মন বোঝেনা পর্ব-১২+১৩

0
60

#মন_বোঝেনা
#Tahmina_Akhter

১২…

সাবিনা দৌঁড়ে বারান্দায় গেলেন। নীচে তাকিয়ে দেখলেন কিছু মানুষ জড়ো হয়ে আছে। হয়ত, মারামারি হচ্ছে এলাকার ছেলেদের মধ্যে। হটাৎ চিৎকার শুনে অতিরিক্ত ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন সাবিনা। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। তারপর, অথৈকে ডাকার জন্য ওর রুমের দিকে পা বাড়ায়। গিয়ে দেখলেন অথৈর রুমের দরজা খোলা। ভেতরে ঢুকলেন সাবিনা। পুরো রুম আঁধারে ছেয়ে আছে। কে বলবে এখন বিকেল? সাবিনা নিঃশব্দে হেঁটে রুমের দুটো জানালার পর্দা সরিয়ে কাচ খুলে দিলেন। আলোয়ে ভরে ওঠল সারা ঘরময়। সাবিনা ঘুরে খাটের দিকে তাকালেন। মেয়েকে দেখে উনি মৃদু আর্তনাদ করে দৌঁড়ে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। অথৈ যেন এই স্পর্শের অপেক্ষায় ছিল। মা’কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। সাবিনা মেয়েকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করছে,

— তোর কি হয়েছে অথৈ? মা’কে বল না সোনা? তোর সঙ্গে কি কেউ মিস বিহেভ করেছে? এই অথৈ? জবাব দিস না কেন?

সাবিনা মেয়েকে শান্ত করতে যেয়ে নিজেই অস্থির হয়ে যাচ্ছেন। অথৈ শান্ত হতে পারছিল না। কাঁদতে কাঁদতে ওর হিচকি উঠে গেছে। দম আঁটকে আসছে ওর।

সাবিনা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। নিজেকে শান্ত রাখার বৃথা চেষ্টা করছেন। উনি নিজেও জানেন অথৈকে শান্ত করতে হলে নিজেকে আগে শান্ত হতে হবে। ধীরে ধীরে অথৈর কান্না বন্ধ হলো। মায়ের কাঁধে মাথার রেখেই জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তকে নিয়ে ভাবছে। এত বড়ো সেক্রিফাইস করার মত মন-মানসিকতা যে এখনও তার তৈরি হয়নি সেটাও উপলব্ধি করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। সাবিনা ভাবছেন এখনই সময় অথৈকে জিজ্ঞেস করার,?

— অথৈ?

— হুম?

— তোকে আমরা কত আদর করে বড়ো করেছি! সেই তুই যদি হুট করে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদিস তবে কেমন লাগবে আমার বল? জানিস বুকের বা পাঁজরের কাছে মনে হচ্ছে কেউ বড় পাথরের বোঝা তুলে দিয়েছে। তোর কান্না দেখলে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। কি হয়েছে মা’কে বল? বলে তো দেখ মা সমাধান করতে পারি কি না?

মায়ের কথায় অথৈর যেন দুঃখ আরও বেড়ে যাচ্ছে। চোখের পানি ছাপিয়ে বের হচ্ছে। এতটা অসহায় কেন লাগছে আজ? মানুষটাকে রিজেক্ট করার পর মনে হচ্ছে সে নিজেকেই নিজে প্রত্যাখান করেছে।

— তোর আব্বুর সঙ্গে শেয়ার করবি? আমাকে বলার প্রয়োজন নেই। তোদের বাপ-মেয়ের কোনো ব্যাপারে আমি ছিলাম না আমি কোনোদিন। আজও থাকব না। তোর বাবা কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। তার সঙ্গেই বলিস তোর ব্যাপারে।

— আব্বুকে আমি কিছুই জানাতে পারব না মা। আব্বু শুনতে পারলে ভীষণ কষ্ট পাবে। বলবে আমি তার কথার, সিদ্ধান্তের মান রাখিনি।

— কি বলছিস তুই এসব? তোর আব্বুর কোন সিদ্ধান্তের কথা বলছিস?

—- মা আমি একজনকে পছন্দ করি।

অথৈর কথাটি বলতে না বলতেই কেঁদে ফেলল। সাবিনা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর, ফিক করে হেসে বলল,

— ওমা এতে কান্না করার কি আছে? পছন্দ করিস ভালো কথা। কে সে? তাকে আমাদের সামনে নিয়ে আয়। পরিচয় করিয়ে দে?

