মন বোঝেনা পর্ব-০৪

0
55

#মন_বোঝেনা
#Tahmina_Akhter

৪.

— চাকরি ছাড়ার রিজেন কি আমি জানতে পারি মিস অথৈ?

প্রহরের প্রশ্নের জবাবে অথৈ খুবই শান্ত চোখে তাকালো প্রহরের পানে। প্রহর যেন এতসময় ধরে এই ক্ষণের অপেক্ষায় ছিল। জীবনে যে কিছু কিছু মূহুর্ত কেবল গড গিফটেড হয় তা আজ হারে হারে টের পাচ্ছে। অথৈ প্রহরের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দক্ষিণের বারান্দার দরজার ওপরে ঝুলতে থাকা মানি প্লান্টের টবের ওপর দৃষ্টিপাত করেই শান্ত সুরে বলল,

— খুবই পার্সোনাল রিজেন।

— চাকরিতে জয়েন করার আগে কিছু এগ্রিমেন্ট পেপারে আপনার সাইন নেয়া হয়েছিল। সেই পেপার পড়েছিলেন?

— জি ; পড়েছিলাম।

— গুড। তাহলে সেখানে আপনি চাকরি ছেড়ে দিতে চাইলে যে কয়েকটা কারণ দেখাতে হতো সেসব কারণগুলোতে কি আপনার পার্সোনাল কারণ দেখিয়ে চাকরি ছাড়তে পারবেন এমন কিছু লেখা ছিল?

প্রহরের কথায় অথৈ দোটানায় পড়ে গেলো। আসলেই তো শর্তগুলোতে এমন কিছু লেখা ছিল না। অথৈকে শান্ত রুপে দেখেই প্রহর বলল,

— দেখুন মিস. অথৈ চাইলেই আপনি হুট করে একটা চাকরি পাবেন না। ঠিক তেমনিভাবে চাইলে একটা চাকরি ছাড়তে পারবেন না। কারণ, প্রত্যেকটা কোম্পানির নিজস্ব কিছু রুলস আছে। আমাদের কোম্পানিতেও রুলস আছে। চাকরি ছাড়বেন ভালো কথা। আগামীকাল অফিসে আসুন। রুলসগুলো দেখুন, পড়ুন তারপর ডিসেশনে আসুন। তাড়াহুড়ো করবেন না। কারণ, তাড়াহুড়োর কাজ শয়তানের কাজ।

প্রহর উঠে দাঁড়ালো। অথৈ আগের মতই বসে আছে। সাবিনা রান্নাঘর থেকে ট্রে-ভর্তি নাশতা এনে টি-টেবিলের ওপরে রাখল। প্রহরকে দাঁড়িয়ে থাকতো দেখে সাবিনা প্রহরকে বলল,,

— খালি মুখে যাওয়া যাবে না।

— আন্টি আজ হাতে মোটেও সময় নেই।
কোনো একসময় এসে আপনার হাতের ভেজা চিতই পিঠা খেয়ে যাব। আজ চলি।

যদিও সাবিনার সঙ্গে কথা বলছিল প্রহর কিন্তু ; ধ্যান-ধারণা ছিল অথৈর কাছে।অথৈর চিন্তিত মুখখানা দেখে প্রহর মনে মনে বলল,

—– আমার কাছ থেকে যত দূরে যাওয়ার চেষ্টা করছো তারচেয়ে বেশি আমার কাছাকাছি আসছো। হয়তো কিছুটা সময় লাগবে কিন্তু একটা সময় পর তুমি নিজেই বুঝতে পারবে। প্রহরের জন্য তুমি কি?

প্রহর সাবিনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে। ঠিক তখনি সাবিনা অথৈকে উদ্দেশ্য করে বলল,,

— প্রহরকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আয়।

অথৈ অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ওর মায়ের দিকে। প্রহর ততক্ষণে দরজা পর্যন্ত চলে গিয়েছে। কি মনে করে একবার পেছনে তাকানোর জন্য তাগিদ অনুভব করল। পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলো অথৈ ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রহরকে হুট করে পেছনে তাকাতে দেখে অথৈ অপ্রস্তুত হয়ে বলল,,

— মা বলল দরজা লাগিয়ে আয়। তাই এলাম।

কথাটি বলে নিজেই জিভ কাটল অথৈ। মনে মনে নিজের মা’কে বকছে। প্রহর মুচকি হেসে নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। অথৈ দরজা লক করে সোফায় দুই পা উঠিয়ে বসল। টি-টেবিল থেকে বোল থেকে একটা পিরিচে দুটো ভেজা চিতই পিঠা ওঠিয়ে খেতে আরম্ভ করল। পিঠা মুখে দিতেই অথৈ চোখ বন্ধ করে বলল,

— মা, তোমার হাতে তৈরি করা কোনো খাবার মজা হোক বা না হোক ভেজা পিঠা জাস্ট অসাম হয়!

— থাক তাহলে পিঠা খেয়ে থাক। আমার হাতের সরষে ইলিশ দিয়ে আজ রাতে আর ভাত খাস না।

রান্নাঘর থেকে জবাব দেয় সাবিনা। অথৈ সরষে ইলিশের কথা শুনে মুখ কালো করে বলল,

— মা, তুমি আমায় ফেলে একা খেতে পারবে?

