মন বোঝেনা পর্ব-১৮+১৯

0
47

#মন_বোঝেনা
#Tahmina_Akhter

১৮…

— লাইট অফ করবেন প্লিজ?

ভীষণ ভয় এবং লজ্জা মিশ্রিত কন্ঠে কথাটি বলল অথৈ। অথৈর কথায় প্রহর থামল। গোলগোল আঁখিদুটিতে এক রাজ্যে সমান বিস্ময়। অথৈর অনুরোধের সারমর্ম খোঁজার চেষ্টা প্রহরের মাঝে। পরমূহুর্তে সারমর্ম ধরতে পারল যখন তখন হো হো করে হেসে উঠল। পুরো ঘরের চারদেয়ালে প্রহরের হাসির প্রতিধ্বনি তুলছে।

অথৈ নিজেকে আরও গুটিয়ে ফেলল। অথচ এমন হবার কথা ছিল না। ভীষণ অন্যরকম হতে পারত আজকের এই মূহুর্ত। জীবনের সবচেয়ে বেস্ট একটা মোমেন্টের স্মৃতি যখন মস্তিষ্কে ক্যাপচার করার কথা ঠিক তখনি ভয় আর লজ্জা কিনা কাবু করে ফেলেছে তাকে! নিজেকে নিয়ে যেন আজ বিরক্তবোধ হচ্ছে অথৈর। না জানি প্রহর এখন তাকে কি ভাবছে?

হুট করে পুরো ঘরজুড়ে আঁধার নেমে এলো। প্রহর অথৈর কথা রেখেছে। লাইট অফ করে দিয়েছে। পুরো ঘরজুড়ে কেবল কালো রঙের আবরণ, চোখের ভাষায় যাকে আমরা অন্ধকার হিসেবে কল্পনা করি।

অথৈ এবার যেন কিছুটা সাহস পেল। যাক এবার তাহলে প্রহরকে প্রাণভরে দেখা যাবে আর প্রহর টেরও পাবে না। অথৈ নিজের মাথার ওড়না হালকা তুলে তাকালো। জানালার সাদা পর্দা ভেদ করেই চাঁদের আবছা আলো আসছে। সেই আলোর সাহায্যে অথৈ দেখল প্রহর ধীরপায়ে এগিয়ে আসছে ওর দিকে। প্রহরকে কাছে এগিয়ে আসতে দেখেই অথৈ নিজের ঘোমটা নামিয়ে চোখমুখ বন্ধ করে শক্ত হয়ে বসে রইল। একমিনিট, দুইমিনিট তারপর আরও পাঁচমিনিট অতিক্রম হলো কিন্তু প্রহরের অস্তিত্ব টের পায় না অথৈ। অস্থিরতা ভর করে শরীরে। মাথার ঘোমটা সরিয়ে প্রহরকে খোঁজার চেষ্টা করবে যখন তারআগেই আবিষ্কার করল অন্য এক দৃশ্য। মূহুর্তের মধ্যে মোহাচ্ছন্ন হয়ে পরল অথৈ।

উত্তরদিকের জানালার পর্দা সরিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে প্রহর। চাঁদের আলো এসে পরছে তার মুখে। সুখী চেহারা নিয়ে তাকিয়ে আছে চাঁদের দিকে। চোখে তারায় আজ আকাশের হাজার সুখের তারা হাতছানি দিয়ে ডাকছে যেন তাকে। এতটা গভীরভাবে কখনো কি এই প্রকৃতির মাঝে ডুবেছিল সে? মোটেও না। যান্ত্রিক জীবনে কেবল অফিস আর ঘরই ছিল উপভোগ্য বিষয়। অথৈর অস্তিত্ব সম্পর্কে যেদিন জানতে পারল ঠিক সেদিন থেকেই যেন জীবনের অন্য এক অর্থ সম্পর্কে অবগত হয়েছে সে। মানুষের সাজানো গোছানো জীবনে একজন ব্যক্তিগত মানুষের প্রয়োজন হয়। যেই মানুষটাকে নিজের জীবন, প্রেম, ভালোবাসা, সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্নার মত মূহুর্তে যেন ঠিক দুই ইঞ্চি দূরত্বে সবসময় হাতের নাগালেই পাওয়া যায়। প্রহরের জীবনের সেই মানুষটা আর কেউ নয় অথৈ । যাকে সে প্রতি সেকেন্ডে, প্রতিটা মূহুর্তে নিজের পাশেই চায়।

