#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_২২.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
রাতেরবেলা কেনো জানি কারেন্ট চলে গেলো। ম্যানেজারকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তারা মিনমিন করে উত্তর দিলো। কারেন্ট না থাকার জন্য পুরো রেসোর্টের পরিবেশ অন্ধকারে ছেয়ে আছে। চারপাশ যেনো মারাত্মক ঘুটঘুটে অবস্থা ধারণ করেছে। রুমের মধ্যে ভ্যাপসা গরমটা ভালোই জ্বালাতন করছে। এটা নিয়ে সবার মধ্যে বেশ উৎকন্ঠা দেখা যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর থেকে ভীষণ গরম পরেছে আজ, এই ভ্যাপসা গরমের জন্য রুমের ভেতরটাও খুব অসহনীয় হয়ে উঠেছে। রেসোর্টের চারপাশে প্রচুর গাছগাছালি থাকলেও বাতাসের আনাগোনা তেমন দেখা যাচ্ছেনা। গাছের পাতাও যেনো অনেকক্ষন ধরে নড়ছেনা। রাত তখন আটটা বিশ বাজে। নীতি পুরোপুরি বিরক্ত হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে মাঠে ঘুরঘুর করছে। আকাশে একটা গোলকার চাঁদ উঠেছে, সেই চাঁদের চন্দ্রপ্রভায় চারপাশটা উজ্জ্বল হয়ে আছে। নীতি খোলা আকাশে সময় কাটানোর জন্য চুপচাপ নরম ঘাসে পা ছড়িয়ে বসলো। কালো কূর্তিটা হাঁটুর কাছে টানটান করে ঠিক করতেই ঢোলা হাতাটা কনুইয়ে কাছে তুলে ফেললো। নরম ঘাসগুলো চাঁদের আলোতে টসটসে দেখা যাচ্ছে। ঘাসগুলো যে কতটা সতেজ হয়ে আছে, সেটা ঘাসগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। হঠাৎ শোঁ শোঁ করে মৃদ্যু হাওয়ার ঝাপটা বয়ে গেলো। নীতি সেই হাওয়ায় গা এলিয়ে পরম শান্তি অনুভব করলো। চোখদুটো বন্ধ করে ঠান্ডা হাওয়ার পরশ নিতেই হঠাৎ দুজোড়া পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলো। চোখ খুলে শব্দ উৎসের দিকে তাকাতেই কিছুট দূর থেকে শানাজ আর সাবাকে দেখতে পেলো। ওরা দুজন একসাথে কথা বলতে-বলতে নীতির দিকেই আসছিলো। নীতির পাশে দুজন বসতেই জম্পেশ একটা আড্ডা শুরু হলো। হাসির আমেজ নিস্তেজ রেসোর্টের চারপাশে ছড়িয়ে গেলে সবাই তখন চুম্বকের মতো মাঠে জড়ো হতে লাগলো। মেহনূর নিজের রুমে শুয়ে-শুয়ে মোমবাতির আলোতে বই পড়ছিলো। আজকের উপন্যাসটা মারাত্মক সুন্দর, আর সবচেয়ে বেশি প্রিয়। শরৎচন্দ্রের ‘ চন্দ্রনাথ ‘ উপন্যাসটা মেহনূর কতবার পড়েছে জানা নেই। আজ আবারও যখন গরমের যন্ত্রণা ভুলার জন্য বইটা নিয়ে বসলো, সত্যি-সত্যিই চন্দ্রনাথের লেখনভঙ্গিতে মগ্ন হয়ে সবকিছু ভুলে গেলো। সুরাইয়া তখন বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছিলো, কিন্তু মেহনূরের রুম থেকে মোমবাতির আলো দেখে পা থামিয়ে দাঁড়ালো। ও যে রুমে শুয়ে ফের বই পড়ছে এটা কাটায়-কাটায় বুঝে গেলো। কটেজের সেই রুমবন্দি ঘটনার পর থেকে কোনো কারণ ছাড়াই মেহনূরের উপর জিদ চেপেছে সুরাইয়ার। কেনো এই জিদ এসে ভর করেছে সেটা ও নিজেও জানেনা। সুরাইয়া চুপচাপ আধ-ভেজানো দরজা দিকে পায়ে-পায়ে এগুতে লাগলো, দরজাটা সড়াৎ করে খুলতেই বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা মেহনূরকে দেখতে পেলো। বুকের তলায় বালিশ রেখে ফর্সা গালে হাত চেপে একান্তমনে বইয়ে ডুবে আছে মেহনূর। রাশি রাশি কালো চুলগুলো বিছানার ঢাল পেরিয়ে মেঝেতে পরে আছে, পাদুটো অনবরত নাড়াচ্ছে বলে শাড়ি কিছুটা টাখনু থেকে উপরে উঠে গেছে। তাতে ওর ফসার্টে সুন্দর পাদুটো একটুখানি দেখা যাচ্ছে। হালকা বেগুণির শাড়িতে ওই অবস্থায় ওমন মেয়েকে দেখলে যেকারোর দৃষ্টি স্থির হয়ে যেতো। কোনো পুরুষ দেখলে তার মাথায় আগুন ধরতো নির্ঘাত! এই মেয়ে যে ছোট থেকেই অপরূপ সুন্দরী, মায়ার সবটুকু ব্যাখ্যা নিয়ে জন্মেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মাথার চুল থেকে শুরু করে পায়ের নখটা পযর্ন্ত নিখুঁতভাবে সুন্দর। সুরাইয়া এসব ভাবতে-ভাবতেই ঈর্ষান্বিত দৃষ্টিতে দরজার নবটা শক্ত করে মোচড়ালো। ওমনেই নব ঘুরানোর শব্দ শুনে মেহনূর তৎক্ষণাৎ দরজার দিকে তাকালো। মেহনূরের শান্ত-নির্মল চাহনি দেখে দাঁত শক্ত করে ভেতরে ঢুকলো সুরাইয়া, হনহন করে ওর কাছে আসতেই বিছানার পাশে এসে অটলভাবে দাঁড়ালো। মেহনূর মুখ তুলে সরল দৃষ্টিতে সুরাইয়ার দিকে তাকাতেই সুরাইয়া শক্ত গলায় টেবিলের দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,
– তোর এক্সট্রা মোমটা নিয়ে গেলাম। আমার রুমে মোম ফুরিয়ে গেছে। দিয়াশলাইও পাচ্ছিনা। তা তুই কি পড়ছিস?
মেহনূর যেভাবে শুয়ে ছিলো, সে অবস্থায় থেকে স্বাভাবিক গলায় বললো,
– চন্দ্রনাথ।
মেহনূরের উত্তর শুনে সুরাইয়া একপলকের জন্য ওর দিকে তাকালো। এরপর দৃষ্টি সরিয়ে এক্সট্রা মোমটা নিয়ে জলন্ত মোমটা থেকে সেটা জ্বালিয়ে নিলো। মেহনূর আবার বইয়ের দিকে মনোযোগ দিলে সুরাইয়ার জ্বলজ্বল চোখদুটো টেবিলের উপর ‘ পরিণীতা ‘ বইটার দিকে আটকে গেলো। সাথে-সাথেই চোখেমুখে ছেয়ে গেলো ধূর্ত চিন্তা কষার পরিকল্পনা। চুপ করে টেবিলের উপর আচঁল ফেলে পরিণীতা বইটা চুরি করলো সুরাইয়া। তারপর সেটা আচঁলের ভেতর গছিয়ে জলন্ত মোমবাতি বাঁহাতে নিয়ে রুমের বাইরে যেতে থাকলো। যাওয়ার আগে আরো একবার মেহনূরের দিকে পিছু ফিরে তাকালো, এরপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে বেপরোয়া ভঙ্গিতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। মেহনূর হয়তো কল্পনাও করতে পারলো না ওর সাথে কি হতে চলেছে। এদিকে সুরাইয়া চুরি করা বইটা নিজের রুমে লুকানোর জন্য রুমের দিকে যেতেই হঠাৎ কানে স্পষ্ট শুনতে পেলো, মাঠে সবাই মশা তাড়ানোর জন্য কাগজ পুড়ার চিন্তা করছে। কাগজ পোড়ানোর উৎকট গন্ধ পেয়ে মশারা চলে যাবে। সুরাইয়া কানে এটাও শুনতে পাচ্ছে মাহতিম কাগজের আনার জন্য প্রীতিকে নির্দেশ দিচ্ছে। প্রীতি এদিকে কাগজ আনার জন্য ম্যানেজারের কাছে চলে গেলে ধীরেসুস্থে আচঁলের ভেতর থেকে পরিণীতা বইটা বের করলো সুরাইয়া, জলন্ত মোমবাতির আলোয় সেটা একপলক দেখে নিয়ে মাঠের পানে যেতে লাগলো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে পেছন থেকে সুরাইয়া এসে বললো,
– তোমরা এই পুরাতন বইটা পুড়াতে পারো। আমার রুমে ডাস্টবিনের ভেতর এটা ফেলা ছিলো। আমার মনেহলো ডাস্টবিনে না রেখে এটা পুড়িয়ে ফেললেই ভালো হয়। অন্তত মশার উপদ্রব থেকে বাঁচা যাবে। এই নেও।
সুরাইয়ার বই ধরতে-ধরতে হঠাৎ প্রীতি দৌড়ে এলো। প্রীতি অনেকগুলো খবরের কাগজ নিয়ে চলে আসলে মাহদি দৌড়ে গিয়ে সেগুলো স্তুপ করে দিলো। সুরাইয়ার হাত থেকে সামিক বইটা নিয়েছিলো, কিন্তু সে বেখেয়ালি হয়ে প্রীতির কাগজে তাকিয়ে থাকলে বইটার দিকে বিশেষ নজরে তাকালোনা। মাহতিম খবরের কাগজগুলো জড়ো করতেই আগুনের জন্য ম্যাচের কথা উঠালো, আর তখনই সুরাইয়া দ্রুতবেগে নিজের হাতের মোমবাতিটা এগিয়ে দিলো। মাহতিম তীক্ষ্ণ নজরে সুরাইয়ার হাবভাব বুঝার চেষ্টা করছে, এই মেয়ে সারাদিন মুখ কুঁচকে রেখে এখন কেনো সাহায্য করতে এসেছে, সেটাই এখন মাথায় ধরছেনা। মাহতিম ওর হাত থেকে মোমবাতিটা নিয়ে কাগজে আগুন ফেললো, কাজ শেষে মোমবাতি ফেরত দিলে সুরাইয়া বইটার দিকে আবার তাগাদা দিলো। আর দিতেই কিনা চুপচাপ কটেজের দিকে চলে আসলো। সিড়ি দিয়ে কটেজে ঢুকতেই মেহনূরের রুমে উকি মেরে বললো,
– মেহনূর রে, আমাকে একটা সাহায্য করবি?
মেহনূর কথাটা শুনতে পেয়েই চটপট ভঙ্গিতে জবাব দিলো,
– বলো বুবু, কি করতে হবে? আমি এখুনি করে দিচ্ছি।
সুরাইয়া একগাল অদ্ভুত হাসি হেসে মেহনূরের জন্য সরল মুখে বললো,
– তোর সবচেয়ে সুন্দর বইটা আমাকে দে তো। আমি কিন্তু চন্দ্রনাথ পড়বো না, ওটা দিবি না। একটু রোমান্টিক হলে ভালো হয়। পরিণীতা আছেনা? তুই ওটা এনেছিস না? থাকলে দে, তোর বইটা নিয়ে একটু পড়ি। আমার এখানে সময় কাটছেনা।
মেহনূর খুশি হয়ে চওড়া একটা প্রাণখোলা হাসি দিয়ে দ্রুত বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। টেবিলের উপর ব্যাগ থেকে বের করা বইগুলো হাতড়ে-হাতড়ে কাঙ্ক্ষিত বইটা খুঁজতে লাগলো। পাগলের মতো খুঁজতে লাগলো, সব বই উলোট-পালোট করে খুঁজতে থাকলো, কিন্তু কোথাও বইটা খুজেঁ পাচ্ছেনা। অস্থির হয়ে উন্মাদের মতো বিছানার উপর বালিশ উল্টে দেখলো, বিছানার নিচে উঁকি মারলো, টেবিলের চারপাশে হন্যে হয়ে খুঁজলো, কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলোনা। ওর বিবশ অবস্থা দেখে সুরাইয়া তৃপ্তিতে বাক-বাকুম করছিলো, কিন্তু সেটা মুখে প্রকাশ না করে মিথ্যা চিন্তার অভিনয় করে বললো,
– কি হয়েছে রে? কি খুঁজছিস? বইটা কি হারিয়ে গেছে?
মেহনূর তখনো সবকিছু তছনছ করে খুঁজে যাচ্ছে। কোথাও সেটার হদিশ না পেয়ে ওর বুক শুকিয়ে আসছে, প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে, কন্ঠরোধ হয়ে আসছে ওর। তবুও নিজেকে সংযত করে প্রচণ্ড ধরা গলায় বললো,
– আমার পরিণীতা বইটা পাচ্ছিনা বুবু। ওটা কোথায় রাখলাম? আমিতো টেবিলেই রেখেছি বুবু। ওটা না পেলে আমি কি করবো? ওটা দাদীর বই ছিলো, ওটা দাদীর বই। আমি ওটা খুঁজে পাচ্ছিনা বুবু। ওটা কোথায় গেলো?
