#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_২৬.
#ফাবিয়াহ্_মমো.
অংশ – ০১.
মাহতিম বাড়ির অবস্থা দেখে এটুকু অন্তত বুঝে গেছে, এখানে নিশ্চয়ই কোনো বড়সড়ো গণ্ডগোল হয়েছে। বাড়ির ভেতর গ্রামের মহিলা-সহ অনেকগুলো বুজুর্গ মানুষ দাড়িয়ে আছে। সবাই ওদের আগমনে দেখে নিচুগলায় কানাকানি করছে। সেখানে কিছু-কিছু মহিলা ছিলো যাদের পোশাক-আশাকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, তারা ভালো গেরস্থ ঘরের গৃহকর্ত্রী, কিন্তু আচরণে তখন বোঝা যাচ্ছিলো, তারা বিনোদন নিতে উদগ্রীব। কোথাও কোনো নেতার মুখরোচক ঘটনা ঘটলে সাংবাদিক যেমন বসেনা, তেমনি গ্রামের মধ্যে উনিশ-টু-বিশ হলেই মহিলারা আর ঘরে থাকেনা। মাহতিম এতোগুলো মানুষের মাঝে কোথাও সৌভিকদের খুঁজে পাচ্ছেনা, ওরা কোথায় আছে, কোথায় বসেছে কিচ্ছু তখন বোঝা যাচ্ছেনা। এর মধ্যে বাড়িতে এতো মানুষের ছড়াছড়ি দেখে মেহনূর প্রচুর ঘাবড়ে যায়। দ্রুত চোখদুটো নিচে নামিয়ে শাড়ির আচঁলটা মাথায় টেনে নেয়। আচঁলটা তাড়াতাড়ি কপালে টেনে মুখ ঢেকে শানাজের পেছনে লুকিয়ে পরে। শানাজ মেহনূরের অবস্থা দেখে শান্তমুখে সবার সামনে ওকে আড়াল করে রাখে। বাড়িতে এতো মানুষের ঢল দেখে মাহতিম সবার আগে প্রশ্ন ছুঁড়ে বলে,
– আপনারা এখানে কেনো? কি হয়েছে এখানে? কি কারনে এতো ভিড় করেছেন?
মাহতিমের প্রশ্ন শেষ হতেই কয়েক মিনিটের জন্য নিরবতা চলতে থাকলো। মাহতিম কিছুই বুঝতে পারছিলো না, কি থেকে কি হতে যাচ্ছিলো। কিন্তু মূহুর্ত্তের মধ্যে ভিড়ের মাঝখানে দুই ফাঁক হয়ে গেলে তখন হান্নান শেখকে ধীরগতিতে আসতে দেখা গেলো। গ্রামের মানুষগুলো হান্নান শেখকে আসতে দেওয়ার জন্য জায়গা করে দুপাশে চেপে গেলো। হান্নান শেখ কেমন জীর্ণশীর্ণ শরীরে সুজলার হাত ধরে হেঁটে আসছিলেন। সেই সঙ্গে হান্নান শেখের পিছু-পিছু একে-একে বাড়ির সবাই দোতলা থেকে দৌঁড়ে-ছুটে হাজির হলেন। মাহতিমের মনে কৌতুহলের সীমা শেষ হচ্ছিলোনা, আর তখনই শেফালী হাউমাউ করে মরা কান্না মতো কাদতে-কাদতে চলে এলো। ভিড় হটিয়ে কটুক্তির সুরে চোখের পানি মুছতে-মুছতে বললো,
– তা বাবা, তোমার উদ্দিশ্য কি সফল হই গেছে? বাড়ির মাইয়ার মান-ইজ্জত শেষ কইরা সুখ পাইছো তো?
মাহতিম এমন প্রশ্নের কোনো অর্থই বুঝতে পারলো না, ভ্রুঁ কুঁচকে সঙ্গে-সঙ্গেই পালটা প্রশ্ন করে বললো,
– মেজো মামী, আপনি সোজা রাস্তা ছেড়ে বাঁকা রাস্তা ধরছেন কেন? যা বলতে চাইছেন সেটা সোজাসাপ্টা বললে কি সমস্যা? কি হয়েছে?
শেফালী কান্নারত মুখটা কঠোর করে মাথার ঘোমটাটা আরেকবার ঠিক করলো। মাহতিমের দিকে কয়েক পা এগিয়ে ওর সামনে এসে বললো,
– তুমি সুজা রাস্তা জানবের চাও না? তাহালে শুনো, তুমি আব্বার কাছে কি বইলা গেছিলা? তুমি সবগুলা মাইয়ারে ভালোমতো দেখভাল করবা এই কথা বলছিলা না? তুমি ওই তরুণের হাতে মাইয়াডারে একলা ছাড়িছো ক্যান? ওই কুলাঙ্গার কাছে আমগোর মাইয়া ফালাইয়া কি সুখ পাইছো তুমি! এইটার উত্তর তুমি দিবা, আজকাই দিবা। আমি কোনো কথা শুনবার চাই না। তুমি আমার মাইয়ার সাথে ভুল করিছো, তুমি ওরে ঘুরবার লিগা না নিয়া গেলে আজকা এই দিন দেখবার লাগতো না। সব তোমার দোষ, তোমার দোষ!
বলতে-বলতেই পুরো গ্রামবাসীর সামনে কান্নায় ঢলে পরলো শেফালী। কান্নার আওয়াজ বেড়ে যেতেই গ্রামবাসীরা নিজেদের মধ্যে কানাঘুসো করে কথা বলতে লাগলো। এদিকে হান্নান শেখ পাথরের মতো কাঠের একটা চেয়ারে বসে আছেন, সুজলা বারবার ‘ আব্বা, ও আব্বা ‘ডেকে হাতপাখায় হাওয়া করছেন, মারজা আঙিনার চৌকিতে থম মেরে বসে থাকতেই হঠাৎ সৌভিকদের আগমন হলো। সৌভিকরা সবাই দোতলা থেকে একযোগে নেমে আসলো। শেফালী এমন পর্যায়ে কাঁদতে লাগলো যেটা দেখে কিছু গ্রামের মহিলা এসে দ্রুত ধরাধরি করে একটা বেতের মোড়া এনে বসিয়ে দিলো। মাহতিম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চারপাশে তাকাতে থাকলে হঠাৎ সৌভিকদের দেখা পেয়ে সেখানে ছুটে গেলো। সৌভিকের কাধে হাত রেখে মাহতিম জোর গলায় বলে উঠলো,
– আমি আসার আগে কি হয়েছে এখানে? শেফালী মামী কি নিয়ে এমন কাহিনী করছে?
