মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব-৪২+৪৩

0
968

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৪২.
#ফারিয়াহ্_মমো .

শোকাহত বাড়ির মতো নিস্তব্ধ ছিলো দশটা নাগাদ। মাঝরাতের সেই ভয়াবহ ঘটনার পর ভোররাতে ঘুমাতে পারেনি কেউ। সকালের আলোটা গগনপটে ছড়িয়ে পরলে তখন যেনো ঘুম-ঘুম ভাব হলো, কিন্তু ঘুমকে তখন পাত্তা দেওয়ার মতো অবস্থা ছিলো না কারোর। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতেই ফোনের বিপ্ আওয়াজে চমকে উঠলো আট মাথা, ফোনের উপর চোখ বুলাতেই সব ফেলে হুড়মুড়িয়ে উঠলো, একসঙ্গে নিজ-নিজ রুমের ওয়াশরুমে ছুটলো তারা। দ্রুত নিজেদের ফ্রেশ করে বাড়ির ঠিক বাগান সাইডটায় জড়ো হলো। সূর্যহীন আকাশটা শীতের আবরণে গুমিয়ে আছে, কুয়াশাচ্ছন্নে আবৃত হয়ে আছে চারপাশ। বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে সিড়ি দিয়ে নেমে ডানে বাঁক নিলো সবাই, যার-যার হুডির পকেটে সবারই হাত গোঁজা, মাথায় কেউ হুডি টেনেছে, কেউ পেচিয়েছে মাফলার। শিশির জমা ঘামের উপর পা ফেলে নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে এক-এক করে জড়ো হলো তারা, মুখে কারোর রা নেই, নিশ্বাসের সাথে-সাথে নাক দিয়ে ধোয়ার মতো বেরুচ্ছে, দূর থেকে দেখলে মনেহয় নাক দিয়ে আগুনের রেশ ফুটছে। কনকনে শীতের সকালে দেয়ালহীন পাকাপোক্ত কটেজটার সামনে এলো সবাই, এটা মাহতিম নিজের জন্য বানিয়েছে। গোলকার কটেজটা সুউচ্চ হলেও চর্তুদিকে দেয়াল দেওয়া নেই, কটেজে ঢুকার জন্য একপাশে তিনটে সিড়ি দেওয়া আছে, কেউ সিড়ি দিয়ে শালীনভাবে উঠতে পারে, আবার কেউ ঘাস থেকে পা বাড়িয়ে এমনেতেও কটেজে ঢুকতে পারবে। মেয়েদল যেহেতু কমফোর্ট জোনে থাকতে ভালোবাসে, তাই নীতি-প্রীতি-ফারিন সিড়ি দিয়ে উঠলো, বাকিরা নিজেদের মতো পা উঁচিয়ে কটেজে ঢুকে পরলো। গোলাকার একটা মস্ত টেবিল বিছানো সেখানে, টেবিলের চারদিক জুড়ে বারোটার মতো চেয়ার সাজানো হয়েছে। ফাঁকা চেয়ারগুলোতে নিজেদের আসন অধিকার করে আসল জায়গায় দৃষ্টি দিলো সবাই। সেখানে তাকিয়ে প্রথম প্রশ্নটা শান্ত গলায় বললো তৌফ,

– মামু, এই সকাল-সকাল এই তলবে ডাকলা ক্যান? এক্সক্লুসিভ কিছু হইছে?

কথা বলার জন্য গলাটা একটু কেশে শীতের রুক্ষতা কাটালো সৌভিক। হাতদুটো টেবিলের উপর মুঠোবন্দি করে রাখতেই গম্ভীর সূচকে বললো,

– মাহতিম এবার গোপন কিছু করছে গাইজ। আমি ধরতে পারছিনা। কালরাতে যে রাগটা দেখালো, সেটা স্রেফ একপাক্ষিক জেদ ছিলো না। ওর আচরণগুলো আমার সেন্স অন্যদিকে ডিটেক্ট করছে। প্রথমত, ও কখনো চার মাসের ছুটিতে ঢাকা ফিরে না। দ্বিতীয়ত, অনামিকার ব্যাপারটায় ওভাবে রিয়েক্ট করে হুল্লোড় দেখাবে এটা আদতেও সম্ভব না। মেহনূরকে ক্ষতি করেনি জানি, এটা যে করবে না শিওর ছিলাম। তৃতীয়ত যেটা খটকা লেগেছে সেটা হলো ‘ তাড়াহুড়ো ‘। এই তাড়াহুড়োটা আগে কখনো ওর ভেতর দেখিনি, ও নেভির কোন্ পদের কর্মকর্তা এটা নতুন করে আর বললাম না। ওর মাইন্ড-ফিটনেস সবগুলোই এক্সিট্রিম লেভেলের ডিটারমাইন্ড, তার উপর ও যেই ফিল্ড থেকে বিলং করে সেখানে তিল পরিমাণ দয়া দেখানোর দীক্ষা শিখেনি। ও কেনো তাড়াহুড়োটা করছে বুঝতে পারছিস কেউ?

পালাক্রমে নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করলো ওরা। সৌভিকের দৃষ্টি এখনো পূর্বের মতোই কঠোর। সিয়াম কথাটা আমলে নিয়ে এমনভাবে বললো যেনো কাকপক্ষি পযর্ন্ত কথাটা ওর শুনতে না পায়,
– ও কি কিছু নিয়ে ভয়ে আছে?

তৎক্ষণাৎ চকিত ভঙ্গিতে সিয়ামের দিকে তাকালো সবাই, এমন অবস্থা দেখে সিয়াম যেনো বিষম খেয়ে খুকখুক করে কেশে উঠলো। সৌভিকের দৃষ্টি শুধু কঠিনের মতো শক্ত হয়ে রইলো, গলার স্বর আগের চেয়েও গম্ভীর করে বললো,

– আমার মন বলছে, ও গোপন মিশনে জড়িয়ে আছে। ও চাচ্ছে আমরা যেনো আউট অফ ঢাকা হই। চট্টগ্রামে চলে গেলে ওর কোনো টেনশনই থাকবেনা। সেখানে কোনো প্রবলেম হলে যেকোনো সময় স্পেশাল ফোর্স এসে আমাদের উদ্ধার করতে পারবে, কিন্তু ঢাকায় থাকলে সেই টিম আসতে-আসতে যা ঘটার সব ঘটে যাবে। ও যে কি নিয়ে টেনশন করছে সেটাই আমি রাত থেকে চিন্তা করছি। ধরতে পারিনি।

সৌভিকের কথায় নিজের বাক্য ঠেকিয়ে তেজী সুরে বললো প্রীতি,
– ভাইয়া যেটাই করুক তাই বলে কি ভাবীর সাথে ওরকম বিহেভ করবে? মেহনূর ভাবী যেমনই হোক, এখানে প্রত্যেকটা মেয়ের নিজস্ব গন্ডি আছে। কেউ খুব তাড়াতাড়ি অন্যের ইজি হয়ে যায়, কেউ বেশি টাইম লাগায়। কিন্তু ভাইয়ার আচরণটা আমার —

সৌভিক এমন কথায় দারুণ চটে গিয়ে বাঁজখাই গলায় বললো,
– আরে রাখ তোর আচরণ! একটা মানুষ যদি তোর সাথে ফ্রি হওয়ার চেষ্টা করে, সেক্ষেত্রে তুই কি নখ কামড়ে বসে থাকবি? ভাবী কি বুঝেনা মাহতিমের ভেতরে কি চলে? ওর মুখের দিকে ঠিকমতো তাকালেও তো বুঝার কথা ও এখানে বিশ্রাম নিতে আসেনি। একটা মানুষের মধ্যে নূন্যতম সহ্য থাকে রে, আমি তো নিজেই ভাবীর ন্যাকামো দেখে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি, মাহতিমের মধ্যে কি হয় সেটা নাইবা বললাম।

সৌভিকের গরম মেজাজ দেখে আজ কেউই আগ বাড়িয়ে কথা বললো না। প্রীতিও নিজের কথায় বাধা পেয়ে বাকি কথাটুকু গিলে ফেললো। তৌফ এতে ক্ষান্ত রইলো না, তেড়ে এসে যুক্তি ছেড়ে গজগজ সুরে বললো,

– শা’লার মাথাই কাজ করতাছে না। এইসব প্যাঁচ যে ক্যামনে সামলামু, ক্যামনে যে ঠিক করমু, রাস্তাই তো চোখে দেখিনা। তোরা কিছু ভাবছোস কেউ?

তৌফকে শান্ত করে পাশ থেকে বললো সামিক,
– আমার মাথায় একটা বুদ্ধি আছে। এক্জিকিউট করতে হেল্প লাগবে। আমার এখন মাহদিকে প্রয়োজন, আমি যেই টোপ ফেলতে যাচ্ছি, সেটা জায়গামতো নিশানা পেলেই সবকিছু ঠান্ডা হয়ে আসবে।

সামিকের চোখের ভাষাই যেনো দক্ষবুদ্ধির পরিকল্পনা বোঝাচ্ছে। সবাই কিছুক্ষণ মৌনতার সাথে নিরব থাকলো ঠিকই, পরক্ষণে সবার ঠোঁটে ফুটে উঠলো আত্মবিশ্বাসের চিন্তামুক্ত হাসি। নয়জন মাথা যখন দিনশেষে একত্র হয়, তখন হাজার বিপদের ভেতরেও সুরাহা যেনো অন্ধকার চিঁড়ে বেরিয়ে আসে। মনের সকল ভয়-ডর-শঙ্কা এমনভাবেই নিঃশেষ করে দেয় যেনো আশার আলোতে বলিয়ান হয়ে উঠে তাদের স্বতন্ত্র প্রাণ।
.

