মন বোঝেনা পর্ব-১৪+১৫

0
60

#মন_বোঝেনা
#Tahmina_Akther

১৪.

— আমার মেয়েকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে আপনার ছেলে। মিচ্যুয়াল ডিভোর্স হচ্ছিল ওদের মাঝে। এমন তো আর না যে আপনার ছেলের মতামত না নিয়ে আমরা ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। হুট করে কি এমন হয়েছে যে আপনার ছেলে আমার মেয়েকে আমারই বাড়ির সামনে থেকে নিয়ে গেছে?

আলফাজ সাহেব রাগান্বিত সুরে জিজ্ঞেস করল এহসান এবং নাজিফা মির্জাকে। সাবিনা আলফাজকে শান্ত থাকার জন্য বারবার অনুরোধ করছিল। কিন্তু, আলফাজ নিজের ধৈর্য ধরে রাখতে পারছিল না। এহসান কিছু বলতে যাবে ঠিক তখন না নাজিফা এহসানকে ইশারায় চুপ থাকতে বলল। এহসান স্ত্রীর কথামত চুপ করে আছে।

— প্রমাণ আছে আপনাদের কাছে যে আমার প্রহর অথৈকে কিডন্যাপ করেছে?

নাজিফার দৃঢ়তা অকুতোভয় কন্ঠ শুনে আলফাজের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। মৃদু চিৎকার দিয়ে হুমকিস্বরূপ বলল,

— সিসিটিভি ফুটেজ আছে। এবং সেখানেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে অথৈকে কে নিয়ে গেছে? আপনি যতই আপনার ছেলের সাফাই গান না কেন? আপনার ছেলেকে যদি আমি জেলের ভাত না খাইয়েছি তবে আমার নাম আলফাজ আহমেদ না? আজকের দিনের মধ্যে অথৈকে আমার চাই এট এনি কস্ট।

নাজিফা এবার আর চুুপ থাকতে পারল না। নিজের স্বভাবগত গন্ডি পেরিয়ে আলফাজ সাহেবকে শক্ত গলায় বললেন,

— সিসিটিভি ফুটেজের ব্যাখায় যাব না আমি। অথৈকে তো আর প্রহর বাড়ির ভেতর থেকে কিংবা রাস্তার থেকে তুলে নিয়ে যায়নি। আপনাকে আমি দুটো পয়েন্ট দেখাচ্ছি । পয়েন্ট নাম্বার ওয়ান-
ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে প্রহর গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল রাস্তায়। অথৈ বিল্ডিং থেকে বের হয়ে গেটের তালা খুলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রহরের সঙ্গে দেখা করে। এই ঘটনা দেখলে বোঝা যায় যে, আপনার মেয়ের সম্মতিতে আমার ছেলের সঙ্গে তার দেখা হয়।

পয়েন্ট নাম্বার ট্যু-

যখন ওদের দুজনকে একসঙ্গে দেখা গিয়েছে তখন সময় প্রায় রাত একটা ত্রিশ মিনিট। এত গভীর রাতে অথৈ কেন প্রহরের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছে? প্রহরের সঙ্গে তো ওর কখনোই বনিবনা হয়নি! এহসানের কাছে শুনেছি আমি। অফিসে আমার ছেলে বস হিসেবে অথৈ কার থেকে কখনো রেসপেক্ট পায়নি। সেঃ অথৈ কিনা প্রহরের ইশারায় সাড়া দিতে রাত একটা ত্রিশ মিনিটে ঘর ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে গেছে!

