মন বোঝেনা পর্ব-০৩

0
64

#মন_বোঝেনা
#Tahmina_Akhter

৩..

— আব্বু, আমি আর চাকরিটা করছি না।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কথাটি বলল অথৈ। আলফাজ নিউজপেপার ভাজ করে টি-টেবিলের ওপরে রেখে বলল,

— কেন? পার্টটাইম জব হিসেবে তোর জন্য জবটা পারফেক্ট। এটাই তো বলেছিলি তুই।

অথৈ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বলল,

— আমি তো জানতাম প্রহর মির্জা আমার অফিসের সিইও। তিনি আমার আম্মাজানের বান্ধবীর ছেলে! কিন্তু, প্রহর মির্জা কি জানত এই ব্যাপারটা? মোটেও না। জানলে মোটেও সে আমাদের বাড়িতে আসতে চাইত না। ভীষণ অহংকারী মানুষ সে। এই যে গতকাল তাকে আমাদের বাড়িতে দেখলাম এটাই তো আমার জন্য ছিল পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য!

— কি ভাবতে বসেছিস আবার?

আলফাজের কথায় অথৈ ভাবনার জগত থেকে বের হয়ে এলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আলফাজের সামনে হাঁটু গেড়ে অনুনয়ের সুরে বলেই ফেলল,

— আব্বু আমি যেই কোম্পানিতে চাকরি করি সেই কোম্পানির সিইও হচ্ছে নাজিফা আন্টির ছেলে প্রহর মির্জা। গতকাল আমাদের বাড়িতে উনাকে দেখার পর আমার কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে আব্বু ! সে আমার মায়ের বান্ধবীর ছেলে। আমি তার কোম্পানির সামান্য একজন এমপ্লয়ি। যদিও তিনি আমাদের সেক্টরে তেমন আসেন না। তবুও তার সাথে আমার যতবারই দেখা হবে ততবারই আমার মনে হবে তিনি আমার স্ট্যাটাসকে উপহাস করবেন। যেটা আমি মোটেও সহ্য করতে পারব না।

আলফাজ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা যে এত আত্মসম্মানবোধে গড়া কখনো চোখে পরেনি তেমন। অথৈর জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো অফিস আলাদা এটেনশন পেতে চাইত এই বলে যে, প্রহর মির্জার মায়ের বেস্টফ্রেন্ড হচ্ছে ওর মা। কিন্তু ; না। অথৈ এমন কিছুই করবে না উল্টো চাকরি ছেড়ে দেবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।

আলফাজ মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,

— তোর যা সঠিক মনে হয় তাই সিদ্ধান্ত নিবি। আমি জানি আমার অথৈ কখনোই ভুল সিদ্ধান্ত নেয় না।

— থ্যাংক ইউ আব্বু। জানো না গতকাল রাত থেকে আমার মাথায় টেনশনের জ্যাম লেগে গিয়েছিল। এখন একটু শান্তি লাগছে। অলরেডি সাতটা বেজে গেছে। আসছি আব্বু। আজ অফিসে রিজাইন লেটার জমা করে আসব।

অথৈ হাসিমুখে ওর আব্বুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বারান্দা থেকে ওর ঘরে চলে এলো। গোসল শেষ করে কালো ম্যাচিং ব্লাউজের সাথে কালো পাড়ের সুতির নীল রঙের শাড়ি পরে নিলো। কাঁধ সমান চুলগুলো ছড়িয়ে দিলো। চোখে কাজলের রেখা টেনে ঠোঁটে লাইট পিংক কালারের লিপস্টিক দিয়ে পার্স নিয়ে বেরিয়ে পরল অফিসের উদ্দেশ্য। সাবিনা বেশ কয়েকবার অথৈকে নাশতা খেয়ে যেতে বলল। কিন্তু, অথৈ তাড়া দেখিয়ে বের হয়ে যায় বাসা থেকে ।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিল অথৈ। পার্স থেকে মোবাইল বের করতেই দেখলো অলরেডি সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। অফিসে আটটার আগে পৌঁছেতে হবে। কিন্তু, অফিসে পৌঁছেতে সময় লাগবে চল্লিশ মিনিট। অথৈ চিন্তিত ভঙ্গিতে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে।

— কি রে অথৈ? কোথাও যাবি নাকি?

নিজের নাম শুনে অথৈ পেছনে তাকিয়ে দেখলো ওর ক্লাসমেট আবির বাইক নিয়ে ওর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। অথৈর মাথায় চট করে বুদ্ধি এলো। আবিরের সামনে এসে অথৈ অনুরোধের সুরে বলল,

— একটা উপকার করবি ভাই?

— উপকার করব। কিন্তু, এই যে তুই দেখা হলে আমাকে জানপ্রাণ দিয়ে, আকুলতা দেখিয়ে ভাই ডাকিস এটা কি ঠিক হচ্ছে? আমি তোর কোন জন্মের ভাই হই বল?

