মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব-৪০+৪১

0
966

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৪০.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

সোল্লাসে মেতে উঠলো আনসারী নিবাস। কেউ বুঝতে পারেনি, ভাবতে পারেনি, মাহতিম হুট করে সকলের মাঝে ফিরে আসবে। যেখানে আসার কথা ছিলো ছয়টা মাসের ব্যস্ত জীবন কাটিয়ে, সেখানে চারটা মাসের হাড়ভাঙ্গা ক্লান্তি শেষে আচমকা সে ফিরে এসেছে। মাহতিমের আগমনে পুরো বাড়ির আবহাওয়া আনন্দমেলায় রমরমা, তবুও দুটি মানুষের মন যেনো ভার হয়ে আছে। রজনী ও অনামিকা এবার যেনো সুযোগের অবস্থা দেখে রসালো ঠোঁটে হাসলো। এদিকে মাহতিম আসতে-না-আসতেই দলবলকে খবর দেওয়ার মতো মহৎ কাজটা করে ফেলেছে। এবারও সে বাড়ির বাইরে বেড়ানোর পরিকল্পনা করে রেখেছে। মারজা এ নিয়ে কোনো দ্বিধা প্রকাশ করলেন না। তিনি জানেন, ছেলে এবারও তার কোনো কথা শুনবে না। মাহতিম যেহেতু বেড়ানোর এহলান করেই দিয়েছে, তার মানে যতো ঝড়বৃষ্টি হোক না কেনো, সে যথাসময়ে সবকিছু রেডি করে ফেলবে, একইসাথে বন্ধুদল এবং ভাইবোনেরা ঠিকই যথাসময়ে হাজির হয়ে যাবে। পরদিন ভোরের আলো ফুটতে-না-ফুটতেই সকলের আসার খবর আসতে লাগলো। মেহনূর একের-পর-এক খবর শুনে আশ্চর্যে হতবাক! বাড়িতে আসতে দেরি, অথচ বাড়ির হুল্লোড় ফিরতে দেরি হলো না। মারজাকে ঔষুধ খাইয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিচে নামলো মেহনূর, রাতে মাহতিমের সাথে থাকা সম্ভব হয়নি। সে নিজেই মেহনূরকে মারজার রুমে ঘুমাতে পাঠিয়ে দিয়েছে, কেনো দিয়েছে মেহনূর সেটা জিজ্ঞেস করেনি। সকালের নাস্তার আয়োজনটা সিরাজ কাকা ও সাবু খালা সামলাচ্ছে। রান্নাঘরের সবকিছু কতদূর এগিয়েছে সেটা দেখার জন্য সেখানে উপস্থিত হলো মেহনূর, পরোটার তলায় একটুখানি তেল ঢেলে মেহনূরের উদ্দেশ্যে বললো খালা,

– ও বউ তুমি উইঠা গেছো? যাক ভালা হইলো। তুমি এট্টু এইনে খাড়াও তো দেহি, আমি যাইয়া এট্টু কফিডা দিয়া আহি। রজনী ভাবী হেই কহন চাইছে, এট্টু খাড়াও এইহানে। আইতাছি।

ট্রে-তে চটপট কফির মগটা রেখে চুলাটা মৃদ্যু আঁচে কমিয়ে সাবু খালা চলে গেলো। বৃদ্ধ সিরাজ একে-একে সব নাস্তা প্রস্তুত করে অন্য কাজের জন্যে বেরিয়ে পরলো। মেহনূর সবকিছু ঠিকঠাক দেখে অন্য চুলায় চায়ের পানি বসালো, সকাল-সকাল মারজাকে এক কাপ আগুন গরম চা না দিলে তিনি মুখ ফুলিয়ে বসে থাকেন। মেহনূর বাদে অন্য কারোর হাতে চা খেতে তিনি যথেষ্ট নারাজ। সারি সারি তাক থেকে চাপাতার বয়াম নিয়ে গোল ঢাকনাটা ঘুরাতে-ঘুরাতে খুলতে লাগলো মেহনূর, চুলার কাছে চায়ের দুটো কাপ এবং দুধ-চিনি রেখে দিলো। পরিষ্কার ছাঁকনি দিয়ে চায়ের কালচে লিকারটা কাপে ঢেলে নিতেই চামচ দিয়ে দুধ মিশিয়ে নিলো, চিনির পরিবর্তে মারজার কাপে জিরো সুগারের ছোট্ট ট্যাবলেট ছেড়ে দিলো। পুনরায় যখন চায়ের কাপে চামচ নাড়াতে ব্যস্ত হলো, তখনই দমকার হাওয়ার ন্যায় পিঠের উপর উষ্ণসূচকের লহমায় চমকে উঠলো মেহনূর। সমস্ত শরীরের সাথে-সাথে হাতটা শিউরে উঠতেই আঙ্গুলের ডোর থেকে ফসকে গেলো চামচটা, তখনই টস করে চামচটা কাপের গায়ে শব্দ করে উঠলো। চোখদুটো আচ্ছন্নের মতো তৎক্ষণাৎ বন্ধ হয়ে এলে পেছন থেকে একজোড়া হাতের আগমন টের পেলো মেহনূর। হাতদুটো ধীরগতিতে কোমরের দুধার থেকে ধেয়ে এসে পেটের উপর বেষ্টন করে ধরলো। দফায়-দফায় অধরযুগলের ছোট্ট-ছোট্ট পরশ যেনো পিঠের পরিখায় ছাপিয়ে দিতে উন্মত্ত ছিলো। ক্রমে মেহনূরের হাতদুটো মুঠো হয়ে গেলো। জানালার গ্লাস গলে সোনালী সূর্যের আলোটা পাতার ফাঁকফোঁকর দিয়ে ঝাঁঝরা হয়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করছিলো, স্নিগ্ধ সকালের মনোহর পরিবেশ যেনো নিরব সাক্ষী হয়ে সব দেখতে লাগলো। রুদ্ধপ্রায় নিশ্বাসে চোখদুটো খুললো না মেহনূর, মনের উপর বশীভুত অবস্থার জন্য দেহের উপরও চন্ঞ্চলতার উচ্ছাস এসে ভর করছে। শক্ত করা মুঠোদুটোর আঙ্গুল আস্তে-আস্তে আলগা করলো মেহনূর, কাপের কাছ থেকে হাত নামিয়ে পেটের উপর থাকা হাতযুগলের উপর আস্তে করে রেখে দিলো। কোনোমতে আধো-আধো গলায় স্বর নামিয়ে ঘোরাক্রান্ত মানুষটার উদ্দেশ্যে বললো,

– এটা রান্নাঘর, ছেড়ে দিন না।

পিঠের উপর কার্যসাধন করা মাহতিম নিঃশব্দে হেসে ফেললো তখন। মেহনূরের কন্ঠ যে ভীতু বনে গেছে সেটা আন্দাজ করে ঠোঁটে প্রগাঢ় হাসি ফুটিয়ে তুললো। নিশ্বাসের অবস্থা প্রখর হয়ে গেছে, বারবার পেটের উঠা-নামার জন্য নিজের হাতদুটোও সমান তালে উঠা-নামা করছে। মেহনূরকে ছেড়ে দিয়ে যদি নিজের দিকে ঘুরানো হয়, তাহলে সে কি লজ্জায় মাহতিমের দিকে তাকাতে পারবে? অতি লজ্জায় তার ছোটোখাটো মুখটা কি রক্তজবার মতো লাল হয়ে যাবে না? এইযে আদুরে ভঙ্গির আচরণগুলো করলো, ছোট ছোট স্পর্শে ছুঁইয়ে দিলো, এসবের ব্যতিরেকে সে কি লজ্জায় বুঁদ হবেনা? মুখটা নিজের দিকে ঘুরাতে নিলে, চোখদুটোয় দৃষ্টি মিলাতে নিলে, তখন কি দুহাতে লজ্জামাখা মুখটা তাড়াতাড়ি ঢাকবে না? মাহতিম মনের মধ্যে অজস্র কথা ভাবতে থাকলে পিঠের উপর থেকে ঠোঁট সরিয়ে আনলো, তার নিচু করা মাথাটা উপরে তুলতেই মেহনূরের ডানকাধে থুতনি ছেড়ে দিলো। সদ্য শেভ করা ক্লিন গালটা সন্তপর্ণে মেহনূরের ডান গালে ছুঁইয়ে দিতেই চোখ বন্ধ করে বললো,
– এটা যদি আমাদের রুম হতো, তখন কি আগলে রাখতে?