মাহতিমের চটপট প্রশ্ন শুনে সৌভিকরা নিজেদের মধ্যে চাওয়া-চাওয়ি করলো। সাবির চোখের ইশারায় কি যেনো ইঙ্গিত দিলে ফারিন সবার মধ্য থেকে সাহস করে বললো,
– ভাইয়া ঘটনা এখানে উলটে গেছে। আমরা বাড়িতে ঢুকেই দেখি এই অবস্থা হয়ে আছে। তরুণ যে মেহনূরের সাথে কেলেঙ্কারি করার চেষ্টায় ছিলো, সেটা সুরাইয়া কালরাতেই বলে দিয়েছে। আমরা সবেমাত্র বাড়িতে ঢুকেছি, ওমনেই সুরাইয়া হাউমাউ করে কেদেঁ উঠে। আমরা তো একদম তাজ্জব বনে গেছিলাম ওর কান্না দেখে। ও কি কারণে কেদেঁ উঠলো বুঝতেই পারিনি। ও দেখি একদৌড়ে শেফালী মামীর গলা জড়িয়ে ধরলো। আর মেহনূরের ব্যাপারে কিসব মিথ্যা কথাগুলো বললো, আমি সাত জনমেও ভুলবো না ভাইয়া। হান্নান নানা সেই থেকেই থমকানো অবস্থা চুপ হয়ে গেছেন। মেহনূর যে উনার কতো আদরের সেটাতো তুমিও জানো, নানা এখন যে-হারে নিরবতা পালন করছেন প্রচুর ভয় লাগছে ভাইয়া। উনি মুরুব্বি মানুষ হলেও কাজকর্মের ব্যাপারে প্রচুর কড়া। কিন্তু ভিশ্বাস করো, সুরাইয়ার মতো এতো জঘন্য মেয়ে আমি আমার এন্টায়ার লাইফে দেখিনি।
মাহতিম এমন চালবাজির ঘটনা শুনে নির্বাক-হতবাক-হতভম্ব হয়ে গেলো। গতরাতে মেহনূরের সাথে যে খারাপ ঘটনা হতে যাচ্ছিলো সে বিষয়ে সবাইকে চুপ থাকার জোরদার ভাবে বলেছিলো মাহতিম। বাড়িতে কেউ যেনো আগ বাড়িয়ে কথা না তুলে সেটাও ভালোভাবে বুঝিয়ে বলেছিলো সে, কিন্তু সুরাইয়া এখানে এসে এতোবড় পল্টি মারবে সেটা কল্পনায়ও ভাবতে পারেনি মাহতিম। এখানে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এসব মান-সম্মানের ব্যাপার নিয়ে গ্রামবাসীর কাছে কাহিনী পৌঁছে গেলে সহজে ভালো ঘর থেকে মেয়েদের জন্য বিয়ের সম্বন্ধ আসবেনা। মেহনূরের বিয়ে ঠিক হয়ে গেলেও বাকি মেয়েগুলো জন্য এটা ভীষন চিন্তার কথা। মাহতিম ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে সবগুলো কথা চিন্তা করতে লাগলো। এদিকে সুরাইয়া যেই চালটা দিয়েছে, সেটা ঠিকঠাক মতো জায়গায় ফিরিয়ে আনা একটু কঠিন। তবুও মাহতিম সবকিছু ভেবেচিন্তে সুরাইয়াকে নিচে আনার জন্য সাবাকে পাঠিয়ে দিলো। সাবা আদেশ পেয়ে সুরাইয়াকে আনতে চলে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যে সাবা টানতে-টানতে সুরাইয়াকে সিড়ি দিয়ে নিচে নামালো, সবার সামনে এনে মাহতিমের উদ্দেশ্যে বললো,
– মাহতিম ভাইয়া, যা বলার বলুন। ওকে নিয়ে এসেছি।
মাহতিম সাবার দিকে তাকিয়ে সায় বুঝিয়ে মাথাটা মৃদ্যুভঙ্গিতে নাড়ালো। সুরাইয়ার ভীতু হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে মাহতিম পরপর দুবার তালি মেরে সবার দৃষ্টি আর্কষণ করলো। সুরাইয়া ভয়ে চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো মিইয়ে গেছে, শেফালী মাহতিমের অবস্থা দেখে নিজেও ভেতরে-ভেতরে শঙ্কানুভব করছে। মাহতিম এখন কি করবে কে জানে, কিন্তু ততক্ষণে মাহতিম সুরাইয়ার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে হান্নান শেখের দিকে তাকিয়ে বললো,
– হান্নান নানা, আমি খুব লজ্জার সাথেই বলতে চাচ্ছি, আপনার নাতনী সুরাইয়া এক নাম্বার মিথ্যাবাদী। ওর মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন বলে মনে করছি। ও আপনাকে কি কথা শুনিয়ে গুল খাইয়ে রেখেছে, আমি শুনতে পেরে অবাক হয়েছি। কিন্তু সত্য এটাই আপনার সুরাইয়া যা বলেছে সেটা আধা-সত্য। যা হয়েছে, যেটা হয়েছে ওটা আমার জন্য খারাপ দিকে যেতে পারেনি। কিন্তু এরকম মিথ্যা কথা বলার জন্য বাড়িতে হৈ-হুল্লোড় অবস্থা হবে, সেটা সত্যিই চিন্তার বাইরে ছিলো।
মাহতিমের কথায় হান্নান শেখ কঠোর দৃষ্টিতে তাকালেন। তিনদিন ধরে বাড়ির বাইরে নাতনী পাঠিয়ে যতটা টেনশনে ছিলো, আজ সেই টেনশনের ফলাফল সত্যি-সত্যিই খারাপ এলো। হান্নান শেখ প্রচণ্ডরূপে মাহতিমের উপর ক্ষেপে আছেন, কি করে মেহনূরের গায়ে অন্য পুরুষের আচড় লাগে সেটা নিয়েই ভেতরে-ভেতরে ফুসছেন। কিন্তু বাইরে থেকে একদম নিরব হয়ে আছেন। তিনি কথা বলার জন্য শুষ্ক ঠোঁটজোড়া জিহবা দিয়ে ভিজিয়ে নিলেন, মাহতিমের দিকে ভাবশূন্য দৃষ্টিতে বলে উঠলেন,
– আমার নাতনীদের নিরাপত্তা নিয়ে তুমি কি যেনো বলেছিলে মনে আছে?
প্রশ্নটা শুনে মাহতিম তখন জোরে একটা নিশ্বাস ছাড়ে। নিজেকে যথাযোগ্য দোষী সাব্যস্ত করে দৃষ্টি নত করে রাখে। রাগান্বিত হান্নান শেখের সামনে ধীরপায়ে হেঁটে এসে কোমল স্বরে বলে,
– নানা, কে আপনার কানে কি ধরনের কথা লাগিয়েছে সেটা আমি জানিনা। তবে এ কথা বলতে বাধ্য হবো, আমি আপনার নাতনীদের সুস্থ-সমেত হাজির করেছি। রেসোর্টে যে ঘটনাটা ঘটেছিলো, ওটা সত্য হলেও আধা-সত্য ছিলো। আর আপনি এটাও জানেন আধা-সত্য মিথ্যার সমতুল্য। রেসোর্টে তরুণ এসে মেহনূরের উপর দ্বিতীয়বার কুকর্ম করতে চেয়েছিলো, কিন্তু তরুণ তখন আমার জন্য কিছুই করতে পারেনি। আপনি যদি তরুণের মুখ থেকে সত্য শুনতে চান তাহলে আমাকে একটু সময় দিন। আমি ওকে আনার ব্যবস্থা করেছি।
কথাগুলো শুনে হান্নান শেখের কোনো হেলদোল হলো না। তিনি কঠোর মুখভঙ্গিতে চেয়ে রইলেন মাহতিমের দিকে। পরক্ষণে চোখ নামিয়ে সুজলার উদ্দেশ্যে বললেন,
– মা এক গ্লাস লেবুর পানি আনো।
সুজলা আদেশ পেয়ে হাওয়া করা বন্ধ করে বললো,
– জ্বী আব্বা।
সুজলা লেবুর পানি আনার জন্য রান্নাঘরে চলে গেলো। হান্নান শেখ শক্ত চাহনিতে মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছুক্ষণ নিরবতা কাটিয়ে মারজার উদ্দেশ্যে বললেন,
– মারজা মা, তোমার ছেলে যে ওয়াদা ভঙ্গ করেছে এর জন্য তুমি কি বলবে?