শাওয়ারের সিলভার নবটা বাঁদিকে ঘুরাতেই ফোঁটায়-ফোঁটায় বর্ষণ শুরু হলো। নবটা মোচড়ে স্পিড খানিকটা বাড়িয়ে দিতেই এবার তুমুল আকারে বর্ষণ শুরু হলো। কৃত্রিম বৃষ্টির ফোঁটাগুলো তুষারকণার মতো ঠান্ডা, ভোর-সকালে বরফের মতো কনকনে ঠান্ডা পানিতে গা ভেজাচ্ছে মাহতিম আনসারী। শীত-গ্রীষ্ম কোনোটাই তার নিয়মমাফিক রুটিনকে ছেদ করতে পারেনা, টানা চারটা বছর যাবৎ নিজেকে কঠিন নিয়মে আবদ্ধ করার ফল এটা। শার্টের বোতামগুলো ডানহাতে খুলতে লাগলো মাহতিম, মুখটা শাওয়ার দিকে উঁচু করে রাখা। প্রতিটি ঠান্ডাতুল্য বিন্দু তার দেহের ভাঁজে-ভাঁজে মিশে গিয়ে সিক্ত করতে মত্ত। ঠান্ডা পানি যেনো তার চোখদুটোর দেখা পেয়ে আনন্দে উল্লাসিত, ঠোঁটদুটো যেনো ঠান্ডার সংস্পর্শ পেলে সাথে-সাথে রক্তিম হয়ে উঠে। বাঁহাতে মোটা ব্যান্ডেজ থাকা সত্ত্বেও তোয়াক্কা করেনা মাহতিম, একটানে সেখান দিয়ে শার্ট খুলে আনে সে। কাটা জায়গাটা আবার যেনো চনমনিয়ে বিষিয়ে উঠলো, ব্যথায় শুধু বন্ধ চোখদুটো যেনো খিঁচুনি দিয়ে ফের স্বাভাবিক হয়ে গেলো। চোখ বন্ধ থাকার পরও মনের আন্দাজ মোতাবেক শার্টটাকে ছুঁড়ে মারলো, ওমনেই জবজবা ভেজা শার্টটা ‘ ছলাৎ ‘ শব্দ করে ভরা বালতিতে গিয়ে পরলো। দেয়ালে ডানহাতে ফেলে মাথাটা নিচু করলো মাহতিম, হাতসহ সমস্ত দেহ যেনো চিনচিন করে ব্যথা করছে, মাথাটাও ভীষণ টনটন করছে, চোখ খুলে তাকাতে গেলে ভারী ব্যথা এখন। এটা নির্ঘাত গতরাতের ফলাফল, যার দরুন এখন বেখাপ্পা কায়দায় ফাঁসতে হলো। আজকের মধ্যেই সবাইকে কক্সবাজার পাঠাতে হবে, সবাইকে এখান থেকে নিরবে সরিয়ে ফেললে তবেই চিন্তামুক্ত হওয়া সম্ভব। ছুটি নেয়নি, চায়নি, কোনোটাই করেনি মাহতিম। এখানে আসার পেছনে পূর্বঘটনার অপারেশনটা কঠিনভাবে জড়িত। নেভির স্পেশাল ফোর্সের তত্ত্বাবধানে প্রায় দুই বছর আগে যেই ‘ অপারেশন ঝিলতলা ‘ নামের অভিযান হয়েছিলো, সেই ঘটনার চূড়ান্ত পর্ব এবার নিজ হাতে সাজাবে মাহতিম।

রাজধানীর মতো জনবহুল শহরে লুকিয়ে-লুকিয়ে অ’স্ত্র আনাগোনার ব্যবসা করছিলো একদল গোপন সংগঠন। ভ’য়াবহ, বিধ্বং’সী, আক্রম’ণাত্মক অ’স্ত্রগুলো তারা বিপুল টাকার বিনিময়ে দেশের যেকোনো প্রান্তে কিছু অযোগ্য ব্যক্তিদের হাতে তুলে দিচ্ছিলো, সরকার ও জনগণের অগোচরে চলছিলো বিশাল বড় কারসাজি। কিছু অ’স্ত্র বিশেষ সুপারিশের ভিত্তিতে সামরিক বাহিনীর জন্য আনা হতো, কিছু অ’স্ত্র এমনও ছিলো যা দেশে ব্যবহার করা সম্পূর্ণ নি’ষিদ্ধ, সেসব ভয়াবহ নিষিদ্ধ অ’স্ত্রগুলো নির্দ্বিধায় সকলের চোখে ধূলো দিয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছিলো। ওসব বিপদজ্জনক অ’স্ত্রের ব্যাপারে যদি একটা মানুষ তিল পরিমাণ ধারণা পেতো, তাহলে তার পায়ের তলায় মাটি খসে যেতে সময় নিতো না। এমনই একটা সংঘবদ্ধ দলকে ধরার পেছনে সামরিক বাহিনীর বিশেষ দল লেগেছিলো। প্রত্যেকটা দেশেই মূলত ‘ নেভাল ফোর্স ‘ নামে স্পেশাল ফোর্স রেডি তৈরি করা আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভারতের ‘ মারকোস ‘, আমেরিকার ‘ সিল টিম ৬ ‘, পাকিস্তানের ‘ এসএসজিএন ( SSGN ) টিম ইত্যাদি। যারা মূলত নেভাল ফোর্স বেস্ড স্পেশাল ফোর্স। তেমনি বাংলাদেশের জন্য আমাদেরও সফল ফোর্স রয়েছে, নাম ‘ সোয়াডস ‘ (SWADS)। যারা আমেরিকার ঘাঁটি থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসছে সেই বহু শতক আগে থেকে। তবে এর শুরুটা ২০০৮ সালের দিকে চট্টগ্রামে হলেও আনুষ্ঠানিক জন্ম ২০০৯ সালের দিকে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে যুক্ত হওয়া সোয়াডস সদস্যদের প্রশিক্ষনটা কোনো সাধারণ ধাঁচের প্রশিক্ষণ নয়। উক্ত প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষ ইন্সট্রাক্টদের আগমন ঘটে, যারা মূলত আমেরিকা-কোরিয়া-তুরস্ক থেকে এসে থাকে। তাদের চরম কঠোর-কাঠিন্য-শক্ত স্বভাবের জন্য তারা ‘ দ্যা ব্রুট ‘ বলেও পরিচিত, একজন সোয়াডস ক্যান্ডিডেটকে সফল সোল্ডার ( Soldier ) হিসেবে রূপান্তর করার জন্য এই ব্রুট ব্যক্তিদের বিশেষ অবদান উল্লেখ্যযোগ্য। বলে রাখা প্রয়োজন, প্রশিক্ষকরা কোনোপ্রকার নমনীয়তা, কোমলতা, দয়া দেখান না। তারা নির্মমতা এবং ত্রুটির ব্যাপারে অতি মাত্রায় হিংস্র। মূলত সকলেই সোয়াডস হবার সুযোগ পায় না, ঝরে পরার সম্ভবনা প্রায় ৯৮%। ‘ সোয়াডস ‘ এর অন্যান্য স্বতন্ত্র ইউনিট সম্পর্কিত তথ্যসমূহ ‘ হাইলি ক্লাসিফাইড ‘ বিধায় তাদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ জানা অসম্ভব। তবে এটুকু নিশ্চিত এই দল জল-স্থল-আকাশ পথে চলার জন্য সদা প্রস্তুত, সদা তৈরি। এবার ভেলকি দেখানোর আখেরী পর্ব চলে এসেছে।

স্বচ্ছ আয়নার সামনে দাঁড়ালো মাহতিম। চুল থেকে টুপ-টুপ করে পানি পরছে, ডানহাতটা দিয়ে ব্যাকব্রাশ করে চুলগুলো পেছনে ঠেলে নিলো। শেভটা ঠিকঠাক মতো হয়েছে কিনা সেটাও গাল ঘুরিয়ে দেখে ফেললো। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ফাস্ট-এইডের খোলা বাক্স থেকে একটানে গজ কাপড়টা বের করলো, ক্ষতের মুখে তুলা চেপে সাদা ব্যান্ডেজের কাপড় দিয়ে বাঁহাতটা পেঁচাতে লাগলো। হঠাৎ ড্রেসিং টেবিলের উপর ফোন বেজে উঠলে স্ক্রিনে দৃষ্টি দিলো সে, ‘ HANNAN SHEKH ‘ ! ওমনেই মুখের স্বাভাবিক আঁচটা বদলে গিয়ে চিন্তার আদলে ছেয়ে গেল তার, মাহতিম ফোনটা বন্ধ ধরলো না। ফোনটা বেহালভাবে বাজতে-বাজতে একইভাবে আপনা-আপনি কেটে গেলো। টানা তিনবার কেটে যাওয়ার পর যখন আর কোনো কল আসলো না, তখন তাড়াতাড়ি নিজের ড্রেসিং সম্পণ্ণ করে ফোনটা হাতে তুললো মাহতিম। একসেকেন্ডও দেরি না করে কল বসালো জায়গামতো। সাতসকালে এমন একটি অচেনা নাম্বারের কল পেয়ে অপর প্রান্তের লোক বেশ বিরক্ত নিয়ে কল রিসিভ করলো, তার চেয়েও দ্বিগুন বিরক্তি মিশিয়ে বললো,

– হ্যালো, কে?