মেহনূরের অবস্থা একদম নাজেহাল হয়ে গেলো। খুঁজতে-খুঁজতে বিছানার চাদর, বালিশের জায়গা সব উল্টে ফেলেছে। সুরাইয়া মিচকি-মিচকি হাসিতে ফেটে পরলেও খুব কষ্ট করে হাসি আটকে নিলো, হাসিটা এমনভাবে ঢাকা দিলো যেনো মেহনূরের কষ্টে ওরও খুব কষ্ট অনুভব হচ্ছে। সুরাইয়া রুমের ভেতর পা ফেলে ওকে বাইরে আনার চিন্তা করলো। শান্ত হওয়ার জন্য মাথায় হাত বুলিয়ে রুমের বাইরে এনে মাঠে যেতে থাকলো। মেহনূর বারবার বলতে লাগলো বইটা ও টেবিলের উপরেই রেখেছে। স্পষ্ট করে মনে আছে বইটা টেবিলের উপরেই ছিলো। কিন্তু হুট করে ওটা কোথায় হারিয়ে ফেললো? সুরাইয়া ওর হাতটা ধরে আগুনের কাছে গোলআড্ডায় নিয়ে আসলো। সবাই নিজেদের মধ্যে তুমুল হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠেছে বলে মেহনূর মাথা নিচু করে রইলো। কিন্তু কি ভেবে যে একপলকের জন্য দৃষ্টি তুলে তাকালো ওমনেই মাহতিমের হাতে ওর দৃষ্টি আটকে নিশ্বাস চেপে আসলো। মাহতিম একটানে বইটাকে দুই খন্ড করে সেটা আগুনের দিকে ছুঁড়ে মারলো। মাহতিম মেহনূরের আগমন লক্ষ করলেও চোখ তুলে ইচ্ছে করে তাকায়নি, এদিকে মেহনূর যে ওর দিকে অপলকে তাকিয়ে আছে সেটাও বুঝতে বাকি নেই। মেহনূর বই ছেড়ার দৃশ্য দেখে কয়েক মিনিট ওভাবেই থম মেরে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকলো। পাশ থেকে সুরাইয়া চুপিচুপি ওর কাছ থেকে দূর সরে কটেজের দিকে চলে গেলো। মেহনূর স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ সাবার নজরটা ওর দিকে পরলো। সাবা ওর চোখের চাহনি দেখে খানিকটা বিচলিত হয়ে শানাজের কানে ফিসফিসিয়ে কিছু বললো। শানাজও চিকন কপালে ভাঁজ ফেলে বসা থেকে দাঁড়ালো, হাত ঝাড়া দিয়ে মেহনূরের কাছে এসে ওর কাধ ধরে প্রশ্ন করলো,
– তোর কি হয়েছে মেহনূর? তুই এখানে থাম্বার মতো দাড়িয়ে আছিস কেন? আয় আমাদের সাথে বসে পর। আড্ডা দে, মন ভালো হয়ে যাবে। পরশু তো চলেই যাচ্ছি।
মাহতিম কান খাড়া করে সব কথা শুনছিলো। কিন্তু মনের খটকা মেটাতে যেই মেহনূরের দিকে তাকালো, ওমনেই মেহনূরের সজল নয়নের ছলছল দৃষ্টি দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলো। মাহতিমের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই মেহনূরের বড়ো বড়ো চোখ থেকে হঠাৎ বর্ষন শুরু হলো। সেই বর্ষণের জন্য বুক ফুলে উঠতে থাকলে শানাজ চিন্তিত হয়ে তাড়াতাড়ি ওকে নিজের দিকে ঘুরালো, গালে দুহাত চেপে তীব্র উৎকন্ঠায় বলে উঠলো,
– তুই কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে? বাড়ির কথা মনে পরছে? মেহনূর তুই চুপ হ তো, কি হয়েছে খুলে বল দেখি।
মেহনূর গাল থেকে দুহাত সরিয়ে আবার মাহতিমের দিকে তাকালো। রাগে-ক্ষোভে-লজ্জায়-ধিক্কারে মাহতিমের দিকে দৃষ্টি রেখে শানাজের উদ্দেশ্যে কান্নাসুরে বললো,
– আমার বই পুড়িয়ে কি আনন্দ পেলো বুবু? ওদের জিজ্ঞেস করো আমার বই কেনো পুড়িয়ে দিলো। আমার বইয়ের কি দোষ ছিলো এখানে? ওটা দাদাভাইয়ের একান্ত বই ছিলো বুবু। আমি দাদাভাইকে কি জবাব দিবো? দাদীর ছোঁয়া ছিলো ওই বইটায়। দাদী ওই বইটা ধরেছিলো। ওরা আমার বই পুড়িয়ে দিলো বুবু। আমার বই পুড়িয়ে ছাই করে ফেলেছে।
কথাটুকু বলতেই সবার সামনে হাউমাউ করে কেদেঁ উঠলো মেহনূর। ঝরঝর করে দুচোখের কোল থেকে অশ্রু নির্গত হচ্ছে। ওর ফুপানো কান্না দেখে সাবা তড়িঘড়ি করে উঠে এসেছে। শানাজ ওর চোখ মুছাতে হাত আগালে মেহনূর রাগ দেখিয়ে সরিয়ে দিলো। মাহতিমের মতো সবাই তখন কি করবে বুঝতে পারছিলো না। মেহনূর এভাবে হাউমাউ করে কেদেঁ উঠবে এটা চিন্তাও করা যাচ্ছিলোনা। মাহতিমের মনে হচ্ছিলো সে বোধহয় জীবনের সবচেয়ে বড় অপরাধটা করে ফেলেছে। কিন্তু এখানে ওর দোষটা আদৌ আছে কিনা সেটা নিয়ে চিন্তা করার অবস্থা পযর্ন্ত নেই। সিয়াম ওর ব্যকুলভাবে কান্না দেখে অপরাধী মুখে বললো,
– মেহনূর তুমি কেঁদো না প্লিজ। আমরা সত্যিই জানতাম না, ওটা যে তোমার বই ছিলো। অতো পুরোনো বই, তার উপর বইয়ের মলোটটাও ছিলো না, এজন্য —
বাক্য শেষ করার আগেই মেহনূর টলটলে চোখে তেজ নিয়ে তাকালো! সিয়ামের দিকে রাগী দৃষ্টি দিয়ে তৎক্ষণাৎ ভয়াবহ ভাবে চেঁচিয়ে উঠলো,
– এজন্য আপনারা পুড়িয়ে ফেলবেন? ওটার কি কোনো মূল্য নেই? ওটা যে আটাশি সনের বই এটা জানেন?
এবার সিয়ামের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ওই অশ্রুপূর্ণ চোখে মাহতিমের দিকে তাকালো। চোখ থেকে অনবরত টপটপ করে পানি পরতেই চেঁচানো সুরে বললো,
– একবার পেছনের পৃষ্ঠা দেখেছেন? সেখানে যে আমার দাদাভাইয়ের নাম লিখা ছিলো চোখে পরেনি? কেনো পুড়ানোর জন্য আমার রুম থেকে আনলেন? আপনি শুধু অসভ্য না! আপনি একটা জঘন্য চোরও! আপনার মতো জঘন্য মানুষ যেনো আমার সামনে না আসে! আমি কখনোই আপনার চেহারা দেখতে চাইনা!
মেহনূরের প্রতিটি কথা বাজেভাবে আহত করছে মাহতিমকে। বিনা দোষে, বিনা অপরাধে শুধু-শুধুই মেহনূরের কাছে ‘ অসভ্য-চোর-জঘন্য ‘ উপাধি পাচ্ছে। মাহতিম শক্ত হয়ে ছিলো ঠিকই, কিন্তু ভেতরের অবস্থা তুফানের মতো ঝড় তুলে দিচ্ছিলো ওর। এদিকে মেহনূরকে সবাই বুঝাতে চেষ্টা করলে মেহনূর কাঁদতে-কাঁদতে ঘুটঘুটে অন্ধকারের দিকে দৌড়ে পালিয়ে গেলো। এরপর আর চিল্লাচিল্লি হলো না। সৌভিকরা স্তম্ভের মতো স্তম্ভিত হয়ে গেলে কোনো কথাই আর বলতে পারলোনা। মাহতিম বাকরুদ্ধ হয়ে ধীরে-ধীরে মাথা নিচে নামিয়ে ফেললো, ঘাসের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস ছাড়লো। মেহনূরের কথাগুলো কান দিয়ে ধোয়া ছুটিয়ে দিয়েছে, নিজেকে শান্ত রাখার তীব্র চেষ্টায় মাহতিম একদম নিঃশব্দ হয়ে গেছে। আচানক ভয়ার্ত সুরে চিল্লিয়ে উঠলো তৌফ, ঘুটঘুটে জায়গাটার দিকে অস্থির কন্ঠে সপ্তমে গলা চড়িয়ে বললো,
– সর্বনাশ! মেহনূর এটা কোন রাস্তার দিকে দৌড় লাগালো! ওইটা তো জঙ্গলের রাস্তা ওই জায়গার অবস্থা বহুত খারাপ হয়ে আছে ভাই! এই মাইয়া আবার বিপদে পরে নাকি।
তৌফের কথা শুনে সবাই শিউরে উঠে ‘ হায়হায় ‘ করতে লাগলো। মাহতিম তাড়াতাড়ি বসা থেকে উঠে সবার উদ্দেশ্য বললো,
– কেউ ওই রাস্তায় পা দিও না। আমি ওখানে যেয়ে নিয়ে আসছি। কালকের বৃষ্টির জন্য জায়গাটা কাদা-কাদা হয়ে থাকতে পারে, তোমরা গেলে ব্যথা পেতে পারো। তোমরা টেনশন মুক্ত থাকো। আমি ওকে নিয়ে আসছি।
মাহতিম চটপট ওদের কথা বুঝিয়ে দ্রুত জায়গাটার দিকে হাঁটা দিলো। ওই জায়গাটায় প্রচুর গাছগাছালি ছিলো বিধায় আলো একদম পৌঁছাতে পারেনি। প্রথমবার কেউ খালি নজরে তাকালে ভয়ে তার গা কাঁটা দিয়ে উঠবে। মাহতিম অন্ধকারে তলিয়ে যেতেই দুহাতে ঝোঁপের গাছগুলো সরিয়ে ভেতরে ঢুকলো। চোখ সয়ে দুমিনিটের মতো হাটা দিতেই হঠাৎ চোখের সামনে বিধ্বস্ত অবস্থায় মেহনূরকে দেখতে পেলো। মেহনূর যে জায়গায় ছিলো সেখানটায় চাঁদের ছোট-ছোট আলো পাতার ফাঁক গলে আসছিলো। তাই যতটুকু দেখতে পেলো ওমনেই একদৌড় দিয়ে মেহনূরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো মাহতিম। কাঁদায় হাত-পা মাখামাখি হয়ে গলায়-গালেও কিছু কাদা লেপ্টে ছিলো। মাহতিম ওর অবস্থা দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পরতে নিলে হঠাৎ একটু আগের ঘটনা স্মরণ করে চুপ হয়ে গেলো। কাদা বাঁচিয়ে শুকনো একটা জায়গায় পা ফেলে ওর সামনে এসে হাটু গেড়ে ঝুঁকলো। মেহনূর যে মাথা নিচু করে তখনো ফুপিয়ে কাঁদছে, সেটা ওর পিঠের অবস্থা দেখলেই বুঝা যায়। মাহতিম ওর দিকে হাত এগিয়ে থুতনি উঁচিয়ে মুখ তুললো। নম্র কন্ঠে শান্ত ভঙ্গিতে বললো,
– রাগ দেখিয়ে কার ক্ষতিটা হলো? আমার না তোমার? দৌড়টা এই জঙ্গলের দিকে না দিয়ে আমার দিকেই দিতে। আমিতো রাগ ঝাড়ার জন্য পালটা জবাব দিতাম না।
মাহতিমের দিকে দৃষ্টি তুলে তাকালে অন্ধকারের জন্য স্পষ্ট দেখে পারলো না মেহনূর। শুধু বুঝতে পারলো মাহতিম আবারও ওর দিকে ওর সামনে বিপদের বেলায় হাজির হয়েছে। একটু আগের ঘটনা চিন্তা করতেই মেহনূর সাথে-সাথে ঝটকা মেরে মাহতিমের হাত সরিয়ে দেয়। মাথা নিচু করে কাদাটে জায়গা থেকে উঠতে নিলে আবার ধপ করে পরে যায়। মাহতিম ওর কীর্তিকলাপ দেখে হাসবে-না-দেখবে সেটাই চিন্তা করছিলো। এমন বেকুব মার্কা কাণ্ডজ্ঞান দেখে মাহতিম শেষমেশ আবার বলে উঠলো,
– আমাকে ধরে উঠলে তোমার জন্য ভালো হবে। নয়তো এখান থেকে উঠার চান্স খুবই কম। সামনে একটা পুকুর আছে, চাইলে সেখানে গিয়ে কাদা পরিস্কার করতে পারো।
মেহনূর মুখ তুলে অসহ্য ভঙ্গিতে বললো,
– আপনি এখান থেকে চলে যান।
মাহতিম ওর আকস্মিক রাগের আচরণগুলো খুব মনোযোগ সহকারে দেখেছিলো। এখন যেই আচরণগুলো করছে সেটাও যে রাগের শামিল এটা ওর জানা আছে। তাই মাহতিম বিনম্র সুরে সৌজন্যে ভঙ্গিতে বললো,
– তোমার কি সত্যিই মনেহয় আমি ওই বইটা ইচ্ছা করে পুড়েছি? তাছাড়া আমি তোমার বইটা কিভাবৈ খুজেঁ পেলাম, সেটা কি জিজ্ঞেস করা উচিত না? আমিতো তোমার রুমে যাইনি, তাহলে কি করে তোমার বইটা আমার হাতে চলে এলো? সৌভিকরা তোমার রুমে গিয়েছে কিনা জানিনা, কিন্তু অন্যের মাধ্যমে চোরা কাজ করানোর মতো বিশ্রী স্বভাব আমার নেই। মাঝে-মাঝে চোখে দেখা সত্যও অনেকসময় মিথ্যার মতো হয়।
মেহনূর এবার কথাগুলো শুনে খানিকটা অন্যমনষ্ক হয়ে গেলো। নিজের ভাবনা চিন্তায় মশগুল থেকে কিছুক্ষণ পর বললো,
– আপনি কিভাবে আমার বই পেয়েছেন?
মাহতিম ওর উত্তর শুনে মৃদ্যু ভঙ্গিতে হেসে দিলো। মেহনূরের ড্যাবড্যাবে চাহনির দিকে দৃষ্টি রেখে সরল গলায় বললো,
– বলবো, নিশ্চয়ই বলবো। তার আগে আমার সাথে ওই পুকুরটার কাছে চলো। ওখানে বসে হাত-পা ধুয়ে নাও। কাদাগুলো সরাও, তারপর তোমাকে খুলে বলছি। আসো, হাতটা ধরে উঠে দাড়াও।
মাহতিম উঠে হাত বাড়িয়ে দাঁড়ালে মেহনূর তবুও মাথা নিচু করে থাকে। ওর ব্যাপারটা সম্পূর্ণ বুঝতে না পারলেও সামান্য আঁচ করতে পারলো। সেই অনুমানের সূত্র ধরেই প্রশ্ন করে বললো,
– দৌড়াতে যেয়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছো নিশ্চয়ই?
মেহনূর লজ্জার জন্য বলতে পারলো না, পায়ে সে ব্যথা পেয়েছে। দৌড়াতে গিয়ে কাদার মধ্যে পা আটকে ধপ করে পরেছে। অসহায়ের মতো নতমুখে বসে থাকলে হঠাৎ একজোড়া হাত এসে চোখের পলকে কাদা থেকে উপরে তুলে ফেললো। মেহনূর কিছু বুঝে উঠার আগেই পেশিবহুল বাহুদুটো ওকে গুটিশুটি করে কোলে তুলে নিলো। মেহনূর ঘটনার আকস্মিকতার জন্য চোখ খিচে ফেললে কিছুক্ষণ পর হাঁটার গতি অনুভব করলো। হাঁটার জন্য ওর শরীরটাও যে একটু-আধটু নড়ছে, সেটা মেহনূর স্পষ্টরূপে টের পেলো। মেহনূর ধীরে-ধীরে চোখের পাতা খুললে গাছের ফাঁকে-ফাঁকে চাঁদের উঁকিঝুঁকি দেওয়া চন্দ্রালো দেখতে পেলো। মেহনূরের নরম শরীরটা কোলে তুলে মাহতিম সোজা পুকুরঘাঁটের দিকে রওনা দিয়েছে। অন্ধকারে খুব সাবধানে পা ফেলে এগুতে হচ্ছে। একটুখানি অসর্তক হলে এখুনি মেহনূরকে নিয়ে পরে যেতে হবে। মেহনূর যে মাহতিমের দিকে চুপ করে তাকিয়ে আছে, মাহতিম সেটা আড়চোখে ধরতে পারলো। কিন্তু ওর দিকে পালটা দৃষ্টি ছুড়তে গেলে পা পিছলে এলাহিকাণ্ড ঘটে যাবে। মাহতিম পুরোটা মেঠোপথ নিজেকে শান্ত রেখে শেষমেশ গন্তব্যস্থলে পৌঁছালো। পুকুরঘাঁটের পাকা পাটাতনে মেহনূরেকে বসিয়ে দিলো। হাতের ঘড়িটা খুলে মেহনূরের কোলে রেখে প্যান্ট গুটাতে ব্যস্ত হলো মাহতিম। পুকুরের স্বচ্ছ-পরিস্কার পানিতে নেমে সবার আগে নিজের হাতদুটো ধুয়ে নিলো। মেহনূরকে কোলে তুলার জন্য ওর আকাশী রঙের টিশার্ট ইতিমধ্যে কাদার কারনে নষ্ট হয়ে গেছে। মাহতিম সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে মেহনূরের দিকে আদেশসূচকে বললো,
– পাদুটো দেখাও।
মেহনূর কথাটা শুনেই কাঁচুমাচু করে পা আরো লুকানোর চেষ্টা করলো। এবার মাহতিম রেগে গিয়ে ভ্রুঁ কুঁচকে বললো,
– এখন কিন্তু কথা না শুনলে সোজা পুকুরে ফেলে দিবো।
মেহনূর একটা কড়া ধমক খেয়ে নির্বোধ হয়ে গেলো। পা এগিয়ে দিতেই মাহতিম ওর পায়ে মুঠোভর্তি পানি ছেড়ে কাদা পরিস্কার করে দিলো। দুইপা একসঙ্গে ধুয়ে দিতেই শাড়ির নিচটা যতটুকু সম্ভব কাদা পরিস্কার করে দিলো। এবার হাতদুটো পরিস্কার করে দেওয়ার জন্য ওর ডানহাতটা ধরলো মাহতিম। নির্লিপ্তে হাতটা পানি দিয়ে ধুয়ে ধুতেই মেহনূর একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো। মেহনূরের চাহনি দেখে মাহতিম আন্দাজ করতে পারলো, এইমূহুর্তে ওর ভেতরে কি কি চিন্তা ঘুরছে। মাহতিম ওর হাত ধুয়ে দিতেই ঠোঁটে হাসি টেনে বললো,
– তোমার জায়গায় যদি সুরাইয়া এখানে থাকতো আমি সুন্দর করে গলাটা টিপে ধরতাম। টানা পাঁচ মিনিট ওভাবে টিপে রেখে গলায় একটা পাথর বেধেঁ দিতাম। তারপর এই পুকুরে ছেড়ে দিয়ে চলে যেতাম। এই কাজটা করতে পারলে আমার জীবনটা ধণ্য লাগতো শিওর।
কথাটা শুনে খু/নি-খু/নি লাগলো মেহনূরের। কিন্তু কেনো সুরাইয়ার ব্যাপারে এমন ফালতু কথা বলছে সেটার জন্য মুখ খুললো মেহনূর। কিন্তু কিছু বলার আগেই মাঝপথে আটকে দিয়ে মাহতিম নিজের আসল কথাটা বলল,
– তোমার বইয়ের ব্যাপারে আমি কিছুই জানতাম না। মশার যন্ত্রণা কমানোর জন্য কাগজ পুড়াতে বলেছিলাম। প্রীতি কিছু নিউজপেপার কালেক্ট করে এনেছিলো, আর ওগুলো দিয়েই আ/গুন জ্বালিয়েছি। কিন্তু হুট করে সুরাইয়া একটা পুরোনো বই নিয়ে আসলো। আর মোস্ট ইন্ট্রেস্টিং পয়েন্ট ইজ, ওই বইটা পুড়ানোর জন্য ও নিজেই কিনা তাগাদা দিয়েছিলো। আমিতো খেয়ালও করিনি বইটা আসলে কিসের ছিলো। বইটা যখন দুফালি করে ছিঁড়ে আগুনে পুড়াতে দিয়েছি তখনই তুমি ওই দৃশ্য দেখে আমার উপর ক্ষেপে গেছো। এটা কি আমার দোষ?
