মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব-৫৩+৫৪

0
867

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৫৩.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

হারিকেনের পলতেটা বাড়িয়ে দিয়ে বিছানায় আসলো মেহনূর। দুপুর থেকেই নাকি বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন, পুরোটা গ্রাম অন্ধকারে ডুব দিয়েছে। কখন কৃত্রিম আলোতে উজ্জ্বল হবে জানা নেই। ছোট থেকেই দেখেছে গ্রামে একটুখানি হেরফের হলেই বিদ্যুৎ চ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ করে বিদ্যুৎ যাওয়ার রহস্যটা আজও ধোয়াশা রয়ে গেছে। জানালার কপাটটা দুহাতে চাপ দিতেই খটাশ করে খুলে গেলো। ভেতরে ঢুকলো এক পশলা অন্ধকারযুক্ত আবছা আলো। গায়ে পাতলা-নরম কাথাটা টেনে জানালার দিকে মুখ করে শুয়ে পরলো সে। আকাশ পরিষ্কার, কিন্তু আকাশটা অদ্ভুত মায়াজালে রহস্যঘেরা নভোমণ্ডল ঠেকছে। মনের ভেতর তীব্র উৎকন্ঠায় জানান দিচ্ছে, ‘ এখানে আসাটা ঠিক হয়নি, এখানে আসাটা একদম ঠিক হয়নি ‘। এমন অদ্ভুত মনোভাবের উদয় দেখে দারুণ বিচলিত হলো মেহনূর। তার ছোট্ট মাথাটা আস্তে-আস্তে গূঢ় বিষয়গুলো ধরার চেষ্টা করলো। মাহতিম আনসারী, সে একজন নৌসদস্যের বিশেষ বাহিনীর কর্মকর্তা। তার পেশাজীবনটা ব্যস্ততায় ভরা থাকলেও সে কখনো পিছুটান ভুলেনা। সে যে বয়সে বড়, তার ধ্যান-জ্ঞান-চিন্তা-অভিজ্ঞতা সবকিছুই দূরদর্শী, তবুও সে মেহনূরের প্রতি কটাক্ষসূচক অবহেলা দেখায়নি। তার শক্ত চেতনার প্রত্যেকটা পদক্ষেপ আগেভাগে ঠাহর করা যায়না। সে খুবই ঠান্ডা মাথায় একেকটা কাজ করে, তার ওই নিষ্পাপ-হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে কেউ তার গভীর চিন্তার আয়তনটা মাপতে পারবেনা। জানালা থেকে মুখ সরিয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকালো মেহনূর। সোজা হয়ে শুতেই বুকের উপর কাথা ও কাথার উপর দুহাতের আঙ্গুলগুলো আষ্টেপৃষ্টে রাখলো সে। একে-একে ভাবতে লাগলো, রজনী ও অনামিকা দুচোখে তাকে সহ্য করতে পারেনা। এমনকি যতোবার অনামিকার সাথে তার চোখাচোখি হয়েছে সেখানে অনামিকার চোখে কেবল হিংস্রতাই দেখেছে। রজনীও তাকে একা পেলে যথেষ্ট অত্যাচার করে। এসব ঘটনা লজ্জায় কোনোদিন মাহতিম বা অন্যকারো কাছে বলেনি মেহনূর, না বলার ফলে তার সরল মনটায় গভীর একটা দাগ কেটেছে। কক্সবাজার গিয়েও মাহতিমকে একমিনিটের জন্য শান্ত দেখেনি। কি একটা চিন্তায় সবসময় বিভোর হয়ে থাকতো। তার বিভোর ভাবটা মিথ্যা হাসির কারসাজিতে ঢাকা পরলেও মেহনূরের কাছ থেকে চোখ এড়াতে পারেনি। এবার গ্রামে পাঠিয়ে যেই অপ্রত্যাশিত কাণ্ডটা ঘটালো, এতে আরো স্পষ্ট হয়ে গেছে মাহতিম ভয়ানক কিছু লুকাচ্ছে। গ্রামে পাঠানোর মতো স্পর্ধা মাহতিমের হবার কথা নয়। যেখানে সে নিজেই মেহনূরকে দূরে রাখতে নারাজ ছিলো, আজ ইচ্ছে করেই বহু মাইল দূরে গ্রামের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সৌভিকের আচরণেও সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাচ্ছে ব্যাপারটা খুবই গুরুতর। বাড়িতে দাদাভাই নেই, তিনি সম্ভবত গাঁয়ের কোনো কাজ দেখতে আবার বেরিয়ে পরেছেন। এই মূহুর্তে দাদাভাইয়ের সাথে মাহতিমের উটকো চিন্তার কারণটা আলোচনা করলে হয়তোবা দাদাভাই বুদ্ধি দিতে পারবেন। একমাত্র দাদাভাইয়ের কাছেই সব সমস্যার সমাধান থাকে। না, এবার আর দেরি নয়। সকল লজ্জা মাটি করে কাল সকালেই দাদাভাইয়ের সাথে মাহতিমকে নিয়ে আলোচনা করতে যাবে। এইসময় বাইরে ‘ ঘেউ ঘেউ ‘ করে কুকুর ডেকে উঠলো, বাতাসে গাছের শাখা-প্রশাখা নড়েচড়ে পাতার মর্মর আওয়াজ তুললো। লম্বা একটা জার্নি করেও চোখে ঘুম আসছেনা। চিন্তায়-চিন্তায় তার মাথাটা ঘুমহীনায় ঘন হচ্ছে। আঙ্গুলগুলো আলগা করে বালিশের নিচে হাত ঢুকিয়ে দিলো, টেনে বের করলো এন্ড্রয়েড ফোনটা। ফোনটার দিকে তাকিয়ে থাকতেই মাহদির কাছে ফোনের বিষয়বস্তু শেখার স্মৃতিগুলো মনে পরলো। এই আধুনিক যন্ত্রটা চালাতে প্রথম-প্রথম খুব যন্ত্রণার হলেও এখন এটা চালাতে বেশ পটু মেহনূর। এটার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব শুধু মাহদির। একজন অনভিজ্ঞ মানুষকে অভিজ্ঞ করার পেছনে যতটুকু ধৈর্য্য-শ্রম-ইচ্ছা ঢালা লাগে সবটাই শুধু মাহদি করেছিলো। পাকনাটা কোনো অংশে মেহনূরকে পিছিয়ে রাখেনি। একটা মোবাইল ফোন চালানো দ্রুততার সাথেই শিখিয়ে দেয়, একটা কম্পিউটার হুটহাট দরকারে কিভাবে অন করতে হয় তাও শিখিয়ে গিয়েছে। শহুরে কায়দা বোঝার জন্য, ধরার জন্য মাঝে-মাঝে ফারিনকে কল দিয়ে বুদ্ধি সংগ্রহ করতো। সেই বুদ্ধি মেহনূরের সাথে আলাপালোচনা করে দু-একটা খাটিয়ে ফেলতো। মেহনূরকে ‘ বউ ‘ ডাকার স্বভাবটা মুছতে পারেনি কেউ, খোদ মেহনূরই মাহদিকে বলে-কয়ে ‘ ভাবী ‘ ডাকাতে পারেনি। সবসময় মাহদি বলতো,

– ভাইয়া তো তোমার চেয়ে বড়। বড় মানেই আগে-আগে বুড়ো। বুড়ো হলেই হাড়গোড় ভেঙ্গে ম-রে যাবে। আমিও ততদিনে হ্যান্ডসাম হয়ে যাবো, এরপর তোমাকে বিয়ে করবো। ঠিক আছে না?

এমন উত্তর শুনে কাধে বা মাথায় আলতো করে চাপড় মারতো মেহনূর, একগাল হেসে দিয়ে কখনো-কখনো মাহদির ফর্সা গালদুটো টেনে দিতো। চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস ছাড়লো সে, চোখের পাতা ভিজে উঠার আগেই নিজেকে ঠেলা দিয়ে শক্ত করলো। ফোনটা অন করে তর্জনী চালাতে-চালাতে একটা কল বসালো, ফোনটা কানের কাছে ধরতেই নিচের ঠোঁট কামড়ে রাখলো। খুব স্বাভাবিক আওয়াজে রিং হচ্ছে কিন্তু কল ধরছেনা। বাজতে-বাজতে কলটা কেটে যেতেই স্ক্রিনের দিকে তাকালো। কলটা কেনো ধরেনি? এই মাঝরাতে তো ডিউটি থাকার না। এই সময় সে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়। ফোনটাও কলের জন্য নরমাল মুডে রাখে। ওই লোক কি তাকে কল দিতে ভুলে গেলো?প্রচণ্ড রাগ লাগছে! ভুলে যাওয়ার তো কথা নয়। সে কি ফেলনা নাকি? কটমট রাগ নিয়ে আবার কল দিলো মেহনূর, এবারও একই কাণ্ড ঘটিয়ে কলটা কেটে গেলো। পরপর দুবার ব্যর্থ হয়ে হতাশার বদলে অদ্ভুত জেদ চেপে ধরলো। কোনোদিকে না ভেবেই ডিরেক্ট অন্য একটা নাম্বারে কল বসালো সে। একবারও ভাবলো না কলটা দেওয়ার পর কি দশা হতে পারে। কলের কয়েকটা টোন যেতেই রিসিভ হলো, সৌজন্যতার সাথে পুরুষ কণ্ঠটা বললো,

– হ্যালো,

মেহনূর যথাসম্ভব ভদ্রতা রেখে বললো,

– আপনার স্যার কোথায়?