মাহতিম বিরক্তির ধাঁচটা পুরোপুরি ধরতে পারলেও সময় নষ্ট না করে মোদ্দাকথায় আসলো,

– আরাফাত সাহেব, নেভি ফোর্স থেকে মাহতিম আনসারী বলছি। এই মূহুর্তে আমার এলাকায় নেটওয়ার্ক জ্যাম করা চাই। টানা দুটো ঘন্টার জন্য সব স্থগিত। কল ড্রপ করার সাথে-সাথে কাজটা যেনো শুরু দেখি। এই এরিয়ায় যদি একটা কল আসতে দেখি, কিছুক্ষণ পর ইমেইল একাউন্টে নিজের রাস্টিগেট লেটার দেখতে পাবেন।

কল কাটার শব্দ হতেই সম্বিৎ ফিরে পেয়ে চমকে উঠলেন ভদ্রলোক। এখনো আশ্চর্যের ঘোরটা তিনি কাটাতে পারেননি। পরিচয় শোনার পর ‘ বস্ বা স্যার ‘ বলে সম্বোধন করে মাফ চাইবেন, সেই সুযোগটাও এই নৌ-কর্মকর্তা দিলো না। কান থেকে ফোন নামিয়ে উক্ত সেল নাম্বারে তাকালেন তিনি, সত্যিই কি মাহতিম আনসারী কল দিয়েছে? তিনি কতো শত পুলিশকে তুড়ি বাজিয়ে ঢপ মেরে দিলেন, অথচ এই কন্ঠের কাছে এতো ঘাবড়ে গেলেন কি করে? কাছের কথা মনে পরতেই দ্রুত তিনি হন্য হয়ে ছুটলেন, এখুনি অনেকগুলো কল করতে হবে। একটু দেরি হলেই তার চাকরি নট, একেবারেই সাসপেন্ড!
.

চিন্তিত হান্নান শেখ কপালে রীতিমতো ঘাম ছেড়ে পায়চারি করছেন। হাতদুটো পিছমোড়া করে আবদ্ধ রেখে একবার এমুখো, আরেকবার ওমুখো করে ছুটছেন। বাড়িতে সবাই ঘুম শেষে নিজ-নিজ কাজে লিপ্ত, শানাজ একটু আগে কলেজের দিকে বেরুলো, সুরাইয়া-সাবা ঘরের কাজ দেখছে। সাবা উঠোনে বসে কাঁচা মরিচের বোটা আলাদা করতেই দাদার রুমের দরজা গলে ভেতরে তাকিয়ে আছে। দাদাকে খুবই চিন্তাগ্রস্থ দেখাচ্ছে এখন, কি নিয়ে চিন্তায় মগ্ন সেটা জানার জন্য খচখচানি হচ্ছে সাবার। সাবা কাজের ফাঁকে-ফাঁকে বারবার সেদিকে দেখছে, ব্যাপারটা সুরাইয়ার দৃষ্টিতে আঁটকা পরলে সাবার মাথায় চাট্টি মেরে বলে,

– ওখানে কি? কি দেখিস ওখানে? ভাতার দেখিস?

সাবা মুখটা বিকৃত করে সুরাইয়ার দিকে তাকালো, সেও পালটা প্রতি’শোধ হিসেবে সুরাইয়ার দিকে মরিচ ছুঁড়ে বললো,
– মুখ সামলে কথা বল্! আমি ওখানে দাদাভাইকে দেখছি। তোর মতো খাচ্চ’র ভাবিস নাকি?

সুরাইয়া এবার ফুঁসে উঠে বললো,
– খবরদার আমাকে ‘ খা’চ্চর ‘ ডাকবিনা সাবা!

সাবা আরো রাগ দেখিয়ে আঙ্গুল তুলে চেঁচিয়ে উঠলো,
– তুই আমাকে নাম ধরে ডাকবি না! তোর মায়ের মতো ফাতরামি করলে দাদাভাইয়ের কাছে বিচার লাগাবো! চুপচাপ মরিচ কুট্। অন্যদিকে চোখ দিলে এক্কেরে কষিয়ে মা’রবো।

সাবার হুঙ্কারে চুপটি মা’রলেও রাগে দপদপ করছিলো সুরাইয়া। উঠোন থেকে চেঁচানির আওয়াজ পেয়ে এবার হান্নান শেখ নিজেই ছুটে এলেন, আক্রোশে ভ্রুঁ কুঁচকে বললেন,
– তোমাদের ঝগড়া কি কোনোদিন থামবে ভাই? প্রতিদিনই তোমরা বোনেরা-বোনেরা লড়াই করো, আমার বুড়ো শরীরটা এসব দেখলে কি টিকবে?

হান্নান শেখের কড়া গলায় দু’বোন খামোশ হয়ে মাথা নিচু করলো। সাবা অপরাধীর মতো মুখ করে আরো খিঁচিয়ে গেলো, সুরাইয়ার অবশ্য গায়েও লাগলো না। সাবা কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে অধোমুখে বললো,
– দাদু, আজ আমি ভুল করিনি। এই সুরাইয়া আমাকে ইচ্ছা করে রাগায়। দাদু, আপনি কি কোনো ব্যাপারে চিন্তিত?

টনক নড়লো হান্নান শেখের, তিনি নিজের চিন্তান্বিত চেহারার উপর স্বাভাবিক চেহারার মুখোশ লাগিয়ে চাপা হাসিতে বললেন,
– না না, কিসের চিন্তা দাদু? ওই আমার ছোট দাদুভাইয়ের কথা একটু খুব মনে পরছিলো। কতোদিন ওকে একটু দেখিনা। সবসময় তো চোখের সামনে থাকতো, মনে একটা জোর পেতাম। দূরে থাকে তো, কথাও হয়না।

মুখে উদাসী ছাপ ফেলে মলিন করে হাসলেন হান্নান শেখ। তাঁর চলে যাওয়ার দিকে নির‍্যুত্তর ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো সাবা, অন্যদিকে সুরাইয়া দাদার দিকে মুখ ভেঙচি করে তীব্র আপোষ বুঝালো। হান্নান শেখ পুনরায় মলিনতার ছাপ উবে দিয়ে রাগান্বিত মুখায়বে ফিরে এলেন, কলটা ধরলো না, আবার মেহনূরের নতুন ফোনটাও বন্ধ। এখন সবার ফোনই ‘ নট রিচেব্যাল ‘ বলছে। কি চালাকি হচ্ছে ওখানে? ও কি টের পেয়ে গুটি সরালো নাকি? গায়ের রক্ত যেনো টগটগ করে মাথায় উঠে গেলো, তিনি দ্রুত বিছানার তোশক উঠিয়ে গোপন ফোনটা বের করলেন। এবার এটার ব্যবহারের সময় এসে পরেছে।
.