— অবশ্যই পারব। তুই যখন শ্বশুরবাড়ি যাবি তখন কি আমি তোকে নিয়ে ভাত খাব বল?

— মা তখনকার ব্যাপার সম্পূর্ণ আলাদা। এখন তো তুমি আমায় অভিমান করে বলছো সরষে ইলিশ একা খেয়ে নিবে। কিন্তু, যখন আমি শ্বশুরবাড়িতে চলে যাব তখন তুমি চাইলেও আমাকে রোজ কাছে পাবে না। পরিস্থিতি তখন তোমাকে মানিয়ে নিতে বলবে।

কথাগুলো বলার সময় অথৈর কন্ঠস্বর কাঁপছিল। মেয়ের কথা শুনে সাবিনা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। অথৈর পাশে গিয়ে বসলেন। দ্রুত অথৈকে বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে কাঁদো গলায় বললেন,

— ধুর পাগলি! মন খারাপ করিস ক্যান? তোর নানুকে ছাড়া আমি আছি কেমন করে? তোরও যখন বিয়ে হবে তুই উল্টো আমাকে ভুলে যাবি।

— আমি মোটেও তোমাকে ভুলে যাব না।

অথৈ ওর মায়ের বুকে মাথা গুজে কেঁদে ফেলল। সাবিনার দুচোখে পানি। আসলেই মেয়েদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং কষ্টদায়ক সম্পর্ক বুঝি বিয়ে। বাবা-মায়ের কাছ থেকে চিরকালের জন্য দূরত্ব।

অথৈর কান্নাভাব মিইয়ে যায় ওর আব্বুকে দেখে। সাবিনা ফোন করে মেয়ের মন খারাপের গল্প বাবাকে শোনালো। তারপর, বাবা মেয়ের ফেবারিট চকলেট আইসক্রিম এবং একটি গোলাপফুল। অথৈ তো হুট করে ওর আব্বুর কাছ থেকে সারপ্রাইজ গিফট পেয়ে আনন্দে আত্মহারা।

রাতের খাবার সবাই একসাথে খেলো
সাবিনা নিজ হাতে খাইয়ে দিলেন মেয়েকে। মেয়ে তো আনন্দে আটখানা। মেঘ না চাইতে জল। রাতের খাবারের পর অথৈ আলফজের সঙ্গে ওর চাকরি ছাড়ার ব্যাপারে এবং প্রহরের আজ এই বাড়িতে আসার পেছনের কারণ জানালো। সবটা শুনে আলফাজ বলল,

—তাহলে কাল অফিসে গিয়ে কথা বলে দেখ।

— ঠিক আছে আব্বু।

——–

রোজকার মতই আজও অথৈ শাড়ি পরে অফিসে যায়। অফিসের ভেতরে ঢুকতেই ইশতিয়াকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় অথৈর। অথৈকে দেখে ইশতিয়াক হাসিমুখে এগিয়ে এসে বলল,

— তুমি এসেছো! তুমি জানো না গতকাল বিকেলে কি ঝড়ই না গিয়েছে আমার ওপরে?

— কেন? কি হয়েছিল?

—তোমার রিজাইন লেটার প্রহর স্যারের ডেস্কে পৌঁছানো মাত্রই আমার ওপ…

— মি.ইশতিয়াক??

অথৈ এবং ইশতিয়াক দু’জনেই পেছনে ঘুরে তাকালো। প্রহর দাঁড়িয়ে আছে। ইশতিয়াক ঢোক গিলে কোনোমতে বলল,

— জি স্যার? হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?

— গেট আউট ফ্রম হেয়ার। ডু ইউর ওয়ার্ক প্রোপারলি।

— ইয়েস স্যার।

ইশতিয়াক চলে গেছে নিজের কেবিনের পথ ধরে। অথৈ প্রহরের দৃষ্টি বাঁচিয়ে চলেই যাচ্ছিল কিন্তু প্রহর ওকে ডাক দেয়।

— অফিসে ঢুকে সোজা আমার
কেবিনে আসা উচিত ছিল আপনার। রাইট?

— ইয়েস স্যার।

— তাহলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করেছিলেন কেন?

— ফর্মালিটি..

— অফিস আওয়ারে ভদ্রতা দেখাতে গিয়ে আপনারা যে আমার কতখানি লোকসান করেছেন একমাত্র ওপর ওয়ালা জানে?
আমার কেবিনে আসবেন তাও দশমিনিটের মধ্যে। কারণ নয়টায় আমার মিটিং আছে।

কথাগুলো বলেই প্রহর চলে যায়। আর অথৈ ভেঙচি কেটে বলল,

–অফিস আওয়ারে ভদ্রতা দেখাতে গিয়ে আপনারা যে আমার কতখানি লোকসান করেছেন একমাত্র ওপর ওয়ালা জানে?
আমার কেবিনে আসবেন তাও দশমিনিটের মধ্যে। কারণ নয়টায় আমার মিটিং আছে।
কেন আমরা আপনার কি এমন ক্ষতি করে ফেললাম? আমাদের কথা আমরা খরচ করেছি কিন্তু আপনার এত মাথাব্যাথা কেন?