চমকে যেতেই ভ্যাবাচ্যাকা গেলো কণ্ঠটা। থতমত সুরে বললো,

– ক-ককি? কাকে চান?

ঢোক গিলে স্বাভাবিক গলায় বললো মেহনূর,

– আমি আনসারী সাহেবের স্ত্রী বলছি। উনি যদি ফ্রি হন তাহলে বলে দিবেন উনার স্ত্রীর নাম্বারটা ব্লকলিস্টে ফেলে দিতে। ভালো থাকবেন। রাখি, আল্লাহ্ হাফেজ।

কলটা টুপ করে কেটে যেতেই স্থির হয়ে গেলো নোমান। সময় ও পরিস্থিতির গণ্ডি হঠাৎই যেনো তালগোল পাকিয়ে ফেললো। ডানকানে এখনো ফোনটা চেপে রেখে একদৃষ্টিতে অন করা কম্পিউটারে তাকিয়ে আছে। সে বসে আছে মাহতিমের ডেষ্কে, তার একটা গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টের জন্যে। জোরে শাওয়ার ছাড়ার আওয়াজ হতেই সৎবিৎ পেলো নোমান, হালকা একটা ঝাঁকুনি খেয়ে কান থেকে ফোন সরিয়ে ফেললো। সত্যিই তার বসের বউ কল দিয়েছিলো? এটা কি বসের মুখে শোনা সরল-সহজ বউ? সরল-সহজ বউ হলে হালকার-উপর-ঝাপসা মেরে ধমক দেয়? বাম হাত উঠিয়ে নিজের বাঁগাল বরাবর চড় মারলো নোমান, তবুও বিশ্বাস হতে চাইছেনা! নোমান তড়িৎ গতিতে ডেষ্ক থেকে উঠে সোজা ওয়াশরুমের সামনে গেলো, ভেতর থেকে জোরালো শব্দে শাওয়ারের আওয়াজ ভেসে আসছে। ধপধপ করে দরজায় আঘাত করলো নোমান, নূন্যতম হেলদোল না রেখে বলতে লাগলো,

– স্যার, স্যার আপনি এক্ষুণি বাইরে আসুন। ম্যাডাম বলেছে তাঁর নাম্বারটা এক্ষুনি ব্লকে ফেলতে।

আকাশ থেকে পরার মতো চমকে যায় মাহতিম। ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে প্রচণ্ড আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে,

– তুমি কি বলছো? কে বলেছে?

মাহতিমের কথা আংশিক বুঝলো নোমান। দ্রুতগতিতে উত্তর দিয়ে বসলো,

– স্যার, আপনার ম্যাডাম বলেছে।

নোমানের বেকুব মার্কা কথা শুনে গা জ্বলছে মাহতিমের! এই ছেলে সামান্য উত্তরটাও ঠিকঠাক মতো দিতে পারেনা। মাহতিম রাগ দেখিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,

– আরে কোন্ ম্যাডাম? আমার মা না আমার বউ?

নোমান এতোক্ষন পর বোকামিটা বুঝতে পারলো। জিভ কামড়ে চোখ খিঁচে সাথে-সাথে জবাব দিলো,

– স্যার, আপনার বউ।

ঠোঁট গোল করে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো মাহতিম। হাত বাড়িয়ে শাওয়ারের স্পিডটা ধীর হাতে কমাতেই হঠাৎ কিছু একটা মনে পরলো। ‘ এক মিনিট ‘, কথাটা মনে মনে বলতেই স্থির হয়ে গেলো সে। চোখ বড়-বড় করে তাড়াতাড়ি শাওয়ারের নবটা বন্ধ করতে লাগলো মাহতিম। সর্বনাশ! সাংঘাতিক! সে ভুলে গেছে! একদম ভুলে গেছে!

.

ছোট্ট চারকোণা কাঠের টেবিলটার উপর হারিকেন রাখা। হারিকেনের হলুদাভ-কমলা রঙটা রুমের অন্ধকার কাটিয়ে দিচ্ছে। সুন্দর গোছানো রুমটার দু-দুটো জানালাই খোলা। গ্রামাঞ্চলে অন্ধকার নামলেই জানালা খোলার ছোটোখাটো রেওয়াজ আছে। রেওয়াজ হয়তো বাতাসের জন্য অথবা রুমের ঘুটঘুটে অন্ধকার কাটানোর জন্য চলে। বিছানার মাঝখানটায় বসে আছে দুজন। দুজনই মুখোমুখি হয়ে আছে। নতমুখে বসে আছে সৌভিক, দৃষ্টি তুলে তাকানোর ক্ষমতা তার নেই। নিজের কোলের উপর শানাজের হাতটা দুহাতের ভেতর শক্ত করে ধরে রেখেছে। যেনো আলগা করে ধরলেই শানাজ পালিয়ে যাবে। চুপচাপ শান্ত দৃষ্টিতে সৌভিকের দিকে তাকিয়ে আছে শানাজ। অনেকক্ষণ যাবৎ দুজনের মধ্যে গম্ভীর নিরবতা চলছে। সৌভিকের আকস্মিকভাবে জাপটে ধরার ফলে একটু কেঁদে ফেলেছিলো শানাজ, আপাতত সে রাগী-রাগী ভাব দেখানোর অনর্থক চেষ্টা চালাচ্ছে। সৌভিকের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতেই তার গালে হাত রাখলো সে। বিমর্ষ মুখের গালটা আঙ্গুলের স্পর্শে ছুঁয়ে দিতেই মুখ তুললো সৌভিক। শানাজের সাথে চোখাচোখি দৃষ্টি রেখে তাকালে শানাজ মলিন হাসি দিয়ে বললো,

– অনেক শুকিয়ে গেছো। এর আগেরবার এতো খারাপ অবস্থা দেখিনি।

ফ্যাকাশে ঠোঁটে কাষ্ঠ হাসলো সৌভিক। সেই হাসিতে বলে ফেললো,

– এর আগেরবার তুমি ছিলে না। এখনো আছো।

চুপ রইলো শানাজ। একটু থেমে আবার বললো,

– যোগাযোগ তো তুমি বন্ধ করেছো সৌভিক। আমি বেহায়ার মতো যোগাযোগ রাখতে চেয়েছিলাম, একবারও তোমার কাছ থেকে সাড়া পাইনি।

শানাজের কথায় কোমল করে সায় দিলো সৌভিক। মাথাটা উঁচুনিচু দুলিয়ে শানাজের হাতটা টেনে ঠোঁটের উপর রাখলো। চোখ বন্ধ করে আলতো স্পর্শ করে বললো,

– আমাদের সম্পর্কটা আগানো মানে বিরাট ঝামেলা টানা। তুমি কি ঝামেলা টানতে চাচ্ছো?

