মন বোঝেনা পর্ব-০৬

0
68

#মন_বোঝেনা
#Tahmina_Akhter

৬.

কোনো এক তপ্ত দুপুরে …

— আমাদের নেয়া ডিসিশন আমাদের বাচ্চারা কেন সাফার করবে? তাছাড়া ছোটবেলার বিয়েকে কেইবা এত ইমর্পোটেন্স দেয়?

আলফাজ সাহেবের কথা শুনে এহসান মির্জা চোখের চশমা খুলে টেবিলের ওপর রেখে বলে,

— যখন বিয়ে হয় তখন আমার ছেলে প্রহর কিন্তু মোটেও ছোট ছিল না। পনেরো বছরের কিশোর ছিল। সে বিয়ের মানে না বুঝলেও অন্তত এটা বুঝত যে বিয়ে মানুষের জীবনের একটি সিদ্ধান্ত। যেটা জীবনের কোনো এক মোড়ে এসে নিতে হবে। অথৈর বয়স তখন আট বছর। তার বিয়ের ব্যাপারে বোঝার কথা না। তখন কিন্তু আপনি অতি উৎসাহের সঙ্গে আমার ছেলেকে আপনার মেয়ের জন্য নির্বাচন করেছিলেন। কথা দিয়েছিলেন মেয়ের আঠারো হলে আমাদের কাছে আমাদের বৌ মা’কে ফেরত দেবেন। মেয়ের আঠারো পেরিয়ে চব্বিশ চলছে। এতগুলো বছর অপেক্ষার পর এখন কি শুনতে হচ্ছে? আপনারা আপনাদের মেয়েকে আমার ছেলের কাছে দিতে ইচ্ছুক নন। তখন বাস্তবতা বুঝেননি কিন্তু এখন বুঝতে পারছেন। আমার পুরো চৌদ্দগৌষ্টী জানে আমার প্রহরের বৌ আছে। এখন তাদের কাছে আমি কি জবাব দেব?

— আপনার মত এত বড়ো মাপের বিজনেস ম্যান যদি ছেলের বিয়ে ভেঙে যাওয়ার ভয়ে কুঁকড়ে যান তাহলে গরীবের ব্যাটারা কি করবে ভাইজান? প্রহর যদি বিয়ে করতে চায় এমন হাজারখানেক মেয়ে এক চুটকি বাজালে পেয়ে যাবেন।

— আমি আমার ছেলের জন্য বৌ খুঁজতে যাব কেন? বিয়ে করেছে না অথৈকে? অথৈ আমার প্রহরের স্ত্রী।

— অথৈ প্রহরকে পছন্দ করে না।

— কেন?

ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল এহসান। আলফাজ কফির মগে চুমুক দিয়ে হিমানী এবং প্রহরের মাঝে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি শেয়ার করল। সবটা শোনার পর এহসান বিব্রত অবস্থায় বলল,

— অথৈর কথা বিশ্বাস করছেন আপনারা? হয়ত অথৈ আপনাদের কাছে প্রহরের ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলেছে। প্রহরের অফিসে কি ঘটেছে তা অথৈ জানবে কি করে?

— কারণ, অথৈ প্রহরের অফিসে চাকরি করছে।

আলফাজের কথায় দমে যায় এহসান। এহসান মির্জার মিইয়ে যাওয়া মুখটায় হতাশার ছাপ স্পষ্ট দেখতে পেলো আলফাজ। চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো আলফাজ তারপর এহসান মির্জাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

— আমার মেয়ের মনে আপনার ছেলের জন্য পজেটিভ থিংকিং নেই। বিয়ের মত একটা ব্যাপার নিয়ে আমি বা অথৈ কম্প্রোইজ করতে চাই না।

— কিন্তু, অথৈর নিশ্চয়ই এটা জানা উচিত যে প্রহরের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছে?একবার জানিয়ে দেখুন না অথৈ কি চায়?