মারজা কালো শাড়ির আচঁলটা মাথায় ঠিকঠাক মতো টেনে নিলেন। ছেলের দিকে ভাবহীন দৃষ্টিতে একপলক তাকিয়ে এরপর হান্নান শেখের জন্য বললেন,
– আপনি যেটা ঠিক মনে করবেন সেটাই করুন বাবামশাই। আপনার সিদ্ধান্তের উপর আমার পুরো বিশ্বাস আছে।
মারজার কথা শুনে হান্নান শেখ তরুণের জন্য অপেক্ষা করতে রাজি হলেন। তরুণকে দ্রুত যেনো হাজির করা হয় সেটার জন্য মাহতিমকে বলে দিলেন। মাহতিম তখন নিজে গিয়ে তরুণকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে এলো। ধরে-বেঁধে হান্নান শেখের সামনে হাজির করতেই সত্য কথা উগলে দিলো। সুরাইয়া গতরাতে শানাজের ফোন দিয়ে শেফালীকে কল করেছিলো। কলের মধ্যে মায়ের কাছে মেহনূরের কথা বলে দেয় সুরাইয়া। তরুণ রেসোর্টে এসে মেহনূরের রুমে ঢুকে কুকীর্তি করতে চেয়েছিলো সেটাও সবিস্তারে জানিয়ে দেয়, কিন্তু ভাগ্য ভালো বলে মাহতিমের জন্য মেহনূর তখন বেঁচে যায়। এদিকে তরুণ প্রচুর ধোলাই খাওয়ারর কারণে হাসপাতালে ভর্তি করতে পাঠিয়ে দেয়। পুরো ঘটনা যখন শেফালীর কানে চলে আসলো, তখন আশ্চর্যের জন্য পুরো দশমিনিট হ্যাং মেরে বসেছিলো সে। এদিকে সুরাইয়া সবকিছু বলে দিতেই শেফালী বাজে একটা বুদ্ধি আঁটে। আর সেই বুদ্ধির জন্যই পুরো গ্রাম ডেকে হাহাকার করা তামাশা করে বসে। তরুণের অবস্থা খুবই নাজুক এখন, হাতে স্যালাইনের নল ঢুকানো ওর। হাসপাতাল থেকে জরুরী রেফারেন্সের ভিত্তিতে হাসপাতাল থেকে এ্যাম্বুলেন্স দিয়ে ছেড়েছে। মাহতিম বুকের কাছে দুহাত ভাঁজ করে তরুণের দিকে তাকিয়ে আছে। তরুণ হুইলচেয়ারে বসা অবস্থায় ভয়ে-ভয়ে তাকিয়ে আছে। মাহতিমের হাতে ধোলাই খেয়ে চোয়াল একপাশ বেঁকে গেছে, বাম চোখটা এমনভাবে ফুলে আছে যেনো মৌমাছি কামড়েছে। ডানহাতটা প্লাস্টার করা বলে সেটা গলার দুপাশ থেকে রশি টেনে বুকের ঝুলিয়ে রেখেছে। মাহতিম চোখ শক্ত করে প্রথম কুকর্মের কথা জানাতে ইশারা করলো। তরুণ বাঁকানো চোয়ালে খুব কষ্টে ঢোক গিলে আবার বলে কথাগুলো বলতে লাগলো,
– আমি শাওনের জন্য এবাড়িতে আসতে পারতাম না। শাওন কিভাবে জানি বুঝে গেছিলো আমি ওর ছোটবোন শানাজকে পছন্দ করতাম।
এটুকু কথা বলে জোরে-জোরে হাঁপাতে লাগলো তরুণ। শ্বাসকষ্টের রোগীর মতো খসখসে আওয়াজে শ্বাস টানতে লাগলো সে। এদিকে তরুণের মুখে শানাজের কথা শুনে আগুনের মতো তাকিয়ে আছে সৌভিক। রাগে ইচ্ছামতো গালিগালাজ করছে! সৌভিকের অবস্থা দেখে কূলকিনারা হারানোর মতো কাঁচুমাচু করছে শানাজ। দূর থেকে সৌভিকের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সৌভিক তরুণের দিকে রাগে কটমট করতে থাকলে হঠাৎ শানাজের দিকে চোখ পরে। শানাজ সবার দৃষ্টি বাঁচিয়ে সৌভিকের জন্য ঠোঁট নাড়িয়ে বলে,
– সৌভিক ঠান্ডা।
সৌভিক ঠোঁট নাড়ানো কথাটা বুঝতেই মাথাটা সঙ্গে-সঙ্গে ‘ না ‘ ভঙ্গিতে দুবার নাড়ালো। উপস্থিত সবার দৃষ্টির অগোচরে গলার কাছে ডানহাতটা চুলকানোর ভঙ্গিতে উঠালো। অন্যদিকে তাকিয়ে কেবল বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে গলা বরাবর একটান দিলো। ওই দৃশ্য দেখে শানাজ ভয়ে চমকে উঠলে তৎক্ষণাৎ আশেপাশে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো। আবার সর্তকতার সাথে চোখ তুলে সৌভিকের দিকে আগের মতোই বলে উঠলো,
– ওকে জ-বাই করতে হবেনা সৌভিক। মাহতিম ভাইয়া ওকে পঙ্গু বানিয়ে দিয়েছে।
সৌভিক সেদিকে না তাকিয়ে সামিকের সাথে ইচ্ছে করে কথা জুড়ে দেয়। তরুণ আবার কাহিল ভাব কাটিয়ে বলে উঠে,
– শাওন পড়াশোনার জন্য বিদেশে চলে গেলে আমি গ্রাম ছেড়ে চলে যাই। কিন্তু কয়েক বছর পর যখন বাবার সাথে ভিটেবাড়ি বিক্রি করতে আসি, তখন মেহনূরকে দেখে অনেক ভালো লাগে। মেহনূর সবার ছোট ছিলো, ও সবার আড়ালে-আড়ালে থাকতো। আর এটার জন্যই নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আমার ঝোঁক চলে আসে। আমি সুরাইয়াকে দিয়ে মেহনূরকে যেভাবেই হোক গোয়ালঘরে আনতে বলেছিলাম। মেহনূর আসছিলো, কিন্তু ওর সাথে কিছু করার আগেই ও ভয়ে পালিয়ে যায়। আমি সেদিন কিছুই করতে পারিনি। এর মধ্যে মাহতিম ভাইজান আমাকে কুত্তার মতো মারে, জানের ভয় দেখায়। আমি ওইদিন রাতে আর চিন্তা না করে শহরের জন্য রওনা দেই। কিন্তু মেহনূরের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আর শহরে ফিরিনি। গ্রামের বাইরে আবার এক ছোটভাই রেসোর্ট করছিলো। নতুন-নতুন ব্যবসা, ওর সাথে পার্টনারে জয়েন্ট দিলাম। কিন্তু এদিকে ভাগ্যের জোরে মাহতিম ভাইজান ঘুরাঘুরির জন্য ওই রেসোর্ট বুক করলো। আমি সবার থেকে লুকিয়ে চলতাম, চুপিচুপি মেহনূরকে দেখতে যেতাম। কিন্তু প্রতিবারই সিয়াম ভাইজান, নীতি, মাহদি ওদের জন্য কাছে ভিড়তে পারতাম না, কোনোবারই কিছু করতে পারতাম না। গতকাল গ্রিল পার্টির আয়োজন করছিলো, আ-মমি এই সুযোগে মেহনূরের রুমে গেলাম, কিন্তু এইবারও কিছু করার আগে ভাইজান —
তরুণ আর কিছু বলতে পারছিলো না, কাশতে-কাশতে গলা জ্বলে যাচ্ছিলো ওর। বুক শুকিয়ে শ্বাস টান হচ্ছিলো প্রচুর। মাহতিম ওকে হাসপাতালে ফিরিয়ে দিয়ে হান্নান শেখের মতামত শোনার ইচ্ছা পোষণ করলো। হান্নান শেখ কাঠের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালেন, আর সকল গ্রামবাসীকে নিজ-নিজ কর্মে ফিরে যেতে বললেন। গ্রামবাসীরা সব প্রশ্নোত্তর পেয়ে গেলে হান্নান শেখের কাছে সালাম ঠুকে চুপচাপ বেরিয়ে গেলেন। এবার হান্নান শেখ কোমরের কাছে দুহাত বেঁধে ধীরগতিতে পায়চারী করতে লাগলেন। পায়চারী করা অবস্থায় মাটির দিকে তাকিয়ে শান্ত মুখে বললেন,
– সুরো,
সাথে-সাথে সুরাইয়া জবাব দিয়ে বসলো,
– জ-জজ্বী দাদা।
শেফালী ততক্ষণে কান্নার অভিনয় থামিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। সুরাইয়ার সাথে কি কথা হতে যাচ্ছে সেটার জন্য উদগ্রীব চাহনিতে তাকিয়ে আছে। মাহতিম হান্নান শেখের কাছ থেকে দু-পা পিছিয়ে মেহনূরকে দেখার চেষ্টা করছে। নিশ্চয়ই এতোকিছু হওয়ার পর কেদেঁ-কেদেঁ নাক-মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে মেহনূর। কিন্তু শানাজের পেছনে এমনভাবেই মুখ লুকিয়ে আছে, একটুও ওকে দেখতে পেলো না মাহতিম। হান্নান শেখ সুরাইয়াকে কঠিনভাবে জেরা করতে থাকলে তৌফ এদিকে সৌভিকের কানে ফিসফিস করে বলে,