— তুই আমার এই জন্মের ভাই। তোর সাথে আমার চেহারার কত মিল জানিস তুই?

— হয়েছে হয়েছে। এখন বল কি উপকার করতে হবে?

— আমাকে “বিগ ওশান” কোম্পানির সামনে নামিয়ে দিয়ে আসতে পারবি? আটটার আগে পৌঁছেতে হবে। রিকশা পাচ্ছি না আর যদিও রিকশা দিয়ে চলেও যাই তবুও আটটার আগে পৌঁছেতে পারব না।

— তুই চাকরি করছিস! কবে থেকে?

—যেতে যেতে বলি?

— এজ ইউর উইশ।

আবিরের বাইকের পেছনে বসেই অফিসের উদ্দেশ্য রওনা হলো অথৈ। যেতে যেতেই অথৈ ওর চাকরির খুটিনাটি সব ব্যাপার জানালো আবিরকে। আজ রিজাইন লেটার জমা করবে সেটাও বলল। চাকরির ছাড়ার কথা শুনে আবির বলল,

— দোস্ত, একটা কথা বলি শোন। চাকরিটা ছাড়িস না। এখনকার বাজারে এমন চাকরি পাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। ” “বিগ ওশান ” কোম্পানি প্রত্যেকবছর বিভিন্ন ভার্সিটি থেকে শিক্ষার্থীদের বেতন সহকারে ট্রেনিং দেয়। তারপর, তাদের কোনো ব্রাঞ্চে চাকরি দেয়। এত এত সুযোগ সুবিধা কোনো কোম্পানি দেয় এখনকার যুগে? আরেকবার ভেবে দেখ।

— মাঝেমধ্যে লাভের চিন্তা করতে হয় না। আমার এই চাকরিটা না করলে যদি লোকসান হয় তবে তাই হোক। তবুও চাকরিটা করছি না। এন্ড দিজ ডিসিশান ইজ ফাইনাল।

— তোর ইচ্ছা।

কথা বলতে বলতে “বিগ ওশান” বৃহৎ কোম্পানির সামনে এসে পৌঁছে যায় আবির এবং অথৈ। অথৈ বাইক থেকে নেমে আবিরকে ধন্যবাদ জানিয়ে গেটের ভেতরে ঢুকে পরে। এদিকে আবির বাইক নিয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্য রওনা হয়।

এদিকে প্রহরের নিজের কেবিনের এক বিশাল অংশে জুড়ে কেবল কাঁচের দেয়াল। রাস্তার পাশেই তার কেবিন হওয়ায় সব স্পষ্ট দেখা যায়। কাঁচের দেয়াল ভেদ করে দেখতে পেলো তার অপ্রিয় দৃশ্য। অথৈ কারো বাইক থেকে নেমে হাসিমুখে কথা বলে বিদায় নিয়ে অফিসে ঢুকে পরল।

কপালের দুপাশের শিরা ফুলে ওঠেছে প্রহরের। এত ঈর্ষা প্রহরের মনে এর আগে কখনো জন্মায়নি। কিন্তু, আজ নিজের রাগ দেখে প্রহর শুধু ভেবে দেখল সৃষ্টিকর্তা সবাইকে একই উপাদান দিয়ে গড়েছেন। হয়তো ভালো-মন্দের তারতম্য আছে। এই যে তার নিজের ভেতরে যে ঈর্ষাকাতর একটা মন ছিল এটা কি কখনো জেনেছিল? মোটেও না। হয়ত, এর আগে অথৈ নামক সুখপাখির সন্ধান ছিল না তার জীবনে।

অথৈ অফিসে ঢুকে রিসেপশনে যায়। তারপর, হাজিরা খাতায় সাইন করে থার্ড ফ্লোরে যাওয়ার জন্য লিফটের সামনে অপেক্ষা করছে। থার্ড ফ্লোরে ৩নং সেক্টরে কেবল স্টুডেন্টদের নিয়ে কাজ করা হয়। লিফটের দরজা খুলল অথৈ ভেতরে ঢুকে পরল।

থার্ড ফ্লোরে এসে লিফটের দরজা খুলে গেল। অথৈ বের হয়ে চলে যায় ১৪নং ডেস্কে। ল্যাপটপ অন করে রিজাইন লেটার লিখে ফেলল। তারপর,, কাগজে প্রিন্ট করে ফেলল। রিজাইন লেটার হাতে নিয়ে আবারও পড়ে দেখল কোনো ভুল আছে কিনা এই ভেবে? না, কোনো ভুল নেই।

এবার রিজাইন লেটারটা ইশতিয়াক স্যারের ডেস্কে জমা করতে পারলেই হলো। যেই ভাবা সেই কাজ। অথৈ লেটার হাতে নিয়ে ইশতিয়াক স্যারের কেবিনে চলে যায়। ইশতিয়াকের কাছে লেটার জমা করার পর। ইশতিয়াক অবাক হয়ে অথৈকে জিজ্ঞেস করল,

— এত ভালো চাকরি ছেড়ে দিচ্ছো! কিন্তু কেন?

