মন বোঝেনা পর্ব-২২+২৩

0
53

#মন_বোঝেনা
#Tahmina_Akhter

…২২…

প্রহর পাগলপ্রায়। হন্য হয়ে দৌঁড়ে বেড়াচ্ছে। এয়ারপোর্টের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত নিজের প্রাণপিয়াসীকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। শত অচেনা মুখগুলোর মাঝে নিজের চিরচেনা সেই মায়াবী মানবীকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। যাকে দেখলে হৃদয়ের বুকে সৃষ্ট হওয়া কালবৈশাখীর ঝড়ের তান্ডব শান্ত হবে। কিন্তু!! শেষ ভরসাটুকু বোধহয় আর নেই। ইমিগ্রেশন বিভাগে খবর নিয়ে জানা গেল। অথৈ আজ সকাল এগারোটার ফ্লাইটে ঢাকা ছেড়েছে। ব্যস, এতটুকু অব্দি খেয়াল আছে প্রহরের। এরপর, আর কিছুই মনে নেই। পুরো পৃথিবী যেন হুট করে কালো আধারে ছেয়ে যাচ্ছে।

প্রহরকে বাড়িতে নেয়া হলো। পুরো চব্বিশ ঘন্টা অতিবাহিত হওয়ার পর ওর চেতনা ফিরে আসে। কিন্তু, হায় এই চেতনা যদি কখনো না ফিরে আসত!! কেন মৃত্যু হলো না? এই ভেবেই প্রহর নিজের চুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ করে টানছিল। নিঃশব্দের কান্নায় চোখদুটো টকটকে লাল হয়ে আছে। নাজিফা ছেলের পাশে বসে আছে। সামনে মেঝেতে পরে আছে একটি সাদা কাগজ। কি সামান্য যোগ্যতা এই কাগজের! অথচ, পুরো দুনিয়ায় যত ক্ষমতা এই কাগজের মধ্যে রয়েছে। তা অন্য কোনো বস্তুতে নেই। অনাদরে পরে থাকা এই কাগজটা আজ প্রহরের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ভাঙনের কারিগর। যাকে ভালোবাসে সংসার করার সাধ জেগেছিল। আজ সেই মানুষটা তার পর হয়ে গেছে। শুধুমাত্র এই কাগজের জোড়ে। একটি স্বাক্ষরের জোড়ে।

—- আম্মি কোন পাপের শাস্তি আমি পাচ্ছি বলুন তো? মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমার অথৈ আমাকে এতটা দূরে ছুড়ে ফেলেছে। ও যদি আমাকে ভালোই না বাসত তবে কেন বিয়ে করতে রাজি হলো?

ছেলের কথায় নাজিফা কান্নায় ভেঙে পরলেন। তবুও, ছেলের মাথায় হাত রেখে বললো,,

— বাবারে মাঝে মাঝে আমরা যা দেখতে পাই সবটা কিন্তু সত্যি নাও হতে পারে। হয়ত অথৈ…

— আম্মি প্লিজ!!! আর কোনো কিছু ওর সম্পর্কে বলবেন না। আমিও প্রথমে বিশ্বাস করিনি। কিন্তু, ডিভোর্স লেটারের সঙ্গে পাওয়া চিঠি পড়ার পর আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছি যে অথৈ চিটেড অন মি। ও আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমার পবিত্র ভালোবাসাকে, আমাদের পবিত্র বিয়ের বন্ধনকে প্রত্যাখান করেছে।

প্রহর কথাগুলো যখন বলছিল ঠিক তখন নাজিফা খেয়াল করছিল ছেলের চেহারায় ফুটে উঠা ঘৃনাকে। যেই চোখে এতদিন অথৈর জন্য ভালোবাসা ছিল আজ সেই চোখে কেবল অথৈর জন্য ঘৃনা ফুটে উঠেছে। নাজিফা ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ছেলেটাকে শান্ত করার দরকার। এতটা ভেঙে পরেছে ছেলেটা।

পুরুষ মানুষ হয়ত কখনো কাঁদে না। তবে মাঝে মাঝে পরিস্থিতি তাদের এতটাই বাধ্য করে যে তাদের উপায় থাকে না। প্রহরের পরিস্থিতি ঠিক তাই। ভালোবাসার মানুষ যখন ধোঁকা দেয় ঠিক তখনি বোঝা যায় হৃদয় ভাঙার সুরে কতটা কষ্ট হয়??