নাজিফা কথাগুলো শেষ করে ক্ষান্ত হলো। আলফাজ, সাবিনা এবং এহসান চুপ করে আছে। এর ফাঁকে সাবিনা নাজিফাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

— দেখ নাজিফা। কে কার ডাকে সাড়া দিয়েছে? প্রহর কেন অথৈকে কিডন্যাপ করেছে সব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলেও প্রহর এবং অথৈকে খুঁজে পাওয়া অনেক জরুরি। আমি চাই না কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার স্বীকার হোক আমার মেয়ে। তুই এখুনি প্রহরের সঙ্গে কন্টাক্ট করার চেষ্টা কর। আর যদি না পারিস তবে আমরা পুলিশের সাহায্য নিতে বাধ্য হব।

নাজিফা শুনল কথাগুলো। নাজিফার কপালে দুশ্চিন্তার ভাজ স্পষ্ট। ছেলেটা গতকাল রাতেও বলেছে অথৈর সঙ্গে জোর করে সংসার করবে না। সেই আলাপের দু’ঘন্টা পের হতে না হতেই কোন ফাঁকে গিয়ে অথৈকে কিডন্যাপ করে কোথায় চলে গেছে কে জানে? মানুষ যে প্রেমে পরলে বোকা হয়ে যায় আজ তার সঠিক প্রমাণ পেলো নিজের ছেলেকে দেখেই।

নাজিফা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোবাইল হাতে নেয় প্রহরকে কল করার জন্য। হুট করে একটি মেসেজের নোটিফিকেশন এলো। প্রহরের নাম্বার থেকে এসেছে। উত্তেজনায় নাজিফার শরীর কাঁপছে। ভয়ে ভয়ে মেসেজ ওপেন করল। পুরো মেসেজ শেষ করার পর নাজিফা শুকনো গলায় এহসানকে ডাক দিয়ে বলল,

******★*******

অচেনা পাখির কলরবে আজ ঘুম ভাঙল আমার। চোখ বন্ধ রেখেও টের পাচ্ছিলাম রৌদ্রের। হুট করে মনে হলো আজকের সকাল খানিকটা ভিন্ন। অন্যরকম কিছু। প্রচন্ড ভালোলাগা নিয়ে যখন চোখ খুললাম তখন নিজেকে আবিষ্কার করলাম, অচেনা স্থানে, অচেনা ঘরে!

অজানা আতংকে এতটাই ভয় পেয়েছি হুট করে চিৎকার দিয়ে বন্দিদশা থেকে মুক্ত হতে চাচ্ছিলাম। ঠিক তখনি কেউ ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে উঠল,

— মাত্র এক ঘন্টা হয়েছে ঘুমিয়েছি। চিৎকার করছো কেন? পাশের ঘরে দাদি আছে শুনতে পারলে কি বলবে বলো তো?

— আপনি.. এ.. এক মিনিট। আপনার সঙ্গে আমার শেষবার দেখা হয়েছিল রাতে। আপনি আমাকে কল করে নীচে আসতে বলেছিলেন। আমি নীচে গিয়েছিলাম। এন্ড দ্যান ওয়াট হেপেন্ড আই ডোন্ট রিমেম্বার! আপনি কি করেছেন আমার সঙ্গে? আর কোথায় নিয়ে এসেছেন আমাকে?

কথাগুলো বলতে বলতেই অথৈ প্রহরের বুক থেকে সরে এসে খাট থেকে নেমে পরল। প্রহর গাঢ় চোখে চেয়ে রইল অথৈর পানে। অথৈ রাগে কাঁপছে। নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে। প্রহরের কাছে মনে হলো অথৈকে সে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছে। অফিসের সেই পরিপাটি, শাড়ি পরিহিতা অথৈকে আজ অন্যভাবে আবিষ্কার করেছে। ঘুম জড়ানো চোখ, ঝাঁঝালো কণ্ঠ, এলো চুলের অথৈকে আজ নতুন অর্থেই দেখ হলো। প্রহর যখন অথৈকে দেখতে ব্যস্ত ঠিক তখনি অথৈ একটি অভাবনীয় কান্ড ঘটিয়ে ফেলল।

খাটের ওপর উঠে এসে প্রহরের শার্টের কলার চেপে ধরল। সামান্য প্রহরের দিকে ঝুঁকে দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে বলল,

