মন বোঝেনা পর্ব-২০+২১

0
45

#মন_বোঝেনা
#Tahmina_Akhter

..২০…

ভোর হতে তখন ঢের বাকি! প্রহর বিছানা ছেড়ে
উঠেছে প্রায় মিনিট দশেক আগে। কারণ, অথৈকে কথা দিয়েছে। রোজ সকালে অথৈ জেগে উঠতেই জাগতিক সকল বস্তুর আগে যেন প্রহরের মুখখানা দেখতে পায়। প্রহর ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ফজর ওয়াক্তের নামাজ আদায় করল আগে। তারপর, গাড়ির চাবি নিয়ে সোজা রওনা হলো অথৈদের বাড়ির উদ্দেশ্য। গেটের সামনে ঘুমে ঝুমতে থাকা দারোয়ান প্রহরকে গাড়ি নিয়ে বের হতে দেখে ভীষন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে ফেলল।

— স্যার ওসময়ে কই যাইতাছেন!!

দারোয়ানের কথায় মুচকি হেসে প্রহর গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে বলল,,

— আমার যে বিয়ে হয়েছে এটা নিশ্চয়ই জানো?

— জি ;জানি।

— আমার সেই বিয়ে করা বৌকে দেখতে চাচ্ছি। বাড়ির কেউ আমার খোঁজ করলে সকাল হলে জানিয়ে দিও আমি কোথায় আছি।

দারোয়ান প্রহরের কথায় সায় জানিয়ে গেইট খুলে দিলো। প্রহর তার অথৈর কাছে ফিরে যাচ্ছে। এদিকে কালো আকাশ ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে সাদায় পরিণত হচ্ছে। গাড়ি অথৈদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। প্রহর গাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা অথৈর রুমের ব্যালকনির দিকে তাকালো। সাদা চুরিদার পরিহিতা এক এলোকেশীর ঘুমাচ্ছান্ন চোহারা দেখে পরপর দুটো হার্টবিট মিছ করল যেন প্রহর। অস্বাভাবিক গতিতে কাপতে থাকা হৃদয়ের ওপর বা হাতটি রেখে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মেয়ের দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে কল করল। অথৈর হাতে থাকা মোবাইল ভাইব্রেট হচ্ছে। অথৈ কল রিসিভ করল ঠিকই তবে চুপ করে রইল। চারদিকে যখন কেবল নীরবতা বিরাজ করছে। তখন দুটো মানুষের হৃদয়ে তখন উথাল-পাতাল ঢেউয়ের জোয়ার আছড়ে পরছে হৃদয়ের কূলে।

— হ্যালো, অথৈ কথা বলবে না আমার সঙ্গে??
দেখো তোমায় একটুখানি দেখার আশায় ছুটে এসেছি। এই অথৈ?

“এই অথৈ” ডাক শোনার পর অথৈর সারা শরীরে অজানা শিহরণ বয়ে যায়। এতটা মায়া, এতটা আর্কষন প্রহরের কন্ঠ ছাড়া পৃথিবীর আর কারো কন্ঠে আছে কিনা জানা নেই অথৈর। কম্পিত গলায় বলল,,

— সাদা পাঞ্জাবিতে কিন্তু আপনাকে হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে। আপনাকে ছাড়া আজ একাকি রাত্রি পার করে কথা অনেক জমে গিয়েছিল। কিন্তু, আপনাকে দেখে যে আমার সকল অভিযোগ, ভালোবাসায় পরিণত হয়ে গেছে!!!

— কোথাও যাবে??

— এত সকালে!!

— নিস্তব্ধ নগরীতে ঘুরতে বেশ লাগবে। যেখানে কেবল তুমি আর আমি। ভালোবাসাবাসিতে নাহয় আজ আমরা সকালের স্নিগ্ধ আলোয়ে গা ভাঁসাবো।

প্রহরের কথা শেষ হতে না হতেই অথৈ ওর ঘরে গিয়ে চট করে বোরকা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে দ্রুত নীচে নেমে এলো। হাঁটতে হাঁটতে বোরকায় নিজেকে জড়িয়ে মাথায় খুব সুন্দর করে ওড়না জড়িয়ে গেইট খুলে বের হয়ে এলো।

প্রহর অথৈকে বের হতে দেখে এগিয়ে গেলো সামনে। অথৈর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। অথৈ সেই বাড়ানো হাতে হাত রেখে প্রহরের চোখে দৃষ্টি রেখে বলল,,

— এত ভোরে কষ্ট করে এসেছেন কেন?

