মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব-৪৪+৪৫

0
968

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৪৪.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

অনুরাগের সময়টুকু সাঙ্গ করে কোমল উষ্ণজোড়া মুক্ত করলো মাহতিম। চোখ খুলে ওই মুখখানিটা ড্রিম লাইটের মৃদ্যু আলোয় দেখার চেষ্টা করলো। আরো কাছ থেকে নিবিড় চাহনিতে মায়াবিদ্ধ হওয়ার জন্য ঘাড়ের নিচে থাকা হাতটা উর্ধ্বমুখী করলো। মুখটার বন্ধ চোখের দৃষ্টিতে দৃষ্টি রাখলো মাহতিম। এবার যেনো চোখ সয়ানো চাহনিতে আবিষ্কার করলো, তার পাজকোলে আবদ্ধ থাকা প্রিয় মুখটার বন্ধ চোখদুটো থেকে নির্মল ধারায় অশ্রু ঝরছে, তার গালের উজ্জল চামড়াটা এমনই রাঙ্গা হয়ে ছিলো যে, প্রকৃতির সদ্য ফোঁটা লাল গোলাপের রসগুলো যেনো গালের চামড়ায় মাখিয়ে দিয়েছে কেউ। মৃদ্যু ভঙ্গিতে হাসলো মাহতিম, রুমের লাইটটা না জ্বালিয়ে আবারও ধীরপায়ে হাঁটতে শুরু করলো। কানের রহস্যময় ছিদ্রপথে বৃষ্টির মুষলধারার শব্দ আসছে, মাটিগুলো ভিজে শ্যাওলার চাপা গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে, সেই সাথে গন্ধে মিলেমিশে আছে কিছু নাম-না-জানা ফুলের প্রাণচাঞ্চল্যকর মধুর সুভাষ। মাহতিম ওই আরক্ত মুখের দিকে দৃষ্টি ফেলে তার হাতদুটো নিচে নামিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলো। মেহনূরকে সোফায় বসিয়ে তার সামনেই ফ্লোরে হাঁটুগেড়ে বসলো মাহতিম, পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে মেহনূরের দিকে তাকালো সে। বৃষ্টির স্বচ্ছ শীতল ধারায় সিক্ত হয়ে গায়ের ধবল রঙটা রক্তিম হয়ে উঠেছে মেহনূরের, মুখটা অদ্ভুত আবেশে অনুপম ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে আছে। মেহনূরের শান্ত চাহনিটুকুর সবটুকুই মাহতিমের হাসিমাখা চাহনির দিকে নিবদ্ধ, ঠান্ডা ভাবটা এখনো দেহের অঙ্গে-অঙ্গে শিউরে দিচ্ছে তার, দাঁত কপাটির ভাবটা এখন কম। মাহতিম নিজের ঘোর দৃষ্টিটা সংযত করে রুমের লাইট জ্বালিয়ে লাগেজের দিকে চলে গেলো, সেখান থেকে শার্ট বাছাই করতেই স্বাভাবিক গলায় বললো,

– তোমার গায়ে একটাও হবে না জানি। কিন্তু তোমাকে আজ রাতটুকুর জন্য পরতে হবে। সকালের ভেতর তোমার ভেজা কাপড়গুলোর ব্যবস্থা করে ফেলবো। তুমি কি একটু এ্যাডজাস্ট করতে পারবে? না ভেজা কাপড়েই থাকবে?

একটু আগের ওমন লজ্জা জনিত অবস্থায় পরার জন্য মেহনূর কোনো উত্তর দিবেনা তা ভেবেছিলো মাহতিম। তাই উত্তরের আশা ছেড়ে দিয়ে নিজের জন্য পোশাক নির্বাচনে উদ্যত হলো সে। বৃষ্টিমুখর বর্ষায় মৌনব্রত রুমটায় ছেদন করলো ঠান্ডা একফালি ইতস্তত সুর,

– আপনার, আপনার নেভি রঙের শার্টটা চাই।

চমকে উঠে দুই চোখ বড়-বড় করে তৎক্ষণাৎ ডানে তাকালো মাহতিম। চরম আশ্চর্য নিয়ে মেহনূরের দিকে তাকালে সাথে-সাথে দৃষ্টি নামাতে বাধ্য হলো মেহনূর। মাহতিম কোনো প্রশ্ন ছুঁড়ে আর বিব্রত পরিস্থিতি সৃষ্টি করলো না তখন। ধীরে-ধীরে মেহনূরের সহজ হওয়ার লক্ষণটা দেখে মন হালকা হলো, সে চুপচাপ মেহনূরের উদ্দেশ্যে তোয়ালে ও একসেট পোশাক বিছানায় রেখে নিজেও পোশাক বদলাতে ওয়াশরুমে চলে গেলো। দরজা লাগানোর আগে স্বাভাবিক গলায় বললো,

– তোমার চেন্ঞ্জ করা হলে দরজায় নক দিও।

মেহনূরকে একান্ত অবস্থায় পেয়েও ভেতরের ঝড়টা দামাল সামলালো মাহতিম। উজবুক মেহনূর এবার ঠিকই মাহতিমের ‘ পালাই পালাই ‘ অবস্থাটা বুঝে আপন মনে হেসে ফেললো। সোফা থেকে উঠে চটপট কাপড় ছেড়ে গায়ে শুকনো পোশাক জড়ালো মেহনূর, আয়নার সামনে যেতে-যেতে ভেজা বেণীটা আঙ্গুলে-আঙ্গুলে উন্মুক্ত করে ফেললো। ডানহাতের আঙ্গুলগুলো মাথায় চিড়ুনির মতো ঢুকিয়ে দিতেই আয়নায় নিজের ঢিলেঢালা পোশাকের প্রতিচ্ছবিটা দেখে থমকে গেলো। একমূহুর্ত যেনো নিরব রইলো মেহনূরের দৃষ্টি-নিশ্বাস-দেহ। এরপরেই খিলখিল করে জড়তাহীন মুখটা যেনো বহুদিন পর হেসে উঠলো, আয়নার সামনে হাতদুটো ‘ কাকতাড়ুয়া ‘ স্টাইলে দুপাশে উঠালো মেহনূর, তার চিকন দেহ থেকে নেভি কালারের শার্টটা কতো ঢিলা তা দেখে হাসিতে ফেটে পরলো। পড়নের ট্রাউজারের মাপ দেখে মনে হচ্ছে, যেনো পেটমোটা মোমের ভেতর একরত্নি সরু সুতার পলতে। খুব কষ্টে ট্রাউজারের ফিতা বেঁধে কোমরের সাথে জড়িয়েছে মেহনূর, এতো ঢিলা-ঢিলা পোশাকে আসলেই অদ্ভুত লাগছে এখন। চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে পা টিপে-টিপে ওয়াশরুমের দরজায় আস্তে করে টুকটুক করলো, সেখান থেকে চুপটি করে সরে এসে লাগেজটা গুছিয়ে দিতে ফ্লোরে বসলো। ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ হলে কি ভেবে যে সেদিকে তাকালো, হাতের কবল থেকে ভাঁজকৃত শার্টটা অসহায়ের মতো লাগেজে ফসকে গেলো। ফ্লোর থেকে ধীরগতিতে উঠে দাঁড়াতেই অতি অসহন ভঙ্গিতে ঢোক গিললো মেহনূর, তার সামনে থাকা মানুষটা তরতাজা রক্তের খন্দ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে এখন। ভেজা শার্টটা ওয়াশরুম থেকে ধুয়ে আনলেও রক্তের দাগগুলো এখনো ছোপ-ছোপ করে সাদা কাপড়ে দৃশ্যমান হয়ে আছে। বাঁ বাহুটার জন্য ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শার্ট বা গেন্ঞ্জি পরতে পারেনি মাহতিম, কালো ট্রাউজারটা পরেই বেরিয়ে পরেছে এখন। মাথাটা তোয়ালে দিয়ে ঘষতে-ঘষতে সোজা আয়নার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। বাহুর উপর সাদা ড্রেসিংটা রক্তে ধুয়ে-ধুয়ে লাল-রক্তিম হয়ে উঠেছে, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ফোনটা প্লাস্টিক ব্যাগ থেকে বের করে সৌভিককে কল করলো। কলটা লাউডে রেখে ভেজা চুল মুছতে-মুছতে ওপাশ থেকে কলটা রিসিভ হলো,

– হ্যাঁ, সৌভিক? মা ঠিক আছে? ঔষুধ দিয়েছিস?

প্রশ্নটা শুনে উত্তরের আশায় উৎসুক চোখে তাকালো মেহনূর। ওমনেই দেরি না করে আশ্বস্ত গলায় বললো সৌভিক,

– দোস্ত এখানে সব কন্ট্রোলে আছে। রজনী মামীকে যদি ঠিক সময় না ধরতে পারতাম তখন যে কি হতো! উহ্, ভাবতেই বুকটা শুকিয়ে আসে। মারজা আন্টিকে ঔষুধ খাইয়ে ঘুমাতে পাঠালাম। আমরা সবাই সামিকের বন্ধুর বাসায় উঠেছি। তুই আমাদের নিয়ে টেনশন করিস না। তোদের খবর বল, তুই কি রেসোর্টে উঠছিস?

তোয়ালেতে মুখ মুছতে-মুছতে জবাব দিলো মাহতিম,
– দশমিনিট হলো চেকিং দিয়ে রুমে আসলাম। বাইরে যে কি বৃষ্টি! ড্রাইভ করতে গিয়ে মেজাজটাই বিগড়ে গেছে।

কলের ওপাশ থেকে হাসির আওয়াজ শোনা গেলো, সেই হাসিতে আরো কথা সারছিলো দুই বন্ধু। পেছন থেকে নির্বিকার চাহনিতে চেয়ে থেকে লাগেজটা ঠিকমতো বন্ধ করে রাখলো মেহনূর। মাহতিমের ভেজা শার্টটা পানি চিপড়ে চেয়ারের উপর রাখা ছিলো, সেটাকে হাতে তুলে রক্তের দাগগুলো দেখলো মেহনূর। ওই লন এরিয়া থেকে রুম পযর্ন্ত দূরত্বটা চাট্টিখানি ব্যাপার না, তার উপর এই লোক সমস্ত রাস্তা এই ক্ষেপাটে বৃষ্টির মধ্যে নিজেই ড্রাইভ করে এসেছে। সুখকর অনুভূতিটা স্বল্প সময়ের জন্য স্থায়ী ছিলো। তবুও স্বল্প সময়টুকু তার মনের অলিন্দ স্থানে বুঝিয়ে দিচ্ছিলো, এই মাহতিম আনসারী পুরুষটা ব্যতিত অন্য কোনো পুরুষ স্বস্তির-শান্তির-নির্ভয়ের জায়গাটুকু কোনোদিন দিতে পারবেনা। শার্টটা নিয়ে চেয়ারের উপর টানটান করে মেলে দিলো মেহনূর। কথা বলা শেষ হতেই পিছু ঘুরলো মাহতিম, ওমনেই ক্ষণিকের জন্য চোখাচোখি হয়ে গেলো দুজনের। মেহনূরের রাশি-রাশি লম্বা চুল থেকে বেশ পানি ঝরছে, মাথাটা ঠিক করে মুছেনি দেখে একটু রাগ লাগলো মাহতিমের। তোয়ালেটা কি সাজিয়ে রাখার জন্য দিয়েছিলো? রাগটা দাঁতে চেপে ভেতরে দমিয়ে মেহনূরের দুবাহু ধরে বিছানায় বসালো মাহতিম, তোয়ালেটা নিয়ে তার ঠিক মুখোমুখি হয়ে ফ্লোরে হাঁটু ভেঙ্গে বসতেই বললো,
– আজ যদি তোমার কঠিন ঠান্ডা লাগে তাহলে আমার চেয়ে জঘন্য কেউ হবেনা মেহনূর। তুমি প্রচুর অবাধ্যতা করছো, আমি এসব মোটেও সহ্য করতে পারিনা।

কন্ঠের তেজ দেখে ঘাবড়ে গেলো মেহনূর। আজ তো নির্ঘাত জ্বর-ঠান্ডা-নিউমোনিয়া যা আছে, সব বেঁধে যাবে। কারণ, শীতের এমন করুণ মৌসুমে বরফের মতো বৃষ্টি তাকে গোগ্রাসে ছুঁয়ে ফেলেছে, নিউমোনিয়ার অসুখ থেকে একচুল নিস্তার পাওয়ার জো নেই। ইতিমধ্যে চুলের উপর মাহতিমের বলশালী হাতদুটোর কসরত চলছে যেনো, তোয়ালে দিয়ে চুলের শেষ পানিটুকু হরণ করার তীব্র চিন্তা। মেহনূর বিপাকে ফাঁসলেও আধো-আধো চাহনিতে হাসির ছলে বলে ফেললো,

– আমি কঠিন ঠান্ডায় যদি দম আঁটকে ম-রে যাই? তাহলে কি আপনি খুশী হবেন?