সূর্যের অবস্থানটা আকাশের মধ্যখানে ঠিক মাথার উপর। ভূমিতে সোনালি আলোটা বেশ প্রখর হচ্ছে, ঘড়িতে ঘন্টার কাটাটা বারোর দিকে, মিনিটের কাটাটা সদ্য পনেরোর ঘরটা ছুঁয়েছে। বাড়ির সিড়ির কাছে একসারিতে তিনটা গাড়ি থামানো। প্রথমে ভোলভো কোম্পানির আভিজাত্যপূর্ণ গাড়িটা আয়েশী স্টাইলে দাঁড়িয়ে আছে, তার পেছনে দশ সিটের পারিবারিক মাইক্রোবাসটা, তার পেছনে দাম্ভিকের চেহারা নিয়ে থেমে আছে জিপটা। রজনী আজ শাড়ি পালটে হলুদ থ্রিপিসের বেশে সেজেছে, স্পা করা চুলগুলো ছেড়ে সানগ্লাসটা মাথায় সেঁটে রেখেছে। অনামিকার পড়নে হাতাহীন কালো কূর্তি, ভেতরের মেয়েলি পোশাকের স্বচ্ছ চিকন স্ট্রিপদুটো দু’কাধের উপর দৃশ্যমান। রজনী নিজেই নিজের গাড়ি ড্রাইভ করবে বলে মারজাকে সে জোর করে পাশে বসিয়ে নিলো, অনামিকার সুপ্ত ইচ্ছাটা জিপের ড্রাইভিং সিটের পাশে বসার ছিলো, কিন্তু রজনী সে ইচ্ছাতে পানি ছুঁড়ে চোখ রাঙানি দিয়ে নিজের গাড়িতে উঠিয়ে নিলো। মাইক্রোটাকে বিদায় দিয়ে রজনীর ভোলভো গাড়িটা সবার আগে ছুটলো। তৌফের সাথে ট্যূরের রাস্তা নিয়ে কথা বলতে-বলতে আসছিলো মাহতিম, এদিকে মাইক্রোটা আস্তে-আস্তে পূরণ হয়ে শেষ। হুট করে কল আসলে বাধ্য হয়ে কল রিসিভ করতে কোণায় চলে যায় মাহতিম, ততক্ষণে নীতির হাত ধরে নিচে নেমে আসে মেহনূর। গাঢ় নীল রঙের শাড়িটা আজ ভিন্ন কায়দায় পরিয়ে দিয়েছে নীতি, শাড়ির সাথে হুবহু কালার মিল করে মখমলের ছোট হাতার ব্লাউজ। নীল জামদানী শাড়িটাকে লেহেঙ্গার মতো পরিয়ে দিয়েছে। অনেকটা লেহেঙ্গার ওড়না যেমন ঘুরিয়ে এনে বুকের সামনে দিয়ে আঁচলের মতো পিছনে ছেড়ে দেয়, ঠিক সেই স্টাইলে যেনো শাড়ির বেশভূষা। চুলগুলো সব পেছনে টেনে বেশ মোটা এবং লম্বা একটা বেণী ঝুলিয়ে দিয়েছে, মাথার অগ্রভাগে ছোট-ছোট চুলগুলো সুন্দর করে আঁচড়ে দিয়েছে। নীতি ইচ্ছে করে সাজায়নি মেহনূরকে। যে মেয়েটা আকাশের সমস্ত নীলকে একীভূত করে নিজের গায়ে জড়িয়ে ফেলেছে, তার দেহে আলগা রঙের কৃত্রিম সাজটা একদম বেমানানই লাগবে। সিড়ি দিয়ে নামতে-নামতে এই ফাঁকে আরেকবার ব্লাউজটা নিচের দিকে টান মারলো, তবুও ব্লাউজটা পেটের চিলতেখানি ফাঁকটা ঘুচালো না। নীতির হাত ছেড়ে পিছু-পিছু আসতেই হঠাৎ বাঁদিকের কোণায় চোখ পরলো মেহনূরের, সাদা শার্টের টানটান পিঠটা আড়চোখে দেখতে পেয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো। আজ কেনো শার্টের হাতাদুটো গুটায়নি? বাঁহাতটা কি প্রচণ্ড ব্যথা? সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই অন্যমনষ্ক মেহনূর শাড়িতে হোঁচট খেয়ে দাঁড়িয়ে পরলো, ওমনেই হাতের নীলগাছী চুড়িগুলো রিনঝিন করে উঠলো। নীতি সদর দরজার কাছে এসে পাশের সু’শেল্ফ থেকে দুজনের জুতা বের করতে নিলে পেছন থেকে বাধা দিলো মেহনূর,

– আমার জুতা নিতে হবেনা আপু, আমি নেই। আমি নেই। আপনি গাড়িতে উঠুন।

কথা মতো, দ্বিতীয় গাড়িটাও ‘ সরাৎ ‘ করে মেইন গেট দিয়ে ছুটে গেলো। জানালা দিয়ে গাড়ি যাওয়ার দৃশ্য দেখে চোখ বন্ধ করে চিন্তার ভারী নিঃশ্বাসটা ছাড়লো মাহতিম। কলে কথা বলতে-বলতে দরজার কাছে আসতেই দেখলো তার সু’জোড়া রেডি। কাজটা নীতির ভেবে এক পশলা হাসি দিয়ে কালো সু’য়ের খাপে পা ঢুকিয়ে দিলো। ফিতা বাঁধার জন্য নিচে ঝুঁকতে নিলে তখনই সরু ফিতাগুলো আয়ত্তে নিয়ে ফেললো এক খন্ড নীল রাজ্যের উষ্ণতা। মাহতিম অনুভব করলো, তার হাত-পা কেমন ঠান্ডা হয়ে আসছে। তার হাতে থাকা ফোনটা কান থেকে নির্লিপ্তে নেমে যাচ্ছে, কলের ওপাশ থেকে অনবরত বলেই যাচ্ছে,

– হ্যালো স্যার? স্যার, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? আনসারী স্যার, আপনি কি…..

– চলমান .

#FABIYAH_MOMO .

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৪৩.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

মাহতিমের চোখের সামনে যা ঘটলো তা চিন্তার বাইরে ছিলো! গায়ের রক্ত যেনো হিম হয়ে গেছে তার! সে ভাবতে পারেনি, কল্পনাও করেনি, মেহনূর তার জন্য থেকে যাবে। এমনই একটি মূহুর্তে তার জুতাজোড়া নিয়ে ব্যস্ত হবে সেটা ভাবনার ভেতরেই আনা দুষ্কর ছিলো। হাতের ফোনটা থেকে অনেকক্ষণ ‘ হ্যালো, হ্যালো ‘ করে শব্দ ভেসে এলো ঠিকই, শেষে সাড়া না পেয়ে কেটে গেলো সেটা। মাহতিম তখনও আশ্চর্যের রেশ কাটিয়ে স্বাভাবিক হতে পারেনি। তার মনেও পরেনা এতোটা আশ্চর্য তার কর্মজীবনে কোনো অপারেশন চলাকালীন হয়েছিলো কিনা। ভেতরের অস্বাভাবিক দূরাবস্থাটা চট করে সামলে নিয়ে খিটখিটে মেজাজে গলা তুললো মাহতিম,

– তুমি ওদের সাথে গেলে না কেনো? কি সমস্যা ছিলো ওদের সাথে যেতে? আমার সাথে চালাকি করার চেষ্টা করছো, না? যাওনি কেনো?

মুখ তুলে সরল দৃষ্টিতে তাকালো মেহনূর, তাকিয়ে থাকতেই জুতার গিটটা দুহাতে টাইট দিয়ে স্থিরচোখেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। স্মিত হাস্যে শান্ত গলায় বললো,