লজ্জায় নিজেকে আড়াল করতে চাইছে মেহনূর। এতো লজ্জা, এতো চাপা অবস্থা নিয়ে এই মানুষটার সামনে দ্বিতীয়বার পড়া যাবে না। তার মুখে তো কিছু আঁটকায় না, তন্মধ্যে কখন কি বলে ফেলে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। মেহনূর ঢোক গিলে চোখ খুলে দরজার বাইরে দৃষ্টি দিলো, কেউ এখনো দেখেনি দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়তেই পেটের উপর থেকে চাপযুক্ত বন্ধনটা ঢিলে হয়ে গেলো। কাধ থেকে ভারী থুতনিটা সরে যেতেই চুলার একটু পাশে ঠিক ডানদিকটায় উঠে বসলো মাহতিম। ঠান্ডা হয়ে আসা চা-টা ফের গরম দেওয়ার জন্য চুলায় বসালো মেহনূর, একবারের জন্যও সে মাহতিমের দিকে চোখ তুলে তাকালো না। একটু আগের চনমনে ভাবটা এখনো দেহের শিরায়-শিরায় দোল খেয়ে ঘুরছে, যদি চোখের ভাষায় সেটা ধরা খেয়ে যায় তাহলে ঘোর বিপদ আসন্ন! মাহতিম মিচকি-মিচকি হাসিতে মেহনূরের কাণ্ডকারখানা দেখতেই সরল গলায় বললো,
– ম্যাডাম, আপনার হাতের এক কাপ চাই। মেহেরবাণী করে যদি মাহতিম আনসারীর খায়েশটা পূরণ করতেন, তাহলে পুরো নেভি টিম আপনাকে কুচকাওয়াজের সংবর্ধনা দিতো।

চুলার টগবগে চায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ মাথা নিচু করে হেসে দিলো মেহনূর। শব্দহীন ভঙ্গিতে হাসতে থাকলে হাসি-হাসি চোখ তুলে মাহতিমের দিকে তাকালো, এক পশলা প্রাণবন্ত হাসি দিয়ে বললো,
– দিচ্ছি।

ফিরতি উত্তরটা শুনে আশ্চর্য হতে গিয়ে হেসে ফেললো মাহতিম। একটু হলেও হোক, মেহনূরের বরফতুল্য জড়তা দিনকে-দিন সময়ে-সময়ে উষ্ণ সাহচর্যে গলতে শুরু করেছে। মাহতিম চুপ করে হাসিমুখে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে রইলো। ধোয়া উঠা চা-টা দু’বার দু’দফায় গরম করে দুটো কাপে ঢেলে নিলো মেহনূর, একটা কাপের তলায় পিরিচ দিয়ে সেটা মাহতিমের দিকে এগিয়ে দিলো। বাড়িয়ে দেওয়া কাপটার দিকে একপলক তাকালো মাহতিম, পরক্ষণে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে পলকহীন দৃষ্টিতে বললো,

– চিনিটা যদি চেখে দেখতেন, আমার মতো ব্যস্ত মানুষটার কষ্টটা একটু কমে যেতো।

কথাটার ইঙ্গিত বুঝতে একটুও সময় লাগলো না, চট করে পুরোনো দিনের স্মৃতিকথা মনে পরলো। সেই রাতেরবেলা সবাই যখন ঘুমের রাজ্যে নাস্তানাবুদ, তখন একাকী রান্নাঘরে চায়ের পসরার সামনে হাজির হয়েছিলো এই অ’সভ্য খ্যাত লোকটা। সেদিনও একই কায়দায় এক কাপ চায়ের ফরমাশ করেছিলো সে, বুদ্ধির উপর ভেলকি দিয়ে মেহনূরের চুমুক বসানো কাপে সে নিজেও ঠোঁট লাগিয়ে চুমুক দেয়, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা কৌতুহল কিশোরীর কাছে নিজের আর্দ্র অনুভূতি ব্যক্ত করে লোকটা। আজও এই লোকটা তার কাছে মনের রুদ্ধ-দ্বার খুলে আবদারের বায়না চেয়ে বসেছে। মেহনূর ইতস্তত ভঙ্গিতে নত মাথায় কাঁচুমাচু করতে থাকলে হঠাৎ মেহনূরের পেছনে থাকা দূরবর্তী দরজায় দৃষ্টি থমকে গেলো মাহতিমের। সাবু খালা রান্নাঘরে ঢুকবে কিনা সেটা নিয়ে হাঁশফাঁশ করছিলো, তার এদিক-ওদিক করা দ্বিধাপূর্ণ দৃষ্টি যখন একজোড়া তীক্ষ্ম দৃষ্টির পানে পানে পরলো, সে ভয়ে ভূত দেখার মতো শিউরে উঠে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো, তাড়াতাড়ি করে নিজেকে স্বাভাবিক করার ধান্দায় জোরপূর্বক হাসি ছুঁড়ে দিলো। কিন্তু আফসোস, লাভ হলো না। ওই তীক্ষ্ম দৃষ্টি তার ধারালো-ভয়াবহ চাহনি দিয়ে ভেতরের ক্ষেপাটে ভঙ্গিটা এমন ভাবে প্রকাশ করলো, সাবু খালা এক সেকেন্ডও দাঁড়ানোর স্থিতিতে রইলো না, ভীতিগ্রস্থ মুখ নিয়ে তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলো। এদিকে মেহনূর নিজের প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থাটা কোনোমতে কাটিয়ে চায়ের কাপে ঠোঁট চেপে দিলো, ছোট্ট এক চুমুক দিয়ে মাহতিমের দিকে ঠেলে দিলো কাপটা। মেহনূর লজ্জাহত অবস্থার জন্য চোখ তুলেনি, যদি একবার চোখ তুলে মাহতিমের দিকে তাকাতো, ভয়ে হয়তো সহজলভ্য আচরণটা আর কখনোই দেখাতে পারতো না মেহনূর।

.

দিনের আলোটা নেভার কৌশলে কমলাবর্ণের চাকাটা পশ্চিমে এখন ডুবো-ডুবো করছে। সূর্যের তেজীভাব হ্রাস পেয়ে ঠান্ডা বাতাসের ঢল নেমেছে। প্রকৃতির মাঝে দেখা যাচ্ছে বেগুনি আকাশের দারুণ আদিখ্যেতা, সেই আকাশে ডান ঝাপটে নীড়ে ফিরছে পাখিদের ব্যস্ত দল। কিছু কুচকুচে কাক কুৎসিত ডাকে ‘ কা কা ‘ করছে, বাতাসের জোরালো ঝাপটা খেয়ে গাছের পাতারা কল্লোল করছে এখন। দ্বিগ্বিদিক ছেয়ে যাচ্ছে নিরবতার চাদর, শহুরের হুল্লোড় কমতে-কমতে কয়েকটা হর্ণের বাজনা শোনা যাচ্ছে। টাইলসে বাঁধাই করা পরিষ্কার ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে মাহতিম, তার পাপড়িভরা নয়নদুটো আকাশের উপর ন্যস্ত। আজ বাইরে যাওয়া হয়নি বলে চুলের উপর জেলের আস্তরণ পরেনি, জেলহীন চুলগুলো বাতাসের সান্নিধ্য পেয়ে থেমে-থেমে উড়ছে। গাঢ় বাদামী রঙের শার্টটা এখন কালো হুডির নিচে ঢেকে আছে, বুকের কাছে হুডির চেইনটা লম্বালম্বি করে খোলা। ওই চেইন খোলা অংশ দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভেতরের বাদামী শার্ট, শার্টটার প্রথম বোতামটা খোলা থাকার কারণে বাতাসের ঝাপটা লেগে বুকের কিন্ঞ্চিত অংশ উন্মুক্ত হয়, আবার বাতাসের ঝাপটা কমে গেলে আগের অবস্থায় ফিরে আসে। পরশু দিন কক্সবাজার যাওয়ার জন্য পরিকল্পনা করেছে মাহতিম, তার ফিল্ডের মূল ঘাঁটিটা চট্টগ্রাম শহরে। সেখান থেকে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে কতবার ঘিয়েছে সেটা অবশ্য বেহিসেব। এবার পরিবার নিয়ে বেড়িয়ে আসার চিন্তাটা পাকাপোক্ত করেছে শুধুমাত্র মেহনূরের জন্য, মেহনূর আজ পযর্ন্ত বাড়ির গন্ডি পেরিয়ে প্রকৃতি দেখেনি। মাহতিম হিমেল হাওয়ার ওই সাঁঝের মায়ায় চোখ বন্ধ করলো, মানসপটের সাদা ক্যানভাসে রঙতুলি চালিয়ে বেশ রঙিন ছবি তৈরি করলো, সেখানে মেহনূর নামক হাস্যোজ্জ্বল কিশোরীর চোখে-মুখে লজ্জার ছাপ, পড়নে সোনালী পেড়ে লাল টুকটুকে শাড়ি, নাকে বিয়ের সাজের মতো সোনালী রঙের গোল নোলক, মাথাটা টিকলী সমেত অলঙ্কৃত, হাতভর্তি বধূর সাজের মতো ভারী-মোটা চুড়ি। রঙবেঙরের ফুলের মাঝে সুসজ্জিত ছোট্ট ঘরে নূপুরের পদধ্বনিতে আগমন করবে মেহনূর আফরিন। লম্বা ঘোমটার আড়ালে যার সমস্ত রূপ আবৃত থাকবে সেদিন। দীর্ঘদিনের অপেক্ষা, উৎকন্ঠা শেষে তীব্র আকাঙ্ক্ষিত দিনটায় স্বপ্নচারিনীর মেহেদি রাঙা হাতদুটো অধিকারের আবেশ খাটিয়ে নিজের হাতে পুড়ে নিবে। মেহেদির সুক্ষ সৌন্দর্যের উপর গাঢ় চুম্বনের ওষ্ঠজোড়া চেপে রাখতে দিবাক্ষণ প্রস্তুত যেনো, লজ্জায়-ভালোবাসায় দুরুদুরু করা বুকটায় একটু সাহস ভরে চোরা নজরে তার প্রাপ্তবয়স্ক সুদর্শণ পুরুষটাকে প্রাণভরে দেখবে মেহনূর, হঠাৎ দুজনের মাঝে চোখাচোখি হতেই…

– হ্যালো আনসারী, একা একা এখানে কি করছো? খারাপ লাগছে নাকি? কোম্পানি দিবো?

