মন বোঝেনা পর্ব-১৬+১৭

0
61

#মন_বোঝেনা
#Tahmina_Akhter

১৬…

অথৈর পরিবারকে এবং নিজের পরিবারকে দেখে প্রহর শক্ত করে অথৈর হাত ধরে রাখল। অথৈ মলিন দৃষ্টিতে এক ক্ষনের জন্য তাকিয়ে ছিল প্রহরের দিকে। প্রহরের হাসিমুখটায় অমাবস্যার আঁধার নেমে এসেছে। অথচ, বেশকিছু সময় আগেও প্রহরের ঠোঁটের কোণে হাসি লেগে ছিল।

প্রহরের বুকে দহন হচ্ছে। অথৈর বাবা-মাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন অথৈকে তারা চিরকালের জন্য ওর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে। যদি এরকম কিছু হয় প্রহর স্রেফ মরে যাবে। এত বিলাসবহুল জীবনে যদি ভালোবাসা নামক বস্তু না থাকে তবে বেঁচে থাকা দায়।

আলফাজ এবং সাবিনা মেয়েকে দেখে যেন তাদের হৃদয়ে প্রাণ ফিরে এসেছে। সাবিনা এবং আলফাজ অথৈর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। প্রহরের হাতে বন্দি করে রাখা অথৈর হাতটাকে মুক্ত করে আলফাজ প্রহরের দিকে রক্তচক্ষু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

—– ডোন্ট ইউ ডেয়ার প্রহর! আমার মেয়েকে আমার বাড়ির সামনে থেকে তুলে এনে তুমি মোটেও ভালো করোনি।

প্রহরের চোখের সামনে দিয়ে অথৈকে একপ্রকার টেনে নিয়ে যাচ্ছে আলফাজ। ওদের পেছনে সাবিনা। প্রহর অসহায় হয়ে নাজিফার দিকে তাকালো। নাজিফা চোখে ইশারায় ছেলেকে শান্ত থাকতে বলল। কিন্তু, মায়ের কথায় কি অশান্ত হৃদয় শান্ত হবে? বুকের ভেতর যেই উথাল-পাথাল ঢেউ আঁছড়ে পরছে তা কেবল অথৈকে বুকের মধ্যে আগলে নিতে পারলে শান্ত হবে। কোনো শান্তি বাণী কাজে আসবে না এখন।

প্রহর বিয়ে বাড়ির আমেজ ছেড়ে ঘাট বাঁধানো পুকুরের কাছে চলে যাচ্ছে। নাজিফা এবং এহসান দৌঁড়ে ছেলের পেছনে ছুটে গেল।।

বিশাল এক পুকুর। পুকুরের চার পাড়ে অসংখ্য সুপারি গাছ এবং নারকেল গাছের সাড়ি। শান বাঁধানো ঘাটে এসে বসল প্রহর। টলটলে জলের দিকে তাকিয়ে রইল। জলের মাঝে নিজের প্রতিবিম্ব ফুটে উঠেছে। প্রতিবিম্বর দিকে তাকিয়ে প্রহর আবিস্কার করল ওর প্রতিবিম্ব বিদ্রুপের হাসি হাসছে। প্রহর বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে ছিল। প্রহরকে অবাক করে দিয়ে তার নিজের প্রতিবিম্ব বলে উঠল,

— অথৈ কখনোই তোর ছিল না এবং কখনোই তোর হবে না। জোর করে একটা মানুষের দেহকে আটকাতে পারবি। কিন্তু, অথৈর মনকে কি দিয়ে বাঁধবি? মানুষকে কি দিয়ে কাবু করা যায় জানিস? ভালোবাসা দিয়ে। কিন্তু, অথৈ তো তোকে ভালোবাসে না। আবিরকে ভালোবাসে। যদি তোকে ভালোবাসত তাহলে তোর এত অস্থিরতা দেখেও কেন বলল না, প্রহর আপনি অস্থির হবেন না। আমি ভালোবাসি আপনাকে!