– আমিযে আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

শিরশির করে কথাটা যেনো বেজে উঠলো কোথাও, তবুও সেটা ভাব-সাবে প্রকাশ করলো না মাহতিম। মুখের অবস্থা পূর্বের চেয়েও কাঠিন্য করে হনহন গতিতে মেহনূরের ডানসাইড কেটে সোজা বাইরে বেরুলো, প্যান্টের ডান পকেট থেকে চাবি বের করতেই চট করে জিপে উঠে বসলো। বসতেই শরীরটা যেনো চিনচিন করে উঠলো তার, আবারও গতরাতের ব্যথাটা শিরায়-শিরায় সিগন্যাল দিয়ে যাচ্ছে, ব্যথাটা সাধারণ মানুষের জন্য তীব্র, তবে এটা আপাতদৃষ্টিতে তার জন্য কিছুই না। এক সেকেন্ডের মতো দাঁত শক্ত করে চোখদুটো বন্ধ রাখলো সে, জোরে একটা দৃঢ়ভঙ্গির নিশ্বাস ছাড়তেই স্টিয়ারিংয়ে দুহাত রাখলো মাহতিম, যেই স্টার্ট দিয়ে জিপের ব্রেকজনিত ব্যাপারটা চেক দিতে নেয়, তখনই দরজার দিকে দৃষ্টি থমকে স্টিয়ারিংয়ের হাতদুটো শক্ত হয়ে এলো। দরজা দিয়ে পায়ে-পায়ে বেরিয়ে এলো নীলাভ ছায়ার মানবী, তার মুখটা করুণ লজ্জায় আবৃত হয়ে আছে, দ্বিধাগ্রস্ত দৃষ্টিদুটো ভূমিতে নিক্ষেপ করে পেটের কাছে হাতদুটো কচলাতে-কচলাতে জিপের কাছে চলে আসছে, একজোড়া তীক্ষ্ম-বিচক্ষণ চোখ তার আগমন দেখে অনিমেষ নয়নজোড়ায় তাকিয়ে আছে। নীল শাড়িটার দিকে পর্যবেক্ষণশীল দৃষ্টিদুটো একবার রাখতেই তার মেমোরি সেন্স জানান দিলো, শাড়িটা তারই কিনে দেওয়া। দূরত্বটুকু পায়ে হেঁটে ঘুচাতেই ড্রাইভিং সিটের পাশে এলো মেহনূর, আড়চোখে দেখতে পেলো, তার ব্যক্তিগত মানুষটা আজ আগের মতো হাসি-হাসি চোখে দেখলো না। সে একটুও যেনো গ্রাহ্য করলো না, একবারও চোখ তুলে তাকালো না। মেহনূর যে আজ ব্যতিক্রম করে সেজেছে তা কি চোখে পরেনি? এইযে ব্লাউজের হাতাটা ছোট পরেছে, তারই কিনে দেওয়া শাড়িটা গায়ে পেঁচিয়ে নিয়েছে, বাইরে বেরুলে কখনো পিঠ উন্মুক্ত ব্লাউজ না পরা সত্ত্বেও আজ পরেছে, এগুলো কি তার চোখে পরছেনা? মেহনূর মুখ তুলে দেখলো, মাহতিম তার দিকে একদম তাকিয়ে নেই, সে জিপ স্টার্টের জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতিটা নিয়ে ফেলেছে। শাড়ি পরে জিপে উঠতে এবারও হিমশিম খেলো মেহনূর, মাটি থেকে বেশ উঁচু লেগস্ট্যান্ডটায় পা উঠাতে ব্যর্থ হচ্ছিলো, তার পা’টা ফসকে যাচ্ছিলো বারবার। ব্যর্থতার অথৈ জলে হাবুডুবু খেলেও মনে শেষ আশাটুকু ছিলো যে, মাহতিম এখুনি হাত বাড়িয়ে তাকে উঠতে সাহায্য করবে, কিন্তু আফসোসের গলাধঃকরণ করে মাহতিম এসবের কিছুই করলো না, বরন্ঞ্চ ঝাঁঝালো গলায় ধমক লাগিয়ে এখানে ফেলে যাওয়ার হুঙ্কার দিয়ে বসলো। দূর থেকে বাগানের ফুলে পানি দিতেই পুরো দৃশ্যটা দেখছিলো সিরাজ কাকা, তিনি অবস্থা বেগতিক দেখে তাড়াতাড়ি পানির পাইপ ফেলে গ্যারেজের দিকে ছুটে গেলেন, একই দৌড়ে তিনি বগলচাপা করে লাল বস্তুটা মেহনূরের কাছে এনে রাখলেন, মেহনূর কাঁদো-কাঁদো চেহারায় দৃষ্টি ফেলে দেখলো, তার পায়ের কাছে জিপে উঠার জন্য একটা টুল রাখা হয়েছে। মেহনূর টুল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ডানে তাকিয়ে সিরাজ কাকার দিকে তাকালো, বৃদ্ধ সিরাজ অভয় সূচকে মাথা নাড়িয়ে টুলে পা বাড়ানোর ইশারা করলেন। অদ্ভুত এক আনন্দে উদাসী মুখের মধ্যেই হাসিটুকু উঁকি দিলো মেহনূরের, টুলে পা ফেলে জিপে উঠে বসতেই দায়িত্বভার হিসেবে ঝুলন্ত আঁচলটুকু মেহনূরের কোলে তুলে দিলেন সিরাজ কাকা। মাহতিম এসবের দিকে ভ্রুক্ষেপ পযর্ন্ত করছিলো না, সে শুধু সিরাজ কাকার দিকে চোখ দিয়ে বাড়ির দিকে ইশারা করলো। শব্দহীন মুখে একবার ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে মাথা নাড়িয়ে অব্যক্ত আজ্ঞাটা বুঝিয়ে দিলেন সিরাজ। গোলাকার স্টিয়ারিংটা দুটি দক্ষ হাতের চালনা পেয়ে সমস্ত জড়তা ছেড়ে গতিশক্তি ধারণ করলো, জিপটা শোঁ শোঁ করে বাড়ির শূন্য ঠোকাঠা মাড়িয়ে বেজায় স্পিডে ছুটতে লাগলো।
.
হৃদয়ের কপাটগুলো ভয়ের আস্তরণে নড়বড়ে হয়ে আছে, অবচেতন মনটা মিনিটে-মিনিটে অদ্ভুত কিছুর আভাস দিচ্ছে। সেই আভাসে আরো সংকুচিত হয়ে লজ্জাবতী পাতার মতো কুঁকড়ে যাচ্ছেন মারজা। তার সরল মনের শান্ত আঙিনাটা এই যাত্রা নিয়ে কোনোভাবেই স্বাভাবিক থাকতে পারছেনা, তার মাতৃতুল্য অমূল্য স্নেহের মনটা অজানা-অচেনা ভয়ের কোটরে ঢুকে গেছে, মনে হচ্ছে এবার খুবই খারাপ কিছুর মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। ভেতর থেকে কোনোভাবেই ভালো কিছুর ‘ শুভসংকেত ‘ পাচ্ছেন না, হাজার চেষ্টা করেও শান্ত থাকার বদলে চাপা অস্থিরতায় উদ্বিগ্ন হয়ে পরছেন তিনি। একটু পরপর সবার আগমন নিয়ে খবর নিচ্ছেন, মাথা ঘুরিয়ে পেছন থেকে তাদের গাড়ি দেখা চেষ্টা করছেন, বোতল খুলে ঢকঢক করে পানি খাচ্ছেন, আবার মাঝে-মাঝে পানিটা কুলি করে চলন্ত গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে ফেলছেন। পেছনের সিটে বসা অনামিকা মারজার কীর্তিকলাপ দেখে কৌতুহলী হওয়ার পরিবর্তে বিরক্ত হচ্ছে, এই মহিলা কিসের ঢং শুরু করেছে? ঢং করার কি জায়গা পেলো না? এমন ফালতু ভাবে কেউ হাইরোডে কুলি করে? ‘ মেন্টাল ‘ বলে মনে-মনে বিরক্তির বার্তা ছুঁড়লো অনামিকা। রজনী এমনভাবে ড্রাইভিং করছে যেনো সে ট্যূরের চূড়ান্ত স্ফূর্তিতে মেতে আছে। মোবাইল টেপা বাদ নিয়ে কানে সাদা-সাদা দুটো ইয়ারপড গুঁজলো অনামিকা, ফেসবুক স্ক্রল করতেই একটি লোমহর্ষক লাইভ টেলিকাস্ট দেখে আতঙ্কে তার মুখটা হা হতে লাগলো। নিষ্পলক দৃষ্টিতে লাইভের অবস্থাটা দেখতেই গলা শুকিয়ে খরা, বহু কষ্টে ভীতগ্রস্থ চাহনিদুটো ফোন থেকে সরাতে পারলো অনামিকা, কথা বলতে গেলো কিন্তু কন্ঠস্বর যেনো তোতলা সুরে বিকৃত হয়ে গেলো তার,

– ফু-ফু-ফু-ফুপ…ফুপি রাস্তায় স্ট্রাই— ,
.

বেপরোয়া স্পিডে শহরের হাইরোড মাড়িয়ে মাইক্রোবাসটা ছুটছে। সমুদ্র দেখার অভিলাষে তন-মন যেনো প্রফুল্লতায় মেতে উঠেছে, মাইক্রোর সেই বদ্ধ পরিকর চলন্ত পরিবেশে সুর উঠলো নীতির,

‘ দুঃখটাকে দিলাম ছুটি আসবেনা ফিরে, ‘

নীতির হাসিতে গেয়ে উঠলো প্রীতির চন্ঞ্চল মন,

‘ এক পৃথিবী ভালোবাসা রয়েছে ঘিরে, ‘

দুবোনকে ছাড়িয়ে ড্রাইভিং সিট থেকে বললো তৌফ,
– ‘ দুঃখ টাকে দিলাম ছুটি আসবেনা ফিরে, ‘

মুচকি হাসিতে নিজেও ঠোঁট নাড়ালো সৌভিক,
– ‘ এক পৃথিবী ভালবাসা রয়েছে ঘিরে, ‘

সবাইকে টেক্কা দিয়ে হাতদুটো পাখির ডানার মতো ঢেউয়ের ভঙ্গি করে গাইলো ফারিন,
– ‘ মনটা যেন আজ পাখির ডানা, ‘

পাশ থেকে কলি ছিনিয়ে গেয়ে উঠলো মাহদি,
– ‘ হারিয়ে যেতে তাই নেইতো মানা, ‘

ঠোঁটের কাছে ফিসফিসিয়ে বলার মতো সুর তুললো সিয়াম,
– ‘ চুপি চুপি চুপি সপ্ন ডাকে হাত বারিয়ে, ‘

খিলখিল হাস্য ধ্বনিতে সবাই যেনো মিলে গেলো তখন। পুরো মাইক্রোতে যেনো হাসির কলরব ছুঁয়ে-ছুঁয়ে যাচ্ছিলো, পেছনের সিট থেকে গিটারের টুংটাং আওয়াজে কাঙ্ক্ষিত গানের মিউজিক বাজতেই দারুণ উল্লাসে, দারুণ আমেজে একসাথে গলা মিলিয়ে গাইলো সবাই,