বেখাপ্পা প্রশ্ন দুটো ঠাট্টা করে বলেছিলো মেহনূর, এই ঠাট্টাটা কারো বুকের মধ্যে সাহসের দূর্গম প্রাচীরটা কেমন ভিত্তিসহ নাড়িয়ে দিবে সেটা চোখে দেখা যায়নি তখন। আগ্নেয়গিরির ভয়াবহ উদগীরণের ভয়ে মেহনূর দিশেহারা হয়ে পরলে মাহতিম বুকের ধাক্কাটা সামলে নিয়ে ফের মাথা মুছতে থাকে। শান্ত ও সংযত গলায় যোগ্য জবাবদুটো ছুঁড়ে বলে,
– আমার সাথে যতখুশী ফাজলামি করো, আপত্তি নেই। শুধু এসব ব্যাপারগুলো এড়িয়ে বলার চেষ্টা করবে। আমি এমন কথাবার্তা পছন্দ করি না।

নিরব হুমকির বার্তা শুনে তটস্থ চোখে তাকালো মেহনূর, অনুতপ্ত সুরে গলা নামিয়ে বললো,
– বুঝতে পারিনি। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে।

কথাটায় সায় দিয়ে চুল মোছা শেষ করে বললো মাহতিম,
– এবারের জন্য মাফ। পরবর্তীতে এমন ভুল করলে ক্ষমা থাকবেনা। কথাটা মনে থাকে যেনো।

মাথাটা উপর-নিচ নাড়িয়ে সম্মতির ইঙ্গিতটা বুঝালো মেহনূর। বসা থেকে কেবল উঠে দাঁড়াতে নিচ্ছিলো মাহতিম, এদিকে ব্যান্ডেজ পালটানোর তাগাদা কিভাবে দিবে সেটা নিয়ে উশখুশ করতেই হঠাৎ গলাটা মিহি করে সাবধানী কন্ঠে বললো,

– আপনার ব্যান্ডেজটা একটু দেখতে পারি?

.

অস্থিরতার জন্য নিশ্বাসটা কোনোভাবেই স্বাভাবিক হচ্ছেনা। বারবার এপাশ-ওপাশ করেও ঘুমের লেশমাত্র ছোঁয়া নেই। বুকের ভেতর অদ্ভুত-উদ্ভট ভয় এসে দলা পাকিয়ে মনটাকে খেয়ে দিচ্ছে। দুঃস্বপ্নের ভেতর রাতগুলো পার করলেও আজ যেনো ভয়ের কারনে ঘুম নেই। মাহতিমকে তিনি বাড়ি ফেরার জন্য অনুরোধ করেছেন, স্পষ্ট করে বলেছেন তার মন কোনো অজানা ব্যাপার নিয়ে ভয় পাচ্ছে। শরীর-মন যেভাবে ছটফট করে শুরু করেছে তাতে স্বস্তিতে বুকে নিশ্বাসও নিতে পারছেন না। সত্যি-সত্যিই খারাপ কিছু হবে। মায়ের মন বিপদের গন্ধ যেনো দশ গজ আগে থেকে টের পায়, ধরতে পায় তার আশেপাশে অনিষ্ট কিছু হবে। এখনো মন যেনো চিৎকার করে বলছে, ‘ জঘন্য কিছু হবে, জঘন্য কিছু হবে। পালা। ‘ মারজা ভয়ে আবার শোয়া থেকে উঠে ঢকঢক করে দু’গ্লাস পানি খেলেন। কম্বল ফেলে, বালিশ উলটে তাড়াতাড়ি হাতের ফোনটা নিয়ে মাহতিমকে কল করলেন। এখান থেকে তিনি সন্তানদের নিয়ে নিরাপদে ফিরতে চান, বাড়িটাই উনার আসল জায়গা, ভরসার জায়গা। বাড়ি থেকে বেরুলেই বিপদ! কলটা নেটওয়ার্কের জন্য কেটে গেলো, মাহতিমের কাছে পৌঁছলো না। তিনি ফোন ফেলে পাগলের মতো রুমে পায়চারি শুরু করলেন, পায়ের গিঁটগুলো অবশ হয়ে এলেও পায়চারী থামালেন না। থাই জানালার বাইরে গুমোট আকাশের বর্ষণ দেখে ভীত মুখটা সেদিকে তাক করলেন, থুতনিটা মৃদ্যু-মৃদ্যু কাঁপতেই চোখ ফেটে অশ্রু বেরিয়ে এলো, তিনি বিড়বিড় করে আকাশের দিকে ব্যর্থ অন্তরের ব্যকুল ভারে বলতে লাগলেন,

– আমি আর সহ্য করতে পারি না গো মাবুদ। এ কি যন্ত্রণায় পরেছি! কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবেনা, কেউ বুঝবে না আমি কেমন চিন্তায় ম-রে যাচ্ছি। এই প্রথম বাড়ি থেকে বের হয়ে স্বস্তি পাচ্ছি না, কি ভয়াবহ বিপদের ঠাহর হচ্ছে সেটা যদি কাউকে বলতে পারতাম।

ফিরোজা রঙের সাদা পেড়ে ওড়নায় চোখ মুছলেন মারজা। ফোনটা নিয়ে আবার তিনি মাহতিমের ফোনে কল দিলেন। ইচ্ছা ছিলো মেহনূরের সাথে কথা বলে মন হালকা করবেন, তার বিশ্বাস মেহনূর তার কথা হাওয়ায় উড়াবে না, শুনবে। একে-একে নিরর্থক কলগুলো দিলেন ঠিকই, কিন্তু নক্ষত্রবাড়ি রেসোর্টের সীমানায় সেগুলোর একটাও পৌঁছালো না।

.
বৈরি আবহাওয়ার সোল্লাস ধ্বনিটা শাঁ শাঁ করে শোনা যাচ্ছে। প্রবল বৃষ্টির ঝড়ো হাওয়া যেনো উদ্যমী হয়ে লম্বা-লম্বা গাছগুলোকে মাটিতে ঝুঁকাতে চাচ্ছে। এতোক্ষণ কেবল বৃষ্টির উত্তালটা বহাল ছিলো, এখন এর সঙ্গে দ্বিগুণ উৎসাহে যুক্ত হয়েছে ঝড়ো হাওয়াটা। মাহতিম চরম আশ্চর্য হয়ে মেহনূরের কথা মতোই বিছানায় উঠে বসলো, মুখোমুখি হয়ে বসতেই কোনোপ্রকার জড়তা ছাড়া মাহতিমের বাঁ হাতটা ধরলো মেহনূর, ফোলা পেশির শক্ত হাতটা ধরতেই নিশ্বাস ভারী হয়ে এলো। নিশ্বাসের অদম্য অবস্থাকে প্রকাশ না করে ভেজা গিঁটটা খুলে প্যাঁচানো কাপড় সরিয়ে আনলো মেহনূর , ক্ষতটা একপর্যায়ে দুচোখের সামনে উন্মুক্ত হলে তৎক্ষণাৎ চোখ খিঁচ মেরে আবার ধীরগতিতে চোখ খুললো। মাহতিম সবই চুপচাপ ভঙ্গিতে দেখে যাচ্ছিলো, ঠোঁটে সহজাত শান্ত হাসি ঝুলছে তার। রক্ত মাখা ভেজা তুলাগুলো তুলতে-তুলতেই বিহ্বল কন্ঠে বললো মেহনূর,
– খুব ব্যথা করছে?

মাহতিম মৃদ্যু হাসি দিয়ে মেহনূরকে একটু খোঁচা মেরে বললো,
– করলেও তো তোমার এতে যায় আসে না।

হাত থামতে গেলেও থামালো না মেহনূর, কিছু না শোনার ভঙ্গিতে কাজ সারতেই কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো,
– যদি বলি যায় আসে?

চোখে বিষ্ময় ফুটিয়ে অবাক হলো মাহতিম, তৎক্ষণাৎ তর্জনী দিয়ে মেহনূরের থুতনি উঁচিয়ে ফেললো, সরল দৃষ্টির মাঝে তার অস্থির চাহনিটুকু মিলিয়ে দিয়ে চন্ঞ্চল সুরে বললো,
– কিসে যায় আসে তোমার? কিচ্ছুতে যায় আসে না! আমার শরীরের কাঁ’টাছেড়া দেখে কাঁদো-কাঁদো মুখে তাকাও, অথচ জায়গামতো ছুঁ’ড়ি তো তুমিই ঢুকিয়েছো।

থুতনিটা তাচ্ছিল্যের সাথে সরিয়ে দিয়ে কম্বল টেনে শুলো মাহতিম। বিছানার ডানদিকে ওপাশ ফিরে চোখ বন্ধ করে মেহনূরকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করলো। সমস্ত আয়োজন, সমস্ত চিন্তাভাবনা, সমস্ত জল্পনা নসাৎ করে দিলো ওর। হাতের মুঠোয় ভেজা ব্যান্ডেজের তুলোর দিকে দৃষ্টি দিলো মেহনূর, আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে মাহতিমের দিকে তাকালো। আজ এতোটাই অবজ্ঞার দুয়ারে ঠেলে দিলো যে, মাহতিম ওর দিকে পিঠ দিয়ে শুয়েছে। মেহনূর মুঠোভর্তি তুলাগুলো রুমের বিনে ফেলে লাইট নিভিয়ে বিছানায় ফিরলো। কম্বলটা গায়ে টানতেই মাহতিমের পিঠের দিকে মুখ করে শুলো। হাতটা একটু উর্ধ্ধে উঁচিয়ে জানালার একটা দ্বার কিন্ঞ্চিত ঠেলে দিলো, চাপ পেয়ে জানালাটা ক্যাচ করে খানিকটা খুলে গিয়ে সরু একফালি আলো ঢুকলো। আলোটা দুজনের মধ্যবর্তী দূরত্বের উপর তেরছা হয়ে পরেছে, ফাঁকা পেয়ে প্রকৃতির উদ্দাম হাওয়াও শান বাজিয়ে ঢুকছে। মেহনূর বালিশে গাল রেখে গালের নিচে বাঁহাতের তালু রেখে সুঠাম পিঠটার দিকে তাকালো, বিছানা ছুঁয়ে-ছুঁয়ে ডানহাতটা বাড়িয়ে দিতেই আবার পূর্বের জায়গায় ফিরিয়ে আনলো। সাহস হচ্ছে না বুকে, যদি মাহতিম ক্ষেপে উঠে? চোখ বন্ধ করে ডানহাতটা মুষ্টি করলো মেহনূর, ঘুমের জন্য বৃথা চেষ্টা সেরে ফের ডানহাতটা বাড়িয়ে দিলো। একবুক ভয়, একটু আশা, খানিকটা অনুশোচনা নিয়ে বিছানা থেকে শূন্য উঠিয়ে পিঠের উপর হাত রাখলো মেহনূর। আজ একটুও অস্বাভাবিক ভাবে হৃদকম্পন হচ্ছে না, দূর্বল লাগছেনা, কুণ্ঠা হচ্ছেনা, মেহনূর অদ্ভুত ভালো লাগায় পিঠ ছুঁয়ে হাতটা কাধে রাখলো। কম্বলটা সাথে-সাথে নড়েচড়ে উঠতেই অভিযোগী মুখটা কাধের কাছে এনে অপ্রসন্ন গলায় বললো,
– কি চাই?