শানাজ মোটেও এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলো না। গাল থেকে হাতটা চট করে সরালো সে, অপ্রস্তত ভাবটা প্রকাশ করে গমগম রাগ দেখিয়ে বললো,

– কেনো? আমার সাথে যখন সম্পর্ক করতে গিয়েছো তখন এই খেয়াল ছিলো না? তখন কি মনে পড়েনি এই সম্পর্কটাই একদিন ঝামেলার মতো হয়ে যাবে? তখন এই হুঁশ-জ্ঞান কোথায় গিয়েছিলো তোমার? আজকে কোন্ সাহসে তুমি ঝামেলা টানার বলছো?দোষ কি আমার ছিলো নাকি তোমার ছিলো? কেনো তোমার দোষের জন্য আমি কষ্ট পাবো? আমি তো তোমার পিছু-পিছু বেহায়া হতে যাইনি! তুমিই এমন সব কাজ করেছো যার জন্য আজ আমার এমন দশা। একমাত্র তুমি এমন যন্ত্রণায় আমাকে ফেলে গিয়েছো সৌভিক! দায়ী তো তুমি।

শানাজের ক্ষিপ্ত মুখ দেখে কিছু বলতে গিয়েও শেষপর্যন্ত নিজেকে আঁটকে ফেললো সৌভিক। কথাটা বলতে নিজের বিবেক পযর্ন্ত কাঁপছে! শানাজকে কিভাবে আসল সত্যটা বলবে? ওর দাদা যে নিজেই সৌভিককে কল দিয়ে যোগাযোগ নষ্ট করতে বলেছে এটা কি ঠাস-ঠাস বলা যায়? শানাজ হয়তো আন্দাজও করতে পারবেনা আজকের এই মনোমালিন্যের জন্য ওর দাদা কি ধরনের কথা উচ্চারণ করেছে। ওই বুড়ো লোকটাই আজকের জন্য সর্বেসর্বা দায়ী! সৌভিক যদি যোগাযোগ নষ্ট না করতো তাহলে পুরো ব্যাপারটা মাহতিম ও মাহতিমের পরিবারের কাছে বিশ্রী ভাবে ধরা পরতো। মাহতিম অবশ্যই সৌভিকের কথা শুনে সিদ্ধান্ত নিতো, কিন্তু বাকিরা কি তা করতো? সৌভিক কথাটা মিথ্যে করে বললো,

– আমি ক্যারিয়ার নিয়ে বিজি ছিলাম শানাজ। তখন আমার লাইফে একটা বেস্ট অপোরচুনিটি চলে এসেছিলো। তাই —

আর বানিয়ে-বানিয়ে বলতে পারছেনা সৌভিক। এভাবে কঠিন সত্যকে মিথ্যার চাদরে ঢাকাটা তার জন্য কষ্টকর। সৌভিকের কথা ও নিরবতা শুনে ওর গালে একটা চড় মারতে মন চাচ্ছিলো। সম্পর্ক করার সময় এইসব ক্যারিয়ার-ফ্যারিয়ার হেনতেন কোথায় চলে যেতো? তখন কি ভুলেও মনে পরতো না, আমার ওমুক একটা ক্যারিয়ার আছে, তমুক একটা ঝামেলা আছে? চড়ের ইচ্ছাটাকে প্রশ্রয় না দিয়ে কাটাকাট আওয়াজে বললো শানাজ,

– তুমি আমার সামনে থেকে বেরিয়ে যাও সৌভিক। তোমার ভেতর যদি লজ্জা থাকে, আর তুমি যদি ভদ্রঘরের সন্তান হয়ে থাকো, তাহলে আমার রুম থেকে বেরিয়ে যাও। পারলে সকালেই আমাদের বাড়ি থেকে চুপচাপ কেটে পরবে। মেহনূরের কাছে কোনো অভিযোগ করার দুঃসাহস দেখাবে না! আমার বোন আর বোন জামাইকে এসবের ভেতর ঢুকালে তুমিও আমার জঘন্য রূপ দেখে ছাড়বে। চলে যাও এখান থেকে। ভুলেও আমার কাছে লজ্জাহীনতা পরিচয় দিতে এসো না।

নিজের অসহায় অভিব্যক্তি লুকাতে পারলো না সৌভিক, চট করে শানাজের দিকে থমথমে দৃষ্টিতে তাকালো। শানাজের মুখের উপর রাগের আস্তরটা লেপ্টে আছে, সেখানে টান-মায়া সবকিছু লুপ্ত। শানাজ কোনোখানে না তাকিয়ে সোজা তর্জনী তুলে দরজার দিকে তাক করলো। সরাসরি মুখের উপর বললো,

– বেরিয়ে যাও।

মাথা হেঁট করে বিছানা থেকে নামল সৌভিক। ফ্লোরে পাদুটো ফেলে দাঁড়িয়ে পরতেই একবার মাথা ঘুরিয়ে পিছু চোখে দেখলো, এরপর পা চালিয়ে দরজাটা খুলে ভারী বুক নিয়ে চলে গেলো সে। দরজা দিয়ে বেরিয়ে ডানে মোড় নিতেই পেছন থেকে হিঁচকে কান্নার আওয়াজটা পেলো, মেঝের দিকে দৃষ্টি নত রেখে একপা-একপা করে চলে যেতে লাগলো।

.

সকালটা শান্ত। পাখপাখালির কলরবে চারপাশটা মুখর। আকাশের বুকে অগ্নিপিণ্ডটা আলো বিকিয়ে চলছে, মাঠে-ঘাটে সোনালি আলো ছড়িয়ে ধাবমান আছে সূর্য। গ্রামের মানুষগুলো অলসতা ছেড়ে নাস্তা পানি সেরে নিজ-নিজ কাজে ব্যস্ত হচ্ছে। এদিকে ফসলি জমিতে চাষীদের হরদমে কাজ চলছে। শেফালী তার মেয়েকে নিয়ে দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়ের বাসায় গিয়েছে, এই আত্মীয় আবার কেমন আত্মীয় সেটা নিয়ে মাথা ঘামায়নি কেউ। সাবা কলেজের একটা মূল্যায়ন পরীক্ষা দিতে চলে গেছে। কলপাড়ে হাত-মুখ ধুয়ে শানাজের হাতটা ধরলো মেহনূর, শানাজ একহাতে মেহনূরকে ধরে রেখে অন্যহাতে মেহনূরের মুখটা গামছায় মুছে দিচ্ছে। দুবোনের দৃশ্যটা দূর থেকে দেখছে দুধ দুয়ানো সুজলা। কেউ কি বলবে ছোটটার এখন বিয়ে হয়ে গেছে? এখনো দুবোনের ভেতর ভারী আশ্চর্যজনক মহব্বত দেখা যায়। সুজলার অন্যমনস্কতার দিকে দৃষ্টি দিতেই মাহমুদার নজরে দূরের দৃশ্যটা চোখে পরলো। বাছুরের মুখে কচি ঘাস ধরে প্রশান্ত গলায় বললো,

– এদের দেখলে পরানটা জুড়িয়ে যায়।

মুখ ফিরিয়ে মাহমুদার দিকে একগাল হাসলো সুজলা। দু’পাটি ধবধবে দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বললো,

– এখন কোমরটা বাঁধো ছোটো বউ। বিয়ে তো দিয়েই দিলে। এখন নাতী-পুতির মুখ দেখার জন্য সময় গুনতে থাকো।

সুজলার কথায় সেও হাসলো তখন। অন্যদিকে হান্নান শেখের জন্য চিন্তিত মেহনূর শানাজের উদ্দেশ্যে বললো,

– দাদাভাই কখন আসবে বুবু? সেই রাত থেকেই দাদাভাই বাড়ি নেই। এমন দেরি তো আগে কখনো করতে দেখিনি। দরকার পরলে সকালের নাস্তাটা মুখে দিয়ে তারপর কাজে বেরিয়ে যায়। তুমি কিছু জানো?

ভেজা গামছা নিজের কাধে ফেলে মেহনূরকে নিয়ে হাঁটতে লাগলো। শান্ত স্বরে বললো,

– তোর এই গাঁইয়া বুবুকে বিশ্বাস করলে সমস্যার কথাটা বলতে পারিস। অন্তত তোর চিন্তার চাকা কিছুটা হলেও থামবে।

সিড়ির প্রথম ধাপে পা ফেলতেই কপাল কুঁচকালো মেহনূর, শানাজের হাতটা ঝাঁকুনি দিয়ে কপট দেখিয়ে বললো,

– খুবই বাজে কথা বুবু! এই গাঁইয়া আবার কেমন শব্দ? তুমি এসব বলে-বলে আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছোনা ?

মেহনূরের কথায় হাসি দিয়ে উপহাসের ভঙ্গিতে বললো,

– ধুর পাগলী, দূরে ঠেলাঠেলির কি আছে? তুই তো এখন দূরেই থাকিস। শহরে থেকে-টেকে পাকা হয়ে গেছিস সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। আগে চড় মা’রলেও তোর মুখে খই ফুটতো না, আর এখন ভাইয়ার সাথে উঠ্-বস্ করে কত চালু হয়েছিস ভাবা যায়? আমার কাছে এলি তাও ঘুরঘুর করে দাদাজানকে খুঁজছিস, এটার ইঙ্গিত বুঝি বুঝবোনা?

শানাজের হাত ধরে দোতলা সিড়িতে পা রাখলো মেহনূর। শানাজের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো,

– তুমি একটু বেশি খোঁ’চাচ্ছো না?

