহতিম সম্পূর্ণ বোতল উপুড় করে সেটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে খেলছে। সৌভিক-সহ সবাই যখন ভ্রুঁ কুচঁকে কিছু বলতে যাবে, ঠিক ওইসময় সিয়াম সবার মুখে তালা ঝুলিয়ে সবার আগে বললো,
– কিরে ভাই? এগ্লা কি? কলিজায় তো পানি আছিলো না। আমিতো ভাবছি মাহদী আবার ইতরামি কইরা মূত্রপানি ছাড়ছে। শা-লা, তুই আর মানুষ হইলিনা। যা তোরে অভিশাপ দিলাম, বাড়ির মধ্যে বাসর করতে পারবিনা! ভাবীর চুমু খাইতে পারতি না! বিয়ের দিন শান্তি পাইতি না!
সিয়ামের কথায় হো-হো করে হেসে দিলো মাহতিম। রেলিংয়ের দিকে পিঠ ঠেকিয়ে মারাত্মক হাসিতে ফেটে পরলো। হাসতে-হাসতে আবার রেলিংয়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে খালি বোতলটা ছুড়ে মারার ভঙ্গি করলে সিয়াম ভয় পেয়ে এক দৌড়ে নীতির পেছনে লুকালো। নীতির কানে ফিসফিস করে বললো,
– দেখছোস অবস্থা? শা-লারে এমন ভয়ানক অভিশাপ দিলাম তাও শা-লার ভয় লাগেনা। হারামজাদার পিনিক উঠছে নাকি? এমনে হাসে ক্যা?
নীতিও তখন এমন অবস্থা দেখে খিলখিল করে হাসছিলো। সিয়ামের দিকে মুখ ঘুরিয়ে হাস্যরত অবস্থায় বললো,
– মাহতিম ভাই ভালো করেই জানে, শকুনের দোয়ায় গরু মরেনা। তুমি যেই টোটকা মেরেছো, এতে কোনো কাজ হবেনা সিয়াম ব্রো। এজন্যই মাহতিম ভাই হাসছে। চিল, চিল।
মাহতিমের হাসি দেখে সবাই পেট ফাটা হাসিতে মজে উঠলো। এদিকে হাসতে-হাসতে তৌফের ভয়ার্ত অবস্থাটা আবারও অভিনয় করে দেখালো। পুনরায় তৌফের সেই হাস্যকর অবস্থা মনে করে হাসির জোয়ার ফেটে পরলো। ফারিন-নীতি-প্রীতি তিনজনই হাসতে-হাসতে পেট চেপে বসে পরলো মেঝেতে। আর কোনো কথা হলো না হাসি ছাড়া সেখানে।
.
সন্ধ্যার আধার পরবে-পরবে অবস্থা এখন। পাখিগুলো ডানা মেলে ব্যস্ত ভঙ্গিতে নীড়ে ফিরছে। নাম-না-জানা পাখিগুলো নির্বিকার চিত্তে আকাশে উড়ছে। তেজী সূর্যটা তাপ হারিয়ে পশ্চিমে আকাশে হেলে পরেছে। দৃশ্যটা কি দারুণ! কি চমৎকার! কি অসাধারণ! মাহতিম সেটাই এতোক্ষন মুগ্ধ নজরে দেখছিলো। সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এবার নির্মল পানির স্বচ্ছ পুকুরের দিকে দৃষ্টি রাখলো। দুপুরের শার্টটা বদল করে এডিডাসের কালো টিশার্ট পরেছে মাহতিম। গাঢ় নেভি ব্লু রঙের প্যান্ট পরেছে সে। প্যান্টের দুপকেটে হাত গুঁজিয়ে পুকুরপাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে আর মাত্র চার দিন সময় আছে। একদম গুণে-গুণে চারদিন। সৌভিকরা সবাই পিকনিক স্পটের প্ল্যান করেছে, কিন্তু পিকনিক স্পটে গেলে সেখানে থাকার জন্য তিনদিন সময় চলে যাবে। বাকি থাকলো একদিন। মাহতিম এটা ভালো করেই বুঝেছে, ওর কাজিন এবং বন্ধুগুলা তলে-তলে কি পরিকল্পনা সেরেছে। কিন্তু যতোই পরিকল্পনা করুক, যাকে নিয়ে এতোসব কাহিনী রটনা চলছে সে কি আদৌ এসব বুঝতে পারে? যদি বুঝতে পারতো, তাহলে চোখের ভাষা বুঝতো। যদি টের পেতো, তাহলে যাওয়ার নাম শুনে অস্থির হতো, ছটফট করতো, না যাওয়ার জন্য বারণ করতো। স্বল্প পরিচয়, অল্প চেনা, তবুও মন কেনো ছাড়তে চাইছেনা?