অথৈ খাট থেকে নেমে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় প্রহরের কাছে। প্রহরের থেকে মাত্র একহাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে অথৈ। অথৈর অস্তিত্ব টের পেয়ে যায় প্রহর। যখন অথৈ খাট থেকে নামছিল তখন ওর হাতের মুঠোভর্তি চুড়ির রিনরিন শব্দ শুনে বুঝে ফেলেছিল যে তার অর্ধাঙ্গিনী ছুটে আসছে।

অথৈ চিন্তিত ভঙ্গিতে প্রহরের দিকে তাকিয়ে বলল,,

—আপনি রাগ করলেন আমার ওপর? আসলে হুট করেই নিজেকে আপনার স্ত্রী হিসেবে নিজেকে প্রেজেন্ট করতে পারছি না! ভীষণ লজ্জা পাচ্ছি! অথচ এমন কখনো হয়নি!

অথৈর কথা শুনে প্রহর পেছনে ফিরল। চাঁদের আলো এসে পরছে অথৈর চেহারায়। চাঁদের আলোয়ে অথৈকে এক অন্যরকম রুপে আবিষ্কার করল প্রহর। চেহারা থেকে আলাদা দ্যুতি ছড়াচ্ছে। পরনের গহনাগুলো কেমন চকমক করছে। সেই সাথে অথৈর চঞ্চল দুটি আখিতে নিজেকে কেমন দেউলিয়া মনে হচ্ছে!

— আপনি কি রেগে আছেন আমার ওপর? কথা বলছেন না যে?

অথৈর কথায় কেমন অনুশোচনার সুর ভেসে এলো! প্রহর মৃদু হাসল। আঁধারের খেলায় অথৈর অগোচরেই রয়ে গেলো প্রহরের সেই হাসিটা।

এক পা এগিয়ে অথৈর খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালো প্রহর। অথৈ হকচকিয়ে যায়। দূরে সরে যাওয়ার জন্য যেই পা বাড়াবে ঠিক তখনি অথৈর হাত টেনে ধরল প্রহর। অথৈ পেছনে ঘুরে তাকায় না। কেবল এতটুকুই বলল,

— হাত ছেড়ে দিন।

— হাত যখন ধরেছি তখন ছেড়ে দেয়ার প্রশ্নই আসে না। এই হাত ধরার জন্যই তো কতশত রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিয়েছি। আর আজ সেই হাত কাছের নাগালে পেয়েও ছেড়ে দিব! মোটেও না। পারলে আমি তোমার হাতের সঙ্গে আমার হাতের লক সিস্টেম করতাম।

কথাটি বলতে বলতে প্রহর অথৈর হাত সামান্য উচু করে হাতের পিঠে অধর ছোঁয়ায়। অথৈ শিউরে ওঠে। জীবনে প্রথম কোনো পুরুষের কাছ থেকে পাওয়া প্রথম স্পর্শ। প্রথম পুরুষটা তার ব্যক্তিগত মানুষ। হুট করে মনের আঙিনায় একফালি বসন্তের রোদ্দুর ছুঁয়ে গেল অথৈর।

অথৈ মাথা নীচু দাঁড়িয়ে আছে। প্রহর তাকিয়ে আছে তার প্রিয়তমা স্ত্রীর অনবত মুখের দিকে। জানালার গ্রীল গলিয়ে চাঁদের আলো এসে তাদের সারা গায়ে মাখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। চারপাশে মৃদু বাতাস বইছে। বাতাসের দোলে অথৈর শাড়ির আঁচল দুলছে।

