মন বোঝেনা পর্ব-০৫

0
57

#মন_বোঝেনা
#Tahmina_Akhter

৫.

পরদিন সকালে অফিসে এসে অথৈ সর্বপ্রথম প্রহরের কেবিনে চলে যায়। দরজায় নক করলে ভেতর থেকে প্রহর ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেয়। অথৈ কেবিনে ঢুকে সালাম দেয়। অথৈ কন্ঠস্বর শুনে প্রহর ল্যাপটপের স্ক্রীণ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ডেস্কের সামনে তাকালো।

কালো শাড়ি, বেলিফুলের বাঁধনে আটকে যাওয়া খোঁপায় অথৈকে আজ ভীষণ অন্যরকম দেখাচ্ছে। পরিণত লাগছে হুট করে! প্রহর নিজের দৃষ্টিকে সংযত করল। অথৈকে বসার অনুমতি দিয়ে ফের ল্যাপটপে দৃষ্টি রাখল। অথৈ চেয়ার বসল। মুখোমুখি হলো প্রহর এবং খেয়া।

— রাতারাতি অফিসের রুলস বদলে দেয়ার প্রধান কারণটা কি জানতে পারি?

অথৈর কথা শুনে প্রহর ভ্রু কুচকে তাকালো। অথৈ প্রহরের চোখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

— নাকি আমাকে আটকে রাখার জন্য আপনি রুলস বদলে ফেলেছেন?

অথৈর মুখে এই কথা শুনে প্রহর ল্যাপটপ বন্ধ করে বলল,

— আপনি কি নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ভাবেন?

— মানে?

— মানে বুঝতে পারছেন না? তাহলে আমি বুঝিয়ে দেই আপনাকে। আপনাকে যখন যাচাই-বাছাই করে এই অফিসের একজন এমপ্লয়ি বানানো হলো তখন আপনাকে কিছু রুলস এবং কন্ডিশন দেখানো হয়েছিল। আপনি স্বাচ্ছন্দ্যে সেই রুলস এবং কন্ডিশন মেনে কাগজে সাইন করেছেন। এখন আপনি যদি কন্ডিশন ব্রেক করে চাকরি ছাড়তে চান আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু, চাকরি ছাড়তে হলে আপনাকে অতিরিক্ত আরও একমাস অফিসে কাজ করতে হবে। তারপর, আপনি নির্দ্বিধায় চাকরি ছাড়তে পারবেন। আপনাকে কেউ বাঁধা দেবে না। আপনাকে আঁটকে রাখার কোনো কারণ তো দেখছি না আমি। না আপনি আমার স্ত্রী? না আপনার সাথে আমার কোনো কমিটেড আছে? আপনি শুধুই আমার অফিসের একজন এমপ্লয়ি। কথাটি মনে রাখবেন আপনি শুধু আমার অফিসের একজন এমপ্লয়ি।

প্রহরের কথা শুনে অপমানে মুখ থমথম করছে অথৈর। কেঁদে ফেলার মত মেয়ে অথৈ নয়। কিন্তু, প্রহরের কথাগুলো হজম হচ্ছে না। কথার তর্কে জিতে যাওয়ার লোভ সংবরণ করতে না পেরে দ্বিতীয়বারের মত প্রহরের উদ্দেশ্য আক্রমনাত্মক কিছু বাক্য ছুঁড়ে দিলো অথৈ।

— অফিসের কেউই শাড়ি পরত না। শুধু আমি শাড়ি পরে আসতাম। অফিসে শাড়ি পরে আসা যাবে না রুলস কি শুধুমাত্র আমার জন্য? এজন্যই কি রাতারাতি রুলস বদলে গিয়েছে?

— এতদিন অফিসের সবাই মনমত ড্রেস পরেছে। কিন্তু, আজ থেকে নতুন রুল অনুযায়ী অফিসের নারী স্টাফদের জন্য বোরকা-হিজাব এবং ছেলেদের ক্যাজুয়াল ড্রেস।

— আমি বোরকা পরে আসব না।

— দ্যাটস ইউর চয়েজ।

— আমি আজই রিজাইন লেটার জমা করব।

— এজ ইউর উইশ। বাট লেটারের সঙ্গে একলক্ষ টাকা জমা দিয়ে যাবেন।

প্রহরের কথা শুনে অথৈ ভ্রু কুচকে বলল,

— কিসের এক লক্ষ টাকা?