হঠাৎ চিন্তার জালে ছেদন করে পেছন থেকে নরম সুর বাজলো। মাহতিম চেতন ফেরার মতো সম্বি পেয়ে পিছনে ফিরে তাকালো। সামনে যেই মানুষটা দাড়িয়ে আছে, তাকে দেখে একটুও প্রতিক্রিয়া দেখালো না। কাঠ-শক্তের মতো অটল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মাহতিম। ছোট্ট মেয়েটার ছোট পদক্ষেপ খুবই ধীরেসুস্থে মাহতিমের সামনে আসলো। সদাসর্বদার মতো চোখ নিচু মাথা নুইয়ে বললো,
– দাদাভাই আপনাকে ডেকেছে। আপনার সাথে জরুরী কি যেনো কথা আছে। আপনি একটু কথা বলে আসুন।
কোমল ঠোঁটদুটো যখন কথার ছলে দুলে উঠে তখন ভয়ংকর ভাবে হৃদয় মুচড়ে যায়, দৃষ্টি নামানো পল্লব যখন ভয় মাখানো চাহনি নিয়ে হুট করে তাকায়, সেই দৃষ্টির মাঝে মন যেনো আটকা থাকতে চায় তখন। উজ্জ্বলবর্ণের গাল-গলা, ছোট হাতটার উষ্ণ নরম তালু, নরম চিকন আঙ্গুল, সবকিছু ছুয়িঁয়ে দেয়ায জন্য মন কেমন অস্থির হয়ে উঠে। সকল অদৃশ্য বেড়িবাধ ভেঙ্গে তীব্র অধিকারবোধ খাটাতে ইচ্ছে করে। থুতনি উঁচিয়ে আরো ভয় দেখিয়ে ওই কম্পিত ঠোঁটের দিকে অনেকক্ষণ আবদ্ধ থাকতে মন চায়। কিন্তু দীর্ঘনিশ্বাসের মতোই হতাশার নিশ্বাস এসে ভর করে। দূরে ঠেলে দেয় কেশবতী বালিকার ছোট-ছোট আবদার থেকে, দৃষ্টি সরাতে বাধ্য করে অসমতার চিন্তা থেকে। মেহনূর নিজের কথাটুকু শেষ করলেও মনের ভেতর আরেকটি প্রশ্ন করার জন্য খচখচ করছে। প্রশ্নটা করবে-কি-করবেনা সেটা নিয়ে দ্বিধায় আছে। মাহতিম ওর কাঁচুমাচু অবস্থাটা দেখে সরল গলায় প্রশ্ন করলো,
– আরো কিছু বলার আছে?
পুরুষালী শক্ত-সম্মোহন কন্ঠটা কর্ণধারে দারুণভাবে ঠেকলো ওর। মেহনূর সেই সুরটা শুনে সঙ্গে-সঙ্গে চোখ বন্ধ করে ফেললো। আবার যখন চোখ খুললো, তখন বুকের ভেতর বিশাল সাহস জুগিয়ে মাথা নুয়ানো অবস্থায় বললো,
– আপনি কি চারদিন পরই চলে যাবেন?
কথাটা শুনে পলক নামানো থমকে গেলো মাহতিমের। এই মেয়ে কি সত্যি-সত্যিই ওর যাওয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছে? কেনো করছে? কাল যখন সুক্ষ্ম মেজাজ দেখিয়ে পাঁচদিনের কথাটা বলেছে তখন কি ওর মন খারাপ করেছে? নাকি অসভ্য আখ্যা পাওয়া বেহায়া পুরুষটা তাড়াতাড়ি বিদায় হোক, সেজন্য জিজ্ঞেস করছে? মাহতিম দ্বিতীয় কারণটা ভেবে আবারও চাপা রাগে রাগান্বিত হলো। মেহনূরের দিকে দুকদম এগিয়ে সম্পূর্ণ দূরত্ব ঘুচিয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। মেহনূর তৎক্ষণাৎ এমন কাণ্ডে দুহাত খিচ মে-রে শাড়ি খামচে ধরলো, বারবার শুস্ক গলায় ঢোক গিলতে লাগলো, বুকের ধুকধুকনি দ্রুতবেগে ধুক-ধুক করে চলতে থাকলো। এদিকে শক্ত-কঠোর মাহতিম রাগত স্বরে বললো,
– মেহনূর আফরিন, ধরো আমার জায়গায় তরুণ হলো, আর তরুণের জায়গায় আমি। তাহলে একটা জিনিস চিন্তা করো, তোমার আর আমার সাথে যতবার-যেভাবে সাক্ষাৎ হয়েছে, সেখানে আমি না-হয়ে যদি তরুণ হতো? ভাবো, ভাবো, ভাবতে থাকো। ভাবার সময়টা চারদিন দিলাম। চতুর্থ দিনে সুন্দর করে জবাবটা দিয়ে দিও। চলি।
– ‘ চলবে ‘
#FABIYAH_MOMO
#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_১৭.
#ফাবিয়াহ্_মমো.
মেহনূরের মাথায় জট পাকিয়ে আপনমনে চললো মাহতিম। মাথার মধ্যে একটাই চিন্তা, একটাই পরিকল্পনা, মেহনূরকে এবার কঠিনভাবে জব্দ করে ছাড়বে। মেহনূর পিটপিট করে তাকিয়ে রইলো, কিন্তু ওর মাথার মধ্যে কিছুই ঢুকলো না। মাহতিম আর পিছু তাকিয়ে দেখার ইচ্ছা পোষণ করলো না।সোজা পা চালিয়ে বাড়িতে ঢুকে হান্নান শেখের রুমে আসলো। রুমের ভেতর পা রাখতেই চরম আশ্চর্য হয়ে কপাল কুঁচকে ফেললো। ভেতরে সৌভিক-নীতিরা কেমন উৎসুক দৃষ্টিতে বসে আছে। হান্নান শেখের সাথে কি নিয়ে যেনো আলাপ করছে। মাহতিমকে ঢুকতে দেখেই হান্নান শেখ একপ্রস্থ হাসি দিলেন। ইশারায় কাছে ডেকে বাকিদের সাথে বসতে বললেন। মাহতিম ওদের ভাব-গতি দেখে কিছুই বুঝতে পারছিলোনা, চুপচাপ ধীরগতিতে পা চালিয়ে বেতের মোড়া টেনে বসলো। হান্নান শেখ মাহতিমের দিকে সরল দৃষ্টিতে তাকালেন। হালকা কেশে বললেন,
– নানু, তোমার ভাইবোন আর বন্ধুগুলো বাইরে ঘুরাঘুরি করতে চাচ্ছে বুঝলে? এখন তারা আমার কাছে অনুমতি হিসেবে আমার নাতনীগুলাকে সঙ্গে নিতে চাইছে। কিন্তু নানুভাই, আমি আমার নাতনীগুলোকে বাড়ির বাইরে কখনো দূরে পাঠাইনি। এখন তুমি বলো নানুভাই, আমার এই মূহুর্তে কি করা উচিত? তুমি তো ওদের চেয়ে বড়, ওদের চেয়ে ভালো বুঝো। ওদের দিকটার পাশাপাশি আমার দিকটাও একটু চিন্তাভাবনা করে বলো।