— অথৈর ভালোবাসার প্রয়োজন নেই আমার। আমার ভালোবাসা যথেষ্ট আমাদের জন্য। অথৈ কাকে ভালোবাসে ওসব দেখার সময় আমার নাই। আমি অথৈকে ভালোবাসি এটাই জানি। আর অন্যকিছু জানতে মোটেও উৎসাহী নই।

প্রহরের কথা শুনে প্রহরের প্রতিবিম্ব অট্টহাসিতে ফেটে পরল। প্রহর অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো জলে ফোটে ওঠা নিজের প্রতিবিম্বের দিকে।

— প্রহর?

কারো ডাক শুনে প্রহর পেছনের দিকে তাকালো। ওর মা এসেছে। প্রহর আবারও জলের দিকে তাকালো। আশ্চর্য তো এংন ওর প্রতিবিম্ব স্বাভাবিক। হাসছে না কেন? এতক্ষণ তবে কি হচ্ছিল?

নাজিফা এবং এহসান দৌড়ে এসে প্রহরের পাশে গিয়ে বসল। প্রহর তাকালো না উনাদের দিকে । নাজিফা ছেলের কাঁধে হাত রেখে শান্ত সুরে বলল,

— তোর দাদুর বাড়িতে আসবি একবার আমাকে জানানোর প্রয়োজনবোধ করলি না? আর ওভাবে অথৈকে নিয়ে এলি কেন?

— অথৈ আমার স্ত্রী আম্মি। ওকে কোথাও নিয়ে গেলে নিশ্চয়ই আমার কারো কাছ থেকে পারমিশন নিতে হবে না?

— বারবার গোয়ার্তমি করবি না প্রহর! তুই টিনেজ প্রহর নেই যে এখন যা মন চাইবে তাই করবি। তুই নিজেই আমাকে বলিছিলি অথৈর সঙ্গে ডিভোর্সের ব্যবস্থা করতে। আবার কি মনে হলো তোর বলা নেই কওয়া নেই মেয়েটাকে ওর বাড়ির সামনে থেকে তুলে নিয়ে এসেছিস তোর দাদুর বাড়িতে! তুই কি চাইছিস বল তো আমাদের?

— আমার অথৈকে চাই। কতবার বোঝাবো তোমাদের? একই কথা বারবার বলতে বলতে আমি ক্লান্ত। অথৈকে যদি না পাই আই সয়্যার ছেলের মরা মুখ দেখার জন্য প্রস্তুত হও তোমরা।

নাজিফা বিস্মিত হয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। প্রহর রাগে অন্ধ হয়ে গেছে। কি বলছে কিছুরই বোধগম্য নেই ওর! এহসান ছেলের কাঁধে হাত রাখল। ব্যস একটুখানি স্নেহমাখা স্পর্শের প্রয়োজন ছিল বোধহয়। প্রহর ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর, কাঁদতে কাঁদতে ওর বাবাকে বলল,

— ভালোবাসা বড্ড খারাপ অনুভূতি কেন? ওকে না পেলে মনে হয় অনুভূতির তাপে পুড়ে ছাই হয়ে যাব। বাবা, ওকে আমার করে দিন না? ওকে না পেলে আমি জানি না আমার পরিণতি কি হবে? আমার শুধু অথৈকে চাই বাবা৷ পৃথিবীর কোনো কিছুই আমাকে মুগ্ধ করেনি, মোহে আটকাতে পারেনি , টাকা-পয়সার প্রতি লোভ জাগাতে পারেনি। আমার নিজের হাতে গড়া কোনো সম্পদ আমাকে মানসিক তৃপ্তি দিতে পারেনি। আমার মুগ্ধতা, ভালোবাসা, সম্পদ, লোভ, মানসিক তৃপ্তি সবটাই যেন অথৈকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বাবা। আমি অথৈকে না পেলে মরে যাব বাবা। স্রেফ মরে যাব।

———————–

— তোর মোটেও উচিত হয়নি ওতরাতে ঘর থেকে বের হয়ে প্রহরের সঙ্গে দেখা করার। প্রহরকে আমি জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়ব। তুই জানিস? আবিরের পরিবার কোনোভাবে জেনে গেছে তুই বাড়িতে নেই। তোকে তোর অফিসের বস কিডন্যাপ করেছে। তুই আন্দাজ করতে পারছিস আমাদের জন্য ব্যাপারটা কতটুকু এমব্যারাসিং?