— তাকে আমি বারণ করে দিয়েছি। বলেছি আমি অন্যকারো সাথে কমিটেড।

প্রথমে সাবিনা মেয়ের কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারলেন না। কিন্তু, কমিটেড শব্দটা শোনার পর ভ্রু কুঞ্চিত করে অথৈর হাত ধরে শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

— তুই কার সঙ্গে কমিটেড অথৈ?

— ইধি ফুপি কল করেছিল কাল। উনি আমাকে সবটা বলেছে।

— ইধি!!

— হ্যা ; মা। ইধি ফুপি সব বলেছে। ছোটবেলায় যে তোমরা আমার বিয়ে দিয়েছো এটাও বলেছে আমাকে। আমি নাকি আব্বুকে দুশ্চিন্তায় রেখেছি। আমার জন্যই নাকি আব্বুর বারো মাস প্রেসারের ঔষুধ খেতে হয়। তাছাড়া, আমি যদি তোমাদের সেই পাত্রকে মেনে না নেই। আব্বুর এবং তোমার এই সমাজে মান-মর্যাদা কমে যাবে। সবাই তোমাদের প্যারেন্টিং নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। তোমাদের জন্য আমার জীবন সদা সর্বদা বিসর্জন দিতে তৈরি আছি। আমার কারণে তোমরা কখনো কারো সামনে মাথা নত করোনি, করবেও না। তোমাদের জন্য আমি এমন হাজারটা সেক্রিফাইস করতে পারি মা। তোমাদের ভালোবাসার সামনে পৃথিবীর সকল ভালোবাসা তুচ্ছ।

অথৈর কান্নারত মুখের দিকে তাকিয়ে সাবিনা অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইল। কতগুলো বছর ধরে মেয়েটার কাছ থেকে ঘটনাটি লুকিয়ে রেখেছিল। আর ইধি কিনা মেয়েটাকে সবটা জানিয়ে দিলো! একটিবার তাদের জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনবোধ করল না! একটিমাত্র মেয়ের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে সবসময় প্রাধাণ্য দিয়ে এসেছে ওর বাবা এবং মা৷ বিয়ের মত একটা সেনসিটিভ ইস্যুকে দুই বান্ধবী মিলে আবেগের বশে এসে দুটো ছেলে-মেয়ের বুঝ হবার আগে বিবাহ বন্ধনে আঁটকে ফেলেছে। যতদিনপ উনারা বুঝতে পারলেন যে উনাদের সিদ্ধান্ত ভুল হয়েছে ততদিনে বড্ড দেরি হয়ে গেছে । আজ মেয়ে কাঁদছে কারণ তার পছন্দের মানুষকে সে রিজেক্ট করেছে। কারণ, তার বাবা-মায়ের সম্মানের দিকে যে তাকে তাকাতে হবে এই ভেবে?

সাবিনা জানে না এই পরিস্থিতি কি করে সামাল দেবেন? নিজের মেয়েকে তো আর কষ্ট দিতে পারবেন না। গোল্লায় যাক দুনিয়া! অথৈ যাকে পছন্দ করেছে তার সঙ্গেই অথৈর বিয়ে হবে। অথৈর বাবা এলেই আজ রাতের মধ্যে নাজিফার সঙ্গে কথা বলে অতিশীঘ্রই প্রহর এবং অথৈর ডিভোর্স সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করতে হবে।
আপাতত এই ব্যাপারে অথৈর সঙ্গে কথা না বলে নিজেরাই ঝামেলা মিটিয়ে নিবে। নয়ত, অথৈ আরও ভেঙে পরবে। যেই সম্পর্কের কোনো ভিত্তি নেই সেই সম্পর্কের বিচ্ছেদ অনুষ্ঠান এতটা আয়োজন করে কেন করতে হবে?

সাবিনা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। ইশশ একরাতের মধ্যেই মেয়েটার ওপর কি ঝড়টাই না বয়ে গেছে!

