মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব-৬৪

0
1044

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৬৪.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

সারারাত ঝুম বৃষ্টি শেষে দিনের আলো ফুটলো। পূব আকাশে আস্তে-আস্তে সূর্যের চাকা উঠলো। ভেজা মাঠ-ঘাট সূর্য-কিরণে চিকচিক করছে। কচু পাতায় শিশির জমে মুক্তোর মতো জ্বলছে। পাখির মিষ্টি-মধুর কিচির স্বরে প্রকৃতি জেগে উঠছে। বাতাসের দোল খেয়ে গাছের পাতাগুলো মর্মর ধ্বনি তুলছে। একফালি সোনা রোদ্দুর জানালার ফাঁক গলে ঢুকলো। পর্দাদুটোর মাঝ দিয়ে সেই আলোটা মুখে এসে পরলো। দিনের আলোটা চোখে পরতেই ঘুম ভাঙলো মেহনূরের। চোখের পল্লবজোড়া বেশ ভারী-ভারী লাগছে। সম্ভবত রাতে কান্নার জন্য চোখদুটোর এই দশা। কিন্তু আজ মন খারাপের রেশটুকু কেটে গেছে। সকালের নির্মল হাওয়াটা বুক ভরে-ভরে কিছুক্ষণ টানলো মেহনূর, মনটা একদম ঝরঝরে হয়ে গেছে। এতো শান্তি, এতো প্রফুল্ল মন, আগে কোনোদিন টের পায়নি। গাছের নতুন পাতার মতো সবকিছু সতেজ লাগছে। শোয়া থেকে উঠে বসতেই ব্যকুল চোখে একজনকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু সেই মানুষটা এতো সকাল-সকাল কোথায় হারিয়ে গেলো? লম্বা হাই তুলে বিছানা থেকে নেমে পরলো মেহনূর, শোয়ার জন্য বিগড়ে যাওয়া চুলগুলো নতুন খোপা করে বাইরে পা দিলো। সকালের নরম রোদটা মেহনূরের গায়ে মোলায়েম ভাবে ছুঁয়ে দিলো, আদুরে উষ্ণতায় শরীর চনমন করে উঠলো তার। এখনো কটেজের দরজাগুলো খুলেনি, তার মানে ঘুমের আরামটা কারোরই ভাঙেনি। সিড়ির ধাপ পেরিয়ে একটু সামনে এগোলো মেহনূর, পায়ের নিচে নরম সবুজ ঘাসগুলো সুড়সুড়ি দিচ্ছে। হাত-মুখ ধুয়ে শাড়ির আঁচলে ভেজা মুখটা মুছতে-মুছতে নিরিবিলি রেসোর্টের পুকুরপাড়ে গেলো সে। বৃষ্টির কারণে পুকুরপাড়ের রাস্তাটা স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে। এমনেতেই জায়গাটা গাছ-গাছালির জন্য ভয়াবহ অন্ধকার। তার উপর সূর্যের আলো পড়ে না। কাদা বাঁচিয়ে পা ফেলতেই দুহাত এগিয়ে ঝোঁপের কুন্ঞ্জটা সরিয়ে দিলো, তখনই চোখ ধাঁধিয়ে এক পশলা আলো মেহনূরের চোখ বুজিয়ে দিলো। ঝোঁপটা পেরিয়ে চোখ খুললো মেহনূর, পুকুরপাড়ের দিকে স্পষ্টভাবে তাকাতেই দূর থেকে সবুজ টিশার্টটা নজর কাড়লো। শান বাঁধানো পাকা জায়গায় একা বসে আছে মাহতিম। সাতসকালে একা বসে থাকাটা বিলক্ষণ মনে হচ্ছে না। ঘুম থেকে উঠেই এখানে চলে আসলো? কিছু কি হয়েছে? কালরাতেও মাহতিম কোনো কথা বলেনি। মাহতিমের মধ্যে এরকম নিঃশ্চুপ আচরণ বোধগম্য হচ্ছে না। মেহনূর চুপচাপ পা বাড়িয়ে মাহতিমের পেছন গিয়ে দাঁড়ালো। পেছন থেকে মাহতিমের চোখদুটো ধরার জন্য যেই হাত বাড়ালো, তখনই খপ করে হাতদুটো ধরলো মাহতিম। একবারও পিছু না তাকিয়ে ওইভাবেই মেহনূরের হাত ধরে বললো,