— পার্সোনাল কারণ আছে স্যার।

— আরেকবার ভেবে দেখো।।

— নো স্যার। আর ভাবব না। আপনি রিজাইন লেটারে সাইন করে দিন।

— আমি নয় প্রহর স্যার সাইন করবে।

— অপেক্ষা করতে হবে?

— না ; অপেক্ষা করতে হবে না। বাড়িতে চলে যাও। তোমাকে ইমেইল করে জানিয়ে দেয়া হবে এই ব্যাপারে।

— ধন্যবাদ স্যার। আসছি আমি।

— ওয়েলকাম মাই ডিয়ার।

অথৈ বের হয়ে এলো ইশতিয়াকের কেবিন থেকে। করিডোর পেরিয়ে যাওয়ার সময় প্রহরের সঙ্গে অথৈর দেখা হয়ে যায়। অথৈ আড়ষ্টতা দেখিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে যায়। আর প্রহর যেন অথৈকে দেখেও দেখল না এমন ভান করে চলে যাচ্ছে। এক দিক দিয়ে ভালোই হলো অথৈর অস্বস্তি হচ্ছে না।

সেদিন বাড়িতে ফেরার পর অথৈ দ খাবার খেয়ে সেই যে ঘুম দিয়েছে এখন সন্ধ্যা হয়ে এলো। তবুও ঘুমিয়ে আছে। ওর মোবাইলে একের পর এক কল আসছে। মোবাইল সাইলেন্ট মোডে থাকার কারণে অথৈ কলের আওয়াজ শুনলই না।

কলিংবেলের শব্দ ভেসে এলো। সাবিনা মাত্রই মাগরিবের নামাজ পরে তসবীহ হাতে নিয়ে “সুবহানাল্লাহ” বাক্য পড়ছিলেন। বাসায় আলফাজ নেই। মসজিদে গিয়েছেন। অথৈ আজ অবেলায় পরে পরে ঘুমাচ্ছে। কয়েকবার ডাক দিয়ে এসেছেন। কিন্তু তার ঘুম ভাঙার নামই নেই। সাবিনা গিয়ে দরজা খুললেন। এবং দরজা খুলতেই বড়ো ধাক্কা খেলেন। কারণ, প্রহর এসেছে। সাবিনাকে দেখে প্রহর সালাম জানিয়ে জিজ্ঞেস করল,

— আন্টি? অথৈ বাসায় আছে?

— হ্যা ; আছে।

— ওকে একটু ডেকে দিবেন?

— অবশ্যই। ভেতরে এসো তুমি।

প্রহর যেন এই কথার অপেক্ষায় ছিল। ড্রইংরুমের সোফায় প্রহরকে বসিয়ে রেখে সাবিনা তড়িঘড়ি করে অথৈর রুমের দরজায় নক করতে লাগলেন। ভাগ্যিস, অথৈর রুমটা উত্তর দিকে। ড্রইংরুম থেকে এই ঘরের দরজা দেখা যায় না। নয়তো, আজ ভীষণ লজ্জা পেতে হত অথৈর জন্য। এই ভরসন্ধ্যায় কেন যে ঘুমিয়ে আছে?

সাবিনাকে দুশ্চিন্তার হাত থেকে বাঁচিয়ে ফেললো অথৈ। ঘুমে দুলতে থাকা অথৈ ওর মাকে জিজ্ঞেস করল,

— মা, মাত্র তো আধঘন্টা ঘুমালাম। তুমি এভাবে দরজা ধাক্কালে আমার কি ঘুম হয় বলো তো?

— চারঘন্টা ধরে ঘুমিয়ে এখন বলছিস মাত্র আধঘন্টা ঘুমিয়েছিস। বাকি রাত এখনও পরে আছি। যত ইচ্ছে ঘুমিয়ে থাকিস তখন । প্রহর এসেছে। তোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।

— আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে! কিন্তু, কেন? অথৈ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল ওর মাকে।

— আমি কিভাবে জানব?? তুই গিয়ে দেখা কর। তাছাড়া তোর অফিসের সিইও। হয়ত, অফিসিয়াল কোনো কাজে তোর কাছে আসতে পারে?

কথাগুলো বলে সাবিনা যেভাবে এসেছিলেন ঠিক সেভাবেই তড়িঘড়ি করে রান্নাঘরের দিকে ছুটলেন। যতই হোক প্রহর তো উনাদের মেয়ের জামাই। আপ্যায়ন না করলে কেমন দেখায়??

অথৈ তখনও দরজার সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ওর মা তো জানে না যে, আজ ওর রিজাইন লেটার জমা করে এসেছে অফিসে। যদি জানত তাহলে প্রহর স্যারকে এই বাড়িতে দেখলে ভ্রু- কুচকে তাকাত। অথৈ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কে জানে প্রহর কেন এসেছে?

#চলবে