আলফাজ বাড়িতে ফিরেই অথৈর সঙ্গে দেখ করতে চাইলেন। সাবিনা বাধা দিলেন। সাবিনার বাধা’কে উপেক্ষা করেই অথৈর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে। সাবিনা একে একে সব ঘটনা জানিয়ে দেয় আলফাজকে। সব জানার পর আলফাজ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো সাবিনার দিকে। সাবিনা আলফাজের হাতের ওপর হাত রেখে বলল,

— জানি না ইধির কখনো খারাপ চেয়েছিলাম কিনা? কিন্তু, ইধির কারণে আমার মেয়ে যে কষ্ট পেয়েছে আমি কোনোদিনও ভুলব না। আমার এইটুকুন মেয়েটা কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে গেছে।

— তাহলে এখন কি করব? নাজিফা আপাকে কল করে জানাব যে অথৈ সব জেনেছে জানার পর ও বলছে যে, ও বিয়ে মানে না।

— তাই বলে দাও। আমাদের মেয়ে আমাদের জন্য জীবনের চমৎকার এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কাছে আত্মসমর্পণ করে সারা জীবন আফসোস করুক আমরা তা চাই না । আমরা মেয়ের মুখের হাসির কারণ হতে চাই। কান্নার কারণ মোটেও হতে চাই।

— প্রহর মির্জাই যে ওর স্বামী এটা কি জানে অথৈ? নাকি কেবল বিয়ের কথাই শুনেছে?

আলফাজের কথায় সাবিনার কপালের চিন্তার ভাজ পরল। বিচ্ছিন্ন ভাবনাকে একপাশে রেখে সাবিনা বলল,

— ইধি যেহেতু এতকিছুই বলেছে তাহলে প্রহরের নাম এবং পরিচয় নিশ্চয়ই জানিয়েছে। আর অথৈর ব্যাপারে তো জানোই? ও যে প্রহরকে মোটেও পছন্দ করে না এটা তোমার আমার চেয়ে ভালো কে জানে?

সাবিনার যু্ক্তি শুনে আলফাজ আর বলার মত খুঁজে পেলো না।
আলফাজ সেই রাতেই নাজিফাকে সবটা জানালো। অথৈ যে এই বিয়েকে মেনে নিতে পারছে না তাও বলে দিয়েছে।

**************

অথৈ আর প্রহরের অফিসে যেতে পারল না। বলতে গেলে ইচ্ছে করেই যায়নি। কি দরকার শুধু শুধু মনটাকে পোড়ানোর? বিরহ দহনে মন পোড়ার গন্ধে এমনিতেই ঘুম আসে না অথৈর। গত সাতদিন ধরে অথৈ নিজেকে বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। দিনশেষে নিজেই নিজের কাছে হেরে যাচ্ছে। কোনো যুক্তির মারপ্যাচে প্রহরকে ভুলতে পারছে না অথৈ। এদিকে ওর বাবা-মা বারবার তার পছন্দের মানুষের নাম জানতে চাইছে। অথৈর একটাই কথা আগে, তোমরা সবকিছু ঠিক করো। তারপর তার নাম জানাব। পরিচয় জানিয়ে দেব। তোমাদের অতি পছন্দের মানুষ প্রহর মির্জাকে যে আমি মন দিয়েছি তোমরা অতি শীঘ্রই জানতে পারবে।

আলফাজ মেয়ের কথায় মুচকি হাসে। মনে মনে বলে,

— আবিরকে ভালোবাসিস তুই! এটা আমি টের পেয়েছি অনেক আগেই। দুজন দুজনকে কত ভালোভাবে বুঝিস! আবিরের সঙ্গে যে তোর বিয়ে ঠিক করে রেখেছি পরে তোকে সারপ্রাইজ হিসেবে জানাব৷

ঘটনার বেশ কিছুদিন পর মির্জা ভ্যালিতে…

প্রহর ওর রুমে বসে আছে। রাত তখন ঢের হয়েছে। ল্যাপটপের স্ক্রীণে অথৈর হাসোজ্জল চেহারা ভেসে আছে। প্রহর সেদিকে তাকিয়ে আছে। চোখের পলক পরছে না। কিছুসময় অতিক্রম হবার পর প্রহরের চোখ থেকে আপনাআপনি জল গড়িয়ে পড়ে। ভালোবাসা হারানো যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতেই প্রহর মৃদু চিৎকার দিয়ে বলল,

— যাকে কখনো মেনে নিতে চাইনি। দেখতে চাইনি তার ছবি। তাকে আজ কতটা চাইছি! অথৈ! এই অথৈ! আমি কি নিয়ে বাঁচব বলো? অথৈকে ছাড়া প্রহর অসম্পূর্ণ। হে আল্লাহ আজকের রাতে আপনি আমাকে মৃত্যু দান করুন। আজ রাতে যদি মরে যাই। হাশরে আমি অথৈকে চাইতে পারব। আগামীকাল আমার অথৈ পর হয়ে যাবে। অথৈ আমার জন্য হারাম হয়ে যাবে।

পুরুষ মানুষ চিৎকার করে কাঁদতে পারে না ঠিকই। কিন্তু তাদের হৃদয়ে যতটা অনুভূতি লুকানো থাকে তা উপলব্ধি করার ক্ষমতা এই পৃথিবীতে কারোর নেই। প্রহরের অর্ন্তদেহে সবটা নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। দেহের বাইরে কে জানবে কতটা ভাঙচুর দেহের অন্দরে হচ্ছে?