— যেভাবে এনেছেন ঠিক সেভাবে আমাকে আমার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবেন। রাইট নাউ।

— তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসার জন্য তো এখানে নিয়ে আসিনি অথৈ।

— আপনি কি পাগল হয়ে গেছ..কথাটি সম্পূর্ণ করতে পারল না অথৈ। আয়নায় চোখ যায়। পরনের লাল শাড়ি দেখে ভ্রু কুচকে ফেলল। চট করে মনে হল তার পরনে লাল শাড়ি ছিল না। কালো সাদা রঙের থ্রী-পিছ ছিল। আয়না থেকে দৃষ্টি সরিয়ে প্রহরের দিকে তাকিয়ে বলল,

— আমার পরনের কাপড় কে বদলেছে?

— আমি। নির্বিকার হয়ে জবাব দিলো প্রহর।

অথৈর কাপড় বদলে দেয়া যেন খুব স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল তার কাছে। অথৈর মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর শব্দ শুনল আজ৷ নারীর জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ তার ইজ্জত। সেই ইজ্জতের ওপর যখন কোনো আঁচ লাগে তখন সেই নারীর মৃত্যু ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। কারণ, মানুষের বসবাস সমাজের মধ্যে। সমাজ একজন কলুষিত নারীকে কখনোই মেনে নিবে না। মেনে নিবে না তার কলংকিত দেহকে। অথৈর দুচোখে জল ভরে ওঠল। যাকে বিশ্বাস করল, যাকে ভালোবাসল। যাকে রক্ষক ভেবেছে সেই মানুষটাই কিনা ভক্ষক! জীবনের সবচেয়ে বড় ধোকা ওর প্রিয় মানুষটাই ওকে দিয়েছে?

অথৈ কপাল এক হাত রেখে অসহায় হয়ে প্রহরকে উদ্দেশ্য করে বলল,

— এটা আপনি কি করলেন? একটিবার ভাবলেন না আমার পরিণতি কি হবে? আমি এই সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারব কি-না?

অথৈকে প্রায় দিশেহারা অবস্থায় দেখে প্রহর তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নেমে অথৈর সামনে গিয়ে ওকে ধরতে চাইলে অথৈ প্রহরের বুকে ধাক্কা দিয়ে বলল,

— ডোন্ট ইউ ডেয়ার মি. প্রহর মির্জা। আমাকে স্পর্শ করার দুঃসাহস দেখাবেন না। আমি পাগল! নয়ত আপনার মত পুরুষকে বিশ্বাস করেছিলাম? হিমানী ঠিকই বলেছিল, আপনি একজন নারীলোভী।

— অথৈ!! ডোন্ট ক্রস ইউরস লিমিট।

—আপনি আপনার সকল লিমিট ক্রস করে ফেলেছেন। আপনি এতটা নারী পিপাসু যে আপনি নারীদেহের ভেতরে যে একটি মন থাকে সেটা আপনি কখনোই উপলব্ধি করতে পারেননি।

প্রহরের মনে হলো ওর কানে কেউ গরম সীসা ঢেলে দিয়েছে। এতটা তিক্ত বাক্য নিজের প্রিয়তমা স্ত্রী কাছ থেকে শুনতে হবে কখনো কল্পনা করেনি।

— হিমানীকেও বুঝি এভাবে ভোগ..।

অথৈ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই অথৈর ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে চুপ হতে বলল প্রহর। কিন্তু অথৈ নাছোড়বান্দা। প্রতিবাদ না করে থাকতে পারবে না। ঘৃনাভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রহরকে বলল,

— আপনি আমার সতিত্ব নষ্ট করে ফেলেছেন! আমি কি এমন অপরাধ করেছি যে আপনি আমাকে এত বড়ো শাস্তি দিয়েছেন? এখন যে আমার আত্মহত্যা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

