মন বোঝেনা পর্ব-০২

0
87

#মন_বোঝেনা
#Tahmina_Akhter

২..

পুরনো ঘটনা মনের দৃশ্যপটে হানা দেয়। অথৈ দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে তাকিয়ে আছে প্রহরের দিকে। আর প্রহরের চোখে প্রশান্তির সুখ। গত একমাস ধরে যার জন্য প্রহরের চোখ ঘুম ছিল না। আজ সেই মানুষটা তারই চোখের সামনে বসে আছে। ঠিক সেদিনের মত আজও তার একই চাহনি। পরনের হলদে শাড়ি, অগ্নি/মূর্তি, চোখ রা/ঙিয়ে তাকায় সবটা আজও তার চোখেমুখে স্পষ্ট।

প্রহরের মা নাজিফা এবং প্রহর অথৈদের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে আজ। অথৈদের ড্রইংরুমে অথৈর বাবা-মা, প্রহর এবং প্রহরের মা বসে আছে। তাদের সবার দৃষ্টির কেন্দ্র বিন্দু অথৈ। অথৈ প্রহরকে ওদের বাসায় দেখে যা রিয়াকশন দেখিয়েছে আপাতত ওদের বাল্যকালে হওয়া বিয়ের খবর কি করে জানাবে তা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পরেছে অথৈর বাবা-মা এবং নাজিফা ।

— অথৈ?

— জি ; আন্টি?

— এদিকে এসো।

নাজিফা অথৈকে কাছে ডাকলেন। অথৈ নাজিফার পাশে গিয়ে বসল। প্রহর আড়চোখে বারবার অথৈকে দেখছিল। তারমানে,তার হৃদয়হরনী আর কেউ নয় স্বয়ং অথৈ। মেয়েটাকে দেখেছিল প্রায় দশবছর আগে। যখন ওদের বিয়ে.. ওয়েট ওয়েট তারমানে অথৈ ওর স্ত্রী! ও মাই গড! এতটা চেঞ্জ! গলুমলু অথৈ এতটা শুকিয়ে গেছে! তাই তো প্রথম দেখায় চিনতে পারেনি সে!

প্রহরের বুক অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। আজ যে এই বাড়িতে এলো। কেন এলো?অথৈর ব্যাপারটা সেটেল করার জন্য। কিন্তু,, এই অথৈ তার হৃদয়হরনী হবে কে জানত? তার কৈশোরকালের বৌ যে অথৈ সেটাও তো জানত না। এখন কি করবে প্রহর?? ডিভোর্সের কথা যেহেতু উঠেছে তাহলে ডিভোর্স তো হবেই হবে।

প্রহর নিজের চোখেমুখে সর্ষেফুল দেখছিল। নিজেকে এতটা অসহায় এর আগে কখনো লাগেনি। হুট করে প্রহর ওর আম্মিকে বলল,

— আম্মি বাড়িতে চলুন।

প্রহর তাগাদা দিচ্ছে বিধায় নাজিফা ছেলের কথায় দ্বিরুক্তি না করেই সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে এলো। পুরো রাস্তাজুড়ে প্রহর চুপচাপ ছিল। নাজিফা সেদিকে মাথা ঘামালো না। কারণ তার ছেলের স্বভাবগতই ইন্ট্রোভার্ট।

ফিরতে ফিরতে রাত হলো। বাড়িতে ফেরার পর প্রহর এবং ওর মা ড্রইংরুমে এসে বসল। নাজিফা লিজাকে ডাক দিয়ে দুই কাপ চা দিতে বলল। এমন সময় প্রহর ওর আম্মিকে ডেকে বলল,,

—-আম্মি? আমার অথৈকে চাই।

প্রহরের কথায় নাজিফার মাথায় বাজ ভেঙে পরল যেন। মানে কি! যেই ছেলে আজ ক’টা বছর ধরে অথৈ নাম থেকে বাঁচতে চাইছে। আজ সেই ছেলে বলছে ” আমার অথৈকে চাই”

সোফা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো নাজিফা। ছেলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবমূর্তি বোঝার চেষ্টা করল। আদৌও কি তার ছেলে অথৈকে চাইছে? নাকি তার নিজের ভ্রম! নাজিফাকে অবাক করে দিয়ে প্রহর বলল,

— আম্মি, আপনি বললে এই বিয়েটা ভাঙবে না।

— কিন্তু, বিকেলে যে আমি নিজ মুখে তোদের ডিভোর্সের কথা বলে এসেছি আলফাজ ভাইয়ের সামনে। তুই তো সামনেই ছিলি তখন বারণ করলি না কেন?