— তোমার উর্ধে কোনোকিছুই আমার নয়। তুমি আগামী পাঁচদিন রোজ সকালে আমাকে দেখতে
চেয়েছো আর আমি কিনা সামান্য এই আবদারটুকু পূরণ করতে পারব না!

কথাগুলো বলতে বলতে অথৈর কপালে নিজের ঠোঁটজোড়া ছুঁয়ে দিলো প্রহর। অথৈ লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে ফেলল। অথৈর গালে আলতো করে হাত রেখে বলল,,

— এভাবে লজ্জা পেয়ো না। কখন জানি আমার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়! বলো তো অথৈ এই মূহুর্তে কি করে নিজেকে সামাল দেই?

প্রহরের নেশাক্ত গলায় বলা কথাগুলো চোখ বন্ধ করে শুনছিল অথৈ। ওই নেশাক্ত চোখে কি করে চোখ রাখবে! আচমকা বন্ধ চোখের পাতায় ভেজা চুমুর স্পর্শে কেঁপে উঠল অথৈ। প্রহরের বুকের কাছের পাঞ্জাবি শক্ত করে মুঠ করে চেপে ধরল। ব্যস, এতটুকু ছিল। প্রহর অথৈকে বুকের মাঝে শক্ত করে চেপে ধরল। অথৈ যেন এতক্ষণ এই আশ্রয়টুকুর আশায় ছিল। নিজের লাজরাঙা মুখটা প্রহরের বুকের মাঝে লুকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,

— আপনি বাড়িতে ফিরে যান।

— কেন??

খানিকটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল প্রহর। কিন্তু, অথৈকে বুকের বাঁধন থেকে মুক্ত করল না। অথৈ নিজেকে ছাড়ানোর জন্য চেষ্টা করতে করতেই বলল,

— আপনি যেই কথাগুলো বলছেন! বিশ্বাস করুন আমি বোধহয় দম বন্ধ হয়ে মরে যাব।

প্রহর অথৈকে বাঁধন থেকে মুক্ত করে দিলো। অথৈ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পারলে এখান থেকে একছুটে দৌড়ে চলে যেতে ঘরে। প্রহর বেশ কিছুক্ষণ অথৈকে পর্যবেক্ষণ করল। তারপর, কি মনে করে বলল,,

— যাও তুমি। সন্ধ্যায় দেখা হবে।

কথাটি বলে আর দেরি করেনি প্রহর। সোজা গাড়িতে বসল। আর সাই করে গাড়ি নিয়ে রওনা হলো। এদিকে অথৈ প্রহরের কান্ড দেখে কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। লোকটার যে মাঝে মাঝে কি হয় আল্লাহ জানে!!

— সন্ধ্যায় দেখা হবে কথাটি বলল কেন? আচ্ছা, প্রহর কি আমার কথা রাগ করেছে?

কথাটি মাথায় আসতেই অথৈ জীভ কেটে ঘরের দিকে ছুটলো । প্রহরকে কল করতে হবে। নিশ্চয়ই রাগ করে চলে গেছে।

ঘরে ঢুকে সর্বপ্রথম খাটের ওপর থেকে মোবাইল হাতে নিয়ে কল করল প্রহর নাম্বারে। কিন্তু, কল ঢুকছে না। অথৈর এবার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে!!

দিন গড়িয়ে বিকাল হলো কিন্তু প্রহরের মোবাইলে কল যাচ্ছে না। অথৈ চিন্তিত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে ওর মায়ের কাছে যাচ্ছিল কিছু বলার জন্য এমন সময় কালো মুখোশধারী কিছু লোক এসে অথৈর মুখের ওপর কিছু একটা স্প্রে করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই অথৈ জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পরল মেঝেতে।