মন চায় মন চায়,
যেখানে চোখ যায়,
সেখানে যাব হারিয়ে

ওওও

মন চায় মন চায়,
যেখানে চোখ যায়,
সেখানে যাব হারিয়ে।

.
দুপুরের তৃতীয় প্রহর চলছে, অরুণের তেজী চাকাটা আজ ম্রিয়মাণ। গ্রীষ্মের মতো দাপট না দেখালেও শীতের হিমেলে উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। হাইরোডে এখন জ্যাম নেই, আজ যে কেনো এমন জ্যাম নেই তা ধরতে পারছেনা মাহতিম। বেকুবের দলটা ফোনই ধরছেনা, এদিকে মেহনূরকেও জিপে রাখা সম্ভব না। ধ্যাত! কেনো করলো এই কাজ? কেনো ওদের সাথে গেলো না? রাগটা সম্পূর্ণ নিজের মধ্যেই চেপে রাখলো মাহতিম। এই মূহুর্তে রাগ দেখিয়ে লাভ নেই, একটু আগে কল এসেছে সামনের পরিস্থিতি খুবই খারাপ! সড়ক অবরোধ করে দলবল জুটিয়ে গাড়ি ভাঙচুর করছে, যত্রতত্র আগুন জ্বালিয়ে হাহাকার অবস্থা! রাজনৈতিক অবস্থাটা ইতিবাচকের পাশাপাশির কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তা আর বলার প্রয়োজন রাখেনা। বাঁহাতের হাতঘড়িটায় একপলকের জন্য চোখ বুলিয়ে ফের সামনের দিকে তাকালো, খুব একটা সময় খুব। কখন-কিভাবে-কোনদিক দিয়ে বিপদ এসে হানা দেয় বুঝতে পারছেনা, ভয়টা নিজের জন্য না হলেও পাশে থাকা মানুষটার জন্য হচ্ছে। ড্রাইভিংয়ের ফাঁকে-ফাঁকে কালো সানগ্লাসের আড়ালে নজর রাখাটা থেমে নেই, পাংশুটে ছোট্ট মুখটা কেমন মিইয়ে গেছে। একরত্নি হাসি নেই সেখানে, উজ্জ্বলতার রেশ নেই, দৃষ্টিদুটোও বিষণ্ণ, ঠিক নুইয়ে পরা ছোট্ট চারাগাছের মতো। মুখটা বায়ে ফিরিয়ে চলন্ত জিপ থেকে ছুটে যাওয়া দৃশ্যগুলো চুপ করে দেখছিলো মেহনূর। মাথাটা সিটের সাথে হেলান দিয়ে ঘুম-ঘুম অবস্থায় দেখছিলো। আজও গাধার মতো গায়ে গরম পোশাক নেই, আবার শাড়িটাও অতো মোটা পরেনি। কাঁপুনি ধরানো ঠান্ডা বাতাসে একটু পরপর বাহুতে হাত ঘষে উষ্ণসূচক করছিলো সে, আঁচলটা দিয়ে গা ঢাকা সত্ত্বেও কাঁপুনি কমছেনা। পাশ থেকে আড়চোখে ড্রাইভ করা অবস্থায় ওসব কীর্তিকাণ্ড দেখে চোখ সামনের দিকে ঘুরালো মাহতিম, কিছু একটা চিন্তা করে স্পিড খানিকটা কমিয়ে আনতেই চিন্তার অঙ্কটা ক্ষণিকের ভেতর ফলে গেলো। মেহনূর ঘুমে বিভোর হয়ে যেই মাথাটা বাঁদিকে রাস্তা বরাবর ছেড়ে দিতে নিলো, সাথে-সাথে একসেকেন্ডও দেরি না করে ঘাড়ের পেছনে হাত গলিয়ে মেহনূরকে আগলে ধরলো মাহতিম। তন্দ্রাচ্ছন্ন মেহনূর নির্ঘুম রাত্রির ক্লেশে ঘুমাতে না পারলেও প্রশান্তিময় জিপের ভ্রমনে গভীর তন্দ্রায় ডুবে গেছে, মেহনূরকে বুঝতে না দিয়ে আস্তে করে ওর মাথাটা নিজের কাধে রাখলো মাহতিম। গ্রীষ্মের তালুফাটা গরমে যখন তৃষ্ণার্ত গলাটা ঠান্ডা পানির স্বাদ পেয়ে অদ্ভুত শান্তিতে চোখ বুজে আসে, মাহতিমও যেনো কাধের উপর উষ্ণতার ভর পেয়ে চোখদুটো ক্ষণকালের জন্য বন্ধ করেছিলো। আজ যদি জিপটা নিজে না চালাতো, তবে ওই ঘুম-ঘুম বিষণ্ণ কোমল মুখটায় অসংখ্য ছোঁয়া ছুঁইয়ে দিতো মাহতিম। উন্মাদের মতোই দুহাতে মুখটা তুলে কাজটা করতো সে, একটুও বাধা-নিষেধ মান্য করে নিজের প্রগাঢ় ইচ্ছাটা পাথর চাপা দিতো না। বুক হালকা করে নিশ্বাস ছাড়লো মাহতিম, হঠাৎ প্যান্টের ডান পকেটটায় সুড়সুড়ি দিয়ে উঠলো। তার ভাইব্রেট ফোনটা কলের জন্য বাজছে, মাহতিম ফোনটা বের করে দেখলো সামিকের নাম্বার থেকে কল এসেছে। জিপটা সুযোগ মতো রাস্তার একপাশে থামিয়ে কলটা রিসিভ করলো মাহতিম, মেহনূরের ঘুমন্ত দেহটা একইভাবে ধরে রেখে ছোট্ট স্বরে ‘ হ্যালো, হ্যাঁ সামি– ‘ বলতে নেবে তখনই কথাটা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আতঙ্কগ্রস্থে চেঁচিয়ে উঠলো সামিক,
– মাহতিম ভাই, তুমি কোথায়? ভাই খবরদার তুমি আর এগিয়েও না। এখানে গাড়ি ভাঙচুর করছে! রাস্তায় স্ট্রাইক চলছে ভাই, তুমি জলদি জিপ ঘুরাও! তাড়াতাড়ি ঘুরিয়ে গাজীপুরের রাস্তা ধরো! আর এগিও না। আমি সবাইকে নিয়ে আমার বন্ধুর বাসায় উঠেছি। সামনের রাস্তা খুবই জঘন্য, ওরা গাড়িতে আগুন পযর্ন্ত দিয়ে ফেলছে! তোমাকে নেটওয়ার্কের জন্য কলও দিতে পারছিলাম না। ভাই প্লিজ তাড়াতাড়ি, প্লিজ তাড়াতাড়ি পালাও।

সামিকের অস্থির কন্ঠের চেঁচামেচি শুনে নিজেকে ধাতস্থ রাখলো মাহতিম। পরিস্থিতি যতোই নাগালের বাইরে যাক, নিজের ধূর্ত মস্তিষ্কটার উপর ভালোই ভরসা আছে। সামিককে শান্ত হতে বলে নিজেও কয়েক মিনিটের ভেতর যুৎসই প্ল্যান সাজিয়ে নিলো। এর জন্য কিছুক্ষণ গুগলে ঘাঁটাঘাটি করলো মাহতিম, বৃদ্ধাঙ্গুলে উপর-টু-নিচ স্ক্রিল করতেই হঠাৎ একটা কনটেন্ট দেখে বৃদ্ধাঙ্গুলটা থেমে গেলো তার। সানগ্লাসের ভেতর দিয়ে বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টিদুটো সেই ইংরেজিতে লেখা কনটেন্টে বুলাতেই ঠোঁটে বিচক্ষণতার বাঁকা হাসিটা খেলে গেলো। এখন তাকে জরুরী দুটো কল করতে হবে, পাওয়ারটা আবারও খাটানোর সময় এসে পরেছে। কলটা ডায়ালে ফেলে কানে চাপতেই মেহনূরের দিকে মুখ করলো মাহতিম, সানগ্লাসের দৃষ্টিটা মেহনূরের মুখের উপর ফেলে চাপা হাসিতে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,