— আমি আমার মেয়েকে চিনি। দুশ্চরিত্র মানুষ ওর কাছে চোখের বিষ। দুশ্চরিত্র মানুষের সঙ্গে জীবনের বাকি দিনগুলো কাটাবে এটা তো কখনোই হতে দিবে না।

— অথৈ প্রহরের ব্যাপারে যা জেনেছে কিংবা শুনেছে সবটাই ভুল। হিমানি প্রহরকে ট্রেপে ফেলার জন্য আপত্তিকর কিছু করতে চেয়েছিল। যেটা আমি সহ অফিসের সব স্টাফরা জানে। অথৈ শুধু শুধু আমার ছেলেকে দুশ্চরিত্রের কাতারে ফেলতে পারে না।

— ভাইজান, আমি আপনাদের সাথে এই ব্যাপারে আর কোনো কথা বলতে চাই না। শুধু এতটুকুই জানাতে চাই অথৈর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। চারমাস ওর বিয়ে। প্রহরকে বলবেন ওকে তালাক দিয়ে দিতে।

— আঙ্কেল মেয়েকে বিয়ের খবর জানাননি কিন্তু ডিভোর্সের খবর জানাবেন কিভাবে?কারণ, অথৈ – প্রহরের বিয়ের তো রেজিষ্ট্রেশন হয়নি। মৌখিকভাবে বিয়ে হয়েছে। তালাক পেতে হলে নিশ্চয়ই অথৈকে ভরা মজলিসে তালাক শব্দ তিনবার শুনতে হবে।

প্রহরের কন্ঠস্বর শুনে পেছনে ঘুরে তাকালো আলফাজ এবং এহসান সাহেব। আলফাজ প্রহরকে দেখে যতটা না অবাক হয়েছে তারচেয়ে বেশি ভাবছেন প্রহরের কথাগুলো। সত্যিই তো এভাবে দেখেনি। এতবছর চাপা দিয়ে রাখা বিয়ের খবর মেয়েকেই শোনালে কি রিয়াকশন হবে ভেবেই ঘাম জমে গেছে আলফাজ সাহেবের শরীরে।

সানশেড রেস্টুরেন্টে ফরেনার ক্লাইন্টের সঙ্গে অফিসিয়াল মিটিংয়ের জন্য এসেছিল প্রহর। ওর বাবাকে এবং অথৈর বাবাকে এই রেস্টুরেন্টে দেখে প্রহর বুঝতে পারল যে ওর বাবা এখানে কেন এসেছে?
মিটিং শেষ করে যখনি ওদের টেবিলের কাছে এলো তখনি অথৈর বাবার মুখে “তালাক” শব্দ ভেসে এলো প্রহরের কানে। সারা শরীরের রক্ত হিম স্রোত বয়ে যায়। নিজেকে সামলে ফেলল মূহুর্তের মধ্যে। বিয়ের ব্যাপারে হয়তো নিজেদের হাত ছিল না। কিন্তু বিয়ের সম্পর্ক যদি ভাঙতেই হয় তবে অথৈকে জানানোর রাইট নিশ্চয়ই আছে। অথৈ নিজ মুখেই বলুক না তার এই সম্পর্ক কন্টিনিউ করা উচিত কি না?

— প্রহর? এসব তুই কি বলছিস?

— বাবা, আমাকে বলতে দাও আজ।

প্রহর ওর বাবাকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলেই আলফাজ সাহেবের মুখোমুখি দাঁড়ালো। আলফাজ সাহেব দেখলেন প্রহরের চোখেমুখে অস্থিরতার ছাপ। অথৈকে হারিয়ে ফেলার অস্থিরতা যদি প্রহরের মাঝেই ছিল তবে কিছুদিন আগেও কেন নাজিফা আপা বলেছিল যে, তার ছেলে অথৈকে মানতে পারছে না। এই বিয়ে নামক সম্পর্ক থেকে তার ছেলে অতি দ্রুতই মুক্তি পেতে চায়। আলফাজ সাহেব আজ প্রহরের মুখ থেকে শেষ কথাটি শুনতে চান। হয় এপাড় নয়ত ওপাড়। মেয়ে তো কাঠ পুতুল নয় যে, যে যেভাবে চাইবে মেয়েকে সেভাবে নাচাবে।