— আপনাকে যেই পোস্টে রাখা হয়েছে সেই পোস্টর জন্য আমাকে আরও এক সেশন অপেক্ষা করতে হবে। দ্যান ইউনিভার্সিটি থেকে বাছাই করা স্টুডেন্ট আমি খুঁজে পাব। ততদিন পর্যন্ত এই পোস্ট খালি পরে থাকবে। রুলস অনুযায়ী কোনো স্টুডেন্ট তার ট্রেনিং চলাকালীন যদি স্বইচ্ছায় চাকরি ছাড়তে চায় তাহলে আমাদের কোম্পানি থেকে তারা যে এক লক্ষ টাকা পেয়েছিল সেই টাকা আমাদের রিফান্ড করতে হবে। বিশ্বাস না হলে পড়ে দেখুন।

প্রহর ড্রয়ার থেকে একটি কাগজ বের করে অথৈর দিকে বাড়িয়ে দিলো। অথৈ ছো মেরে কাগজটা নিয়ে রুলস গুলো পড়ে দেখলো। আহত সিংহীর মত ফোঁসফোঁস করছে অথৈ। মানে সে এখন পরেছে গেঁড়াকলে। সেই চাইলেও এখন এই কোম্পানি থেকে বের হতে পারবে না। কারণ, সেই এক লক্ষ টাকা অথৈর পক্ষে রিফান্ড করা সম্ভব নয়। টাকাটা তার এক বন্ধুকে দিয়েছে ধার দিয়েছে এক বছরের জন্য ।

অথৈর চিন্তিতমুখের দিকে তাকিয়ে রইল প্রহর। প্রহর অথৈর চিন্তিত মুখখানা দেখেই বুঝতে পারল চাকরিটা ছাড়তে পারবে না। অথৈকে একটু বাজিয়ে দেখার জন্য প্রহর আবারও বলে উঠল,

— আজ আমার কোনো মিটিং নেই। আপনি চাইলে রিজাইন লেটার জমা করতে পারেন।

অথৈ চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল মেঝের দিকে। চাকরি ছাড়াটা এখন বোকামি হবে। বোকামি করা যাবে না মাত্র একমাসের ব্যাপার তো। এক লক্ষ টাকা দেয়ার ঝামেলা তখন ঘাড় থেকে নেমে যাবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অথৈ প্রহরকে উদ্দেশ্য করে বলল,

— আমি অতিরিক্ত একমাস চাকরিটা কন্টিনিউ করব। তখন তো আর টাকা কিংবা চাকরি ছেড়ে দিলো কোনো ঝামেলায় পরতে হবে না. তাই না?

— জি ; তখন কোনো ঝামেলায় পরতে হবে না আপনাকে।

— ঠিক আছে। তাহলে আমি আসছি।

— ওকে মিস.অথৈ। তবে আপনার সেক্টরে যাওয়ার আগে অফিসের ড্রেস পরে নিবেন। তারপর, মিস তন্বীর সঙ্গে দেখা করে আসবেন।

অথৈ বের হয়ে এলো প্রহরের কেবিন থেকে। দোতলায় যাওয়ার সময় আজ লিফট ব্যবহার করল না। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো অথৈ। করিডর পেরিয়ে যাওয়ার সময় অথৈ আজ একটি বিষয় খেয়াল করল। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ করিডর সম্পূর্ণ ফাঁকা। বিষয়টা তেমন গায়ে মাখল না অথৈ। হয়ত অফিস আওয়ার তাই সমাগম কম। দোতলায় পৌঁছানোর পর করিডর ফাঁকা থাকার কারণ বুঝতে পারল অথৈ।

পুরো অফিসের সেটিংস বদলে ফেলেছে। তিনতলায় নারী স্টাফদের কর্মক্ষেত্র। পুরুষদের দোতলায়। নীচতলায় প্রহর এবং তার বাবার এহসান মির্জা সহ আরও অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কেবিন সেখানে বরাদ্দ করা হয়েছে। অথৈ এই সব খবর শুনেছে মিস তন্বীর কাছ থেকে। সবটা শোনার পর অথৈ নাক-মুখ কুঁচকে বলল,

— প্রহর স্যার কি জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে নাকি?