— আমার দাদি কি বলে জানো? মাঝে মাঝে আমাদের প্রচুর ধৈর্য ধারণ করতে হয় কাঙ্ক্ষিত কিছু পাওয়ার জন্য। হোক সেটা সুখ, কিংবা টাকা অথবা শখের মানুষকে নিজের করে পাওয়ার জন্য। আমার টাকা আছে, সুখ আছে। কিন্তু,যেদিন থেকে আমার চোখের দৃষ্টি তোমায় খুঁজে পেলো ঠিক সেদিন থেকে মনে হলো আদৌও কি জীবনের প্রকৃত সুখ পেয়েছি? মোটেও পাইনি। কোটি টাকার মালিক হয়েও সুখী হতে পারিনি শুধুমাত্র তুমি পাশে ছিলে না বলে। ধৈর্য ধারণ করেছিলাম, রেখেছিলাম নিজের প্রতি, আমার রবের প্রতি বিশ্বাস। আজ দেখো তুমি আমার স্ত্রী হয়ে, আমার বৈধ প্রেমিকা, আমার চক্ষু শীতলকারী আদরিনী হয়ে উপস্থিত হয়েছো।

অথৈ প্রহরের দিকে তাকিয়ে রইল। প্রহর যে খুব চমৎকার ভাবে কথা উপস্থাপন করতে পারে আজ আবারও প্রমাণ পেলো। প্রহর হাত বাড়িয়ে অথৈর গালে একহাত রেখে আদুরে গলায় বলল,

— আমার জীবনে শুধু তোমাকে চাই অথৈ। টাকা গেলে টাকা আসবে। সম্পদ চলে গেলে আবারও গড়তে পারব। সবকিছুর বিকল্প আছে শুধু বিকল্প নেই মানুষের। পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ অদ্বিতীয়। কেউ কারো মত নয়৷ প্রহরের অথৈ কেবল একজন সেটাই তুমি। তোমাকে হারাতে চাই না। তুমি কখনো ছেড়ে যেয়েও না আমাকে ফেলে। যদি তোমাকে কখনো কষ্ট দিয়ে ফেলি মনের অজান্তে তবে শুধরে দিও আমার ভুলগুলো। তবুও একলা ফেলে কোথাও যেও না। নয়ত আমার জীবনের সকল ছন্দ হারিয়ে ফেলব।

দূর থেকে রাতের এক নিশাচর পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। কপাট খোলা জানালা দিয়ে হুড়হুড় করে বাতাস প্রবেশ করছে। জানালার পর্দা গুলো খানিকটা নড়ছে। তিমিরে তলিয়ে যাওয়া ঘরটায় কেবল দুটো মানুষের অস্তিত্ব। প্রহরের বাহুতে বন্দী অথৈ। অথৈ প্রহরের স্পন্দিত বুকে মাথা রেখে বলল,

— বেশি ভালোবেসে আমাকে দেনাদার বানিয়ে ফেলবেন না যেন? কারণ, আপনার মত এত যত্ন নিয়ে ভালোবাসা দেয়ার যোগ্যতা কই আমার?

— যত্ন নিয়ে সবাই ভালোবাসে অথৈ। কারো ভালোবাসা চোখে পরে আর কারো ভালোবাসা লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে যায়। তুমি শুধু আমার পাশে থেকো। মন চাইলে চুলের ফাঁকে হাত রেখে বিলি কেটে দিও। কখনোবা ছাঁদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে গুনগুনিয়ে গান গেয়ে শোনাবে। যে গানের একমাত্র শ্রোতা কেবল আমি হব। আমি তোমার মাঝে ভালোবাসা খুঁজে নিব৷ তোমার কিছুই দিতে হবে না। এখন উঠো নামাজ পড়তে হবে।

প্রহর অথৈর হাত ধরে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ানোর আগেই অথৈ প্রহরকে থামিয়ে বলল,,

— এশার ওয়াক্তের নামাজ দাদির ঘরেই আদায় করেছি আমি।

— আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করার জন্য দুই রাকাআত নামাজ পড়ব। তুমি কি খুশি নও আমাকে নিয়ে কিংবা তোমার নতুন জীবন নিয়ে?