আলফাজ মেয়ের ওপর রেগে কথাগুলো উগড়ে দেয়। সাবিনা অথৈর কাঁধে হাত রেখে পাশে বসে ছিল। অথৈ মাথা নীচু করে বসে ওর আব্বুর কথাগুলো শুনছিল। ওর আব্বুর বলা কথাগুলো শেষ হতেই অথৈ শান্ত সুরে ওর আব্বুকে জবাব দিলো।

— আমার অফিসের বস আমাকে কিডন্যাপ করেনি আব্বু। আমাকে আমার স্বামী নিয়ে এসেছে।

দুটোবাক্য যেন বজ্রপাতের ন্যায় পরল সাবিনা এবং আলফাজের ওপর। বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো মেয়ের দিকে। অথৈ সেদিক কর্ণপাত না করেই আলফাজের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল।

— তোমরা মোটেও এই কাজটা ঠিক করোনি আব্বু! আমি তোমাদের কতটা ট্রাস্ট করি! আর তোমরা কি করলে? আমাকে একটিবার জানানোর প্রয়োজনবোধ করলে না! আবিরকে আমি স্রোফ ভালো বন্ধু করি। এর বাইরে নাথিং এলস। সেই আবিরের সঙ্গে তোমরা আমার বিয়ে ঠিক করে রেখেছো আমাকে না জানিয়ে!

— কিন্তু, তুই তো আবিরকে পছ…

সাবিনাকে পুরো কথা সম্পূর্ণ করতে বাঁধা দিলো অথৈ।

— মা, আমি আবিরকে নয় প্রহরকে ভালোবাসি।

সাবিনা এবং আলফাজ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তাদের মাথায় কিছুই ঢুকছে না। সাবিনা অবাক হয়ে অথৈকে প্রশ্ন করল,

— কিন্তু, তুই তো বলিছিলি তুই অন্য কাউকে ভালোবাসিস। প্রহরের সঙ্গে যেন তোর ডিভোর্সের শীঘ্রই ব্যবস্থা করি। আবার এখন তুই নিজেই বলছিস যে প্রহরকে তুই ভালোবাসিস!

অথৈ ওর মায়ের হাত ধরে বলল,

— মা খুব বড়ো মিসআন্ডারস্টান্ডিং হয়েছিল আমার। ইধি ফুপি আমাকে কেবল ব্যক্তি সম্পর্কে এবং তার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক এতটুকু বলেছিল। নাম বলেনি। আমি রাঙামাটি থেকে আসার পর তোমাদের যখন ডিভোর্সের ব্যবস্থা করতে বললাম তখনও কিন্তু পারতে আমাকে নামটা জানাতে। কিন্তু বলোনি তোমরা। তুমি এবং আব্বু কখনোই আমাকে নাম জানাতে চাওনি।

অথৈ ওর মায়ের হাত ধরে কথাগুলো বলেই ওর আব্বুর দিকে তাকিয়ে বলল,

— আব্বু আমি প্রহরকে ভালোবাসি। প্রহরকে পাওয়ার জন্য আমি সেই ব্যক্তির কাছ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তোমাদের ডিভোর্সের ব্যাপারে বলেছিলাম।

অথৈ মাথা নীচু করে ফেলল। কত বড়ো একটা ভুল বোঝাবুঝির কারণে ওদের জীবনে কতবড়ো বিপর্যয় আসতে চলেছিল! আলফাজ উঠে দাঁড়ালো। ধীর পায়ে হেঁটে অথৈর সামনে এসে দাঁড়ালো। সাবিনা মেয়েকে একপাশে জড়িয়ে ধরল। কারণ আলফাজের রাগান্বিত চেহারা অনেক কিছুই বলে দিচ্ছিল। আলফাজ হাত উঠাতেই অথৈ ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। আর সাবিনা মেয়েকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে বলল,

— মোটেও আমার মেয়ের গায়ে হাত দেয়ার দুঃসাহস দেখাবে না আলফাজ। কাউকে ভালোবাসা অপরাধের কিছু নয়। মনের অজান্তেই হোক অথৈ কিন্তু আমাদের পছন্দ করা পাত্রকে ভালোবেসেছে। তুমি নিজে কি করেছো? আমাকে টিউশনি পড়াতে যেয়ে আমাকে ভালোবাসার মোহে ফেলে বিয়ে করেছো। আর আমাদের মেয়ে নিজের স্বামীকে ভালোবাসে বলে ওর গায়ে তুমি হাত তুলতে চাইছো?