– এমন ছোটোখাটো চালাকি আমার বেলায় খাটে না।

হাত ছেড়ে দিলো মাহতিম। আবারও নির্জনতায় ডুবে গেলো চারপাশ। মাহতিমের দৃষ্টিজোড়া পুকুরের মৃদ্যু দোলায়মান স্রোতের উপর অটল। বিশেষ ভাবনায় মত্ত মাহতিমকে বিরক্ত করলো না মেহনূর। মাহতিমের বাঁ-পাশটায় স্থান গেড়ে শান্তভাবে বসলো। মাহতিমের চওড়া-প্রশস্ত কাধটায় মাথা রেখে তার হাতটা পেঁচিয়ে ধরলো। মেহনূরের কাণ্ডকারখানায় কোনো ভাবাবেগ দেখালো না মাহতিম। অনতিকাল পেরুতেই মেহনূর অর্ধৈয্যের গলায় বলে ফেললো,

– স্বাভাবিক আচরণটা করছেন না কেনো? আমিতো আপনাকে ভুল বুঝিনি। যেটা সত্য, যেটা ঘটতো, সেটা নিয়ে আপোস করার কোনো কারণ ছিলো না। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। আপনি আমার উপর কেনো রেগে আছেন?

ঘাড়টা বামে ঘুরালো মাহতিম। বোধহয় মেহনূরের মুখটা দেখার একটুখানি প্রয়াস ছিলো। আবার মুখ ঘুরিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে শান্ত ভাবে বললো,

– আমি চুপ থাকলেই ‘ রেগে আছি ‘ ভাবো কেনো?

কাধ থেকে মাথা তুললো মেহনূর। মাহতিমের মুখের দিকে দৃষ্টি রেখে বললো,

– আপনি স্বাভাবিক আচরণ করছেন না।

এবার একসেকেন্ডও দেরি করলো না মাহতিম। কথার তোড়ে সঙ্গে-সঙ্গে মেহনূরের দিকে তাকালো। সত্যিই মাহতিমের হাব-ভাব স্বাভাবিক নেই। রাতেও এই ব্যক্তি এরকম হালে ফিরেনি। রাত পেরুতেই কি এমন হলো? কেনো সকাল-সকাল কাউকে না জানিয়ে একা বসে আছে? চোখের দৃষ্টি জ্বালাময় দেখাচ্ছে। কোনো ব্যাপার নিয়ে ভেতরে-ভেতরে ভীষণ ফুঁসছে। ঢোক গিলে একটু কাছে গেলো মেহনূর। ক্লিন শেভ বাঁগালটায় হাত রেখে আলতো গলায় জিজ্ঞেস করলো,

– আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন না?

একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মাহতিম ছোট্ট সুরে বললো,

– কোনোদিন অবিশ্বাস করিনি।

আবার প্রশ্ন ছুঁড়লো মেহনূর,

– তাহলে কেনো কথাটা লুকাচ্ছেন?

মাহতিমের পালটা উত্তর,

– তুমি এভাবে জিজ্ঞেস করোনি।

মেহনূর থামলো না। নিজেও উত্তাপের সাথে বললো,

– আজ জিজ্ঞেস করছি, এখন জিজ্ঞেস করছি, বলুন।

মাহতিম পুরোপুরি মেহনূরের দিকে ঘুরলো। মুখোমুখি হয়ে মেহনূরের অন্যহাতটাও নিজের ডান গালে রাখলো। ছটফট দৃষ্টির মাঝে নিজের শান্ত দৃষ্টিটুকু রেখে দিলো। মেহনূর অপেক্ষায় অধীর, মনের ভেতর উচাটন অবস্থা ধেয়ে-ধেয়ে বাড়ছে। ওই শান্ত চোখদুটো তাকে গভীরে টেনে নিচ্ছে। জিভে ঠোঁট বুলালো মাহতিম, একটু ধাতস্থ হয়ে বলতে শুরু করলো,

– যা বলবো সব মন দিয়ে শুনবে। শুধু শর্ত একটাই, যা বলবো, আজকের পর সবকিছু ভুলে যাবে। ওই ছোট্ট বুকটায় এসব মনে রাখার দরকার নেই। ঠিক আছে?