– ‘ এবার যদি বায় চান্স আউট অফ কন্ট্রোল হই, আংশিক মধুচন্দ্রিমা হয়েই যাবে। ‘

.
রাতের খোলসে ঝিমিয়ে আছে মহিনপুরের গ্রামটা। গ্রামের নামটা এতোদিন ধামাচাপা ছিলো অনিচ্ছুক কারণে, তবে এটা যেহেতু খোলাশা হয়েই গেছে সেক্ষেত্রে বলা উচিত এটা মেহেরপুরের কাছাকাছি। গ্রামটা মূলত মেহনূর আফরিনের শৈশবের স্মৃতিখানি, তার বেড়ে উঠার একমাত্র স্থল ছিলো। কিন্তু ‘ বিয়ে ‘ নামক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সেই গ্রাম থেকে আজ বহুদূরে বসবাস করছে।’ স্বামী ‘ নামক পুরুষের সাথে তার বৈবাহিক সম্পর্ক এখন পন্ঞ্চম মাসে পর্দাপণ করেছে, এ নিয়ে ক্যালেন্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে দিন হিসাব করলো হান্নান শেখ। হ্যাঁ, পন্ঞ্চম মাসটা শুরু হয়েছে বৈকি, কিন্তু সম্পর্কটা আদৌ স্বামী-স্ত্রীতে পরিণত হয়েছে কিনা সেটা জানাটা জরুরী। তিনি জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা এখন জঘন্য নিয়মে শুধরাতে চাইছেন, হোক সেটা ভুল, সব ভুলেরই তো সমাধান আছে। যদি তার নাতনী ওই ধুরন্ধর লোকের সাথে এখনো সম্পর্ক স্থাপন না করে থাকে, তাহলে তিনিও ষোলআনা মিলিয়ে কাহিনী শেষ করে দিবেন। ওই বদমাইশের বাচ্চাটাকে সামনে পেলে সবার আগে ওর মাথাটা থেতলে দিতেন তিনি। কতো বড় চালাকি করেছে ওই শয়তান! তারই বাড়িতে ঢুকে, তারই নাকের নিচে থেকে-থেকে দাবার গুটি সাজিয়ে নিয়েছে, আবার সুযোগ মতো ছোঁক করে ছোবল মেরে গুটি সরিয়ে ফেলেছে। তিনি কি এতোদিন চোখে পট্টি মেরে ঘুমাচ্ছিলেন নাকি? ওই হারামির কর্মকাণ্ড কি করে তিনি দেখতে পেলেন না? নির্ঘাত ওই বদমাইশের বাচ্চা অনেক তথ্য হাতিয়ে ফেলেছে। মেহনূরকে বিয়ে দেওয়ার সময় ছোট্ট একটা শর্ত রেখেছিলো হান্নান শেখ, তার ছোট নাতনীটা যেহেতু এখনো বয়সে পাকা হয়নি, তাই তাকে কাবিন করেই রাখা হোক, সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। এ কথায় মাহতিম তার সাথে সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করে বলেছিলো, বিয়েটা যেহেতু হয়েই গেছে সেক্ষেত্রে বাড়ির বউ বাড়িতে ফিরলেই যুগোপযোগী, বাপের বাড়িতে না থেকে আসল বাড়িতে থাকাটাই ঠিক হবে। মারজা যদি সেদিন ‘ হ্যাঁ, হ্যাঁ ‘ করে জোর না দিতো, তাহলে হান্নান শেখ খুব সহজেই তার সহজ-সরল নাতনীকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে সরিয়ে আজ আনতে পারতেন। খুব সহজেই আরেক পাত্র খুঁজে তাদের ভুলভাল বুঝিয়ে বিয়ে দিয়ে দিতেন। নিজের কপালে গুণে-গুণে দশটা ঝাড়ুর বারি লাগাতে ইচ্ছে করছে, তিনি যে খাল কেটে নিজ বাড়িতেই কুমির চাষ করেছেন সেটা বুঝতে পেরে কঠিনভাবে আফসোস হচ্ছে। ওমন সুপুরুষের মাথায় চতুর বুদ্ধির ক্ষমতাটা আসলেই আশ্চর্যজনক! মাহতিম আনসারী খুবই বিপদজ্জনক মানুষ এ নিয়ে মনে আর সন্দেহ নেই হান্নান শেখের।

.

আজ সবকিছু বিপক্ষে চলে যাচ্ছে, বলা নেই, কওয়া নেই, হুট করে আকাশ চিঁড়ে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। চোখের সামনে প্রায় একহাত পযর্ন্ত বৃষ্টির জন্য স্পষ্ট দেখা যাচ্ছেনা, নিগুঢ় অন্ধকারে তলিয়ে আছে আকাশের গুমোট চেহারা। মাথায় বৃষ্টি নিয়ে তবুও জিপ ছুটাচ্ছে মাহতিম। বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালানো অনেকাংশে নিষিদ্ধ হলেও মাহতিম উলটো স্পিড বাড়িয়ে চালাচ্ছে। বৃষ্টি ফোঁটা যেনো ঠান্ডার একেকটা গোলার মতো আকাশ থেকে ঝরছে, একদম দেহের পশম ছুঁয়ে অন্তঃস্থলে ছুড়ির মতো মারছে। এর চেয়েও ঠান্ডা পানিতে ট্রেনিং নেওয়ার কার্যকরী দক্ষতা তার আছে, অথচ আজ চিন্তার ঘড়িটা বারবার মেহনূরের জন্য টিকটিক করছে। গ্রাম্য রাস্তাটায় পানি জমার কারণে জিপের বেদম গতিতে ‘ ছলাৎ ছলাৎ ‘ করে পানি ভাঙ্গার আওয়াজ উঠছে, সুনশান চারদিকে, কোনো ধরনের কোলাহল নেই, শহুরের হর্ণের ছিঁটেফোঁটা যন্ত্রনাও নেই এখানে। ঢাকা থেকে অদূরে যানবাহনের কালোধোঁয়া মুক্ত পরিবেশে গাজীপুর জেলার রাজেন্দ্রপুর উপজেলার রাজাবাড়ি বাজার ইউনিয়নের চিনা শুখানিয়া গ্রামে সম্পূর্ণ গ্রাম্য পরিবেশে গড়ে উঠেছে ‘ নক্ষত্র বাড়ি ‘ রিসোর্ট। রিসোর্টটি শ্রীপুরের কাছে অবস্থিত। দেশের জনপ্রিয় দম্পতি তথা চলচ্চিত্র পরিচালক তৌকির আহমেদ এবং অভিনেত্রী বিপাশা হায়াতের সুকৌশল চিন্তাধারায় নির্মিত বানিজ্যিক রেসোর্টির উদ্দেশ্যে যাত্রা ধরেছে মাহতিম। শীতে দাঁত কপাটি দিয়ে কাঁপতে থাকা মেহনূর কাঁপতে-কাঁপতে মাহতিমের দিকে বললো,

– এটা কি আমাদের গ্রাম?

মাহতিম তার দিকে না তাকিয়ে কপালের চুলগুলো আবার ব্যাকব্রাশ করে কাটকাট সুরে বললো,
– না।

মেহনূর আর প্রশ্ন করার অবস্থা পাচ্ছিলো না। ঠান্ডায় তার বুকের ভেতর ভারী হয়ে গেছে। নাক বন্ধ হওয়ার ফলে মুখ খুলে নিশ্বাস নিচ্ছে। প্রচণ্ড অসহ্য অনুভূতিতে ছটফট করছে মেহনূর। শৈশব থেকে এই ঠান্ডার জন্য করুণভাবে ভুগছে, নিশ্বাস আঁটকেও আসছে এখন। ড্রাইভিংয়ের ফাঁকে বামে তাকালো মাহতিম। কাঁপতে থাকা উন্মুক্ত পিঠটায় বৃষ্টির বিধ্বংসী ফোঁটাগুলো হিংস্রভাবে পরছে। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে গরম গলায় বললো মাহতিম,
– পাকনামো করে পিঠ খোলা ব্লাউজ পরেছো কি জন্যে?

কাঁপতে-কাঁপতে লাল চোখ তুললো মেহনূর। ঠান্ডায় দাঁতকপাটি লাগার সুরে অত্যন্ত ধীরভাবে বললো,
– আপনার জন্য।

চকিত ভঙ্গিতে আবার বামে তাকালো মাহতিম। তাকানোটা অস্থায়ী রেখে দ্রুত চোখ সরিয়ে ‘ নক্ষত্রবাড়ি ‘ রেসোর্টের সদর দরজা দিয়ে জিপ ঢুকিয়ে দিলো। বুকিংজনিত কাজটা কলেই সম্পণ্ণ করেছিলো বলে দ্রুততার সাথে নিজেদের কটেজ পেয়ে গেলো। কটেজ পযর্ন্ত যাওয়ার দূরত্বটুকু বৃষ্টির মধ্যেই একসঙ্গে হাঁটা দিলো। মাহতিম বড়-বড় পা ফেলে এগিয়ে গেলেও তার সাথে তাল মেলাতে না পেরে পিছিয়ে পরলো মেহনূর। অসহন গলায় কাশতে-কাশতে বললো,

– শুনুন,

ঝুম বৃষ্টির জোরালোপূর্ণ আওয়াজে শুনতে পেলো না মাহতিম। সে নিজগতিতে পা চালিয়ে দ্রুত কটেজের ভেতরে ঢুকে গেলো। মেহনূরের জন্য শুকনো কাপড়ের ব্যবস্থা করাটা এখন মূখ্য কর্ম! তার সাথে ওর কোনো পোশাকই নেই, যদি নিজের লাগেজটা খুলে কিছু পাওয়া যায় তা দিয়েই রাতটা চালানোর ব্যবস্থা করতে হবে। লাগেজটা ফ্লোরে ফেলে তাড়াতাড়ি উপর্যুক্ত পোশাক খুঁজলো মাহতিম, ভাঁজ করা ইস্ত্রির শার্টগুলো মাহতিমের ভেজা হাতের পরশ পেয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো, উলোটপালোট করে খুঁজতেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো মাহতিম,

– তুমি কি আজ রাতটুকুর জন্য আমার শার্ট পরতে পারবে? ভেজা শাড়িতে থাকলে তোমার নিউমোনিয়া হয়ে যাবে। কোনটা পরবে জলদি বলো?

প্রশ্ন করার প্রায় দুই মিনিট পেরিয়ে গেলো। চারপাশ থেকে কোনো উত্তরই এলো না। মাহতিম ভাবলো অভিমানে চুপটি মেরে আছে হয়তো, সে এবার মাথা পিছু ঘুরিয়ে ‘ মেহনূর জবাব দিচ্ছো না কেনো? ‘ বলেই ভ্রুঁ কুঁচকে ফেললো। ডানে-বামে-চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে চিৎকার দিলো,

– মেহনূর !