অথৈর মুখে আত্মহত্যা শব্দ শুনে প্রহর রেগে গিয়ে অথৈর বাহু চেপে ধরতে গিয়েও হাত গুটিয়ে নেয়। জোড়ে শ্বাস ছেড়ে অথৈর হাত ধরে শক্ত করে মুঠোয় চেপে ধরল। যেন ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে অথৈ।

— তুমি আমার স্ত্রী অথৈ। তুমি আমার বাল্যকালের বৌ। তোমাকে আমি সবটা দিয়ে ভালোবাসার অধিকার রাখি। তুমি আত্মহত্যা করবে কেন? আমাদের সম্পর্কের একটা নাম আছে। পবিত্র বন্ধন আছে। বিয়ে হয়েছে তোমার আর আমার।

অথৈ স্তব্ধ হয়ে যায়। ছটফটানো ভাবটা কমে যায়। প্রহর সেই সুযোগে অথৈর হাত আরও শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

— তোমাকে আমি ভালোবাসি অথৈ। আমার পক্ষে তোমাকে ডিভোর্স দেয়া সম্ভব নয়। নিজের মনকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি সফল হতে। তোমাকে ছাড়া আমি নিজের অস্ত্বিত্বকে কল্পনা করতে পারছি না। তোমাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য যদি আমাকে আরও কোনো কঠিন পদক্ষেপ নিতে হয় তবে আমি তাই করব। তবুও আমার তোমাকেই প্রয়োজন।

অথৈ প্রহরের বুক থেকে মাথা তুলে ভেজা চোখ নিয়ে প্রহরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

#চলবে
#মন_বোঝেনা
#Tahmina_Akhter

১৫…

— তোমার সম্মতি না নিয়ে তোমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করার স্পর্ধা আমার নেই অথৈ। আমি এতটা সাহসী নই যে আমার অথৈর সম্মতি না নিয়ে গভীরভাবে ছুঁতে পারব তাকে। তুমি পবিত্র আছো। তোমার শরীরে একটি লোমও আমি দেখিনি। কান্না করো না মেয়ে। তোমার চোখের জলে আমার বুক ব্যাথা করে।

অথৈ কান্না ভেজা চোখে তাকিয়ে রইল প্রহরের পানে। প্রহর অপরাধী কন্ঠে এতক্ষণ ধরে উপরোক্ত কথাগুলো বলছিল। হাতের উল্টোপিঠে চোখের জল মুছে ফেলল অথৈ। প্রহরের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

— কিন্তু, একটু আগে না বললেন আপনি আমাকে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছেন?

— মিথ্যে বলেছিলাম তোমাকে। শিরিন তোমার শাড়ি পাল্টে দিয়েছে। তোমাকে ক্লোরোফোম দিয়ে অচেতন করার কারণে, রাস্তায় বেশ কবার বমি করেছিলে। তোমার পরনের কাপড় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তোমাকে সামলাতে গিয়ে আমারও ড্রেস খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কতক্ষণ আর তোমাকে নোংরা কাপড়ে রাখব এই ভেবে শিরিনকে বললাম তোমার ড্রেস বদলে দিতে।

অপরাধীর ন্যায় মাথা নীচু করে জবাব দিলো প্রহর। অথৈ ভ্রু কুঁচকে ফেলল। তারপর, হুট করে প্রহরের কলার চেপে ধরল।

— এত ভণিতা না করে তখনই বলতে পারতেন আপনি। মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন কেন? আপনি জানেন আমি কতটা ভেঙে পরেছিলাম? আমাকে কিডন্যাপ করে কে নিয়ে আসতে বলেছিল আপনাকে?