নাজিফা জানে না ডিভোর্স লেটারের সঙ্গে আসা আরেকটি সাদা কাগজে কোন বার্তা এসেছিল প্রহরের জন্য। কিন্তু, এতটুকু হলফ করে বলতে পারবে যে, অথৈ তার ছেলেকে দুমড়েমুচড়ে ছুড়ে ফেলছে।

***************★***

এয়ারপোর্টে বিমান থেকে নামতেই বিশাল প্রটোকলের মধ্যে দিয়ে বের হতে হলো অথৈ এবং আবিরকে। কালো কোর্ট স্যুট পরা সাদা চামড়ার লোকগুলোর হাতে বিভিন্ন মডেলের বন্দুক এবং পিস্তল। বিমান থেকে এয়ারপোর্টের বাইরে আসা অব্দি এখন পর্যন্ত আবির একটিবারের জন্যেও অথৈর হাত ছাড়েনি। অথৈ একবার চেষ্টা করেছিল কিন্তু আবির ওর কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে কিছু একটা বলল। ব্যস অথৈ আর কিছুই বলেনি। কাঠপুতুলের ন্যায় রইল। আবির যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে ঠিক সেদিকেই যাচ্ছে। এয়ারপোর্টের বাইরে আসতেই শেতাঙ্গ এক মেয়ে এসে “ও হানি” বলে আবিরের গলা জড়িয়ে ধরল। আবিরও মুচকি হেসে মেয়েটিকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল।

— আই মিসড ইউ সো মাচ।

— আই মিসড ইউ টু বেবি। লিন্ডা দিস ইজ মাই উুড বি ওয়াইফ, অথৈ। আর অথৈ ও হচ্ছে লিন্ডা আমার কাজিন।

অথৈর কোনো কিছুর ভাবান্তর নেই মাথা নীচের দিকে দিয়ে রাখল। আবির আর ব্যাপারটা ঘাটল না। লিন্ডার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অথৈর হাত ধরে ব্ল্যাক ল্যাম্বারগিনিতে বসিয়ে দিলো। তারপর, নিজে গিয়ে বসল ড্রাইভিং সিটে। পেছনে বডিগার্ডদের গাড়ির বহর। অথৈ চোখদুটো বন্ধ করতেই প্রহরের মুখখানা ভেসে উঠেছে। অভিমানী দুটো যেন বলতে চাইছে,

“আমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবে তো? কি করে পারলে ডিভোর্স লেটারে সাইন করতে? একটিবার তোমার হাত কাঁপলো না!”

অথৈ এবার নিজেকে আঁটকে রাখতে পারল না। চোখের পানি গড়িয়ে পরছে। আবির দেখেও না দেখার ভান করল। আপনমনে নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্য রওনা হলো।

বিশালাকার একটি গেটের সামনে গাড়ি থেমে গেল। অথৈ ভেজাচোখে তাকালো আশেপাশে। আবির গাড়ি থেকে নেমে অথৈর দিকে এসে দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে দিলো। অথৈ প্রচন্ড ঘৃনায় চোখ ফিরিয়ে নিলো আবিরের দিকে থেকে। চেষ্টা করল নিজেই গাড়ি থেকে বের হবার জন্য কিন্তু আবির এবার যা করল তারজন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না অথৈ!!