মাথা নাড়ালো মেহনূর। উত্তর পেয়ে বলতে থাকলো মাহতিম,

– তোমার বয়সটা চার, তখন তোমার বাবা মা:রা যান। একটা স্বাভাবিক মানুষের মতো নেচারাল ডে:থ হয়েছে। কেউ উনাকে মা:র্ডার করেননি বা, এই জাতীয় প্ল্যান-প্রোগ্রামও ছিলো না। হয়তো তোমার কানে এসেছে, তোমার দাদাভাই তোমার বাবাকে খু:ন করেছেন। এটা ভুয়া খবর। তোমার বাবা একজন সৎ মানুষ ছিলেন। কিন্তু উনার একটা বাজে অভ্যাস ছিলো, বলতে গেলে সেটার জন্যই উনার মৃ:ত্যু। উনি প্রচুর ধূমপান করতেন, যেটাকে এক্সট্রিম লেভেলের স্মোক করা বলে। প্রায়ই এটা নিয়ে তোমার মায়ের সাথে কথা কাটাকাটি হতো। তোমার মা রাগ করে বাপের বাড়ি চলে যেতেন। কিন্তু সময়ের সাথে-সাথে একদিন সেটা মানিয়ে যায়। তোমার মাও চুপচাপ সেটা সহ্য করতে শিখে গেলেন। বিদেশ যাওয়ার জন্য যেসব কাগজপত্র জমা দিয়েছিলেন, হুট করে সেটার খবর আসে। তোমার বাবা কোনোভাবেই বিদেশ যেতে রাজি ছিলেন না। অনেককিছুর পর যখন বিদেশের মাটিতে পাড়ি দিলেন, তখন তোমাদের বিলাসিতা আসতে শুরু হয়। সবই ঠিকঠাক মতো চলছিলো, কিন্তু একদিন চিঠির পাতায় খবর আসে তোমার বাবার লাংগ ইনফেকশন ধরা পরেছে। তখনই তোমার দাদা ছেলেকে দেশে আনার জন্য বন্দোবস্ত করেন। আটমাসের ভেতর তোমার দাদা সবকিছু ঠিক করেন ঠিকই, কিন্তু তোমার বাবা আর ফিরেন না। সেখানেই হার্ট স্ট্রোক করে মা:রা যান। সবচেয়ে বেশি তোমার মা ভেঙ্গে পরেন। তোমার দাদা হয়তো অবশ্য তোমার বাবাকে দুচোখে সহ্য করতে পারতেন না। উপর্যুক্ত কারণও ছিলো। তোমার দাদাভাই মেয়েমানুষ নিয়ে ফূর্তি করতেই হাতে-নাতে একদিন ধরা পরেছিলেন। সেটার ক্ষোভ তোমার বাবা ভালোমতোই ঝেড়েছিলো। তোমার দাদাটা তোমাদের সবগুলো বোনকে আদর করেছেন, এ বিষয়ে কোনো ডাউট নেই মেহনূর। আজ শুধু এটুকুই বলবো, তোমার দাদার জন্যই তোমাকে পেয়েছি। তাকদির কিভাবে আমাদের দুজনকে মিলিয়েছে সেটা নিয়ে বিস্তারিত বলতে গেলাম না। আমি তোমাকে চিনতাম না, তুমিও আমাকে চিনতে না। তোমার পরিবার আমাদের চিনতো, আমার পরিবার তোমাদের আত্মীয় বলে ভাবতো। তোমাদের বাড়িতে তোমাকেই আমার পছন্দ হলো, তাও আবার বয়সে তুমি ছোটো। বিয়েটাও করে ফেললাম, ওমনেই পুরোনো কেস রি-ওপেন হয়ে কাজে চলে গেলাম। লাইফ কিভাবে ঘুরছে দেখেছো? আমি তোমার উপর রাগ করিনি। লাইফের ইউনিক স্ট্র‍্যাটেজিটা নিয়ে চিন্তা করছিলাম।

চোখ বন্ধ করে বড় একটা দম নিলো মেহনূর। বুক থেকে ধীরেসুস্থে নিশ্বাসটা ঝেঁটিয়ে বের করলো। চোখ খুলে গলা ভিজিয়ে মাহতিমের দিকে তাকালো। বাতাসের ঠান্ডা মোহটা চর্তুদিকে ছড়িয়ে পরেছে। মেহনূর স্বচ্ছ গলায় বললো,

– আমি জীবনেও এই অধ্যায় ঘাঁটতে চাই না। আজকের মতো এখানেই বন্ধ হোক। একটা খারাপ মানুষের বিনিময়ে আপনাকে পেয়েছি, আমার কি এতে খুশি হওয়া উচিত না?