#চলবে

#মন_বোঝেনা
#Tahmina_Akhter

১৩…

— প্রহর?

— হুম?

— আগামী পরশু দিন তোদের ডিভোর্স হবে।

— ভালো।

আম্মিকে জবাব দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল প্রহর। বুকের ভেতর ভাঙন চলছে তা কি করে বোঝাবে কাউকে? হাতের ফাইল সরিয়ে টেবিলের ওপর রেখে দিলো।

নাজিফা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। প্রহরকে চিনতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। হয়ত তার ছেলে সবার সাথে মিশতে পারত না, আগ বাড়িয়ে কথা বলত না, হয়ত আত্মকেন্দ্রিক ছিল বলেই। ঘরের ভেতরে তার ছেলে কতটা প্রাণবন্ত ছিল তার চেয়ে ভালো কে জানে? সেই প্রাণবন্ত ছেলে হুট করে কতটা গম্ভীর হয়ে গেছে সেটা তো তিনি চোখেই দেখতে পাচ্ছেন। ছেলের জীবনটাকে নিজ হাতে ধ্বংস করে দিয়েছেন। ছেলের মুখের দিকে তাকালেই বুক ভেঙে কান্না বেরিয়ে আসে। অথচ, জীবনে এমন ছন্নছাড়া প্রহরকে দেখতে হবে কখনো ভেবে দেখেননি তিনি! নাজিফা নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে পারলেন না। শক্ত গলায় প্রহরকে বললেন,

— তুই শুধু একবার রাজি হয়ে দেখ। অথৈকে আমি যে করেই হোক এই বাড়িতে নিয়ে আসব। হোক আইনের মারপ্যাচে কিংবা সাবিনার ওপর প্রেশার ক্রিয়েট করে। তবুও তুই রাজি হ। অথৈকে আমি তোর করেই ছাড়ব। তোকে আমি কখনো এমন রুপে দেখব আমি কল্পনাও করিনি প্রহর। মা হয়ে তোর জীবনটাকে নষ্ট করে দিলাম।

প্রহর মলিন চোখে ওর মায়ের দিকে চেয়ে রইল। নাজিফা ছেলের চোখের ভাষা বুঝতে চেষ্টা করল।

— আম্মি সংসার জোর করে হয় না। অথৈকে ধরে বেঁধে আমার সঙ্গে সংসার করতে বাধ্য করলে। সেও আমার একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে আমার সঙ্গে সংসার করবে। এটাকে তখন সংসার নয় জেলখানার কয়েদিরা যেমন কারাবাস ভোগ করে ঠিক তেমনি মনে হবে। অথৈর শরীর থাকবে আমার সংসারে আর মন থাকবে অন্য কারো কাছে।

শেষের বাক্য বলার সময় প্রহর মৌনতা গ্রহণ করল যার দরুন নাজিফা শুনতে পেলো না প্রহরের মনের কথা। ছেলের কথায় নাজিফা আর কিছু বলার মত খুঁজে পেলো না।

এমন সময় নাজিফার মোবাইলে কল এলো। লয়ার রিজওয়ান কল করেছে। নাজিফা প্রহরের সামনে কল রিসিভ করল। মিনিট পাঁচেক কথা হলো তাদের মাঝে। নাজিফা কল কেটে দিলো। প্রহর ওর আম্মির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। নাজিফার ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল,

— পরশুদিন তোদের ডিভোর্স হবে তবে লিখিত ভাবে নয় মৌখিক ভাবে। পারবি তো তুই অথৈকে তালাক দিতে? আবারও ভেবে দেখ বাপ? এখনও সময় আছে।

যেন প্রহরের হৃদ স্পন্দন যেন থমকে গেছে। যেন শিরা-উপশিরায় রক্ত বহমান নেই। মস্তিষ্কের প্রত্যেকটি স্নায়ুর আন্দোলন কার্যক্ষমতা কমে যাচ্ছে। যার এত সুখী জীবন তার মনে হচ্ছে পৃথিবীর সকল সুখ আদৌও সে পায়নি। জীবনের সকল পূর্ণতা অথৈকে না পাওয়ার আক্ষেপে অপূর্ণতার মেঘে এসে আড়াল করে দেবে।