মুখোশধারী লোকগুলোর মধ্যে একজন তার মোবাইল বের করে কাউকে কল করে বলল,,

— কাজ হয়ে গেছে। অথৈকে আমরা কোলে…

— চুপ!! এই কথাগুলো বলার সাহস কোত্থেকে পেলি তোরা!!! ওর কাছ থেকে দূরে থাক। ওকে ভুলেও স্পর্শ করবি না। নয়ত, তোদের কি হাল করব আমি কল্পনাও করতে পারবি না। আমি আসছি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এলো সেই ব্যক্তিটি। এসেই অথৈকে কোলে তুলে নিলো। আর সেই মুখোশধারী লোকগুলোর ওপর অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,,

— আজ আমার মুড ভালো নয়ত তোদের আজ রক্ষা করার কেউ ছিল না।

লোকগুলো ভয়ে কাঁপছে। অথৈকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে গেল অজানা মানুষটা।

***************

এদিকে প্রহর বরবেশে অপেক্ষা করছে তার অথৈর জন্য। ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি। অথৈকে আজ চিরতরের জন্য নিজের কাছে নিয়ে আসবে। হুট করে সারপ্রাইজ পেয়ে অথৈর কি রিয়াকশন হবে ভেবেই প্রহর হাসছে।

— হাসলে হবে? অথৈদের বাড়ির কারো নাম্বারে কল ঢুকছে না। তুই একটা কল করে দেখ তো??

নাজিফা ভীষণ চিন্তিত ভঙ্গিতে কথাগুলো বলল। প্রহর দ্রুত ওর মোবাইল দিয়ে কল করল অথৈর মায়ের নাম্বারে কিন্তু কল যাচ্ছে না। প্রহর ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,,

— আম্মি, এখন কি করব?

— মানে কি করবি আবার কি? কনভেনশন সেন্টারে চল। উনারা সময়মত চলে আসলেই হলো।

— কিন্তু… তাছাড়া আজ সারাদিন অথৈর সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়নি। ধরতে গেলে আমি ইচ্ছে করেই ওর সঙ্গে যোগাযোগ করিনি। ওর কিছু হলো না তো আবার?

ছেলের হাসিমুখটায় হুট করেই যেন অমাবস্যার আঁধার নেমে এলো। নাজিফা ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

— তুই যা অথৈদের বাড়িতে। ওসব সারপ্রাইজের দরকার নেই। সোজা অথৈকে নিয়ে কনভেনশন সেন্টারে আসবি।

নাজিফার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হলো প্রহর। পথ যেন ফুরাচ্ছে না। অথচ, বিশ মিনিটের রাস্তা। কোনোরকমে পথ পেরিয়ে অথৈদের বাড়ির সামনে এসে পৌঁছালো প্রহর। গাড়ি থেকে বেরিয়ে একদৌঁড়ে চলে গেলে বাড়ির ভেতরে। ভেতরে ঢুকতেই সব যেমন কেমন দেখাচ্ছিল!!! প্রহরের মনে বিপদের কু গাইছে! সেই সব ভাবনাকে পাত্তা না দিয়ে যখন দোতলায় পৌঁছালো ঠিক তখনি প্রহরের মনে হলো এই দৃশ্য কি কখনো কল্পনায় ভেবেছিল!! মোটেও না। তবুও কেন দেখতে হলো??

ঘরের পুরো মেঝে রক্তে লাল হয়ে আছে। একপাশে পরে আছে আলফাজের দেহ। অন্যপাশে সাবিনার। দুজনের দেহের গলাকাটা অংশ দিয়ে রক্তে চুইয়ে চুইয়ে পরছে। প্রহর কোনেরকম নিজেকে সামলে নিলো। হুট করে অথৈর কথা মনে পরতেই প্রহরের দেহ যেন অসাড় হয়ে এলো। অথৈর কিছু হলো না তো আবার এই ভেবে। অসাড় দেহটাকে কোনোমতে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলো অথৈর ঘরের ভেতরে। কিন্তু, পুরো ঘর ফাঁকা। কেউই নেই। শূন্যতায় ঘেরা । ব্যস এতটুকু মনে আছে প্রহরের। চেতনা হারিয়ে পরে রইল অথৈর ঘরে।

#চলবে

#মন_বোঝেনা
#Tahmina_Akhter

..২১…

কনভেনশন সেন্টারে অপেক্ষারত প্রহরের বাবা-মা যখন দেখলেন দু’ঘন্টা পেরিয়ে গেছে অথচ প্রহর বা অথৈ কেউই ফিরে আসছে না। ঠিক তখনি উনারা আর দেরি না করে বেরিয়ে পরলেন।