বিষণ্ণতায় চূর্ণ হলেও ম্লান হাসি দিলো মেহনূর। ধীরে-ধীরে হাতদুটো গাল থেকে নামালো। মাহতিম মূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে হঠাৎ তীব্র বেগে এক টান মারলো! মাথার পেছনে চাপ দিয়ে বুকের মধ্যে মিশিয়ে নিলো। আচমকা কাণ্ডে প্রচণ্ড বিস্মিত হয় মেহনূর, বুকটা যেনো ধড়াস করে কেঁপে উঠতেই দুরু-দুরু করে ছুটছে। দুচোখ বন্ধ করতেই অতলস্পর্শী বাহুখানা তাকে দখলিস্বত্ব করলো। মেহনূরের পুরো অস্তিত্বটা বুকের সাথে মিশে রইলো। খুবই স্পষ্টভাবে ওপাশের দেয়াল থেকে হৃদ-স্পন্দনের শব্দ শুনছে। ঘড়ির কাঁটার মতো ধুকপুক-ধুকপুক করে বাজছে। আঙ্গুলের ফাঁকে-ফাঁকে সবুজ টিশার্টটা শক্ত করে ধরলো, দুহাতের বলয়ের মাঝে খামচে ধরে রইলো। টের পেলো, মাহতিমের একটা হাত সারা পিঠ জুড়ে ছুটছে। অন্য হাতটা চুলের চামড়ায় নরম স্পর্শ ছড়াতে ব্যকুল। দূরের কোনো গাছে বসে পাখি ডেকে উঠলো। ছন্দ কাটতে-কাটতে প্রকৃতি যেনো গরম করে তুললো। পাখির ডানা ঝাঁপটানির আওয়াজগুলো দুজনের কানেই যাচ্ছে। বাতাসের শীতল পরশগুলো হেলেদুলে শিহরণ জাগিয়ে দিচ্ছে। প্রকৃতির সরলতায় দুজন মানুষ যেনো অনুভূতির নির্যাস করছে। বাতাসের নিষ্ঠুর দোলায় খোপাটা আলগা হয়ে গেলো, পরপর জোরে ঝাঁপটা মেরে গোছাটা পুরোপুরি খুলেই দিলো। মেহনূরের পিঠ ডেঙিয়ে মাহতিমের হাত ঢেকে ছিটকে নিচে পরলো, মেহনূর সবটা টের পেলেও নড়চড় করলো না। বুকের মধ্যে শান্তির সুখটুকু নিতে-নিতে খুবই আস্তে করে বললো,

– নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে,
হৃদয়ে রয়েছো গোপনে।

মেহনূরের কথাগুলো ওপাশের কর্ণধারে পৌঁছে গেছে। প্রতিটি শব্দের অর্থ বুঝে ঠোঁটের কোণে হাসি টেনেছে। মেহনূর কি তার বাবার মতোই কাব্যপ্রেমি? কথাটা খাঁটি সত্য। চরণযুগলের গূঢ়ার্থ বুঝতে পেরে বদ্ধ চোখে শুধিয়ে উঠলো,

– অনেক কাছে রেখেছি মেহনূর। যতটুকু কাছে রাখলে মানুষ নিজেকেই দেখতে পায় না।

এবার একটুখানি নড়েচড়ে উঠলো মেহনূর। শক্ত বুকটার সাথে থুতনি ঠেকিয়ে মুখ তুলে চাইলো। মাহতিম চোখ খুলে মুখ নিচু করতেই ভ্রুঁ নাচিয়ে ইশারা করলো, ‘ কি হয়েছে? ‘। মেহনূর হ্যাঁ-না কিছুই বললো না। কালোমনির সুন্দর চোখদুটোর কাছে অজান্তেই দৃষ্টিবদ্ধ হয়ে আছে। মাহতিমের চোরাদৃষ্টি বারবার সুকোমল অধরজোড়ায় নিক্ষেপ হচ্ছে। মাথার পেছনটায় চাপ দিয়ে মেহনূরের কপালটা নিজের কাছে আনলো মাহতিম, কপালের মধ্যখানটায় সবটুকু উষ্ণতা কয়েক মূহুর্তের জন্য চেপে দিলো। ছেড়ে দিয়ে বললো,