মাহতিম এটুকু কথা সমাপ্ত করে হাতদুটো পরিস্কার করা শেষ করলো। মেহনূর একদম নির্বাক হয়ে তাকিয়েছিলো, ওর দৃষ্টি ঠিক এমন হয়ে আছে যেনো চিন্তা-চেতনা শূন্য হয়ে গেছে। মাহতিম বুঝতে পারলো এটা ঝড় আসার পূর্বমূহুর্ত্তের নিরবতা। তাই সেই নিরবতাকে শক্ত করতে মেহনূরের বাঁগালে হাত রাখলো মাহতিম। গালে চারটা আঙ্গুল বসিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুল এগিয়ে কাদার ছিঁটেটা মুছে দিতে লাগলো। ওর নিরব চাহনির দিকে দৃষ্টি রেখে অন্যহাতটা এগিয়ে ওর গলার ডানদিকে রাখলো। সেখানকার ছিটেফোঁটা কাদাটা পরিস্কার করতেই মেহনূরের দিকে মুখটা একটু এগিয়ে নিয়ে বললো,
– পরিণীতার মর্ম বুঝতে পারো। এদিকে আমার যে শেখরের মতো অবস্থা হয়ে আছে, সেটা বুঝতে পারোনা?
ধুকপুক-ধুকপুক করে বুকের পরিচিত কাঁপুনি বেড়ে গেছে। খুবই অস্বাভাবিক ভাবে বেড়েছে। বেতাল হয়ে গেছে, বেসামাল হয়ে গেছে, বেগতিক হারে ছুটছে, ক্রমশ ধুকধুকনি আরো বেড়েই চলছে। নিঃশ্বাসের প্রখরতা ক্রমান্বয়ে ফিসফিসিয়ে হচ্ছে, চারপাশকে সেই ধুকধুকনি অন্য কথা জানিয়ে দিচ্ছে, অসামঞ্জস্য হয়ে বুকের যন্ত্রটা ধড়াস-ধড়াস আবারও বেকায়দা হয়ে গেছে। মাহতিম নিজের মুখটা আরো এগিয়ে নিয়ে গেলো, নরম গালটা থেকে কাদা পরিস্কার করে হাতটা গলার দিকে এগিয়ে নিলো। মেহনূর স্থির নয়নে তাকিয়ে থাকলেও মাহতিমের উষ্ণ নিশ্বাসগুলো গভীরভাবে ওর মুখের উপর পরছিলো। মেহনূর এবার একদম চোখ বন্ধ করলো না, করলো না একটাই কারন, সে নিজের বাকচিন্তায় ছিলোনা। নিজেকে ওইমূহুর্তে ললিতার জায়গায় মনে হচ্ছিলো। সেই তপ্ত নিশ্বাসের উর্ধ্বশ্বাস ক্ষণেক্ষণে মনের আঙিনায় ছুটে বেড়াচ্ছিলো। মাহতিমের কন্ঠ-স্পর্শ-ঘ্রাণে মেহনূর পুরোপুরি বশবর্তী হয়ে গেছে। মাহতিমের গায়ের নিজস্ব ঘ্রাণ তীব্রভাবে টের পাচ্ছে, কানে ওর কোমলমিশ্রিত ঠান্ডা সুর ক্ষণেক্ষণে শুনছে, হিম-শীতল স্পর্শের ভেতর মেহনূর পুরোপুরি জড়িয়ে গিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। সময় হুরহুর করে পেরিয়ে গেলেও শেখরের মতো ওষ্ঠসিক্ত করলো না মাহতিম। অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেলেও ঠোঁটের মাঝে ঠোঁট ডুবিয়ে অধরজোড়া আঁকড়ে ধরলো না। মেহনূরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতেই আবারও নিচুসুরে ঠান্ডা কন্ঠে বলে উঠলো,
– আমার দেহের উপর ছোট্ট শরীরটা না পাওয়া পযর্ন্ত স্বস্তি পাবো না।
– চলবে
#FABIYAH_MOMO
#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_২৩.
#ফাবিয়াহ্_মমো.
অংশ ০১.
– আমার দেহের উপর ছোট্ট শরীরটা না পাওয়া পযর্ন্ত স্বস্তি পাবো না।
কথাটা শোনার পর শরীর ঝিমঝিম করে উঠলো মেহনূরের। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই মাহতিম ওর স্তব্ধ অবস্থা দেখে একটুখানি হাসলো। গলা থেকে হাত সরিয়ে পানি থেকে উঠে দাঁড়ালো। গুটানো প্যান্টটা নিচে নামিয়ে মেহনূরের কোল থেকে ঘড়িটা নিয়ে পকেটে রাখলো। মেহনূর এখনো বাকরুদ্ধ অবস্থায় চেয়ে আছে। বাইরে শান্ত হয়ে গেলেও ভেতরে তখন লন্ডভন্ড করা ঘূর্ণিঝড় চলছে। মাহতিম ওর কাছে এসে আবার দুহাতে কোলে তুলে নিলো। মেহনূরের হতভম্ব দৃষ্টিটা মাহতিমের মুখ আঁকড়ে রেখেছে। সেই দৃষ্টি যে নামানো উচিত মেহনূরের মধ্যে সেই চিন্তাটুকু নেই। মাহতিম খুব সাবধানে কাদা বাঁচিয়ে রেসোর্টের দিকে এগুতে লাগলো। জঙ্গলের ডানদিকের রাস্তাটা কটেজের দিকে ঢুকেছে, বামদিকের রাস্তাটা সোজা মাঠের দিকে। মাহতিম হাঁটতে-হাঁটতে সামনের দিকে তাকিয়ে মেহনূরের উদ্দেশ্যে বললো,
– কোথায় নিয়ে যাবো? মাঠে ওদের কাছে বসবে? নাকি কটেজে যেয়ে শাড়ি পাল্টাবে?
মেহনূর প্রশ্নটা স্পষ্টভাবে শুনলো ঠিকই, কিন্তু মাহতিমের উপর থেকে নির্বাক চাহনি সরাতে পারলো না। উত্তরের জন্য মুখের জড়তা এখনো যেনো কাটছেনা। মেহনূর কোনো কথা বলছেনা দেখে মাহতিম এবার পা থামালো। মেহনূরের দিকে দৃষ্টি দিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বললো,
– চলো, কটেজে নিয়ে যাই। তোমার শাড়িতে এখনো কাদা লেগে আছে। এই অবস্থায় ওখানে বসলে তোমারই অস্বস্তি লাগবে। শাড়িটা পালটে এরপর তুমি মাঠে এসো।
মাহতিম কথাটা শেষ করে কয়েক সেকেন্ডের জন্য ওর দিকে তাকালো। কিন্তু উত্তরের পাট এবারও চুকালো না মেহনূর। সেইযে থম মারা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো, সেই দৃষ্টি এখনো পুরোপুরি কায়েম আছে। মাহতিম ভালোভাবে বুঝতে পারলো, মেহনূর ওর কথার মর্ম ধরতে পেরেছে। এজন্যই মেহনূর করে চুপ আছে। মাহতিম কটেজের রাস্তাটাই ধরলো। এদিকে ঝোঁপঝাড় থেকে বিভিন্ন সুরে পোকার ডাক আসছে। ঝিঁঝিপোকাও ঝিঁঝি করে কান লাগিয়ে দিচ্ছে। বৃষ্টির কারণে কর্দমাক্ত জায়গাটা গ্রাম্য-গ্রাম্য সুভাষ ছড়াচ্ছে। মাহতিম শুকনো জায়গায় পা ফেলে সামনে এগুতেই হঠাৎ কানে অদ্ভুত একটা শব্দ হলো! শব্দটার অদ্ভুতত্ব এতোই বেশি ছিলো যে মাহতিম তৎক্ষণাৎ পা থামিয়ে চারপাশে তাকালো। চাঁদের আলো ম্লান হয়ে এসেছে এখন। স্পষ্ট করে কিছুই এখন দেখা যাচ্ছেনা। শ্রবণ ইন্দ্রিয় সজাগ থাকার কারনে পায়ের আওয়াজ সুক্ষ্মভাবে পাওয়া যাচ্ছে। এখানে কেউ তো আছে, কেউ তো গা বাঁচিয়ে লুকিয়ে-লুকিয়ে ওদের দেখছে। মাহতিম চোখ ছোট করে ভ্রুঁ কুঁচকে আড়চোখে একবার ডানে তাকালো, আরেকবার একই ভঙ্গিতে বামে তাকিয়ে দেখলো। মনের ভ্রম ভাবার মতো ভুল ওর হয়না। মন যেটা বলছে নিশ্চয়ই সেটার আভাস এখন কোথাও-না-কোথাও আছে। কিন্তু প্রমাণ যেহেতু নেই, তার উপর মেহনূর এখন সাথে, তাই সন্দেহ দূর করার চিন্তাটা আপাতত মাথা থেকে ঝাঁড়লো। মেহনূর ওর আচমকা পরিবর্তনটা দেখে নিজেও চারদিকে তাকালো, কিন্তু কিছুই দেখতে না পেয়ে চুপ করেই রইলো। মাহতিম যে রাস্তাটা দিয়ে এসেছে সেটা কটেজের পেছনের দিকে, তাই মাঠে আড্ডারত কেউ ওদের দেখলো না। মাহতিম সিড়ি ডিঙিয়ে কটেজে ঢুকলো ঠিকই, কিন্তু মেহনূরের রুমে আর গেলো না। দরজার প্রবেশমুখে নামিয়ে দিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। মেহনূর একটা ভারী নিশ্বাস ছেড়ে পা ঘুরিয়ে রুমের ভেতরে ঢুকে গেলো। অন্ধকারে কিছু দেখা না গেলেও আন্দাজের উপর ভিত্তি করে টেবিল থেকে মোমবাতি জ্বালালো। চুলগুলো শক্ত করে খোপায় বেধেঁ ব্যাগ খুলে শাড়ি নিলো। ভালো করে দরজাটা চাপিয়ে দিলো। শাড়ি পালটানোর জন্য কাধের সেইফটি পিনটা খুলবে ওমনেই খুট করে শব্দ হলো একটা। মেহনূর শব্দটাকে ইঁদুরের শব্দ ভেবে পিন খুলায় মনোযোগ দিলে পিছু ফিরে তাকালো না। দিকে চাপানো দরজাটা ধীরে-ধীরে খুলে যাচ্ছে, সেদিকে মেহনূরের খেয়াল নেই, সে শাড়ির কুচির খুলছে। আধো অন্ধকারে দরজাটার ফাঁক দিয়ে কালো ছায়া রুমে ঢুকছে। সেই ছায়াটা কার এখনো সেটা পরিদৃষ্ট না। মেহনূর কুচির কাছে ছোট্ট পিনটা খুলে সবগুলো কুচি টান মারলো আর তখনই দরজাটা সম্পূর্ণ খুলে দপ করে মোমবাতিটা নিভে গেলো। ঘটনার আকস্মিকতায় লোমহর্ষক কাহিপীর মতো চমকে উঠলো মেহনূর! হাতটা মুঠো হয়ে কুচিগুলো খামচে ধরলো। চটপট মাথা ঘুরিয়ে পিছু ফিরে তাকালে দরজাটা একদম খোলা দেখলো। অথচ একটু আগে দরজাটা ভালোভাবে চাপা দিয়ে রেখেছিলো, যদিও ছিটকিনি আটকায়নি, কিন্তু ছিটকিনি দেওয়ার আবশ্যকতাও নেই। চাদের আলোটা একদম ফিকে হয়ে যাওয়ার জন্য অমাবস্যা রাতের মতো অন্ধকার হয়ে আছে। মাঠ থেকে সবার হাসিঠাট্টা বাতাসের সাথে এখানেও আসছে। মেহনূর ভয় ভয় গলায় প্রশ্ন করলো,
– কে?
কোনো উত্তর এলো না। আবার জিজ্ঞেস করলো ‘ কে ওখানে ‘, তবুও কোনো শব্দ হলো না। মিনিট দুয়েকের মতো থমথমে অবস্থায় শক্ত হয়ে রইলো মেহনূর, এরপর কুচিগুলো আগের জায়গায় গুঁজে আচঁল দিয়ে পুরো শরীর ঢেকে নিলো। শব্দহীন ভঙ্গিতে পা ফেলে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো, প্রবেশদ্বারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে বাইরে উঁকি দিলো, আশেপাশে কেউ নেই। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এখানে কেউ ছিলো। চাপানো দরজার বাইরে দাড়িয়ে কেউ সত্যিই দাড়িয়েছিলো। মেহনূর নিরুত্তেজ ভঙ্গিতে ভেতরে ঢুকে আবার মোমবাতি জ্বালালো, দরজাটা পুনরায় চাপানোর জন্য এগিয়ে এলো। কিন্তু চাপানোর সময় মেঝের দিকে তাকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। কর্দমাক্ত দুটো পায়ের ছাপ সাদা টাইলসের উপর পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
.