রঙিন কল্পচিত্রে কেউ যেনো কালো ঢেলে দিলো। সেই কালির গাঢ়তা এতোই প্রকট হলো, কোনোভাবেই পুরোনো চিত্রটা ফিরে পেলো না মাহতিম। চোখের বন্ধ কপাটটা খুলে সঙ্গে-সঙ্গে ডানে ফিরে তাকালো, ঠিক পাশাপাশি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনামিকা। মধ্যবর্তী দূরত্ব দেখে রাগে নিজেই খানিকটা দূরত্ব করে পিছিয়ে গেলো মাহতিম, রেলিং থেকে হাত সরিয়ে ধীরেসুস্থে ট্রাউজারের দু’পকেটে হাত গুঁজে ফেললো। অনামিকার পোশাকে একবার চোখ বুলিয়ে ঘেন্নায় অন্যদিকে মুখ ফেরালো। অনামিকা হাতদুটো ভাঁজ করে লাস্যময়ী হাসি ছুঁড়ে বললো,

– অনেষ্টলি স্পিকিং আনসারী, ডে-বায়-ডে ইউ আর গেটিং হ্যান্ডসাম। মাশল ফুলে তো দেখি হার্টবিট মিসের অবস্থা করে ফেলেছো। তা তোমার ফিগার দেখে তো আমারই প্রেম পাচ্ছে, ওর কি একটুও প্রেম পায় না?

অনায়াসে কথাগুলো বলে দিয়ে টসটসে চোখে আপাদমস্তক দেখতে লাগলো অনামিকা। একদিন এই যুবা পুরুষের উপরই নিয়ন্ত্রণ হারাতে বসেছিলো সে, হারাতে গিয়ে নিজের সম্রন্ত্র ব্যক্তিত্বের উপর এমন অপঘাত খেলো সেটার মাশুল এখনো মনের মধ্যে দগদগে হয়ে আছে। অনামিকার তেরছা খোঁচায় ক্ষেপার পরিবর্তে বাঁকাহাসি দিলো মাহতিম। দৃষ্টিদুটো অনামিকার দিকে স্থির রেখে পায়ে-পায়ে একদম নিকটে এগুতে লাগলো, এমন দৃশ্য দেখে লাস্যময়ী হাসিটা উবে গিয়ে এক লহমায় আতঙ্কগ্রস্থ দৃষ্টি ধারণ করলো। আতঙ্কের আভাসটা অনামিকার চোখে-মুখে ফুটে উঠলে বাঁকা হাসিটা গাঢ় করে একদম কাছে গেলো মাহতিম, মাথাটা নিচু করে অনামিকার দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে কয়েক মিনিট তাকিয়ে থাকলো। অনামিকা যেনো নিজের মধ্যে নেই, সে আবারও অতীতের ভুলের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে। যেই কড়া পারফিউমের ঘ্রাণে দেহের ভেতর নিভু-নিভু কোষগুলো উত্তেজনায় উদ্দীপ্ত হয়ে যেতো, যেই চাহনিতে দৃষ্টি পরলে নিজের বিবেক-আবেগ কাজ করতো না, যেই বাঁকা ঠোটের হাসি দেখলে বুকের ধুকধুকনি নিশ্বাসের ব্যাঘাত ঘটাতে তটস্থ থাকতো, আজ ফের একই অবস্থা হচ্ছে। অনামিকা কন্ঠ গুলিয়ে ফের তোতলামি ভঙ্গিতে সুর ধরেছে,

– ইইইউ আআর গিভিং মি ডেডে’ন্ঞ্জা’রারাস লুলু’ক মাহতিতিম, প্লিপ্লিপ্লিজ ডোন্ট ডু দ্যাদ্যাট..

মাহতিম চওড়া করে হেসে দিলো। নিচু গলায় ক্ষো’ভ দেখিয়ে বললো,
– ইউ আর জাস্ট এ্যা ভা’লগার! আমি সেদিনও তোমায় ঘৃ’ণা করতাম, আজও তোমায় প্রচণ্ড বেশি ঘৃ’ণা করি। তুমি আমার মেহনূরের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলবে, ওর আশেপাশেও যদি তোমার নোং’রামির ছায়া ভিড়তে দেখি, গতবার যেই হাল করেছিলাম, এবার একদম নৃ’শংস অবস্থা করে ছেড়ে দিবো। তোমার চৌদ্দগোষ্ঠীর একটাকেও আমি মাহতিম ভয় পাই না। পলিটিক্যাল পাওয়ার কতো খাটাতে পারো, খাটাও। আমিও মুখে চিড়া ভিজিয়ে তামাশা দেখবো না। চুপ আছি, তার মানে নিশ্চয়ই এটা না, আমি কিছুই করতে জানিনা। আমার মা’কে তোমরা উলটা-সিধা যতোই বুঝাও, আমার আচরণ কোন্ পর্যায়ে জ’ঘন্য হতে পারে সেটা একবার প্রমাণ পেয়েছো। এবার যদি ধরি, খু’ন করে এমন জায়গায় পাঠিয়ে দিবো, সারা জনম খুঁজলেও লা’শের অস্তিত্ব খুঁজে পাবেনা।

বিক্ষোভে ফেটে পরা বাক্যগুলো শশব্যস্তে ছুঁড়ে দিলো মাহতিম। নিচু করা মাথা স্বাভাবিক করে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো, বিদ্যুপৃষ্ঠের মতো শক্ত থাকা অনামিকা থরথর ঠোঁটে স্থির চোখে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। চোখের উপর টলটলে অশ্রুর জোয়ার দেখে একই স্টাইলে আরেকদফা বললো মাহতিম,

– তোমার রজনী ফুপিকে বিশেষ ভাবে সর্তক সংকেত দিয়ে দিও। বলে দিও, যেই হাত দিয়ে আমার বুকের উপর মোচ’ড়ানোর সাহস দেখিয়েছে, ওইহাত আমি সুস্থ রাখবো না। চললাম!

পকেট থেকে দুহাত বের করে মাথায় হুডির টুপিটা এক ঝটকায় টেনে নিলো মাহতিম। ছাদ থেকে বেরিয়ে যেতে-যেতে হঠাৎ দরজার মুখে দাঁড়িয়ে পরলো, কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে শেষে মুখ ঘুরিয়ে স্বাভাবিক এবং সংযত কন্ঠে বললো,

– ট্যূরে যদি ঘাপলা করতে দেখি, একেবারে সমুদ্রের মধ্যেই অস্তিত্ব গেঁ’ড়ে দিয়ে আসবো। লাস্ট এলার্ট!

চলমান .

#ফাবিয়াহ্_মমো .

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৪১.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

অংশ ০১.

সূর্যের চাকাটা সম্পূর্ণ আলো হরণ করে চারধার অন্ধকার করে দিলো। প্রকৃতি যেনো নিরব হতে গিয়ে কুয়াশার প্রহেলিকায় ঘাপটি মেরে বসলো। কেমন শূন্য শূন্য আবহাওয়া চারপাশে ছড়িয়ে আছে, শূন্যতার সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে নিঃশব্দ রুমটা। আলোহীন রুম, সন্ধ্যার পর বাতি জ্বালানোর ইচ্ছে জাগেনি। খোলা জানালাটা লম্বা-লম্বা পর্দা দ্বারা আবৃত, বাইরে থেকে ঠান্ডা হাওয়াটা পর্দার বুক ফুলিয়ে শূন্যে তুলে দিচ্ছে, ওমনেই রুমের ভেতর প্রবেশ করছে দূরের নিয়নবাতির টিমটিমে আলো। স্টাডিটেবিলকে সামনে রেখে রকিং চেয়ারে বসে আছে মাহতিম। তার চোখের কপাটদুটো ক্লান্ত ভঙ্গিতে বন্ধ করে রেখেছে। মনের ভেতর বহুচিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে আজ। সেসব চিন্তাগুলো সারিবদ্ধ ভাবে সজ্জিত করে ভাবছে, একে-একে সব চিন্তার সমাধান ওই অন্ধকার রুমে নিঃসঙ্গ অবস্থায় ভাবছে। এসময় যদি এক কাপ গরম কিছুর আয়োজন হতো, তবে মন্দ হতো না। কিন্তু আবদার করতেও এখন সংযত থাকা লাগবে, যতটুকু সান্নিধ্য মেহনূরের প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই সে পূরণ করবে। মন তো সবসময়ই প্রয়োজনের তুলনায় বেশি চায়, মনের সব খোরাক যদি সাথে-সাথে পূরণ হতো, তবে অপেক্ষার পর সুমিষ্ট আনন্দটা এতো উপভোগ্য ঠেকতো না। বন্ধ দরজাটা কে যেনো খুলছে, নব্ মোচড়ে অতি সাবধানে রুমের ভেতরে পা রেখেছে, আবার সুন্দর করে দরজাটা আগের মতো বন্ধও করে দিলো। মাহতিমের কর্ণধার হামেশার মতো এখনো সজাগ, সমস্ত ইন্দ্রিয় খুব সচলভাবেই চালনা করছে সে। যে মানুষটা রুমে ঢুকেছে তার পায়ের আওয়াজটাও কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস আঁটকে অনুভব করলো, অনুমান শেষে নিঃশ্বাসটা স্বাভাবিক ভাবে ছেড়ে দিতেই ততক্ষণে উক্ত ব্যক্তি নিকটে এসে হাজির। বুকভর্তি লম্বা নিশ্বাস টানলো মাহতিম, এটাও তার নিজস্ব কায়দা। বাতাসে যেই গায়ের গন্ধ মিশে যায়, সেই গন্ধটা টেনে আরেকবার পরোখের কাজটা সেরে নিলো। রকিং চেয়ারে মাথা ও পিঠ হেলানো অবস্থায় চোখ বন্ধ রেখেই মাহতিম উক্ত ব্যক্তিকে চমকে দিয়ে বললো,

– আমি জেগে আছি মেহনূর। লুকোচুরির প্রয়োজন নেই।

আশ্চর্য হয়ে গলার কন্ঠনালি পযর্ন্ত শুকিয়ে গেলো। যেই মানুষটা চোখ বুজে প্রায় নিদ্রা মৌনে শান্ত হয়ে আছে, সে কি করে ঠিকঠাক অনুমানটা করতে পেলো? মাহতিম কি কানে ব্লুটুথ ডিভাইস লাগিয়েছে, বা এমন কিছু সিস্টেম আছে যেটা দ্বারা সে চোখ বুজেও সঠিক অনুমান করতে পারে? মেহনূর অবাক দৃষ্টিতে পিটপিট করে তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ একজোড়া চোখ চট করে তাক হলো। সঙ্গে সঙ্গে দেরি না করে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে চোখ নামিয়ে ফেললো মেহনূর। আশ্চর্য অবস্থার রেশ এখনো কাটেনি, বারবার চোরা দৃষ্টি দিয়ে মাহতিমকে একটু-একটু করে দেখছে। এমন অদ্ভুত মানুষ দ্বিতীয়টি দেখেনি মেহনূর, অন্ধকারের মধ্যেও মানুষটা যেনো সবই টের পাচ্ছে। আধো-আধো গলায় আবছা সুরে সঙ্কোচের সাথে বললো মেহনূর,

– আ-আ-আপনি কি করে বুঝলেন?