— আরে আস্তে কথা বলো। দেয়ালের কান আছে। স্যার শুনতে পারলে কিন্তু ভালো হবে না।

— ভালো হবে না। আর ভালো হতেই বা কি রেখেছে? একবিংশ শতাব্দীতে এসে নারী-পুরুষের মাঝে ভেদাভেদ করা অফিসের এমপ্লয়ি আমরা।

— এখানে ভেদাভেদের কি আছে অথৈ? বরং, ভালোই তো হলো।

কম্পিউটারের স্ক্রীণ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বলল তন্বী।
অথৈ তন্বীর কথা শুনে বিস্মিত হয়ে বলল,

— ম্যাম, আপনি এডুকেটেড মানুষ হয়ে এধরণের আনল্যজিকাল বিষয়কে এপ্রিশিয়েট করছেন!

— আমি না বরং অফিসের প্রত্যেকটা ফিমেল এমপ্লয়ি স্যারের ডিসিশনকে এপ্রিশিয়েট করেছে।

— তবে আমাদের বইয়ের পাতায় শেখানোর বুলি শেখানো হয়েছে নারী-পুরুষের সমান অধিকার। সেই বুলি কি তবে লোক দেখানো?

অথৈর প্রশ্ন শুনে তন্বী থমকালো খানিক সময়ের জন্য। তারপর, মুচকি হেসে অথৈর হাত ধরে বলল,

— অবশ্যই লোক দেখানো বুলি এটা। পুরুষেরাই দেখবে বিভিন্ন সংস্থায় এসে এসব বুলি আওরায়। ছোট মেয়েদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়। অথচ, সেই বুলি আওরায় যেই মানুষগুলো সেই মানুষগুলো সংস্থার বাইরে পুরোদস্তুর অসুস্থ মস্তিষ্কের হয়। এমনও খবর শোনা যায় তারা তাদের নারী কলিগের সঙ্গে অসংযতপূর্ণ আচরণ করেছে। পথে ঘাটে নারীরা যে হ্যারেসমেন্টের শিকার হয়। কাদের দ্বারা এই হ্যারেসমেন্টের শিকার হয় তারা কারা জানো? সুশীল সমাজের সুশীল মানুষগুলোর কাছে। এই অফিসে চাকরি করার আগে অন্য এক অফিসে চাকরি করতাম। সেখানকার এক কলিগ রীতিমত আমাকে তার বেড পার্টনার হবার জন্য অফার করেছিল জানো তুমি? রাজি হইনি বলে একদিন অফিস আওয়ার শেষে আমার মিসবিহেভ করতে চেয়েছিল সেই শয়তানটা। হয়তো, আল্লাহ সেদিন আমার ওপর রহমত করেছিলেন বলে আমার সম্ভ্রম হারাতে হয়নি। আমার অন্য এক পুরুষ কলিগ আমাকে বাঁচিয়েছিল। আমার ওপর আক্রমণ করা মানুষটা পুরুষ এবং আমাকে সেই আক্রমন থেকে রক্ষা করা সেই মানুষটাও পুরুষ। দু’জনে শারীরিক চাহিদা একই। কিন্তু, মানসিক পরিচয় ভিন্ন। দু’জনেই শিক্ষিত। কিন্তু আচরণগত দিক দিয়ে একজন বিকারগ্রস্ত। তুমি যতই নারীর সমাধিকার নিয়ে আন্দোলন করো না কেন কিছু পুরুষের স্বভাবগত দোষের কারণে নারীরা কোথাও সেইফ নেই।

— তাহলে তো আপনার সেই কলিগের মতই আমাদের প্রহর স্যার? হিমানী ম্যামের ইন্সিডেন্ট আপনার মনে নেই নিশ্চয়ই তাই এতটা প্রশংসা করছেন প্রহর স্যারের নামে।

অথৈর কথা শুনে তন্বী কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

— প্রহর স্যার মোটেও তেমন মানুষ নন। বরং হিমানী ছিল মেইন কালপ্রিট। স্যারকে সবার সামনে দোষী বানিয়ে নিজে ভিক্টিম হতে চেয়েছিল।

— কিন্তু, আমি নিজ চোখে দেখেছি…

— সবসময় চোখের দেখা দৃশ্য ঘটনার উল্টো বিবৃতি দেয়। তোমার চোখের দেখায় হয়ত প্রহর স্যার দোষী। কিন্তু, হিমানী ইজ দ্যা মেইন কালপ্রিট। যে কিনা ক্ষমতার মোহে পরে নিজের দেহ সত্তাকে বিলিয়ে দিতে চেয়েছিল। নিজেকে সবার সামনে ছোট করতে সামান্য কার্পন্যেবোধ করেনি।

—- একটা মেয়ে কেন নিজেকে খারাপ বানাতে চাইবে সবার সামনে?