ভোর সকালে ঘুম থেকে উঠলো সবাই। মিষ্টি সকালের শান্ত প্রকৃতি দেখে সবার মন চনমনিয়ে উঠলো। সামিক প্রীতিদের নিয়ে পুকুরঘাঁটে ছবি তুলতে গেলো। সৌভিক গেলো নদীতীরে কিছু দারুণ মূহুর্ত উপভোগ করতে। মাহদি ঘুম থেকে উঠেনি দেখে মাহতিম বেরিয়ে এলো কটেজ থেকে। ফ্রেশ হয়ে গায়ে ডার্ক সবুজের টিশার্ট পরে স্যাপারেট কটেজটার দিকে এগিয়ে এলো। সেখানে দূর থেকে দেখা যাচ্ছে মেহনূর ছোট গোলটেবিলে বসে আছে। ক্রিম কালারের সাদামাটা শাড়ি পড়নে, ব্লাউজটা কালো। মাথায় কোনো সিঁথি নেই, সামনের চুলগুলো সব পেছনে টেনে সুন্দর করে চুল বেধেঁছে। ডানদিকে একটা খেজুর বেণী কোল থেকে মেঝের দিকে ঝুলছে। মাহতিম ততক্ষণে কটেজে ঢুকে ওর মুখোমুখি হয়ে বসলো। চেয়ার টানার শব্দ হলে মেহনূর বই থেকে মুখ তুলে সামনে তাকালো। মাহতিমকে দেখে কোনো বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখালো না। শান্ত মুখে স্বাভাবিক চাহনিতে ফের বইয়ের দিকে মনোযোগ দিলো। মাহতিম দুটো হাত টেবিলের উপর উঠিয়ে আঙ্গুলে-আঙ্গুল মিলিয়ে মুঠো করলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে শান্ত সুরে বললো,
– কাল চলে যাচ্ছি।
বইয়ের উপর রাখা ছোট হাতটা একটু যেনো কেঁপে উঠলো। মাহতিম সেটা আড়চোখে খেয়াল করলো কিনা বুঝা গেলো না। কিন্তু মেহনূর খুব শক্ত হয়ে বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। টেবিলের উপর থাকা সিরামিকের সাদা কাপে চা রাখা ছিলো, সেই চা থেকে থেকে এঁকেবেঁকে ধোয়া উঠছে। মাহতিম আকাশের দিকে উদাস চাহনিতে তাকিয়ে আছে। বুকের ভেতর থেকে চাপা নিঃশ্বাসগুলো শব্দ করে ছেড়ে দিচ্ছে। আজকের রাতটুকু পযর্ন্ত সময় আছে, এরপর সবকিছু গুছিয়ে আসল জায়গায় ফিরে যেতে হবে। আজ রাতেই কনফার্ম করতে হবে, মাহতিম কাল বিকেলে ফিরছে কিনা। মেহনূর বইয়ের একটা পাতা উলটাতেই হাত এগিয়ে কাপের হ্যান্ডেলটা ধরলো। হ্যান্ডেলটার ভেতর তর্জনী আঙ্গুল ঢুকিয়ে কাপটাকে তুলে নিলো। শুষ্ক গলায় চায়ের উষ্ণতা ঢালতে ঠোঁটের কাছে কাপ ছোঁয়ালো, ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে কাপটা আগের জায়গায় রেখে হ্যান্ডেল ছেড়ে দিলো। মাহতিম ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে হেঁয়ালি সুরে বলে উঠলো,
– চায়ে চুমুক দেওয়া ঠোঁটদুটোর জন্য আশেপাশে কেউ অপেক্ষা করছে।
কান দিয়ে গরম ধোয়ার মতো অনুভব হলো মেহনূরের। তৎক্ষণাৎ নিজেকে লজ্জার রেশ থেকে লুকানোর জন্য বৃথা চেষ্টা হিসেবে চোখ বন্ধ করে ফেললো। নিচের ঠোঁটটা দাঁতে কামড়ে অনড় হয়ে রইলো। মাহতিম এবার ওর দিকে চোখ তুলে হালকা একটা হাসি দিলো। মেহনূরের এমন ভাবভঙ্গি দেখে দারুণ মজা লাগছে। ওকে আরো অস্বস্তিতে ফেলার জন্য মাহতিম ছোট্ট বুদ্ধি খাটালো। চায়ের কাপটা শব্দ করে নিজের দিকে টানলো। টেবিলের উপরতলা ঘেঁষে-ঘেঁষে কাপ নেওয়ার শব্দ হলে মেহনূর চোখ খুলে তাকালো। মাহতিমের দিকে ড্যাবড্যাবে চাহনিতে তাকালে মাহতিম ততক্ষণে কাপটা তুলে নিলো। সাদা কাপটার যেদিকটায় মেহনূর চুমুক দিয়েছিলো, মাহতিম সেদিকটায় গাঢ় করে ঠোঁট বসিয়ে চুমুক দিলো। তৃপ্তির মতো আভাস ফুটিয়ে চোখদুটো বন্ধ করে ফেললো। পরপর দুটো চুমুক দিয়ে কাপটা নিচে রাখলো। মাহতিম সেই কাপটার দিকে অন্যমনষ্ক ভঙ্গিতে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো,
– কাল থেকে একটা কথাও তুমি বলোনি। ইভেন এখনো তুমি সাইলেন্ট হয়েই আছো। হয়তো তোমার চুপটি আমাকে অনেককিছু বলে দিচ্ছে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, আমি এটা মানতে পারছিনা। কাল বিকেলের ফ্লাইট বুক করবো। আজ রাতের মধ্যে কিছু একটা মুখ ফুটে বলে দিও। আমি শুধু ওই প্রশ্নটার জবাব চাইবো। আর কিছু আমার জানার ইচ্ছা নেই।
চায়ের কাপটা ছেড়ে চেয়ার থেকে উঠলো মাহতিম। মেহনূরের মুখের দিকে শুধু একবার তাকালো। ওর নিরব চাহনির আড়ালে যে উত্তরটা খেলা করছে, সেটা ওকে মুখ ফুটে বলতেই হবে। মাহতিম আর দাঁড়ালো না, যে চায়ের কাপটা টেবিলের উপর রেখেছিলো সেটা সুযোগ মতো হাতে নিয়ে কটেজের বাইরে পা রাখলো। পিছু ফিরে তাকালো না।
.
সূর্যটা মধ্যগগণের সময় পার করছে। সূর্যের তেজোবর্ধক দাপটে মাঠের ঘাসগুলো তেলতেলে ভাব হারিয়ে ফেলছে। গাছের পাতাগুলো তপ্ত হয়ে আছে বেশ। সৌভিক সবাইকে নিয়ে পুকুরঘাঁটের শানে বসে আলাপ শুরু করলো। আজকের আলাপের মূখ্য বিষয় হলো মেহনূরকে যেভাবেই হোক আজকের মধ্যে টাইট দিতে। যদি মেহনূর টাইটেও সোজা না হয়, তাহলে নিরুপায় হয়ে ওকে অনুনয় করে মাহতিমের ছুটি বাড়ানোর অনুরোধ করতে বলবে। এ কথা শুনে নীতি বিরস মুখে বললো,
– ওর মতো শক্ত মেয়ে আমি দেখিনি সৌভিক ভাই। ও যত ছোট হোক না কেনো, ও বড়দের অবস্থাও হার হারিয়ে দিয়েছে। আমিতো ভাবতেই পারছিনা ও এখনো মাহতিম ভাইয়ের প্রতি ফিল করেনা।
নীতি কথাটা শেষ করতে না দিয়ে সামিক এবার বললো,
– নীতি, তোর একটা জিনিস বুঝা উচিত ওর জন্য এসব নতুন। তার উপর গ্রামের পরিবেশে বড় হয়েছে। এখানে এসব ফ্যাক্ট শহরের মতো আপডেটেড না। ওর যদি ফিল এসেই যায় সেটা কি ও প্রকাশ করবে?
সামিকের কথা নীতি প্রচণ্ড ক্ষেপাটে আচরণ করলো। রাগ দেখিয়ে গমগম গলায় বলল,
– ওর চেয়ে চার মাসের বড়টা হাত-পা তুলে ইজ্জত লুটাচ্ছে, আর ও কিনা টেপ মেরে বাবু সেজে আছে? আমার এসব একদম সহ্য হচ্ছেনা, একদম সহ্য হচ্ছে না! ও যদি সন্ধ্যার মধ্যে ভাইকে কিছু না বলে ওর গলা আমি টিপে ধরবো! আমার ভাইকে রিজেক্ট করবে এরকম মেয়ে আমি সহ্যই করবো না।
নীতির উড়নচণ্ডী রাগ দেখে সৌভিক ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– কুল কুল নীতি, ঠান্ডা হ। আমি বুঝছি তো তুই মাহতিমের কাহিনী নিয়ে চেতে যাবি। তোর কি মনেহয় আমাদের সাহেববাবু হাতপা গুটিয়ে আছে? নারে পাগলী। মাহতিম ঠিকই ট্রামকার্ড ফেলে ওকে বুঝানোর চেষ্টায় আছে। ও ঠিকই আমাদের না দেখিয়ে কাজ সেরে ফেলছে।
সৌভিকের কথায় একটু শান্ত হলো নীতি। কিন্তু পুরোপুরি তেজটা আর কাটলো না। নীতির গরম মেজাজটা ঠান্ডা করার জন্য ফারিন মাঝখান থেকে বলে উঠলো,
– নীতি আপু, আমার গাট ফিলিং বলছে মেহনূর আমাদের ভাইকে রিজেক্ট করার সাহস পাবেনা। ভাই যার সামনে দাড়িয়েছে সেই মেয়ে কখনো দ্বিতীয়বার চোখ নিচু করেনি। আমরা যখন সামারের ছুটিতে দেশে আসতাম, তখন ভাই আমাদের পার্ক-চিড়িয়াখানায় নিয়ে যেতো। ওখানে ঘুরতে গেলে কি হতো মনে আছে? সেতো আপুকে নিশ্চয়ই মনে আছে? ভাইয়া হাসিখুশি স্টাইলে যদি কনা আপুর মতো মেয়েকে হ্যান্ডেল করতে পারে, এখানে মেহনূর তো একদম মাসুম।
কনা নামটা শুনে সিয়ামের চোখদুটো চকচক করে উঠলো। ফারিনের কথায় দাড়ি বসিয়ে চট করে প্রশ্ন করলো,
– কনা-টা সূর্বণা আন্টির ভাতিজি না?
ফারিন শান্ত ভঙ্গিতে জবাব দিলো,
– হ্যাঁ, সূর্বণা আন্টির ভাতিজি। তুমিতো ওকে চিনোই। ও যে সূর্বণা আন্টির সাথে বেহায়ার মতো থাকে, সেটাতো তুমি জানো না। ভাই ছুটি পেলে এজন্যই বাসায় ফিরতে চায়না। এবারও চায়নি।
ফারিনের কথায় সবাই কিছুক্ষণ চুপ থাকলে তৌফ হঠাৎ বলে উঠলো,
– দেখ ভাই, আমার এইসব বুইঝা লাভ নাই। পল্ট্রি মুরগী যদি সন্ধ্যার মধ্যে হু-হা কিছু না করে আমি নিজেই জানিনা ওরে কি করুম। এদিকে মাহতিম হালা এমন ভাব মারাইতাছে গায়ের রক্ত শুদ্ধা টগবগ কইরা জ্বলতাছে।
তৌফের অবস্থা দেখে সৌভিক এক ধমক দিলো। ধমকে কাজ হলো না, উলটো বকবক করতেই থাকলো। মাহতিমের ব্যাপারে অনর্গল কথাগুলো বলতেই সাবির এবার প্রশ্ন করে বললো,
– ভাই তোমার সাথে এমন কি বলছে যেটা শুনে তুমি এমন কথা বলছো?
তৌফ ভ্রুঁ কুঁচকে কাঠিন্য মুখে বললো,
– তুই শুনবি কি কইছে?
সাবির কপট ভঙ্গিতে বললো,
– অবশ্যই শুনবো। শুনবো না ক্যান?
এবার তৌফ ঘাঁটের পাটাতনে আসন করে বসলো। এমন একটা ভঙ্গি করলো যেনো ওরা সবাই শিষ্য, আর ও একজন গুরু। তৌফ জম্পেশ একটা ভাব নিয়ে গলা শক্ত করে বললো,
– ওয় বলে চুমাইতে চুমাইতে ওর বউরে মাইরা ফেলবো। এখন বলতো এগ্লা কি ভালো মানুষের কথা? এগুলা যদি আমাদের সামনে খুল্লাম-খুলা বইলা দেয় তাইলে মান-ইজ্জত তো লুঙ্গির নিচেও থাকতো না।
তৌফের মুখে এমন কথা শুনে কিছুক্ষণ পিনপতন নিরবতা চললো। এরপর একযোগে উচ্চস্বরে ভয়াবহ হাসির রোল উঠলো। হাসতে-হাসতে সবাই নিঃশব্দ হয়ে গেছে, ফারিন হাসতে গিয়ে মাটিতে বসে পরেছে। নীতি চোখ দিয়ে পানি বের করে প্রীতির কাধে মুখ লুকিয়ে ফেলেছে। সৌভিক হোহো করে হাসতেই তৌফের মাথায় জোরে একটা চাট্টি মারলো। চাট্টিটা মেরেই হাস্য অবস্থায় বললো,
– তুই এমন কি বলছিলি বলতো? কি বলছিলি যার জন্য মাহতিম এমন উত্তর দিছে?
তৌফ ভ্রুঁদুটো ভীষণ কুঁচকে রাগত গলায় বললো,
– ওরে আমি কি বলতে যামু? শালার চিন্তা ভাবনাই অশ্লীল! খালি বলছিলাম, তুই তো শালা রোমান্টিক না। বউরে তো আদর মহব্বত করতে পারবিনা। এরপর বাকিটা ইতিহাস বানায়া ফেলছে।
তৌফের কথায় হাসি থামায়ে সিয়াম বলে উঠলো,
– তুই কি ভাবছোস? তোর এমন প্রশ্ন শুইনা ওয় তোরে কোলে বসায়া গালে চুমু খাইবো? তোর মাইন্ড একনাম্বার খাসড়া, ওরে ক্যামনে অশ্লীল বলোস ছাগলের বাচ্চা ছাগল!