মেহনূর ফিসফিস সুরে হাসি আঁটকাতে যেয়ে হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠলো। এদিকে হাসির দশা দেখে মাহতিমের রাগ যেনো আরো তুঙ্গে! কাধ থেকে মেহনূরের হাতটা ঝটকা মেরে ওর দিকে ফিরলো সে, ভ্রুঁ কুঁচকে রাগ দেখিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বললো,
– পাগলের মতো হাসছো কেনো? কি চাই তোমার?

হাসিটা কোনোরকমে চেপে দুই বালিশের দূরত্বটুকু খতম করলো মেহনূর। নিজের বালিশটা বেখেয়ালে রেখে মাহতিমের দিকে এগুতেই বললো,
– ঘুমাতে চাই।

কথা শুনে ছোট-ছোট চোখে বাঁ ভ্রুটা উপরে তুললো মাহতিম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ক্ষীণ মেজাজে বললো,
– ওপাশ ফিরো,

‘ ওপাশ ফিরো ‘ মানেই তুমি ওপাশ ফিরে শোও, আমি আমার শক্ত-সৌম্য-সুগঠিত বুকটা দিয়ে তোমার সুকোমল দেহটা আগলে দিচ্ছি। তোমার দেহের ভেতর আমার উষ্ণতার সাহস, আমার শক্ত চেতনার দৃঢ়তা, আমার জীবিত নিশ্বাস ছেড়ে দফায়-দফায় কাছে থাকার মূলক বুঝাচ্ছি। মেহনূর অম্লানবদনে হাসি উৎসর্গ করে ওপাশ না ফিরে ওই বুকটার কাছে মুখ লুকিয়ে নিলো। প্রশ্নাত্মক চোখদুটো পরম উষ্ণতার নিবেদন পেয়ে তৎক্ষণাৎ বন্ধ হলো, দুপাটি দাঁতের করাত থেকে শান্তির দমটা সশব্দে বেড়িয়ে এলো। এই প্রথম মাহতিম আনসারীর নির্দেশটা কেউ অমান্য করলো, কেউ তার হৃদ দূর্গের বক্ষস্থলটা আত্মসাৎ করে সেখানে ছড়িয়ে দিলো আনন্দের সুখ। ঝুমঝুম বৃষ্টির হিংস্রতায় শীতল হওয়া বুকটার ভেতর থেকে উত্তর এলো,

– আপনি আমার উপর যতখুশী রাগ করুন, আপত্তি নেই। শুধু এসব ব্যাপারগুলো এড়িয়ে চলবেন। আমি এমন দূরত্ব পছন্দ করি না।

মুখটা আশ্চর্যে হা হতেই হোহো করে হেসে উঠলো মাহতিম। বাহুজোড়ায় আষ্টেপৃষ্টে ধরে হাসতে-হাসতে বললো,

– কি কাণ্ড! আমার ডায়লগ আমার উপরেই ছুঁড়ে দিলে?

চলমান .

#FABIYAH_MOMO .

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৪৫.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

অংশ – ০১.

বজ্রপাতের নোঙ্গর যেনো কাঁপিয়ে তুলছে ভূমি! একের-পর-এক বজ্রধ্বনি বুকের ভেতর শেঁল বিঁধিয়ে দিচ্ছে! মেঘে-মেঘে ছুটছে বজ্রপাতের স্ফুলিঙ্গ, প্রকৃতি যেনো ক্রুদ্ধ হয়ে বিকট চিৎকারে ফেটে পরেছে, এমনই একটি কালো অন্ধকারে ঢাকা পরেছে সময়ের সন্ধিক্ষণ। ঘড়িতে ভোর ছয়টা বাজতে পাঁচটা মিনিট বাকি আছে, কিন্তু বাইরে নেই এক চিলতে আলো। আলোহীন প্রকৃতিটা কেমন বীভৎস-ভয়াবহ-গা কাঁপানো লাগছে, তা জানালার সরু ফাঁকটা দিয়ে দেখছে মেহনূর। ঘুমটা বজ্রপাতের প্রথম দুটো বাজের সময় ভেঙ্গে যায়, পাতলা হওয়া ঘুমটা আর চোখের কোটের আসেনি। বাবার বাড়িতে থাকলে ঘুমের ভেতরেই এক চিৎকার দিয়ে উঠে পরতো মেহনূর, কিন্তু আজ সেটা মাহতিমের উষ্ণ বুক পেয়ে হলো না। গুটিশুটি পাকিয়ে কচ্ছপের শক্ত খোলসের মতো উন্মুক্ত বুকটার মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলো তখন। মনের অস্থিরতা একটু স্বাভাবিক হলে হাতজোড়া আলগা করে মুখটা উপরে তুললো মেহনূর। না, মানুষটা এখনো ঘুমে মগ্ন। তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ ঠোঁট প্রসার করে মুচকি হাসলো মেহনূর, ঘুমন্ত মুখটাকে আরো কাছ থেকে, আরো নিবিড়ভাবে দেখার জন্য বালিশে মাথা উঠিয়ে রাখলো। মাহতিমের ব্যান্ডেজ খোলা হাতটা আস্তে করে টেনে এনে নিজের গায়ে রাখলো মেহনূর, কম্বলটা টেনে দিয়ে মাহতিমের পিঠের দিকটা ঢেকে দিলো। ক্লিন শেভের পরিষ্কার গালটায় দাড়ি নেই, প্রতিদিন ক্লিন শেভ করাটা তার প্রোফেশনাল কর্মের বৈশিষ্ট্য। ভোরবেলায় উঠাটা তার নিত্যদিনের শ্যাডিউল, আজই একটু চোখ বুজে শান্তির তন্দ্রায় ডুবে আছে। সেই পরিষ্কার গালটার প্রতি ক্ষুদ্র লোভ কাজ করলো মেহনূরের, এই বৃষ্টিমুখর নিরিবিলি মূহুর্তে লোভটা যেনো দেহ-মনে চন্ঞ্চলতা বাড়িয়ে দিলো। মাহতিমের তন্দ্রাচ্ছন্নের সুযোগ নিয়ে একটুখানি ছুঁয়ে দেওয়ার বাসনায় ডানহাতের আঙ্গুলগুলো অগ্রসর করলো মেহনূর, ঈষৎ কাঁপা-কাঁপা আঙ্গুলগুলো গালের পরিখায় রাখতেই পায়ের নখ-থেকে-মাথার চুল পযর্ন্ত শিউরে উঠলো তার। চোখ বন্ধ করে অন্তঃস্থলের অস্বাভাবিকতা প্রশমন করতে গিয়ে ছোট্ট ঢোক গিললো।

– আমার ঘুম কিন্তু তোমার চেয়েও পাতলা মেহনূর।

চকিত ভঙ্গিতে চোখ খুলে লজ্জায় হাত সরাতে নিলো মেহনূর, গাল থেকে যখনই হাত উঠাতে নিলো তখনই মাহতিমের বলযুক্ত হাতের কঠিন থাবা এসে মেহনূরের হাতটা আগের জায়গায় চেপে রাখলো। এবার তন্দ্রাচ্ছন্ন অভিনয় ছেড়ে স্বাভাবিক এবং ঘুমহীন চোখে তাকালো মাহতিম, সরাসরি মেহনূরের দৃষ্টিতে-দৃষ্টি তাক করে বললো,
– তোমার সামনে এ্যালিট ইউনিটের মানুষ শুয়ে আছে। স্পেশাল ওয়ারফেয়ার ডাইভিং এ্যান্ড স্যালভেজ। তুমি আমার গায়ে হাত রাখবে আর আমি টের পাবো না?

অবাক হয়ে ঢোক গিললো মেহনূর, বিষ্মিত চাহনিটা স্থির রেখে ভয়ার্ত সুরে বললো,
– জ্বী।

মাহতিম চোখাচোখি দৃষ্টিটা অটল রাখা অবস্থায় মেহনূরের হাতটা এনে ঠোঁটের উপর রাখলো। হাতটায় গাঢ় করে ঠোঁটযুগলের অদৃশ্য সীলমোহর ছাপিয়ে দিতেই ধীরাজ কন্ঠে বললো,
– তুমি কি আমাকে এখন পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারো? আমাকে নিয়ে কোনো সন্দেহ বা শঙ্কা উঁকিঝুঁকি করে?

কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাহতিমের হাতের বলয় থেকে ইচ্ছে করে হাত সরালো মেহনূর, মাহতিম অপ্রতিভ দৃষ্টিতে চোখ করতেই মেহনূর পুনরায় মাহতিমের গাল স্পর্শ করলো। চোখ দৃষ্টি অকুণ্ঠ রেখে মুখটা এগিয়ে নিলো। বুকের অকুল চিন্তার নিশ্বাসটা শব্দ করে ছাড়তেই মলিন হাসিতে বলতে লাগলো,

– আপনি কি জানেন, আমি যে নিজেকে পছন্দ করিনা? আমার স্বভাব-চরিত্র নিয়ে এতো গালমন্দ শুনেছি যে এখন নিজের প্রতি এখন ধিক্কার আসে। কেউ যদি বলে ‘ তুমি এটা পারবেনা ‘, তখন আমিও মনে-মনে বিশ্বাস করে ফেলি ‘ আমি সত্যিই ওটা পারবো না ‘। কোনোদিন কারো কথার খেলাফ করিনি, প্রতিবাদ করা আমার ভালো লাগে না। আপন মানুষদের কথায় কিসের প্রতিবাদ করবো বলুন? তাদের প্রতিবাদ করলে যে নিজের কপালেই দুঃখ জুটে! তবুও সত্য হলো আমার জীবনটায় আঠারোটা বছর হলেও আমার জীবনে আঠারোটা মানুষ নেই। আমি লেখাপড়া শেখা এক মূর্খ, যে কিনা গুছিয়ে কথা বলতে জানেনা। সবাই আমাকে নিয়ে নাক ছিটকায়, কারো-কারো কাছে আমি বিরক্তির মানুষ। জানেন, আমি চুপ থাকলেও সব বুঝি। কোনো মেয়ে যদি বাচাল হয় তাহলেও সমস্যা, কম কথা বললেও সমস্যা, স্বাভাবিক থাকলেও কোনো-না-কোনো সমস্যা তাকে ধরবেই। দিনশেষে একটা মেয়ের বিরুদ্ধে আরেকটা মেয়েই আঙ্গুল তুলে কথা বলে। পুরুষের চোখ যদি ছুঁচালো হয়, তাহলে মহিলাদের ঠোঁট ছুঁড়ির মতো ধারালো। হয়তো আমার ঠোঁট ধারালো নেই বলে আমি সকলের কাছে অযোগ্য। আর আপনি একটা অযোগ্যকেই বিয়ে করেছেন, আমার মতো কুচ্ছা শোনা মেয়ের প্রতি তো —

তীব্র ঝাঁকুনি খেয়ে কথা বন্ধ হয়ে গেলো কন্ঠটার! ভূকম্পনের মতো পুরো শরীর কেঁপে উঠতেই নিশ্বাস যেনো কুণ্ডলী পাকিয়ে গলায় বিঁধলো! একফোঁটা নিশ্বাসের জন্য দুহাতের মুঠোতে চাদরটা মোচড়ে এলো, গলা-মাথা-কপাল যেনো ঘেমে উঠার মতো অবস্থা! দম বন্ধ হওয়ার অসহন যন্ত্রনায় শিউরে উঠতেই হঠাৎ গম্ভীর গমগমে সুরটা চাপা ক্ষোভের সঙ্গে ছিটকে এলো,

– ঠিক এভাবেই দম বন্ধ করে মেরে ফেলবো। একদম নিশ্বাস নিতে দেবো না। ঠিক তেঁতাল্লিশ মিনিটের ভেতর তোমার নিশ্বাস ফুরিয়ে যাবে। তুমি আমার সামনে কোন্ স্পর্ধায় এ ধরনের কথা বলার সাহস দেখাও? তুমি কি আমাকে ভয় পাও না? আমার অবস্থা কি হবে ভেবেছো?