– আমি আজই রওনা হবো মেহনূর। তুমি কি আমার সঙ্গে যেতে চাও? যদি আরো কিছুদিন থাকতে —

চোরের মতো কথা ছিনিয়ে তাড়াহুড়ো গলায় বললো,

– না, না ফিরতে চাই। সুরাইয়া বুবুর যন্ত্রণায় থাকা যায় না। আমিও আপনার সঙ্গে ফিরবো।

মাহতিম হাসি দিয়ে বললো,

– চালাকি মনে করেছো বুঝিনা, না? বেচারি আমার ভয়ে তোমার কাছেই যায় না, এখন যত দোষ, নন্দ ঘোসের করছো।

মেহনূর সাথে-সাথে মাথা নিচু করে জিভ কামড় ফেললো। মিথ্যা বলাটা আজও পটুতার সাথে করতে পারে না। কি বলতে যেয়ে কি বললো, ছিঃ! মেহনূরের ধরা খাওয়া মুখ দেখে পাটাতন থেকে উঠলো মাহতিম। পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রিনের দিকে তাকালো। কিছু একটা ডায়ালে বসাতে-বসাতে বললো,

– যদি কিছু করতো, চুলের গোড়া পযর্ন্ত ছিঁড়ে আনতাম। তাছাড়া ওই দুটো মাল-মালতী আমাকে বাঘের মতো ভয় পায়। এমনেতেও কিছু করার সাহস দেখাতো না।

পা চালিয়ে ফোনটা কানে ধরলো মাহতিম।

– হ্যালো, আনসারী বলছি। আমার দুপুর বারোটার ভেতর মাইক্রো দরকার।

– ………………………….. .

– সিকিউরিটি লাগবে না। নোমানকে সঙ্গে পাঠান।

– ………………………….. .

– না, কোনো প্রবলেম নেই। ডানদিকে লেগেছে। না, স্টিচ লাগেনি। মাথায় আহামরি কিছু পাইনি। আপাতত —-

ঝোঁপটার দিকে যেতে-যেতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পরলো মাহতিম। কিছু একটা মনে পরার ভঙ্গিতে পিছু তাকালো সে। দ্রুত ডানহাতে দু’দফা তুড়ি বাজাতেই মেহনূর চোখ তুলে তাকালো। মাহতিম তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুল দিয়ে চলে আসার ইশারা করলো। মুখে কিছু না বললেও আকারে-ইঙ্গিতে বুঝালো,

– উঠে এসো। গরম বাড়ছে। ওখানে বসার দরকার নেই।

মেহনূর উঠলো। মনে-মনে ভাবলো, এটা কি দায়িত্ববোধ, নাকি অধিকারযুক্ত ভালোবাসা?
.

মোল্লাবিহীন গ্রাম অনেকটা মেরুদন্ডহীন প্রাণীর মতো। হান্নান শেখের সবকিছু যতোই বর্বর হোক, গ্রামটার মধ্যে একটু হলেও শৃংখলা ছিলো। যেসব মুরুব্বিরা তাঁর ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতো, তারাই গ্রাম চালানোর জন্য হাতাহাতি শুরু করবে। গ্রামের পুলিশরা ঘুষের জোরে, টাকার গন্ধে ন্যায়নিষ্ঠতা শূঁলে চড়াবে। ক্ষুদ্ধ-বিক্ষুদ্ধ গ্রামবাসী সকলের মুখোশ চিনতে-চিনতে একদিন ঠিকই হাপিয়ে উঠবে, তখন কিভাবে ওই অবস্থা থেকে ব্যবস্থা নেওয়া নিবে? সেটাই যেনো মাথায় ঢুকছেনা মাহতিমের। সকালের নাস্তাটা খেতে-খেতেই হতদরিদ্র মানুষের কথা মনে হয়। না-জানি হান্নান শেখ কতগুলো মানুষের রুজি-রুটি খেয়েছেন। সেইসব অগণিত মানুষ হায়-অভিশাপ বড় নিষ্ঠুরভাবে আঘাত হানবে। এই অভিশম্পাতের মুখ থেকে বাঁচতে হলে যোগ্য বিচারের প্রয়োজন। কিন্তু, সেটা এখন দেখবেই কে? নীতির নামে যারা আদর্শ বেঁচে চলে, সেই গ্রামের মুরুব্বিদের ধরবে? মাথাটা ঠান্ডা করে আরো কিছুসময় ভাবলো মাহতিম। লেবুর ঠান্ডা শরবতটা গিলে সুজলার দিকে তাকালো। সুজলার সাথে তার সম্পর্কটা বেশ মজবুত হয়েছে। এখন আর আগের মতো রাখ-ঢাক রেখে কথা বলার প্রয়োজন পরে না। মাহতিম তাই শরবতটা খেয়ে খালি গ্লাসটা রেখে বললো,