সিয়ামের কথায় চটে উঠলো তৌফ। চোখ রাঙিয়ে খারাপ কিছু বলবে ওমনেই সৌভিক নিজের কথা ঝুলিয়ে বললো,
– যার ব্যাপার নিয়ে তোরা আজাইরা কাহিনী করছিস, ওর আসল রূপ বিয়ের পরেই দেখিস। এখন খালি অফ থাক্। প্রে করতে থাক, মেহনূর যেনো যে করেই হোক, ওর কথাটা মাহতিমের কাছে স্বীকার করে।
সৌভিকের কথায় সায় মিলিয়ে চুপ হয়ে গেলো সবাই। নিজেদের সভা ভঙ্গ করে বিকেলের জন্য প্রস্তুত হলো। দুপুরে গোসলের জন্য গোসল করতে গেলে মেহনূরের কপালে ভাঁজ পরলো। বিকেলের ছোটখাটো পার্টির জন্য লাল যেই শাড়িটা বের করেছে, সেটার সাথে ব্লাউজ আনতে ভুলে গেছে মেহনূর। লাল শাড়ির লাল ব্লাউজটা তন্নতন্ন করে খুজেঁও পেলো না। এদিকে সাবা-শানাজ-সুরাইয়ার গোসল শেষ হয়ে শাড়ি পরেও রেডি। মেহনূর শানাজের রুমে গিয়ে দেখলো তিনবোন সেখানে বিকেলের জন্য এখুনি রেডি হয়ে নিচ্ছে। বিকেলে একটা জমজমাট ‘ গ্রিল-পার্টি ‘ নদীতীরে হবে। বালুর উপর গ্রিল হবে মুরগী, সেখানে গাছের গুড়ি সাজিয়ে গোল করে বসার সিস্টেম, সঙ্গে থাকবে সাথে আনা মিউজিক ইন্সট্রুমেন্ট। আজকের পার্টিটা চমৎকার করার জন্য সবাইকে বর্ণিলরূপে সেজে আসতে বলা হয়েছে। এদিকে শানাজ-সহ বাকি দুজন মেহনূরের ব্লাউজ না আনার ঘটনা শুনে নিজেদের ব্যাগ খুলেছে। শাড়ির সাথে পড়ার জন্য লাল ব্লাউজ তো নেই, উলটো যেই ব্লাউজ আছে সেটা শাড়ির সাথে যাবেনা। সাবা নিজের ব্যাগ থেকে কালো রঙের লাল রঙের ব্লাউজ বের করলো। সেই ব্লাউজের চেহারা দেখে মেহনূর মুখ ঘুরিয়ে ফেললো। সাবা ওকে সুন্দর করে বোঝালো ব্লাউজটা পরে একদম খারাপ লাগবেনা। মেহনূর তবুও ওর কথা আমলে নিচ্ছেনা। মেহনূরের শাড়িটা কালো রঙের জামদানী শাড়ি, সেই শাড়িটার উপর কালো সুতার সুক্ষ কাজ করা। সেই শাড়িটার সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ কালো রঙের ছিলো, যেটা সে ব্যাগে তুলতে ভুলে গেছে। সাবা যেই ব্লাউজটা দিয়েছে শানাজ সেটাই ওকে ধমক-ধামকে পরার জন্য বলে দিয়েছে। এখানে নিশ্চয়ই অপরিচিত কেউ না, সবাই খুব কাছে মানুষ, তার চেয়ে বড় কথা এরা আত্মীয়। মেহনূর মুখ ফুলিয়ে ব্লাউজ নিয়ে নিজের রুমে চলে এলো। দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে ব্লাউজটা দুহাতে চোখের সামনে মেলে ধরলো। লাল রঙের মখমলের ব্লাউজটা যদিও সুন্দর, কিন্তু এর পিঠের দিকে ফিতা সিস্টেম। ক্রস-ক্রস করে দুপাশের ফিতা বেধেঁ ব্লাউজটা পড়া লাগে। স্লিভদুটো কনুই পযর্ন্ত আসবেনা। মেহনূর এই ব্লাউজ পরবে কিনা এটা নিয়ে মারাত্মক দ্বিধাগ্রস্তে ভুগতে লাগলো। সাড়ে চারটার দিকে আয়োজন শুরু হওয়ার কথা, অথচ ঘড়িতে চারটা বাজতে চললো। প্রায় দেড়ঘন্টা ওই ব্লাউজ নিয়ে বসে থাকতেই শেষমেশ পরার চিন্তাই শক্ত করলো। পাকা হাতে দ্রুততার সাথে শাড়ি পরে নিলো মেহনূর। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কুচিগুলো নিচের দিকে ঠিকঠাক করে নিলো। দীর্ঘ কেশগুলো মোটা দাঁতের চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে পিঠ ছেড়ে দিলো। মাথার ডানদিকে একটা সিঁথি তুলে দুদিকের কানে চুল গুঁজে রাখলো। এমন সময় দরজায় তখন ঠকঠক করে কড়া নাড়লো। মেহনূর আয়না থেকে চোখ সরিয়ে দরজার দিকে তাকালো। আসার জন্য অনুমতি দিতেই শানাজ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। কিন্তু কিছু বলার জন্য যেই ঠোঁট নাড়াবে ওমনেই দরজা ধরে বিষ্ময় চাহনিতে থমকে গেলো শানাজ।
– চলবে
#FABIYAH_MOMO
#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_২৩.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
অংশ – ০২.
হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকতেই শানাজ ধীরগতিতে রুমের ভেতরে ঢুকলো। মেহনূরের সামনে এসে আশ্চর্য দৃষ্টিতে আপাদমস্তক দেখতে থাকলো। শানাজের এমন কীর্তিকলাপ দেখে মেহনূর প্রচুর অস্বস্তি বোধ করছিলো। শানাজ মিনিট খানেক শুধু বিষ্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো, মুখে কোনো কথা বললো না। মেহনূর ওর অবস্থা দেখে নিজেই আড় ভেঙ্গে বলে উঠলো,
– তুমি কি এভাবেই তাকিয়ে থাকবে বুবু? আমার তো অস্বস্তি হচ্ছে।
মেহনূরের কথায় নিজের বিষ্মিত ভাব একটু যেনো কমলো। তবুও পুরোপুরিভাবে সেটা গেলো না। শানাজ কাছে এসে মেহনূরের কাধদুটোতে হাত রাখলো, স্নেহ দৃষ্টিতে ওর মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকতেই শান্ত সুরে বললো,
– তোকে যদি এই রূপে আম্মা আর ছোট মা দেখতো, পাগলের মতো খুশী হতো মেহনূর।
শানাজের অম্লান কথায় ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো মেহনূর। নিরবতা আঁকড়ে ধরলো ওকে। মেহনূরকে নিঃশ্চুপ দেখে শানাজ ওর কাধ থেকে হাত সরিয়ে ফেলে। মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে রুম থেকে যেসব সাজগোজের সামগ্রী এনেছিলো, সব ড্রেসিংটেবিলের উপর রাখে। বেছে বেছে লাল রঙের লিপস্টিক পছন্দ করে, কানের জন্য সোনালী টপ, দুহাতে পরার জন্য লাল কাঁচের রেশমী চুড়ি, চোখের জন্য কালো কাজল। শানাজের আনা জিনিস দেখে তৎক্ষণাৎ ঘাবড়ে যায় মেহনূর। সাজার জন্য বারবার দ্বিমত পোষণ করে মুখ কুঁচকাতে থাকে, কিন্তু শানাজের বেপরোয়া জোড়াজুড়িতে মেহনূর বাধ্য হয়ে সাজে। শানাজ ওর সাজগোজ শেষ করে সঙ্গে নিয়ে যায়। নদীতীরে যাওয়ার জন্য কটেজের বাইরে আসে। আশেপাশে কেউ নেই, সবাই ইতিমধ্যে নদীতীরে চলে গেছে। খালি রেসোর্টটা নিরবতার দখলে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। শানাজের পিছু-পিছু মেহনূর যেতে থাকে। শানাজের পড়নে কমলা রঙের তাঁতের শাড়ি, কমলা রঙের ব্লাউজ। চুলগুলো খোপায় গুঁজা, কানের ডানপাশে একটা হলুদ গাদা ফুল। মেহনূর ওর পিছু পিছু কাঙ্ক্ষিত জায়গাটায় চলে এলো। সেখানে আসতেই দেখতে পেলো নদীর কাছে বালুময় জায়গাটা বিকেলের আলোতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। সকলের পরিকল্পনা মতে, গাছের গুড়িগুলো গোল করে সাজানো আছে, মাঝখানে ক্যাম্পফায়ার জ্বলছে, সেখান থেকে একটু দূরে গ্রিল পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। নীতিরাও আজ শাড়ি পরেছে শানাজদের দেখাদেখি। ওদের কাছ থেকে তিনটে শাড়ি নিয়ে নীতি-প্রীতি-ফারিন একসঙ্গে পরেছে। শাড়ি পরানোর পুরো কাজটাই সাবা করে দিয়েছে। সুরাইয়া অন্যান্য দিনের মতো আজ মুখ ফুলিয়ে নেই, প্রাণবন্ত হাসিতে সাবিরের সাথে গ্রিলের জিনিস আনা-নেওয়া করছে। ছেলেদের পড়নে ফর্মাল গেটআপ। শার্ট-প্যান্ট পরার আইডিয়াটা সৌভিক সিলেক্ট করেছে। নীতি তন্মধ্যে ঘোষণা দেয় পার্টির জন্য সবাই উপস্থিত হয়েছে, এখন পার্টি শুরু করতে কোনো বাধা নেই। সত্যিই ঘোষণার পাঁচ মিনিটের মধ্যে সবাই গাছের গুড়িতে বসে পরলো। মেহনূর-নীতি-মাহদি একটা গুড়িতে বসলো, শানাজ-সৌভিক-প্রীতি অপরটায়, সাবা-ফারিন-তৌফ তার পাশেরটায়, ঠিক এমন করে সবাই গুড়িগুলো দখল করে বসলো। এদিকে মাহতিম ম্যানেজারের সাথে টুকটাক কথাগুলো সারার জন্য রেসোর্টে চলে গিয়েছিলো। হাতে একটা কোকের ক্যান নিয়ে মোবাইলে কাজ করতে-করতে নদীতীরে ফিরছিলো। আড্ডার আমেজ যতো বাড়ছে, ততোই শোরগোল ভেসে আসছে। মাহতিম সেই শোরগোলের সূত্র ধরেই ক্যানে চুমুক লাগিয়ে এগুতে থাকলো। ফোনের স্ক্রিনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু মেইল চেক করছিল, কিন্তু ঠিক ওই সময় তৌফের হোহো হাসির জন্য মুখ তুলে সামনে তাকালো। খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকিয়ে এরপর চোখ নামিয়ে ফেললো। হঠাৎ কিছু আশ্চর্য জিনিস দেখার মতো হড়বড় করে ফের তাকালো মাহতিম! ওমনেই চোখদুটো স্থির করে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। ক্যানে চুমুক দেয়া তো দূরের কথা, হাঁটাও থামিয়ে ফেললো মেহনূরকে দেখে। ঝিমঝিম করে সমস্ত শরীরে যেনো ঝড় বয়ে যাচ্ছে! উত্থাল-পাত্থাল জলোচ্ছাসের মতো তীব্র ঝাপটা বুকের উপর আছড়ে পরছে! এ কি দেখলো চোখের সামনে? কাকে দেখলো এই মূহুর্তে? কে বসে আছে এমন সাজে? একে-একে অনেকগুলো প্রশ্ন মাহতিমের সচল মস্তিষ্কে ঘুরঘুর করতে থাকলো। মাহতিম স্থির হয়ে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে থাকলে হঠাৎ আড্ডার মাঝখানে মেহনূরের চোখ মাহতিমের দিকে পরলো। দুজনের অবস্থা থমকে যাওয়া মূহুর্তের মতো আঁটকে গেলো। মেহনূর এতোক্ষন যেই অস্বস্তিটা কাটিয়ে উঠিয়েছিলো, হঠাৎ সেই অস্বস্তিকর অবস্থাটা আবার জেঁকে ধরলো। গলা শুকিয়ে পানির জন্য পিপাসিত হয়ে উঠলো। মাহতিমের চাহনি, মাহতিমের লুক কোনোটাই সহজভাবে নেওয়ার মতো না। আজ লোকটা সেই প্রথমদিনের মতো নিজেকে রেডি করেছে। সেই কালো শার্ট দিয়ে পেশিবহুল শরীরটা ঢেকে রেখেছে। কালো প্যান্টের সাথে কালো শার্টটা সেদিনের মতো বেল্ট দিয়ে ইন করেছে। স্লিভও তুলে রেখেছে কনুইয়ের দিকে। শুধু পরিবর্তন এনেছে শার্টের বোতামের মধ্যে। উপরের দুটো কালো বোতাম দেদারসে খুলে রেখেছে, সেই খোলা অংশ দিয়ে দেখা যাচ্ছে তার উজ্জ্বল বুক। ক্যান ধরা হাতটায় ঘড়ি না থাকলেও কেনো জানি ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। তার হাতের নীল রগগুলো উজ্জ্বল চামড়ার উপর দাম্ভিকতার মতো ফুলে আছে, গালদুটো আজও ক্লিন-সেভ করা। পশ্চিমের হেলে পরা সূর্যটা যেই কমলাভ আলো দিচ্ছে, সেই আলোটা সম্পূর্ণরূপে মেহনূরের মুখটায় পরেছে। মায়াকাড়া শান্ত চোখদুটো কাজলের ছোঁয়ায় ফুটে আছে। চোখদুটো দিঘির সেই কালোজলের মতো গভীর লাগছে। সেই গভীরতায় ডুবে যেতে পারলে জীবন যেনো ধন্য লাগবে, আরো ধন্য। কমলা আভার ঠোঁটদুটো যেই রঙে ঢেকে আছে, সেই লাল টুকটুকে রঙটা মাহতিমকে ঘায়েল করার জনৌ যথেষ্ট। মাহতিম ওই কাঁপা-কাঁপা ঠোঁটের দৃশ্য দেখে তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ করে ফেললো। মাথাটা নিচে নামিয়ে জোরে দুবার নিশ্বাস ছাড়লো। তুমুল অস্থিরতাকে কেন্দ্র করে যে ঝড়ো অবস্থাটা ভেতরে-ভেতরে চলছিলো, সেটা একটু যেনো শান্ত হলো। ক্যানের মুখে আর ঠোঁট ছোঁয়াতে পারলো না মাহতিম, ক্যানটা ওভাবেই নিয়ে এসে সৌভিকের পাশে বসলো। তৌফ আর প্রীতি মাহতিমের চুপটি মুখটা দেখে মিটিমিটি হাসলো, সেই হাসিটা কাউকে বুঝতে দিলো না। মেহনূর জড়তার জন্য আবার হাসি উড়িয়ে ভার মুখে বসে রইলো, আগের মতো প্রাণখোলা হাসিতে যুক্ত হলো না। সৌভিক শেষ বিকেলের শান্ত পরিবেশে গান ধরার জন্য টস করলো। কিন্তু অপ্রকাশিত ভাবে ফলাফল এলো ‘ মেহনূর ‘। মেহনূর টসের চিরকুটে নিজের নাম দেখে প্রচণ্ড ঘাবড়ে গিয়ে সেখান থেকেই চলে যেতে চাইলো, কিন্তু নীতির তোষামোদে আর উঠলো না। মাহতিম অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ থাকলে সৌভিক এবার ফিসফিস করে ওর কানের কাছে বললো,
– দোস্ত আজকের দিনটা নষ্ট করিস না। পুরোনো ফর্মটা ধরে ফ্যাল। এটাই তোর মোক্ষম সুযোগ, কনফেস কর মাহতিম। তুই সোজাসুজি না বললেও সমস্যা নেই, দরকার পরলে ফিল্মি স্টাইলেই বল্। তবুও বল দোস্ত, চুপ থাকিস না।