মাহতিম এতোক্ষনে পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। খাটাশ-খবিশ-বজ্জাতগুলা ইচ্ছে করে ঘুরার প্ল্যান বানিয়েছে। ওদের মূল টার্গেট যে কি, সেটা মাহতিম ভালো করে বুঝে গেছে। কিন্তু হান্নান শেখের কথাটা যখন খেয়াল করলো, তখন একটা জিনিস বুঝতে পারলো, এ বাড়ির মেয়েগুলো এখন পযর্ন্ত বাইরের পরিবেশ দেখেনি। সুন্দর-সুন্দর প্রাকৃতিক জায়গাগুলো ওদের দেখার সৌভাগ্য হয়নি। যদি এই উছিলায় ওরা চারবোন একটু ঘুরেও আসে, তাতে কোনো আপত্তি নেই। মাহতিম ওর ভাই এবং বন্ধুগুলোর চরিত্র জানে, ওরা কখনো দূর্ঘটনা ঘটানোর মতো ব্যক্তি না, তাই নিশ্চিন্তে হান্নান শেখের জন্য মাহতিম প্রস্তাব রাখলো,
– দেখুন নানা, আমি আসলে ঘুরাঘুরির ব্যাপারটা মাত্র জানতে পারলাম। ওরা আমাকে এ বিষয়ে আগে থেকে কিছুই জানায়নি। কিন্তু এখন যেহেতু সব পরিকল্পনা হয়েই গেছে, তাই একটাই অনুরোধ করবো শানাজরাও আমাদের সঙ্গে আসুক। আমি ওদের নিরাপত্তার জন্য সম্পূর্ণ দায়ভার নিচ্ছি। আমাদের সঙ্গে এলে ওদের কোনো ধরনের সমস্যা হবেনা এটুকু নিশ্চয়তা দিচ্ছি। এখন বাকিটা আপনার উপর ছেড়ে দিলাম, আপনি যে সিদ্ধান্ত নিবেন আমি সেটা মানতে বাধ্য হবো।
হান্নান শেখ প্রস্তাবটা শুনে কিছুক্ষণ মৌন অবস্থা পালন করলেন। সবকিছু চিন্তা ভাবনা করে শেষে মাহতিমের উদ্দেশ্যে বললেন,
– তোমরা কি দূরে কোথাও যাবে? নাকি কাছাকাছি এলাকা?
এবার মাহতিম উত্তরের জন্য সৌভিকদের দিকে তাকালো। সৌভিক মিনমিন কন্ঠে হাসি দিয়ে বললো,
– মানে একটু দূরে যেতে চাচ্ছিলাম আরকি। গুগলে দেখলাম গ্রামের বাইরে একটা সুন্দর রের্সোট আছে। রের্সোটাও মারাত্মক সুন্দর, নতুন সম্ভবত ওপেন করেছে। আমরা চাচ্ছি সবাই সেখানে তিনদিনের জন্য ট্যূর হিসেবে যাই। আমরাতো সাজেক, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ট্যূর দিয়েছি, তাই একটু গ্রামাঞ্চল জায়গায় ট্যূর দিতে চাচ্ছি।
হান্নান শেখ এ কথা শুনে আবারও নিরব হয়ে গেলেন। নাতনীদের কখনো ত্রিসীমানার বাইরে যেতে দেননি, অথচ আজ যাওয়ার জন্য অনুমতি চাচ্ছে। সুরাইয়ার মতো উড়নচণ্ডী মেয়েকে ওরা সামলাতে পারবে কিনা, এটা নিয়েও চিন্তা করা লাগছে। হান্নান শেখকে চিন্তিত দেখে মাহতিম নিরস্ত করার জন্য বললো,
– আপনি যদি সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যায় ভুগেন, তাহলে আপনার নাতনীদের ডেকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। ওরা যদি যেতে চায়, তাহলে আপনি কোনো আপত্তি করবেন না। আর যদি না চায়, তাহলে আর কথা বাড়াবো না।
হান্নান শেখ কথাটা শুনেই শানাজদের ডাকলেন। চারবোন যখন একত্রে হাজির হলো, তখন পুরো ঘটনা বলে তাদের মতামত জানতে চাইলেন। মেহনূর বাদে সবাই তখন একলাফে রাজি হয়ে গেলো। শুধু মেহনূর চুপ করে মাথা নিচু করে ছিলো। হান্নান শেখ আর কথা বাড়ালেন না, ওদের সাথে যাওয়ার জন্য অনুমতি দিয়ে দিলেন। হান্নান শেখ কোনো একটা কাজে রুমের বাইরে চলে গেলে সবাই হৈ-হুল্লোড় করে ফূর্তি সুরে চিল্লাতে থাকলো। সবাই যখন খুশীর আমোদে টইটুম্বুর, তখন মেহনূর শুধু আড়চোখে মাহতিমের দিকে তাকাচ্ছিলো। মাহতিম ওই সময় রের্সোট বুকের জন্য ওনারের নাম্বারে কথা বলছিলো। চারদিনের সময় ধরিয়ে লোকটা কেমন ঢপ মারলো? ইচ্ছে করে মেহনূরকে জ্বালানোর জন্যই ঘুরার প্ল্যান বানালো। এদিকে মনে-মনে সুরাইয়া এতো খুশি যে, ও আর দেরি না করে কাপড় গুছাতে চলে গেলো। মাহতিম রিজার্ভেশান নিয়ে আলোচনা শেষ করে সবার উদ্দেশ্যে বললো,
– সবাই একটু শোনো, আমরা ভোর পাচঁটায় রওনা দিবো। সবাই একটু তাড়াতাড়ি করে গোছগাছ শেষ করো। সঙ্গে খাবার পানি এবং কিছু শুকনো খাবার রাখতে পারো। কারণ আমাদের ট্রাভেল করতে চার-পাঁচ ঘন্টা সময় লাগবে। আর রাস্তা যদি বেশি খারাপ হয় তাহলে ড্রাইভিং করতেও প্রচুর টাইম যাবে। এছাড়া থাকা-খাওয়ার জন্য সব ওখানেই বন্দোবস্ত করা আছে, তোমরা চাইলে কাপড়-চোপড় বেশি নিতে পারো। কারো কোনো কোয়েশ্চ্যান আছে এ ব্যাপারে?