— আম্মি আমি কিছুই জানি না। ব্যস, আমার অথৈকে চাই।

আসল কথাটা চেপে গেল প্রহর।

— কিন্তু ; অথৈ তোকে পছন্দ করে না প্রহর। তোদের বিয়ের কথা শুনে কেমন রিয়াক্ট করবে কে জানে? ডিভোর্সের ব্যাপারে তো কেবল ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা হলো।

— এখুনি আলফাজ আঙ্কেলকে কল করে বারণ করেন। অথৈ যেন বিয়ের ব্যাপারে কিছুই জানতে না পারে।

— কিন্তু,অথৈ যদি..

— আমি ম্যানেজ করে নেব আম্মি। আগে আপনি আলফাজ আঙ্কেলের সঙ্গে কথা বলুন।

নাজিফা চিন্তিত ভঙ্গিতে কল করল আলফাজকে। আলফাজ কল রিসিভ করার পর নাজিফা শুধু এতটুকু জানালো যে,, আপাতত বিয়ের ব্যাপারটা যেন অথৈকে না জানানো হয়। আলফাজ বাধ সাধতে চাইলে নাজিফা শক্ত গলায় বলল,,

— অথৈ, আমার একমাত্র ছেলের বৌ। বিয়েটা তো আর ছেলেখেলা নয়। ছেলেখেলা যদি ভাবতাম তাহলে প্রহরকে অন্য কোথাও বিয়ে করাতাম। সময় হলে অথৈ সব জানবে তবে আমি ওকে জানাব। সব জানার পর অথৈ যা সিদ্ধান্ত নেবে আমি এবং প্রহর দুজনেই মেনে নেব।

আলফাজ কল কেটে দিলো। সাবিনা আলফাজের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

— কি হয়েছে??

— অথৈকে বিয়ের ব্যাপারে জানাতে বারণ করেছে।

— কিন্তু,, আগামীকাল যে পাত্রপক্ষ আসবে তারা যদি অথৈকে পছন্দ করে। তাহলে তো বিয়ের দিনতারিখ নির্ধারণ করতে হবে।

সাবিনা আর আলফাজ দু’জনে আবারও দু/শ্চিন্তার মাঝে পরলেন৷ অথৈ আজ প্রহরকে দেখে কিছুই বলেনি। কিন্তু,রেগে গিয়েছিল যে সেটা ওর অভিব্যক্তি দেখে আন্দাজ করে ফেলেছিল ওর বাবা-মা।

ছাঁদের চিলেকোঠার ঘরে বসে আছে প্রহর। চোখেমুখে বিষাদের ছাপ, মলিন মুখখানা সবটাই আজ বিরহের ছাপ। প্রহর আনমনা হয়ে বলল,,

— যার মুখ কখনো দেখতে চাইনি, যাকে নিয়ে কখনো সংসার করব বলে ভাবিনি আজ তাকেই পাওয়ার জন্য, আমার হৃদয় ব্যাকুল হয়ে পরেছে। প্রেয়সীর জন্য আমার হৃদয়ব্যাকুলতার পেছনের কারণ বুঝি আমাদের বিয়ের সম্পর্কের টান ছিল! নয়ত, এত এত মেয়ে এমপ্লয়ির সঙ্গে আমার ওঠা-বসা কখনোই তো তাদের দিকে তাকানোর ইচ্ছে হয়নি? সেদিন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার প্রেক্ষিতে অথৈকে দেখার পরই কেন আমূল পরিবর্তন এলো আমার মধ্যে?

অথৈ যে তাকে খুব সহজে মেনে নিবে না তা আজকের ঘটনা থেকেই বুঝতে পেরেছে। চোখের সামনে একে একে সব ঘটনা ভেসে উঠছে,, অথৈর সঙ্গে তার প্রথমবারের মতো দেখা হওয়া,, তারপর, আজকের বিকেলের ঘটনা। সবটাই মনের দৃশ্যপটে হানা দিচ্ছে।

অতীত,,

—স্যার,একটা কথা বলব?

