মন বোঝেনা পর্ব-২৪

0
39

#মন_বোঝেনা
#Tahmina_Akhter

২৪…..

অথৈ যখন মেইডের সঙ্গে কথা বলছিল ঠিক তখনি হুড়মুড় করে রুমের ভেতরে ঢুকল আবির। আবিরকে দেখে মেইড চলে গেল। অথৈ ওর চোখের পানি মুছে ফেলল। আবির ধীরপায়ে এসে অথৈর সামনে দাঁড়ালো। অথৈ সরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আবির অথৈর হাত পেছন থেকে টেনে ধরে। অথৈ হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই আবির অথৈর হাত পেছনে মুচড়ে ধরে নিজের দিকে টেনে আনল। আবিরের প্রশ্বস্ত বুকে অথৈর পিঠ লেপ্টে আছে। অথৈর নিজের প্রতি ঘৃনা আসছে। নিজের বাবা-মার হত্যাকারীকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে কিছু না করার ক্ষমতা ওকে কুঁড়ে কুড়ে খাচ্ছে।

— আই সেইড লিভ মি আবির। ডোন্ট টাচ মি! আই হেইট ইউ ।

— বাট আই লাভ ইউ অথৈ৷ তোর ভালোবাসার কোনো প্রয়োজন নেই আমার। তোর হেইট ইউ তোর কাছেই রাখ।

কথাগুলো বলতে বলতে অথৈর কানের কাছে মুখ বাড়িয়ে ফিসফিস করে বলল,,

— প্রহরের বুকে ঠিক এভাবে লেপ্টে থাকতি তাই না? তোর এই গালে, ঠোঁট জোড়ায় বুঝি চুমু খে…

— চুপ কর আবির।

— কেন চুপ করব আমি? আমি তোকে ভালোবাসতাম। বাট মাঝখান দিয়ে প্রহর এসে তোকে ভোগ করে ফেলল। কতশত রাত আমার এমনও গেছে কেবল তোকে কিভাবে আদরে বুকে জড়িয়ে রাখব এই ভেবে ভোর হয়ে যেত। আর মাঝখানে প্রহর এসে তোর দেহটাকে… শুধুমাত্র তোর জন্য প্রহর এখনও বেচে আছে নয়ত ওকে আমি…

— নয়ত, তুই কি? ভুলে যাস না প্রহর আমার স্বামী। ওর অধিকার ছিল আমার ওপর। এখন তুই আমার সঙ্গে যা করছিস তা কি জানিস তুই?

— ভালোবাসার মানুষকে ছুঁতে বৈধতার কি প্রয়োজন?

কথাটি বলতে বলতেই অথৈর কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে মেশাতে নিচ্ছিল ঠিক তখনি অথৈ আবিরের কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত করে ফেলল। তারপর, চোখ রাঙিয়ে আবিরকে বলল,

— ডোন্ট ইউ ডেয়ার আবির। তোর ওই পাপী দেহের সঙ্গে আমাকে মিশিয়ে দিস না। তোকে আমি ঘৃনা করি। আমাকে স্পর্শ করার দুঃসাহস দেখাবি না। এতে পরিণাম কিন্তু ভালো হবে না।

আবির হাসতে হাসতে অথৈর দিকে এগিয়ে যায়। অথৈ এবার ভয় পায় না ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। আবির অথৈর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,,

— ওকে; এখন তোকে স্পর্শ করব না। তবে আজ রাতে নিশ্চয়ই স্পর্শ করতে পারব।

কথাটি বলেই অথৈকে চোখ মারল আবির। অথৈ কিছুই বুঝতে উঠতে পারছে না। মানে কি?

— এত প্রেশার দিস না তোর এই ছোট মস্তিষ্কে। আমি বলি আসল ব্যাপারটা। আজ বিকেলে পাশের এক মসজিদে তোর আর আমার বিয়ে হবে। আর বিয়ে হয়ে গেলে রাতে কি হয় সেটা নিশ্চয়ই তোকে বলতে হবে না??

— তোকে বিয়ে করার চেয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে মরে যাব আমি। তবুও তোকে বিয়ে করব না।

— তুই নিজের কোনো ক্ষতি করবি না। তোর সুরক্ষিত দেহের বদৌলতে প্রহর বেঁচে থাকবে। কথাটা নিশ্চয়ই ভুলে যাসনি।

— শুনেছি মানুষ মরে গেলে তার সকল অনূভুতিও নাকি মরে যায়। আমি মরে গেলে আমার হৃদয়ে থাকা প্রহরের জন্য সকল অনূভুতি মরে যাবে। আমার মৃত্যু নিশ্চয়ই সকল সমস্যার সমাধান। অন্তত আমি বেঁচে থাকতে তোকে কখনো বিয়ে করব না।

কথাগুলো বলতে দেরি হয়নি অথৈ দৌঁড়ে যায় ব্যালকনির দিকে। কোনোদিকে না তাকিয়ে সেখানে থেকে লাফিয়ে পরে। এতক্ষণ চোখের সামনে যা কিছু ঘটল তা বুঝতে মিনিট দুয়েক সময় লাগল আবিরের। যতক্ষণে বুঝতে পারল ততক্ষণে সব শেষ। আবির রুমের দরজা খুলে দৌঁড়ে নীচে চলে যায়। লনের দিকে যেতেই দেখতে পেল পিচ ঢালা কালো পথটা লাল রক্তে রঞ্জিত হয়ে যাচ্ছে।