কথাটা শুনে সাথে-সাথে শানাজ প্রশ্ন করলো,
– ওখানে গোসলের জন্য কি ভালো ব্যবস্থা আছে?
মাহতিম চিন্তিত মুখে মোবাইলটা নিয়ে আরো একবার ডিটেইলস চেক দিলো। সেখানকার সব ডিটেলস দেখে বলো,
– সব আছে। ওখানে একটা গ্রাম্য স্টাইলের পরিস্কার পুকুর আছে। একটা সুইমিংপুলও এরিয়ার ভেতর পাবে, ইভেন আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখান থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে যমুনা নদী। সব সিস্টেমই দেখি ফুলপ্রুফ করা, আই থিংক মেয়েদের জন্য কোনো প্রবলম হবেনা। আর কোনো প্রশ্ন?
সবাই একসঙ্গে মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো। মাহতিম সকলের দিকে হাসি দিয়ে ট্যূরের জন্য প্রস্তুত হতে বললো। সবাই নিজ-নিজ রুমে গিয়ে আলমারি খুলে পছন্দসই পোশাক-আশাক বের করলো। সুজলা, মাহমুদা এমন সিদ্ধান্ত শুনে প্রথমে ভড়কে গেলেও শেষে মেয়েদের খুশি বিবেচনা করে আনন্দমেলায় শামিল হলেন। শেফালী কিছুক্ষণ অমত ভাব দেখিয়ে নিরাপত্তার কথা বললেন, কিন্তু পরক্ষণে নিজেই আবার মেয়ের ব্যাগ গুছাতে ব্যস্ত হলেন। রাতের খাবার খেয়ে সবাই যখন ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, তখন হঠাৎ মাহতিমের রুমে হান্নান শেখ আসলেন। মাহতিম বালিশ ঠিক করা বাদ দিয়ে হান্নান শেখকে ভেতরে আসতে বললো। হান্নান শেখ সুক্ষ্ম চিন্তার রেশ ফুটিয়ে মাহতিমের প্রশস্ত কাধে হাত রেখে বললেন,
– তোমরা তাহলে ভোরের দিকে যাচ্ছো তাইনা?
মাহতিম ‘ হ্যাঁ ‘ সুচকে মাথা দুলিয়ে বললো,
– জ্বী নানা। পাঁচটায় বের হলে নয়টা বা সাড়ে নয়টার দিকে পৌঁছে যাবো।
হান্নান ব্যকুল চিন্তায় দৃষ্টি নত করলেন। মাহতিম উনার মনের অবস্থা বুঝতে পারলো। বুড়ো মানুষটা এতোদিন যাবৎ নাতনীদের সাথেই কাটিয়েছেন। ঘুম থেকে উঠেই নাতনীদের হাসিমাখা মুখ দেখেছেন, আবার রাতে শোয়ার আগেও একবার করে দেখে আসেন। সেই মানুষটা যখন তিনটা দিনের জন্য কোমল চারটে মুখের দেখা পাবেনা, সেটা নিয়েই বুকটা কেমন হু হু করে উঠে। মাহতিম হান্নান শেখের মলিন মুখটা দেখে বললো,
– আপনি যদি চান, তাহলে আমি আপনাকে সঙ্গে নিতে পারি নানা। আমাদের কিন্তু এক্সট্রা রুম আছে। আর যদি রুম শট পরে, তাতেও সমস্যা নেই। আপনি আমার রুমেই নাহয় থাকলেন। কি বলেন? আমাদের সাথে যাবেন?
মাহতিমের ইচ্ছাকৃত প্রস্তাব শুনে খুশী মৃদ্যু হাসলেন তিনি। কিন্তু খুশীর প্রকাশ তেমন করলেন না। মাহতিমের কাধে চাপড় মেরে বললেন,
– আমার আর বয়স কই? একসময় প্রচুর ঘুরাঘুরি করেছি। আমার আব্বা একজন মাওলানা মানুষ ছিলো। হায়রে কি বকা! আমি তবুও দোস্তদের সাথে ঘুরাঘুরি করতে যেতাম। তারপর তোমার নানীর সাথে বিয়ে হলো। বিয়ের একবছরের মাথায় তোমার বড় মামা আসলো। এরপর আর ঘুরাঘুরির শখ ছিলোনা। কিন্তু শেষ বয়সে একটা ইচ্ছা ছিলো, আমার নাতনীগুলোকে চিনামাটির পাহাড় দেখিয়ে আনবো। ওখানে তো যাওয়ার শরীর নেই, কিন্তু কালকের উছিলায় ওরা একটু বাইরের দুনিয়া দেখে আসুক। তোমার জায়গায় অন্য কোনো ছেলে হলে আমি জীবনেও রাজি হতাম না নানুভাই। কিন্তু আমি আমার মারজার ছেলেকে চিনি, এজন্য নাতনীগুলার জন্য ভরসা করতে পারি। তা নানু, তুমি নিজের দিকেও খেয়াল রেখো। কোনো সমস্যা হলে খবর দিও কেমন?