– সৌভিক রে, আমার শরীর যে ক্যামনে জ্বলতাছে তোরে বুঝাইতে পারমু না। খালি একটা কথাই তোরে কমু, এই সুরাইয়ারে যদি উচিত শিক্ষা না দিছি আমিও সরকার বংশের নাতী না।
সৌভিক ওর কথা শুনে প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে গেলো। ভ্রুঁদুটো স্বর নামিয়ে বললো,
– তৌফ তুই চুপ থাকবি? এমন সিরিয়াস মোমেন্টে আবলামি বন্ধ করবি? তুই দেখতে পাচ্ছিস না ওখানে কি হচ্ছে? আপাতত অফ যা তৌফ।
তৌফ এমন কথা শুনে চুপ তো হলোই না, উলটো বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
– আসার সময় গোবর পারা মারছিলাম বন্ধু। ভাবতাছি ওই জুতা আইনা সুরাইয়ার দুইগালে ঠাডায়া মারমু।
ইন্ট্রেস্টিং মোমেন্টে বারবার ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য তৌফের উপর ভালোই ক্ষেপলো সৌভিক। কিন্তু ক্ষেপাটে ভাবটা প্রকাশ না করে চুপচাপ সাবিরের পাশে যেয়ে দাঁড়ালো। এমন আহাম্মকের পাশে থাকার চেয়ে সাবিরের পাশে থাকা ঢের ভালো। হান্নান শেখ জেরা শেষ করতেই হঠাৎ শেফালী কেমন মাথাচাড়া দিয়ে আসলো। হান্নান শেখের জন্য প্রশ্ন ছুঁড়ে ত্রস্ত মুখে বললো,
– আব্বা, আপনের কাছে কোনোদিন কোনোকিছুর জইন্যে বলিনাই। কিন্তু আজ না বইলা থাকবার পারলাম না। আপনের ছোট নাতনীর জইন্যে আমার কি ক্ষতি হইলো আপনি সেটা এখনো ধরবার পারেন নাই। আমি আইজ সেই কথা খুলিয়া কবার চাই। মেহনূর গ্রামের সামনে যেইভাবে মান-সম্মান শেষ করিয়া দিছে, এখন সুরাইয়ার জইন্যে ভালা পাত্র জুটবেনা। সুরাইয়া কিন্তু সাবা,শানাজের মতো সুন্দরী না। কোনো পাত্র যে সুরাইয়া বাদে বাকি তিনজনরে পছন্দ করিবে সেই কথা আমি কাগজে লেখিয়া দিবার পারুম।
শেফালীর কথায় চুপ থাকতে পারলেন না সুজলা। এতোক্ষন পর তিনি বাধ্য হয়েই শেফালীর প্রতি উত্তর দিয়ে বললো,
– মেজো বৌ তোমার সাহস তো কম না! তুমি আমার সামনে আমার মেহনূরকে কি কথা বললা? ও কোন্ দিক দিয়ে বাড়ির মান-ইজ্জত শেষ করেছে? আজকে গ্রামবাসী ডাকিয়ে তামাশা করতে গেছে কে? মেহনূর না তুমি? কাহিনী কি তুমি শুরু করেছো না মেহনূর এসে করছে? খবরদার আমার মেহনূরকে নিয়ে একটা বাজে কথা বলতে যাবে না।
সুজলার কড়া কথা শুনে শেফালীও একধাপ গলা চড়িয়ে কথা বলে উঠে,
– আমিতো কিছু শুনবার চাই না ভাবী। আমার মাইয়ারে কেউ বিয়া করবো না আমি এইটা জানি। আমি এখন একটা জিনিসই বলবার চাই, যার উপর আমার মাইয়ার মান-ইজ্জত দেখভালের ভার পরিছে, যে রেসোর্ট ঘুরাবার নিয়ে গেছে তারে কও সবকিছু ঠিক করি দিতে। কয়দিন পরে শানাজ, সাবার বিয়া হই যাবো, মেহনূররে দেখলে পাত্রও ফিট ফাবো। কিন্তু সুরাইয়ার জইন্যে কে আসিবো?
এবার হান্নান শেখ পায়চারী করা থামিয়ে দিলেন। তীক্ষ্মদৃষ্টিতে শেফালীর তাকালে ওই সময় মাহমুদা নিজের আড়ষ্ট ঠোঁট নাড়িয়ে এই প্রথম মেয়ের পক্ষ নিয়ে বললেন,
– ছোট ভাবী, আপনি আমার বয়সে খুব বড় না হলেও সম্পর্কে যথেষ্ট বড়। আপনি সারাটা জীবন আমাকে কথা শুনিয়ে গেলেন। আমার মেয়েকে পদে-পদে খোটা মেরেছেন, সব ওই উপরওয়ালা দেখেছে। আমি একটা কিছু ভুলিনি, আপনি আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলেছেন তবুও আমি সম্পর্কের মর্যাদা করে কিচ্ছু বলিনি। আমার মেয়ে এইটা-ওইটা করে কেনো, সেটা নিয়েও কম কথা বলেননি ভাবী, আপনি ওই বেপরোয়া তরুণটাকেও বাড়িতে থাকার জন্য আব্বার কাছে তোষামোদ করেছেন। ওই ছেলে আমার নিষ্পাপ মেয়েটার সাথে দুই-দুইবার খারাপ কাজ করতে চেয়েছে। আল্লাহ্ যদি মেহনূরের জায়গায় সুরাইয়াকে ফেলে দিতো? তখন কি বলতেন ছোট ভাবী? আপনি কিভাবে আমার একমাত্র সন্তানটাকে দোষ দিতে গেলেন?
মাহমুদার ভিজে আসা চোখদুটো নরম আচঁলে চাপা পরলো। আচঁল দিয়ে দুচোখ মুছে চোখ নিচু করে বললো,
– আমার মেয়ের সাথে প্রতিবার আপনি খারাপ আচরণ করেছেন, আমার মেয়েটা সেই ছোট বেলায় কেদেঁ-কেদেঁ বিচার দিতো। এখন হাজার ব্যথা পেলেও আমার কাছে বলেনা। আমি আপনার মতো গলাবাজি করতে পারিনা ভাবী, আমি নিরীহভাবে চলতে পারি। কেউ আমাকে দুটো কথা শুনালেও পালটা কথা বলতে পারিনা ভাবী।
মাহমুদা আবারও সজল নয়নে শাড়ির আচঁল চাপা দিলো। নিরবে চোখের অশ্রু বির্সজন দিতে থাকলে ওইমূহুর্তে শানাজের পেছন থেকে দৌড়ে পালালো মেহনূর। একদৌড়ে চৌকির পাশ কাটিয়ে সিড়ির ধরে দ্রুততার সাথে উপরে উঠলে লাগলো। মাহতিম-সহ সবাই ওর ফুঁপানো কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলো। মেহনূর চোখ মুছতে-মুছতে বারান্দা পেরিয়ে নিজের বদ্ধ রুমের দরজা ঠেলে ঢুকে গেলো। মাহতিম দোতলার সেই বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে ধীরে-ধীরে চোখ বন্ধ করে ফেললো। নিচের ঠোঁটটা দাঁতে কামড়ে মুখ নিচু করে নিলো। শেফালী দফায়-দফায় নানাভাবে সুরাইয়ার সাথে মাহতিমের সম্পর্ক পাকা করার ইঙ্গিত বুঝাতে থাকলো। কোনো এক বিশেষ কারণে অস্বাভাবিক ভাবে চুপ হয়ে গেছেন হান্নান শেখ। কাঠের কেদারায় বসে অনিমেষ নেত্রে খোলা সদর দরজার দিকে তাকিয়ে আছেপ। মাহতিম সুযোগ বুঝে মারজাকে আলাদা করে ডেকে নিলো। মারজা ছেলের ভাবভঙ্গি দেখে প্রশ্নাত্মক গলায় জোর দেখিয়ে বললো,
– তুই কি বলার জন্য আলাদা ডাকলি মাহতিম?
মাহতিম চুলে ব্যাকব্রাশ করতেই চোখ বন্ধ করে বুকভর্তি নিশ্বাস ছাড়লো। চিন্তিত মুখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
– ছোটটাকে পছন্দ হয়? বুঝেশুনে বলোতো।
চটে যাওয়া মেজাজটা সেকেন্ডের মধ্যে পালটে গেলো মারজার। ছেলের মুখ থেকে এমন কথা শুনে ধাক্কা খাওয়ির মতো আশ্চর্যভাবে তাকিয়ে আছে। মাহতিম মায়ের কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে আবার তাগাদা দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
– কি হলো? পছন্দ হয়না?