— কিডন্যাপ করে নিয়ে না আসলে তোমার আমার ডিভোর্স হতো আগামীকাল ।

কলারে রাখা অথৈর হাতের ওপর নিজের হাত রেখে শান্ত সুরে বলল প্রহর। অথৈ যেন আরও চটে গেল।

— আপনার সঙ্গে আমার ডিভোর্স হলেই বরং ভালো হয়। সামনাসামনি একবার আপনার আমাকে বলা উচিত ছিল আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে। বাট আপনি কি করলেন? লুকিয়ে গেলেন ব্যাপারটা! আমাকে বিয়ের প্রপোজাল দিলেন। কেন? আমাদের বিয়ের সম্পর্কের ব্যাপারে জানালে কি আপনাকে খেয়ে ফেলতাম আমি?

— তুমি কিন্তু এখনও আমার ওপর চেঁচাচ্ছ অথৈ! আমি তোমাকে সত্যটা এইজন্যই জানাতে চাইনি যে যেন তুমি আমাকে আমাদের প্যারেন্টসদের নেয়া সিদ্ধান্তের ওপর নিজের সিদ্ধান্ত বানিয়ে ফেলো। আমি চেয়েছি তুমি যেন শুধু আমাকে ভালোবেসে আমাকে মেনে নাও। ভালোবাসবে দূরের কথা। প্রপোজ করার পর তুমি আমাকে কি বললে? তুমি অন্য কারো সঙ্গে কমিটেড! জানো ভেতরে ভেতরে আমি কতটা ভেঙে পরেছিলাম! মানুষ যে টাকা-পয়সা ছাড়াও ভালোবাসার অনুভূতিতে আটকে যেতে পারে সেদিনই উপলব্ধি করতে পারলাম আমি। রাঙামাটি থেকে ফিরে সোজা বাড়িতে গিয়ে আম্মিকে বলেছিলাম ডিভোর্সের এ্যারেন্জমেন্ট করতে। আম্মি সব এ্যারেন্জ করলেন ঠিকই আমি নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। আমি অথৈ নামক নাম ডিঙিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারছিলাম না। কারণ আমার মস্তিষ্ক অজান্তেই আমার ভূত-ভবিষ্যৎ সবকিছুতেই অথৈকে সেট করে ফেলেছে। যেদিকে যাই মস্তিষ্কের সকল স্নায়ুকোষ অথৈকে মনে করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয় অথৈকে আবির স্পর্শ করবে, ভালোবাসবে। শীতের সকালের মিষ্টি রোদে একই চাদরের তলে তারা একে অপরের সঙ্গে মিশে থাকবে। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম এই ভেবে যে, আবির কেন তোমায় পেয়ে যাবে কোনো সাধনা ছাড়াই?

— ওয়েট! ওয়েট? আবিরের কথা এখানে আসছে কেন?

— আলফাজ আঙ্কেল আমাকে জানিয়েছেন একবার। তোমার আমার ডিভোর্স সম্পন্ন হলে আবিরের সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে। তাছাড়া, তুমি নিজেই তো আমাকে বললে তুমি কারো কমিটেড?

প্রহরের মুখে এই কথা শুনে অথৈ মাথায় হাত দিয়ে মনে মনে বলল,

— যার জন্য করলাম চুরি সেই বলে চোর। আমি যে আপনার সাথে কমিটেড এটা তো জানতাম না। আপনাকে পাওয়ার জন্যই তো সেই অচেনাকে ডিভোর্স দিতে চাইলাম, কমিটমেন্ট ভাঙতে চাইলাম। আর আপনি কিনা ভাবলেন আমি আবিরের সঙ্গে কমিটেড! দুজনেই দুজনকে পেতে এতকিছু করলাম। অথচ, আমার অজান্তেই আমাদের ডিভোর্স হতে পারত। যদি না আপনি আমাকে সত্যিটা জানাতেন। নিজের অজান্তেই আমি আপনাকে হারাতে যাচ্ছিলাম।

আনমনে ভয়ে আঁতকে উঠল অথৈ। প্রহর অথৈকে আঁতকে ওঠতে দেখে অস্থির হয়ে বলল,

— কি হয়েছে অথৈ? শরীর খারাপ লাগছে?