ফিসফিস করে হেসে দিলো মাহতিম। হাসিটা চোখে-মুখে স্থায়ী রেখে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা আবদ্ধ করে হাসি আঁটকালো, হাসির ছলকে তাকিয়ে থাকতেই তর্জনীটা দুবার নাড়িয়ে কাছে আসার ইশারা করলো। তর্জনীর নাড়ানো দেখে ঢোক গিললো মেহনূর। একবার থেমে যাওয়া তর্জনীর দিকে তাকালো সে, আরেকবার হাঁশফাঁশ দৃষ্টিতে মাহতিমের দিকে তাকালো। কালো শার্ট গায়ে হুড়ি পরা লোকটা এখনো নিচের ঠোঁট কামড়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে, মেহনূর মাথাটা নিচে ঝুঁকিয়ে চেয়ারটার দিকে দু’কদম এগিয়ে যেতে লাগলো। রকিং চেয়ারটাও ‘ ঘ্যাড়ঘ্যাড় ‘ জাতীয় শব্দ করে উঠলে আড়চোখে দেখতে পেলো, মানুষটা এখন আর হেলে নেই। সে এখন সোজা হয়ে বসেছে, খুব দক্ষতার সাথে ফ্লোরে পা ঠুকে চেয়ারটা সম্পূর্ণরূপে মেহনূরের মুখোমুখি করে নিলো, মেহনূর এসে পায়ের কাছে দাঁড়ালে নিজের শূন্য হাতদুটো বাড়িয়ে দিলো মাহতিম। দুটো বাড়িয়ে দেওয়া হাতের দিকে একবার-একবার করে দৃষ্টি দিলো মেহনূর, নত চোখজোড়া বেখেয়ালি ভাবে উপরে তুলতে নিলে হঠাৎ সম্মোহন আবেশে থমকে গেলো সে। স্থির দৃষ্টির মাঝে হাসিমাখা চোখদুটো কেমন করে যেনো একীভূত হয়ে গেলো, মেহনূর একবারের জন্যও পলক ফেলার কথা চিন্তা করতে পারলো না। ধীরে-ধীরে বাড়িয়ে দেওয়া হাতদুটোর দিকে আনমনে হাত তুলতে লাগলো, নির্বিঘ্নে শূন্য হাতদুটোর উপর নিজের হাতজোড়া ধীরভাবে ছেড়ে দিতে থাকলো মেহনূর। ধীরগতিটা সহ্য হলো না মাহতিমের, সেই ধীরগতিকে এক লহমায় উপেক্ষা করে পাঁচ আঙ্গুলে মুঠোবন্দি করে সে নিজেই খাবলে ধরলো। শিরশির করে শিউরে উঠার সুযোগও পেলোনা মেহনূর, ক্ষণিকের ভেতর অকুন্ঠ হৃদয়ে হেঁচকা টান মারলো মাহতিম। পায়ের তলা থেকে ফ্লোরের সাদা টাইলস হড়কে যেতেই তৎক্ষণাৎ চোখ খিঁচে ফেললো মেহনূর, ভয়ে হৃৎপিন্ডটা যেনো একলাফ দিয়ে গলায় বসে গেছে। কিছুক্ষণ হা করে আতঙ্কের নিশ্বাসগুলো ছাড়তেই ছোট-ছোট চোখে তাকালো মেহনূর, বুকটা এখনো হুল্লোড় অবস্থায় ঢিপঢিপ করছে। ঠোঁট-গলা শুকিয়ে চৌচির যেনো, পানির জন্য খাঁ খাঁ করে দামাল করছে। কপালের উপর বিন্দু-বিন্দু ঘামও জমে গেছে মেহনূরের, ঘামের আস্তরনের উপর ছোট চুল এসে আষ্টেপৃষ্ঠে লেপ্টে আছে। লেপ্টানো চুলগুলো ডানহাতে সরিয়ে দিলো মাহতিম, সেই হাতটা দিয়েই মেহনূরের গালটা আদর করে ধরলো। মাথার পেছন থেকে খোপা পাঁকানো ব্যান্ডটা খুলে নিতেই বন্দি খাঁচার পাখির মতো কেশরাশি মুক্ত হতে লাগলো, প্রথমে ঘাড় ছুঁয়ে পিঠের উপর পরলো, এরপর অবাধে পিঠ ছাড়িয়ে ঝপ করে ফ্লোরের উপর জমা হলো। গালটা ধরে নিজের কাছে আনলো মাহতিম, সরু-চিকন নাকটার ডগায় আলতো করে নিজের নাক ছুঁইয়ে নিলো। অনুভূতির কাছে নত স্বীকার করে ফের চোখ বন্ধ করলো মেহনূর, মুক্ত হাতদুটো দিয়ে বেখেয়ালেই হোক, বা ইচ্ছাকৃত, সে মাহতিমের কলার দুটো হালকা করে চেপে ধরলো। নাকের উপর ছোট্ট স্পর্শ ছাপিয়ে শীতল কন্ঠে নরম সুরে বললো,

– তোমাকে চেনার জন্য বেশি কিছুর দরকার নেই।

উত্তর শুনে ভ্রু কুঁচকালো মেহনূর। চোখ খুলে চকিত ভঙ্গিতে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললো,
– কেনো?
আবার হাসলো মাহতিম। গাল থেকে হাত সরিয়ে কোমরের ডানপাশটায় রেখে দিলো, মোলায়েম কন্ঠে ধীরভাবে বললো,
– মনে নেই?

ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ কাটা জায়গায় চুমুর ঘটনা মনে পরলো তার। আকস্মিক লজ্জায় চোখ নামিয়ে স্ফুট সুরে বললো মেহনূর,
– জ্বী।

লজ্জায় ছোটোখাটো হওয়া মুখটার দিকে দৃষ্টি রেখে চেয়ারে পিঠ ছেড়ে দিলো মাহতিম। কলার থেকে মেহনূরের হাতদুটো ফসকে যেতেই মেহনূর চোখ খুলে তাকালো। চেয়ারের দুই হ্যান্ডেলে সোজা করে হাত রাখলো মাহতিম, নরম রূপটা সাইডে ফেলে এবার যেনো মূখ্য রূপে ফিরে আসলো। মেহনূর হাসিশূন্য মুখটার কারণ ধরতে পারলো না, অকস্মাৎ লজ্জার বরফটা পানি হয়ে কৌতুহলের সাগরে হারিয়ে গেলো তার। সহজ রূপ পালটে কাঠিন্যের মোড়কে আবদ্ধ হলো মাহতিম, গলায় ঝাঁঝ-তেজ-দাপট মিশিয়ে বললো,

– আমাকে যদি কেউ ঠাস করে চ’ড় মারে, এর পরিবর্তে তুমি তাকে কি করবে? কোনো মিনমিনে জবাব চাই না। স্ট্যাট-কাট কোয়েশ্চ্যান করেছি, স্ট্যাট-কাট আন্সার দিবে। ভেলকিবাজি আমার সামনে করার চিন্তা করবে না মেহনূর। ভালো মানুষের মতো উত্তর দাও।

কথার তেজ দেখেই অবাক হয়ে গেলো মেহনূর। এই মূহুর্তে তাড়াতাড়ি জবাব না দিলে স্থিতি-পরিস্থিতি দুটো বাজে হয়ে যাবে। মেহনূর কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে মাহতিমের দিকে বললো,
– ওটা অবস্থার উপর নির্ভর করছে। যদি মা…

চট করে কথা কাটলো মাহতিম। শক্ত কন্ঠে বললো,
– মা আমার গায়ে কখনো হাত তুলেনা। তাকে স্কিপ করো।