— তোমরা নারীরা পারো বটে! কোথাকার কথা কোথায় টেনে নিয়ে যাও আল্লাহ ভালো জানেন! আমি আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলব? তোমার মস্তিষ্কে এই টাইপের ভাবনা এলো কোত্থেকে সাবিনা ?

আলফাজ মৃদু স্বরে সাবিনাকে বকল। অথৈ ওর মায়ের কাঁধ থেকে মুখ তুলে আব্বুর মুখের দিকে তাকালো। দেখল ওর আব্বু হাসিমুখে তাকিয়ে আছে।

আলফাজ মুচকি হেসে অথৈর মাথায় হাত রেখে বলল,

— অথচ, কিছুমাস আগেও আমি জানতাম আমার অথৈ প্রহরকে পছন্দ করে না। আর আজ প্রহরকে ভালোবাসে অথচ আমি জানি না। প্রহরকে ভালোবাসিস বলেই কি তোর জীবনে আমার প্রায়োরিটি কমে গেছে অথৈ?

— মোটেও না আব্বু। তুমি আমার মাথার তাজ। তোমাকে আমার মাথার মুকুটের ন্যায় সাজিয়ে রেখেছি। তোমাকে সরিয়ে দেয়া মানে আমার জীবনের সকল দুঃসাহস, ভালোবাসা, স্নেহ, আত্মমর্যাদা, অস্তিত্বকে হারিয়ে ফেলা। তুমি আমার জীবনের সৌন্দর্য আব্বু। তোমার মেয়ের এতটা দুঃসাহস হয়নি তোমাকে ছাড়া নিজেকে কল্পনা করার। তুমি না সবসময় বলো আমি তোমার Princess? মা আর তুমি হলে আমার Queen এবং King। তোমরাই আমার রাজ্য। তোমাদের হারিয়ে ফেললে যে আমার Princess পদবি হারিয়ে যাবে।

অথৈ ওর আব্বুর হাতের ওপর মাথা ঠেকিয়ে কথাগুলো বলল। চোখের কোণে জল জমে আছে। যেকোনো মূহুর্তে গড়িয়ে পরবে!

আলফাজের তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে। সাবিনা নিজের চোখে থাকা জল আড়াল করে মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলল,

— তুই আমাদের একমাত্র সন্তান। তোর সুখ চাই বলে নাজিফার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের পরোয়া অব্দি করিনি। সবার আগে আমি তোকেই চেয়েছি অথৈ। তোর আব্বু ভেবেছিল আবিরকেই হয়ত তুই পছন্দ করিস তাই আবিরের সঙ্গে তোর বিয়ে ঠিক করে রেখেছিল। পরে তোকে সারপ্রাইজ হিসেবে জানাত। অথচ, আমাদের জন্য যে কত বড়ো সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল তা কি জানতাম? তুই যা চাইবি তাই হবে অথৈ।

অথৈর চোখে সুখের কান্না। ওর মা’কে জড়িয়ে ধরল। সাবিনা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে রাখল। আলফাজ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল।

#চলবে

#মন_বোঝেনা
#Tahmina_Akhter

১৭…

— প্রহর??

অথৈর গলার স্বর শুনে পেছনে ফিরে তাকালো প্রহর। অথৈ আসছে ওর দিকে। প্রহর চট করে পেছনে ফিরল। দুহাত দিয়ে চোখের কোণায় জমে থাকা জল মুছে ফেলল। তারপর, চেহারায় স্বাভাবিক একটা ভাব বজায় রেখে অথৈর দিকে ফিরল। ততক্ষণে অথৈ প্রহরের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রহরকে দেখেই আঁতকে উঠল অথৈ। দু’টো চোখের পাতা ফুলে গেছে তার। অথৈ বিস্মিত হয়ে প্রহরকে জিজ্ঞেস করল,

— আপনি কাঁদছিলেন?

প্রহর মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। সে কাদেঁনি । অথৈ প্রহরের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

— আপনি আমাকে বিয়ে করবেন?