প্রহরের কথার জবাবে অথৈ মাথা নাড়িয়ে হ্যা বোঝায় অর্থাৎ সে খুশি।

— তাহলে কি উচিত নয় আল্লাহকে শুকরিয়া জানানো? ধরো আমাদের শখের জিনিস কেউ কিনে দিয়েছে তাহলে কি আমরা সেই মানুষটাকে ধন্যবাদ না জানিয়ে চলে যাব? মোটেও না। আমরা তাকে ধন্যবাদ জানাবো অথবা ট্রিট দিব। এখন সেই জিনিসটা যদি রবের উদ্দেশ্য হয় তবে কেন এত কার্পন্যতা? আল্লাহর আমাদের পছন্দের মানুষের সঙ্গে জীবন জুড়ে দিয়েছেন তাহলে কি আমাদের উচিত না আল্লাহকে কৃতজ্ঞতা জানানো?

— ভারি শাড়ি পড়ে নামাজ পড়তে পারব না। এক কাজ করি আমি শাড়িটা বদলে ফেলি। আপনি কি বাইরে যেতে পারবেন?

অথৈর কথা শুনে প্রহর মুচকি হেসে ফেলল। যাক পাগলিটা বুঝল তবে। আল্লাহকে ভালোবাসে। প্রহর বাইরে যেতেই অথৈ শাড়ি চ্যান্জ করে ব্লু কালারের থ্রি-পিছ পরে নিলো।ওয়াশরুম থেকে ওযু করে এসে মাথায় ওড়নায় দুই প্যাচ দিয়ে দরজা খুলে প্রহরকে ডাক দিলো। প্রহর অথৈর নীল রঙা ওড়নার ফাঁকে অথৈর ভেজা মুখ দেখে থমকে যায়। শুকনো ঢোক গিলে মনে মনে “মাশাআল্লাহ ” “আলহামদুলিল্লাহ ” বলে রুমের ভেতরে ঢুকল।

প্রহর ওযু করে এসে দেখল অথৈ জায়নামাজ বিছিয়ে রেখেছে। একটি জায়নামাজ আগে, আরেকটি জায়নামাজ পেছনে। সামনের জায়নামাজে দাঁড়ালো প্রহর । আর পেছনে অথৈ। প্রহরের ইমামতিতে নামাজ আদায় করল অথৈ। জীবনের ঘটে যাওয়া অন্যতম সবগুলো ঘটনার মধ্যে এই মূহুর্তটা যেন সবচেয়ে দামি অথৈর কাছে।

নামাজ শেষ। জায়নামাজ ভাজ করে আলমারিতে রেখে বিছানার কাছে আসতেই প্রহর অথৈর হাত ধরে নিজের সামনে টেনে এনে দাঁড় করিয়ে মাথায় হাত রাখল। তারপর, বিড়বিড় করে কিছু পড়ছে। অথৈ সেই ফাঁকে জিজ্ঞেস করেই ফেলল,,

— কি করছেন?

— দোয়া পড়েছি। বিয়ের প্রথম রাতে স্বামী তার স্ত্রীর মাথায় হাত রেখে দোয়া পড়তে হয়।

— দোয়াটা কি?

— اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ خَيْرَهَا وَخَيْرَ مَا جَبَلْتَهَا عَلَيْهِ ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّهَا وَمِنْ شَرِّ مَا جَبَلْتَهَا عَلَيْهِ

(অর্থ- হে আল্লাহ! আমি তাঁর কল্যাণটুকু এবং যে কল্যাণের ওপর তাকে সৃষ্টি করেছেন, অভ্যস্ত করেছেন সেটা প্রার্থনা করি। আর তার অনিষ্ট থেকে ও যে অনিষ্টের ওপর তাকে সৃষ্টি করেছেন, অভ্যস্ত করেছেন তা থেকে আশ্রয় চাই)। (সুনানে আবু দাউদ ২১৬০)

প্রহরের কথা শেষ হওয়া মাত্রই অথৈ সরে যেতে চাচ্ছিল ঠিক তখনি অথৈকে বাঁধা দেয় প্রহর। অথৈর কানের কাছে মুখ বাড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

— আরও একটি দোয়া পড়তে হয় বুঝলে? কিন্তু তোমার দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করতে পারিনি। তাই আপাতত সেই দোয়ার আমল করা হচ্ছে না আমার।

কথাগুলো বলেই অথৈকে চোখ মারল প্রহর। অথৈ ভীষণ লজ্জা পেয়ে মাথা নীচু করে ফেলে। আর প্রহর হো হো করে হেসে উঠে।