হাঁটু সোজা করে অগোছালো লাগেজ ফেলেই উঠে দাঁড়ালো মাহতিম! এই প্রথম অস্থিরতায়-উৎকন্ঠায়-উদ্বিগ্নে তার বক্ষস্থল পযর্ন্ত ধুকপুক-ধুকপুক করছে! এক দৌঁড়ে কটেজের রুম থেকে বেরিয়ে ডানে-বামে চোখ ঘুরাতেই কটেজের নিয়নবাতির ঝাপসা বর্ষণে নীল শাড়িটা নজর কাড়লো। কাঠের ও বাঁশের লম্বা লনটার শেষ মাথায় জবুথবু অবস্থায় হাঁটুতে মাথা রেখে হাঁপানো রোগীর মতো কাপছিলো মেহনূর। অপরাধী দৃষ্টিতে দাঁতে-দাঁত শক্ত করে ‘ ও আল্লাহ্, কি করলাম! ‘ বলতেই সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে দৌঁড়ে গেলো মাহতিম। মেহনূরের সামনে পা থামিয়ে ধপ করে হাঁটু ভেঙ্গে বসে পরলো সে। কানে অদ্ভুত শব্দটা বেজে উঠলে নতমাথা ধীরে-ধীরে উঠালো মেহনূর। লাল টকটকে চোখের পাতা টেনে খুলতেই সামনের দিকে তাকালো, ঘোলা-ঘোলা চাহনিতে দেখতে পেলো সাদা শার্টটা দেখা যাচ্ছে। চুলগুলো পানিতে জেলহীন হয়ে কপালের কাছে ছড়িয়ে আছে, টুপ-টুপ করে চুল চুয়ে পানি পরছে তার। ঠোঁটদুটো গাছের কচিপাতার মতো দুলে-দুলে কাঁপছে। মেহনূর একদৃষ্টিতে আধবোজা চাহনিতে তাকিয়ে থাকলে দুঃখী কন্ঠে বললো,
– সরি,

মেহনূরের অবস্থা যেনো ‘ নো নড়া, নো চড়া ‘ ভঙ্গিতে থমকে আছে। মাহতিম আরো নত হয়ে মেহনূরের দিকে এগিয়ে গেলো, ঠান্ডা গালদুটো ধরে মুখটার আরেক ধাপ কাছে এগুলো। ভারাক্রান্ত চাহনি দিয়ে অপরাধী গলায় বললো,
– পেছনে তাকাতে খেয়াল ছিলো না।

নির‍্যুত্তর মুখে ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেহনূর। মাহতিম আবার নরম গলায় বললো,
– বসে আছো কেনো? যাবে না?

চোখ বন্ধ করলো মেহনূর, আবার চোখ খুলে মাহতিমের দিকে তাকিয়ে ধীরে-ধীরে মাথাটা ডানে-বামে নাড়িয়ে দিলো। আশ্চর্যে হতবাক হতেই মাহতিম তৎক্ষণাৎ অস্থির কন্ঠে ক্ষোভ দেখিয়ে বললো,
– যাবে না মানে? ফাজলামি? ফাজলামি করছো?

ক্ষেপাটে চোখদ্বয় জ্বলজ্বল করে উঠলে মেহনূরকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মাহতিম। মেহনূর তখন জুলজুল চোখে মাহতিমকে দেখছিলো। অনেকটা নির্বাকভাবে, অনেকটা ভাবশূন্য চাহনিতে। মাহতিম কোনোদিকে কোনোকিছু পরোয়া না করে মেহনূরের হাঁটুর নিচে ডানহাত এবং ঘাড়ের নিচে বাঁহাত ঢুকিয়ে শূন্যে তুলে ফেললো। পাজকোলে আষ্টেপৃষ্টে আবদ্ধ করতেই বুকের কাছে মেহনূরের একপাশটা লেগে গেলো। মেহনূর অনুভব করছে, মাহতিম তাকে কোলে তুলেই কটেজমুখো হয়েছে, সে চাপা জেদ হিসেবে দৃঢ় বাহুবলে মেহনূরকে চেপে রেখেছে। সিড়ির ধাপগুলো পদে-পদে অতিক্রম করে কটেজের রুমে প্রবেশ করলো মাহতিম, রুমের ঠিক মধ্যখানটায় সিলিং থেকে বিশাল আকারের ঝারবাতি জ্বলছে। সেই ঝারবাতির আলোতেই নান্দনিক শোভায় পরিপূর্ণ রুমটা মনোরম হয়ে আছে। পা দিয়ে দরজাটা চাপিয়ে দিলো মাহতিম, মেহনূরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে আস্তে-আস্তে রুমের ডানদিকটায় চলে যাচ্ছিলো সে। কন্ঠটা কোমল করে হাসি দিয়ে বললো,
– আমার শার্ট পরতে হবে ম্যাডাম। কোন কালারটা পড়বেন আপনি?

মাহতিমের কথা ও হাসি দুটোই কৌতুহল করে দিলো মেহনূরকে। অনেকক্ষণ পর স্বচ্ছ চাহনিতে প্রশ্ন সূচকে জিজ্ঞেস বললো,

– কেনো?

মাহতিম শুধু হাসলো। মেহনূরের ঘাড়ের নিচে রাখা হাতটা একটুখানি এগিয়ে নিতেই মেহনূর সেদিকে তাকালো। তাকাতে দেরি, ‘ পটাশ ‘ করে শব্দ হয়ে লাইট নিভে গেলো রুমের। ঝারবাতির চোখ ধাঁধানো সোনালী আলোটা নিভে গেলেও রুমে ড্রিম লাইটের মতো মৃদ্যু আলো ছড়ালো। জানালা দিয়ে ঝুমঝুম বৃষ্টির ছন্দময় শব্দ ঘোর পরিবেশে নিয়ে গেলো। গ্রামের মাটি যেনো সিক্ত-অভিসিক্ত হয়ে সুমিষ্ট ঘ্রাণ ছড়িয়ে দিলো। মেহনূর ওই স্বল্প আলোতে দেখতে পেলো, মাহতিমের মুখটা তার দিকে চলে আসছে। খুবই ধীরভাবে মুখটা নিচে নামিয়ে মেহনূরের কম্পন ওষ্ঠজোড়ায় নিশ্বাস ছাড়লো সে, মেহনূর খামচে ধরলো মাহতিমের সাদা কলারটা। আবারও হেসে দিয়ে মেহনূরের থুতনির উপর ঠোঁটদুটো রেখে মৃদ্যু চাপ দিলো মাহতিম, ফিসফিস করে নিজের ঠোঁটদুটো দ্বারা থুতনি ছুঁইয়ে-ছুঁইয়ে বললো,

– তোমাকে প্রথম চুমুটা কোলে তুলে দিবো বলেছিলাম। মনে আছে?

কুঁকড়ে থাকা মেহনূর চোখ খিঁচুনি দিয়ে জড়িয়ে যাওয়া গলায় বললো,
– ম-ম-মনে আছে।

মেহনূরের ঘাড়ের নিচে থাকা হাতটা উপরে তুললো মাহতিম, চোখ বন্ধ করে থুতনি থেকে অধরযুগল সরিয়ে কিন্ঞ্চিত উপরে তুললো। শীতলতার পরশকে উষ্ণতার কোমলতা দিয়ে ঢেকে দিলো সে। বহুদিনের আকাঙ্ক্ষিত-আকন্ঠ-আকুল স্পর্শের কাছে নত হয়ে মেহনূরের
আদুরে অধরযুগল গাঢ় করে আঁকড়ে ধরলো মাহতিম। পিপাসিত মাটি যেমন বহুদিন-বহুকাল পর পানির সন্ঞ্চার পেয়ে সবটুকু পানিই শুষে নেয়, সেই আদুরে ঠোঁটদুটোয় তেমনিভাবে নিজের উন্মত্ততা প্রকাশ করছিলো সে। মেহনূর অনবরত বুক ফুলিয়ে নিশ্বাস নিতেই হাতদুটো কলার থেকে সরিয়ে মাহতিমের ভেজা গলা ছুঁয়ে-ছুঁয়ে ডানগালে রাখলো, অপর হাতটা বাঁ-গাল ছুঁয়ে-ছুঁয়ে ভেজা চুলের ভেতর ঢুকিয়ে দিলো। হঠাৎ মেহনূর চমকে গিয়ে চোখ খুলে তাকালো, নিজের উন্মুক্ত পিঠটায় তরল কিছুর আভাস পেয়ে তৎক্ষণাৎ চুল থেকে হাত নামিয়ে ফেললো। হাতটা নিজের পিঠের দিকে উলটে নিয়ে সেখানে তরল স্পর্শ করলো, সারা শরীর অদ্ভুত ভয়ে কাটা দিয়ে উঠলো মেহনূরের। স্বাভাবিক হাতটা আচমকা কাঁপতে-কাঁপতে নিজের চোখের সামনে আনতেই বুঝলো, ওটা রক্ত! কাঁপা হাত থেকে চোখ সরিয়ে মাহতিমের দিকে তাকালো মেহনূর। ব্যান্ডেজ গলে রক্ত বেরুচ্ছে, রক্তে মেহনূরের পিঠ লেপ্টে যাচ্ছে, এই মানুষটা কি কাটাছেঁড়ার ব্যথা অনুভব করেনা? নির্বিকারে চোখের পল্লবজোড়া বন্ধ করলো মেহনূর। তার বন্ধ চোখজোড়ার দুইকোল ঘেঁষে অশ্রু গড়িয়ে পরলো নিশব্দে-নির্লিপ্তে-নিমিষে।

চলমান .

#FABIYAH_MOMO