— বলো।

— স্যার, আমার বাথরুমে সমস্যা হচ্ছে আজ। আগামীকাল ডিউটি পালন করব ঠিকমতো।

— তোমার বাথরুম সরি পেট কবে ঠিক ছিল? চাকরিতে জয়েন করার পর থেকে রোজ শুনতে হয় স্যার আমার বাথরুম.. মানে পেটে সমস্যা। আর বাথরুমের সমস্যা বলো কেন? পেটের সমস্যা বলবে।

— জি স্যার। পেটের সমস্যা বলব। কিন্তু, কথা হলো স্যার আমার ছুটির প্রয়োজন। নয়ত, এইখানে ইজ্জতের রফদফা হয়ে যাবে।

প্রহর তাকিয়ে দেখলো রফিকের চোখমুখ লাল হয়ে আসছে। হয়ত সত্যিই ওর অস্বস্তি হচ্ছে? প্রহর হাতের ইশারায় রফিকে চলে যেতে বলল। রফিক কোনোমতে হাসি বিনিময় করে চলে যায়।

সবেমাত্র জিমনেসিয়াম থেকে বের হয়েছিল প্রহর। গাড়ি কাছে এসে দাঁড়িয়েছে প্রহর। ব্যান্ড্রেড সিল্ভলেস ব্ল্যাক গেঞ্জি, থ্রী-কোয়ার্টার প্যান্ট। গলায় ইয়ারফোন। । ঘর্মাক্ত দেহ। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে কপাল জুড়ে। ভেজা কপালে লেপ্টে আছে চুল।

রাস্তায় অতিক্রম করা প্রত্যেকটা মেয়ে প্রহরকে দেখছে । প্রহর হেসে গাড়িতে বসল। তারপর, রওনা হলো ওর বাড়ির উদ্দেশ্য।

দশদিন হলো ঢাকায় এসেছে প্রহর। ওর আম্মির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। আমেরিকা থেকে আসার পর ওর আম্মির সাথে জাস্ট একবার দেখা হয়েছে। তাও আবার এয়ারপোর্টে।

“আমাদের নীড়” নেমপ্লেটের বাড়িটির গেইটের সামনে এসে হর্ণ বাজাতেই দারোয়ান গেইট খুলে দিলো। লনের কাছে আসতেই গাড়ি বন্ধ করে নেমে এলো প্রহর। বাড়িতে ঢুকতেই দেখা হলো ওর আম্মির সাথে। ওর আম্মি রান্নাঘরে কিছু একটা করছিল। তাকে দেখেই সেই কাজ ফেলে চলে এসেছে।

— দুপুরে কি খাবি?

— ভুনা খিচুড়ি আর গরু মাংস।

— এই না গতকাল রাতে বললি তোর ওয়েট বেড়ে যাচ্ছে!

— আপনার হাতের জাদুতে ওসব ওয়েটের ভয় দৌড়ে পালাবে, আম্মি।

নাজিফা হেসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। প্রহর নিজের রুমের দিকে চলে যায় আর নাজিফা তড়িঘড়ি করে রান্না বসায়।

গোসল শেষ করে একেবারে অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বের হলো প্রহর। ডাইনিং টেবিলের কাছে আসতেই দেখলো ওর আম্মি টেবিলো নাশতা সাজিয়ে রাখছে। প্রহর কিছুটা রাগ দেখিয়ে লিজাকে ডাকল। লিজা হলো প্রহরের আম্মির হ্যাল্পিং হ্যান্ড। লিজা এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো প্রহরের আম্মির পেছনে। প্রহর লিজার দিকে তাকিয়ে বলল,

— আম্মিকে এই কাজগুলো কেন করতে হলো?

— ম্যামকে আমি বারণ করেছিলাম। কিন্তু..

— আহ্ প্রহর বাদ দে না বাপ। বছরের ছয়মাস তো বিদেশ পড়ে থাকিস তোরা বাপ-ছেলেতে মিলে। তোদের হাতেগোনা কদিন কাছে পাই বল? তোদের একটুখানি খেদমত করতে পারলে আমার হৃদয়ে ছকুন হয়।

আম্মির কথার ওপর আর কোনো কথা বলল না প্রহর। নাজিফা ছেলের পাতে একে একে সব খাবার তুলে দিলো। প্রহর প্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখল,হাসের মাংস ভুনা, চালের গুঁড়ার রুটি, মিষ্টি দই। প্রহর মুচকি হেসে খাবারে মনোযোগ দিলো। ছেলের খাওয়ার দৃশ্য দেখে নাজিফার মন ভরে উঠল। খুশিতে চিকচিক করছে তার চোখ।

নাশতা শেষ করে নাজিফার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্য রওনা হলো প্রহর।

অফিসে ঢুকতেই একে একে সকল এমপ্লয়ি প্রহরকে সালাম জানাচ্ছে। প্রহর হেঁটে গিয়ে ওর কেবিনে ঢুকল। চেয়ারে বসার পর বেলা বাজালো। কিছুক্ষন পর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল ইশতিয়াক আহমেদ। প্রহরের অফিসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর।

— হ্যালো, স্যার?