#চলবে

#মন_বোঝেনা
#Tahmina_Akhter

…১৯…

জানালার গ্রীল গলিয়ে চাঁদের আলোর টুকরো এসে পড়ছে অথৈর চেহারায়। কিছু সময়ের জন্য প্রহর থমকায়, মুগ্ধ হয়। নিজের নামখানা সেরা ভাগ্যবানদের তালিকায় জড়ো করতে ইচ্ছে করে। হুট করে বদলে যাওয়া জীবনটাকে ভীষন সিনেমাটিক মনে হয়। পরক্ষনেই রবের প্রতি ভীষণ আস্থা জন্মায়। কারণ রব চেয়েছেন বলেই অথৈ আজ তার খুব কাছেই আছে। প্রহর মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে অথৈর গাল ছুয়ে দেখল। ঘুমন্ত অথৈ খানিকটা নড়ে উঠল। প্রহর মুচকি হেসে অথৈর আরও ঘনিষ্ঠে এসে কানের কাছে মুখ রেখে ফিসফিসিয়ে বলল,

— তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি আমার বৌ!

কথাটি বলেই সরে এলো প্রহর। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে।

অথৈ চোখ খুলে তাকালো। তিমিরে ঘেরা ওদের কুটিরে কেবল জানালা দিয়ে আসা চাঁদের অতি সামান্য আলোতে প্রহরের মুখের দিকে তাকিয়ে অথৈ মনে মনে বলল,

— আপনাকেও আমি ভীষণ ভালোবাসি প্রহর।

হুট করে চাঁদের আলো মিলিয়ে গেল কালো মেঘের অন্তরালে। তারায় ভরা ঝলমলে আকাশ হুট করে অন্ধকারে তলিয়ে যায় । বাতাসের তোড়ে গাছপালা যেন তালমিলিয়ে এদিকে সেদিকে দুলছে। ধীরে ধীরে বৃষ্টি নেমে এলো পৃথিবীর বুকে। টুপটুপ বৃষ্টির শব্দ শুনে প্রহরের ঘুম ভাঙল। চোখ খুলে তাকাতেই নিজেকে আবিষ্কার করল অন্যভাবে। বা পাশের বাহুতে কারো অস্তিত্ব টের পাচ্ছে! অথৈ বেঘোরে ঘুমিয়ে আছে প্রহর বাহুর ওপরে। প্রহর আরেকটু খুঁটিয়ে দেখতেই বুঝতে পারল অথৈর হাত ওর বুকের ওপর। অথৈকে রেখে উঠতে মন চাইল না তখন। নিজের বুকের ভেতর চলা উথাল-পাতাল ঢেউ সামাল দেবার জন্য অথৈকে প্রয়োজন। বুকের মাঝে অথৈকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে প্রশান্তির শ্বাস ছেড়ে অথৈর কপালে চুমু এঁকে দিলো। অথৈ প্রহরের স্পর্শ টের পেলো কি না কে জানে তবে প্রহরের বুকে মুখ লুকিয়ে রাখল।

***********************

— কি রে প্রহর তোর বৌয়ের কপালে, গালে, হাতে, পায়ে লাল এগুলো কি দেখা যাচ্ছে?

ইতি ভাবির কথায় পুরো ডাইনিং টেবিল জুড়ে একটি অদৃশ্য বোমা বিস্ফোরণ ঘটল। প্রহরের বাবা-মা, অথৈর বাবা-মা যেন লজ্জায় এইটুকুন হয়ে গেলেন ছেলেমেয়েদের সামনে। অথৈ বোকা হয়ে নিজের হাত পায়ের দিকে তাকাচ্ছে। প্রহর বিস্ফোরিত চোখে তাকালো ইতি ভাবির দিকে।

— মশার কামড়ালে যেই দাগ হয় সেই দাগগুলো কখনো দেখেননি ভাবি? আজব তো আপনি! কখন কোথায় কি বলতে হয় সেই সেন্সটুকুই তো আপনার মাঝে নেই!!

প্রহর প্রায় বিরক্তি প্রকাশ করেই বলল কথাটি। ইতি ভাবি এবার নিজের অপ্রস্তুত হয়ে গেছেন। “মশার কামড়” শব্দটা শুনে অথৈর মা নাশতা ছেড়ে ওঠে এসে অথৈর পাশে দাঁড়িয়ে বলল,,

— মশারি টাঙিয়ে ঘুমাসনি?