মাহতিম সরল ভঙ্গিতে হাসি দিয়ে হান্নান শেখের হাতটা ধরলো। দুহাতের মধ্যে বৃদ্ধের চামড়া কুচঁকানো হাতটা ধরে সম্মতি বুঝিয়ে দিলো। হান্নান শেখ আর বাক্য খরচ করলেন না, চুপচাপ নিজের মনে রুমে চলে গেলেন। এদিকে মাহতিম যখন ঘুমিয়ে পরলো, অন্যদিকে সকলের অগোচরে গোল-বৈঠক বসলো। এবারের বৈঠকটা মাহদি-সহ করা হচ্ছে, তাও আবার ফারিনের রুমে। ফারিনের রুমটা এখন বদল হয়ে সাবার রুমে এসেছে। আজ সাবা শানাজের সাথে ঘুমাবে, তাই ফারিনও খুব চালাকি করে সবার শোওয়ার পরই বৈঠক ডেকেছে। একসঙ্গে নয় মাথা একত্র হয়ে বসেছে, রুমের লাইট নিভিয়ে বৈঠকের মাঝখানে ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালানো হয়েছে। প্রীতি সবার প্রথম ফিসফিসিয়ে বললো,
– কাল যেভাবেই হোক, মেহনূরকে ভাইয়ার জিপেই বসাতে হবে। ও যেনো ভুলেও আমাদের জিপে না বসে।
প্রীতির কথায় সায় দিয়ে সৌভিক বললো,
– কথা তো ঠিক বলছিস। কিন্তু বাকিদের কিভাবে হ্যান্ডেল করি? সুরাইয়া তো পারলে মাহতিমের কোলে চড়ে বসবো।
সুরাইয়ার টপিক আসতেই সবাই চিন্তায় পরে গেলো। মেহনূরকে আবোলতাবোল বুঝিয়ে জিপে বসালে, সেখানে যদি সুরাইয়া এসে পল্টি খায়? কেউ কোনো সূত্র ধরে আগাতে পারলো না। কিন্তু মাহদি ঠিকই একটা সুরাহা খুজেঁ সবাইকে চমকে দিয়ে বললো,
– আমার কাছে একটা প্ল্যান আছে শুনবা?
কেউ ওর কথায় গুরুত্ব দিলোনা। সবাই আগের মতো চিন্তায় ডুবে গেলো। কিন্তু নীতি তখন কি মনে করে মাহদিকে বলার সুযোগ দিলো, মাহদি তখন খুশি হয়ে সবার দিকে তাকিয়ে বললো,
– আমি এদিকে মেহনূর আপুকে ইচ্ছামতো দেরি করিয়ে দিবো। আর ওদিকে তোমরা মাইক্রোতে সব সিট দখল করে বসে পরবা। যখন আপু এসে দেখবে গাড়িতে আর জায়গা নেই, তখন বাধ্য হয়েই ভাইয়ার জিপে বসে পরবে।
কথা শেষ হতেই মাথার পেছনে দারুণ থাবড়া গেলো মাহদি। ব্যথায় আর্তনাদ করতেই তৌফ ওর মুখ চেপে শব্দ আঁটকালো। অন্যদিকে সামিক ওর পানে তাকিয়ে বললো,
– আরে বলদের বস্তা, প্রবলেম তো সিট নিয়ে না। প্রবলেম তো সুরাইয়া নিয়ে।
মাহদি ঝটকা মেরে মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে দিলো। মাথার পেছনে ব্যথাতুর ভঙ্গিতে হাত বুলাতেই বললো,
– আমি কি সেটা জানিনা? তোমরা তো আমার কথায় পাত্তাই দিচ্ছো না। আমি কি বলছি সেটাতো একবার ভালো করে শুনবা? গাড়িতে যে দশটা সিট আছে সেটা কি ভুলে গেছো। আর ঠাসাঠাসি করে না বসলে মেহনূর আপু কি ভাইয়ার জিপে উঠতে যাবে?