অথৈর কথায় প্রহর অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইল। যেন বিশ্বাস হচ্ছে না ওর। তবুও অথৈর কথা জবাব দিলো।

— আমি তোমাকেই চাই অথৈ। বিয়ে করলে তোমাকেই করব। কারণ তোমাকে ছাড়া আমার কোনো গতি নেই।

— তাহলে আজই আমাকে বিয়ে করবেন। আপনার কাজিনের বিয়ের আসরে আমাদের বিয়ে হবে।

— তোমার বাবা-মা রাজি না অথৈ। তারা আমাদের বিয়েকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিবে না।

— যদি মেনে নেয়?

অথৈর দুষ্টুমি ভরা কথায় প্রহর চমকে উঠে। সত্যি কি তাই? হুট করে অথৈর পেছনে চোখ পরল প্রহরের। কারা যেন আসছে? অথৈর বাবা-মা এবং তার আব্বু-আম্মি। প্রহর আবারও অথৈর দিকে তাকালো। অথৈ মুচকি হেসে বলল,

— অবশেষে আপনাকে পাবার আশার আলো খুঁজে পেয়েছি। সেই আশার আলো অন্ধকার গ্রাস করার আগেই চলুন না আমরা আমাদের গন্তব্য একই পথের উদ্দেশ্য শুরু করি? ক্লান্ত পথের পথিক আমরা আমাদের জীবনের প্রতিটা পদে পদে একে অপরের হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাব। আপনি হবেন তো আমার জীবনসঙ্গী?

কথাটি বলেই অথৈ প্রহরের চোখের দিকে তাকালো। দেখল প্রহরের চোখে পানির উপস্থিতি। হুট করে প্রহরের চোখের জল গড়িয়ে পরল অথৈ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। প্রহর কান্নারত অবস্থায় অথৈকে বলল,

— বিয়েতে কি পরবে? এত অল্প সময়ে সব এ্যারেন্জ করব কি করে?

প্রহরের কথায় ফিক করে হেসে ফেলল অথৈ। প্রহর বোকাচোখে দৃষ্টিতে তাকিয়ে অথৈকে বলল,

— হাসার মত কিছুই বলিনি অথৈ।

প্রহর রেগে আছে আর সেই রাগ দেখে অথৈ হাসছে। আজ যে বড্ড সুখানূভুতি হচ্ছে। জীবনের অপ্রাপ্তির হিসেবের পাতা আজ পূর্ণতার গল্পে ভরে যাবে। ইশশ, জীবন আমাদের কত কি দিয়ে যায়? সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, মিলন-বিচ্ছেদ , পূর্ণতা-অপূর্ণতা সবটার উথান-পাত্থানের জোড়েই মানুষ বাঁচে। কেউ সুখের অনূভূতিতে বাঁচে আর কেউ দুঃখের ছাপ বয়ে বেড়ায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।

খুবই সাদামাটা আয়োজনে প্রহর এবং অথৈর বিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছে। লোকজনের সমাগম বলতে গেলে তেমন কেউ নেই। লুবনার বিয়ের পরপরই অনেক মেহমান চলে গেছে, কেউবা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিয়ে সম্পূর্ণ হবার পর অথৈকে নিয়ে একঘরে বসে আছে নাজিফা। গ্রামের কিছু মানুষ বিয়ের খবর শুনে ছুটে এসেছে। প্রহরের বৌকে যেই দেখছে সেই খুশিতে বাকবাকম। এদিকে অথৈকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে প্রহর। কিন্তু, সবার সামনে গিয়ে তো আর সরাসরি বলতে পারছে না যে,

“আপনারা একটু রুম থেকে বের হবেন? আমি আমার স্ত্রীকে দেখে দুটো চোখকে শান্তি দিতে চাই”

প্রহরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ওর কাজিনরা। ষোলো জনের বিশাল বড়ো একটা কাজিনগ্রুপ। প্রহরকে আপসেট দেখে প্রহরের বড়ো জেঠুর ছেলে লাবিব জিজ্ঞেস করল,

— কি হয়েছে ভাই? নিজের বৌকে দুবার বিয়ে করার পর তোমার চেহারা মলিন দেখায় ক্যান? তোমার তো খুশিতে চোখে পানি আসার কথা। আর আমাদের দেখো! জীবনে শুধু একবার বিয়ে করতে চাই তবুও বিয়ে করতে পারছি না। আর তুমি নিজের বৌকে দুবার বিয়ে করে ফেললে!