মায়ের কথায় অসহায়ের মত মুখ করে অথৈ বলল,

— মা এই বিষয়টা কি একটু বাদ দেবে প্লিজ? আমার লজ্জা লাগছে ভীষণ।

কথাটি সকলের কানে পৌঁছেতেই হাসির রোল পরে গেল। সবার কাণ্ডে এবার যেন আরও লজ্জা পেলো অথৈ। নাশতা রেখেই চলে গেলো। প্রহর ডাক দিতে গিয়েও দেয় না। এরই ফাঁকে অথৈর মা অথৈর মশারির ব্যপার সবাইকে জানিয়ে দিলো। অথৈ মশারি টাঙানো ছাড়া যে ঘুৃমায় না এই কথাটি এবার সকলেই জেনে গেলো।

নাশতা শেষে প্রহর ইতি ভাবির কাছ থেকে অথৈর জন্য নাশতা চেয়ে নিলো। ইতি ভাবি একটি প্লেটে রুটি, ডিম ভাজা এবং দুটো রুটি সাজিয়ে দিলো প্রহরের হাতে। প্রহরের কাছে ক্ষমা চাইলো। প্রহর কিছু না বলেই নাশতা নিয়ে অথৈর কাছে চলে গেলো। গিয়ে দেখল তার অভিমানী বৌ জানালার সামনে মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। প্লেট খাটের ওপরে রেখে দরজা বন্ধ করে অথৈর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। এতটুকু সময়ের ভেতরে অথৈ কেবল একবারের জন্য তাকিয়েছিল। এই যে প্রহর এখন ওর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে এতে ওর কোনো রিয়াকশন নেই। প্রহর অথৈর অভিমানটুকু বুঝতে পারল। পেছন থেকে অথৈকে নরম করে জড়িয়ে ধরে সফট কন্ঠে বলল,

— তুমি কি জানো তোমাকে আমি কেন এত বেশি ভালোবাসি?

প্রহরের প্রশ্ন শুনে অথৈ মাথায় নাড়ায়। সে জানে না। প্রহর আরও শক্ত করে অথৈকে বুকের মাঝে চেপে ধরে বলল,

— তুমি অনবরত কথা বললে আমার মনে হয় জীবন্ত এক মানবী টিয়া আমার আশেপাশে ঘুরছে। যার অনবরত কথায় আমার মন বাগিচায় কেবল ভালোবাসার কমলা ফুল ফোটে। স্বল্প সময়ের এই জীবনে আরও বেশ কিছুদিন বাঁচতে ইচ্ছে করে। বুঝলে আমার বৌ?

প্রহরের বলা শেষের বাক্যগুলো শুনে অথৈ ঘুরে দাঁড়ালো। প্রহরের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে ওর চোখদুটো জলে ভরে উঠল। অথৈর চোখের কার্নিশ ছুঁয়ে জল গড়িয়ে পড়ার আগেই প্রহর মুছে ফেলল চোখের জল। দু’হাতের আজলের মাঝে অথৈর মুখখানা ধরে প্রহর শীতল কন্ঠে বলল,,

— মানুষের জীবনের সর্বশেষ ভবিষ্যত হলোই মৃত্যু। মানুষ যখন দুনিয়ায় আসে তখন তার মৃত্যু তার জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করে। কারো স্বল্প সময়ের জীবন তো ; কারো দীর্ঘ জীবন। মৃত্যুদূত একদিন হুট করে এসে পাকরাও করবে। সেদিন দুনিয়ার কোনো পিছুটান আটকাতে পারবে না।, চলে যেতে হবে মৃত্যুদূতের সঙ্গে অসীম যাত্রায়। অতএব, আমাদের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকা জরুরি। কিন্তু, আমরা মানুষের জীবনের সকল আয়োজন যতটা যত্ন নিয়ে করি এর সিকিভাগও আমরা জীবনের শেষ মূহুর্তের জন্য ইনভেস্ট করি না।