তৌফ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো,
– তো ঠাসাঠাসি করে কিভাবে বসবো? আমি তো মোটা না।
মাহদি এবার মুখ ভেঙচি করে বললো,
– মাথায় নাই ঘিলু, আবার আসছে প্ল্যান বানাতে। আমাদের যেই মালপত্র পেছনের ডেকিতে তুলবে, সেখানে পানি ঢেলে দিও। তাহলে ওই মালপত্র সব লাস্টের সিটে বোঝাই করতে পারবে। আর সিট কমে গেলে বসা নিয়েও ঠাসাঠাসি হবে। প্লাস, মেহনূর আপুও বাধ্য হয়ে ভাইয়ার জিপে চড়বে। সুরাইয়া আপু যেহেতু বেশি লাফাচ্ছে, তাকে নীতি আপু আর ফারিন আপুর মাঝখানে কয়েদি বানিয়ে বসাবে। ঘটনা শেষ।
সবাই বিষ্ময়ে হা করে নিজেদের দিকে তাকালো লাগলো। মাহদির মতো পুচকে ছেলে দূর্দান্ত একটা বুদ্ধি দিলো। সবাই খুশীতে আটখানা হয়ে পিঠ চাপড়াতে লাগলো ওর। মাহদি যেনো ফুলে-ফুলে আরো এটিটিউট দেখাতে শার্টের কলারটা টেনে নিলো। গোল-বৈঠক শেষ হতেই সবাই ঘুমানোর জন্য চলে গেলো।
আকাশ এখনো কালো কুচকুচে হয়ে আছে। রাত্রিকালীন শেষ মূহুর্ত চলছে। একটু পরে আযান দিলেই ভোরের আলো ফুটতে শুরু করবে। শানাজ সবার আগে উঠে তিন বোনকে ডেকে তুললো। সুজলা, মাহমুদা, শেফালী সবার জন্য শুকনো খাবারের ব্যবস্থা গেলো। ঘড়িতে বাজে সাড়ে চারটা। শানাজ হাত-মুখ ধুয়ে এসে দাদাকে একবার দেখে এলো। হান্নান শেখ ঘুমাচ্ছেন বলে উনাকে আর ডাকলো না। শানাজ আজ সবুজ রঙের শাড়ি বের করেছে, আচঁলটা কালো, তবে ব্লাউজটা লাল রঙের। সাবাও নিজের জন্য গাঢ় নীলের তাঁতের শাড়ি বের করেছে, ব্লাউজ যে কোনটা পরবে সেটার জন্য সাদা ও নীল রঙ নিয়ে চিন্তায় বসে আছে। সুরাইয়ার জন্য শেফালী এসে লাল রঙের শাড়ি রেখে গেছে। শাড়ির অবস্থা দেখে সাবা ও শানাজ আড়ালে কিছুক্ষণ হাসাহাসি করে নিজেদের কাজে মনোযোগ দিলো। সবার চেয়ে দেরিতে উঠেছে মেহনূর, এদিকে হাতে আছে পচিঁশ মিনিটের মতো সময়। হাতমুখ ধুতে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে কলপাড়ের দিকে দৌড় লাগালো। হাপাঁতে-হাপাঁতে কলপাড়ের দরজা টেনে ভেতরে ঢুকতেই থম মেরে দাড়িয়ে গেলো। মাহতিম বালতি থেকে মগে নিয়ে মুখ ধুচ্ছে। মাহতিম দরজার দিকে একদম নজর না দিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়েই বললো,
– কলপাড় বা বাথরুমে আসার আগে যে নক করে ঢুকতে হয়, সেটা কি জানো না? দরজা তো চাপানো ছিলো, তবুও এই সেন্সটুকু নেই?
মেহনূর তখন রাগ দেখিয়ে বললো,
– আপনি কিন্তু সেদিন রুমে —
কথা শেষ করতে দিলো না ওর। মাহতিম ওকে থামিয়ে দিয়ে ভেজা হাতে চুলের মধ্যে ব্রাশ করতেই বললো,
– তোমার রুমে কোনো দরজা চাপানো ছিলো না। আর যদি দরজা চাপানো থাকতো, তাহলে আমি নক করেই ঢুকতাম। নাহয় ঢুকতামই না। অযথা কারনে এখন গলা চড়াতে আসবেনা। রেডি হও, হাতে বেশি সময় নেই।
মাহতিম ওকে ইশারা দিয়ে রাস্তা থেকে সরতে বললো। মেহনূর ওর ইশারা দেখে মাথা নিচু করে সরে দাড়ালো। মাহতিম ওর পাশ দিয়ে চলে গেলে কলপাড়ে ঢুকে গেলো মেহনূর। চাপকলে চাপ দিতেই দেখলো আবারও কলটা ঘ্যাড়ঘ্যাড় শব্দ করছে, অথচ কোনো পানি দিচ্ছেনা। আরো কয়েকবার জোরে চাপ দিলো ঠিকই, পানি আর পরলো না। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো,
– বালতি ভরেই রেখেছি। চোখ যদি আল্লাহ দিয়ে থাকেন, তাহলে বালতিটা দেখে সেখান থেকে পানি নাও। পানিটা পুকুরের।
মেহনূর আশ্চর্য হয়ে সাথে-সাথে পিছু তাকালো। কিন্তু মাহতিমের মুখ আর দেখতে পেলো না। আশ্চর্য হয়ে বালতির দিকে মুখ ফিরিয়ে মগের জন্য ধীরগতিতে হাত বাড়ালো। সকালবেলা কল একটু সমস্যা করে, প্রথম-প্রথম একটু চাপাচাপি করা লাগে। কিন্তু মাহতিম কি করে জানলো সবার শেষে মেহনূর কলপাড়ে আসবে? আর পানি পাবেনা জন্যই কি পুকুর থেকে বালতি ভরে রেখেছে? মেহনূর ছোট্ট করে নিশ্বাস ছাড়লো। এই লোকটা যে কেমন ধা-ন্দাবাজ সেটাই ভেবে আপনমনে হাসলো।
সবাই রেডি হয়ে ব্যাগপত্র নিয়ে উঠানে এসে হাজির। সামিক, সৌভিক গাড়ির লাস্ট সিটে ব্যাগ ঠেসে রাখছে। গাড়ির ডেকিতে খুব আগেই তিন লিটার পানি ঢালা হয়েছে, ভালোমতো ভিজিয়ে মাহতিমের কাছে কৈফিয়ত দিয়েছে, বৃষ্টির পানিতে ডেকি খুব বাজেভাবে ভিজে গেছে। সেখানে কোনো ব্যাগ-জিনিস রাখা যাবেনা। মাহতিম এ ব্যাপারে সন্দেহ করলেও সেটা নিয়ে মাথা ঘামায়না। এদিকে সুরাইয়া, সাবা, শানাজ উঠানে এসে উপস্থিত হলে তৌফ দ্রুত সৌভিকের বুকে কনুই মারে। সৌভিক কপাল কুঁচকে ওর দিকে তাকালে তৌফ নিচু স্বরে বলে,
– দোস্ত, সুরাইয়ার অবস্থা দেখ। মনেহয় বিয়ের শাড়ি পরে আসছে। ভাইরে ভাই আমারে বুঝা তুই, ট্যূরে কেউ এ গেটাপে বের হয়?