অথৈ চুলের মুঠি ধরে মুখের সামনে ধরে বলল,,

— এটা বাংলাদেশ না। এটা আমেরিকা। আর যেখানে দাঁড়িয়ে আছিস সেটাও আমার এলাকা। আমার প্রোর্পাটি। তোকে যদি মেরে লাশ গুম করে দেই কেউ টের পাবে না৷ কথায় কথায় আমার সঙ্গে মেজাজ দেখাবি না। নয়ত…

— নয়ত কি? প্রহরকে মেরে ফেলবি? আমাকে মেরে ফেলবি। তো মেরে ফেল না। দেরি করছিস কেন? পিস্তল রেডি, তোর টার্গেট ঠিক নিশানার জায়গাতেই আছে। জাস্ট একটা গুলি আমার এই জায়গায় ( বুকের বা পাশটায় দেখিয়ে) করে দে। আমি শান্তি পাব। প্রতিটি সেকেন্ড সেকেন্ডে মনে হচ্ছে আমি মরে যাচ্ছি। বারবার মৃত্যুর চেয়ে একেবা…

শেষের কথাগুলো কেমন জড়িয়ে আসছিল। আবির কিছু বুঝে উঠার আগে মাটিতে লুটিয়ে পরল অথৈ। আবির তৎক্ষনাৎ অথৈকে কোলে তুলে নিলো। বাড়িতে প্রবেশ করতেই কয়েকজন মেইড এগিয়ে আসে। আবিরের কোলে অথৈকে দেখে সবাই কানাঘুষা করতে থাকে।

আবির ওর বিশালাকার বেডরুমের নরম বিছানায় অথৈকে শুইয়ে দিলো। তারপর, কল করল ওর চেনা ডক্টরকে। ডক্টর জানালো কিছুক্ষণের মধ্যেই সে আসছে।

আবির শান্ত হতে পারছে না। কেমন যেন ফিলিং হচ্ছে! লাইফে এমন কোনো ঘৃণিত কাজ নেই যে সে করেনি। মানুষ হত্যা করতে গেলে যার হাত একবারের জন্য কাপে না। আজ সেই মানুষটার কি হলো? উদ্ভান্তের মত অথৈর পাশে গিয়ে বসল। অথৈর হাতের ওপর হাত রাখতে গিয়েও রাখল না। অথৈর মুখটার দিকে তাকাতেই ভীষণ মায়া হলো আবিরের। চেহারায় শুষ্কতার ছাপ, প্রিয়জন হারানোর বেদনা সবটাই যেন অথৈকে অন্তঃসারশূন্য করে গেছে। আবিরের যে কিছু করার নেই। হৃদয়ের কাছে সে নিজেই তো বন্দি। কি নেই তার? গাড়ি-বাড়ি, বাংলো, টাকা-পয়সা,ক্ষমতা সব আছে। ছিল না শুধু একছত্র হৃদয়ের মালিক। অথৈকে যেদিন প্রথমবার দেখেছিল ঠিক সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত অথৈর জন্য একই অনূভুতি। অনূভুতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। অথচ, লোকে বলে ভালোবাসার রঙ বদলায়। কই আমার ভালোবাসার রঙ বদলায়নি কেন?

ডক্টর এসে অথৈকে চেকআপ করল। দুটো ইনজেকশন পুশ করলেন। শারীরিক দূর্বলতা এবং ব্লাড প্রেশার লো থেকে এমনটা হয়েছে বলে চলে গেলেন। সেই সাথে এটাও বলে গেলেন খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে যেন সতর্ক হয়। আবির ডক্টরকে বিদায় দিয়ে অথৈর পাশে এসে বসে রইল। এতটা চুপ, এতটা স্থীর,এতটা শান্ত অথৈকে কখনো কি দেখেছিল সে? নাহ। যার চঞ্চল, মনভোলানো হাসিতে শ’খানেক হৃদয়ে ঢেউ আসত। সেই মানুষটা আজ এতটা স্তব্ধ হয়ে গেছে। তবে, আজ এই ক্ষণের উপযোগী ব্যবহার করা হোক।

আবির অথৈর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কখনো কখনো চোখের দিকে, কখনো ঠোঁটের দিকে, কখনো কপালের ওপর ছড়িয়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলোতে। হুট করে নাকের দিকে দৃষ্টি পরল। সাদা পাথরের নাকফুল জ্বলজ্বল করছে। কিছু একটা মনে পড়তেই আবিরের কপালের দুপাশের শিরা ফুলে ওঠে। হাতের মুষ্টি শক্ত করে চেপে ধরে।

ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো আবির। কিছুক্ষণ পর একজন মেইডকে সঙ্গে নিয়ে রুমের ভেতরে ঢুকল। মেইডকে ইশারা করতেই মেইড খুবই আলতো হাতে অথৈ যাতে টের না পায় ঠিক সেভাবেই নাকফুল খুলে ফেলল। মেইড নাকফুলটা খুলে এনে আবিরের কাছে দিতে আসছিল। আবির রাগান্বিত সুরে বলল,

— ডাস্টবিনে ফেলে এসো।

মেইড চলে গেল। আর আবির তার পরবর্তী প্ল্যান নিয়ে ভাবছে। ভাবতে ভাবতেই আবিরের চেহারায় শয়তানি ভাব ফুটে উঠে৷ হুট করে হা হা হা হাসিতে মেতে উঠল।

#চলবে

#মন_বোঝেনা
#Tahmina_Akhter

…২৩…

সময় তখন রাত তিনটে। প্রহর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। অদূর আকাশে তাকিয়ে আছে। দুচোখে কেবল সেই চিঠির শব্দগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে। এখনো তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে অথৈ আর ওর নেই। যাকে হৃদয়ের পুরোটা দিয়ে ভালোবাসল সে কিনা বিশ্বাসঘাতকতা করল!! প্রহর চোখে ক্রোধ জন্মায়। যে ক্রোধের কারণে সামনে থাকা মানুষগুলো ভস্ম হয়ে যাবে।

চোখের সামনে ফের কাগজটি মেলে ধরল। চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো অথৈর হাতে লেখা শব্দগুলোকে।

প্রিয় প্রহর,

আপনি যখন আমার চিঠিটা পড়বেন তখন হয়ত আমি আর আপনার থাকব না। আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে ঠিকই কিন্তু আমি আপনাকে মানতে পারছিলাম না। হুট করে মনে লোভ জন্মে গিয়েছিল। আপনার কত টাকা-পয়সা, পাওয়ার। এসব দেখেই আপনার ভালোবাসায় সাড়া দিয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার আপনার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর থেকে আমি নিজেকে বোঝাতে পারছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল যে আমি আমার স্বত্তাকে এবং আমার হৃদয়কে টাকার সামনে নিলাম তুলে দিয়েছি। কিছুটা দেরি হলেও আমি বুঝতে পারলাম যে আমি আবিরকে ভালোবাসি। আবিরকে ছাড়া আমি পাগল হয়ে যাব। আমার চেয়ে হাজারগুন সুন্দরী মেয়ে আপনি ডিজার্ভ করেন। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন। বিয়ে করে ফেলুন।

ইতি,
অথৈ

চিঠিটা পড়া শেষ হলো। পকেট থেকে লাইটার বের করে আগুন ধরিয়ে চিঠিটাকে পুড়তে যাচ্ছিল কিন্তু কিছু একটা মনে পড়তেই লাইটার অফ করে ফেলল। চিঠিটা সযত্নে ভাজ করে ঘরে এসে আলমারীতে তুলে রাখল।

প্রহর ড্রয়ার বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আনমনে বলল,,

— তোমাকে ভুলতে পারছি না অথৈ। আবার তোমার কাছ থেকে পাওয়া ধোঁকাও যে ভুলতে পারছি না। কি করব বল মন বোঝেনা।

বিছানাতে গিয়ে গা এলিয়ে শুয়ে পরল। জানে ঘুম আসবে না তবুও প্রকৃতির নিয়ম মানতে যে হয়। চোখদুটো বন্ধ করতেই অথৈর মন ভোলানো হাসির শব্দে প্রহরের ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ফুটে উঠে।

আমেরিকায়,,

অথৈর যখন চোখ খুলল তখন প্রায় দুপুরবেলা। অথৈ বেশ কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইল। হুট করে জীবনের কালো অধ্যায়ের কথা মনে আসতেই হু হু করে কেঁদে ফেলল বেচারী। ওর বাবা-মা, ভালোবাসার মানুষ প্রহরের কথা। আবির নামক ঝড় যে কোনো একসময় ওর জীবন থেকে এতগুলো মানুষকে কেড়ে নিবে যদি জানত তবে কখনোই ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করত না। কিন্তু, আফসোস।

এমনসময় দরজা খুলে কেউ ভেতরে এলো। অথৈ ভেজাচোখে তাকালো সেদিকে। আবির এসেছে। আবিরকে দেখেই বেড থেকে নেমে দাঁড়িয়ে পরল অথৈ। আবির মুচকি হেসে বেডে বসল। খুব ভালো করে অথৈর পুরো শরীর একবার চোখ বুলিয়ে বলল,,

— আমিই এসেছি। এত ভয় পাওয়ার কি আছে?