সৌভিকের ফিসফিসানিতে মুখ তুলে তাকালো মাহতিম। সৌভিক মাহতিমের দিকে দৃষ্টি রেখে আবার ইশারায় তাগাদা দিয়ে ফেললো। মাহতিম কিছুক্ষণ নিরব থেকে চোখের ইশারায় গিটারটা পাস করতে বললো। সৌভিক একটা প্রাপ্তির হাসি দিয়ে সিয়ামের কোল থেকে গিটারটা নিয়ে মাহতিমের হাতে দিলো। মাহতিম কালো গিটারটা কোলে রেখে সোনালী তারে আঙ্গুল বসিয়ে টুং করে একটা শব্দ করলো। সেই ছোট্ট শব্দের কৌতুহলে সবাই নিজেদের আড্ডা থামিয়ে মাহতিমের দিকে দৃষ্টি আর্কষণ করে তাকালো। মাহতিম তখন মাথা নিচু করে গিটারের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে। আজ বহু বছর পর গিটারের তারে আঙ্গুল রেখেছে, আগের মতো সুর তুলতে পারবে কিনা সেটা নিয়ে দ্বিধাদন্ডে ভুগছে। তবুও সাহস করে আবারও গিটারের তারে টুং করে শব্দ তুললো, কিন্তু মনের ভেতর থেকে জোর আসছেনা একদম। যেই আঙ্গুল দিয়ে পিস্তর-রাইফেলের ট্রিগার চাপে, সেই আঙ্গুল এখন গিটারের তারে খুবই অযোগ্য হয়ে উঠেছে। চর্চাহীন আঙ্গুলগুলো আবারও সাহস দেখিয়ে তারের মাঝে চালাতে লাগলো, টুং টুং করে শব্দ তুলে একসময় আসল সুরটা ধরে ফেললো। চোখদুটো বন্ধ করে গলা খানিকটা ভিজিয়ে নিলো, মৃদ্যু কেশে ঠিক করলো শুষ্ক হয়ে আসা গলাটা। সবার মধ্যে প্রচণ্ড উৎকন্ঠা কাজ করছে মাহতিমের জন্য। মাহতিম আজ যেই রূপটা দেখাচ্ছে সেটা শুধু তিন বন্ধু সিয়াম-সৌভিক-তৌফ দেখেছে। ভাইবোনরা দেখার সুযোগ পায়নি। নিরিবিলি পরিবেশটা গিটারের সুরে মূর্ছিত হলে মাহতিম আস্তে-আস্তে গানের সুর তুললো। কাঙ্ক্ষিত গানটার শব্দতালে একে-একে পিয়ানো বেজে উঠলো, বাঁশির নরম সুর চলতে থাকলো, মাউথ-অর্গানের শব্দ তুললো সিয়াম-তৌফ-সামিক। সবাই বাধ্য হলো চোখ বন্ধ করে গানের মাঝে ডুবে যেতে, নিমিষেই আবদ্ধ হয়ে যায় গানের সুরে।
তাকে অল্প কাছে ডাকছি, আর আগলে-আগলে রাখছি।
তবুও অল্পেই হারাচ্ছি আবার।
তাকে ছোঁব ছোঁব ভাবছি, আর ছুঁয়েই পালাচ্ছি। তবুও তাকেই ছুঁতে যাচ্ছি আবার।
গানের গলাটা সুরের জন্য থামলো। গিটারের আওয়াজের পাশাপাশি মাউথ অর্গ্যানের নিপুণ সুরে জমে উঠলো প্রকৃতি। সবার চোখ বন্ধ হলেও মেহনূর চোখ খুলে তাকালো। আগুনের হলুদবর্ণের আলোতে মাহতিমের দিকে দৃষ্টি থামলো। মাহতিম গিটার চালানো অবস্থায় যে ওর দিকে তাকিয়ে থাকবে, সেটা চিন্তা করতে পারেনি মেহনূর। মাহতিম ওর দিকে তাকিয়ে আবারও নিজের গলা মিলিয়ে গাইতে থাকলো। গানের লাইনগুলো যেনো মেহনূরকে কাছে আসার জন্য ব্যক্ত করছিলো।
অভিমান, পিছু নাম।
তাকে পিছু ফেরাও, তার কানে না যায় পিছু ডাক আমার।
মুখ বুজেই তাকে ডাকছি আবার।
তাকে অল্প কাছে ডাকছি, আর আগলে-আগলে রাখছি।
তবুও অল্পেই হারাচ্ছি আবার।
মাহতিম চোখ বন্ধ অবস্থায় গানের শেষ লাইনটা উচ্চারণ করলো। গানের শেষে সুরের তালটা ফিনিশিং দিতেই চোখ খুলে যেই ওর দিকে তাকালো, মেহনূর সম্পূর্ণ বিমোহিত দৃষ্টিতে স্বীকারোক্তি সূচকের হাসি দিলো। সেই হাসির দিকে তাকিয়ে আবারও স্থির-জ্ঞান ভুলে গেলো মাহতিম। গিটারের তারে ভুলবশত জোরে আঙ্গুল চালাতেই আচমকা আঙ্গুল কেটে ফেললো। অস্ফুট শব্দে ছোট্ট একটা আর্তনাদ করে উঠলে সবাই চমকে গিয়ে চোখ খুললো। বাজনা আকস্মিকভাবে থেমে গেলো। মাহতিম কাটা আঙ্গুলের কাটাস্থানে তাকিয়ে দেখলো টপটপ করে রক্ত ঝরছে। রক্তে হাত লাল হয়ে যাচ্ছে। সবাই চিন্তায় ব্যকুল হয়ে উঠলে মাহতিম সবাইকে শান্ত হতে বলে। কেউ ওর কথা শোনেনা, বাধ্য হয়ে সবাইকে সাংঘাতিক ধমক দেয় মাহতিম। ওর ধমকে সবাই চুপ হয়ে গেলে শুধু সাবির রেসোর্টের দিকে চলে যায়। বাকিরা আগের জায়গায় বসে থাকলে মাহতিম ওদের গ্রিল প্রস্তুত করার জন্য কাজে লাগতে বলে। এদিকে কাটা আঙ্গুলটা অন্যহাতে শক্ত করে চেপে আছে মাহতিম। গিটারের তারে একফালি চামড়া আলগা হয়ে কেটেছে। হঠাৎ সামনের দিকে চোখ তুলে তাকালে আর ছোট্ট মানুষটার মুখে হাসি দেখতে পেলো না মাহতিম। সে এখন বিষণ্ণ মুখে মাহতিমের দিকে তাকিয়ে আছে। আশেপাশে যদি শানাজরা না থাকতো তাহলে মাহতিম ঠিকই ওর কাছে যেয়ে বলতো,’ কিছুই হয়নি, ঠিক আছি। ‘ মাহতিম ওর দিকে ইশারায় কিছু বলবে ভেবেছিলো, কিন্তু তার আগেই মেহনূর সেখান থেকে উঠে দাঁড়ালো। সবার উদ্দেশ্যে বললো,
– আমার প্রচুর মাথাব্যথা উঠেছে। আমি একটু ঘুমাতে চাই। আপনারা সবাই এখানে মজা করুন, দয়াকরে আমার জন্য আনন্দের পরিবেশটা নষ্ট করবেন না। আমিতো এমনেই এসব পছন্দ করিনা, তাই একটু বিশ্রাম চাচ্ছি। আমি তাহলে যাই?
মেহনূরের কথায় মাহতিম কিছু বলার আগেই নীতি চট করে বললো,
– যদি খুব মাথাব্যথা থাকে, তাহলে রুমে যেয়ে ঘুমিয়ে পরো মেহনূর। জেগে থেকো না। আমাদের আসতে হয়তো দেরি হতে পারে। যদি কিছুর প্রয়োজন হয়, আমাদের কাছে ওয়েটার পাঠিয়ে দিও।
মেহনূর সায় জানিয়ে চুপচাপ চলে গেলো। পিঠের উপর আচঁল টেনে রেসোর্টের নিয়ন বাতির রাস্তাটা দিয়ে রেসোর্টের ভেতর ঢুকলো। কারেন্টের লাইন ঠিক করা হয়েছে দেখে রেসোর্ট এখন কালকের মতো অন্ধকার না। মেহনূর কটেজের সিড়িতে পা ফেলে ভেতরে ঢুকলে মনটা খচখচ করে উঠলো। একটু দাঁড়িয়ে চারপাশে চোখ বুলিয়ে বারবার সবখানে দেখতে থাকলো। কেনো জানি মনে হচ্ছে ওকে কেউ আড়ি পেতে দেখছে। মেহনূর বিষয়টাকে পাত্তা না দিলেও মন কেমন খটমট করছে। গতরাতে রুমের বাইরে জুতার যেই ছাপ দেখেছিলো, সেটা নিয়েই সন্দেহ জাগছে। ছাপটা কি আদৌ মাহতিমের? মাহতিম যদি হয়েই থাকে তাহলে রুমের বাইরে কি করতে আসবে? এসব চিন্তায় মশগুল হয়ে মেহনূর অন্ধকার রুমের লাইট জ্বালালো। আর ঠিক তখনই চোখের সামনে ভেসে উঠলো বীভৎস রুমের অবস্থা! বিকেলের দিকে পুরো রুম গোছালো অবস্থায় ছিলো, সেই রুম এখন লন্ডভন্ড হয়ে আছে। বিছানার চাদর উল্টিয়ে ফ্লোরে ফেলে দিয়েছে, বালিশগুলো পরে আছে নানাদিকে, টেবিলের উপর উপন্যাসের বইগুলো এলোমেলো করে রাখা হয়েছে, কিছু বই ফ্লোরেও পরে আছে। মেহনূর রুমের এমন ভয়া-নক অবস্থা দেখে চরম বিষ্ময়ে থ বনে গেলো। বিষ্ময়ে আঁখিদুটো বড় বড় হয়ে উঠলে হঠাৎ থপ থপ করে পায়ের আওয়াজ পেলো। ক্ষীণতা থেকে তীব্র হচ্ছে এগিয়ে আসার আওয়াজটা। মেহনূর ভয়ের আক্রোশে মুখ বুঝে রইলে হঠাৎ চারধার ঘুটঘুটে অন্ধকার করে কারেন্ট চলে গেলো। অমাবস্যার রাতের মতো অন্ধকার হয়ে গেলো রুমের ভেতরটা। মেহনূর ভয়ের চোটে ‘ বুবু ‘ বলে চেঁচিয়ে উঠলো, কিন্তু কেউ বুবু ডাকের সাড়া দিলো না। মেহনূর রুম থেকে বেরুনোর জন্য দ্রুত পিছু ফিরে তাকালে ক্যাচ করে আপনা-আপনি দরজা বন্ধ হয়ে গেলো। বাইরের আলোটুকুও আর থাকলো না। নিকষ কালো বীভৎস অন্ধকারে মেহনূর কিছুই দেখতে না পেয়ে বন্ধ দরজা খুলতে গেলো, কিন্তু ছিটকিনির কাছে আর যেতে পারলো না। ছিটিকিনির কাছে হাত পৌঁছানোর পূর্বেই আচঁলটা পেছন থেকে শক্তভাবে টান অনুভব করলো। মেহনূর চেষ্টা করেও ছিটকিনি খুলতে পারলো না, উলটো আচঁলের জন্য টান খেয়ে পেছনের দিকে পিছাতে লাগলো। ভয়ে যেনো শ্বাসনালী রোধ হওয়ার উপক্রম! এদিকে আতঙ্কের জন্য কন্ঠনালী জীর্ণ হয়ে গোঙানির মতো আওয়াজ বের হচ্ছিলো, তবুও সেই আওয়াজ বাইরে গেলেও শোনার কেউ ছিলো না।
সৌভিক বিফের জন্য লক্ষ করলো টমেটো সসের বোতল শেষ হয়ে গেছে। অথচ এদিকে প্রচুর সস লাগবে। সৌভিক অবশিষ্ট সসগুলো বোলে ঢালতেই জোর গলায় বললো,
– গাইজ আমার এদিকে টমেটো সস শর্ট। কেউ আমার রুম থেকে সসের বোতল দুটো এনে দে।
সৌভিকের কথাটা তীব্র সাউন্ড বক্সের জন্য কারোর কানেই গেলো না। এদিকে মাহতিম চুপচাপ গুড়ির উপর ব্যান্ডেজ লাগিয়ে বসে আছে। মেহনূর যে উদাস হয়ে চলে গেছে ব্যাপারটা একটুও সহ্য হচ্ছে না ওর। হঠাৎ কি ভেবে যেনো রেসোর্ট যাওয়ার রাস্তায় চোখ গেলো। সাথে-সাথে কপালে অনেকগুলো ভাঁজ পরে চিন্তিত হয়ে উঠলো। এই রাস্তা এমন অন্ধকার কেনো? মানে কি? কারেন্ট কি চলে গেছে? নাকি রেসোর্টের লাইনে কোনো সমস্যা হয়েছে? মাহতিম চিন্তার রোষানলে ফেঁসে যেতেই চট করে গুড়ি থেকে উঠলো। সৌভিক সমানে সসের জন্য চেঁচিয়ে যাচ্ছে মিউজিকের জন্য কেউই শুনলো না। সৌভিক শেষমেশ বাধ্য হয়ে মাহতিমের কাছে এসে দাড়ালো, ওর কানের কাছে সস আনার কথাটা বললে মাহতিম তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলো। মাহতিম সসের জন্য চলে গেলে সৌভিক ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকলো। রেসোর্টে যাওয়ার জন্য যে মন আকুপাকু করছে সেটা সৌভিক ঠিকই বুঝে গেছে। মাহতিম পকেট থেকে ফোন বের করে ফ্ল্যাশ-লাইট জ্বালালো। অন্ধকার রাস্তায় আলো ফেলে রেসোর্টের গেট দিয়ে ঢুকলো। ভেতরের অবস্থা দেখে মনে-মনে যা ভেবেছিলো, সেটাই হয়ে আছে। কোথাও কোনো আলো নেই, তার উপর অন্ধকার হয়ে আছে। মাহতিমের মনে শুধু একটাই চিন্তা, মেহনূর যেনো সুস্থ-সমেত থাকে। মনের মধ্যে কু ডাকার মানে সে কিছুতেই বুঝতে পারছেনা। মোবাইলের আলোয় রাস্তা ধরে মাঠের কাছে আসতেই বুকটা ধ্বক ধধ্বক করে লাফাতে লাগলো! মাহতিম একবার-দুইবার-বারবার যেই আওয়াজ শুনলো সেগুলো একটাও চিনতে দেরি হলো না! অন্ধকার চিড়ে ‘ মেহনূর ‘ বলে চেঁচিয়ে উঠলো মাহতিম! দ্রুততার সাথে দৌড় লাগিয়ে ওমনেই রুমের দিকে ছুটলো! কটেজের ভেতরে ঢুকে বদ্ধ দরজায় জোরে ধাক্কা মারলো! কিন্তু ভেতর থেকে আঁটকানো দেখে সেটা আর খুললোনা। এদিকে মেহনূরের কান্না অনবরত ভেসে আসছে রুমের ভেতর থেকে। ওমন আওয়াজে মাহতিম স্বাভাবিক স্থিতিতে থাকতে পারেনা, ওমনেই লাত্থি দিতে থাকে বন্ধ দরজায়। শরীরের সমস্ত জোর দিয়ে সজোরে ধাক্কা মারলে ধড়াম করে দরজা খুলে যায়। চোখের সামনে কান্নার হিড়িকে হিচকি তুলতে থাকা মেহনূর ঠোঁট উলটে কাঁদছে, আচঁলটা তরুণের শক্ত হাতের মুঠোতে আশি শতাংশ এসে গেছে। মেহনূর সেই আচঁলটুকু আটকানোর জন্য দুহাতে খামচে আছে। কান্নায় চোখদুটো ফুলে লাল হয়ে উঠেছে। মাহতিম স্থির হয়ে নির্বাকভাবে মেহনূরের দিকে তাকিয়েছিলো। বুকভর্তি লম্বা-লম্বা শ্বাস প্রশস্ত বুক ফুলিয়ে টানছিলো। তরুণ মাহতিমের মুখের অবস্থা দেখে অজান্তেই মুঠো ঢিলা করে আচঁল ছেড়ে দিলো। হাতের মুঠো থেকে আচঁল সরে যেতেই মেহনূর নিজের খামচানো হাতটা স্বাভাবিক করে ফেললো। কিন্তু হিচকি তুলা কমলো না ওর। মাহতিমের কপালের রগদুটো যেভাবে ফোলে উঠেছে, তরুণের আর বুঝতে বাকি রইলো না, এখন তাণ্ডবলীলা ঘটতে যাচ্ছে। তরুণ গলা উঁচিয়ে বড় করে ঢোক গিললো। এদিকে মাহতিম দরজা ছেড়ে ধীরপায়ে রুমের ভেতরে ঢুকছিলো, তরুণের দিকে শক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে কোমরের দিকে হাত নামালো। তরুণ আবার একটা ঢোক গিলে দেখলো মাহতিম বেল্ট খুলে ফেলছে। কোমর থেকে বেল্টটা খুলে বামহাতে খুব কায়দা করে পেঁচাচ্ছে। তরুণ পা পিছিয়ে পেছনের দিকে চলে গেলে মাহতিম ওকে একচুল ছাড় দেয়না। বামহাতে বেল্টটা সম্পূর্ণ পেঁচিয়ে ডানহাতের আঙ্গুলগুলো কটকট করে ফুটিয়ে নিলো। তরুণের একদম কাছাকাছি যেতেই রুম কাঁপিয়ে হুলস্থুল চিৎকার শুরু হলো! মেহনূরের চেয়ে হাজার গুণ তীব্রতায় চিল্লাতে থাকলো তরুণ। মাহতিমের হাতে প্রতিটি বেল্টাঘাত খেয়ে ছিলা মুরগীর মতো ফ্লোরে গড়াগড়ি খেতে লাগলো সে! মেহনূর সেই হাহাকার দৃশ্য দেখে চোখ খিচ মেরে কানে হাত চাপা দিয়ে কাঁদছে। মাহতিম এখন মেহনূরের চেয়ে তরুণের আহাজারি শুনার জন্য মরিয়া হয়ে আছে। সেদিন ওকে শুধরানোর সুযোগ না দিলে আজ এরকম দিন দেখতে হতো না। মেহনূরের গায়ে হাত দেওয়া তো দূর, চোখ দেওয়ারও সাহস কুলাতে পারতো না। পিটাতে-পিটাতে মাহতিম হয়রান গেলেও বেল্টটা বামহাত থেকে ডানহাতে চালান দিয়ে পিটাতে লাগলো। এদিকে সৌভিক অপেক্ষা সসের জন্য করতে-করতে কাহিল হয়ে উঠলো। নিরুপায় হয়ে নিজেই যখন সসের জন্য পা বাড়ালো, তখন সিয়াম এসে প্রফুল্ল সুরে বললো,
– কি মামু, ওদের রোমান্স দেখার জন্য যাও ক্যান? লজ্জা করেনা? ওরা একা আছে, একা থাকতে দাও।
সিয়ামের কথায় ভ্রুঁ কুঁচকে ক্রুদ্ধ হলো সৌভিক। রাগী সুরেই তেজ দেখিয়ে বললো,
– সসের বোতল যে সবগুলো আনা দরকার ছিলো, সেই তাল নাই তোমার? এখন আমি কই থেকে সস আমদানী দিবো?