মারজা হা করে চোয়াল ঝুলিয়ে বড়ো-বড়ো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ছেলের কথায় উত্তর দিতে যেয়ে তিনি তীব্র উত্তেজনার ‘ না ‘ সূচকে মাথা নাড়িয়ে ফেলেন। তৎক্ষণাৎ মাহতিমের মুখের অবস্থা বারোটা বেজে যায়। মায়ের কাছ থেকে নির্ঘাত ‘ হ্যাঁ ‘ পাবে দেখে একটু ঢপবাজি করতে চেয়েছিলো। মায়ের কাছ থেকে বিপরীত জবাব পেয়ে মাহতিমের বুকটা চিপে এলো। তাড়াতাড়ি মায়ের দুকাধ ধরে আলতো একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললো
– ও মা তুমি এ কি বলছো? না করছো কেনো? ও কি ছোট না? তোমার তো ছোট বউ লাগতো, ওকে কি সত্যিই পছন্দ হয়না?
মারজা নিজের তালগোল সামলে নিয়ে হা করা মুখ চট করে বন্ধ করলো। মাহতিমের বুকে জোরে একটা ঘুষি মেরে রাগ দেখিয়ে বললো,
– তুই আমাকে এভাবে চমকে দিবি কে জানতো? বাপের মতোই বদ হয়েছিস ! তোর বাপটাও আমাকে শান্তি দিতো না, এখন তুইও এই বয়সে আমাকে শান্তি দিলি না।
মাহতিম মায়ের অবস্থা দেখে চওড়া একটা হাসি দিলো। মায়ের দুকাধ ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক সুরে বললো,
– কি করি বলো? ওকে এই অবস্থায় দেখা সম্ভব? শেফালী মামীর ব্যাপারে কিছু বলার নেই। আমি ওই সুরাইয়ার মতো সাইকোকে বিয়ে করতে পারবো না। মা যেমন, মেয়েটাও তেমন। তুমি প্রস্তাবটা দ্রুত দিয়ে সবকিছু পাকা করো মা, আমি তিন কবুলের জন্য ব্যবস্থা করে ফেলি। খারাপ ভাবে নিও না মা, এদিকে তোমার শেফালী ভাবী যা করেছে পুরো ব্যাপার নিয়ে সাত গ্রাম পযর্ন্ত ছিঃছিঃ করবে। এখন বিয়েটা করে ফেললে সামনে অন্তত কোনো ঝামেলা হবেনা।
মারজা ছেলের কথায় সম্মতি জানিয়ে দিলো। কিন্তু প্রস্তাব রাখার ব্যাপারে মারজা একবার হান্নান শেখের মুখটার দিকে তাকালো। রাগের কারণে মুখের কুঁচকানো চামড়া পযর্ন্ত লাল হয়ে আছে। সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে মারজা অন্যমনষ্ক গলায় বললো,
– বাবা, যদি আজকের ঘটনার জন্য বিয়ের প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দেয়?
মাহতিম হান্নান শেখের দিকে তাকালো, দাম্ভিকতার ভঙ্গিতে বুক ফুলিয়ে নিশ্বাস টেনে নিলো। সেটা শব্দ করে ছেড়ে দিতেই দুপকেটে হাত ঢুকিয়ে শক্ত চাহনিতে বলে উঠলো,
– ‘ না ‘-টা খালি করুক না, তারপর আমার খেলা দেখাবো।
– ‘ চলবে ‘
#FABIYAH_MOMO
#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_২৬.
#ফাবিয়াহ্_মমো.
অংশ – শেষ.
বাড়ির পরিবেশ থমথমে হয়ে আছে, সবার মধ্যে তীব্র উত্তেজনা কাজ করছে। কি থেকে কি হবে, সেটা নিয়ে চিন্তা করছে সবাই। মাহতিম দূরে দাড়িয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে। সেই সঙ্গে অপেক্ষা করছে, পরিস্থিতি কিরূপ হবে সেটা দেখার জন্য। হান্নান শেখ এতো কিছু হওয়ার পরও চুপ করে আছেন, নিশ্চয়ই এটা আগাম ঘটনার সূত্র। মারজা বিচক্ষণ বুদ্ধির সাহায্যে হান্নান শেখের কাছে প্রস্তাব পেশ করলো, খুবই শান্তভাবে কোমল কন্ঠে বিয়ের ব্যাপারটা তুলে ধরলো,
– আজকের ঘটনার জন্য আমি খুব কষ্ট পেয়েছি বাবামশাই। এমন ঘটনা গ্রামবাসীর কাছে না আসলেও পারতো। এটা যদি নিজেদের মধ্যে মীমাংসা হয়ে যেতো, অন্ততপক্ষে এতো বড় ঝামেলা হতো না। কিন্তু আপনার কাছে কিছু দিন যাবৎ কিছু কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আজ সে কথাটা না বলে পারছিনা, আপনার ছোট নাতনীকে আমার মেয়ের মতো রাখতে ইচ্ছে করে। আমার তো কোনো মেয়ে হয়নি, এটার আফসোস আজীবন থাকবে। আপনিও জানেন, আর মাওয়ি-ও জানতো, আমি খুব মেয়ে পাগল মহিলা। কিন্তু আল্লাহ্ আমার ভাগ্যে ছেলেই দিয়েছেন, কোনো মেয়ে সন্তান দেননি। মাহদির বেলায় একটাই চিন্তা ছিলো, ও মেয়ে হলে ভালো হতো, কিন্তু ছেলে হওয়ার পরও আমি অখুশি হইনি। কিন্তু বাবামশাই, মায়ের মন সবসময়ই একটা মেয়ের অভাব অনুভব করে। সেই থেকে ইচ্ছে ছিলো, বড় ছেলেকে দিয়ে ছোট একটা মেয়ে আনাবো। নিজের মেয়ের মতোই লালন-পালন করে বড় করবো, একটু-একটু করে সংসার বুঝিয়ে দিবো, সময় হলে সবকিছুর ভার তুলে দিবো। কিন্তু আমার ছেলে তার কর্মজীবনে এতোটাই ব্যস্ত, এতোগুলো বছরে সে বিয়ের চিন্তা করতে পারেনি। আপনি যদি মেহনূরকে আমার জন্য একেবারে দিয়ে দেন, আমি নিজের শেষরত্নের মতোই ওকে যত্ন করবো। আল্লাহ্ আমাকে যতদূর সার্মথ্য দিয়েছেন, সবটাই ওর জন্য বিলিয়ে দেবো, কিন্তু বাবামশাই আজকের ঘটনা চিন্তা করে আপনি আমার আবদারটা ফিরিয়ে দিয়েন না। আমার সন্তানের ভালোর জন্য আমি মেহনূরের হাত চাইছি বাবামশাই, মেয়েটাকে আমার ঝুলিতে দিয়ে দিন।
মারজার আকুতি ভরা আবদারের কাছে চুপ করে রইলেন হান্নান। তিনি মুখেও কিছু বললেন না, চোখও তুলে তাকালেন না। কিছুক্ষণ গভীরভাবে নিরবতা পালন করার পর সুজলার দিকে তাকালেন। সুজলার সজাগ দৃষ্টি দেখে তিনি কিছু আচঁ করতে পারলেন, কিন্তু সেই আঁচকৃত কথাটা মুখ ফুটে বললেন না। সময় যখন হুরহুর করে আধঘন্টা পেরিয়ে গেলো, তখন মারজার শান্ত মুখটা ধীরে-ধীরে নিচে নেমে গেলো। মনের মধ্যে একটাই ভয়, একটাই দুশ্চিন্তা, ছেলে আবার হুলস্থুল কাণ্ড করে কিনা। মারজা মনে-মনে শুধু একটাই জপমালা করছিলো, হান্নান শেখ যেকরেই হোক বিয়েতে রাজি হয়ে যাক, বিয়ের জন্য সম্মতি দিক, সবকিছু ঠিকঠাক করার উছিলা হোক। ঘড়িতে এগারোটা বেজে বিশ মিনিট চলছে, মাহতিম সেটাই নিজের হাতঘড়িতে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দেখছে। এদিকে সৌভিক, নীতি, তৌফ, সিয়ামরা মারাত্মক চিন্তায় ভেঙ্গে পরেছে, মাহতিম অতো মনোযোগ দিয়ে ঘড়ি কেনো দেখছো? ঘড়িতে কি লুকিয়ে আছে? এসব নিয়ে কৌতুহল জাগতেই সামিক বলে উঠলো,
– সৌভিক ভাই? মাহতিম ভাইয়ের লক্ষণ ভালো দেখাচ্ছেন। ভাই ঘড়িতে কি দেখছে?