— না ; ঠিক আছি আমি।

— কিছুক্ষণ বিশ্রাম নাও। আমাকে একটু বের হতে হবে।

প্রহর অথৈর হাত ধরে বিছানার দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় কথাগুলো বলল। মানুষটা যে এতটা পাগল ছিল ওর জন্য কখনো বুঝতেও দেয়নি। এত ভালোবাসা বুকে বয়ে বেরিয়েছে অথচ একটিবারও ক্লান্ত হয়নি। একটিবারও বলেনি যে, তোমাকে ভালোবেসে আমার ক্লান্তি লাগছে। খানিকটা ভালোবাসার বোঝা তুমি কাঁধে তুলে নাও।

অথৈ মৃদু হেসে প্রহরের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,

— ভালোবাসা নামক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে যেদিন পাশ করবেন সেদিনই জানতে পারবেন, আপনার অথৈ কেবল আপনাকেই পেতে চেয়েছে আর কাউকে নয়।

অথৈকে শুইয়ে রেখে প্রহর চলে যাচ্ছিল ঠিক তখনি অথৈ প্রহরকে ডেকে জিজ্ঞেস করল,

— কোথায় যাচ্ছেন?

— এই তো কাছে কোথাও যাচ্ছি!

—আমিও যাব সঙ্গে।

অস্বস্তি কাটিয়ে জবাব এলো অথৈর পক্ষ থেকে। অথৈ আবারও প্রহরকে জিজ্ঞেস করল,,

— কাছে বলতে কোথায়? এখানে পুকুর আছে?

এরই ফাঁকে প্রহর এগিয়ে এসে অথৈর হাত মুঠোয় বন্দি করে বলল,

— বাইরে গেলেই দেখতে পারবে।

অথৈ প্রহরের সঙ্গে বেরিয়ে এলো। প্রহর ঘরের দরজা খুলে বের হবার পর অথৈর চোখের সামনে উন্মুক্ত হলো এক বিয়ে বাড়ির দৃশ্য। গুরজনের তাড়াহুড়ো, বাচ্চাদের কোলাহল, পাড়া-পড়শীর উৎসুক দৃষ্টি সবটাই চোখে পরল অথৈর। অথৈ প্রহরের বাহু শক্ত করে চেপে ধরল তারপর জিজ্ঞেস করল,

—আমরা কোথায় আছি?

অথৈর প্রশ্নের জবাবে প্রহর মুচকি হেসে খুব মিষ্টি গলায় জবাব দেয়,

— তোমার শ্বশুরবাড়িতে। তুমি এখন আমাদের গ্রামের বাড়িতে আছো।

অথৈ বিস্মিত হয়ে দেখছিল চারপাশ। সত্যি কি তাই! ভাবতেই বিস্মিত হলো। প্রহর যদি ডিভোর্স আটকানোর জন্য ওকে কিডন্যাপ করে নিয়ে আসে তবে ওদের গ্রামের বাড়িতে কেন নিয়ে এসেছে?

প্রহর যেন অথৈর মুখ দেখে মনের হাল বুঝতে পেরেছে।

— আগামীকাল আমার কাজিন লুবনার বিয়ে। বেশ কয়েকবার ফোনে দাওয়াত, দাওয়াত কার্ড অব্দি পাঠিয়েছে আমার ইউসুফ চাচ্চু। বাবা-আম্মি কেউই দাওয়াত এক্সেপ্ট করেনি কারণ যেদিন লুবনার বিয়ে হবে ওইদিন তোমার আমার বিচ্ছেদের দিন ঠিক হয়েছে। বিচ্ছেদের দিন এখন গোল্লায় গেছে। সোজা বৌ নিয়ে এসেছি বোনের বিয়েতে।

শেষের কথাগুলো বলার সময় প্রহরকে বেশ আনন্দিত মনে হচ্ছিল। অথৈ কেবল প্রহরের সুখি চেহারার দিকে তাকিয়ে নিজেই আনন্দ অনুভব করছে।

— এইডাই কি তোর বৌ রে প্রহর? ভোর রাইতে বৌরে কোলে লইয়া বাইত আইলি। তহন তোর বৌয়ের মুখটা দেখতে পারি নাই। দেহি তো তোর বৌ কেমন?