ড্যাবড্যাব চাহনিতে হা হয়ে গেলো শানাজ। অবাক হয়ে বললো,

– ওমাগো, কার মুখে খোঁ’চার কথা শুনি? তুই দেখি চপর-চপর কথা বলতে শিখেছিস। সবই তোকে ভাইয়া শিখিয়েছে তাইনা? ঠিকই করেছে। তোর মতো আস্তো বোবা নিয়ে সংসার করা যায় নাকি? চল্ উপরে চল্। উপরে যেয়ে আমার কাছে সব ঝেড়ে-কেশে হালকা হয়ে বলবি। কাল রাত থেকে দেখছি তোর মুখটা ভার। কি নিয়ে টেনশন করছিস ওটা তোর দেবরের জন্য জিজ্ঞেস করিনি। এখন চল, সব ফটফট করে বলবি।

শানাজের সাথে বহুদিন পর খোলামেলা কথায় বসলো মেহনূর। শানাজের হাতে খাবারের প্লেট, সে ডাল চচ্চরিতে ভাত মাখিয়ে চালাকি করে মেহনূরকে টপাটপ খাইয়ে দিচ্ছে। মেহনূর খাবার চিবোতে-চিবোতে সবটুকু কথাই বলে দিলো। অনামিকার ঘটনা থেকে শুরু করে এই গ্রামে আসার ঘটনা পযর্ন্ত বললো। সব শুনে শানাজের কপালে একটু পরপর ভাঁজ পরছিলো। হঠাৎ শানাজ দরজার দিকে তাকাতেই দ্রুত সেটা ছিটকিনি মেরে লাগিয়ে দিলো। ‘ দেয়ালেরও কান থাকে ‘ প্রবাদটার মতো শানাজ একটু সতর্ক কন্ঠে বললো,

– তুই আপাতত চুপ থাক্। মাহতিম ভাইয়াকে কিচ্ছু বলিস না। ভাইয়া যে তোকে এখানে পাঠালো, আমার মনেহচ্ছে ভাইয়া নিজেই এখানে আসতে যাচ্ছে। দেখিস ভাইয়া ঠিকই আসবে। পুরো কাহিনী শোনার পর মনেহলো ভাইয়া তোকে কিছু একটা থেকে দূরে সরাতে চাচ্ছে। সেটা ওই রজনীও হতে পারে, আবার অন্য কেউ। আচ্ছা একটা কথা বলতো, তুই কোন আক্কেলে ভাইয়ার কাছে ওই অনামিকার কাহিনী জানতে চেয়েছিলি? তোর কি ঘিলুতে এটুকুও কাজ করেনি তার আত্মসম্মানে ঘাঁ লাগবে?

– আমি তো তখন পুরো ঘটনা জানতাম না বুবু। নীতি আপু যখন পুরো ঘটনা বললো, আমার তখন এতো খারাপ লেগেছিলো, বলে বোঝাতে পারবোনা। ওইদিন আমার উপর ক্ষেপতে গিয়ে হাতটা কি করেছিলো, ওটা ভুলবো না বুবু। ওইদিনের পর থেকে নিজের কাছে ওয়াদা করেছি আর কখনো ওরকম করবো না।

– তোর শ্বাশুড়ি কবে যাচ্ছে?

– সোমবারে টিকিট। মার শরীর যে কি খারাপ হয়েছে। রাতে ঘুমের ট্যাবলেট দিলেও শেষরাতে জেগে যায়।

– খুব কাঁদে, নারে? মাহদিটা অনেক চন্ঞ্চল ছিলো। বাচ্চাটা আর নেই ভাবতেই বুকটা খালি লাগে। ভাইয়ার মনে খুব কষ্ট আছে মেহনূর। তোর বরটা আসলেই খুব শক্ত, তুইযে বললি একটুও কাঁদেনি আমার খুব অবাক লাগছে। আমি যদি ভাইয়ার জায়গায় থাকতাম অজ্ঞান হয়ে বিছানায় পরে থাকতাম। সেখানে দ্যাখ, নিজের ছোটো ভাইকে দাফন করে শান্ত ভাবে কাজে ফিরে গেছে। ভাইয়ার সাথে খবরদার উঁচু গলায় কথা বলবি না, খুব সম্মান করবি। আমাকে সকাল-সকাল ফোন দিয়ে কি বলেছে জানিস?

মেহনূর খাবার চিবোনো বাদ দিয়ে উৎসুক হয়ে বললো,

– কি বলেছেন?

শেষ লোকমাটা গোল-গোল করতেই শানাজ বলতে লাগলো,

– বলেছে, ‘ শোনো বড় শ্যালিকা, আমার বউটার দিকে বিশেষ খেয়াল রাখবে। আমি আসার পরপরই যেনো সুস্থ দেখতে পাই। যদি টাষ্কটা ঠিকঠাক মতো করো, তাহলে তুমি যা চাইবে তাই-ই দিবো। ‘

শানাজ একদম নকলবাজের মতো অভিনয় করে দেখালো। অভিনয় দেখে হাসতে-হাসতে বললো মেহনূর,

– তারপর?

ঠিক তখনই দরজার কাছ থেকে উত্তর ছিঁটকে এলো,

– তারপর আমি দেখা করতে খুব দেরি করে ফেললাম দাদু।

চমকে গিয়ে শানাজ-মেহনূর দুজনেই দরজার দিকে তাকালো। দেখলো হান্নান শেখ সদ্য গোসল সেরে সুতির পাণ্ঞ্জাবী পরে দাঁড়িয়ে আছেন। দুজনেই খুশীতে গদগদ হয়ে উঠলো, এবার দাদার সাথে জম্পেশ আড্ডা চলবে।

.

সময়ের কাটা ও সপ্তাহের বার অজান্তেই চলতে লাগলো। বিরতিহীন সময়ের গণ্ডিটা ধীরে-ধীরে কঠিন দিনের দিকে এগোচ্ছে। খুব নির্ঝঞ্ঝাটে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাড়ি দিলো মারজা, তার চিকিৎসার পুরো প্রক্রিয়ার জন্য সদা-সর্বদা নীতি-প্রীতি সঙ্গে থাকবে। আমেরিকার ঘাঁটিতে চিকিৎসার সুবাদে দেশে থাকবেনা কয়েক মাস। খাঁ খাঁ বিরান ভূমির মতো শূন্যতায় ছেয়ে গেছে পুরো আনসারী নিবাস। বাড়িতে বিশ্বস্ত চাকর সিরাজ কাকা তদারকিতে আছেন, সাবু খালা দেশের বাড়িতে ভাতিজির বিয়ে খেতে গেছেন। আরো যতো চাকর-বাকর ছিলো তাদের যাওয়ার আগে ছুটি দিয়ে গেছেন মারজা, শুধু ছুটি চাননি সিরাজ কাকা। তিনি সকলের অনুপস্থিতিতে বাড়ির দেখভালের কাজ নিজ হাতে করতে ইচ্ছুক। মারজা যাওয়ার পরপরই বিদায় নিয়েছে রজনী, সে তার ভাইয়ের জন্য উত্থাল নির্বাচনে সাহায্য করতে ছুটেছে। রজনীর নির্দেশে জাফলং বেড়াতে গিয়েছে অনা। অপরদিকে গ্রামের মাটিতে ফিরতে পেয়ে প্রাণবন্ত হয়েছে মেহনূর। তার গোমড়ামুখো ভাব কেটে গিয়ে স্বচ্ছ চন্ঞ্চলতার ভাবসাব দেখা দিচ্ছে। মায়ের সাথে, বড় মার সাথে, সাবা ও শানাজের সাথে সহজ হয়ে গেছে মেহনূর। সকলের সেবা ও যত্নের কঠোরতায় সুস্থ হচ্ছে সে। নিউমোনিয়ার মতো রোগটা সারতে-সারতে শূন্য স্কেলে এসে পৌঁছেছে। এখন দেহে কেবল মাংসের ঘাটতি। উপন্যাসের বইগুলো এখন আগের রুক্ষ লাগেনা, মাঝে-মাঝে পড়তে-পড়তে গভীর স্মৃতিতে ডুবে যায়। কখনো মাহতিমের দুষ্টু কথাগুলো ভেবে বই হাতেই খিলখিলিয়ে হাসে, কখনো মাহতিমের চিন্তায় মুখ কালো হয়ে বই নামিয়ে রাখে। আয়নার সামনে চুল আঁচড়াতে গেলে মনে হয়, এই বুঝি পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো, এই বুঝি পেছন থেকে কাধে মুখ গুঁজে দিলো। কিন্তু দিনশেষে কেউই তার গা কাঁপিয়ে শিরশির অনুভূতিটা জাগাতে আসেনা, কেউ সম্মোহন দৃষ্টিতে মুগ্ধ করে হাসি ছুঁড়ে তাকায় না। দিনে-রাতে যখনই মাহতিম একটুখানি অবসর পায় তখনই মেহনূরের খোঁজ নেয় সে। মেহনূর প্রতিবারই জিজ্ঞেস করবে,

– কবে আসছেন?