— ওই যে বললাম, ক্ষমতার মোহে।

অথৈ আর কথা বাড়ালো না। তন্বী নিমের কাজে মনোযোগ দিলো আর অথৈ নিজের সেক্টরে চলে এলো। কাজ করার সময় আজ তেমন অস্বস্তি হয়নি। কারণ, আজ ট্রেইনার পুরুষ নয় মহিলা ছিলেন। দিনশেষে অথৈর মনে হলো সত্যিই প্রহরের সিদ্ধান্তই সঠিক। কারণ, নারীরা সহজে যতটা নারীর সঙ্গে মিশতে পারে। চাইলেও পুরুষের সঙ্গে ততটা পারে না।

অফিস আওয়ার শেষ। অথৈ অফিসের ড্রেস পরেই বের হয়ে এলো। নীচতলার করিডর পেরিয়ে যাওয়ার সময় প্রহরের সামনে দিয়ে হেঁটে যায় অথৈ। ভেবেছিল প্রহর হয়ত তাকে চিনতে পারবে না। কিন্তু, অথৈ কি জানে প্রহর অথৈকে চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেললেও ঠিক খুঁজে পাবে। যতক্ষণ না পর্যন্ত অথৈ চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়েছে ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত প্রহর তাকিয়ে ছিল। অথৈ চলে যাওয়ার পর প্রহর আনমনে বলল,

— তোমায় ঠিক যেভাবে দেখতে চেয়েছি আজ তেমনই দেখতে পেলাম। কালো বোরকায় চমৎকার মানিয়েছে তোমায়। প্রকাশ্যে যতটা সুন্দর তুমি! আড়ালে তারচেয়েও চমৎকার দেখায় তোমাকে।

———————–

— অথৈর বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করো তারা তাদের মেয়েকে কখন আমাদের হাতে তুলে দেবে?

এহসান মির্জা খাবার খেতে খেতে প্রশ্ন করল নাজিফাকে। নাজিফা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। অথৈর বাবা-মা কি চায়? এবং প্রহর যে নতুন করে অথৈকে পেতে চাইছে সবটাই খুলে বলল। সবটা শোনার পর এহসান সাহেব নাজিফাকে জানালো যে তিনি আগামীকাল আলফাজ সাহেবের সঙ্গে দেখা করবেন। অথৈকে প্রহরের জীবনে পার্মানেন্ট ভাবে আনার জন্য যা যা প্রয়োজন সবটাই করবেন বলে আস্বস্ত করল নিজের স্ত্রী নাজিফাকে। নাজিফা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। যাক এহসান যেহেতু বলেছে সে অবশ্যই ব্যাপারটা সামলে ফেলবে।

রাত এগারোটা। ছাঁদে বসে আছে প্রহর। অপেক্ষার তারা গুনছে আকাশের দিকে তাকিয়ে। হুট করে মনে পরল অথৈর কথা। তারপর, মনে পরল ওর মায়ের বলা কিছু কথা। আগামীকাল ওর বাবা নাকি অথৈর বাবার সঙ্গে কথা বলবে। কি হবে কথা বললে? অথৈর মন থেকে কি ওর পার্সোনেলাটি নিয়ে যে নেগেটিভেটি ভাবনা তৈরি হয়েছে তা কি দূর হবে মোটেও না। বরং, আরও একধাপ পেছনে ফিরে যাবে অথৈ এবং অথৈর পরিবার।
প্রহর দূর আকাশের সবচেয়ে আলোকিত তারার দিকে তাকিয়ে বলল,

— অথৈকে জয় করতে হবে ভালোবাসা দিয়ে। জানি না পারব কিনা? তবুও শেষ অব্দি চেষ্টা করব। যদি না পারি তবে অন্যপথ অবলম্বন করতে বিলম্ব করব না। Because, Everything is fair in love and war.

কথাগুলো বলার সময় প্রহরকে ভীষণ অন্যরকম দেখাচ্ছে। ভালোবাসায় ব্যর্থ হবার ভয়ে প্রেমিক যেমন ছটফট করে ঠিক তেমনি করছিল প্রহর।

#চলবে