ষাটোর্ধ বৃদ্ধা প্রহর এবং অথৈর সামনে এসে কথাগুলো বলল। অথৈর গালে এক হাত রেখে প্রহরের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধা বলল,

— সাধে কি আর নিজের বিয়া করা বৌরে তুইলা আনছোস? এমন বৌরে কেবল পিঞ্জিরার মইধ্যে বন্দি বানায়া রাখতে হয়। মন চাইলে একটু বাইর কইরা দেখবি নয়ত আটকায় রাখবি৷

কথাগুলো শেষ করে বৃদ্ধা অথৈর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

— আমি প্রহরের দাদি। তোমারও দাদি হই আমি।

অথৈ দাদিকে সালাম জানালো। দাদি ভীষণ খুশি হলো। অথৈকে জড়িয়ে ধরে অস্থির হয়ে বলছিল,

— তোমারে না পাইলে আমার নাতি শেষ হইয়া যাইত। তোমারে ফেরত আনতে সে ভুল পথ বাইছা নিছে ঠিকই কিন্তু তোমার প্রতি তার ভালোবাসা ভুল না৷

অথৈ আঁড়চোখে একবার প্রহরের দিকে তাকিয়েছিল। দেখল প্রহর ওদিকেই তাকিয়ে আছে। অথৈ লজ্জায় দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল। প্রহর নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজের হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করছে।

দুপুর হতেই আরও অনেক মেহমান আসতে শুরু করে। সেই সব মেহমানদের মাঝে ছিল অথৈর বাবা-মা এবং প্রহরের বাবা-মা। প্রহরের দাদিকে দেখে উনারা থেমে গেলেন। প্রহরের দাদি ভীষণ আনন্দিত হয়ে ছেলের বৌকে বুকে জড়িয়ে বললেন,

— কেমন চোখ জুড়াইয়া যায় প্রহরের বৌরে দেখলে!

নাজিফা অবাক হয়ে নিজের শ্বাশুড়িকে জিজ্ঞেস করল,

— আম্মা, প্রহর এখানে এসেছে? অথৈ কি ওর সঙ্গেই আছে?

— ওর বৌ ওর লগে থাকব না তো কি আমার লগে থাকব। যেই পরীর লাহান বৌ প্রহরের! প্রহর যে এতদিন এই বৌয়ের লাইগা ধৈর্য ধইরা আছিল আমি তো ভাইবাই অবাক হইয়া যাইতাছি!

নাজিফা সহ বাকি সবাই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রহর কেন অথৈকে কিডন্যাপ করেছে কিছুই বুঝতে পারছে না? আর অথৈ বিহেভিয়ার খানিকটা সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। দুটো আসুক আজ। হাতেনাতে ধরবে। তারপর জিজ্ঞেস করবে মামলা কি? দুজন ভেতরে ভেতরে কি ফন্দি আঁটছে?

এদিকে প্রহর, অথৈ, প্রহরের কিছু কাজিন বাড়ির বাইরে গিয়েছিল। পাশেই বিলের ধারে। এখন বাড়িতে ফিরে এসেছে। উঠোন পেরিয়ে যখন ঘরের কাছাকাছি এলো তখন পরিচিত কিছু মুখ দেখে প্রহর এবং অথৈ থমকে দাঁড়ালো। পরিবারের কাছে কি জবাব দিবে ভেবেই ঘাম ছুটে যাচ্ছে প্রহর-অথৈর।

#চলবে