মাহতিম হরহামেশার মতো একই উত্তর দেয়,

– এইতো আর কিছুদিন।

কয়েক মিনিটের জন্য মনে হতো কালই চমকে দেওয়ার জন্য মাহতিম আসছে। আবার, মন থেকে জবাব আসতো, অপেক্ষা করিস না, সে আসবে না। রাতে ঘন্টার-পর-ঘন্টা কথা বললেও মেহনূরের কাছে শূন্য-শূন্য ঠেকে, যেনো কত কথা বলার ছিলো, সেগুলো নিষ্ঠুর সময়ের জন্য ফুড়িয়ে গেছে। একদিন রাতে ঠকঠক করে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। মেহনূর চমকে গিয়ে অদ্ভুত শিহরণে লাফিয়ে উঠলো, বইটা নির্দয়ের মতো ফেলে রেখে তাড়াহুড়ো করে দরজা খুলতে লাগলো। প্রশস্ত এক হাসি দিলেও মনটা ভীষণ মুষড়ে পরলো তার। হাসিটা মন থেকে উঠে গেলেও ঠোঁট থেকে মুছলো না। সে তার দাদাভাইকে দেখে কেনো মন থেকে খুশী হলো না? দাদাভাইয়ের জায়গায় যদি অন্য কেউ হতো তাহলে খুব খুশী হতো? দাদাভাই সেদিন রাতে উদ্ভট কথা বললো,

– দাদুভাই, যদি তোমাকে সবসময়ের জন্য আমার কাছে রেখে দেই তাহলে তুমি থেকে যাবে?

বিষণ্ণ ভারাক্রান্ত মেহনূর কোনোকিছু না ভেবে চুপ ছিলো। মাহতিমের ‘ আসবো-আসবো ‘ করে আশাভঙ্গের কথাগুলো মনে পরতেই অন্যমনষ্ক গলায় বলেছিলো,

– আমি থাকবো।

অন্যমনষ্ক মেহনূর যদি একটুখানি সজাগ হতো, যদি একটু বুঝতো তাকে এমন প্রশ্ন কেনো করা হচ্ছে, তাহলে সে বুঝি লাগেজ ফেলেই পালিয়ে যেতো। হান্নান শেখের ধূর্ত ইচ্ছাটা যদি মাইন্ড রিডিংয়ের মতো ধরা পরতো, তাহলে মেহনূর আর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে থাকতে পারতো না। গোল-গোল চাহনিতে বরফের মতো জমে যেতো সে। হান্নান শেখ নিজ রুমে ফিরে আসতেই তোশকের নিচ থেকে ফোন, ক্যালেন্ডারের সবশেষ পাতা থেকে স্কচট্যাপে আঁটকানো সিম, মস্তিষ্কের ভেতর থেকে হাতড়ে বের করা মুখস্ত নাম্বার একত্র করলো। কলটা ডায়ালে দিতেই তিন-থেকে-চারবার বাজার পর রিসিভ হলো। হান্নান শেখ ওরফে কালাম সরদার নিচু গলায় বললো,

– খবর কি সজীব্বা?

সজীব নামের ছেলেটা ঘ্যাটঘ্যাট করে বিশ্রী হাসি দিলো। ফচ্ করে একদলা পানের পিক ফেলে বললো,

– আফনের মা’ল দেহি নায়কের লাহান। হেরে ট’পকাইতে বহুত কসরত করন লাগবো। এই লিগ্গা সোইপ্পার দলডারে আইতে কইছি। হা’লারা মিডিসিন লইয়া আইতাছে। পেডে চা’ক্কু হান্দায়া মুচুড় মারলেই দ’ম শেষ। কুনো টেনশান নাই মামু। আফনে নিচ্চিত থাহেন।

– চলমান .

#FABIYAH_MOMO .

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৫৪.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

দীর্ঘদিনের ষড়যন্ত্রটা বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। সব রকমের কলাকৌশল প্রস্তুত করা শেষ। এখন শুধু শিকারের জন্য অপেক্ষা। চারিদিক থেকে হানা দেওয়ার জন্য ওত পেতে আছে দলবল। একটা ইশারা পেলেই জানোয়ারের মতো কোপ চালাবে তারা। ঘড়িতে টিক-টিক করে দশটা বেজে যাচ্ছে, রাত্রিকালীন সময়। জঙ্গলের গোপন আস্তানায় তিনটা ছেলেপিলে নিয়ে বসে আছে কালাম। উঠোনের চৌকিতে চুপচাপ বসে আছে সে। তার সামনে এক পেয়ালা ধোয়া উঠা মালাই চা। পেয়ালার হাতলটা দু’আঙ্গুলে পেচিয়ে সোজা ঠোঁটের কাছে আনে, হালকা একটা ফু দিয়ে ছোট্ট চুমুক দেয়। আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে কালাম। চতুর মস্তিষ্কটা প্রচণ্ড আরাম বোধ করে।

– চাছা?

চাচার বিকৃত সম্বোধনে একটু বিরক্ত হয় কালাম। চোখ বন্ধ রেখেই মাথা নেড়ে সায়সূচকে ইশারা করলো, তা দেখে ছেলেটা একটু পুলকিত হলো। বাকি দুজনের দিকে একবার করে চেয়ে নিয়ে এবার মূখ্য কথায় ফিরলো। কন্ঠে একটু সতর্কতা মাখিয়ে একবুক ভয় নিয়ে বললো,

– বাইরেত্তে এট্টু ঘুইরা আহি? হেই কহনতে কামলা খাটতাছি চাছা, এট্টু বাইরে যাইতে চাইতাছি। এট্টু যাই?

সাথে-সাথেই দুপাশ থেকে কনুই গুঁতা খেলো ছেলেটা। তার দুপাশে থাকা দুজন ছেলে আরো কিছু বলার জন্য তাগাদা দিলো। ছেলেটা ইশারার গুঁতা খেয়ে আমতা-আমতা করে বললো,

– না মানে, হইছে কি চাছা, বিল্লাল আর মফিজও আমার লগে যাইতে চায়। আপনে যুদি —

একটানা চুমুক দিয়ে পেয়ালাটা নামিয়ে রাখলো কালাম। চোখদুটো বন্ধ করে যোগাসনের মতো বসে আছে সে। গলাটা গম্ভীর করে খড়খড়ে সুরে বললো,

– যেতে চাস যাবি। কিন্তু, গোসল ছাড়া এই আস্তানায় ঢুকবি না।

কথাটার গভীর অর্থটা অন্যকেউ না বুঝলেও ওরা তিনজন ঠিকই বুঝলো। রাতের এই নিরিবিলি সময়ে ফূর্তি করতে চাচ্ছে ওরা, এসব বিষয়ে হস্তক্ষেপ দেখায় না কালাম সরদার। একসময় সেও যৌবনকালে এসব নিয়ে মত্ত ছিলো, বিভিন্ন ভাবে সিনেমার টিকিট যোগাড় করে নানা অসাধু কাজ করতো, তাও সেটা লোকলজ্জার চক্ষু এড়িয়ে। তার সঙ্গী-সাথীরা নানাভাবে ধরা পরলেও সে নিজে কখনো ধরা পরেনি। ব্যাপারটা কাকতলীয় হলেও চরম সত্যি। ঠোঁটে ঝলমলে হাসিটা কায়েম রেখে বাবু, বিল্লাল, মফিজ উঠে গেলো। তিনজনই খুশীতে গদগদ হয়ে যেতে ধরলে পেছন থেকে গাম্ভীর্য সুরে বলে উঠলো,

– রমজানের ফার্মেসীতে যাবি না। ধরা পরবি। মকবুইল্লার দোকানে ওইসব পাওয়া যায়। আর শোন, যদি কেউ কেলেঙ্কারি করতে গিয়া ধরা পরোস! একেকটার ক’ল্লা আলাদা থাকবো, সাবধান। মাথা কোনদিকে, বডি কোনদিকে, হদিশও পাবি না।

ভয়ে-বিষ্ময়ে তিনজন একে-অন্যের দিকে তাকালো। একসঙ্গে ঢোক গিলে কালাম সরদারের কাছ থেকে বিদায় নিলো তারা। পুরো আস্তানায় শুধু জেগে আছে কালাম, বাকিসব গভীর ঘুমে।লুঙ্গি ও কোমরের চিপা থেকে ফোন বের করলো, বাটন ফোনটা টিপে কল করলো সে। পেয়ালাটা আবার উঠিয়ে চুমুক দিতে নিলে ওই মূহুর্ত্তেই রিসিভ হলো কলটা। বিপরীত পাশ থেকে মার্জিত ও সভ্য সূচকে বললো,

– হ্যালো,

উত্তর না দিয়ে বেশ জোরে চুমুক দিলো কালাম। ভাবভঙ্গি এমন, যেনো চা খাওয়াটাই প্রধান কাজ, বাকিসব পরের ব্যাপার। হঠাৎ সে খেয়াল করলো, একটা ‘ হ্যালো ‘ বলার পর আর কোনো শব্দ আসছেনা। চায়ে শেষ চুমুকটা দিতেই বিদঘুটে হাসি দিলো কালাম। হাসতে-হাসতে লুঙ্গির কোঁচে কপাল মুছে বললো,

– ভয়ে জবান বন্ধ হইলো নাকি?