অথৈদের বাড়িতে ঢুকতেই প্রাণপ্রিয় বান্ধবী এবং তার স্বামীর এমন মৃত্যু দেখে নাজিফা ভেঙে পরলেন। অবচেতন মনেই প্রহর এবং অথৈর কথা মনে পরল। দোতলার উদ্দেশ্য হাঁটতে শুরু করলেন। এই ফাঁকে প্রহরের বাবা পুলিশকে কল করলেন।

দোতলায় অথৈর ঘরে ঢুকতেই দেখলেন প্রহর নিচে পরে আছে। নাজিফা ছেলের কাছে গিয়ে বসলেন। মাথা কোলে তুলে নিলেন। প্রহরকে ডাকছেন কিন্তু প্রহরের কোনো রেসপন্স নেই। নাজিফা কাঁদতে কাঁদতে প্রহরের বাবাকে ডাক দিলেন। স্ত্রীর ডাক শুনে প্রহরের বাবা এসে দেখলেন তার ছেলে অবস্থা। আর কোনোকিছু না মাথা ঘামালেন না। নাজিফাকে রেখে প্রহরকে নিয়ে নিজেই হসপিটালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। কারণ, যেকোনো মূহুর্তে পুলিশ আসবে। কাউকে না কাউকে থাকতে হবে এখানে। ড্রাইভারের সাহায্য নিয়ে প্রহরকে গাড়িতে তুলে রওনা হলো হসপিটালের উদ্দেশ্য। এদিকে নাজিফা তখন ভয়ে, আতংকে মূর্ছা যাবার উপক্রম।

সেই ঘটনা পেরিয়ে যাওয়ার আজ পঞ্চমতম দিন। সেদিন প্রহর মাইল্ড স্ট্রোক করে। তবে আল্লাহর অশেষ দয়ায় বড় বিপদের হাত রেখে রক্ষা পায় সে। সাবিনা এবং আলফাজের ময়না তদন্ত শেষে দাফন হয়। কিন্তু, অথৈর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। প্রহর যেন বেঁচে থেকেও মৃত্যুর মত অনুভূতিতে জড়িয়ে আছে। আজ হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ পেয়েছে প্রহর। প্রহর চুপচাপ কারো সঙ্গে কথা বলছে না। মলিন মুখখানায় কেবল অথৈকে হারিয়ে ফেলার তীব্র বেদনা প্রকাশ পাচ্ছে। ডিসচার্জের সকল ফরম্যালিটিস সম্পূর্ণ করে প্রহরের বাবা যখন কেবিনে এলেন ঠিক তখনি প্রহর বেড ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো। নাজিফা ছেলেকে ধরতে আসছিল। প্রহর হাতে ইশারা করল অর্থাৎ প্রয়োজন নেই।

— তুই কোথাও যাচ্ছিস??

নাজিফা প্রশ্ন করল ছেলেকে। প্রহর ওর মোবাইল বের করে কাউকে কল করতেই যাচ্ছিল। ওর আম্মির প্রশ্ন শুনে বলল,,

— হ্যা।

— কোথায়??

— অথৈকে খুঁজতে।

— অথৈকে খোঁজার জন্য পুলিশ আছে। তুই এত অসুস্থ শরীর নিয়ে কি করবি? যদি তোর কিছু হয়ে যায়?

— আম্মি, অথৈকে যদি আমি খুঁজে না পাই তবে এমনিতেই মরে যাব। আজ পাঁচদিন ধরে আমি কাপুরুষের মত হসপিটালের বেডে শুয়ে আছি। তোমরা পুলিশের মিথ্যা আশ্বাস নিয়ে বাস করছো। আমার অথৈ কি অবস্থায় আছে একটিবার ভেবে দেখেছো তোমরা?