অথৈর চোখের জল মুছতে মুছতে কথাগুলো শেষ করল প্রহর। অথৈ প্রহরের দিকে তাকিয়ে বলল,

— এতটা গভীরভাবে কখনো এই বিষয়ে ভেবে দেখিনি। আপনাকে ধন্যবাদ জানাই।

— ধন্যবাদ জানিয়ে কাজ হবে না বরং ইহকাল এবং পরকালের জন্য আমাদের ঝুলিতে অসংখ্য নেকি জমাতে শুরু করতে হবে।

প্রহরের কথাগুলো শুনেই অন্যমনষ্ক হয়ে অথৈ চলে যাচ্ছিল ঠিক তখনি প্রহর অথৈর কনুই ধরে নিজের দিকে টেনে এনে ধরল। অথৈ প্রশ্নবোধক চাহনি ছুঁড়ে দিলো প্রহরের দিকে। প্রহর সেই চাহনি উপেক্ষা করে অথৈকে আর কাছে টেনে এনে দাঁড় করিয়ে ফিসফিস করে বলল,

— মশারী টাঙিয়ে ঘুমাতে পারো না এটা আমাকে বললে কি ক্ষতি হতো বলো? শুধু শুধু মশা কামড় খেলে মাঝখানে বদনামি হলো আমার, লজ্জা পেলে তুমি।

— রাতে কি হয়েছিল কে জানে? এত গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলাম যে মশার কামড় অব্দি টের পাইনি! আপনাকে মশা কামড়ায়নি?

কথাটি বলেই অথৈ প্রহরকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছিল। এদিকে প্রহর দুষ্টুমিভরা কন্ঠে বলল,,

— আসলে অথৈ হয়েছে কি মশারা চান্স পায়নি আর কি? আমার বৌ যেভাবে আমার বুকের মাঝে সেঁধিয়ে ছিল তাতে মশারা আমার ওপর রেগে গিয়ে আমার বৌকে কামড় দিয়ে চলে গেল।

প্রহরের দুষ্টুমিভরা কথাগুলো শুনে অথৈ রেগেমেগে বেরিয়ে গেছে আর প্রহর হাসতে হাসতে অথৈর পেছনে পেছনে বের হয়ে এলো।

অথৈ হাঁটতে হাঁটতে পুকুরঘাটে চলে এলো। পেছনে পেছনে প্রহর চলে এসেছে। অথৈ পেছনে ঘুরে বলল,

— কিছু বলবেন?

— কি বলব? আমি তো তোমার অভিমান ভাঙাতে এলাম। এখন দেখি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগে উল্টো আমাকে প্রশ্ন করছো!!

প্রহরের কথা শেষ হতেই অথৈ খানিকটা এগিয়ে এসে প্রহরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,

— অভিমান ভাঙাতে এসেছেন?

— অফকোর্স।

— ঢাকায় কবে যাব আমরা?

— আগামীকাল।

— আমি আজই যেতে চাই।

— অভিমান ভাঙানোর শোধ কি তবে অন্যভাবে দিতে হচ্ছে??

— আমি কিছুই জানি না ব্যস এতটুকু জানি আজই চলে যেতে হবে আমাদের।

কথাগুলো বলার সময় অথৈকে কেমন বিমর্ষ মনে হচ্ছিল প্রহরের কাছে। তাই অথৈকে এই বিষয়ে আর কোনো কথা না বলেই হাত ধরে বলল,

— তুমি বলেছো তারমানে আজই আমরা ঢাকায় ফিরব। কিন্তু, একটা ব্যপার ছিল?

অথৈ প্রহরের চোখে দৃষ্টি রেখে বলল,

— কি ব্যাপার?

— তোমাকে এখন আমার সঙ্গে আমাদের বাড়িতে নিতে পারব না।

— কেন?