অস্থির অবস্থায় উত্তেজিত হয়েছিলো মেহনূর, মাহতিমের কথা শুনে সেই অবস্থা থেকে একদম পরিশ্রান্ত হয়ে গেলো। নিশ্বাসের জন্য আরেকবার মুখ উঁচাতেই প্রশিক্ষণ সম্পণ্ণ হাতের থাবাটা ঢিলা করলো মাহতিম। ছাড়া পেয়ে মুখ হা করতেই চোখ খিঁচুনি দিয়ে লম্বা নির্মল শ্বাস টানলো, ঢোক গিলে গলাটা ভিজিয়ে চোখ খুলে তাকালো মেহনূর। বিশাল দেহের শক্তপোক্ত শরীরটা এখন তার দেহের উপর ঝুঁকে আছে। তার তীক্ষ্ণদৃষ্টির প্রতি একটুও ভয় না পেয়ে চোখে-চোখ রেখে কিন্ঞ্চিৎ হাসি দিয়ে বললো,

– পেতাম। সেই ভয়টা আপনিই দূর করে দিয়েছেন। এর জন্য কেবল আপনি দায়ী।

মাহতিম এখনো গম্ভীর, মুখে ছোট্ট কথা অবধি নেই। একটু থেমে পুনরায় হেসে বললো মেহনূর,

– আপনি আমাকে কোনোদিন মারবেন না। যদি মেরেও ফেলেন তাতে আমার আফসোস — ,

মুখ থেকে কথা লোপাট করলো মাহতিম। তেজপূর্ণ কন্ঠে দৃঢ়তার সাথে বললো,

– আমার অবস্থাই বেহাল হয়ে যাবে। আমি থাকতে পারবো না।

গুড়ুম-গুড়ুম করে আকাশ ডেকে উঠলো, বৃষ্টির সাথে একঝাঁক দমকা হাওয়া ঢুকে পরলো নিরব রুমে। ঠান্ডার প্রখরতাকে জানান দিয়ে ফর্সা হতে লাগলো ঘুটঘুটে কালো আকাশটা। মাহতিম ভারী নিশ্বাস ছেড়ে মুখটা নিচে নামাতে লাগলো তখন, একটা হাত দিয়ে আদর করে ধরলো মেহনূরের গালের আস্তরণ। স্বেচ্ছায় আঁখিপল্লব বন্ধ করলো মেহনূর। নিজের উৎসুক হৃদয়কে সমুখে বাড়িয়ে দিয়ে স্বল্প সময়ের উষ্ণতার জন্য উন্মুখ হলো। কিছুক্ষণ পরেই দুচোখের পাতায় উন্মাদের মতো অধরকার্যের প্রগাঢ় চাপ অনুভব করলো মেহনূর।
.
বন্ধুর বাড়িতে উঠে দারুণ যন্ত্রনার শিকার হয়েছে সামিক। এখানে হুট করেই পানির মটরটা নষ্ট হয়ে সবাইকে কঠিন ভোগান্তিতে ফেলেছে। শহরে বিদ্যূৎ-পানি-গ্যাস তিনটির জন্য হাহাকার অবস্থা থাকে, গ্রামে এসব না থাকলেও বিকল্প এবং আদিযুগের ঐতিহ্য রীতিতে দিব্যি কেটে চলে। নাওয়া নেই সেই গতকাল থেকে, হাতমুখ ধোয়ার জন্য প্লাস্টিক বালতিতে বৃষ্টির জমা করা পানি দিয়ে কাজ চালিয়েছে। সবচেয়ে বেশি গোমড়া হয়ে আছে রজনী। একটু পরপর কঠিন গলায় সামিককে এসপার-ওসপার করে ধুয়ে দিচ্ছে, গলার তেজ শুনে দুঠোঁট চেপে হাসছে মাহদি। রজনী যেই চোখ পাকিয়ে তাকায় ওমনেই নাদান বাচ্চার মতো ‘ আমি ফিডার খাবো ‘ ভঙ্গিতে মারজার দিকে তাকায়। মারজার অস্থির বিপন্ন মন আরো বিপর্যস্ত হয়ে কঠিন ধমক লাগায়। মায়ের বকুনি খেয়ে এবার উদাস হয়ে যায় মাহদি। সবার বকাবকি ইচ্ছামতো শুনতে পারবে মাহদি, শুধু মা আর ভাইয়ের বকা শুনলে নেতিয়ে যায়। যেই বাসায় ওরা অতিথি হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে সেখানে খেলনা তো নেই, উলটো খেলার সঙ্গীও নেই। ফারিন যা একটু সঙ্গ দিতো, এখন সে দরজা আঁটকে প্রীতির সাথে চুটিয়ে ঘুম দিচ্ছে। ট্যূরের উছিলায় কেউ গেমসের খেলার জন্য মাহদিকে ফোন দিচ্ছে না, বারান্দায় গিয়ে গ্রিল ধরে বাইরে তাকালো মাহদি। থুতনিটা গ্রিলের উপর বসিয়ে ভাই আর ভাবীকে মিস করছিলো সে। তারা দুজন মানুষ যতোই তাকে বকা দিক, দিনশেষে কখনো তাকে একা ফেলে যায়নি। মাহতিম যতই ব্যস্ত ব্যক্তিসম্পন্ন কর্মকর্তা হোক, একবার বাড়ি ফিরলে সেই সব কষ্টের দিনগুলো একদম ভুলিয়ে দিয়ে যায়। মেহনূর কোনোদিন মাহদিকে না খাইয়ে নিজে খেয়েছে বলে এখনো মনে করতে পারে না মাহদি। মেহনূরকে যতখুশি তত ‘ বউ, বউ ‘ করে ডাকে, এতে একটুও বিরক্ত হয়না মেহনূর, উলটো হাসি দিয়ে পিঠ একটা আদুরে চাপড় মারে। হতাশার নিশ্বাস ফেলে ঘোলাটে আকাশে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো সে,

– তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো ভাইয়া। আমার কিছুতেই মন টিকছে না। জলদি আসো, জলদি আসো।

চোখ বন্ধ করে দু’মিনিট শান্ত থাকলো মাহদি। ঝমঝম বৃষ্টির আওয়াজটা নিরবে অনুভব করলো। ডান পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে ভেজা টাইলসের উপর আনমনে এঁকেবেঁকে চিত্র কষতে লাগলো। চোখ খুলে ডান পা দিয়ে একই কাজ করতে-করতে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে নিচে তাকালো মাহদি। হঠাৎ একটা দৃশ্য দেখে ডানপা থামিয়ে সেটা আরো মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো। দারোয়ানের বাথরুম থেকে টিনের দরজাটা একটু ফাঁক করে উঁকি দিয়ে আছে সিয়াম। মাথাটা উঁকি দেওয়ার পাশাপাশি ডানহাতে সবুজ বদনাও দেখা যাচ্ছে। চাল ধোয়া পানিটা যেনো বদনায় না পরুক তার জন্য হাতটা টান-টান করে বাইরে এগিয়ে ধরেছে। বৃষ্টির পানি দিয়ে বদনা ভর্তি? হোহো করে গলা ফাটিয়ে হেসে দিলো মাহদি। তার হাসি এখন দেখে কে! বাথরুমে গিয়েও বেচারা আধা কাজ শেষ করে বদনা ভর্তি করতে নেমেছে। মাহদি হাসতে-হাসতে গ্রিল ছুঁয়ে-ছুঁয়ে ফ্লোরে ধপাস করে বসে পরলো। হাসির তোড়ে ফ্লোর থাপড়াতে-থাপড়াতে হাসতে লাগলো। একটু শান্ত হলে পেট চেপে আবার উঠে দাঁড়ালো মাহদি, আবার একই দৃশ্য দেখতে হোহো করে হেসে গ্রিলে কপিল ঠেকিয়ে দিলো।

.
থেমে-থেমে বৃষ্টি হচ্ছে আজ। শীতে মুড়িয়ে আছে সাদামাটা দিনটা। কম্বলের পশমতুল্য উষ্ণতার ভেতর নতুন বউ নিয়ে ঘুমিয়ে আছে নোমান ইকবাল। এবার বসের অজুহাতে সেও কিছুদিন ছুটি পেয়েছে। বাড়ি ফিরতেই নানা টেনশনের ভেতর দিয়ে পরিবারের চাপাচাপিতে বিয়েটা করতে নারাজ ছিলো। শেষমেশ হামেশার মতো তার বসের কাছে পরামর্শ চাইলো নোমান। তার বিশ্বাস, তার বস মাহতিম আনসারীর কাছে সব ধরনের সমাধান পাওয়া যায়। লোকটার মাথায় যেনো উপস্থিত বুদ্ধির মেশিন ফিট করা আছে, যখনই কোনো বিপদ দেখে জাস্ট কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করতেই এমন একটা পরিকল্পনা করে যা বর্ণনাতীত! এবারও বসের পরামর্শ মোতাবেক বিয়েটা করেই ফেলেছে নোমান। রক্ষণশীল পরিবারের ছেলে বলে বড়সড় আয়োজন করে বিয়ে করেনি। কিন্তু এখন বিয়েটা করে মনেহচ্ছে, আহা স্বর্গীয় সুখ! তার বসকে এখন একশো-একটা চুমু দিতে ইচ্ছে করছে। লোকটা কি জম্পেশ বুদ্ধিই না দিলো! তার মানে তার বস মানুষটা যতোই শুকনো মুখে গম্ভীরভাবে চুপ থাকুক, দিনশেষে তারও অভিজ্ঞতা আছে। বউকে জড়িয়ে ধরে আরো আয়েশ করে ঘুম দিলো নোমান, হঠাৎ বিপ্ বিপ্ করে তার ফোনটা ভাইব্রেট হয়ে উঠলো। আরামের শয্যা ছেড়ে ফোন ধরতে অলসতা কাজ করছিলো, একটানা পাঁচটা ভাইব্রেট কল কেটে যেতেই ষষ্ঠ নাম্বারের সময় বউয়ের ঠ্যালা খেয়ে উঠলো নোমান। কলটা ঘুম-ঘুম চোখে না দেখে রিসিভ করলো, মুখভর্তি গালি থেকে একপ্রস্থ গালি ছুঁড়ে বললো,

– ওই হা-লা, কে রে তুই? এমন বে-টাইমে কল দিলি কোন্ কলিজা দিয়ে?