হাত বাড়িয়ে দুজনেই হ্যান্ডশেক করল। প্রহর ইশতিয়াককে বসতে বলল। ইশতিয়াক চেয়ার বসল।

— ক’টা মিটিং আছে আজ? নতুন এমপ্লয়ি নেয়ার কথা ছিল। ইন্টারভিউ নেয়া হয়েছে??

— আজ মিটিং নেই স্যার। তবে নতুন এমপ্লয়ি সিলেক্ট করা হয়ে গেছে। নতুনদের জয়েনিং আজই হয়েছে।

— আমার পিএ কোথায়?

— হিমানি তো আজ আসেনি।

— ওয়াট! আসেনি মানে কি? সে কি জানত না আজ আমি অফিসে আসব?

— জানত স্যার কিন্তু হুট করে..।

— মে কাম ইন স্যার?

দরজা নক করল কেউ। ইশতিয়াক এবং প্রহর দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করল। প্রহরের পিএ হিমানি এসেছে। প্রহর দৃষ্টি ন করে বলল,

— ইয়েস কাম ইন। এন্ড মি. ইশতিয়াক ইউ ক্যান গো নাও।

— থ্যাংক ইউ স্যার।

ইশতিয়াক কেবিন থেকে বেড়িয়ে যায়। হিমানি এসে ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে রইল।।

— আমি অফিসে এসেছি দশমিনিট হয়েছে। আমার পিএ হিসেবে তোমার উচিত ছিল আমার আগেই অফিসে হওয়া।

— স্যার, রিকশা পেতে দেরি হচ্ছিল।

–লেইম এক্সকিউজ! নতুন কিছু বলো। এসবের দোহায় শুনতে এখন আর ভালো লাগছে না।

কথাগুলো বলেই প্রহর চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়ায় ঠিক তখনি হিমানি অভাবনীয় কান্ড ঘটিয়ে ফেলল। প্রহরকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধলল, পাগলের ন্যায় প্রলাপ বকছে।

— স্যার, প্লিজ আজকের মতো মাফ করে দিন। আর কখনোই লেইট করব না আমি। আপনি যা বলবেন আমি তাই করব।

প্রহর হিমানীকে নিজের কাছ থেকে সরানোর চেষ্টা করছিল ঠিক তখনি কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে একজন প্রবেশ করল। তবে প্রহর এবং হিমানিকে একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে ভীষণ লজ্জা পেয়ে কেবিন ছেড়ে দৌড়ে পালায় সেই মানুষটি।

প্রহর সেই মানুষটাকে পেছন থেকে ডাকে কিন্তু সে আর পেছনে ফিরে তাকায় না।

সেদিনই প্রথমবারের মত অথৈকে দেখেছিল প্রহর। সেই প্রথম দেখায় প্রহরের জন্য অথৈর মনে নেগেটিভ চিন্তাভাবনা ঢুকে পরে। যে কারোই এই ভাবনা থেকে যাবে মস্তিষ্কে। অথৈর বেলায় তাই ঘটেছে। অথৈই এবং প্রহর দুজনেই পরিস্থিতি স্বীকার।

অতীতের পাতা থেকে বেরিয়ে বুকের বা পাশে হাত রেখে প্রহর বলল,,

— যদি জানতাম তোমাকে না পাওয়ার ব্যথায় আমি কুঁকড়ে যাব, ধ্বংস হবো। তবে আরও আগেই তোমাকে বুকের খাঁচায় বন্দী করে রাখতাম। তবে এখন যেহেতু জেনে গেছি তুমি আমার কি? তাহলে তোমাকে আমার হৃদয়ের ব/ন্দিনী বানিয়ে ক্ষান্ত হবো। ততদিন নাহয় বিষাদের প্রহর গুনে রাখব। কারন , মন বোঝেনা অপেক্ষার মানে।

অথৈকে পাওয়ার জন্য প্রহরের অপেক্ষাময় দিনগুলো শুরু হলো। কবে শেষ হবে জানা নেই। কিন্তু,, এই বিষাদময় অপেক্ষার অবসান শীঘ্রই শেষ হবে।

#চলবে