সৌভিক নিজেও এখন মূর্খ বনে আছে। মাহতিম কি করার চিন্তায় আছে সে বিষয়ে তিল পরিমাণ ধারণা নেই। মাহতিমের দিকে তাকিয়ে থেকে সৌভিক শুধু একটা কথাই বললো,
– মন বলছে ও সময় কাউন্ট করছে। এক্যুরেট সময়টা চলে এলেই কাহিনী শুরু করবে। তোরা জাস্ট প্রে কর, ভালোয়-ভালোয় যেনো বিয়েটা টেলে যাক।
সৌভিকের কথা শুনে ফারিন মাঝখান থেকে বলে উঠলো,
– হান্নান নানা চুপ করে আছে কেন? উনার কি এখানে চুপ থাকা উচিত? ওই সুরাইয়াকে কষিয়ে দুটো চড় মারা দরকার ছিলো। ওর মতো কাজ যদি আমি করতাম, আম্মু আমাকে পিটিয়ে শেষ করতো। ওর যে কপাল কতো ভালো, আমি সেটাই চিন্তা করছি। কিন্তু কথা হলো গিয়ে, মেহনূর দৌড়ে পালালো কেনো? আমি কি রুমে যেয়ে দেখে আসবো?
ফারিনের ব্যাপারটা শুনতে পেয়ে নীতি কথাটার উত্তর দিলো। শান্ত সুরে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
– দুই মিনিট দাড়া, আমার মনে হয় নানা কিছুক্ষণের মধ্যে উত্তর জানাবে।
নীতির কথাটা শুনে পুরো গ্যাং ওর দিকে আশ্চর্যভাবে তাকালো। ওর কথাটা শুনে মনে হলো, নেপালের কাঠমুণ্ডু যেনো মোল্লাবাড়িতে চলে আসছে। কিন্তু সময়ের জরিপ বেশিক্ষণ না হতেই হান্নান শেখ মুখ খুললেন। খুবই তেজহীন গলায় নরমভাবে মারজার প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। মারজা এ কথা শুনে আর দেরি করতে চাইলেন না, যতদ্রুত সম্ভব আজকের মধ্যেই কাজি ডাকিয়ে তিন কবুল বলিয়ে দিবেন। মাহতিম ঘড়ির দিকে এগারোটা ত্রিশ পযর্ন্ত তাকিয়ে ছিলো, উদ্দেশ্য একটাই ছিলো, যদি সাড়ে এগারোটার ভেতর উত্তর না জানাতো, তাহলে সিড়ি ধরে উপরে গিয়ে মেহনূরকে তুলে আনতো। হান্নান শেখ নাতনীর বিয়ে উপলক্ষ্যে একটু হাসার চেষ্টা করলেন, কিন্তু শেফালীর চেহারার দিকে তাকাতেই তিনি পুনরায় বেজার হয়ে গেলেন। মারজা একান্তভাবে মাহমুদার সাথে কথা সেরে নিলো, বিয়ের জন্য সবাইকে দাওয়াত না দিয়ে কিছু পরিচিত লোকদের বলার ব্যবস্থা করলো। হান্নান শেখ মারজার উচ্ছ্বসিত মুখটা দেখে ক্ষণিকের জন্য শেফালী ও সুরাইয়ার ঘটনাটা মাটি চাপা দিলেন, বিয়ের কাজটা শেষ হতেই মা-বেটিকে পাকড়াও করে ধরবেন। গায়ে সাদা রঙের পাণ্ঞ্জাবী চাপিয়ে হাটের উদ্দেশ্যে গেলেন হান্নান শেখ। সঙ্গে নিজের দলবল ডাকিয়ে কিছু ছোকরা-সহ আয়োজনে লেগে পরলেন। এদিকে তরুণের ঘটনা মীমাংসা করার জন্য গ্রামে পাঁচটার দিকে পন্ঞ্চায়েত বসবে। সেখানে গ্রামবাসীর সামনে হান্নান শেখ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিবেন। এ ঘটনার সাথে যেহেতু ওতপ্রোতভাবে মাহতিমও জড়িত, তাই বিয়ের পর্ব শেষ হতেই পন্ঞ্চায়েতের সালিশের জন্য ওকেও বেরুতে হবে। পুরো ঝামেলা আজকের মধ্যে মিটমাট করে শেফালীর ব্যাপারেও কঠিন সিদ্ধান্ত নিবেন হান্নান শেখ। কিন্তু তার আগে নাতনীর হুটহাট বিয়েটার জন্য দ্রুততার সাথে আয়োজন করা জরুরী। সাত গ্রামে মুখ নোংরা হওয়ার চাইতে মেহনূরের বিয়েটা আজকের ভেতর সেরে ফেললে ঠিক। এতে পরবর্তীতে কেউ কটাক্ষ করার সাহস পাবেনা। তাই হান্নান শেখ নিজেও বিয়েটার জন্য দেরি করতে চাইলেন না। বেলা চারটার দিকে কাজি আসলে সাড়ে চারটার ভেতর বিয়ে পড়ানো শেষ হবে। সুজলা, মাহমুদা রান্নার কাজ দেখার জন্য গ্রামের কিছু মহিলার সহযোগিতা নিলো। বড়-বড় ডেক পাতিলে রান্নার জন্য সবাই একত্র হলো। হান্নান শেখের নির্দেশে কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পরলো কয়েকজন পাক্কা বাবূর্চি। এরপর শুরু হলো রান্না করার কাজ, যেটা চলতে থাকলো উঠোনের একদিক। মারজা কণের জন্য শাড়ি কিনতে যেয়ে মারাত্মক বিপাকে পরলো। এটা যেহেতু গ্রাম, তাই মনমতো শাড়ি পাওয়া মুশকিল। মারজা ভীষণ চিন্তায় মগ্ন হলে শেষে মাহতিমের কাছে ব্যাপারটা খুলে বললো, মাহতিম সবটা শুনে শান্ত ভঙ্গিতে জানালো, সে নিজে এখানকার মার্কেট থেকে শাড়ি এনে দিবে। যেহেতু ঘরোয়াভাবে বিয়ে হচ্ছে, তাই নরমাল শাড়ি হলেই যথেষ্ট। মারজা মাহতিমের কথায় অনেকক্ষণ পর শান্ত হলো। ছেলের কথায় সম্মতি দিয়ে বাকি কাজে মনোযোগ দিলো।
বেলা যখন একটার কাটায় পৌঁছলো, তখন নীল আকাশটা কালো মেঘের আড়ালে ভয়ংকর ভাবে ঢেকে গেলো। কালো কালো মেঘগুলো বেশ জোরেসোরে গর্জন করতে লাগলো। আকাশের অবস্থা দেখে বোঝাই যাচ্ছিলো, কিছুক্ষণের মধ্যে তুমুল বৃষ্টি পরবে। সবাই দ্রুতগতিতে কাজ সেরে বাড়িতে ঢুকে পরে। ঠিক দেড়টার দিকে সত্যি-সত্যিই তুমুল বর্ষণ শুরু হয়। বৃষ্টির মধ্যেই সব কাজ শেষ করে হান্নান শেখ বাড়িতে ফিরেন, সঙ্গে করে কাজি এবং কিছু হুজুর মানুষ আনেন। বৃষ্টি কমার অপেক্ষা করতে-করতে এদিকে চারটা বেজে যায়। বৃষ্টির কমার বদলে উলটো অবস্থা দেখা দেয়। আবহাওয়ার ওমন খারাপ পরিস্থিতি দেখে সবাই শুধু হতাশার নিশ্বাস ছাড়ছে, বৃষ্টির জন্য রাস্তাঘাটের অবস্থা করুণ হয়ে যাচ্ছে। সুজলা এবং মাহমুদা এসে মেহনূরকে প্রস্তুত করে, সাড়ে চারটার দিকে কাজি এসে কবুলের কাজ শেষ করবে। হান্নান শেখ কাজিকে ডেকে বিয়ের কাজ শুরু করতে বলেন। কাজির আদেশে সিয়াম তখন মাহতিমকে ডাকতে যায়, মাহতিম সাদা শার্টের কলার ঠিক করে আয়নায় নিজেকে দেখে নেয়। সবকিছু পার্ফেক্ট দেখার পর নিচে নামে, কাজির বিপরীত সোফায় গিয়ে বসে পরে। মারজা ছেলের কীর্তিকলাপ দেখে ক্ষুদ্ধ হয়ে আছে, বিয়ের সময় সাদা শার্ট পরে নরমাল পোশাকে