এবার শক্ত গলায় জবাব এলো,

– জানো-য়ারের সাথে কথা বলতে ঘেন্না করে।

একটু থামলো কালাম, হঠাৎ নিরবতা চিঁড়ে হো-হো হাসির পৈশাচিকতা ফুটে উঠলো। কিছুক্ষণ পর হাসি থামতে-থামতে গম্ভীর হলো সে, কন্ঠ তীক্ষ্ম করে বললো,

– মুখ সামলে কথা বলবি। তোর চৌদ্দগোষ্ঠী শেষ করতে আমার এক মিনিটের ব্যাপার! বেশি পাওয়ার দেখাতে যাবি, ওমনেই মা’রা।

তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো মাহতিম। হাসিটা থামিয়ে ডিরেক্ট তুই-তোকারি করলো সে, পুরো বেপরোয়া ভঙ্গিতে গর্জে উঠলো তখন,

– আমার চৌদ্দগোষ্ঠীর ভেতর তোর নাতনী বাদ নেই। মুখটা তুই সামলে কথা বলবি! তোর আলগা পাওয়ার আমাকে দেখাতে আসিস না।

থামলো না কালাম। ঝাঁঝের সাথে বলে ফেললো,

– তোর ওই পাওয়ার আমার বা* ছিঁড়বে। শা’লা জানো’য়ারের বাচ্চা! তুই এইবার খালি আমার সামনে আয়, তোর বুকের কলিজা আমি দুই হাতে কু’টিকু’টি করবো! তুই আমাকে ঢপ খাইয়েছিস না? আমার চোখে পট্টি মেরে এতোগুলো দিন চালাকি করেছিস, তোকে তো আমি বিনা সুদে ছাড়বো না। তুই একবার শুধু আসবি! তোর যে কেমন করুণ দশা করবো, রাস্তার শেয়াল-কুত্তাও তোকে শুঁকতে আসবেনা!

রাগটা একটু বেসামাল হয়ে যায়, ওমনেই ধাম-ধাম করে বিকট একটা আওয়াজ হলো। সেই আওয়াজে পুরোপুরি হকচকিয়ে যায় কালাম। ভ্রুঁ কুঁচকে বিষয়টা বুঝবার চেষ্টা করতেই তীব্র ও ক্ষিপ্র গলায় চেঁচিয়ে উঠলো মাহতিম, তার ঝাঁঝপূর্ণ প্রতিটা শব্দ-বাক্য-কথা শুনে বাধ্য হয়ে ফোনটা কান থেকে দূরে সরালো সে। মাহতিমের তেজপূর্ণ কথা তখনো থামেনি,

– তুই আমার সাথে চালাকি করার চেষ্টা করবি না শয়তান! তুই সেদিন আমার হাত থেকে বেঁচে গেলেও তোকে খোঁজা আমি বন্ধ করিনি। তোর জঘন্য কর্মকাণ্ডের ভেতর আমার বউকে ইনক্লুড করবি না, করলেই তুই শেষ! আমার নৃশংস রূপ তোকে খু’ন করে ছাড়বে! তোকে জ’বাই করতে কোনো আইন মানবো না, এই মাহতিম তোকে শেষবারের মতো শাষিয়ে দিচ্ছে! তুই আমার সাথে শ’ত্রুতা করতে চাস, করবি! আমি কোনো বাধা দেবো না। শুধু আমার মেহনূরের কাছ থেকে একশো হাত দূরে থাকবি, ওর কানের কাছে উলটাপালটা কিছু ঢুকালেই তোর জিহবা টেনে ছিঁড়’বো! আমি মাহতিম আনসারী তোর মতো জানো’য়ারকে ভয় পাইনা, তোর পুরো কাহিনী কোন্ স্টাইলে পণ্ড করি দেখিস!

এরপর আর কথা হয়নি মাহতিমের সাথে। মেহনূরকে গ্রামে পাঠানোর পরও মাহতিম কি করে নিশ্চিন্তে আছে, এটারই হিসাব মিলাতে পারছেনা কালাম। তার মনেহচ্ছে, মাহতিম এবার এসপার-ওসপার সংঘর্ষ করতে চাচ্ছে। তার চেয়ে বড় কথা ওই মাহতিমকে চুপ করে রাস্তা থেকে সরাতে হবে। মাহতিমকে আগেই যদি মে-রে ফেলা যায়, তাহলে এখানে চিন্তা নেই। দ্রুত সজিবকে জানাতে হবে, ওদের পাকাপোক্ত প্ল্যান এবার ফলাতে শুরু করুক।

.

আভিজাত্য কেবিনের শীতল এসিতে বসে আছে রজনী। পুরো কেবিনের চর্তুপাশটা কাঁচের দেয়ালে ঘেরা। চারপাশে নানা নান্দনিক জিনিস স্থান পেলেও শৌখিনতার ঘাটতি নেই। চারকোণা বাদামি রঙের ডেষ্কে বসে আছে সে, তার সামনে রকিং চেয়ারে ভাবুক ভঙ্গিতে বসে আছে তার ভাই। দুজনের ভেতর মধ্যকার আলোচনা একটু আগে শেষ হয়েছে, এখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের মূহুর্ত চলছে। সিদ্ধান্তটা নেবেন তার ভাই। গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো শোনার জন্য উৎসুক হয়ে আছে রজনী। তার দৃঢ় বিশ্বাস, তার ভাই কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেয়না। এমনকি ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তার নেই বললেই চলে। অনেকক্ষণ পর ইন্টারকম বাজিয়ে দু’কাপ কফির অর্ডার দিলো, কফিটা এসে পরতেই নিজের বোনকে সেটা খেতে বললো। যদি কফির জায়গায় বিষও খেতে বলতো, তাও নির্দ্বিধায় ‘ হু-হা ‘ না করে খেয়ে ফেলতো রজনী। ঠিক এমনই অটল বিশ্বাস কাজ করে তার ভাইয়ের প্রতি। কালো মগটা ডানহাতে তুলে চেয়ারে একটু পিঠ হেলে দিলো, বোনের দিকে সরল চাহনিতে দৃষ্টি দিয়ে কফিতে চুমুক দিলো ভদ্রলোক। শান্ত মেজাজের সাথে বললো,

– রিভেন্ঞ্জটা ভুলে যা রজু।

কফিতে চুমুক দিতে পারলো না রজনী। ভাইয়ের দিকে চমকানো দৃষ্টিতে তাকালে এক চুমুক দিয়ে মগটা ডেষ্কে রাখলো ভদ্রলোক। চেয়ারের হ্যান্ডেলদুটোয় কনুই লাগিয়ে দুহাতের আঙ্গুলগুলো আবদ্ধ করলো সে, গলা খাঁকাড়ি দিয়ে বললো,

– সবসময় রিভেন্ঞ্জের জন্য মুখিয়ে থাকবি না। এটা খারাপ। এখন অনাকে এব্রডে পাঠিয়ে দে। ওর ব্যাপার নিয়ে এইসময় চিন্তা করলে তুই আমার ব্যাপারটা ঠিকঠাক মতো দেখতে পারবি না। কথা বুঝেছিস?

রজনী চোখ নিচু করে বললো,

– জ্বী ভাইজান।

রজনীর থমথমে মুখ দেখে নরম হলো ভদ্রলোক। একটু ঝুঁকে এসে বললো,

– অতিরিক্ত সফট্ হওয়াটা ঠিক না রজু।

তৎক্ষণাৎ চোখ তুললো রজনী ইবনাত। ভাইয়ের দিকে চোখাচোখি দৃষ্টি রেখে বললো,

– আমি আর আপনি দুজনই অনার উপর হাত তুলিনি ভাইজান। কোনোদিন না! শুধু একটা ভুলের জন্য ওকে পিটিয়ে জখম করে দিলো? ওর পিঠের দাগগুলো আজও মিশেনি ভাইজান! পায়ের একটা নখ এখনো নষ্ট হয়ে আছে, আপনি এখনো চুপ থাকবেন?