ওপাশ থেকে চিবিয়ে-চিবিয়ে বললো কেউ,

– তোমার কলিজা আমি পারা দিয়ে ধরবো নোমান। স্ক্রিনে চোখ লাগিয়ে দেখো কে আমি।

চোখ কচলাতে গিয়ে হাত থেমে গেলো নোমানের। কথা শুনে বুকের ভেতর ধুকুর-পুকুর করছে। বড় করে ঢোক গিলে কান থেকে ফোন নামালো নোমান। স্ক্রিনে তাকিয়ে ‘ M.A.B. ‘ স্পষ্ট করে অক্ষর তিনটা দেখতে পেলো। মাহতিম আনসারী বস! ভয়ে-ভয়ে কানে ফোন ঠেকিয়ে ভীত কন্ঠে বললো,

– হ্যা-হ্যালো বস,

ওপাশ থেকে ক্ষেপে গিয়ে বললো মাহতিম,

– বউ হয়েছে বলে আমার সাথে গালাগালি? এগুলো কেমন ধরনের আচরণ নোমান? তোমার কি এখন লম্বা বিরতি দরকার? প্রয়োজন হলে জানাও, আমিও সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

নোমান তাড়াতাড়ি নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করে মাফ চাইলো। ভুলটা তার নিজের বলে অনেকবার ক্ষমার বাক্য খরচ করলো। মাহতিম এখন ঘ্যানঘ্যাননি শোনার মানসিকতায় নেই বলে সংক্ষেপে তার জন্য একটা গাড়ি পাঠানোর কথা বললো। নোমান যথা আজ্ঞার মতো নির্দিষ্ট ঠিকানায় গাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করে জিপটার তদারকির জন্য নিজে রওনা দিলো। সূত্র মোতাবেক নক্ষত্রবাড়ি রেসোর্টে পৌঁছলো একটা গাড়ি, জিপটা কর্তৃপক্ষের কাছে রেখে নোমানের ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলো মাহতিম। আগত গাড়িটায় চড়ে বৃষ্টির মধ্যেই সামিকের বন্ধুর বাসার দিকে রওনা দিলো সে। মেহনূর জানালার কাঁচ নামিয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করছে, মুখের উপর বৃষ্টির ছাঁট খেয়ে থেমে-থেমে হাসছে। পলকে-পলকে নজর দিচ্ছে মাহতিমের বিচক্ষণ চোখ। এতোদিন পর ফ্যাকাশে বিষণ্ণ চেহারায় হাসির লালিমা ফুটেছে, হাসির উচ্ছলতায় প্রাণবন্ত সুমিষ্ট মুখটায় মায়া ছাপিয়ে দিয়েছে, ভেতরের গুমোট-শক্ত আবরণটা নিঃশেষ হয়ে গুছানো-নরম মনোচিত্তে ফিরিয়ে দিয়েছে। একদিকে যেমন মেহনূরের সাথে সম্পর্কটা সহজ করে এনেছে, তেমনি মেহনূরের অন্তর থেকে জানতে পেরেছে কঠিন সত্য। শোনার পর মাহতিম যেনো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো, পরের বাক্যগুলো কিচ্ছু শুনতে পায়নি সে। স্টিয়ারিং চেপে একপলকের জন্য বামে তাকালো মাহতিম, মুখটা ড্রাইভে ফিরিয়ে এনে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,

– মেহনূর, যদি তোমার দাদাভাই আমাকে বিয়ের ব্যাপারে ‘ না ‘ করে দিতো, তখন কি তুমি আমায় ফিরিয়ে দিতে?

এমন অদ্ভুত কথা শুনে ঠোঁট থেকে হাসি মিলিয়ে গেলো, জানালা থেকে মুখ ঘুরিয়ে ডানে তাকাতেই মাহতিমের দিকে তাকালো। হতভম্ব দৃষ্টিতে বললো,

– আপনি কেমন প্রশ্ন করলেন?

মাহতিম তাড়া দিয়ে বললো,

– উত্তরটা শুনতে তো দোষ নেই। তাছাড়া এখন তুমি আমার বউ। তোমার দাদা হাজারবার মাথা ঠুকলেও তো তোমাকে ফিরিয়ে দেবো না।

মেহনূর এমন অপ্রস্তুত প্রশ্ন শুনে অনেক সময় যাবৎ কথা বললো না। জানালার কাঁচটাও উঠিয়ে দিলো সে, ভেজা হাতটা আঁচলে মুছতে-মুছতে তার ঠোঁটের হাসিটুকুও যেনো ছিনিয়ে ফেললো কেউ। মেহনূর দীর্ঘক্ষণ যাবৎ মৌন পালন করে নির্লিপ্ত সুরে বললো,

– আপনাকে ফিরিয়ে দিতাম।

বিকট আওয়াজে চলন্ত গাড়িটা জোরালো ভাবে থেমে গেলো! হুট করে এরকম ব্রেক কষাতে পেছন থেকে অন্য একটা গাড়ি পাশ কেটে যেতে-যেতে ‘ খান* পোলা চোখ কি আকাশে তুইলা চালাস ‘ বলে জঘন্য একটা গালি দিলো। মাহতিম গালিটা শুনলো কিনা ঠাহর করা গেলো না, দু’হাত দিয়ে স্টিয়ারিংটা শক্ত করে ধরে আছে সে, চোখদুটো বন্ধ দৃষ্টি নিচের দিকে ঝুঁকানো তার। সীটবেল্ট বাঁধার সুবিধায় কোনোরকম ক্ষতি বা ব্যথা পায়নি পায়নি মেহনূর, কিন্তু ভয়ের যেই গোলাটা চোখের সমুখে দেহের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে টের পেলো সেটা বীভৎস! ফোন বাজার আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে পকেট থেকে ফোন বের করলো মাহতিম, চোখদুটো তখনও নিদারুণ যন্ত্রনায় বন্ধ। কলটা আন্দাজমতো রিসিভ করে কানে চাপলো মাহতিম, ওপাশ থেকে অত্যন্ত চিন্তিত এবং অস্থির গলায় বললো,

– হ্যালো আনসারী স্যার, প্লিজ ক্লাইন্ডলি আমার কথাটা শুনুন! আপনাকে ওরা ট্রেক করার ফর্দ করে ফেলেছে। আপনি এলার্ট থাকুন, দ্যা আর ভেরি ডেন্ঞ্জারাস স্যার! ওরা সংখ্যায় কতজন আপনার পেছনে লেগেছে আমরা কেউই ইনফরমেশন পাচ্ছি না। আপনাকে যেখানেই পাবে সেখানেই ওরা মা-র্ডার করে ফেলবে স্যার!

– চলমান

#FABIYAH_MOMO .

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৪৫.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

অংশ – শেষ .

নিজের মৃ’ত্যুর পরোয়ানা শুনেও উত্তেজিত হলো না! যেকোনো সময়ই হানা দেবে দস্যুর মতো জানো’য়াররা! কি করে এমন তুমুল বৃষ্টির ভেতর তাদের সামাল দেবে সেটা নিয়ে ছক কষানো প্রচুর হিসেবী কাজ! এবার সে একা নয় মোটেই, সঙ্গে যে বসে আছে তাকে নিয়েই সমস্ত চিন্তা জেঁকে আছে। স্টিয়ারিংয়ে দুহাত চেপে স্থির দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে মাহতিম আনসারী। তার ক্লান্তিকর মাথাটা কোনোভাবেই এমন পরিস্থিতিতে ঝিমিয়ে পরলে চলবেনা, শান্তভাবে পুরো খেলাটাই তাকে ঘুরিয়ে দিতে হবে। বাইরে বৃষ্টি, রাস্তা-ঘাট জনশূন্য, বৈরি আবহাওয়ার অজুহাতে গাড়ি চলাচল নগন্য। স্টিয়ারিং থেকে হাত নামিয়ে মুখটা এবার বামে ঘুরালো সে, দৃষ্টিটা তীক্ষ্ম করে ঠান্ডা কন্ঠে বললো,

– আমাকে যেতে হবে মেহনূর। আমি কখন ফিরবো জানি না, তোমাকে রেসোর্টে রেখে আসছি। কোনো ভয় নেই, সামিক এসে তোমাকে রেসোর্ট থেকে নিয়ে যাবে।

খটকা লাগলো বুকে। এমন ঝুম বৃষ্টির ভেতর মাঝ রাস্তায় থেমে কোথায় যেতে চাইছে? না, মন কিছুতেই মানছেনা। মেহনূর কিছুটা নাছোড়বান্দার মতো বললো,

– আমি যাবো না। আপনি কোথায় যাবেন?

অন্য সময় হলে উত্তর পেয়ে খুশী হতো মাহতিম, কিন্তু আজ খুশীর বদলে রাগের আক্রোশটা হামলে পরে মনে। মুখটা কঠোর করে বলে,

– প্লিজ আমার কথাটা চুপচাপ শোনো, একটু পরেই সামিক এসে তোমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাবে। কোনো টেনশন নেই। উলটো আমার সাথে থাকলেই বিপদ। আমি কাজটা শেষ করেই ফিরবো। কথা দিচ্ছি ফিরবো।

শেষোক্ত বাক্য শুনে আর স্থির থাকেনা মেহনূর। মনের ঝলমল উঠোনটায় হিংস্র পশুর মত দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে ভয়। গা কাটা দিচ্ছে ক্ষণেক্ষণে। মেহনূরের ভীতিগ্রস্থ মুখ দেখে নিজের কঠোর রূপটা গলিয়ে নিলো মাহতিম, কন্ঠ আর্দ্রের মতো কোমল করে বললো,

– তুমি কখনো আমার অবাধ্যতা করোনি, তো আজ কেনো করছো মেহনূর?