– বড় মা, গ্রামের মানুষগুলোর কথা ভেবেছেন? যেই ছিদ্রগুলো আপনার শ্বশুর করে গেছেন, সেগুলো সময় থাকতে ভরে ফেলুন।

সুজলা উজবুক চাহনিতে মাহতিমের দিকে তাকালো,

– শ্বশুরের দোষ কি আমরা সহ্য করবো?

মাহতিম ভণিতা না কে বললো,

– অপশনই তো রাখেনি। আপনার ছেলে যদি এ দেশে থাকতো, তাহলে মেবি সুবিধা করা যেতো।

সুজলা কাঠ-কাঠ গলায় বলে দেয়,

– শাওন কোনোদিনও এ দেশে আসবে না। ও আমার কাছে ওয়াদা করে গেছে।

মাহতিম কথাটা শুধরে দিয়ে বললো,

– ভুল বললেন বড় মা। ও আপনার কাছে ওয়াদা করতে বাধ্য হয়েছে। আপনিই ওকে বিদেশ যেতে বাধ্য করেছেন। তবে, সেটা ওর মঙ্গলের জন্যই করেছেন।

সুজলা এবার না বলে পারলো না,

– এতোসব খবর কি করে পাচ্ছো? তোমার জন্য দেখি কিছুই গোপন করা যাবে না।

মাহতিম দাম্ভিকতার হাসি দিয়ে বললো,

– ভুল বুঝবেন না বড় মা। আমি লোক লাগালে পাতাল থেকেও ভুসভুস করে তথ্য বেরোতে থাকে। আমি শুধু ওইটুকুই শুনি, যেটুকু আমার প্রয়োজন। আমি বর্তমানে গ্রামবাসীর কথা চিন্তা করছি। এটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করে বুঝলাম, আপনিই এখন মোল্লাবাড়ির গুরুজন। আপনার চেয়ে বয়সে আর কেউ নেই।

সুজলা মর্মার্থ বুঝে ভীত চোখে তাকালো। তাড়াতাড়ি বলে ফেললো,

– অসম্ভব! এমন আকাশ-পাতাল চিন্তা কোরো না মাহতিম। তুমি শহরে থাকো, তাই গ্রামের রীতিনীতি বোঝো না। ভুলেও ওকাজ করতে যেও না বলছি। আমি ওসবে অভ্যস্ত নই, কোনোদিন পারবো না।

মাহতিম কথাটা হেলা-ফেলা না করে জোর দিয়ে বললো,

– আপনি পারবেন। আপনার সুবুদ্ধির পরিমাপ কতখানি পযর্ন্ত হতে পারে, সেটা অলরেডি বুঝে গিয়েছি। আগে শুধু নিজের বাড়ি দেখতেন, এখন আপনি সবার বাড়িতে নজর দিবেন। পার্থক্য এটুকুই, আপনি মানুষগুলোর সেবা করবেন, আপনার শ্বশুরের মতো শোষণ করবেন না।

সুজলা কথা শুনে শান্ত হলো না। অশান্ত কন্ঠে বললো,

– আমি দ্বারা সম্ভব হলে আজ রাজি হতাম। কিন্তু মন সায় দিচ্ছে না মাহতিম। কথাটা যতো ছোট শোনাচ্ছে, দায়িত্বের ভারটা কিন্তু অনেক। এটা একটা পুরুষের কর্ম, সেখানে তুমি আমাকে কেনো টেনে আনছো?