– দোষটা কি অনার ছিলো না?

– না, ছিলো না। ওর বয়সটাই ওরকম। মা ছাড়া বড় হয়েছে, আপনার আদরটাও ওর কপালে জুটেনি, আমিও আপনার বিজনেসের কাজে ব্যস্ত থাকতাম, সেখানে ওর এরকম হওয়াটা কি স্বাভাবিক না? তাছাড়া ভুল করেছে বলে এতো বড় শা’স্তি দিবে? একটা মেয়ের গায়ে সোজা হাত? তাকে মা’রপিট? আপনি আমাকে না থামালে এতোদিনে ল্যা’ঠা চুকিয়ে দিতাম ভাইজান। অন্তত লকআপের হাওয়া খাওয়াতাম।

– সবসময় বাড়াবাড়ি ভালো না রজু। একহাতে কখনো তালি বাজে না এটাও মাথায় রাখবি। প্লিজ, সিচুয়েশনটা বিগড়াতে যাস না, অনাকে রেডি করে পাসপোর্ট বুঝিয়ে দে।

– জ-জজ্বী, ভাইজান। কথাটা বলতে যেয়ে তোতলে ফেললো রজনী।

.

আজ গুণে-গুণে পন্ঞ্চম দিন। প্রায় পঁয়ত্রিশ ঘন্টা যাবৎ যোগাযোগহীন। পুরোপুরি চ্ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ঢলে আছে মেহনূর। একটা মানুষ কিভাবে নিখোঁজ হয়ে যায়? কোনো সাড়া নেই, কোনো খবর নেই, কোনো খোঁজ নেই! মাহতিম যে ভেতরে-ভেতরে কিছু একটা নিয়ে খুব মশগুল থাকতো, সেটার জন্য কি খারাপ কিছু হয়েছে? তাড়াতাড়ি নিজেকে শান্ত করে মেহনূর। এসব কুলক্ষণ নিয়ে ভাবলে সে স্থির থাকতে পারেনা। অস্থির হলেই রুমের ভেতর পায়চারী থাকতে থাকে, পা দুটো ব্যথায় বিষিয়ে উঠলেও পায়চারী থামেনা। তার কাছে নোমানের নাম্বার ছাড়া আর কারোর নাম্বার নেই। নোমান ছেলেটাও ফোন বন্ধ করে রেখেছে। সৌভিককে একবার কল দিবে? না না, সৌভিককে কল দিলে নীতিরাও টেনশনে পরবে। ওখানে মারজা চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছে। দাদাভাইয়ের সাথে কথা বলে সুরাহা চাইবে? ধ্যাত্! তাও তো হয় না। দাদাভাইও একটা জরুরী কাজে শহরে গিয়েছে। কবে ফিরবে কেউ জানে না। মাথা খাটাতে পারছেনা মেহনূর। কিচ্ছুনা সহ্য হচ্ছেনা। পায়চারী করতে-করতে হঠাৎ তার খোপাটা আলগোছে খুলে গেলো। ফোনটা হাতে নিয়ে আবারও দুটো নাম্বারে পরপর কল দিলো সে। মেয়েলী সুরে লাগাতার একই জবাব, ‘ আপনি যে নাম্বারটিতে কল করেছেন, তা এই মূহুর্তে বন্ধ আছে। ‘ ঠোঁট শক্ত করে ফোনটা ঢিল মা’রতে নিলো, কিন্তু মা’রলো না। আস্তে করে ফোনটা বিছানার দিকে ছুঁড়ে দিলো। সাংঘাতিক কিছু হয়েছে, নাহলে ফোনটা শুধু-শুধু বন্ধ থাকেনা। নোমানের ফোন যেখানে হরহামেশা খোলা থাকে, সেখানে অদ্ভুতকাণ্ডের মতো বন্ধ। আর কতোক্ষণ? পাঁচটা দিন যাবৎ নিজেকে পাগল-পাগল লাগছে। এলোচুলেই দক্ষিণ-টু-উত্তর দিকে পায়চারী করছে সে। এলোচুলগুলো হাঁটার জন্য কোমরের সাথে বারি খাচ্ছে।স ময়ের প্রতিটি কাটা তো এগুচ্ছে, কিন্তু কাটাগুলো সূইঁয়ের মতো ভয় খুঁচিয়ে আনছে। নাস্তার জন্য ডাকতে এসে পায়চারীর দৃশ্য দেখে প্রচণ্ড ধাক্কা খায় সাবা, মেহনূরকে উদভ্রান্তের মতো অস্থির দেখে চটজলদি রুমে ঢুকে। সরাসরি মেহনূরের সামনে এসে দুই বাহু ধরে চিন্তার সুরে বলে,

– সমস্যা কি? তুই এভাবে দৌঁড়াচ্ছিস কেনো? তোকে যে নিচ থেকে ছোটমা ডেকেছে, তুই শুনেছিস? কি হয়েছে মেহনূর?

সাবার দিকে তাকিয়ে অনবরত হাত কচলাচ্ছে মেহনূর। কি বলবে, কিভাবে বলবে কিছুই মাথায় ঢুকছেনা। মাথাটা ডানে ঘুরিয়ে বিছানায় থাকা কালো ফোনটার দিকে তাকালো। এদিকে সাবা উত্তর না পেয়ে মেহনূরের থুতনি ধরে নিজের দিকে ঘুরালো। স্বাভাবিক কন্ঠে আশ্বস্ত সুরে বললো,

– বলবি না কি হয়েছে? দেখে তো মনে হচ্ছে এখুনি কেঁদে দিবি। বুবুকে চাচ্ছিস?

ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে মেহনূর। বড় করে ঢোক গিলতেই চোখ বন্ধ করে সে, আজ চিকন-চিকন ভ্রূঁদুটো রাগে নয়, বরং হতবিহ্বল হয়ে কুঁচকে গেছে। ঠোঁটটা থরথর করে কাঁপতেই চোখের পাপড়ি চুয়ে একফোঁটা পানি বেরুলো। তা দেখে দারুণ উদ্বেগে চন্ঞ্চল হলো সাবা, মেহনূরের বাহুজোড়া মৃদ্যু ঝাঁকুনি দিয়ে বললো,

– মেহনূর, কিচ্ছু লুকাস না! তাড়াতাড়ি বল কি হয়েছে? ভাইয়ার খোঁজ এখনো পাসনি? কিছু হয়েছে? কিছু তো বল্ গা’ধা!

ভেজা পাপড়ি খুলে সামনে তাকালো মেহনূর। কিছু গিয়েও স্থির হয়ে যায় সাবা। মূহুর্ত্তের ভেতর চোখের সাদা অংশটা লাল হয়ে গেছে মেহনূরের, নাকের ডগাটা লাল হতে শুরু করেছে। মেহনূর আগের মতো ফুপিয়ে কাঁদেনি , না সে হাউমাউ করে উঠেছে। তার চেহারায় ভয় ছেয়ে থাকলেও বাইরে থেকে পুরোপুরি শক্ত। থরথর ঠোঁটে, লালবর্ণ চোখ দিয়ে যেহারে ভয় নিংড়ে আসছে, তাতে সংবাদটা শুভ লাগছেনা। থুতনি ছেড়ে দিলো সাবা। কাধদুটোতে হাত রেখে সাহস জুগিয়ে বললো,

– তুই ভয় পাচ্ছিস?

মেহনূর পূর্ণদৃষ্টিতে সাবার দিকে তাকালো। মৃদ্যুস্বরে বললো,

– না।

কন্ঠের শঠতা দেখে প্রসন্ন হলো সাবা। শক্ত জমিনে থাবার মতো বাজিয়ে বললো সে,

– ভাবছিস ভাইয়া বাঁচবে কিনা? এটা নিয়েই তো ভয় পাচ্ছিস, ঠিক বলেছি কিনা বল্।

কথাটায় বুলেটের মতো ধাক্কা খেলো মেহনূর। ভয়ের দলাটা ঠেলেঠুলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

– হ্যাঁ, পাচ্ছি। খুব বাজে ভাবে পাচ্ছি। তোমাকে মিথ্যা বলে লাভ নেই। তুমি সবসময়ের মতো আজও মন পড়ে ফেলেছো। আমাকে চিন্তামুক্ত থাকতে বোলো না সাবা বুবু। উনাকে যেই পযর্ন্ত চোখের সামনে না দেখবো, না ছুঁবো, তোমার কোনো কথা আমি বিশ্বাস করতে পারবো না। তুমি আমাকে একা ছাড়ো বুবু, একা থাকতে চাই।