সেজে এসেছে। মাহতিম মায়ের দিকে একনজর তাকালো ঠিকই, কিন্তু না-দেখার ভান করে চোখ সরিয়ে ফেললো। কাজির দিকে মনোযোগ দিতেই কাঙ্ক্ষিত সময়ে পরপর তিন কবুল বলে দিলো। মাহতিমের কবুল বলার সাথে-সাথেই তৌফরা চাপা খুশীতে উচ্ছ্বসিত হতেই খিচ মেরে নিজেদের আঁটকালো। বন্ধু-কাজিনদের অবস্থা দেখে মাহতিম ওই ভরা মজলিশে দারুন লজ্জা পেয়ে চোখ রাঙিয়ে তাকালো, কিন্তু লাভের লাভ কোনোটাই হলো না। তৌফ মোটা একটা পিলারের কাছে কোমর নাচাতে লাগলো, সিয়ামও পাগলের মতো তৌফের সাথে তাল মিলিয়ে দিলো। সিয়াম নিচের ঠোঁটটা দাঁতে চেপে তৌফের সাথেই কোমর দুলিয়ে নাচতে থাকলো। সাবির ওদের উজবুকের মতো কাণ্ডকারখানা দেখে টেনেটুনে লাইব্রেরি ঘরে নিয়ে গেলো। নীতিও প্রচণ্ড লজ্জায় বুঁদ হয়ে মাহতিমের দিকে তাকালো, জোরে একটা নিশ্বাস ছাড়তেই মাথাটা ডানেবামে হালকাভাবে দুলালো। মাহতিম এবার নীতির হাতের দিকে চোখ বড় করে ইশারা করলো, নীতি ইশারাটা খেয়াল করতেই নিজের হাতের দিকে তাকালো, ওমনেই বুঝতে পারলো মাহতিম ওকে ফোন চেক করতে বলছে। নীতি তড়িঘড়ি করে ফোন চেক দিতেই নোটিফিকেশনে মেসেজ দেখতে পায়, মেসেজের লেখাগুলো পড়তে থাকে তখন। ‘ Tui Mehnur er room e ja, ekhane dariye thakis na. Okhane beshi kahini hole amake ekta signal dibi. That’s the what, you’ve to do.
নীতি মেসেজটা পরার পরেই পা চালিয়ে সিড়ির দিকে চলে গেলো। মেহনূরের রুমে যেতেই যা ভেবেছিলো, তাই দেখলো। মেহনূর চোখ ফুলিয়ে নাক লাল করে নিঃশব্দে কাঁদছে, শানাজ ওকে থামানোর জন্য নানাভাবে বুঝাচ্ছে। নীতি মাহতিমের আদেশমতো দাড়িয়ে থাকলো, মিনিটের মধ্যে কাজি এসে কণের কাছ থেকেও কবুল শুনে নিলো। মাহতিমের কাছ থেকে যত দ্রুত উত্তর পেয়েছিলো, মেহনূরের কাছ থেকে কবুল শুনতে তার চেয়ে দ্বিগুণ সময় ধৈর্য্য ধরতে হলো। মেহনূর যখন প্রথম কবুলের সময় অঝোর কেদেঁ দেয়, তখন না পারতে মাহমুদা গিয়ে হান্নান শেখকে ডেকে আনে। হান্নান শেখ রুম থেকে সবাইকে বের করে শুধু কাজিকে রেখে দেয়। কাজির সামনেই নাতনীর মাথায় হাত রেখে কবুল বলার জন্য অনুরোধ করে। মেহনূর কান্নামিশ্রিত চোখ তুলে দাদার দিকে একবার তাকায়, দাদার সেই মমতাপূর্ণ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে তোতলানো সুরে কবুল উচ্চারণ করে। বিয়ের পর্ব শেষ হলে হান্নান শেখ নাতনীর সাথে একান্ত আলাপ সারেন। মেহনূরের পাশে বসে পান্ঞ্জাবীর পকেট থেকে পুরোনো দিনের বহু ব্যবহৃত রুমালটা বের করেন। নাতনীর মুখটা নিজের দিকে তুলে রুমালে চোখ মুছিয়ে দেন হান্নান। মেহনূর দাদার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে চুপ হয়ে যায়, কান্নার হিড়িকি মৃদ্যু-মৃদ্যু কাপুনিতে কেঁপে উঠে। হান্নান শেখ নরম কন্ঠে আদরের সাথে ডেকে উঠেন,
– দাদুভাই, কেঁদো না দাদুভাই।
দাদার কন্ঠ শুনে শান্ত মেহনূর আবার ঠোঁট ফুলিয়ে মাথা নিচু করে কেদেঁ দেয়। ফিসফিস করে নতমুখে দুই চক্ষুকোল থেকে অশ্রু ঝরাতে থাকে। হান্নান শেখ ভারী একটা নিশ্বাস ছেড়ে নিজের কুঁচকানো চামড়ার হাতটা মেহনূরের মাথায় তুলে দেন। মনের উপর পাথর চাপা দিয়ে নিজের অশ্রুজড়িত আবেগ সামলে নেন, কন্ঠ অনেকটা শান্ত করে আবার বলে উঠেন,
– তোমরা খুব নিষ্ঠুর নিয়মে দুনিয়ায় আসো দাদু। তোমরা মায়া বাড়িয়ে হুট করে একদিন পরের বাড়িতে চলে যাও। এইযে আজ চলে যাচ্ছো, নিজের মনকে বিশ্বাস করানো যাচ্ছেনা। কালও মনে হচ্ছিলো তুমি আমার নাতনী, মোল্লা হান্নান শেখের নাতনী। কিন্তু আজ তুমি মারজার সম্পদ। চোখের পলকে সম্পর্ক ভাগ হয়ে গেলো দাদু। আজ থেকে তোমার উপর আমার অধিকার কমে গেলো। তোমার বাবা এই পরিবারের জন্য যা করেছে, আমি তোমাদের জন্য ওটুকুও করতে পারিনি। বিদেশের মাটিতে বছরের-পর-বছর খাটছে, অথচ দেশে আসার নাকি সুযোগ নেই। তোমাকে খুব ভালো ঘরে দিয়েছি দাদুভাই, আমি আমার মেয়ের কাছেই তোমাকে পাঠিয়ে দিয়েছি। ওরা খুব মানুষ। তোমার মরহুম শ্বশুর একটা নরম মনের ব্যক্তি ছিলো, ও বেঁচে থাকলে দেখতে পেতে কতো সোহাগে মাথায় তুলে রাখতো। কেঁদো দাদুভাই, আজ যদি বিয়েটা না দিতাম গ্রামের মানুষ তোমাকে নিয়ে ছিঃছিঃ করতো। আমি তোমার সম্মান নিয়ে ওরকম ব্যবহার দেখতে পারতাম না দাদু, এই বুড়ো বয়সে সহ্য করতে পারতাম না। তুমি আমার বাকি নাতনীদের তুলনায় অনেক অবুঝ, ওরা খারাপ পরিস্থিতিতে পরলে নিজের স্বার্থ মতো কাজ করতে পারে। কিন্তু তুমি সেটা আজ পযর্ন্ত শিখোনি। যাদের কাছে তোমাকে সপে দিয়েছি, আল্লাহ তায়ালর কাছে দোয়া করি ওরা তোমাকে ভালো রাখুক। সুস্থ রাখুক। সুখে-শান্তিতে থাকো।
হান্নান শেখের কথা শুনে মেহনূর একটু-একটু করে কান্না থামিয়ে ফেললো। দাদার সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটাতেই হান্নান শেখের ডাক চলে এলো। পন্ঞ্চায়েতের জন্য আগেই রওনা দিতে হবে, তাই হান্নান শেখ সবকিছু বুঝিয়ে চলে গেলেন। বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও ছাতা হাতে দলবল নিয়ে ঝাঁক আকারে বেরিয়ে পরলেন। নিচে সবাই খাবারের জন্য ব্যস্ত হয়ে পরলে মাহতিম সুযোগ মতো দোতলায় যায়, মেহনূরের দরজার দিকে যেই এগুতে নিবে ওমনেই শানাজ আর সাবা এসে পথ আঁটকে দেয়। দুজনেই বুকের কাছে হাতভাঁজ করে ভ্রুঁ নাচিয়ে একসঙ্গে জিজ্ঞেস করে,
– কোথায় যাচ্ছেন?