সৌভিকের রাগ দেখে সিয়াম তাড়াতাড়ি ওকে শান্ত করতে বললো,
– আরে মামা রিল্যাক্স হও। চলো বোতল আনি। চিন্তা কইরো না, আসল জায়গায় তাকামু না। সসের দিকেই চোখ দিয়া থাকুম।
সৌভিক এ কথার প্রেক্ষিতে কিছু বললো না। কিন্তু সিয়ামের সঙ্গে সস আনার জন্য রেসোর্টে ঢুকলে যেই আর্তনাদের চিৎকার শুনলো, দুজনেই হকচকিয়ে নিজেদের দিকে তাকিয়ে রইলো। সিয়াম একটা ঢোক গিলতেই সৌভিক ওকে রেখে একদৌড় দিলো। সিয়ামও সঙ্গে-সঙ্গে দৌড়ে এসে মাহতিমের কীর্তিকলাপ দেখলে তাড়াতাড়ি দুজন ওকে বহুকষ্টে থামালো। মাহতিমকে পেছন থেকে জাপটে ধরলো সিয়াম, আর হাত থেকে বেল্টটা নিয়ে নিলো সৌভিক। সৌভিক আর সিয়াম অনেক চেষ্টায় পরিস্থিতি ঠান্ডা করে সবাইকে ডেকে আনলো। তরুণের অবস্থা কঠিন ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মাহতিমকে বুঝিয়ে দিলো। মাহতিম কিছু সময় পর শান্ত হলে সবার আগে ম্যানেজার এবং তিনজন সাঙ্গু-পাঙ্গুদের ধরলো। এই তরুণ এখানে কিভাবে এলো সেটা স্ববিস্তারে ব্যাখ্যা দিতে বললো। এদিকে শানাজ এসে পায়ের জুতা খুলে দুগালে ঠাসঠাস করে মারলো। মার খাওয়া তরুণ ফ্লোরে গোঙানি দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। কিন্তু সম্পূর্ণরূপে চেতন হারালো না। মেহনূরের অবস্থা কাঁদতে-কাঁদতে খুবই নাজেহাল হয়ে গেলে মাহতিম শানাজদের সামলানোর জন্য বললো। নিজে রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে তরুণের পাশাপাশি ম্যানেজারের ব্যবস্থা করলো। ম্যানেজারকে ওয়েটারের সামনেই পরপর দুটো কড়া হাতে চড় মারলো। কিন্তু ম্যানেজার উলটো টাকার গরম দেখালে মাহতিম লোকটার দিকে দুমিনিট তাকিয়ে থেকে দুম করে ডান চোয়াল বরাবর ঘুষি মারলো। ম্যানেজার পিছনে ছিটকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করতে থাকলে তৌফ দ্রুত মাহতিমকে বাধা দিয়ে বললো,
– এখানে কিছু করিস না বস্। এখানে আমরা একা না। শানাজরা আছে। ওরা জানতে পারলে ভয় পেতে পারে। আপাতত একটু ঠান্ডা —
কথাটার মাঝখানে হাঁপাতে হাঁপাতে এলো শানাজ। হাঁপানো সুরেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তত দ্রুততার সাথে বললো, মেহনূর সাবার রুমে দরজা আটকে দিয়েছে। কারোর কথাই ও শুনছেনা, সবাই ওকে দরজা খুলার জন্য অনুনয় করছে কিন্তু কাজ হচ্ছেনা। মাহতিম ম্যানেজারের ব্যাপারটা সৌভিকের হাতে দিয়ে নিজে মেহনূরের পরিস্থিতি দেখতে গেলো। ম্যানেজারের সাঙ্গু থেকে এক্সট্রা চাবি নিয়ে গেলো। এই তরুণ নামক আগাছার বাচ্চাটাকে কুটিকুটি করতে পারলে ভালো হতো! মাহতিম দরজার বাইরে থেকে সবাইকে সরিয়ে চাবি ঘুরিয়ে নব্ খুলে ফেললো। সবাইকে নিজ-নিজ রুমে পাঠানোর জন্য নীতির হাতটা চাপ দিয়ে ইশারা বুঝালো। ওমনেই নীতি সবাইকে নিয়ে ঠান্ডা হওয়ার জন্য কটেজ থেকে বাইরে গেলো। এদিকে মাহতিম ভেতরে ঢুকার আগে দুবার নক করে বললো,
– মেহনূর আমি কি রুমে আসতে পারি? এখানে তরুণ নেই। আমি তরুণকে জায়গামতো পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছি। মেহনূর তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?
ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ এলো না। মাহতিম বাধ্য হয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেলো। রেসোর্ট এখন আলোকিত হয়ে গেলেও মেহনূর ইচ্ছে করে রুমের লাইট নিভিয়ে রেখেছে। মাহতিম দরজাটা ঠেলে দিয়ে মেহনূরের কাছে আসছে। খোলা জানালা দিয়ে যতটুকু নিয়নবাতির আলো আসছে, তাতে মেহনূরের অবস্থা ভালোই বোঝা যাচ্ছে। মেহনূর ফ্লোরে বসে বিছানায় মুখ লুকিয়ে কাঁদছে। পিঠটা দরজা দিকে থাকায় মাহতিম ওর পেছন দিকটাই দেখতে পাচ্ছে। মাহতিম ধীরে-ধীরে ওর কাছে এসে ফ্লোরে বসে পরলো। মেহনূরের দিকে তাকিয়ে মাহতিম ছোট্ট নিশ্বাস ছাড়লো। নিচু স্বরে বলে উঠলো,
– মেহনূর ওকে শাস্তি দেওয়ার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছি। তুমি কি এখন শান্ত হবে?
মেহনূর এবারও কোনো জবাব দিলো না। মাহতিম আরো কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ ওর দিকে বলে উঠলো,
– শয়তানটা কোথায় ব্যথা দিয়েছে মেহনূর?
মাহতিম প্রশ্নটা ছুঁড়ে প্রচন্ড হতবিহ্বল অনুভব করছিলো। নিরাপত্তার জন্য যেই ওয়াদাটা হান্নান শেখের কাছে করেছিলো, সেই ওয়াদা প্রায় ভেঙ্গেই গেলো। মাহতিম অপরাধী মুখে মাথা নিচু করে বসে থাকলে হঠাৎ মেহনূর বিছানা থেকে মুখ না তুলে পিঠের পিছন থেকে চুল সরিয়ে দিলো। সবগুলো চুল বামে টেনে আনতেই পিঠ থেকে কেশরাশি সরে গেলো। মাহতিম তখনই দেখতে পেলো, পিঠের দিকে দুটো ফিতার গেড়ো খুলে এসেছে, ফর্সা পিঠটার কয়েক জায়গায় নখের দাগ লেগেছে। মাহতিম কি বলবে কিছুই মুখে বলতে পারছিলো না। এতোটা অসহায়, এতোটা ধিক্কার আগে কখনো নিজের উপর আসেনি, আজ যতোটা নিজের উপর হচ্ছে। মাহতিম নিজেকে সামলানোর মাত্রা কমিয়ে দিয়ে মেহনূরের পিঠের দিকে এগিয়ে আসে। কান্নার জন্য এখনো পিঠটা ক্রমান্বয়ে কাঁপছে ওর। মাহতিম হাতদুটো ফিতা বাধার জন্য এগিয়ে নিলো। আলগা হয়ে আসা ফিতাদুটো আগের মতো বেধে দিতেই ওর কাধ ধরে নিজের দিকে মুখ ঘুরালো। মেহনূরের কান্নারত মুখটা দেখার জন্য মাহতিম থুতনি তুলে ওর মুখের দিকে ধরলো। গালে দুটো হাত রেখে মুখ কিছুটা কাছে নিয়ে বললো,
– আমার জবাবটা দিয়ে দাও মেহনূর। আমার হাতে বেশি সময় নেই। তোমার একটা উত্তরের জন্য আমার সবকিছু থেমে আছে। আমাকে প্রচুর সাফার করাচ্ছো তুমি। আমি কিভাবে শক্ত হয়ে আছি, তোমার সে সম্বন্ধে ধারণাও নেই।
মেহনূরের টলটলে চোখদুটো থেকে থেমে-থেমে পানি পরছে। কিন্তু জবাব দেওয়ার মতো কোনো ভাবভঙ্গি দেখা যাচ্ছে না। মাহতিম আবার তাড়না দিয়ে মেহনূরকে জোর দেখিয়ে বললো,
– আজকেও যদি চুপ থাকো, আমাকে কোনোদিন খুজেঁ পাবেনা মেহনূর আফরিন। যদি এটা ভাবো, আমি পাগলা প্রেমিকের মতো তোমার পিছনে ঘুরঘুর করতে চলে আসবো, তাহলে এটা তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ধারণা। আমি কোনোদিন পিছু ছাড়া অতীতের দিকে তাকানোর মতো মানুষ না। আমি শুধু এটুকু জানতে চাই, আমি কি চলে যাবো? দুমিনিটের ভেতর জবাব দিবে। আর যদি সময় নষ্ট করার ধান্দা করো, তাহলে মাথায় এটা ঢুকিয়ে নাও আমি আবেগের বেলায় আবেগ, কাজের বেলায় কাজ শুনতেই পছন্দ করি। আবেগের জায়গায় যদি কাজ দেখি, আই হেভ নাথিং টু স্যা। সোজা এখান থেকে চলে যাবো!
মাহতিম নিজের কথাগুলো শেষ করে অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকলো। এদিকে তিরতির করে সময় চলে গেলেও মেহনূর কোনো কথা বলছিলো না। মেহনূরের চুপটি দেখে মাহতিম ব্যর্থ চেষ্টায় ব্যথিত হচ্ছিলো প্রচুর। মেহনূরের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতেই ওর গাল থেকে হাতদুটো আলগা করে দিচ্ছিলো সে। মাহতিম মনে-মনে সময়ের হিসাব গুণতেই দুমিনিট যখন শেষের দিকে পৌঁছে যাচ্ছিলো, তখন মনের উপর পাথর চাপা দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। এদিকে মেহনূর জড়তার জন্য মুখ ফুটেও কিছু বলতে পারছেনা, এই লোকটা কেনো চোখের চাহনি দেখে বুঝতে চাইছেনা? মাহতিম যখন শেষ দশ সেকেন্ডে ধীরে-ধীরে হাত নামিয়ে নিচ্ছিলো তখনই মেহনূর পাগলের মতো ডানেবায়ে মাথা নাড়াতে-নাড়াতে বলে উঠলো,
– যাবেন না, আপনি যাবেন না, যাবেন না।
উন্মাদের মতো কথাটুকু বলতেই মাহতিমের হাতদুটো গাল থেকে সরিয়ে নিলো। নিজের কোমল হাতদুটো মাঝে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। মাথা নিচু করে কেদেঁ দিয়ে আবার বলে উঠলো,
– যাবেন না, আপনি কোথাও যাবেন না। আপনার জায়গা কেউ নিতে পারবেনা। অন্য কেউ আসতে পারবেনা। আপনি যাবেন না।
– চলবে
#FABIYAH_MOMO
#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_২৩.
#ফাবিয়াহ্_মমো.
শেষ অংশ.