কথাগুলো শেষ করে বের হয়ে গেল প্রহর। ছেলেকে আর বাঁধা দেয়নি নাজিফা। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অতঃপর নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হলো।

এসআই রাহিমের বাসায় এসেছে প্রহর। এসআই রাহিমের অপেক্ষায় বসে আছে প্রায় মিনিট পাঁচেক এর মত। সকালের নাশতা শেষ করে এসআই রাহিম ড্রইংরুমে এসে বসল।প্রহরকে দেখে ঢোক গিলল৷ আমতাআমতা করে বলল,,

— স্যার আপনি কেন কষ্ট করে আসতে গেলেন? আমাকে যাস্ট একটা কল করতেন…

— আমার স্ত্রীর খোঁজ…

রাহিমের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। কারণ, গোপন খবরের সূত্র অনুযায়ী প্রহর মির্জার ওয়াইফ যার কাছে আছে তার কাছে পুলিশ পৌঁছেতে যাওয়ার আগে পুলিশের দেহগুলো হয়ত বুড়িগঙ্গা কিংবা শীতলক্ষ্যার তীরে ভেসে উঠবে। আর সামনে বসা থাকা প্রহর মির্জাই বা কম কিসের। যদি একবার জানতে পারে যে তার স্ত্রী কার কাছে আছে? কোথায় আছে? জেনেও পুলিশ কিছু করছে না ব্যস গুলি করে দেবে। ভীষণ পাষাণ লোক এই প্রহর মির্জা। মাঝখানে কি হয়েছিল কে জানে? পাষাণ হৃদয়ের লোকটা একেবারে শান্ত হয়ে গিয়েছিল। হয়ত বউটার জন্য!!

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে ফেলল রাহিম। প্রহরের দিকে তাকিয়ে বলল,,

—- আমরা খোঁজ করছি স্যার। সিসিটিভি ফুটেজ চেক করা হচ্ছে। আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনার স্ত্রীর খোঁজ অবশ্যই পেয়ে যাবেন..

— আজ পর্যন্ত তোকে যতগুলো কাজ দিয়েছি সবগুলোই তুই ঠিকভাবে করেছিস। কিন্তু, আমার কলিজায় কে হাত দিয়েছে তুই এখন পর্যন্ত বলতে পারছিস না আমাকে!! কি অদ্ভুত!! নাকি তুই ইচ্ছে করেই… তোর বাচ্চাটার বয়স জানি কত??

এসআই রাহিম বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে প্রহরের দিকে। প্রহর ওর প্যান্টের পকেট থেকে পিস্তল বের করে রাহিমের কপালে তাক করে বলল,,

— এতক্ষণ যা বলেছি তা আবারও রিপিট কর। কারণ, তখনকার কথাগুলো আমার বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি।

এসআই রাহিম থরথর করে কাঁপছে। না ধরা পরে গেছে সে। বেঁচে ফেরার একটাই পথ সব সত্য জানিয়ে দেয়া। প্রহরের সামনে দুই হাত জোড় করে বলল,,

— স্যার, আপনার স্ত্রী যার কাছে সে আন্ডারওয়ার্ল্ডের মাফিয়া। ঢাকা শহরের যত অনৈতিক কর্মকান্ড আছে সবকটাতেই তার প্ররোচনা আছে। তাকে সবাই মেসবাহ নামে চিনে। আপনার স্ত্রী তার কাছেই আছে।

প্রহরের মনে হলো যেন ওর বুক থেকে হাজার টনের একটি পাথর সরে গিয়েছে। ওসব মাফিয়াদের ভয় পায় না প্রহর। কয়েক কোটি টাকা দিলেই তো অথৈকে ফিরে পাওয়া যাবে। প্রহর পিস্তল সরিয়ে ফেলল। রাহিমের অন্তরে প্রাণ ফিরে এলো। প্রহর পিস্তল পকেটে ঢুকিয়ে রাখতে রাখতে বলল,,

— কোথায় সেই আস্তনা যেখানে মেসবাহ থাকে??

প্রহরের কথায় এবার শুকনো ঢোক গিলল। তারপর, চোখদুটো বন্ধ করে বলল,,

— স্যার, আজ সকাল এগারোটার ফ্লাইটে আপনার স্ত্রীকে নিয়ে মেসবাহ ভাই আমেরিকার উদ্দেশ্য রওনা হয়েছে।

প্রহর যেন এই কথার জন্য প্রস্তুত ছিল। কিন্তু,, যখন নিজেকে সামলে ফেলল ঠিক তখনই পরপর দুটো গুলির শব্দ হলো। রাহিমের রক্তাক্ত দেহ নীচে পরে আছে। মাথার দিকে দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।