সাবা আর কিছু বললো না। কোনোপ্রকার সহমর্মিতার প্রয়োজন নেই। এই মূহুর্তে সহমর্মিতা দেখানোর চেয়ে মেহনূরের সাহসিকতা দেখতে ইচ্ছুক। এই মেহনূর একসময় চরম লেভেলের গা’ধা ছিলো, এটা কেউ বিশ্বাস করবে না। গা’ধা বলাও ভুল হবে। তার গালে কঠিন ভাবে চ’ড় মা’রলেও উফ আওয়াজ করতো না। আড়ালে কাঁদতো, নয়তো নিরব হয়ে যেতো। সময়ের সাথে, পরিস্থিতির চাপে মানুষের কত কি পাল্টায়! স্বভাব-চরিত্র-আচার-আচরণ সবকিছু পালটে যায়। পালটে যায় পুরোনো খোলসের ব্যক্তিত্ব। নিজেকে শক্ত-সামর্থ-সাহসী বানাতে গিয়ে ধারণ করে নতুন অস্তিস্ত্ব। সেই খোলসের আড়ালে ঢাকা পরে গোবেচার ব্যক্তিত্বটা। দূর্বল ব্যক্তিত্বের মানুষরা সমাজের অনুপযোগী জীব, সেটা মানুষই তাদের ক্ষণেক্ষণে বুঝিয়ে ছাড়ে।

রুম থেকে নিঃশব্দে বেরুতে নেয় সাবা। ভেজা চোখ নিয়ে বিছানায় বসে মেহনূর, দৃষ্টিটা মেঝের দিকে নিক্ষেপ করা। দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে বাইরে যেতেই একটু থামলো সাবা, মাথা ঘুরিয়ে মেহনূরের উদ্দেশ্যে বললো,

– বাইরে বৃষ্টি পরছে। আম্মার কাছে শুনেছি, বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে দুয়া করলে সেটা নাকি কবুল হয়।

চট করে দরজার দিকে তাকালো মেহনূর। দরজায় আর সাবা নেই, তার চলে যাওয়ার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। হাতের তালু দিয়ে চোখ মুছলো মেহনূর, তার পিছনে থাকা জানালাটা বন্ধ। বাইরে যে তুমুল আকারে বৃষ্টি পরছে সেটা বন্ধ জানালার জন্য খুব একটা বোঝেনি। বিছানায় পুরোপুরি উঠে সোজা জানালা খুলতে চলে গেলো। জানালাটা খুলে দুহাতে টান দিতেই কাঠের দ্বারদুটো খুলে গেলো। ঝপ-ঝপ করে একঝাঁক বৃষ্টির ছাঁট তার শাড়িতে পরলো। লাল-নীল-গোলাপী রঙের মোটা পাড়টা বৃষ্টির ছোঁয়ায় ভিজে উঠলো, ডানহাত দিয়ে বাড়তি পানিটা ঝাঁট দিলো মেহনূর। জানালা দিয়ে মুষলধারার শীতল বর্ষণের দিকে তাকালো। গাছগুলো স্নান করে মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে, মাটির ভিজা গন্ধও মৃদ্যু-মৃদ্যু পাচ্ছে। খোলা জানালা গলে দুহাত বাড়িয়ে দিলো মেহনূর, ভারী-ভারী বৃষ্টিফোঁটা বরফের মতো তার হাতদুটো ভিজিয়ে দিচ্ছে। গভীর করে দম নিয়ে চোখ বুজলো সে, হাতদুটো মুঠো করতেই চোখ ভিজে উঠলো। ভেতরের সবকিছু উজাড় করলো ওই মুঠোর মধ্যে, প্রতিটা কথা আওড়াতে-আওড়াতে চোখ থেকে টপটপ অশ্রু ঝরছিলো তার, তবুও থামেনি মেহনূর, সবটুকু কথা ব্যক্ত করতে অস্থির হলো সে,

– আমার জীবনে এরকম পরিস্থিতি কখনো আসেনি। আমি নিজের জন্য কষ্ট পেলেও আজ ভেঙ্গে যাচ্ছি। আমি খুবই দূর্বল, খুব বেশিই দূর্বল। এই দূর্বলতা তাঁকে না দেখা পযর্ন্ত কাটবে না। আমি শুধু জানি, আমি তাঁকে প্রচণ্ড ভালোবাসি। এই ভালোবাসার ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। আমার মধ্যে যেই ভয় ভর করেছে, তা দয়াকরে দূর হোক। আমার স্বামী, আমার অভিভাবক, আমার সবকিছু সুস্থ ভাবে ফিরে আসুক। সে আমাকে কোনোদিন কষ্ট দেয়নি, কোনোদিন আমাকে নিচু চোখে দেখেনি। আমার মধ্যে হাজারো খুঁত থাকলেও তাঁর কাছে অপদস্থ হইনি। আমাদের সাক্ষাৎ খুবই অল্পদিনের হতো, বারবার সে দূরে চলে যায়। আমি চাইলেও বাধা দিতে পারিনা। আজ সে কোথায় আছে আমি জানি না। যেই ফোন দিয়ে কিছুদিন আগেও কথা বলেছি, সেই ফোনটা পাঁচটা দিন ধরে বন্ধ। আগে কখনো ফোন বন্ধ হয়নি। আমি তাঁকে কোনোদিন অসভ্য বলবো না, সে একবার ফিরে আসুক।

মুঠো ভরে-ভরে নিচ দিয়ে লম্বাকারে পানি পরছে। বৃষ্টি যেনো মুঠোভর্তি করার মহাআনন্দে আছে। হঠাৎ পেছন থেকে রাগ দেখিয়ে বললো,

– এ্যাই মেহনূর! তুই বসে-বসে বৃষ্টির পানি হাতাচ্ছিস? আবার ঠান্ডা লাগতে চাস? তাড়াতাড়ি হাত ভেতরে আন।

কানে মায়ের ডাক শুনে চমকে গেলো মেহনূর। অতিদ্রুত নিজেকে ধাতস্থ করে হাত ভেতরে ঢুকালো। আঁচলে মুছতে-মুছতে মাথা না ঘুরিয়ে বললো,

– তুমি যাও, আমি আসছি। হাত বাইরে দেবো না।

মাহমুদা একপলক মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে নিরুত্তাপ কন্ঠে বললেন,

– মনে থাকে যেনো। খেতে আয়, তোর বড়মা কুমড়া পাতার বড়া বানিয়েছে। দেরি করিস না।

মাহমুদা চলে যেতেই মাথা ঘুরালো মেহনূর। মাহমুদার গমন দেখে জোরে নিশ্বাস ছাড়লো, খেতে একদম ইচ্ছে না করলেও কথা রাখার জন্য খেতে হবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দুহাত মাথায় উঠালো মেহনূর, এলোচুলটা খোপা করতেই হঠাৎ ‘ টুট-টুট ‘ বিপ হলো। আয়নার ভেতর দৃষ্টি থমকে চোখের চাহনি বড়-বড় হতে লাগলো। মাথায় খোপা পাঁকানো হাতদুটো শক্ত হয়ে আছে, বুকের হৃদস্পন্দনটা একধাপ-একধাপ করে বাড়ছে। এটা কি ভ্রম না সত্যি? কল্পনা না বাস্তব? অতীত না বর্তমান? কন্ঠনালী শুকিয়ে বক্ষতালু পযর্ন্ত শুকিয়ে উঠলো তার। আয়না থেকে চোখ সরিয়ে বামে তাকালো মেহনূর, বিছানার উপর কালো ফোনের স্ক্রিনটা জ্বলে আছে। এটাও ভ্রম না, কল্পনা না, অতীতও না। এটা চূড়ান্ত কোঠায় সত্য যে ফোন বেজেছে। নোটিফিকেশনের টোনটা স্পষ্ট কানে শুনেছে। মাথা থেকে দুহাত নামিয়ে ফেললো সে, বাঁদিকে সম্পূর্ণ ঘুরে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো, ডানহাত এগিয়ে ফোন হাতে নিতেই ঢোক গিলে নিলো। ফোনের উপর ‘ নিউ ম্যাসেজেস্ ‘ লিখা। সেখানে বৃদ্ধাঙ্গুল রাখলো মেহনূর, পুরো স্ক্রিনটা বদলে গিয়ে ম্যাসেজের ওয়ালটা ওপেন হলো। সেখানে একটা অপরিচিত, আন-সেভ নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এসেছে। সম্পূর্ণ ইংরেজি কির্বোডের ইংরেজি বর্ণমালায় ক্যাপিটাল অক্ষরে লিখা,

NICHE ASHO. KAWKE BOLTE JEYONA. ANTICEPTIC LIQUID NIYE DRUTO ASHO PLEASE.

DON’T PANIC.

NEW SIM.

M. ANSARI

– চলমান .

#FABIYAH_MOMO .