মাহতিম বিজ্ঞের মতো বলে উঠলো,

– পুরুষের কর্ম পুরুষই করবে। আপনি তো নিজের চৌকাঠ ডিঙোবেন না। আপনার নিজের লোকবল থাকবে, উঠাবসার মানুষ থাকবে, তাদের ইশারা করে কাজ করাবেন।

সুজলা অনেকক্ষণ ব্যাপারটা নিয়ে তর্কবিতর্ক চালালো। কিন্তু খাঁটি যুক্তির কাছে সুজলাও টিকলো না। মাহতিমের সোজাসাপ্টা কথা, আপাতত হাতের চাবি নিজের কাছেই রাখুন। শুধু চাবি চালানোর পন্থাটা বদলে ফেলুন। দীর্ঘসময়ের তর্কযুদ্ধটা শেষমেশ মাহতিমের জয়ে ইতি টানলো। মাহতিম বিষয়টা নিয়ে বিশদ আলোচনা করতে-করতে সবাইকে মোল্লাবাড়িতে পৌঁছে দিলো। সেই একই মাইক্রোতে বসে থেকে সে এবং মেহনূর সদর দরজা থেকে বিদায় নিলো। যাওয়ার আগ পযর্ন্ত সুজলার মাথায় সবকিছু ঠিকঠাক মতো বুঝিয়ে দিলো। এবার যেনো মহিমপুর গ্রামটা অন্য চেহারার জন্য অপেক্ষা করছে। শাষক-শোষণ মুক্ত গ্রাম হয়ে ভিন্ন আদলের চিন্তা করছে। সুজলা ঠিকই গূঢ়ভাবে সবকিছু চিন্তা করে নিলো, দীর্ঘদিনের নীল-নকশাকে নসাৎ করে নতুন চিত্র বানালো। সেই চিত্রে সাদা-কালো রঙ হটিয়ে রঙিন তুলি চালালো, মনের ভেতর যত ভেতর কলাকৌশল, পরিকল্পনা, চিন্তাভাবনা আসলো, আস্তে-আস্তে বাস্তবায়ন শুরু করলো সে। প্রথম দফায় বিরাট ধাক্কা খেলো সুজলা। কিন্তু সময় বাড়তে-বাড়তে সত্যি-সত্যিই সবকিছু পালটে যেতে থাকলো। যেই অরাজকতা ছোট্ট একটা গ্রামের ভেতর চলছিলো, সেখান থেকে সবকিছু ধূলিসাৎ হতে লাগলো।

.

সময়ের গণ্ডি প্রায় মাসখানেক পেরুলো। আনসারী-নিবাসে চিকিৎসা শেষে মারজা ফিরে এলো। কয়েক মাসের ছুটি পেয়ে পরিবারিক মূহুর্তে যুক্ত হলো মাহতিম। এই উছিলায় সৌভিকের ব্যাপারটা পাকাপাকি করতে সবকিছু বন্দোবস্ত করতে লাগলো। বাড়িতে একটা ধুম উঠলো শীঘ্রই সৌভিকের বিয়ে হচ্ছে। বিয়েটা বিরাট ধুমধামে মহাসমারোহে ঘটবে। নিজের বিয়ে নিয়ে যতটুকু ঘাটতি ছিলো, তার চেয়ে অনেকখানি সৌভিকের বিয়েতে করবে। বেচারা সৌভিক লজ্জায় এখন অফিসের কাজে ব্যস্ততা দেখায়, বিয়ের হাট-পাট নিয়ে কথা তুললেই চাটুকারের মতো ছিটকে যায়। সবকিছু বিবেচনায় রেখে দুপক্ষের শর্ত-সম্মতিতে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শানাজের বিয়েটা আনসারী-নিবাস থেকে উঠবে, এ নিয়ে ব্যাপারটা ঠিকঠাক করা হয়। সেই অনুযায়ী বিয়ের তিন সপ্তাহ আগে গ্রাম থেকে সবাইকে আনায় মাহতিম।বিয়ে উপলক্ষ্যে রমরমা পরিবেশে কেউই বাদ যায়নি। শেফালি যেনো মুখরোচক হয়ে সবার সঙ্গে মিলে গিয়েছে। মাহতিমকে বাঘের মতো ভয় পেয়েই হোক, বা সৎ বুদ্ধির জন্যই হোক, সুরাইয়া এখন আগের মতো নিকৃষ্ট সুলভ দেখায় না। নিজেকে মার্জিত রূপে দেখানোর জন্য বেশ মাপযোগ করে কথা আগায়। বাড়িটা হৈ-হৈ কল্লোলে মুখরিত হলেও কোথায় যেনো শূন্যতা কাজ করে। প্রায়ই মনে হয় কি যেনো নেই। আজও তৌফের ছাদে এসে পূর্ণিমা চাঁদ দেখে শূন্য-শূন্য লাগলো। চাঁদটার দিকে তাকিয়ে থাকতেই মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো,