আবারও ভাবনাচিন্তায় পরলো মেহনূর। এ কি জ্বালা? এমন অসময়ে কেমন জেরা চালাচ্ছে? মাহতিমকে যদি কেউ চড় মারে তাহলে মেহনূর তো কিছুই বলতে পারবে না। সে তো কখনো উঁচু গলায় ধমক পযর্ন্ত দেয়নি। নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে রাখতে গিয়ে অন্যায়ের উপর গলা উঁচাতে শিখেনি। উলটো ছোট থেকে ধমক-মার-গালি খেয়ে বড় হয়েছে। কোনো উত্তর না পেয়ে অসহায় চোখে তাকালো মেহনূর, নিজের অযোগ্যতার উপর ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে এখন। প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে, কেনো এসব বাড়ি থেকে শিখলো না? মেহনূরের নির‍ুত্তর-নিরুত্তেজ অবস্থা দেখে রাগে শরীরের চামড়া জ্বলে যাচ্ছে! মানুষ তো নিজের খাতিরেও একটু-আধটু গর্জে, একটা কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামীও নানা মিথ্যে যুক্তি সাজিয়ে বেঁচে যায়, অথচ ওকে একা ফেলে গেলে জীবনেও স্বস্তিতে থাকবেনা মাহতিম। এবার রাগের হুঙ্কারটা রন্ধ্রে-রন্ধ্রে দামামা ফাটাচ্ছিলো, যা করতে চায়নি আজ মেহনূরের সাথে তাই করলো। মেহনূরের দু’বাহু বাঘের থাবার মতো খামচে ধরে কাছে টানলো মাহতিম, রাগান্বিত চাহনি দিয়ে উত্তপ্ত তেজে নিশ্বাসগুলো ফোঁস-ফোঁস শব্দ করে ছাড়ছিলো। মেহনূর দুপাটি দাঁত শক্ত করে ব্যথা চেপে নিলো, ব্যর্থ হয়ে গেলো সে। অন্তরের শিরায়-শিরায় ব্যথার ইন্ধন জেগে উঠতেই মস্তিষ্ক তখন চোখের বহিঃপথে অশ্রু ছেড়ে দিলো, দাঁত আরো শক্ত করলো মেহনূর। চোখ থেকে একটা অশ্রুও নিচে পরতে দিবে না, ব্যথা হোক, আরো হোক, এটাই তার প্রাপ্য! রাগটা কোনো আঙ্গিকেই কমার অবস্থাতে ছিলো না, মাহতিম সেটা চড়াও করে ফলিয়ে দিলো, দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
– তোমাকে কেউ যদি চ’ড় মারতো, আমি ওর নাম-নিশানাই মুছে দিতাম! রজনী মামী তোমাকে আদর করে গিয়েছে, অনা সতেরটা শাড়ি নষ্ট করে দিয়েছে, দুজন মিলে তোমার সাথে মাইন্ড-গেম খেলছে তুমি এসব বুঝতে পারো না? তুমি কি শিশু? তুমি কি এখনো চাও, আমি কাজ ফেলে ছুটি নিয়ে তোমার সেবা করি? তুমি কবে বুঝতে শিখবে তোমার এখন নরম সেজে থাকলে চলবে না! তুমি এখন নিজেতে মত্ত নও মেহনূর! তোমার সাথে আমার অস্তিত্ব গেঁথে আছে। ক’দিন পর তোমার সাথে আমার শারীরিক-মানসিক-পারিবারিক-সামাজিক সবকিছু মিশে যাবে, আমি সর্বক্ষণ তোমার পাশে বসে থাকতে পারবো না বলদ মেয়ে! আমার চাকরী আছে আমার উপর একটা সুস্থ টিম আছে, একটা সুস্থ ডিপার্টমেন্ট নির্ভর করছে। সময়ে-সময়ে তাদের সাথে কাজ করাটা আমার কর্তব্য-ধর্তব্য দুটোই! তোমাকে কি করে বোঝাবো, আমি এখান থেকে এক পা সরিয়ে ফেললে তোমার দিকে মনোযোগ দেওয়ার পযর্ন্ত সময় নেই! তুমি প্রতিবার একেকজনের চ’ড়-থা’প্পর —

নরম হাত দিয়ে মুখে চাপা দিলো মেহনূর। মাথাটা ‘ না ‘ সূচকে নাড়িয়ে ঠোঁট উলটে বলতে লাগলো,
– মা উঠে যাবে, দোহাই চুপ করুন। আমাকে মারলে মারুন, যা খুশী তাই করুন। চিৎকার করলে মা উঠে আসবেন।

হাত সরিয়ে ক্রুদ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে রইলো মাহতিম। রাগের আড়টা তখনো বজায় রেখে চলছে সে। মেহনূরের বাহুটা তাচ্ছিল্যের সাথে ছেড়ে দিতেই চোখ বন্ধ করে রাগ হজমের প্রক্রিয়া চালাতে থাকে। আঁচলে ভেজা চোখ শুষ্ক করতেই আর্দ্র কন্ঠে বললো মেহনূর,
– একটা প্রশ্ন করি?

কিছুক্ষণ নিরব থাকলে হঠাৎ শঠতার সাথে জবাব এলো,
– বলো,

প্রশ্নটা করবে-কি-করবে না এমন দ্বিধায় ফের ফাঁসলো মেহনূর। শেষপর্যন্ত গলা ঝেড়ে আমতা-আমতা সুরে বলে উঠলো,

– আপনি অনামিকার সাথে কি করেছিলেন? ও আপনাকে কেনো ‘ চরি’ত্রহীন ‘ বলে ডাকে? কেনো বলে আপনি আমাকে ভো’গের জন্য তুলে এনেছেন? ওর পিঠের দাগগুলো আপনি করেছেন না? আমি আপনার ভোগবস্তু?

দুই মিনিট যাবৎ কোনো শব্দ হলো না রুমে। একদম শান্ত, সুনশান, নিঃশব্দ হয়ে রইলো অন্দরখানা। উত্তরের অপেক্ষায় মেহনূরের তৃষ্ণার্ত মন উন্মুখ হয়ে ছিলো, এরপরই বিকট শব্দ যেনো পুরো রুমের ভেতরটা ঝালা-পালা করে দিলো! চুরচুর করে মারাত্মক এবং তীব্র শব্দে সবার ঘুম যেনো তখনই লন্ডভন্ড! একলাফে শয্যা ছেড়ে সবাই তখন শব্দ-উৎসের দিকে দ্রুতবেগে দৌঁড় লাগালো, সৌভিক দৌঁড়ের গতিতে সবাইকে পিছু ফেলে দরজার কাছে সবার আগে পৌঁছলো। এক ধাক্কায় দরজা খুলতে যাবে, ভেতর থেকে আরেকদফা শব্দ তেড়ে এলো, শব্দের উত্তেজিত আওয়াজে দুকান বরাবর হাত চেপে খিঁচে উঠলো সৌভিক। তাড়াতাড়ি উত্তেজনা কাটিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো, ওমনেই ভয়ে-আতঙ্কে বিস্ফোরণ চাহনিতে ‘ মাহতিম ‘ বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো!

– চলমান .

#ফাবিয়াহ্_মমো .

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৪১.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

শেষ অংশ সংখ্যা .