মাহতিম দুজনের অবস্থা দেখে না হেসে পারলো না। একটুখানি হেসে দিয়ে ফাজলামির সুরে বললো,
– যেখানে ফুল, সেখানেই মৌমাছি।
এমন হেয়াঁলি কথার ইঙ্গিত বুঝে সাবা আর শানাজ হাসি থামিয়ে ফেললো। কথাটার পেছনে মাহতিম ওদের দারুণ একটা লজ্জা দিলো। শানাজ মুখটা কালো করে ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,
– এটা কিন্তু ঠিক না ভাইয়া, আপনি এখনই মেহনূরের সাথে কথা বলতে পারবেন না।
শানাজের কথার রেশ টেনে সাবাও পাশ থেকে বলে উঠলো,
– জ্বি ভাইয়া, আপনি সন্ধ্যার আগে ওর কাছে ভিড়তে পারবেন না।
মাহতিম দুজনের কথা শুনে ছোট চোখে তাকালো। ডানহাতটা কালো প্যান্টের ব্যাকপকেটে চালান দিলো। পকেট থেকে ওয়ালেট বের করতেই তাচ্ছিল্যের গলায় বললো,
– আসতে-আসতেই সেই রাত হয়ে যাবে শানাজ। পন্ঞ্চায়েতের জন্য রওনা দিবো। বউ যে ভেতরে কেদেঁকেটে সর্বনাশ করে ফেলেছে, আমাকে একটু সামলাতে হবেনা?তোমরা তো টিস্যু দিয়ে চোখদুটো মুছে দিচ্ছো, আমারতো অন্য টেকনিকে চোখ মুছতে হবে। কতো দিবো?
শানাজ-সাবা না পারতে নিজেদের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করলো। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে মাহতিমের দিকে তাকালো, মাহতিম ওয়ালেট খুলে আবারও ঠোঁট নাড়িয়ে বললো ‘ কতো দিবো? ‘। শানাজ মনে-মনে দুটো অঙ্ক বসিয়ে মুখ দিয়ে সংখ্যাটা বললো,
– দশ।
মাহতিম এমাউন্টের অবস্থা শুনে প্রচণ্ড অবাক হয়ে গেলো। বাঁ ভ্রু উঁচিয়ে চোয়াল ঝুলিয়ে আহাম্মক হয়ে গেলো। ওয়ালেটের দিকে আবার বিষ্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– সিরিয়াসলি দশ? তোমরা জানো কতগুলো টাকা আবদার করেছো? আমার কাছে সত্যিই এতো টাকা ক্যাশ নেই। তোমাদের এই আবদারের জন্য ব্যাংকে যেতে হবে দেখছি।
মাহতিমের অবস্থা দেখে দুবোন হোহো করে হেসে দিলো। দুজনের হাসি দেখে মাহতিম স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসে ক্রেডিট কার্ড বের করলো। শানাজ এদিকে সাবার উপর লুটোপুটি খেয়ে হাসছে, মাহতিম এই সুযোগে শানাজের হাতে কার্ড গুঁজিয়ে দরজা ঠেলে ঢুকে। শানাজ বাধা দেওয়ার জন্য কিছু বলবে তার পূর্বেই মাহতিম দরজা আটকে দেয়। হুটহাট করে দরজা খুলে ঢুকে পরাতে মেহনূর প্রচুর চমকে যায়, হাঁটু থেকে কপাল তুলে সামনের দিকে তাকায়। তখনই দেখতে পায়, মাহতিম দুই নাম্বার ছিটকিনিটা আঁটসাঁট করে আঁটকে দিচ্ছে। মেহনূর সেই দৃশ্য দেখে অশ্রুচোখে কুকড়ে উঠে। মাহতিম হুট করে রুমে ঢুকে চট করে ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়েছে, মেহনূর জড়তার ভয়ে সেদিনের মতো পিছাতে থাকে। মাহতিম হাতদুটো ঝারা মেরে পিছু ফিরে তাকাতেই মেহনূরের ওই অবস্থা দেখে হাত ঝারা থামিয়ে ফেলে, চোখদুটো তীক্ষ্ম করে কপালে অসংখ্য ভাঁজ ফেলে তাকায়। প্রশ্ন গলায় জিজ্ঞেস করে,
– খুশী হওয়ার বদলে পিছিয়ে যাচ্ছো কেনো? কি সমস্যা?
মেহনূর আর কোনো কথাই বলতে পারলো না। হাতঘড়িতে চোখ স্থির রেখে মাহতিম ওর দিকে হেঁটে এলো। বিছানায় উঠে মেহনূরের সামনে যেয়ে বসতেই স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকালো। মেহনূর বন্ধ জানালার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে পিছিয়ে আছে, হাঁটুদুটো বুকের কাছে তুলে জবুথবু হয়ে বসে আছে। পড়নে লাল রঙের সুতির শাড়ি, মেরুন রঙের মোটা পাড়। মাথায় ঘোমটা দেওয়া, হাতদুটো লাল রেশমী চুড়িতে ভর্তি করা। মাহতিম ওর দিকে ইচ্ছে করেই এগিয়ে গেলো, মেহনূর চুপসে গিয়ে হড়হড় করে চোখ নামিয়ে ফেললো। মেহনূরের হাতটা টেনে নিয়ে নিজের গালে চেপে ধরলো মাহতিম। মেহনূরের দিকে দৃষ্টি রেখে হাতটা ঠোঁটের কাছে এনে ছুঁয়িয়ে দিলো। সেই হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলে ক্ষীণ ব্যথায় চোখ কুঁচকে ফেললো মেহনূর। মাহতিম ওর দিকে নিবদ্ধ রেখে বুকের বাঁদিকটায় চেপে ধরলো। খুবই শক্ত করে, বেশ চাপ দিয়ে বাপাশটায় আবদ্ধ রাখলো। মেহনূর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে কৌতুহলের রেশে চোখ তুলে তাকালো। মাহতিমের দিকে তাকাতে গিয়ে লক্ষ্য করলো, মাহতিম লম্বা-লম্বা শ্বাস নিচ্ছে। নিবিষ্ট নয়নে স্থিরভাবে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে আছে।মেহনূর সেই দৃষ্টি থেকে চোখ সরিয়ে নিলোহ বিচলিত নয়নে হাতচাপা দেওয়া স্থানটায় তাকালো। সাদা শার্টটার নিচে বুকের বাঁপাশটা আঁটো হয়ে ঢেকে আছে, সেই শার্টের উপর চেপে রাখা হাতটা ধুক-ধুক, ধুক-ধুক করে কিছু টের পাচ্ছে। হাতের তালুতে জোরে-জোরে হাতুড়ি পেটাচ্ছে কেউ। মেহনূর সে জায়গাটা থেকে চোখ সরিয়ে মাহতিমের দিকে তাকালো। লম্বা-লম্বা শ্বাস নিতেই মাথাটা নিচু করে ফেললো মাহতিম। চেপে রাখা হাতটাও ধীরে-ধীরে আলগা করে দিলো, এতে মূহুর্ত্তের মধ্যে মেহনূরের হাতটা ওর হাতের বলয় থেকে বিছানায় পরে গেলো। মাহতিম নিচুস্বরে বলতে লাগলো,
– তোমাকে দেখলে আমার এই অবস্থাটাই হয় মেহনূর। ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারিনা, নিতে গেলে বুকে টান লাগে। অসহ্য একটা ব্যথা হতে থাকে, সেই ব্যথাটা কষ্টের না দূরত্বের, জানিনা। এই অবস্থাটা সামলানোর দায়িত্ব তোমার। বুকে যেহেতু হাত রাখার অধিকার দিয়েছি, নিশ্চয়ই তোমার ছোট্ট দেহটা রাখার অনুমতিও আছে। আমি সেটার জন্য অপেক্ষায় থাকলাম মেহনূর। কাউন্ট ডাউন শুরু।
– ‘ চলবে ‘
#FABIYAH_MOMO