সৌভিক একপলক সুরাইয়ার দিকে তাকালো। কটকটে লাল রঙের শাড়ি পরেছে সুরাইয়া, যার পাড়টা সোনালী। মুখে বেইজ মেকআপ জাতীয় কিছু করেছে, যার জন্য ব্রাইডাল লুক বুঝা যাচ্ছে। সৌভিক এটুকু বুঝতে পারলো সে যদি আর কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকে তাহলে অট্টহাসিতে মারা যাবে। তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চোখ সরিয়ে মাথা নিচু করে বললো,
– বন্ধু, মাহতিম যদি এইটারে এখন ইজ্জত দেয় তাহলে কেমন লাগবো ভাব তো?
তৌফ নিজের জম্পেশ উত্তরটা দিবে ওমনেই দরজা দিয়ে দ্রুতগতিতে বের হলো মাহতিম। পকেট থেকে জিপের চাবি বের করতেই সুরাইয়ার অবস্থা দেখে পা থামিয়ে দাড়ালো। সুরাইয়ার দিকে যখন আপাদমস্তক তাকাচ্ছিলো, তখন সুরাইয়া সেটা আড়চোখে দেখে মনে-মনে খুশিতে গদগদ হয়ে যাচ্ছিলো। এদিকে মাহতিম পাল্টা কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে চুপচাপ জিপে উঠে বসলো। কি-সিস্টেমে চাবি ঢুকাতেই শেফালী এসে হৈচৈ সুরে বললো,
– আচ্ছা, এত্তাগুলা মানুষ যাবো। এত্তাগুলা জিনিস যাবো, গাড়ি কেন একটা যাবো? এক গাড়িতে ঠাসাঠাসি করিয়া বসবার মানে আছে? ও সুরাইয়া, তুই গাড়ি থিন নামতো। জিপগাড়িতে উঠিয়া বস।
এ কথা শুনে মাহতিম চাবি মুচড়ানো থামিয়ে শেফালীর দিকে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো। শেফালীর দৃষ্টি আর্কষণ করে বললো,
– জিপ কি আপনি চালাবেন মেজো মামী? কাকে অর্ডার দিচ্ছেন? আমিতো আমার জিপে আর কাউকে বসাবো না।
মাহতিমের অবস্থা দেখে নীতিরাও কিছু বললো না। সৌভিক শুধু ঠোঁটের উপর তর্জনী দিয়ে চুপ থাকার ইশারা করলো। পেছন থেকে সুজলা, মাহমুদা, মারজা ও হান্নান শেখ এসে জড়ো হয়েছে সেটার জন্য বাধা দিলো। শেফালী প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়ে বললো,
– দেহো, মাহতিম! তুমি কলাম ভালা কাজ করতেছো না। গাড়িতে ঠাসাঠাসি কইরা বসলে কেউ কি শান্তিমতো যাবার পাবো? তোমার জিপ তো পুরাই খালি। সুরাইয়ারে এট্টু বসবার জায়গা দিলে তো ক্ষতি হবো না।
মাহতিম এবার ভ্রু উঁচিয়ে ড্রাইভের হুইলের উপর দুহাত রেখে তাকালো। রাগত স্বরে সংযত ভঙ্গিতে বললো,
– আপনার মেয়ে কি খুবই ভালো মনে করেন? একটার-পর-একটা রঙ তামাশা যে করছে, সেটা কি ভুলে গেছেন? সুরাইয়া যদি আমার বোন হতো থাপড়িয়ে ওর সাহস বের করে দিতাম। আমার একটা বোন আজ পযর্ন্ত কুপথে যায়নি। আমাকে না-জানিয়ে, পরিবারকে না-বলে কোত্থাও বের হয়নি। সেই মেয়েকে আমার পাশে কেনো, আমার আশেপাশেও রাখবো না। আপনার যদি একান্ত সমস্যা হয়, ওকে ওই গাড়ি থেকে নামিয়ে নিন।
মাহতিমের কথা শুনে মারজা তেড়ে আসলেন। ওর পাশে দাড়িয়ে কপাল কুঁচকে শাসন ভঙ্গিতে বললেন,
– এগুলো কেমন আচরণ? তোকে বারবার কেনো বলতে হয় মেজো ভাবীর সাথে ভালোভাবে কথা বলবি? তুই বাবামশাইয়ের সামনে এরকম আচরণ করছিস?
মাহতিম মায়ের দিকে একপলক তাকিয়ে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে শেফালীর দিকে তাকালো। শেফালীও দারুণ ক্ষেপেছে দেখে সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
– তোমার বাবামশাইয়ের কোনো সমস্যা হলে এতোক্ষনে ঠিকই আওয়াজ তুলতো, উনি যেহেতু চুপ করে আছেন তুমি আর কথা বলো না মা। আমি ওই সুরাইয়াকে আমার জিপে তুলবো না।
মারজা কঠিন কিছু বলতে যেয়ে থেমে গেলেন। মাথা ঘুরিয়ে সুজলা ও মাহমুদার দিকে তাকিয়ে নিজের অসহায়ত্ব বুঝালেন। সুজলা চোখ দিয়ে ইশারা করে সেখান থেকে সরে আসতে বললো। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে মারজা যখন চলে এলো, তখন মাহদির হাত ধরে মেহনূর বের হলো। সবার শেষে, সবার দেরিতে মেহনূর এসে উপস্থিত হলো। এবার শেফালী দারুণ একটা কোপ বুঝে ঘোড়া এগিয়ে বললেন,
– তা বাবা, এখন কি করবা শুনি? মেহনূর যে এখন বসবার জায়গা পাবো না। ওর জন্যে কি জিপে ব্যবস্থা করবা?