— আঙ্কেল? আমি কি খুব খারাপ কিংবা আমার কাছে মেয়েকে দিতে ইনসিকিউর ফিল করছেন? আমার সাথে ঘটে যাওয়া একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিল অথৈ। আমি না চাইতেও সেই ট্রেপে ফেসে গিয়েছিলাম। কিন্তু, অফিসের কিছু মানুষ এবং অথৈ মনে প্রাণে বিশ্বাস করে আমি আসল দোষী। অথচ, আমি কিছুই করিনি। হয়ত, আপনারও বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা। না হবারই কথা। নিজের মেয়ের কথা বিশ্বাস না করে কেন পরের ছেলের কথা বিশ্বাস করবেন? তবুও আমি চাই আপনি আমাকে ভুল না বুঝে একটিবার আমাদের সম্পর্কটাকে নিয়ে ভেবে দেখুন। হয়ত, অপরিণত বয়সে বিয়ে হয়েছে আমাদের। কিন্তু আমি চাই আমার অথৈর সঙ্গে জুড়ে দেয়া এই জন্মান্তরের সম্পর্ক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বহাল থাকুক। আঙ্কেল আমি কি একটিবার এই সুযোগ পেতে পারি না আপনার কাছে?

প্রহরের আকুতি ভরা টলটলে জলের দুচোখ দেখে আলফাজ এবং এহসান দুজনেই থমকে যায়। এহসান দ্রুত উঠে এসে ছেলের কাঁধে হাত রাখল। প্রহর ওর বাবার দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বলল,

— বাবা, আমি চাই আমার স্ত্রী আমার কাছে ফিরে আসুক। যেদিন থেকে অথৈকে চোখের দেখা দেখলাম সেদিন থেকে আমার মনে হচ্ছে আমার ওকেই দরকার। আমার ব্যক্তিগত মানুষ কেবল অথৈ। অথৈ ছাড়া অন্য কেউ আমার পাশে এসে দাঁড়াবে এটা আমি কল্পনাও করতে চাই না।

— কিন্তু, অথৈ যদি তোমাকে না চায়?

আলফাজের কথা প্রহর বুকে তীরের আঘাতের ন্যায় বিঁধে গেলো। ভীষণ চোট পেলো হৃদয়ে। তবুও মানতে হবে। সত্যিই তো অথৈ যদি তাকে না চায়? জোর করে কি ভালোবাসা পাওয়া যায়?

— অথৈ যদি আমাকে না চায় তাহলে আমি কোনোদিনও আপনাদের এই বিষয়ে ফোর্স করব না। আঙ্কেল আমার একটি অনুরোধ আছে। শুনবেন?

আলফাজ এহসান সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে ফের প্রহরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

— বলো?

— আমার এক সপ্তাহ সময়ের প্রয়োজন। একসপ্তাহ পরে আপনি অথৈকে আমাদের বিয়ের ব্যাপারে জানাবেন। তখন ও যা সিদ্ধান্ত নেবে আমি মেনে নেব।

— ঠিক আছে। এক সপ্তাহ সময় পেলে তুমি। এরপর অথৈর যা হবে সিদ্ধান্ত হবে আমি এবং তোমরা সবাই মেনে নিবে এই প্রত্যাশা রাখছি।

কথাটি বলেই আলফাজ সাহেব এহসান এবং প্রহরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলেই যাচ্ছিল ঠিক তখনি প্রহরের ডাক শুনে থমকে দাঁড়ালো আলফাজ। পেছনে ফিরে তাকালো। প্রহর আলফাজের কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,

— কার সাথে অথৈর বিয়ে ঠিক হয়েছে?

— অথৈর ক্লাসমেট আবিরের সঙ্গে অথৈর বিয়ে ঠিক হয়েছে। তোমাদের তালাকের পর অথৈর ইদ্দত শেষ হবার পরই ওদের বিয়ে। হয়ত, ভাবছো আমি এত শিওর হয়ে কি করে বলছি যে তোমাদের তালাক হবে? কারণটা বলি তবে। আমার অথৈকে আমি খুব ভালো করে জানি। সে কোনোদিনও তোমাকে স্বামী হিসেবে মানবে না।

কথাগুলো বলে আর দাঁড়ালেন না আলফাজ। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে যায়। উদ্ভ্রান্তের মতো টেবিলে বসে রইল প্রহর। ছেলেকে এতটা ভেঙে পরতে বোধহয় এর আগে কখনো দেখেনি এহসান।

এদিকে বিগ ওশান অফিসে….

—- অথৈ?

—জি ; ম্যাম?

— অফিস থেকে সবাই রাঙামাটি যাচ্ছে বার্ষিক বনভোজনে। তুমি যাবে না?