প্রশ্নের প্রেক্ষিতে চুপ রইলো মেহনূর। এটা সত্যি যে, এখন পযর্ন্ত সে কোনো কথায় অবাধ্যতা করেনি। মাহতিম যখন-যেভাবে বলেছে, মেহনূর চোখ বন্ধ করে সেগুলো বিশ্বাস করে পালন করেছে। মেহনূরের নিরবতা দেখে মুখ ঘুরালো মাহতিম, হাতের ব্ল্যাক ডায়ালের ব্রাউন ঘড়িতে চোখ রেখে সময়ের অঙ্কটা আবারও সচল মস্তিষ্কে হিসাব করে নিলো। ঘড়ি থেকে মুখ তুলে সামনে তাকাতেই গাড়িটা রিভার্স করে ঘুরাতে চললো, স্থির গাড়িটা যখন ডানে টার্ন করে রিভার্স হচ্ছিলো তখনই মেহনূর অস্থির হয়ে চিন্তিত দৃষ্টিতে দু’হাতে মাহতিমের বাহুটা জড়িয়ে ধরলো। সাদা শার্টের স্লিভটার নিচে নতুন ব্যান্ডেজের আস্তরণ থাকলেও মেহনূরের এখন সেই হুঁশ নেই, সে অস্থির-উৎকন্ঠায় পাগলের মতো বলতে লাগলো,

– আমি যাবো না, আপনি গাড়ি ঘুরানো বন্ধ করুন। আমি যাবো না বলেছি, আপনি জোর করেও ওখানে ফেলে আসতে পারবেন না। গাড়ি থামান।

রির্ভাস করতে গিয়েও বিরাট বাধা খেলো মাহতিম। শান্ত স্বভাবের মেহনূরকে বেশিরভাগ সময়ই নিরব থাকতে দেখেছে, দেখতে-দেখতে একটা অভ্যাসও হয়ে গেছে যে, মেহনূর তাকে নিয়ে কোনোদিনও মনের সুক্ষ্ম অবস্থা প্রকাশ করবে না। কিন্তু আজ এ কি দেখছে? তার সৌম্য বাহুটা খামচে ধরে বাধা দিচ্ছে? মাহতিম ধীরেসুস্থে গাড়িটা আকস্মিক দূর্ঘটনা থেকে বাঁচানোর জন্য নিরাপদ সাইডে পার্ক করলো। লতার মতো জড়িয়ে ধরা বাহুটাকে মেহনূরের কবল থেকে না ছাড়িয়ে উলটো তার গালটা ডানহাতে ছুঁলো। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আশ্বস্ত সুরে বললো,

– আমার কিচ্ছু হবে না মেহনূর। প্লিজ লক্ষ্মী মেয়ের মতো আমার কথাটা শোনো, তুমি রেসোর্টে থাকো। আমি কাজটা শেষ করেই আসছি। দেরি করবো না।

ভয় জড়ানো চোখে ঢোক গিললো মেহনূর, মাহতিমের দিকে সহজ চাহনিতে তাকিয়ে বললো,

– ফোনে কি বলেছে? আপনি মিথ্যা বলবেন না। আমি দেখেছি আপনি কলটা কাটার পরপরই আমাকে রেখে আসতে চাইছেন।

মাহতিম স্বগোতক্তির মতো করে বললো,
– ওসব দিয়ে তোমার কাজ নেই। তুমি রেসোর্টে যাচ্ছো এটাই ফাইনাল। আর একটা বাড়তি কথা বলবে না।

কথার পিঠে কথা বাড়ালো না মাহতিম, চুপচাপ অন্যহাতে গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে ফেললো। মেহনূর বাহুটা ছেড়ে দিয়ে অমত ভঙ্গিতে নির্জীব চাহনিতে বললো,

– আপনি আমাকে এখানেই ফেলে দিন। আমি নিজ দায়িত্বে রেসোর্টে যেতে পারবো। আমার জন্য আপনার গাড়ি ঘুরিয়ে পেট্রোল খরচ করে রেসোর্ট ফিরতে হবে না।

গম্ভীর নিরব মুখটা নিমিষের ভেতর আরো গম্ভীরতায় মিলিয়ে উঠলো, গাড়ি স্টার্ট দিলো ঠিকই, কিন্তু সেটা রিভার্স সিস্টেমে না নিয়ে সোজা পথে চালাতে লাগলো। নিস্তেজ অবসন্ন ভঙ্গিতে সিটে বসলেও মেহনূরের তটস্থ মন মাহতিমের উপর পরে রইলো, কলে নিশ্চয়ই এমন কিছু শুনেছে যার জন্য সে মেহনূরকে রেসোর্টে রেখে আসতে চাইছিলো। মেহনূর কারণটা জানার জন্য হালকা একটু কেশে নিজের জড়তা কাটিয়ে বললো,

– আপনাকে কলে কি বলেছে? কেনো আপনি রেসোর্টে রেখে আসতে চাইলেন?

মাহতিমের কান দিয়ে দু’বাক্যের দুটো প্রশ্ন ঢুকলেও তার চোখ তখন ডানদিকের লুকিং মিররে পেছনের দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত। পেছন থেকে কেউ ফলো করছে কিনা এটা এখনো আঁচ করা যাচ্ছে না। লুকিং মিরর থেকে চোখ সরিয়ে ফের সামনের দিকে তাকালো মাহতিম, পায়ের নিচে থাকা প্যাডেলটা মৃদ্যু চাপ দিয়ে গাড়ির স্পিডটা আরেকধাপ বেড়ে ফেললো। উত্তর না পেয়ে চন্ঞ্চল মনটা মেহনূরকে ছটফট করে তুললো, মেহনূর আবার তাগাদা দিয়ে জিজ্ঞেস করতে নিলে কঠিন এক ধমক দিলো মাহতিম, গরম সুরে বললো,

– তোমার শুনে লাভটা কি? কেনো জানার জন্য লাফাচ্ছো? মনে-মনে এটা ভাবছো নাকি তোমাকে রেসোর্টে ফেলে আরেকজনের কাছে যাচ্ছি?

পুরোনো কর্মকাণ্ডের কথা স্মরণ রেখে জঘন্য খোঁচাটা দিলো মাহতিম। সুক্ষ্ম খোঁচাটা খেয়ে চমকানো দৃষ্টিতে কয়েক মিনিট স্তম্ভ রইলো মেহনূর। এর চেয়ে জঘন্য খোঁচা সত্যিই আর হয় না। মেহনূর ভয়ের বিষাদযুক্ত দেয়াল ভেঙ্গে স্তম্ভিত গলাতেই বললো,

– কলের ঘটনায় যদি আপনার ক্ষতির গন্ধ না পেতাম, আমি জীবনেও আপনাকে পালটা প্রশ্ন করতাম না। আপনি যে আমার সাধারণ প্রশ্নে বিরক্ত হন আগে জানলে চুপ থাকতাম।

মাহতিম নির‍্যুত্তর, তার দৃষ্টি বারবার লুকিং মিররের দিকে চলে যাচ্ছে, দক্ষ হাতে দাপটের সাথে গাড়ি আগাচ্ছে বৃষ্টির মধ্যে। অন্যহাতে ফোনটা দিয়ে কাউকে কল করলো সে, কাধের সাথে ফোনটা কানে চেপে গাড়ি চালাতে-চালাতে কাগজ-কলম জোগাড় করলো। মেহনূর ড্যাবড্যাব করে সবকিছু দেখতে থাকলেও কৌতুহলে মনের অবস্থা কুণ্ঠিত হয়ে আছে, প্রশ্ন করারও অবস্থা নেই। একই সাথে এতোগুলো কাজ কিভাবে সামলাচ্ছে এই সুন্দর-মার্জিত লোকটা? কি করে সম্ভব এসব? গাড়ি চালাচ্ছে, কথা বলছে, কাগজে-কলমে খসখস করে যাচ্ছে, মনোযোগ দিয়ে লুকিং মিররে তাকাচ্ছে, একটার-পর-একটা কাজ ক্রমাগত করে যাচ্ছে, তবুও কোনোকিছু এলোমেলো ভাবে করছে না, একদম ঠিকঠাক ‘ ওয়েল ম্যানার্ড ‘ স্টাইলে করছে। এমনটা বিশেষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত লোকেরাই যে করতে পারে তার জলন্ত প্রমাণ মেহনূর সাক্ষাৎ দৃষ্টিতে দেখতে পারছে। মেহনূরকে উপেক্ষা করে কলে কথা বলতেই স্টিয়ারিংয়ের উপর কাগজ ঠেসে কলম চালাতে লাগলো মাহতিম, মেহনূর একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলো কাগজে অনেক কিছু সাংকেতিক ভাষায় লিখে যাচ্ছে সে। লেখাগুলো তার মতো সাধারণ মানুষের মাথায় জীবনেও ঢুকবে না। মাহতিম থেমে-থেমে গম্ভীর গলায় বলছে,

– এখনো সেইফ জোনে আছি।

ওপাশ থেকে উত্তর,
– স্যার, আপনি ডান দিকের মাটির রাস্তাটা ধরুন। ওদিকের রাস্তাটা কেউ ইউজ না করলেও ওটা শর্টকাট হবে। সেইফলি আসতে পারবেন।

মাহতিম কলমটা রেখে কাগজটায় চোখ বুলিয়ে বললো,
– ডানদিকের রাস্তাটা মেইবি হান্টেড রোড। ওখানে প্রেমে ব্যর্থ এক ছেলে সুইসাইড করেছিলো বলে ওই রাস্তা দিয়ে কেউ আসে না তাইতো?

মাহতিমের কথা শুনে ভিড়মি খেলো লোকটা। কি আজব! এতো ডিটেলস তো সে নিজেও বের করেনি। ছোট্ট করে উত্তর দিলো,
– জ্বী স্যার, ওটা হান্টেড। আপনি প্লিজ ডানদিকের ওই রোড ধরেই আসুন। ওটাই আপনার জন্য সেফ হবে। বাঁদিকের রাস্তা দিয়ে গেলেই বিপদ!

মাহতিম ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ঠেলে দিয়ে বললো,

– আমার ক্যালকুলেশন মোতাবেক, ডান-বাম, সামনে-পিছে সবখান দিয়েই আঁটকা পরতে যাচ্ছি। ওদের ট্রেক ডাউন করা ছাড়া আমার হাতে সেকেন্ড অপশন নেই। ডেন্ঞ্জার জোন থেকে বের হলে ইনফর্ম করবো, রাখি।

শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা হতে যাচ্ছে, বৃষ্টির ঢলটা হালকা একটু কমে এলেও সামনে আসছে ঘোর বিপদ! মাহতিমের কথাবার্তা শুনে মেহনূরের অবচেতন মন বিপদের সর্তকবার্তা দিয়ে ফেলেছে। জীবনে এই প্রথম প্রতিকূল অবস্থায় পরতে যাচ্ছে, মন তীব্র উৎকন্ঠায় উচাটন করছে। কি হবে সামনে? মাহতিম খারাপ পরিস্থিতি দেখেও হেসে কথা বললো? গাড়ির সিটে পিঠ ছেড়ে দিয়ে নিজেকে শান্ত করার উছিলায় জানালার কাঁচের সাথে মাথা ঠেকিয়ে দিলো মেহনূর, গুড়ুম-গুড়ুম করে আকাশ ডেকে কাঁচের জানালাটা দফায়-দফায় বৃষ্টির পানি আছড়ে অস্বচ্ছ থেকে স্বচ্ছ হচ্ছে। প্রকৃতির সাথে বৃষ্টির রফাদফার দৃশ্য দেখার জন্য জানালার বাইরে চোখ রাখলো মেহনূর, স্বাভাবিক চাহনিতে ভেজা গাছপালাগুলোর বৃষ্টিস্নান অবস্থা দেখতেই হঠাৎ চোখ থমকে গা শিউরে উঠলো! গাড়ির স্পিড আরো বেদম গতিতে বেড়ে যাচ্ছে এদিকে, মেহনূর ভালো করে স্পষ্ট চোখে দেখার জন্য লুকিং মিররে চোখ দিতেই ভয়ে জানালা থেকে সরে এলো। মুখ ঘুরিয়ে মাহতিমের দিকে তাকাতেই দেখলো, ইতিমধ্যে বিচক্ষণ দৃষ্টিতেও সেই লোমহর্ষক ঘটনাটা ধরা পরে গেছে। মূলত এ কারণেই বেড়ে যাচ্ছে গাড়ির স্পিড। মাহতিমের শক্ত-কঠোর-তেজী মুখটা দেখে চোখ বন্ধ করে মাথা নামালো মেহনূর, আতঙ্কে স্বরটাও অতল স্তরে নিচে নামিয়ে বললো,