মাহতিম শক্তমুখে তাকিয়ে রইলো। অন্যদিকে মেহনূর অবুঝের মতো ঘটনা বুঝার চেষ্টা করতে লাগলো। মাহদি এখন কি করবে সেটা বুঝতে না পেরে মেহনূরের হাত ছেড়ে মাইক্রোর দিকে দৌড় লাগালো। সামিক ওকে আসতে দেখে হাত বাড়িয়ে নিজের কোলে বসার জন্য ইঙ্গিত দিলো। মাহদি ছুটে এসে গাড়িতে চড়ে সামিকের কোলে উঠে বসলো। কিন্তু মেহনূর কি করবে বুঝে উঠতে পারছেনা। গাড়িতে যেহেতু জায়গা নেই, তাই সে ঠিক করলো ওদের সঙ্গে যাবেনা। শেফালীর চটান-চটান কথাও যেনো বন্ধ হতে চাইছেনা। প্রীতি দ্রুত একটা সিদ্ধান্তে আসার জন্য সিয়ামের ফোনে টেক্সট পাঠালো। সৌভিক ড্রাইভিং সিটে বসা ছিলো, সিয়াম তার পাশেই বসা। টেক্সটের টিউন বেজে উঠতেই সিয়াম পকেট থেকে ফোন নিয়ে দেখলো প্রীতির মেসেজ। প্রীতি সেখানে লিখেছে, ‘ Bro do something. This Shefali is just irritating. Please try to convince Mahtim vaiya. ‘ প্রীতির মেসেজ দেখে সিয়াম সেটা সৌভিককেও দেখালো। সৌভিক চিন্তিত মুখে সিয়ামের দিকে তাকিয়ে রইলো। হান্নান শেখ বলে দিলেন, যদি একজন নাতনী না যেতে পারে, তাহলে চারজনই বাদ যাবে। কারোর যাওয়ার দরকার নেই। সুজলাও বলে দিলেন, মেয়েরা বাড়িতে থাকুক, বাকিরা ঘুরে আসুক। ট্যূরের রাস্তা যখন সবাই বন্ধ দেখলো, তখনই মাহতিম থমথমে অবস্থায় নিরবতার চ্ছিন্ন করে বললো,
– মেজো মামী, ছোটবেলায় টস খেলছেন না? সুরাইয়া এবং মেহনূর এ দুজনের নামেই দুটো চিরকুট লিখবো, আপনাকে যেকোনো একটা চিরকুট শুধুমাত্র একবার উঠাতে বলবো। চিরকুটে যেই নাম আসবে সেই ব্যক্তি আমার জিপে বসবে। আর যে বাদ যাবে সে নীতি ও ফারিনের সাথে বসবে। ওই মাইক্রোতে একটা সিট খালি, এই জিপেও একটা সিট খালি। বাকিটা বুঝছেন তো?
চিরকুটের কথা শুনে সবাই ‘ আল্লাহ্ আল্লাহ্ ‘ করতে লাগলো। চিরকুটের নামটা যেনো মেহনূরই হয়, আর মেহনূরই যেনো মাহতিমের পাশে বসে আসতে পারে। সবাই একমনে জিকিরের তুফান লাগিয়ে দিলো, অন্যদিকে পকেট থেকে ছোট কাগজ বের করে দুটুকরো করে নিলো মাহতিম। চিরকুটে নাম বসিয়ে সুন্দর করে ভাঁজ করলো। দুহাতের মুঠোয় একবার ঝাঁকি মেরে শেফালীকে তুলতে বললো। শেফালী অনেক চিন্তা করে দুমিনিট সময় নষ্ট করে একটা চিরকুট বাছাই করলো। সেই বাছাইকৃত চিরকুট খুলেই দেখতে পেলো সেখানে চারটা অক্ষরে ‘ মেহনূর ‘ লিখা। শেফালীর মুখে এক ডলা কালি মাখার মতো কালো হয়ে গেলো, অপরদিকে গাড়ির ভেতরে সবাই চাপা খুশিতে আবেগ আটকে রাখলো। মাইক্রোর দরজা টান দিয়ে আঁটকানো হলো, আর শেফালীর সামনে দিয়েই মাহতিমের পাশে এসে মেহনূর দাড়ালো। জিপে উঠার জন্য কোনো প্যাডেল না থাকায় উঠতে সমস্যা হচ্ছিলো মেহনূরের। সেটা দেখে মাহতিম ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে মেহনূর সেটা ধরলো না। মাহমুদাকে ডেকে মায়ের হাত ধরে জিপে উঠে বসলো মেহনূর। সবাইকে বিদায় জানিয়ে মাইক্রোটা আগে ছুটলো, এরপর শান বাজিয়ে ধূলো উড়িয়ে মাহতিমের জিপ চললো। শত গালি, শত ধিক্কার, শত ভৎসনা করে উঠানেই দাড়িয়ে শেফালী। কঠোর চোখে রাগী দৃষ্টিতে ছাড়খার করে গালাগাল করতে লাগলো মেহনূরকে। উনার মেয়ে সুরাইয়ার জন্য গলার কাটা হিসেবে এই মেহনূর যেনো পয়দা হয়েছে। সবাই বাড়ির ভেতরে চলে গেলে মুষ্টিবদ্ধ করে থাকা শেফালী মাটির দিকে তাকালো। মাটিতে দুটো চিরকুট দেখে দুহাতে দুটো উঠিয়ে নিলো। একটা খোলা চিরকুট, অপরটা বন্ধ। শেফালী বন্ধ চিরকুটটা খুলে স্থির হয়ে গেলো। রাগে সমস্ত শরীর দপদপ করে জ্বলে উঠলো। দুটো চিরকুটেই একই অক্ষর, একই বর্ণ, একই শব্দ যেনো লেখা। চারটা গোটা গোটা অক্ষরে ‘ মেহনূর ‘ শব্দ লেখা।
– চলবে
#FABIYAH_MOMO