— তুই এসেছিস বলেই ভয় পেয়েছি।

অথৈর জবাব শুনে আবির হাসলো। তারপর, দুহাত তুলে তালি বাজাতেই দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল দুজন মেইড। দু’জনের হাতে অনেকগুলো শপিং ব্যাগ। আবির ইশারা করলে মেইড দুজন শপিং ব্যাগগুলো খাটের ওপর রেখে বের হয়ে গেল রুম থেকে। আবির ইশারা করল অথৈকে কাছে আসতে। অথৈ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল একইজায়গায়। আবির নিজের রাগ কন্ট্রোলে রাখল কারণ পাখিকে যখন খাঁচায় আটকাতে পেরেছে তবে পোষ মানাতে বেশি বেগ পেতে হবে না। এখন শুধু ধৈর্য দিয়ে বাকি কাজটুকু সম্পূর্ণ করতে পারলেই হলো।

—অথৈ?? অথৈ??? অথৈ…

শেষ ডাকে অথৈ প্রায় ভয়ে আঁতকে উঠল। অথৈ কানে হাত দিয়ে মেঝেতে বসে পরল। আবির ধ্যাত বলেই নিজের চুলে হাত রাখল। তারপর, কিছু একটা ভাবলো। বেড থেকে নেমে অথৈর পাশে গিয়ে বসল। অথৈ দূরে সরতে চাইলে আবির ওর হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আগের জায়গায় বসিয়ে রাখে। অথৈ কাঁদতে কাঁদতে বলছে,

— আর কি চাস বল তুই? আমার পুরো পরিবার, আমার ভালোবাসা, আমার সংসার সবই তো ধ্বংস করে ফেলেছিস।

— আমার শুধু তোকেই চাই বাবুই পাখি। তুই ভালো তো আমার জগত ভালো। তুই খারাপ তো তোর প্রহরর…

অথৈ কান্না বন্ধ করে আবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,,

— প্রহরকে তুই কিছু করবি না। আমাকে যা যা করতে বলেছিস আমি সব মেনে নিয়েছি। বিনিময়ে আমি তোর কাছে আমার প্রহরের নিরাপত্তা চেয়েছি।

কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলল অথৈ। কান্নারত অথৈর দিকে আছে আবির। কালো চুরিদার, খোলা চুল, চোখের জল নিয়ে যে কাউকে সুন্দর লাগে কখনো ভেবে দেখেনি আবির। কিন্তু, আজ অথৈকে দেখে বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছে আসলেই মেয়েটাকে প্রত্যেকটি রুপে চমৎকার দেখায়। আবির কোনো এক ঘোরে অথৈকে নিজের কাছে টেনে আনে তারপর চোখের জল মুছে দেয়। অথৈ নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। ওর মনে ভয় হয় এই বুঝি ওর ইজ্জতের ওপর হামলে পরবে এই জল্লাদটা। অথৈর হাত আর শক্ত করে চেপে ধরল আবির। তারপর , মৃদুস্বরে কন্ঠে বলল,,

— তুই শুধু আমার হয়ে যা। দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। আমি প্রহরকে কিছু করব না। আর কখনো বাংলাদেশে ফিরে যাব না। কি নেই আমার বল? সব আছে। সব। নেই শুধু এই পাথরের বুকে ভালোবাসা। তোকেই চাইছি শুধু। তোর নামখানা দিবি আমায়??