– পেছন থেকে তিনটা গাড়ি ধাওয়া করছে —

বন্ধ এসির গাড়িতে জোরে নিশ্বাস ছাড়লো মাহতিম। যেই কারণে এই বোকা জীবকে রেসোর্টে রেখে আসতে চাইছিলো, সেটাই এখন ফলতে যাচ্ছে। এরপর যেই দৃশ্যগুলো পরপর দেখবে, সেগুলো দেখার পর কি মেন্টালি ট্রমায় চলে যায় কিনা সন্দেহ! ‘ সামান্য গাড়ি দেখেই ভয় পাচ্ছো, ধাওয়া-পাল্টা-ধাওয়া দেখলে কি করবে? ‘ কথাটা মনে মনে আওড়ালো মাহতিম। রুদ্ধ পরিস্থিতিটা বাগে না আনলেও একটা হাত বাড়িয়ে মেহনূরের নত মুখটা উপরে তুললো, হিসেবী মূহুর্ত থেকে কয়েক সেকেন্ডের সময় ছিনিয়ে এক লহমায় মেহনূরের দুঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো মাহতিম। দুম করে বুকের ভেতর কড়াঘাত লাগতেই শিউরে উঠলো মেহনূর। সেই শিউরে উঠা কাঁপা অবস্থার ভেতর উষ্ণতার হাতটা খোলা পিঠের উপর আলতো পরশে ছুঁয়ে দিতে লাগলো ওর, ডানহাতে এখনো গাড়িটা চালাচ্ছে মাহতিম। মেহনূরের ভয়াক্রান্ত চোখ থেকে সমস্ত ভয় যেনো নিজের হাসি-হাসি দৃষ্টি দিয়ে শুষে নিলো সে, ওই অল্পক্ষণ সময়টুকুতে ছোট্ট কন্ঠে বললো,

– কোনো ভয় নেই মেহনূর।

হাসিমাখা দৃষ্টিদুটোর চাহনিতে নিজেকে মিলিয়ে নিলো মেহনূর। মধ্যবর্তী দূরত্ব যেনো দুই ইন্ঞ্চির মতো, নিশ্বাসের উষ্ণতা যেনো আশ্বাসের ছোঁয়ায় মুখের উপর ছুঁয়ে যাচ্ছে। মেহনূর চোখ বন্ধ করে মাহতিমের ক্লিন শেভ গালটায় নিজের কপাল ঠেকিয়ে দিলো, মাহতিম এই ফাঁকে আবার সামনে তাকিয়ে ড্রাইভের বিধিটা দেখে লুকিং মিররে তাকিয়ে নিলো। হঠাৎ একটু-একটু করে টের পেলো তার বাঁহাতের তলায় থাকা পিঠটা গরম। বেশ ভালোই গরম বলা চলে। পাঁচ আঙ্গুলের থাবা দিয়ে অনাবৃত পিঠটা আবৃত করে কিছুটা চিন্তিত গলায় বললো মাহতিম,

– জ্বর আসছে কেনো? ঔষুধ যে দিয়েছিলাম খাওনি?

মেহনূর উত্তর দেওয়ার অবস্থাতে নেই। প্রাণপণে চাইছে আজ এই মানুষটার যেনো কিচ্ছু না হোক। মনের যেই মূখ্য স্তরটা যার সাথে বেঁধে গেছে সেটাতে কিছুতেই ভাটা না পরুক। মাহতিম আস্তে করে হাতটা সরিয়ে এনে মেহনূরকে সিটে ঠেলে দিলো, ব্যাঘাত খেয়ে মেহনূর চোখ খুলে তাকাতেই মাহতিম লুকিং মিররে পেছনের অবস্থা দেখতে-দেখতে হঠাৎ গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,

– হেড ডাউন,

মেহনূর কথাটা না বুঝে উজবুকের মতো তাকিয়ে থাকলে মাহতিম নিজেই মেহনূরের মাথাটা ধরে লহমায় নিচে ঝুঁকিয়ে দিলো। মূহুর্তের ভেতর কান তাক লাগানো শব্দ ভেসে আসতে থাকলে গাড়িও সাপের মতো এঁকেবেঁকে চালাতে লাগলো মাহতিম! বৃষ্টির ঢলটা কমে এলেও বাতাসের সাথে প্রাণচাঞ্চল্যকর শব্দগুলো ছুটে আসছে! পেছন থেকে একের-পর-এক গুলির সাইরেন বাজলেও গাড়ির এলোমেলো গতির জন্য একটাও নিশানা মতো লাগলো না। মেহনূর চোখ-মুখ খিঁচে কানে দুহাত চেপে থাকলেও স্পষ্ট শুনতে পেলো মাহতিম তাচ্ছিল্যের হাসিতে বলছে,

– আমিতো এদের পাক্কা খেলোয়াড় ভেবেছিলাম, এরা তো দেখি বেহুদা টার্গেট ছুঁড়তে এক্সপার্ট।

কথাটা শুনে কানে হাতচাপা অবস্থায় চোখ খুললো মেহনূর। মাথাটা আগের জায়গায় তুলতেই দেখলো, মাহতিম নিজের একটা হাত পায়ের কাছে নামিয়ে কালো প্যান্টটা খানিকটা উঠিয়ে কালো মোজার কাছ থেকে কিছু বের করছে। অনুমানের ভিত্তিতে ভাবলো বস্তুটা বেশ ভারী। নিমিষের ভেতর তিন আঙ্গুলের কঠোর কব্জায় একটানে পিস্তলটা বের করলো মাহতিম, পিস্তলটার মুখে সরু চোঙার মতো কয়েক ইন্ঞ্চির লম্বা বস্তুটা ফিট করতেই মেহনূরের দিকে একপলক তাকালো, হাসলো, হাসি ঠোঁটেই বললো,

– টানা দশ মিনিট পর তোমার এপিসোডে ফিরছি মেহনূর। তোমার এপিসোডে তো চুমু আছে। মিস করতে চাচ্ছি না।

বোকার মতো তাকাতেই কিছুটা ক্ষুদ্ধ অনুভব করলো মেহনূর। ‘ অসভ্য, এক নাম্বার অসভ্য! ঠোঁটে কিচ্ছু আঁটকায় না! ‘ কপাল কুঁচকে মনে-মনে বিড়বিড় করে মুখটা অন্যদিকে ঘুরালো মেহনূর। এদিকে দুহাতের স্লিভদুটো কনুইয়ে টেনে মাথাটা পেছনে ঘুরালো, চোখের চাহনি সর্তক, হাতের মধ্যে পিস্তল। মেহনূরের অভয় মন বুঝতে পেরেছে এখুনি পালটা এ্যাকশনটা রটতে যাচ্ছে, চলমান গাড়িটা একই স্পিডে বহাল রেখে গাড়ির ভেতর থেকে টার্গেট করলো মাহতিম। এক চোখ বন্ধ করে লক্ষবস্তুর দিকে পিস্তল তাক করতেই প্রোফেশনাল স্টাইলে থেমে-থেমে চারটা শব্দহীন গুলি ছুঁড়লো, ওমনেই তীব্র আর্তনাদে হাহাকার চিৎকার ভেসে আসলো পেছন থেকে, ধাম-ধাম করে ভারী বস্তুর আছড়ে পরার শব্দ শোনা গেলো, বৈদ্যুতিক খাম্বাগুলো যেভাবে আকস্মিক শব্দে ব্লাস্ট হয়ে যায় ঠিক তেমন।মেহনূর তীব্র শব্দের কৌতুহল দমাতে না পেরে দ্রুত মাথাটা পেছনে ঘুরায়, গাড়ির পেছন গ্লাসটায় চারটা গোল-গোল নতুন ছিদ্র দেখা যাচ্ছে, দূরের গাড়িগুলোর অবস্থা দেখে মেহনূর রীতিমতো হতভম্ব! সে একবার মাহতিমের দিকে আশ্চর্য দৃষ্টিতে তাকালো, আরেকবার সেদিকে দৃষ্টি ছুঁড়ে পেছনে দেখলো! শেষের গাড়িটার চাকা ব্লাস্ট হয়ে আগুন ধরে গেছে, তার একটু আগে থাকা গাড়িটা ডানদিকে কাত হয়ে আছে, সবার আগে থাকা গাড়িটার ড্রাইভার সিটেই ‘ স্পটডেথ ‘ এর শিকার! মেহনূর অকল্পনীয় চাহনিতে মাহতিমের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিললো, সুচতুর হাতে যে চারটা গুলি ছুঁড়েছে একদম কাটকাট স্টাইলে তিনটা গাড়ি খালাস! মাহতিম ততক্ষণে পুর্বের ফর্মে ফিরে গাড়ির চালাতে ব্যস্ত, দূরবর্তী গাড়ির দূর্দশার দিকে এক ঝলক চোখ বুলিয়ে মেহনূর পাংশু মুখে বললো,

– আপনার গু’লির আওয়াজ হলো না কেন?

মাহতিম পিস্তলটা আগের জায়গায় রাখতে-রাখতে বললো,

– ইটস অল এবাউট টেকনিক। সাইলেন্সার লাগিয়েছি। গুলি ছুঁড়লে আওয়াজ হবে না। এখন আবার প্রশ্ন কোরো না কিভাবে ওদের জায়গা মতো গু’লি করলাম। এসবের উত্তর দিলে নিজেকে নিয়ে বড়াই করা হবে, যেটা আমি পছন্দ করি না।

উত্তর শুনে মুচকি হাসলো মেহনূর। চিন্তার ক্লেশগুলো মন থেকে ঝেঁটিয়ে সীটে গা হেলিয়ে দিলো। এতোক্ষণ যা টের পায়নি, গ্রাহ্য করেনি সেটাই এখন শিউরে-শিউরে দিলো তাকে। বৃষ্টির কবল থেকে বাঁচতে পারেনি বলে হিংস্র জ্বরের ছোবল খেয়েছে মেহনূর। গতরাতে মাহতিম ঔষুধ খাইয়ে দিলেও সেটার ডোজ কাজে দেয়নি একটুও। চোখের পাতা বন্ধ হওয়ার জন্য আনচান করছে, হাত-পা’ও বেশ কাঁপছে, গ্রীষ্মের মতো তপ্ত বায়ুটা দেহের শিরায়-উপশিরায় চলাচল করে বাড়ছে ক্রমশ। অদ্ভুত এক মূর্ছার ভেতর তলিয়ে যেতে লাগলে চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে উঠলো, এরপর ধূসর হলো, এরপর আরো ধূসর হলো, এরপর ধূসর রঙটা রঙ পালটে কালো রঙে টপকে গেলো। কালো রঙে আসাটা যেনো মস্ত এক ভুল, নিজের দেহের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণের স্নায়ুটাকে আস্তে করে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। স্নায়ুটা একটুও সজাগ হলো না। তবুও চূড়ান্ত মূর্ছায় যেতে যেতে হালকা মতোন শুনলো কেউ তার নাম বলে চেঁচাচ্ছে, যেনো বারবার কাতর ধ্বনিতে চিৎকার করছে, ‘ মেহনূর চোখ খুলো, চোখ খুলো। প্লিজ চোখ খুলো না — ‘