লাবিবের কথায় হাসির ফোয়ারা বইছে। প্রহর রেগে কটমটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে লাবিবকে বলল,

— সবসময় ডাবলমিনিং বের করিস কেন? তুই কি বিয়ে করছিস? তোর কি বৌ আছে? কিছুই তো নাই। অতএব কি দাঁড়ালো তোর যেই জিনিসের অভিজ্ঞতা নাই তুই কেমনে সেই ব্যাপারে আলাপ করিস? যেই ব্যাপারে তোর নলেজ নাই সেই ব্যপার থেকে দশহাত দূরে থাকবি। যেদিন বিয়ে করবি, বৌ আসবে সেদিন আমার অবস্থা বুঝতে পারবি।

প্রহরের কথা শুনে সবাই চুপ হয়ে গেলেও একজন চুপ থাকল না। সোজা সেখান উঠে ছাঁদ থেকে নেমে নাজিফার কাছে গিয়ে A – Z ডিটেইল খুলে বলল। সবটা শোনার পর নাজিফা হেসে ফেলল। মাগরিবের নামাজের পর সবাইকে তাগাদা দিলো ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য। সবাই চলে যাওয়ার পর নাজিফা শিরিনের হাত শাড়ির প্যাকেট এবং গয়নার বক্স দিয়ে বলে যায় অথৈকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিতে।

অতি যত্নসহকারে অথৈকে সাজিয়ে দিলো শিরিন। লাল জামদানি শাড়ি, সিম্পল গলার স্বর্ণের চেইন, কানে সোনার দুল, নাকে নাকফুল, সাথে শিরিনের হাতের জাদুতে যেন অথৈকে অনন্যা বানিয়ে ফেলেছে। সাজানো শেষ হবার পর শিরিন অথৈর থুতনিতে হাত রেখে বলল,,

— প্রহরকে আগলে রেখো। তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসে। এত বছর ধরে ওকে দেখছি। কখনো এতটা অস্থির হতে দেখিনি যতটা আজ সকালে দেখেছিলাম। যখন তোমাকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলো ঠিক তখনি। তোমার জ্ঞান ফিরছিল না বলেই যেন প্রহরের শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। পরে আমি এসে সাহায্য করলাম। কিছুসময়ের মধ্যে তোমার চেতনা ফিরে এসেছে। ব্যস, এতেই যেন আমার ভাইয়ের মুখ বিজয়ের হাসি ফুটে উঠেছে। সেই হাসি আমি সবসময় প্রহরের মুখ দেখতে চাই। তুমি হবে প্রহরের হাসির কারণ।

শিরিনের কথা শুনে অথৈ মনে মনে নিজের সঙ্গে নিজেই ওয়াদাবদ্ধ হলো। সে কখনোই প্রহরকে কষ্ট দিবে না ।

বেশ রাতে করেই প্রহরকে ঢুকতে দেয়া হলো অথৈর ঘরে। প্রহর সকলের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে হাপ ছেড়ে বাঁচল। রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। রুমের ভেতরে ঢুকতেই গোলাপ ফুলের সুগন্ধি টের পেলো। আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে তাকাতেই নিজের ঘরে আবিষ্কার করল একটি আস্ত ফুলের বাগানকে। লাল গোলাপের সমারোহ। লাল গোলাপের মাঝে আর একটি লাল গোলাপ ফুটে আছে। সেই ফুলকে দেখা মাত্রই প্রহর স্থীর হলো। ধীরেপায়ে এগিয়ে যায় সেই ফুলের দিকে।

এদিকে অথৈ প্রহরের উপস্থিতি টের পেয়ে শক্ত হয়ে বসে আছে। এতদিনের চেনা-জানার বাইরে আজ তাদের মাঝে নতুন সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক। যেখানে কেবল শারীরিক লেনাদেনা নয় বরং ভালোবাসার লেনাদেনাও আছে। বরং শারীরিক লেনাদেনার চেয়ে ভালোবাসার লেনাদেনার দাম এবং ওজন বেশি।

—আসসালামু আলাইকুম অথৈ। বিবাহিত জীবনের প্রথম অর্থাৎ আজকের রাতটা ভীষণ মূল্যবান আমার কাছে। জানতে চাইবে না কেন?

প্রহরের কথায় অথৈ ঘোমটা তুলে প্রহরকে বলল,

#চলবে