—তোর মুখে “ভালোবাসা ” শব্দটা উচ্চারণ করিস না। এতে ভালোবাসা নামক শব্দের অপমান হবে।
ভালোবাসা হারিয়ে ফেললে কেমন লাগে তুই কখনো অনুভব করতে পারবি না। তুই জানবি কি করে?? তুই একটা পাষাণ, নির্দয় মানুষ। আমার বদদোয়া রইল তোর জন্য যেদিন তোর জীবনে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসা আসবে সেই ভালোবাসা যেন আল্লাহ তাআ’লা যেন ছিনিয়ে নেন। যেমনটা তুই আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিস।

অথৈর কথাগুলো শোনার পর পাগলের মত মাথার চুলগুলো টানছে আবির।

— এটা তুই কি বললি অথৈ? ফিরিয়ে নে তোর বদদোয়া। তুই তো আমার ভালোবাসা। তোর কিছু হলে আমি মরে যাব রে বাবুই পাখি। আমি কি বলছি তুই শুনতে পারছিস? তের বদদোয়া তুই ফিরিয়ে নে অথৈ। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চা।

আবিরের কথা শুনে পাগলের মত হাসছে অথৈ। হাসতে হাসতে ওর চোখের কোণে পানি চলে আসে। কোনোমতে হাসি থামিয়ে আবিরকে বলল,

— তুই একটা খুনি। তোর মুখে কি আল্লাহর নাম শোভা পায়?? আল্লাহকে যদি ভয় করতি তবে আমার সাথে আমার পরিবারের সাথে এত বড়ো জুলুম করতে পারতি না। ফেরত নেব না আমার বদদোয়া। আমি নিজ চোখে তোর ভালোবাসা হারানোর তীব্র ব্যথায় ছটফট করা দেহটাকে দেখতে চাই যেমনটা এখন আমি ছটফট করছি।

আবির অসহায়ের মত তাকিয়ে রইল অথৈর দিকে। জীবনে আজ প্রথমবারের মত নিজেকে নীচ মনে হলো। পাওয়ারলেস মনে হলো।

সবার মাথার ওপরে যে একজন আছে আমরা মাঝে মাঝে ভুলে যাই। অথচ, তিনি আছেন, সব দেখছেন। একদিন সকল পাপ-পূন্যের বিচার তিনি নিজ হাতে করবেন।

আবির আর কিছুই বলতে পারল না অথৈ রুম থেকে বের হয়ে গেলো। অথৈ সেখানে বসেই কাঁদছে।

—- ম্যাম??

অথৈ পেছনে তাকিয়ে দেখল একজন মধ্যবয়স্ক নারী হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে বাঙালি মনে হচ্ছে। অথৈ ওর চোখের জল মুছে ফেলল। মেইড বলল,

— স্যার বলেছে ফ্রেশ করিয়ে আপনাকে তৈরি করতে সাহায্য করতে।

— আমি এখন কিছুই করব না। আপনি প্লিজ যান এখান থেকে।

— আমি এই ঘর থেকে এখন যদি বেরিয়ে যাই তবে আমার চাকরিটা আর থাকবে না। আপনি আমার দোয়া করে হলেও ফ্রেশ হোন। প্লিজ, মা।

মেইডের কথা শুনে অথৈর কি যেন হলো! মেইডের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,,

— আমি কি আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারি??

মেইড ভীষণ অবাক হয়। কারণ, তার মত এত নগন্য মানুষের অতি সামান্য এই আবদার কিন্তু কেন? মেইড না করতে পারেনি। অথৈ মেইডকে জড়িয়ে ধরল। তারপর, কাঁদতে কাঁদতে বলছে,,

—- আমার বাবা আমাকে সবসময় মা বলে ডাকত। আমার মা ঠিক আপনার মত করে কথা বলত।

অথৈর কান্না দেখে মেইড ভয় পেয়ে যায়। অথৈর মাথায় হাত বুলিয়ে বলছে,

— এতে কান্না করার কি আছে? আপনার বাবা-মায়ের কাছে কল করুন। কথা বলুন। হুট করে দূরে চলে এসেছেন তাই এতটা খারাপ লাগছে।

— আমার বাবা-মা কেউ নেই। চিরদিনের জন্য আমাকে এতিম করে চলে গেছে।

অথৈর ওপর ভীষণ মায়া হলো মেইডের। আর কিছু বলে যে সান্ত্বনা দিবে সেই ভাষাটুকু অব্দি খুঁজে পাচ্ছে না।

#চলবে