মাহতিমের হাতদুটো মুঠোয় পুড়ে হাউমাউ করে কাঁদছিলো মেহনূর। চোখের কোল থেকে টলটল করে অশ্রু বর্ষণ হচ্ছিলো তখন। মাহতিম তার কাঙ্ক্ষিত উত্তর পেয়ে নিরব হয়ে আছে। চোখের সামনে কান্নারত মেহনূরের মুখটা দেখে মিশ্র অনুভূতির শিকার হচ্ছে। মাহতিম নিজের হাতদুটো মেহনূরের নরম হাতের বন্ধন থেকে সরিয়ে নিলো। মেহনূর তখন মাথা নিচু করে ফুপিয়ে কাঁদছিলো, সেই কান্নার ফিসফিস সুর রুমের চর্তুদিকে ছড়িয়ে পরছিলো। মাহতিম চুপচাপ ওর ডানহাতটা পরম উষ্ণতায় ধরলো, সেই কোমল হাতটা ধীরে-ধীরে নিজের ওষ্ঠজোড়ার কাছে এনে চোখ বন্ধ করে ছুঁয়ে দিলো। হাতের তেলোয় স্পর্শ পেয়ে হেলদোল হলো না মেহনূরের। কান্নাও যেনো কমলো না ওর। মাহতিম ওর অবস্থা দেখে ঠোঁট থেকে হাতটা সরিয়ে নিলো, সেই চুমু খাওয়া হাতটা টেনে আনলো নিজের ডান কাধের উপর। মেহনূরের অশ্রুপূর্ণ মুখটার দিকে আরেকটু এগিয়ে যেতেই ওর হাতটা কাধ থেকে ঘাড়ের উপর রেখে দিলো। মাহতিম অন্যহাতটা এগিয়ে মেহনূরের নিচু করা মাথাটা উঠানোর জন্য থুতনি উচিয়ে ধরলো, থুতনি থেকে হাত সরিয়ে গলার দিকে নামালো ধীরেসুস্থে। গলার বামদিকে কালো তিলটার উপর বৃদ্ধাঙ্গুল রেখে বাকি চারটে আঙ্গুল ঘাড়ের দিকে রেখে দিলো। মেহনূর তখন কান্না থামিয়ে অশ্রুনয়নে মাহতিমের দিকে দৃষ্টি তুলে তাকালো। মাহতিমের শান্ত-গভীর চাহনির মাঝে পুরোপুরি আটকে গেলো মেহনূর। জানালা দিয়ে আসা বাইরের আলোটা সরাসরি মাহতিমের উপর পরেছিলো। মেহনূর একদৃষ্টিতে মাহতিমের দিকে তাকিয়ে থাকতেই ওর অন্য হাতটা টেনে নিজের গালে চেপে ধরলো মাহতিম। মেহনূরের দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে দিলো। আকস্মিক কাণ্ডে দুজনই তখন চোখ বন্ধ করে ফেললো। মাহতিম বুক ফুলিয়ে লম্বা-লম্বা নিশ্বাস ছাড়ছে, অপরদিকে মেহনূর হিচকির জন্য মৃদ্যু-মৃদ্যু কেঁপে উঠছে। বাইরের ঠান্ডা বাতাসে রুমটা ক্রমশ শীতল হচ্ছিলো, গায়ে তখন পরশ লাগছিলো হিম বাতাসের। রুমের ভেতরটা আবছা অন্ধকারে ঢেকে থাকলেও নিশ্বাস চলছিলো বেগতিক হারে। মাহতিম গালটার উপর মেহনূরের হাতটা আরো জোরে চেপে ধরলো, আর্দ্র গলায় নরম ভঙ্গিতে বললো,
– জড়তা কাটানো শুরু করো মেহনূর। সামনে আমার ঠোঁটে চুমু খেতে হবে।
এমন কথা শুনে প্রচণ্ড লজ্জায় কুঁকড়ে উঠলো মেহনূর। চোখদুটো আরো ভেতরের দিকে কুঁচকে নিলো। অশ্রুবর্ষন আপাতত থমকে গেলেও মাহতিমের কথায় প্রচণ্ড লজ্জা কাজ করছিলো। মাহতিম চোখ খুলে কপাল থেকে কপাল সরিয়ে নিলো, মেহনূরের বদ্ধ চোখের দিকে অনিমেষ চাহনিতে তাকালো। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস সুরে বললো,
– আদুরে ঠোঁটদুটোর জন্য আনসারী অপেক্ষা করবে।
কথাটুকু শেষ করতেই মাহতিম দ্রুত ওকে ছেড়ে দিলো। ঘাড় থেকে হাত সরিয়ে নিজের গাল থেকেও হাত সরিয়ে নিলো। মেহনূর লজ্জায় যে চুপ মেরে আছে, সেটা ভাবভঙ্গি দেখে বুঝতে বাকি রইলোনা মাহতিমের। মেহনূর সম্পূর্ণরূপে ছাড়া পেয়ে চোখ খুলে তাকালো, ওমনেই দেখলো মাহতিম ওর দিকে মিটিমিটি হাসছে। মেহনূর উজবুকের মতো তাকিয়ে থাকলে মাহতিম চুপচাপ উঠে দাড়ায়। মেহনূরকে দ্রুত ঘুমাতে বলে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। মেহনূর সেই আদেশমতো আরো কিছুক্ষণ নিরিবিলি কাটিয়ে শাড়ি পালটে ঘুম দেয়। এদিকে মাহতিম হাসি মুখে রুম থেকে বেরুলেও বাইরে এসে শক্ত হয়ে যায়। পকেট থেকে ফোন বের করে জরুরী ভিত্তিতে কাউকে কল দেয়। অপর পাশটা রিং বাজতেই হঠাৎ সেটা রিসিভ হয়। ওপাশ থেকে ‘ হ্যালো ‘ আওয়াজটা আসতেই মাহতিম সংযত গলায় জবাব দেয়,
– রাত দশটার দিকে একটা মেইল পাঠাচ্ছি। আশা করবো, ভ্যাকেশানটা গ্রান্টেড হবে।
মাহতিমের কথা শুনে কয়েক মিনিট নিরব রইলো। স্বাভাবিক ভাবেই বুঝা যাচ্ছিলো, অপরপক্ষের কাছে ছুটিজনিত ব্যাপারটা একদমই সন্তোষজনক না। মাহতিম সেটা আচঁ করতে পারলেও আগ বাড়িয়ে কিছু বললো না। কলের কাজটা শেষ করে সবাইকে আজকের ঘটনাটা ধামাচাপা দিতে বললো। আপাতত এই ঘটনাটা বাড়িতে না জানালেই ভালো হয়, মাহতিম নিজেই এই ব্যাপারটা নিয়ে হান্নান শেখের সাথে আলোচনায় বসবে। খুবই ঠান্ডা মস্তিষ্কে গুরুতরভাবে হ্যান্ডেল করতে হবে। এ কথা শুনে শানাজ একটু যেনো শান্ত হলো, মাহতিমের উপর বিশ্বাস রেখে ভোরে উঠার জন্য ঘুমাতে চলে গেলো। ভোরে রওনা দেওয়ার জন্য শেষ মূহুর্ত্তের প্রস্তুতি দেখলো মাহতিম। মাইক্রো এবং জিপ দুটোই সমান-তালে চেক দিয়ে রুমে এসে ঢুকল। ঘামার্ক্ত শার্টের বোতাম খুলতেই হঠাৎ সৌভিক এসে হাজির। সে ধীরগতিতে রুমে ঢুকে বিছানায় বসে বললো,
– ভাবী কি কনফার্ম?
সৌভিকের কথায় স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকালো মাহতিম। ওর দিকে একপলকের জন্য তাকিয়ে এরপর টিশার্ট পরায় ব্যস্ত হলো। মাহতিম কোনো উত্তর দিলো না দেখে সৌভিক এবার চিন্তিত মুখে বললো,
– দোস্ত মেহনূর কি রিজেক্ট করে দিছে?
মাহতিম টিশার্ট পরার পর প্যান্ট পালটে ট্রাউজার পরে নিলো। তবুও কোনো জবাব দিলো না। এদিকে মাহতিমের নিরবতা দেখে সৌভিকের কৌতুহল কমছিলো না। সৌভিক লাগাতার প্রশ্ন করতে থাকলে মাহতিম গ্লাস নিয়ে সৌভিকের সামনে ধরলো। স্বাভাবিক সুরে বললো,
– পানিটা খেয়ে গলাটা ভিজা।
সৌভিক ওর অদ্ভুতকাণ্ড দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলো। কপালে কয়েকটা ভাঁজ ফেলে প্রশ্নাত্মক গলায় বললো,
– তুই কি আন্সারটা দিবি? ওই মেয়ে তোকে কি বলেছে সেটা তুই বলবি?
মাহতিম আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুলগুলোতে আঙ্গুল চালালো। চুলগুলোকে পেছনে ঠেলতেই সরল গলায় বললো,
– বাসর করতে পারবো না। ও এখনো ছোট।
সৌভিক উত্তরটা শুনে কুঁচকানো ভ্রুঁ নিয়ে ফ্লোরের দিকে তাকালো। মাহতিমের কথাটা উলটো বুঝে হা-হুতাশ ভঙ্গিতে বললো,
– থাক দোস্ত, মন খারাপ করিস না। ওর মতো মেয়ে তোর লাগবোও না। তুই ওর চেয়ে —
অসহায়ের মতো কথাগুলো বলতে থাকলে হঠাৎ কথা থেমে গেলো সৌভিকের। ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে চোখদুটো বিশাল বড়-বড় করে চোয়াল ঝুলিয়ে ফেললো। তৎক্ষণাৎ সৎবিৎ ফিরে পাওয়ার মতো চমকিত ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
– তু-তু-তুই কি বললি?
সৌভিক প্রশ্নটা করতে যেয়ে তোতলামি করে ফেললো। মাহতিম আয়না থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সৌভিকের দিকে মুখ ঘুরালো। বাঁ ভ্রুঁটা উচু করে সরু চোখে বললো,
– তুই কি কানে কম শুনিস, না-চোখে কম দেখিস? আমি এইমাত্র কি বলেছি সেটা তুই বুঝিসনি?
মাহতিমের তীক্ষ্ণদৃষ্টি দেখে ভড়কে গেলো সৌভিক। হড়বড় করে বিছানা থেকে উঠে মাহতিমের একদম সামনে যেয়ে দাঁড়ালো। তুমুল উত্তেজিত হলে মানুষ যেমন কথা গুলিয়ে ফেলে সৌভিকও তেমন কথা জড়িয়ে বললো,
– তা-তা-তার মানে ভাবী পটে গেছে? ভাবী রাজি হয়েছে? তোকে ‘ হ্যাঁ ‘ বলেছে? তোকে বিয়ে করবে তো?
একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন ছুঁড়ে সৌভিক জোরে-জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলো। মাহতিম কিছুক্ষণ কঠোর মুখে তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ মুখের ভাবভঙ্গি পরিবর্তন করলো। প্রাপ্তিসূচক হাসি দিয়ে সৌভিকের দুই কাধে হাত রাখলো। বুকভর্তি জোরে একটা নিশ্বাস টেনে সেটা শব্দ করে ছাড়তেই শান্ত গলায় বললো,
– বিয়েটা করতে হবে সৌভিক। ওকে ফেলে যেতে পারবো না। আজ যদি ও রাজি না হতো, আমি কি করতাম জানিনা। হয়তো বেপরোয়া হয়ে তুলে নিয়ে যেতাম। কিন্তু ও যেহেতু রাজি হয়ে গেছে, আমাকে দ্রুত বিয়েটা করতে হবে। বাড়িতে কালই আমি সব কথা খুলে বলবো। ওকে একা ছাড়া সম্ভব না।
মাহতিমের কথায় প্রচণ্ডরূপে খুশী হয়ে গেলো সৌভিক। আজ মাহতিমের মুখে যে হাসিটুকু দেখা যাচ্ছে সেটা কেবল মেহনূরের জন্যই সম্ভব হয়েছে। এই মেয়েটা ওর কাছে কিভাবে রাজি হয়েছে জানা নেই। কিন্তু বিয়েটা দ্রুত করা জরুরী। সৌভিক সবদিক বিবেচনা করে পরামর্শ হিসেবে বললো,
– দোস্ত বিয়ের প্রস্তাবটা কাল তুলিস না। হান্নান নানা এই ব্যাপারে ডাউট করতে পারে। কথাটা আন্টির কাছে তুলে তারপর নানার কাছে পাঠিয়ে দিবি। আমার তো সুরাইয়ার জন্য টেনশন হচ্ছে। এই মেয়েটা যদি বাড়িতে কথা লাগিয়ে দেয়?
সৌভিকের কথায় মাহতিমও যেনো চিন্তায় ডুব দিলো। সৌভিকের কাধ থেকে হাত সরিয়ে বিছানায় যেয়ে বসলো। সৌভিকও ওর পাশে বসে পরলে মাহতিম চিন্তিত মুখে বললো,
– এই সুরাইয়া মেয়েটা খুব চতুর। ওকে সহজভাবে দেখলে চলবেনা।
সৌভিক কথাটার অর্থ আধা বুঝলো, আধা বুঝলোনা। কেনো মাহতিম এই কথাটা বললো সেটা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বললো,
– তুই কি ওর ব্যাপারে গোপন কিছু জানতে পেরেছিস?
সৌভিকের প্রশ্নে ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে মাথা নাড়ালো মাহতিম। রানের উপর দু’কনুই রেখে দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে গাঢ় গলায় বললো,
– ওর কাছে যে সিক্রেট ফোন আছে সেটা জানিস? ও যে রাতে ঘুমায় না টের পেয়েছিস? সুরাইয়া কত ভালো মানুষ সেটা ওর দাদাভাইও জানে। যখন ক্লাস ফাইভে পড়তো, ডিসপেন্সারির দোকানির সাথে ভেগে গেছিলো। সেদিন বেশিদূর যেতে পারেনি, এর মধ্যে গ্রামের কিছু মানুষ এসে খবর দিলে হান্নান নানা যেয়ে নিয়ে আসে। এরপর থেকেই মোল্লা বাড়ির মেয়েরা বাড়ির বাইরে যায়না। ওর জন্যই হান্নান নানা শানাজদের সাথে কড়াকড়ি করে। আগে ওরা যখন ছোট ছিলো, সবকিছু স্বাভাবিক ভাবেই চলতো।
মাহতিমের কথা শুনে সৌভিক যেনো আকাশ থেকে পরলো। চরম বিষ্ময় নিয়ে একগাদা প্রশ্ন ছুড়ে বললো,
– তুই এইসব তথ্য কোত্থেকে জোগাড় করলি? কিভাবে জানলি? কে জানালো? আর সুরাইয়ার ব্যাপার এতো বড় গোপন সত্য লুকানো আছে! আল্লাহ্ রে, দোস্ত এই সুরাইয়া ভয়ং-কর মাইয়া!
মাহতিম মুষ্টিবদ্ধ হাতটা থুতনি থেকে সরিয়ে সৌভিকের দিকে তাকালো। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সন্দেহ উদ্রেক করে বললো,
– শুধু এটাই না, শেফালী মামীরও কাহিনী আছে। আর শেফালী মামীর জন্য বাড়ির মধ্যে কি কি হয়েছে, সেটাও তোরা কিচ্ছু জানিস না। হান্নান নানাভাই সবই আমাদের কাছে গোপন করে রেখেছে। ইভেন মা-ও এ ব্যাপারে জানে না। একটা জিনিস খেয়াল করেছিস কিনা জানিনা, বাট মেহনূর কিন্তু অন্য দশটা মেয়ের মতো নরমাল না।
মাহতিমের কথায় হতবাক হয়ে গেলো সৌভিক। এতোদিন যে বাড়িতে মেহমান হিসেবে আশ্রিত ছিলো, সে বাড়িতে কতখানি রহস্য লুকিয়ে আছে সেটা আসলেই কেউ জানতো না। কিন্তু মাহতিমের কথা শুনে এটুকু বিশ্বাস হলো, মাহতিম এতোদিন হাত-পা গুটিয়ে বসে ছিলোনা। এখানে যেহেতু এসেছে, দিনের-পর-দিন থাকছে, তার মানে অনেক কিছুই ওর জানা হয়ে গেছে। এখানে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, মেহনূর সতের বছরের কিশোরী হওয়া সত্ত্বেও আচরণ কিন্তু কিশোরীসুলভ না। ওর আচরণে নিরব-গুমর-অত্যন্ত শান্ত গুণ দেখা যায়, সেটা একটা কিশোরী মেয়ের মধ্যে থাকার কথা না। সতের বছর মানেই প্রাণবন্ত-উল্লাসিত-হাসিখুশী মেজাজের কিশোরী, যার আচরণে সম্পূর্ণরূপে চন্ঞ্চলতার গুণ পরিদৃষ্ট হবে। এখানে যেহেতু উলটো গুণ, উলটো আচরণ দেখা যাচ্ছে, তার মানে ওর জীবনে নিশ্চয়ই একটা রহস্য লুকিয়ে আছে। সৌভিকের কেনো জানি মনে হলো, মাহতিম মেহনূরের ব্যাপারে সবই জানে। আর সবকিছু জানার পরেই ওর প্রতি মন বাড়াতে আগ্রহী হয়েছে। সৌভিকের নিরবতা দেখে মাহতিম ওর মনের অবস্থা বুঝে গেলো, কিন্তু কাল যেহেতু ড্রাইভের জন্য ধকল পোহাতে হবে, তাই সৌভিককে রেস্টের জন্যে পাঠিয়ে দিলো। সৌভিক প্রথমে প্রশ্নোত্তর জানার জন্য উদগ্রীব হয়েছিলো, কিন্তু পরক্ষণে মাহতিমের কথামতো সবগুলো ব্যাপার পরে শোনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। মাহতিম ওকে বিদায় দিয়ে রুমের দরজা লাগিয়ে দিলো। এদিকে সৌভিক বহু প্রশ্ন নিয়ে চিন্তা করতে-করতে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিলো। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠলো আলতো সুরে, খুবই সর্তকভাবে। এমন গলায় সেটা ডাক দিলো, সেই সুরটা কানে পৌঁছাতেই স্তম্ভের মতো স্তম্ভিত হয়ে গেলো সৌভিক। মুখ দিয়ে কথা বলা তো দূর, সেসময় অনবরত ঢোক গিলতে লাগলো সে। মাথা কি পিছু ঘুরাবে, নাকি জবাব না দিয়ে হুড়মুড় করে ছুটে পালাবে? কি করলে এই মূহুর্তে ঠিক হয় সেটা নিয়েই ঘামতে লাগলো সৌভিক!
– ‘ চলবে ‘
#FABIYAH_MOMO