প্রহর প্রবাহিত রক্তের দিকে তাকিয়ে কল করল ওর এক বন্ধুকে যে কিনা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। কল করতে ভাবছে সত্যি কি তবে চিরদিনের মত হারিয়ে ফেলল অথৈকে? কেন সেদিন সকালে অথৈ ওভাবে রেখে ফিরে এসেছিল? যদি না ফিরে আসত আজ হয়ত অথৈ ওর হৃদয়ের কাছে থাকত। একেবারে কাছাকাছি।

*********

— এটা তো জানিস আমাদের ধর্মে কারো স্ত্রীকে বিয়ে করার অনুমতি নেই। আমি প্রহরের স্ত্রী। সবচেয়ে বড় কথা আমি প্রহরকে ভালোবাসি।

অথৈর কথাগুলো শেষ হতেই ঠাসস করে থাপ্পড় মেরে বসল আগন্তুক। অথৈ গাল হাত রেখে ঘৃনা চোখে তাকিয়ে আগন্তুককে বলল,,

— থাপ্পড়গুলো গুনে রাখিস। প্রহরের সঙ্গে যখন তোর দেখা হবে। সবগুলো থাপ্পড় ফিরিয়ে দেবে।

— চুপ..প,, একদম চুপ..প। ” প্রহর ” ” প্রহর” বিরক্ত হয়ে গেছি আমি এই নাম শুনতে শুনতে । ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে নে। সংসার করবি শুধু আমার সঙ্গে। ভালোবাসবি শুধু আমাকে। প্রহরকে আর তোর এই মিছেখেলার বিয়েকে ভুলে যা।

অথৈর গাল চেপে কথাগুলো বলল সেই আগন্তুক । অথৈর তীব্র ব্যথায় চোখমুখে শক্ত করে রাখল। পরমূহুর্তে আগন্তুকের কি যেন হলো!! অথৈর গাল ছেড়ে দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। নরম স্বরে বলল,

— তোকে আমি ভালোবাসি বাবুই পাখি। তোকে ছাড়া আমি মরে যাব। দেখ তোকে পেলাম না কেন জানিস? তোর বাবা-মায়ের জন্য। তাই আজ কি করেছিস জানিস?

অথৈ জোড়াজুড়ি করছিল আগুন্তকের বাঁধন থেকে মুক্ত হতে। যখনি ওর বাবা-মায়ের কথা বলল ঠিক তখনি শান্ত হয়ে গেল। ভয়ে অথৈর শরীর থরথর করে কাঁপছে। আগুন্তক যেন অথৈর এই শিথিল দেহের অপেক্ষায় ছিল। আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল অথৈকে। মাথায় ওপর চুমু খেয়ে বলল,,

— তোর বাবা আর মাকে আজ আমি নিজ হাতে মেরে ফেলেছি। তুই কি চাস আমি প্রহরকে মেরে ফেলি।

অথৈ শক্ত মূর্তির ন্যায় বসে আছে। চোখগুলো কেমন কঠিন হয়ে গেছে! নিজেকে সামলে ফেলল। আগুন্তকের চোখে দৃষ্টি রেখে বলল,

— কোন পাপের সাজা দিচ্ছিস আমাকে?? আমার বাবা-মা তোর কি ক্ষতি করেছে?

— তোর বাবা-মা কোনো ক্ষতি করেনি। করেছে তো প্রহর।

—আবির, তোকে আমি অনেক ভালো জানতাম!! কিন্তু, তুই!!

— আমি শুধু তোর সামনেই ভালো ছিলাম।

অথৈ আবিরের পা হাত রেখে কাঁদতে কাঁদতে কাঁদতে বলল,,

— আমাকে আমার বাবা-মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আয়। আমি শেষবারের মত তাদের দেখতে চাই। আর প্রহর আমাকে ছাড়া স্রেফ মরে যাবে।

আবির অথৈর হাত সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে বলল,,

— তৈরি হয়ে থাকবি। আজ সকাল এগারোটায় আমাদের ফ্লাইট। আমেরিকায় যাচ্ছি আমরা।

অথৈ এবার যেন পাগল হয়ে গেল। গাল ফাটিয়ে চিৎকার করছে। কিন্তু ওর চিৎকার শোনার জন্য আবির ছাড়া কেউই নেই। আবিরের কোনো হেলদোল নেই। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে এসে অথৈর সামনে এসে বসল। সিগারেটের গন্ধে অথৈর বমি পাচ্ছে। অথৈ মুখ সরিয়ে নেয় কিন্তু আবির শক্ত করে অথৈর গাল চেপে ধরে ওর সামনে মুখ বাড়িয়ে বলল,

— যদি তুমি চাও যে প্রহর এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকুক তবে চুপচাপ আমার সঙ্গে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে যাও। আর হ্যা একটু পরেই উকিল আসবে। তোর আর প্রহরের ডিভোর্স পেপার রেডি হয়ে গেছে। সাইন করে দিও৷

— যদি সাইন না করি??

ঘৃণিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল অথৈ। আবির যেন এই কথার অপেক্ষায় ছিল। অথৈর চোখে চোখ রেখে, দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

— তুই এটা ভাবিস না যে সুইসাইড করলে বেঁচে যাবি। তোর শরীরে যদি আমি একটুখানি আচঁড়ের দাগ পাই আল্লাহর কসম আমি নিজ হাতে প্রহরকে জবাই করে ফেলব। এখন তুই সিদ্ধান্ত নে তুই কি করবি। হয় প্রহর বাঁচবে কিংবা বাঁচবে না। কিন্তু, সংসার তো তুই আমার সঙ্গেই করবি।

আবির ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তবে যাওয়ার আগে দরজা লক করেই যায়। বন্ধ দরজার এপারে অথৈ কেবল কাঁদে। কারণ, এই এক জীবনে কেবল প্রহরকে ছাড়া আর কাউকে এই জীবনে নিজের পাশে কল্পনা করতে পারেনি এবং পারবেও না। কিন্তু, পরিস্থিতি যে তাকে এমন এক মোড়ে এনে দাঁড় করিয়ে রেখেছে প্রহরের বেঁচে থাকা অনেক জরুরি। অথৈর বিশ্বাস কোনো না কোনো একদিন প্রহর তার অথৈকে খুঁজে বের করবেই। আর ঠিক সেদিনের জন্য হলেও প্রহরকে বেঁচে থাকতে হবে।

উকিল সাহেব এলেন। অথৈ বিনাবাক্য ডিভোর্স লেটারে সাইন করে দেয়। আবির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অথৈর দিকে। সাইন দেয়া হয়ে গেলে উকিল সাহেব চলে গেলেন। অথৈ উঠে এসে দাঁড়ালো আবিরের। চোখের জলে ভেজা গাল, এলোমেলো চুলগুলো যেন অথৈর ওপর বয়ে যাওয়া ঝড়ের আভাস দিচ্ছে। ক্ষণিকের জন্য অথৈর জন্য আবিরের করুনা হলো কিন্তু নিজেকে সামলে ফেলল। কারণ, নারীজাত বড্ড ছলনাময়ী একবার দূর্বলতা জেনে ফেললে কখন কি করে বসে?

— প্রহরের গায়ে যদি বিন্দুমাত্র আচ লাগে তবে মি. আবির মনে রাখবি সেদিন আমি নিজেকে ধ্বংস করে ফেলব। সেই সাথে তোকেও এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য অযোগ্য বানিয়ে রেখে যাব। আমার বাবা-মায়ের কসম।

আবির মুচকি হেসে বলল,,

— তুই শুধু আমার পাশে ছায়ার মত থাকিস। ভালেবাসতে হবে না…

আবিরের কথা শেষ হওয়ার আগে অথৈ ওর মুখের ওপর থু থু ছিটিয়ে দেয়। আবির চোখ বন্ধ করে রাগ সামলাতে ব্যস্ত। চোখ খুলে অথৈর দিকে রক্তচক্ষু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। হুট করে অথৈর ওড়নার কার্নিশ টেনে নিয়ে থু থু মুছে ফেলল। শীতল কন্ঠে বলল,,

— সোজা ঘরে গিয়ে তৈরি হয়ে নে। এয়ারপোর্টে পৌঁছেতে হবে।

কথাগুলো বলেই সেখান থেকে চলে গেল আবির। আর অথৈ মেঝেতে বসে নিজের ভাঙন জীবনের কথা ভাবতে ভাবতে মাতমে মেতে উঠে। যেই মাতম কিনা আকাশপাতাল ভারি করে তুলেছে।

#চলবে