ভীষণ বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করল অথৈ। অথৈর কান্ডে প্রহর মুচকি হেসে বলল,

— বাহ্ আমার অথৈর দেখি ভীষণ তাড়া।

— আপনাকে ছাড়া নিজেকে কল্পনা করতে ভয় হয় আমার। সেখানে সাময়িক বিচ্ছেদ ঘটুক সেটাও আমি চাই না।

অথৈর কথায় প্রহর শান্তি পেলো। অথৈর হাতটা ভীষণ শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

— সাময়িক বিচ্ছেদের পর যদি তুমি জন্মান্তরের জন্য আমার হও তবে তো সাময়িক বিচ্ছেদ গ্রহণ করতেই হবে আমাদের। তোমার বাবা-মা এবং আমার বাবা-মায়ের ইচ্ছে তোমার আমার ওয়ালিমা বিশাল আয়োজনে আয়োজিত হোক। আজ হলো শনিবার। আজ থেকে ঠিক পাঁচদিন পর শুক্রবারে আমাদের ওয়ালিমা হবে। এবং সেদিনই তুমি আমার সঙ্গে আমাদের বাড়িতে যাবে।

অথৈ যেন খুশি হতে পারল না এই খবরে। অথচ এই খবর শোনার পর ওর ভীষণ খুশি হবার কথা। ওর বাবা-মায়ের মেয়ে হয়ে আর পাঁচদিন তাদের সঙ্গে সময় কাটাতে যে পারবে। প্রহর অথৈর শুকনো মুখখানা দেখে হয়তো মনের খবর টের পেয়েছে। অথৈর গালে একহাত রেখে আদুরে গলায় বলল,

— পাঁচদিন তোমার বাবা-মায়ের সঙ্গে সময় কাটিয়ে নাও। এরপর তো তাদের সঙ্গে তোমার দেখা কবে হবে কে জানে?
বাল্যকালের বৌয়ের সঙ্গে কতদিনের দূরত্ব কাটিয়ে এক হবো। তখন কি আর চাইলেই বউকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠাতে ইচ্ছে করবে?

— আপনি আমার মন ভোলানোর জন্য কথাগুলো বলছেন তাই না?

— মোটেও না। তুমি নিশ্চিত হয়ে বাড়ি ফিরে যাও। আমি তোমার ; তোমারই আছি ; তোমারই থাকব আমার বৌ।

সেদিন বিকেলে রওনা হয় প্রহর, অথৈ এবং তাদের পরিবার। প্রহর এবং অথৈ একটি গাড়িতে করে এসেছে। প্রহরের গাড়ি এসে অথৈদের বাড়ির সামনে থামল। প্রহর গাড়ি থেকে নেমে এসে অথৈর পাশে এসে দরজা খুলে দাঁড়ালো। অথৈ মুখ কালো করে বের হলো গাড়ি থেকে। আলফাজ এবং সাবিনা এখনো আসেনি। তাই অথৈ এবং প্রহর অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। অথৈ কোনো কথা বলছে না দেখে প্রহর বলল,,

— এভাবে মুখ কালো করে রেখেছো কেন? তোমার এই অন্ধকার মুখখানা দেখে গেলে কি রাতে আমার ঘুম আসবে বলো? এমনিতেই তোমার অভ্যাস আমার গায়ে লেগেছে!! ঘুম তো বোধহয় আগামী শুক্রবার ছাড়া কপালে নেই।

— আপনি রোজ সকালে এসে আমার সঙ্গে দেখা করবেন। আমার ঘুম ভাঙার পর যেন আমি আপনাকে আমার চোখের সামনে দেখতে পাই। যদি আমার শর্তে রাজি থাকেন তবে আমি আগামী শুক্রবার অব্দি অপেক্ষা করব। আর যদি শর্তে রাজি না থাকেন তবে আমি আজই আপনার সঙ্গে আপনার বাড়িতে ফিরে যাব।

অথৈর কথায় প্রহর মুচকি হেসে অথৈর কপালে টোকা দিয়ে বলল,

— পাগল একটা। যাও তোমার শর্তেই রাজি আমি। রোজ সকালে ঘুম ভাঙার আগেই দেখবে তোমাদের বাড়িতে এসে আমি হাজির। শ্বশুরবাড়িতে যাই আমার আলাদা একটা সম্মান ছিল সেটাও বুঝি বৌয়ের জন্য জলাঞ্জলি দিতে হবে এখন।

প্রহরের কথায় হাসছে অথৈ। আর অথৈর হাসি দেখে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রয় প্রহর। এই মূহুর্ত কখনোই শেষ না হোক। চলতে থাকুক আমৃত্যু সময় ধরে।

#চলবে