সৌভিক গলা ফাটিয়ে চিৎকার দেওয়ার পর তার অবস্থা বিমূঢ়! সে চোখের পলকও ফেলতে পারলো না তখন। কি-থেকে-কি হলো কিছুইতেই আন্দাজ করার অবস্থাতে ছিলো না। শুধু ফ্লোরের উপর তরতর করে ছড়িয়ে পরা রক্তের দিকে তাকিয়ে রইলো, কানের মধ্যে পেছন থেকে সকলের হৈহৈ-রইরই চিৎকারে ‘ কথা বল! ওখানে কি হয়েছে সৌভিক? এই সৌভিক? ‘ শুনতে পাচ্ছিলো, কিন্তু অসাড়ে আঁকড়ে থাকা স্তম্ভিত মন কিছুইতেই জবাব দেওয়ার মতো স্থিতিতে ফিরতে পারলো না। পেছন থেকে সবাই ততক্ষণে হুড়মুড়িয়ে ছুটে আসলো রুমে, এরপর সব যেনো শান্ত-চুপচাপ-নিঃশব্দ। যেই হুল্লোড়টা রাতের তিনটে তেইশের দিকে বাড়ি মাতিয়ে উঠেছিলো, সেটার নূন্যতম শব্দ এখন আর অবশিষ্ট নেই। আবছা অন্ধকারে ডুবো-ডুবো রুমটা এখন সাদা লাইটের আলোয় ফকফকা দেখা যাচ্ছে। স্টাডি টেবিলটার মধ্যখানটা হা করা মুখের মতো ফাঁকা, কাঁচের যেই মোটা আস্তরণটা টেবিলের চার পায়ের উপর দাম্ভিকতার সাথে সেঁটে ছিলো, সেটা এখন বিধ্বস্ত হয়ে ফ্লোরে চূর্ণিত। প্রতিটি কাঁচ-টুকরোর সাথে রক্তের ছিঁটেফোঁটা কামড় দিয়ে লেগে আছে, সাদা টাইলসের উপর ঘণ তরল রক্ত। সৌভিক সবার আগে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে রুমের ডানদিকে নজর ঘুরালো। ফ্লোরে বসে জড়সড় অবস্থায় বিছানায় মুখ গুঁজে ভয়কাতুরে প্রাণীটা রীতিমতো ফোঁপাচ্ছে, অন্যদিকে বিছানায় বসে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে শক্ত-কাঠিন্য মুখটা। থরথর করে সমস্ত শরীর রাগের তপ্ত জোয়ারে কাঁপছে তার। বাদামী শার্টের স্লিভদুটো একটানে কনুইয়ে তোলা হয়েছে, কনুইয়ে আজ স্লিভদুটো ভাঁজ করা নেই। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে হাতের চামড়াটা লম্বাটে হয়ে ফালিফালি হতে গেছে, টলটল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে তখন, অথচ মানুষটা নির্বিকার ভঙ্গিতে এমন ভাবে বসে আছে যেনো হাতে কোনো পীড়া নেই। মারজা চোখে-মুখে যেনো অন্ধকার দেখলেন কিছুক্ষণ, মনে হচ্ছিলো যেনো গভীর রাতে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছেন তিনি। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলে শরীরটা নেতিয়ে পরে উনার, সাথে-সাথে পাশ থেকে ‘ কাকীমা ‘ বলে চিৎকার দিতেই মারজাকে দুহাতে ধরে ফেলে সামিক। মারজার মাথাটা একহাত দিয়ে তার বুকে আগলে ধরে, অন্যহাত দিয়ে মারজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। রজনী যেনো হতবুদ্ধির মতো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, অনামিকার শান্ত-দৃঢ় দৃষ্টি কেবল গম্ভীর রূপধারী আহত মানুষটার উপর স্থির। নীতির মুখে বাক্য ফুরিয়ে হতভম্ব অবস্থা, প্রীতি কোনো চিন্তাশক্তিতে নেই। তৌফ শুধু ভয় পাচ্ছিলো মাহতিমের চেহারা দেখে, সিয়াম কাঠ-কাঠ দৃষ্টিতে যেন কথা বলার অবস্থা গুলিয়ে ফেলছে। সৌভিক পুরো পরিস্থিতিটা ঠান্ডা করার জন্য শীতল মস্তিষ্কের সাথে সামাল দিলো, মাহতিমের দিকে পাঠিয়ে দিলো তৌফ-সিয়াম-সাবিরকে। মেহনূরের দিকে চোখের ইশারায় পাঠিয়ে দিলো নীতি-প্রীতি-ফারিনকে। দু’দলের ছ’জনই সম্মতির সূচকে একবার মাথা নাড়িয়ে ইশারা বুঝিয়ে দিলো, এরপর দু’দলে বিভক্ত হয়ে দু’দিকে এগিয়ে গেলো তারা। সৌভিক ঠান্ডা মাথায় অনামিকা, রজনী ও সামিকসহ মারজাকে রুম থেকে পাঠিয়ে দিলো। এই মূহুর্তে সবকিছু গুছিয়ে আনা প্রয়োজন, কি হয়েছে সেটা সেটা ঠান্ডা ভাবে জিজ্ঞেস করাই উচিত হবে। নীতিরা ফ্লোরে ঝুঁকে মেহনূরকে ঘিরে উঠার জন্য তোষামোদ করতে থাকে, নীতি ফ্লোরের উপর দু’হাঁটু বসিয়ে বিছানা থেকে মেহনূরের মাথাটা তুলে, আঁচড়ানো চুলগুলো তখন এলোমেলো হয়ে মেহনূরের মুখ ঢেকে ছিলো। প্রীতি পেছন থেকে মেহনূরের চুলগুলো আঁটো করে উঁচু একটা খোপা পাকিয়ে দেয়, ফারিন নিজের স্লিপার-ট্রাউজারের পকেট থেকে টিস্যু বের করে মেহনূরের ভেজা মুখটা মুছে দেয়। নীতি ওর গালে-কপালে-মাথায় বারবার নরম করে হাত বুলিয়ে দেয়, একটু কান্না থামিয়ে শান্ত হতে অনুনয় করে। ফারিন ওইসময় মেহনূরের হাত-পা ও শরীরের উপর ক্ষত জায়গার সন্ধান করছিলো, কিন্তু যদ্দূর বুঝলো এই ধ্বংসাত্মক অবস্থায় মেহনূরের শরীরে নখ পরিমাণ আঁচড় লাগেনি। একদিকে মনটা শান্ত হলেও সান্ত্বনার স্বাদটা নিতে পারলো না ফারিন, মাথাটা ঘুরিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালো। মাহতিমের বাদামী শার্টের পিঠটা দেখা যাচ্ছে এখান থেকে, দুটো হাত বিছানার দুপাশে শক্তভাবে রেখে কঠোর ভাবে ফ্লোরের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে রেখেছে। যেই দুটো হাত দিয়ে বিছানায় ভর রেখেছিলো, ওই জায়গায় গলগল করে ফোঁটায়-ফোঁপটায় রক্ত পরে চাদরটা ভিজে যাচ্ছে। মেহনূরের উপর থেকে সহসা মনোযোগ সটকে গেলো ফারিনের, সে চুপচাপ উঠে দাঁড়াতেই ধীর পায়ে মাহতিমের সামনে দাঁড়ালো। মাহতিমের কিন্ঞ্চিৎ নত মাথায় হাত রাখলো, চুলের চামড়ায় আঙ্গুল বসিয়ে বুলিয়ে দিতেই মুখ তুলে তাকালো মাহতিম। দৃষ্টিটা একদম ফারিনের উপর পরলে ভেতরের শক্তভাবটা একটুখানি হ্রাস করলো, নাক দিয়ে সশব্দে জোরে নিশ্বাস ছাড়তেই মাথাটা নামাতে-নামাতে বললো,
– রুমে যা, ঘুমিয়ে পড়্। টেনশন করিস না।

ফারিন কথাটা শুনলো না। উলটো ভাইয়ের মুখটা দুহাতে উপরে তুলে উদাস দৃষ্টিতে করুণ গলায় বললো,
– তুমি এরকম কেনো করলে ভাইয়া?

ফারিনের প্রশ্নে সবাই যেনো মুখ তুলে তার দিকে তাকালো। কয়েক জোড়া বিমর্ষ চাহনি তাদের দিকে নিবদ্ধ হলেও অশ্রুজোড়া চোখদুটো একবারও সেদিকে তাকালো না। ফারিন গালদুটো ছেড়ে দিয়ে সৌভিকের সাথেই ফ্লোরে আসন পেতে বসলো। সৌভিক মাহতিমের পায়ে কাঁটাছেঁড়া জায়গাগুলো ড্রেসিং করাকালীন একপলকের জন্য ওর দিকে তাকালো, তাকিয়ে ফের কাজে মনোযোগ দিলো। ফারিনও যখন মাহতিমের হাত টেনে ড্রেসিং শুধু করলো, তখন বাধা দিতে গিয়ে মাহতিম বিরক্তির সুরে বললো,
– তোরা দুটো শুরুটা করলি কি? কি জন্যে এখানে বসে আছিস? আমার তো এসব কাহিনী সহ্য হচ্ছে না। আমাকে একটু একা থাকতে দে। মাথাটা একটু ঠান্ডা করি। চলে যা রুম থেকে। রুমে এখন কাউকে চাই না।

ফারিন আর সৌভিক দুজনেই মুখ তুলে মাহতিমকে দেখলো, দেখা শেষ করে না-শোনার ভঙ্গিতে একমনে কাজ করতে থাকলো। মাহতিম জানে, এদের হাজার বললেও এখান থেকে ড্রেসিং সম্পন্ন না করে একপাও নড়চড় করবেনা। তার মধ্যে মাথাটা এতো টনটন করছে, সম্ভবত অতিমাত্রায় ফাস্ট্রেশন থেকে আবার নার্ভগুলো উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। মাহতিম যখন মেহনূরের মুখ থেকে ‘ চরিত্রহীন ‘ শব্দটা শুনে তখনও রাগের উত্তপ্ত পিন্ডটা ফুলে-ফেঁপে উঠেনি, কিন্তু যখন ‘ ভোগবস্তু ‘ শব্দটা শুনে তখন রাগেরটা পিন্ডটা ভস্ম হয়ে ভয়াবহ আকারে উদগীরণ হয়ে যায়। দামাল মুঠোর এক আঘাতেই স্টাডিটেবিলের কাঁচটা চুরমার হয়ে শেষ, বাঁহাতের মুঠো জুড়ে তখন অথৈ রক্তের বর্ষা! মেহনূর চিৎকার দিয়ে যে নিজের ভয়গুলো জানান দিবে, তার আগেই পরপর কয়েকটা তাণ্ডব মাহতিম দেখিয়ে ফেলে। তার বাঁহাতটা কাঁচের হিংস্র খোঁচায় বহু জায়গায় ক্ষতবীক্ষত হয়ে তরতাজা রক্ত বেরুতে থাকে, পাষাণের মতোই রুমের ভেতর যাবতীয় জিনিসপত্র ভাঙার মতলবে ছিলো মাহতিম, কিন্তু বিছানার কোণায় গুটিশুটি পাকানো ভয়ার্ত মূর্তির দিকে দৃষ্টি পরতেই তার হাতের ফুলদানীটা শূন্য থেকে নিচে নামিয়ে ফেললো, চুপচাপ বিছানায় এসে ধপ করে বসলো। শেষমেশ মেহনূরকে ছাদের রুমে ফিরিয়ে আনলো নীতি, শব্দহীন অবস্থার মতো শান্ত হয়ে গেছে মেহনূর। চোখ থেকে পানি পরছিলো ঠিকই, কিন্তু ফুঁপিয়ে কান্নাটা থেমে যায় আপনা-আপনি। বালিশে শুইয়ে দিয়ে গলা পযর্ন্ত কম্বল দিয়ে ঢেকে দেয় ওরা। নীতি ডানপাশে বসেছে, প্রীতি অন্যপাশে, ফারিন তখনো ফিরে আসেনি। নীতি কপালে শান্তসূচকে হাত ছুঁইয়ে দিতে থাকলে নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– মনটা হালকা করো ভাবী। কি হয়েছে আমাকে খুলে বলো। না বললে কি করে বুঝবো বলো?