রাত বারোটা,

প্রহর জেগে আছে। ওর ঘরের সঙ্গে লাগোয়া ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আজ ঢাকার রাতের আকাশকে দেখছে। বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রহর তৃষ্ণার্ত গলায় বলছে,

— ভালোবাসারা ভালো নেই। ভালোবেসে মানুষ কেবল ধ্বংস হয়, শূন্যতাকে আঁকড়ে বাঁচে। ভালোবাসার মানুষের জন্য স্পন্দিত হৃদয় ধীরে ধীরে স্পন্দনের মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করে। নিজের চোখে দেখা স্বপ্নগুলোর মৃত্যুর একমাত্র সাক্ষী নিজেই হয়। আমার পরিণতিও কি তবে তাদের মতই হবে?

না ; আর পারছে না। “অথৈকে ভালোবেসেও পেলাম না ” আক্ষেপ নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে ” অথৈকে আমি জয় করে নিয়েছি ” ব্যাপারটা মোটেও মন্দ নয়। ভালো যখন বেসেছি তখন যুদ্ধের ময়দানে নামতে তো হবেই। অথৈর সঙ্গে সংসার করার দরকার নেই। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে অথৈর মুখখানা। রাতে ঘুমানোর ফাঁকে অথৈকে বুকের মাঝে টেনে এনে প্রশান্তির ঘুম দিতে পারলেই হবে। ওত লোক দেখানো সুখী সংসার বুননের দরকার নেই। মন বোঝেনা হাজার খানেক অজুহাত। মনের তোএকটুখানি ভালোবাসার দরকার।

প্রহর অতি দ্রুতই বারান্দা থেকে ঘরে এলো। বেডসাইড টেবিলের ওপর থেকে মোবাইল নিয়ে বের হয়ে গেলো ঘর থেকে। উদ্দেশ্য অথৈর কাছে যাওয়া। প্রিয় বউয়ের মুখখানা দেখার উদম্য ইচ্ছা।

রাতের ঢাকায় ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে একঘন্টার পথ চল্লিশ মিনিটে শেষ করল। অথৈদের বাড়ির সামনে এসে মোবাইল হাতে নিয়ে কল করল তার প্রিয় মানুষের নাম্বারে।

অথৈ রাত জাগা পাখির ন্যায় জেগে আছে। অন্ধকার ঘরে শুয়ে আছে। মাথার ওপর ঘুরতে থাকা ফ্যানের ওপর দৃষ্টি অথৈর। মাথায় বিচ্ছিন্ন দুশ্চিন্তা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রহরকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে পরক্ষণেই সেই মানুষটার কথা ভাবছে। যাকে অবুঝ কালে না জেনে বুঝেই কবুল বলেছে । মানুষটাকে কখনো দেখেনি এবং দেখতেও চায় না। তার পরিচয় অব্দি জানতে চায়নি। কি হবে জেনে? জীবনের চূড়ান্ত সময়ে এসে নামেমাত্র একটি বিয়ে তার আর প্রহরের মাঝে এসে বাঁধা সৃষ্টি করছে। সেই মানুষ আর তার সঙ্গে নামেমাত্র সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেই শান্তি। একটু আগেই ওর মা এসেছিল। বলে গিয়েছে আগামী পরশুদিন সেই নামেমাত্র সম্পর্কের সমাপ্তি হবে। তবে লিখিত নয় মৌখিক ভাবে। কারণ বিয়েটা মৌখিক অর্থেই হয়েছিল। দুজনের অপ্রাপ্ত বয়সের কারণ কাবিননামা করা হয়নি। অথৈ সাফ সাফ ওর মাকে জানিয়ে দিয়েছে যেন সেই লোকের সঙ্গে ওর কোনোপ্রকার দেখা না হয়। সে তালাক বলবে আর অথৈ শুনবে। সাক্ষী যারা থাকবে তারাও শুনবে ব্যস আর কিছুতেই অথৈ থাকবে না। কথাগুলো শুনে ওর মা কিছুই বলল না উল্টো অথৈর মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেছে।

হুট করে মোবাইলের রিংটোন বেজে ওঠে। অথৈ ভয় পাচ্ছে কারণ এত রাতে কার কল আসতে পারে ভেবে। পরিবারের কারো কিছু হলো না তো আবার? অথৈ কাঁপা কাঁপা হাতে বালিশের তলা থেকে মোবাইল বের করে দেখল স্ক্রীণে প্রহর স্যার নাম ভেসে উঠেছে।

অথৈ কল রিসিভ করতে পারল না তার আগেই কল কেটে গেছে। প্রহর আবার অথৈর নাম্বারে ডায়াল করল। এবার অথৈ কল রিসিভ করল।

— হ্যালো অথৈ? প্লিজ কল কাটবে না।তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কিছু কথা আছে।

— কি কথা?