প্রহরকে আচ্ছা মতো মনে মনে বকলো। তারপর প্রহরের কেবিনের উদ্দেশ্য রওনা হলো। প্রহরের কেবিনের দরজার সামনে এসে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে অথৈ। মনে কু গাইছে। যদি সেদিনের মত প্রহরকে আর হিমানীকে অপ্রীতিকর অবস্থায় দেখে ফেলে এই ভয়ে। তবুও তো ভেতরে যেতে হবেই। অস্বস্তি নিয়ে দরজায় নক করল অথৈ।

— কাম ইন।

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলো অন্য এক প্রহরকে। নেভি ব্লু রঙের স্যুট পরা প্রহরকে নীলচে পাঞ্জাবিতে বড্ড অচেনা দেখাচ্ছে। অথৈ সন্দিহান হয়ে পরেছে। লোকটা কি কোথাও ঘুরতে যাবে নাকি?যেতেও পারে! শ’খানেক বান্ধবী হয়তো জুটিয়ে রেখেছে। তাদের মধ্যে থেকে হয়ত কারো মন রক্ষা করার জন্য আজ পাঞ্জাবি পরে পুরো বাঙালি বাবু সেজে বসে আছে।

— বসুন।

প্রহরের কথায় ধ্যানভগ্ন হলো অথৈর। প্রহরের মুখোমুখি চেয়ারে বসল অথৈ। প্রহর ডেস্কের ড্রয়ার থেকে একটি কাগজ বের করে অথৈর সামনে তুলে ধরল। অথৈ দেখলো গোটা গোটা ইংরেজি অক্ষরে লেখা এগ্রিমেন্ট পেপার লেখা।

— আপনার স্বাক্ষর কৃত এগ্রিমেন্ট পেপার। পড়ে দেখুন কি কি শর্ত দেয়া আছে?

অথৈ কাগজটি হাতে নিয়ে সবগুলো শর্ত একে একে পড়ে নিলো। শর্তগুলো
পড়ে শেষ করল। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। অসহায়ের ন্যায় প্রহরের দিকে তাকিয়ে বলল,

— আগামী তিনমাস না-হয় আমি চাকরিটা কন্টিনিউ করলাম কিন্তু অফিসিয়াল ড্রেস পরতে পারব না আমি। সরি স্যার। আমি পারব না।

— চাকরি কন্টিনিউ করতে হবে। সেই সঙ্গে অফিসিয়াল ড্রেস পরতে হবে আপনাকে।

— নো স্যার। আই কান্ট ডু ইট।

— পারতে তো আপনাকে হবেই। এটা একটা প্রতিষ্ঠান। এখানে সবকিছুর একটা সীমাবদ্ধতা আছে। আপনি চাইলে মন মতো চলতে পারবেন না। এই যে আপনি রোজ শাড়ি পরে আসেন এটা কি অফিসের রুলস ব্রেকের মধ্যে পরছে না?

— ইয়েস স্যার।

— ভেরি গুড। এই তো বুঝতে পেরেছেন এইবার। আগামীকাল থেকে অফিসিয়াল ড্রেস পরে আসবেন। আজ অফিস ছুটির পরে মি.ইশতিয়াকের কেবিন থেকে ড্রেস নিয়ে যাবেন।

— ওকে স্যার।

— তাহলে এখন আসতে পারেন।

অথৈ বের হয়ে এলো প্রহরের কেবিন থেকে। অথৈ কেবিন থেকে চলে যাওয়ার পর চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে পেপার ওয়েট হাতে নাড়াচাড়া করতে করতেই প্রহর বলে ওঠল,

— তোমায় শাড়িতে কেবল আমি দেখব। অন্যকেউ তোমার এই দেবী রুপ দেখুক আমি সহ্য করতে পারি না।

অফিস আওয়ার শেষ। অথৈ ইশতিয়াকের কেবিনে যাওয়ার সময় দুটো এমপ্লয়ির কথা শুনে থমকে দাঁড়ালো। দুজন বলাবলি করছে,

— অফিসিয়াল ড্রেসের চক্কর কিছুই বুঝলাম না। হুট করে একরাতের মধ্য এমন ডিসেশান কেন যে নিলো প্রহর স্যার বুঝতে পারছি না!

অথৈ আর দাঁড়ালো না সেখানে। ইশতিয়াকের কাছ থেকে ড্রেস নিয়ে রওনা হলো বাড়ির উদ্দেশ্য। আগামীকাল অফিসে গিয়ে সরাসরি প্রহরের সঙ্গে কথা বলবে। যে রুলস আগে ছিল না সেই রুলস রাতারাতি কাগজে ইনক্লুড করে কেন তাকেই বোকা বানানো হলো?

— পরব না অফিসিয়াল ড্রেস আগামীকাল শাড়ি পরে অফিসে যাব । আগে মি. প্রহরকে জবাব দিতে হবে তারপর রুলস সহ অন্যকিছু।

#চলবে