মেহনূর চোখ বন্ধ করা অবস্থায় ঠোঁটদুটো মুখের ভেতরে পুড়ে নিলো, শুষ্ক ঠোঁটে জিভ ছুঁইয়ে ধাতস্থ কন্ঠে বললো,
– অনামিকা কেনো চরিত্রহীন ডাকে এটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। আর কেনো তিনি ওর পিঠে —

ঠোঁট কুঁচকে ডুকরে কেঁদে উঠে মেহনূর। মুখটা দুহাতের তালুতে ঢেকে নিলে একটু আগের চিত্রগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে। নীতি দ্রুত মেহনূরের উপর শান্ত হওয়ার ইঙ্গিত দিলেও প্রীতির সাথে চোখাচোখি দৃষ্টি বিনিময়ে আলাপ হচ্ছে। প্রীতি যেনো ভয়েই তটস্থ, প্রশ্নপর্ব পুরো শেষ না হলেও বাকি ঘটনা কি হতে পারে, সেটা ইতিমধ্যে দুজনের মাথায় ঢুকে গেছে। রাত তখন চারটার ঘরে ছুঁই-ছুঁই, ফ্যান না চলার জন্য ঘড়ির টিক-টিক শব্দটা বিদঘুটে লাগছে। বাইরের সাথে যেনো পাল্লা দিয়ে ভেতরের অবস্থাও থমথমে। নীতি ড্রিম লাইটের আলোয় রেডিয়াম ধাতুর জ্বলজ্বল করা ঘড়িটার দিকে তাকালো, বুকটা কেমন ধড়ফড় করছে ওর। অজানা ভয়, অনিশ্চিত আশঙ্কা, বিপন্ন পরিস্থিতি নিয়ে সত্যিই বুকটার ভেতর তুফান খেলে যাচ্ছে। যেই কঠিন কথাগুলো বলার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলো, সেগুলো একটার-পর-একটা সাজিয়ে হালকা গলায় কেশে নিলো সে। কাশির শব্দে শুনে সচকিত হলো প্রীতি, বড় বোন নীতি নিশ্চয়ই অতীতের বন্ধ দরজা খুলে ফেলেছে, এখন কিছুক্ষণের ভেতর আসল ঘটনা ব্যক্ত করবে। মেহনূর ঘুমায়নি, চোখ এমনে-এমনেই বন্ধ করা ছিলো। নীতি আরেকদফা অক্সিজেন টেনে নিয়ে সাহসের পিত্তিটা শক্ত করলো, মেহনূরের কপাল থেকে হাত সরিয়ে ওর পেটের উপর থেকে ডানহাতটা তুলে নিলো নীতি। মেহনূর চোখ খুলে তাকাতেই নীতি নিজের হাতদুটোর ভেতর মেহনূরের ডানহাতটা আবদ্ধ করলো, হালকা গলায় বলতে শুরু করলো,

– আমি তোমায় সব বলবো ভাবী। সব গোড়া থেকে বুঝিয়ে বলবো। তুমি একটু শান্ত হও। অযথা চিন্তা করে ভাইয়াকে কষ্ট দিও না। ও মানুষটা তোমায় খুব ভালোবাসে। তুমি তাকে নিয়ে ভুল সময়ে ভুল প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে ফেলেছো। এটার জন্য তোমাকেও দোষ দিতে পারিনা, আবার ভাইয়াও অসময়ে এসব কথা শুনে স্বাভাবিক থাকতে পারেনি। ওগুলো একদম অযৌক্তিক, মিথ্যা, ভিত্তিহীন। ভাইয়া মোটেই আজকের মতো রাগী ছিলো না, কোনোদিন আমরা মনে করতে পারি না ভাইয়া কখনো আমাদের সাথে জঘন্য রাগ দেখিয়েছিলো কিনা। খুব ছোট থেকেই অনামিকা এ বাড়িতে যাতায়াত করতো। রজনী মামী, অনামিকা উনারা এ পরিবারের সদস্যের মতোই থাকতো। পড়াশোনার জন্য ঢাকার পিলখানার এরিয়ায় থাকতো ভাইয়া, যখন ফুপা ছুটিতে বাসায় আসতেন তখন ভাইয়াকে কোনোভাবেই সেখানে আঁটকে রাখা যেতো না। ভাইয়া ছুটে বাসায় আসতো, আর হয়তো তখন থেকেই অনামিকার মন নরম হতে থাকে। আমরা কেউ বিষয়টাকে তেমন পাত্তা দেইনি, কারণ, মনেহতো ওটা বয়সের ঝোঁক। ধীরে-ধীরে বুঝতে শিখলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ভাইয়ার ইচ্ছা ছিলো, ফুপা যেই মেয়েকে চুজ করবে তাকেই বিয়ে করবে, সে কোনো প্রেমঘটিত ব্যাপারে জড়াবে না। এই একটা কথার উপর ভাইয়া যেনো বাঘের মতো অটল ছিলো, কোনো মেয়েই তাকে এই কথা থেকে একচুল নড়াতে পারেনি। অনামিকা যে অসুন্দর তা কোনোদিন বলবো না, কিন্তু অশালীন পোশাক আর উগ্র চিন্তাভাবনার জন্য আমরা কেউই ওকে পছন্দ করতাম না। আমরা দশটা মানুষ আপনের চেয়েও আপনের মতো থেকেছি, কেউ আমাদের দেখলে বলতে পারতো না, কে কাজিন বা কে বন্ধু। সৌভিক, তৌফ, সিয়াম ভাই তারা তো আমাদের সাথেই শৈশব কাটিয়েছে, যদিও তারা ভাইয়ার ছোটবেলার বন্ধু। অনামিকা তখন প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ে, ওই সময় নেভি থেকে ভাইয়ার জয়েন এপ্রুভাল এসে যায়, কিছুদিনের মধ্যেই সব রেডি করে ট্রেনিংয়ের জন্য বিদায় নেয় ভাইয়া। প্রায় ছয়মাসের বেশি সময় সে চট্টগ্রামের ট্রেনিং সেন্টারে ছিলো। একদিন মারজা মামীর অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায়, উনিতো আগে থেকেই অসুস্থ ছিলো, তার উপর একদিন বুকে শ্বাস টান উঠে। সবাই পাগলের মতো একগাদা টেনশন নিয়ে হাসপাতালে দৌড় দিলাম, কিন্তু এই টেনশনের ভেতর মস্ত বড় ভুল করি আমরা। আমরা কেউই জানতাম না সারপ্রাইজ হিসেবে ভাইয়া সেদিন সন্ধ্যায় ঢাকায় ফিরবে, এটাই আমাদের দূর্দশা হয়ে দাঁড়ালো। ভাইয়া কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে জার্নির ক্লান্ত শরীর নিয়ে যখন বাড়িতে ফিরলো, কিন্তু তখন বাড়ির অবস্থা সুনশান। ওইদিন শুধু সিরাজ কাকা সাবু খালা বাড়ির অন্যান্য কাজের জন্য ছিলো, তারা ভাইয়ার আগমন দেখে মামীর সিচুয়েশন নিয়ে ফট করে জানায়নি। এদিকে ভাইয়া নিজের রুমে যায়, গোসল নিয়ে পোশাক পালটে হালকা মতোন খেয়েও নেয়, তখনও সিরাজ কাকা মামীর ব্যাপারটা মিথ্যা কথা দ্বারা ঢেকে দিয়েছে। ভাইয়ার যে লম্বাদিনের ধকল শেষে বিশ্রামের প্রয়োজন সেটা সিরাজ কাকা বুঝতো। ভেবেছিলো রাতে চুপ করে অনামিকার কথাটাও এই ফাঁকে বলে দিবে। এরই মধ্যে অনামিকা তখন —

একটানা কথা বলতে গিয়ে কিছুটা হাঁপিয়ে উঠে নীতি। নির্ঘুম রাতের সাথে ফ্লাইটের ক্লান্তিটা এখনো যেনো ঘুচেনি। মেহনূর উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, এরপর কি হয়েছে সেটা জন্য বুকের ভেতর ধ্বক-ধ্বক হচ্ছে। নীতি ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে আবারও মেহনূরের দিকে তাকালো, প্রচণ্ড ভয় হচ্ছে, প্রচণ্ড! যদি মেহনূর উনিশ-টু-বিশ বুঝে তখন? নীতিকে হঠাৎ থামতে দেখে মেহনূর নিজেই উৎকন্ঠার সুরে বলে উঠলো,
– বলুন না নীতি আপু, আমি শুনতে চাই এরপর কি হয়েছে। ওই খালি বাড়িতে তিনটা মানুষ তো ছিলো, উনি তো একা ওখানে ছিলেন না। বলুন না, এরপর কি ঘটনাটা ঘটেছিলো?