– তোকে মিস করছি রে মাহদি। খালি তোর কথা মনে পরে।

কোথায় যেনো গভীরভাবে ব্যথা লাগে। তৌফ খুব শক্ত থাকার চেষ্টা করে, পারে না। চোখ নিংড়ে দু-এক ফোঁটা পানি বেরিয়ে আসে। কখনো সেই পানিটুকু ভেতরে আঁটকানোর চেষ্টা করে। আজ কেমন অবাধ নয়নে পানি পরতে লাগলো, চাঁদের আলোয় তৌফের চোখদুটো চিকচিক করে উঠলো। নিরবে পেছন থেকে চলে এলো ফারিন, তৌফের ডান কাধে হাত রেখে সেও চাঁদের দিকে তাকালো। বির্মষ সুরে বলতে-বলতেই কেঁদে উঠলো,

– তৌফ ভাই, একা থাকলেই ওর কথা মনে পরে। খাওয়ার টেবিলে কতো ফাজলামি করেছি, কত কি বলেছি। আজ ভালো লাগে না ভাই, সৌভিক ভাইয়ের বিয়েতে মাহদিই মিসিং।

তৌফ অশ্রুচোখে ঢোক গিলে নিজেকে দ্রুত সামলে নিলো। ফারিনকে কাঁদতে দেখে মাথায় জোরে এক গাট্টা মারলো। ব্যথার চোটে কান্না চোখে ভ্রুঁ কুঁচকালো ফারিন। বিস্ময় নিয়ে বললো,

– তুমি আমাকে এতো জোরে মা:রলে?

ফারিনকে হাবার মতো তাকিয়ে থাকতে তৌফ নিজের হাসি আঁটকালো। মুখের উপর রাগী অভাস টেনে তেজালো সুরে বললো,

– খাচ্চরের মতো নাক দিয়ে যে পানি বের করলি, তোর কি একটুও শরম করেনা?

ফারিন রেগে গিয়ে বললো,

– কাঁদলে শরম করবে কেন?

তৌফ ইচ্ছে করে ফাজলামি জুড়ে দিলো,

– ছিঃ ছিঃ, তুই এইটাও জানোস না? মানুষ হাসতে-হাসতে যে ভেদভাদায়া বায়ু ছাড়ে, ওই গন্ধের ঠ্যালায় চারপাশের মানুষ টিকবো?

ফারিন হা করে তাকাতেই ভয়ংকর রেগে গেলো। তৌফকে ইচ্ছামতো এলোপাথাড়ি মারতে থাকলে নিরুপায় তৌফ তাড়াতাড়ি ছাদ থেকে পালিয়ে গেলো। পিছু-পিছু ছুট দিলো ফারিন, একটুও ছাড় দিবে না ব:দমাশটাকে। দৌড়ে দুজন সিঁড়ি দিয়ে নামতে-নামতে যেই করিডোরে আসলো, তখনই প্রচণ্ড কিছু আছাড় মারার শব্দ হলো! শব্দ শুনে তড়াক করে থেমে গেলো দুজন, যেখান থেকে শব্দটা পেলো, দুজনই চুপিচুপি সেদিক বরাবর এগিয়ে গেলো। সরু ফাঁক থাকা দরজার দিকে তাকাতেই চমকে দুজন নিজেদের তাকালো। ফারিন অবাক হয়ে কিছু বলতে নিলে তৌফ ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে চুপ থাকতে বললো। দুজনই দরজার ফাঁক গলে ভেতরে চাইলে সাথে-সাথে চোখ বড় করে ফেললো! মাহতিম মোবাইলটা আছাড় মেরে প্রচণ্ড রাগে ফুঁসছে, একজোড়া ক্রুদ্ধ দৃষ্টি ফ্লোরের উপর আঁটকে আছে। মোবাইলটা তিন পার্টে হয়ে কোথায় ছিঁটকে পরলো, তার কোনো হদিশ নেই। দুজন বুঝতেই পারছেনা, মাহতিম এভাবে ফুঁসছে কেনো? মোবাইলটা আছাড় দেওয়ার কারণ কি?

চলমান .

#FABIYAH_MOMO .