— মোবাইলে বলতে পারব না। তুমি কি একটু নীচে আসতে পারবে?

— মানে? আপনি কি আমাদের বাসার কাছেই?

অথৈ বিস্মিত হয়ে প্রহরকে জিজ্ঞেস করল।

— হ্যা তোমাদের বাসার নীচেই আছি। তুমি একটু আসবে?

— হ্যা ; আমি আসছি।

অথৈ প্রহরের ডাককে উপেক্ষা করতে পারল না। মেইন ডোর খোলার আগে দেয়ালের ওপর ঝুলতে থাকা গেইটের চাবি নিয়ে দরজা খুলে বের হয়ে এলো। পা টিপে টিপে হেঁটে বের হলো ওদের বিল্ডিং থেকে। বাগান পেরিয়ে সদর দরজা কাছে পৌঁছেতেই লোহার গ্রীল গলিয়ে দেখতে পেলো তার প্রিয় মানুষটার গাড়িটাকে। দ্রুত পায়ে হেঁটে দরজার সামনে এসে চাবির সাহায্যে তালা খুলে বের হয়ে প্রহরের গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

প্রহর ড্রাইভিং সীটেই বসে ছিল। পূর্ণ জোসনার আলোতে তার প্রিয় বউকে দেখে গাড়ি থেকে বের হয়ে এলো। তৃষ্ণার্ত অবস্থায় মানুষ পানি পেলে যেভাবে তৃষ্ণা নিবারণ করে। ঠিক তেমনিভাবে প্রহর নিজের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে। নয়ত, অথৈকে একপলক দেখার তৃষ্ণায় মরেই যেত আজ।

— এত রাতে কেন এসেছেন আপনি?

— তোমাকে দেখতে এসেছি। মনকে বুঝাতে পারছিলাম না। মানুষের শরীরের সবচেয়ে বেপরোয়া আর বেহায়া অঙ্গ হচ্ছে মন । বেহায়া মনটাকে বোঝাতে পারছিলাম না আর না পারছিলাম নিজেকে সামলাতে। তাই তো ছুটে এসেছি তোমাকে দেখতে।

অথৈ মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শুনছিল প্রহরের কথা। ভাবছিল মানুষটা কত চমৎকার ভাবে কথা বলে।

প্রহর গাড়ি থেকে বের হয়ে এলো। অথৈর সামনে এসে দাঁড়ালো। খুব কাছাকাছি তারা। অথৈ পিছিয়ে যাচ্ছিল তখনি প্রহর একহাত দিয়ে অথৈর হাত ধরে নিজের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

— তোমাকে আমি ভালোবাসি। এই দেহে প্রাণ থাকা অব্দি ভালোবেসে যাব। তুমি কার সঙ্গে কমিটেড? কার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছে ওসব শোনার আমার কোনো কৌতুহল নেই। আমি শুধু এতটুকু জানি, আমার যা চাই তা পেতে হবে এট এনি কস্ট। এই মূহুর্ত থেকে যা কিছু ঘটবে সব আমার দায়িত্ব এর পেছনে কারো কোনো হাত নেই। যা কিছু করব সব তোমাকে পাওয়ার জন্য করব।

অথৈ বোকার মত তাকিয়ে আছে প্রহরের মুখের দিকে। ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে আলোতে প্রহরের চোখের রক্তিম দৃষ্টি অথৈর অন্তরাত্মাকে নাড়িয়ে দেয়। চোখের দৃষ্টি বলে দিচ্ছে। প্রহর এখানে ভালো উদ্দেশ্য আসেনি। অথৈ এবার প্রহরের বাঁধন থেকে মুক্ত হতে চাইল। ছুটে যেতে চাইল বিল্ডিংয়ের ভেতডে। কিন্তু, প্রহরের শরীরে যেন অসুরের শক্তি ভর করেছে। পকেট থেকে একটি রুমাল বের অথৈর মুখ ওপর চেপে ধরতেই অথৈ ঢলে পরল প্রহরের গায়ে। প্রহর অথৈকে কোলে তুলে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ির দিকে।

#চলবে