নীতি নড়েচড়ে দৃষ্টি নত করলো, শান্ত গলায় বলতে-বলতে ক্রমশ উত্তেজিত হতে লাগলো তার কন্ঠ, যেনো পুরোনো রাগের ভয়ানক জেদটা শরীরের উপর আবারও জেঁকে ধরেছে।

– ওই ন’ষ্টা কোথাকার ভাইয়ার রুমে ঢুকে দরজা আঁটকে দেয়। ভাইয়ার সাথে কেমন বেহায়াপনা করতে চেয়েছে মুখে বলতেও থু আসে। কিছু জিনিস নিজের করে না পেলে, তার প্রতি অদম্য আকর্ষণ জাগে। মূলত অনামিকার এটাই হয়েছিলো। বারবার রিজেকশন খাওয়ার পর নে’শাও করতো এই ন’ষ্টা! এ’লএসডি ড্রা’গে এডি’ক্টেড ছিলো। যেই প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়তো ওখানকারই একদল ওর খাশ বন্ধু ছিলো, সবগুলো শয়তান ছিলো, জাস্ট শয়তান! অনামিকা আর ভাইয়ার মধ্যে কেমন ধস্তাধস্তি হয় কেউ জানে না। কিন্তু ওর অবস্থা আর ভাইয়ার হাল দেখে সিরাজ কাকা বলেছিলো, মাহতিম ভাইয়া ওকে আচ্ছা মতো মে’রেছে। এদিকে সাবু খালা অনামিকার অবস্থা দেখে বলেছিলো ভাইয়া নাকি লালসা মেটাতে গিয়ে রেপ করেছে। তুমিই বলো, আমার ভাইকে দেখার পর কোনো মেয়ে কি তাকে ফিরিয়ে দিতে পারে? আমার কথাগুলো অহংকার ভেবো না ভাবী। আমার ক্লাসমেটরা পযর্ন্ত আমাদের জয়েন ফটো দেখলে মাহতিম ভাইয়াকে ক্রাশ কনফেশনে লেটার দিতো। যেখানে ভাইয়া তুড়ি বাজালেই সুন্দর মেয়ের আনাগোনা চলে আসতো নিশ্চিত, সেখানে ওর মতো ন’ষ্টার দিকে কোন্ দুঃখে তাকাতে যাবে? এরপর যখন —

– থেমে যা নীতি। ভাবীকে ঘুমাতে দে। কাল আমাদের লম্বা জার্নি মনে আছে তো? রেস্ট করতে দে।

দরজার দিকে একসঙ্গে তিনজনের দৃষ্টি চলে গেলো। সৌভিকের চিন্তিত মুখটা এখন পরিশ্রান্ত হয়ে মলিন আকার ধারণ করেছে। হয়তো মাহতিমের মুখ থেকে সেও আসল ঘটনা শুনে ফেলেছে। নীতি আশ্চর্য হয়ে কপাল কুঁচকে বিছানা থেকে নামতেই বললো,

– কাল যাবো মানে? ভাইয়ার অবস্থা কি খুবই ভালো? সে তো ভুলেও ড্রাইভার নিবে না, কাউকে সে জিপও চালাতে দিবে না, তাহলে চালাবেটা কে? কিছুতেই যাবো না আমি। ট্যূরে যাওয়া বাতিল। ওই সা’পের সাথে কোনোমতেই ট্যূরেই যাবো না।

সৌভিক খানিকটা বিরক্ত হয়ে বুকের কাছে দুহাত ভাঁজ করলো। মলিন দৃষ্টি পালটে আক্রোশের ভঙ্গিতে সরল কন্ঠে বললো,
– এসব কথার ভেলকি ওর কানে গেলে এখুনি উঠে এসে চড় লাগাবে।

দৃষ্টিটা তখন নীতির উপর থেকে সরিয়ে এবার নীতির পেছনে ছুঁড়লো সৌভিক। যোগ্যমতো জায়গায় দৃষ্টি স্থির রেখে গমগম সুরে বললো,
– ওর রাগ এখনো কমেনি। কমার মতো ঘটনাও ঘটেনি। হয়তো এখনো সবকিছু ঠিক করার চিন্তায় আছে, নাহলে এইসব ট্যূর-ফ্যূর ফেলে কখন লাগেজ উঠিয়ে বিদায় হতো।

নীতি প্রসঙ্গটা না বুঝে সৌভিকের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো। সৌভিকের স্থির দৃষ্টিটা লক্ষ করে সে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলো, মেহনূরের অবসন্ন দৃষ্টি এখন সৌভিকের দিকে। নীতি মাথাটা দ্রুত ঘুরিয়ে সৌভিকের দিকে অপ্রসন্ন কন্ঠে বললো,
– মানে?

সৌভিক একই তেজে মেহনূরের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নীতির পানে তাকালো। হাতদুটো স্বাভাবিক করে বলে বললো,
– রেস্ট করতে দে এখন, কথা বলিস না। একটু পরই বের হতে হবে। পারলে ভাবীর ব্যাগটা রেডি করে দিস। আর এটা —

অর্ধপূর্ণ কথাটুকু ওখানেই আঁটকে রেখে রুমের বাইরে গেলো সৌভিক। নীতি কিছু বুঝতে না পেরে পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলো ‘ সৌভিক ভাই কোথায় যাচ্ছো? ‘। সৌভিক হনহন করে যেমন বেরুলো, তার বদৌলতে ‘ ঘ্যাচঘ্যাচ ‘ শব্দ করে রুমের ভেতরে ঢুকলো। তার ডান পা বরাবর পিছু-পিছু বেশ বড় একটা কালো লাগেজও এসে উপস্থিত, সৌভিক হ্যান্ডেলটা ধরে আধহেলানো লাগেজটা সোজা করে রাখলো। হ্যান্ডেলটা ছেড়ে দিতেই তটস্থ সুরে বললো,

– এয়ারপোর্টের গোলমালের জন্য এটা অন্য ফ্লাইটে আঁটকে গিয়েছিলো। এটা আমাকে দিতে বললো, এজন্য দিয়ে গেলাম। নীতি, প্রীতি চলে যা তোরা। ভাবীকে ঘুমাতে দে।

সৌভিকের কথায় দুবোনই সেখান থেকে চলে আসলো। আসার আগে মেহনূরকে ভালো করে বুঝিয়ে দিলো, কিছু দরকার হলে সাথে-সাথে তাদের ডাকতে, ডাকতে যেন দেরি না করে। মেহনূর কম্বল সরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো। মাথাটা দুহাতে চেপে কিছুক্ষণ গভীরভাবে নিঃশ্বাসপ্রশ্বাস নিলো, শরীরটা খুবই শক্তিহীন লাগছে, মাথাটাও ভনভন করছে। শেষ রাতের সময় চলছে এখন, এই উছিলায় রুমে ঢুকছে হিম জাগানো বাতাস। ঠান্ডা বাতাসটা সূঁইয়ের মতো খোঁচাচ্ছে, ভালোই শীত লাগিয়ে দিচ্ছে। মেহনূর খোলা দরজাটা বন্ধ করার জন্য ফ্লোরের উপর দু’পা ফেললো, হাতে ভর দিয়ে বিছানা থেক্র উঠে দাঁড়ালো। দরজার স্লাইডিং ডোরটা টেনে দিয়ে টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলো। অনেক চিন্তাভাবনার পর, অনেক যুক্তি মেলানোর পর সিদ্ধান্ত নিলো, লাগেজটা খুলে দেখা উচিত। লাগেজের দিকে তাকিয়ে বুক ফুলিয়ে নিশ্বাস নিলো মেহনূর, সেটা নম্রভাবে ছেড়ে দিয়ে হাতদুটো এগিয়ে লাগেজটার হ্যান্ডেল আঁকড়ে বিছানার কাছে টেনে আনলো, বিছানায় তুলতে গিয়ে রীতিমতো হাঁপিয়ে গেলো। লাগেজটা প্রচুর ভারী। আচ্ছা, এটার মধ্যে কি রাগ ভরে-ভরে পাঠিয়ে দিয়েছে? নাকি রাগের সাথে ওই কাঁচের গুঁড়াগুলো ভর্তি করে পাঠিয়েছে? মেহনূর সরু আঙ্গুলগুলো লাগেজের চকচকে দেহের উপর রাখলো, ঠান্ডা-শক্ত লাগেজটা ছুঁতেই কেমন এক ঘোর আবেশে প্রসন্ন হয়ে বন্ধ হয়ে গেলো ব্যথাক্লিষ্ট চোখদুটো। চোখের সামনে অন্ধকার, একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার ছেয়ে গেলো, সেখানে কোনো আলো দেখতে পেলো না মেহনূর। হঠাৎ অন্ধকারের মাঝখানটা যেনো চিঁড়ে যেতে লাগলো, চিঁড়টা বড় ফাঁক গলে ভোরের আলোর মতো উজ্জ্বলটা ভেদ করে এলো। হঠাৎ, এক লহমায় সকল অন্ধকার ধূলিসাৎ করে ভোরের আলোয় ফুটে উঠলো সবকিছু, সেই পুরোনো কথা, সেই পুরোনো দিনগুলো মনে পরলো তখন। হাসি-হাসি চোখে বাঁকা হাসিতে তাকিয়ে আছে মাহতিম। চোখের মনি জুড়ে তার হাসি-হাসি চোখদুটোর চাহনিটা মিলে আছে, হঠাৎ মুখটা ধীরভাবে এগিয়ে এনে ফিসফিস আওয়াজে বললো,

অজ্ঞাত পরিচয় আমার, অচেনা ছিলাম একদিন।
দ্বিগ্বিদিক জানতো মানুষ, তুমি-আমি কেউ নই।
সময় যেনো ছল খাটালো, ধরিয়ে দিলো সবই।
তোমায় মন বাড়িয়ে ছুঁই মেহনূর, মন বাড়িয়ে ছুঁই।

চোখ খুললো মেহনূর, সিলভার চেইনটা ধরে একটানে বাম থেকে ডানে ঘুরিয়ে আনলো। লাগেজের উপর পার্টের অংশটা দুহাতে ধরে আস্তে করে উপরে উঠাতে লাগলো মেহনূর, লাগেজ ধীরে-ধীরে খুলে যেতেই নির্লিপ্ত চাহনিতে থমকে গেলো। চিরকুটের মতো চারকোণা হলুদ কাগজটা সবার আগেই দৃষ্টি কেড়ে নিলো ওর, সেখানে সুবিন্যস্ত শব্দে নীল কালিতে লেখা ছিলো,

– আমার ভাগ্যবতী বউ, আমার চিরসঙ্গিনী, আমার মেহনূর আফরিনকে আঠারো শাড়ির ভালোবাসা।

চলমান .

#ফাবিয়াহ্_মমো .