তন্বীর মুখে রাঙামাটি নামটি শুনে খুশিতে চোখ চকচক করছে অথৈর। হাতের কাজ বন্ধ করে তন্বীর ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়ালো। উৎসাহী কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

— প্রত্যেক বছরই যায় নাকি পিকনিকে?

— হুম। যায় তো। গতবারই তো কক্সবাজার গেলাম সবাই। এবার নাকি প্রহর স্যার নিজেই রাঙামাটিকে পছন্দ করেছে। ওখানকার লাল পাহাড় নাকি স্যারকে ভীষণভাবে টানছে! আমি নিজেই ভীষণ এক্সাইটেড রাঙামাটি যাওয়ার ব্যাপারে।

— আগামীকালই নাকি যাবে?

— হুম। তোমার কি মন খারাপ অথৈ?

তন্বী অথৈর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল যে অথৈর মন কোনো কারণে ভালো নেই। অথৈ যেন এই ক্ষণের অপেক্ষায় ছিল।

— ম্যাম, যারা ট্রেইনিংয়ে আছে তারা কি যেতে পারবে না?

— অবশ্যই যেতে পারবে। কেন কি হয়েছে?

— আমি তো ভেবেছি ট্রেইনিংয়ে যারা আছে তারা যেতে পারবে না হয়ত। তাহলে আমি যেতে পারব তাই না?

— অফকোর্স যেতে পারবে।

— যেতে হলে কি কি ফরমালিটিস পূরণ করতে হবে?

— লিস্টে তোমার নাম চেক-ইন করাবে। ব্যস বাকি কাজ ম্যানেজিং কমিটির। তুমি শুধু আগামীকাল সময়মত রাত এগারোটায় পৌঁছে যাবে অফিসের সামনে।

— এত রাতে রওনা দেবে কেন?

— আরে ঢাকা থেকে রাঙামাটি পৌঁছেতে অনেক সময় লাগে। তাই রাতেই রওনা হবে। সকালের মধ্যে পৌঁছে যাব। তারপর সারাদিন ঘুরাঘুরি। সন্ধ্যায় আবারও ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দেবে।

— আমার তো রাঙামাটিতে যাওয়ার আনন্দে গা কাঁপুনি দিচ্ছে। লাল পাহাড়ের দেশে যাব! ওফফ, এতদিনে আমার মনের আশা পূরণ হবে! প্রহর স্যার একটা ধন্যবাদ ডির্জাভ করে আমার কাছ থেকে। আগামীকাল দেখা হলে ধন্যবাদ জানিয়ে দেব।

অথৈর কথায় হেসে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো তন্বী। অথৈ নিজেও কাজে মনোযোগ দিলো। কারণ, হাতের কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে। অফিস আওয়ার শেষ হলে খুব দ্রুত মার্কেটে যেতে হবে। শাড়ি কেনা লাগবে তো।

অফিসে বসে থাকা অথৈ আনন্দে আত্মহারা। সে জানল না অব্দি একই আকাশের নীচে ঢাকার এক অভিজাত রেস্টুরেন্টের কোণার চেয়ারে বিষন্ন, ভগ্নহৃদয় নিয়ে বসে আছে প্রহর। সে জানে না যাকে নিয়ে তার জীবনের বাকি পরিকল্পনা। সে আদৌতেও তার হবে কি না? যার একটি কথার মূলে হাজারটা ডিল হয়। যার একটি সাইনে কত কোম্পানির ভাগ্য খুলেছে সেই প্রহর মির্জা জীবন কিনা আঁটকে গেছে অথৈর হ্যা কিংবা না তে! প্রহর হয়ত আলফাজের সামনে খুব সহজে বলে ফেলেছে অথৈ যা বলবে তাই করবে। কিন্তু, আসলেই কি প্রহর পারবে? মোটেও না। তার তো এখুনি ইচ্ছে করছে আবিরের নাক ফাটিয়ে দিয়ে আসতে। প্রহর মির্জার স্ত্রীকে বিয়ের করার শখ আজন্মের জন্য ঘুচিয়ে দিয়ে আসতে। কতবড় সর্বনাশ করতে চাইছে প্রহরের ওই ব্যাটা আবির!

#চলবে