.
সন্ধ্যাহ্নিক সময় চলছে, দখিনা হাওয়ায় শীতের সোল্লাস। রুমটা শীতের শীতলতায় ছুঁয়ে গেলেও ইজিচেয়ারে দোল খাওয়া মানুষটার মাথা গরম। দাঁতের নিচে অনেকক্ষণ যাবৎ সতের পদের মশলা দেওয়া পানটা চিবাচ্ছেন, পানের রসে ঠোঁট টকটকে লাল। কতগুলো পান মুখে দিয়েছেন সেটা অগণ্য। মেজাজের অবস্থা খুবই খারাপ, যেকোনো সময় ঠাস করে বজ্রপাতের মতো বিষ ফলা বসাতে পারে, যেটা হবে খুবই বিপদজ্জনক। বাড়িতে এতোগুলো মানুষ থাকলেও সবার সাথে অভিনয়ের শিল্পটা শানিয়ে যাচ্ছে, নিজেকে বাড়াবাড়ি রকমের সাধু বানাতে গিয়ে মাঝে-মাঝে ভালোই সমস্যায় ফাঁসেন। একটু আগে খবর এসেছে তার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে, সবকটা গাড়ির অবস্থা তছনছ। পুলিশের হাতে ধরা পরার আগেই বেঁচে যাওয়া লোকরা নিরাপদে সটকে গিয়েছে, যারা ঘটনাস্থলে ম-রেছে তাদের জলন্ত আগুনে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। এমন কঠোর পরিকল্পনা থেকে কিভাবে নিস্তার পেলো হান্নান শেখের মাথায় ঢুকছেনা। গাড়িটার ঠিকঠাক মতো জায়গায় গুলি ঠুকেও আগুন ধরাতে পারলো না? উলটো নিজেরাই গুলি খেয়ে কাত হয়ে মরলো? হান্নান শেখ ইজিচেয়ার থেকে উঠে গায়ে মোটা শাল জড়িয়ে নিলেন, সন্ধ্যার সদ্য নেমতন্ন কুয়াশার ভেতর তিনি কাউকে না জানিয়ে বেরিয়ে গেলেন। পেছন থেকে মাহমুদা অবশ্য জিজ্ঞেস করেছিলো, কিন্তু হান্নান শেখ সেটার যোগ্য উত্তর দেননি। গায়ে পায়জামা-পান্ঞ্জাবি পরা মুরুব্বী চেহারার গণমান্য হান্নান শেখ গায়ে শাল চেপে হাতদুটো পিছমোড়া করে নির্বিঘ্ন পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন। গ্রামের মেঠো পথটার উপর ঘাসের কিশলয়গুলো নিষ্প্রাণ হয়ে আছে, গাছে-গাছে বির্বণ পাতা।কুয়াশার ঠান্ডা পেয়ে প্রকৃতির প্রাণ যেনো কাতর হয়ে পরেছে, ঠান্ডার নিবেদন যেনো প্রাণে কুলাচ্ছে না। মসজিদ পথে ফেরা অনেক মুসল্লীর সাথে সাক্ষাৎ দেখা হলেও মনে-মনে তিনি অন্য পরিকল্পনা করছেন। খাঁচার পাখি যদি খাঁচায় আনা হয়, তাহলে পাখির টানে কি পুরুষ পাখি ফিরবে না? যদি পুরুষ পাখিটা ফিরে আসে তখন তো… এটুকু ভাবতেই হাঁটা থামিয়ে আকাশে তাকালেন হান্নান শেখ। নিষ্পাপ মুখে খুবই বিশ্রী হাসি দিয়ে হো-হো করে হেসে উঠলেন।
.

কপালে হাত স্পর্শ করে জ্বরটা পরোখ করলেন মারজা। এখনো কমেনি। পারদ স্কেলে একশো পাঁচ উঠেছে, মাথাটা ধুইয়ে দেওয়ার পরও জ্বর নামেনি। মাহমুদার কাছ থেকে বারবার সতর্ক বার্তা পেয়েছিলো এই জ্বর নিয়ে, সামান্য ঠান্ডা লেগেই মেহনূরের কঠিন জ্বর বাঁধে এ নিয়ে হুঁশিয়ার করা সত্ত্বেও আজ ছেলের গাফিলতিতে এই দশা হলো। কি দরকার ছিলো ওমন বৃষ্টির মধ্যে ভিজিয়ে-ভিজিয়ে গাজীপুর নেওয়ার? পথে কোনো ছোটোখাটো হোটেলেই নাহয় কিছু সময়ের জন্য থাকতো! কক্সবাজার এসেও তিনি স্বস্তি অনুভব করছেন না, সবাইকে সুস্থ-সমেত পেয়েও মনের খচখচানি কমেনি উনার। চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় কাউকে আজীবনের জন্য হারাতে যাচ্ছেন, তাকে কোনোদিন ফিরে পাবেন না তিনি। কেনো এমন কঠিন অবস্থায় পরেছেন শত চেষ্টা করেও উত্তর মেলেনি। জ্বরতপ্ত মেহনূরের মুখ লাল হয়ে উঠেছে, ঠোঁট ফ্যাকাশে, চোখ বন্ধ, হাতদুটো যেনো রুগ্ন হয়ে গেছে। শাড়ি পালটে দিয়ে ঢিলেঢালা সাদা কামিজ পরিয়ে দিয়েছেন, সঙ্গে ঢিলা ধরনের পায়জামা, বুক পযর্ন্ত কম্বল টেনে দেওয়া। হঠাৎ হোটেল রুমের দরজায় ‘ ঠকঠক ‘ করে নক করলো কেউ, মারজা সেদিকে দৃষ্টি দিয়ে অনুমতি জ্ঞাপনে বললেন, ‘ কে? ‘। বাইরে থেকে বাচ্চা স্বরে উত্তর এলো, ‘ মা, আমি মাহদি। ‘। মারজা ভেতরে আসতে বলে মেহনূরের কপালে নতুন পট্টি লাগাতে উদ্যত হলেন, মাহদি সোজা বিছানায় উঠে মেহনূরের দিকে উদাস চোখে তাকালো, দৃষ্টি তুলে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,

– জ্বর কমেনি মা?

মারজা ভারী নিশ্বাস ছেড়ে মলিন কন্ঠে বললেন,

– না রে বাবা, কমার নামই নিচ্ছে না। এমনেই শরীরে কিছু নেই, এই জ্বর যে কি অবস্থা করে দিলো। এখন ডাক্তার কই পাই?

মাহদি একটা হাত এগিয়ে মেহনূরের গরম হাতটা আষ্টেপৃষ্ঠে ধরলো। কাঙ্ক্ষিত কথাটা আস্তে-আস্তে মাকে শুনিয়ে বললো,
– মা, ভাইয়া বলেছে গা স্পন্ঞ্জ করে দিতে। তাহলে নাকি জ্বর নামবে, আর —

মারজা ভ্রুঁ কুঁচকে চোখ রাঙিয়ে ক্ষেপাটে গলায় বললেন,

– তোর ভাই কি এখন আমাকে শেখাতে আসছে? ওর কি জীবনে জ্বর হয়নি? ওর জ্বর কি আমি নামাইনি? আমার হাতে বড় হয়ে এখন আমাকে টোটকার খবর দিচ্ছে? ওকে আমার সামনে আসতে বলিস! অধমটাকে ঠাটিয়ে চড় না মা-রলে বুকে শান্তি পাবো না। এবার ঠিকই চড় মা-রবো।

মায়ের বিদঘুটে রাগ দেখে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে কেটে পরলো মাহদি। না-জানি আবার ভাইয়ার রাগ এসে নিজের উপরই পরে। মা’তো হাতের কাছে যা পায়, তা দিয়েই বেধড়ক মার লাগায়! মাহদি হাঁপাতে-হাঁপাতে দম ফুরিয়ে গোলআড্ডার চৌকাঠে এসে হাজির। নীতি-প্রীতি-ফারিনসহ সবাই হোটেলের করিডোরের শেষ মাথায় বারান্দায় বসে আড্ডা দিচ্ছে। মাহদি হাঁপানো অবস্থা দেখে আড্ডার মধ্য থেকে গলা তুললো ফারিন,

– কিরে বিট্টু, কুকুরের মতো জিহবা নাচিয়ে হাঁপাচ্ছিস কেন? কোত্থাকে ছুটে এলি?

ফারিনকে কড়া একটা ধমক দেওয়ার সাধ জাগলো মাহদির। কিন্তু বড় ভাইয়ের সামনে মুখ খুললে যদি ধাম করে পিঠ বাজায়? সে চিন্তা ঝেড়ে ফেলে চুপচাপ একটা খালি চেয়ার টেনে বসতে-বসতে বললো,

– মা বলেছে, ভাইয়াকে জুতা দিয়ে জুতিয়ে জুতিয়ে মা-রবে।

মাহদির কথা শুনে সবাই ফিক করে হাসতে নিলো, ওমনেই অশনী সংকেতের আঁচ ধরতে পেরে হাসি থামলো সবার। ঠোঁট কামড়ালো নীতি-প্রীতি, দাঁত শক্ত করলো সামিক-তৌফ-সৌভিক, মাথা নুইয়ে ফেললো সাবির, মিছেমিছি পানির গ্লাস তুলে ঢকঢক করে মুখভর্তি করলো সিয়াম। সবাই চোখে-চোখে ইশারা করলো, ‘ পেছনে এমন খামোশ অবস্থা কেনো? সে কি শোনেনি? ‘। সবার পেছনে বারান্দার রেলিংয়ের উপর গুমর মুখে বসে আছে মাহতিম, হাতদুটো বুকের কাছে ভাঁজ করা। চোখ থেকে সবটুকু আনন্দ ঝলসে এবার রাগান্বিত অবস্থা। চোখাচোখি ইশারার কথোপকথনটা ভালোই ধরতে পেরেছে, এদিকে সিয়াম কতদূর পানি গড়ালো সেটা দেখার জন্য পানিভর্তি ফোলা মুখে মাথা ঘুরালো, মাহতিমের রাগে চুপসানো মুখ দেখে ‘ ভু ভু ‘ করে মুখবর্ষণ করলো সিয়াম। মুখবর্ষণের সম্পূর্ণ পানি যেয়ে পাশে থাকা নীতির গায়ে পরলো। সবাই নীতির ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থা দেখে দম ফাটা হাসিতে ফেটে পরলো, সিয়াম কোনোভাবেই হাসি থামাতে পারলো না। তৌফ হাসতে-হাসতে পা থেকে স্লিপার খুলে ‘ জুতিয়ে জুতিয়ে মা-রবে ‘ স্টাইলে অভিনয় করে দেখালো। অভিনয় দেখে পেট ব্যথা করে হাসতে লাগলো সবাই। অন্যদিকে টগবগ-টগবগ করে রাগের তরল ফুটছে মাহতিমের। না পারছে ধরে কয়েক দফা মার লাগাতে, না পারছে জোরেসোরে ধমক দিতে! বাধ্য হয়ে রেলিং থেকে নেমে হৈ-হুল্লোড় থেকে চলে গেলো মাহতিম। নেভি ট্রাউজারের পকেটে দুহাত গলিয়ে অন্যমনষ্ক ভঙ্গিতে হাঁটতে-হাঁটতে লিফটে ঢুকলো, পুরো লিফটে কেবল একটা মেয়েই ছিলো তখন। বিচ থেকে ঘুরে আসার ইচ্ছায় গ্রাউন্ড ফ্লোরের বাটনে বৃদ্ধাঙ্গুল চাপ দিলো মাহতিম, আড়চোখে টের পেলো মেয়েটা বেশি সুবিধার না। পড়নের শাড়িটাও অশালীন ভাবে পরে আছে। মেয়েটা ঠিক বাঁদিকে দাঁড়িয়ে আছে, বারবার পা-থেকে-মাথা পযর্ন্ত লাস্যময়ী চাহনিতে চোখ বুলাচ্ছে, ঠোঁটটাও বুঝি অশ্লীল কায়দায় খানিকটা কামড়ালো। মাহতিম এমন ভান ধরে দাঁড়িয়ে আছে যেনো কিছুই দেখতে-বুঝতে পায়নি। মেয়েটা হঠাৎ আস্তে করে হাতটা কালো সাইডব্যাগে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। সাথে-সাথে আরো সতর্ক হলো মাহতিম! মেয়েটা কি পি’স্তল বের করার চিন্তায় আছে? লিফটে কি মাহতিমের জন্যই অপেক্ষা করছিলো?

চলমান .

#FABIYAH_MOMO .