হসপিটালের করিডরে উদ্ভান্তের ন্যায় পায়চারি করছে আবির। খানিকটা দূরে ওর বডিগার্ড এবং পিএ দাঁড়িয়ে আছে। অপারেশন থিয়েটার থেকে একজন ডক্টর বের আসে। আবির দৌড়ে যায় ডক্টরের কাছে। ডক্টর আবিরকে দেখে হতাশাজনক সুরে জানালো। অথৈর অবস্থা ভীষণ আশংকাজনক। মাথা ফেটে রক্ত বের হওয়ার কারণ অতিরিক্ত রক্তপাত হয়েছে। যদিও রক্ত দেয়া হয়েছে। ডান পা অচল হয়ে গেছে । বাম পায়ের অবস্থা এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। অথৈর মৃত্যু হতে পারে। আর যদিও বেঁচে যায় তবে কোনোদিনও সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে চলতে পারবে না অথৈ। আবির ডক্টরের কথা শুনে যেন নিজের রাগটাকে কন্ট্রোল করতে পারছে না। ডক্টরের কলার চেপে ধরে বলল,,

— প্লিজ ডক্টর সেইভ মাই অথৈ। আই কান্ট লাইভ উইদাউট হার। সি ইজ মাই লাইফলাইন।

আবিরের ম্যানেজার দৌড়ে এসে আবিরকে ছাড়িয়ে নিলো। ডক্টর আবিরের কাঁধে হাত রেখে বলল,

— ডোন্ট ওয়ারি। সি উইল বি ওকে। প্লিজ প্রে ফর হার।।

আবির কিছুই ভাবতে পারছিল না। কেবল অথৈর দেয়া বদদোয়া ওর মস্তিষ্কে ঘুরছিল।

********************

দুই বছর পর….

আজ প্রহরের জন্মদিন। পুরো অফিস জুড়ে সাজ সাজ রব। পার্টি থ্রো করেছে প্রহরের বিজনেস পার্টনার লিন্ডা। যদিও এসব নিয়ে মাথাব্যাথা নেই প্রহরের। প্রহর ভালো করেই জানে লিন্ডা প্রহরের ওপর খানিকটা দূর্বল। দূর্বল না হলে কি কেউ কারো বিজনেস পার্টনারের জন্য এত বড়ো পার্টির আয়োজন করতে পারে! যদিও এখন আর আগের মত কোনো অকেশন এতটা টানে না। অথৈ ওর জীবন থেকে চলে যাওয়ার পর থেকে রঙিন জীবনটা কেবল সাদা-কালো রঙে লেপ্টে আছে। রঙিন দুনিয়া ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকে কিন্তু সাড়া দিতে ইচ্ছে করে না। মাঝে মাঝে ওর ইচ্ছে ছাঁদে গিয়ে সোজা নীচে লাফ দিতে। কিন্তু, যখনি মনে পড়ে আত্মহত্যা মহাপাপ ঠিক তখনি নিজেকে সামলে নেয়।

— হেই প্রহর??

প্রহর ঘুরে দেখলো লিন্ডা দাঁড়িয়ে আছে। প্রহর আবার নিজের কাজে মনোযোগী হলো। লিন্ডা ভীষণ কষ্ট পেলো প্রহরের আচরনে। কত যত্ন নিয়ে আজ পিংক কালারের শাড়ি পড়েছে। ভেবেছিল প্রহর আজ ওর দিকে তাকিয়ে থাকবে। নজর ফেরাতেই পারবে না। কিন্তু, সেই আশায় গুড়ে বালি। প্রহর ওকে পাত্তাই দিচ্ছে না। লিন্ডার ভীষণ রাগ হচ্ছে প্রহরের ওপর। রেগেমেগে প্রহরের সামনে গিয়ে প্রহরকে বলল,

— আপনি কি জানেন মেয়েরা কখন বেশি সাজতে পছন্দ করে?

— সেটা জেনে আমি কি করব মিস লিন্ডা?

প্রহরের উত্তর শুনে আশাহত হলো লিন্ডা। নিজেকে সামলে ফেলল। কারণ, রেগে গেলে সব ভেস্তে যাবে।

— মেয়েরা যাকে মনপ্রাণ দিয়ে চায়, ভালোবাসে ঠিক সেই মানুষটার সামনে নিজেকে খুব সুন্দরভাবে প্রেজেন্ট করতে চায়। আমিও চাই আমার ভালোবাসার মানুষের সামনে নিজেকে প্রেজেন্ট হোক শাড়ি কিংবা বাঙালিয়ানার কিছু।

— লিন্ডা, আপনি বোধহয় জানেন না যে, আমি ডিভোর্সী?

— আমি সব জানি। ওই মেয়ে আপনাকে ফেলে অন্য কারো সাথে পালিয়ে গে…

— শাট আপ লিন্ডা। ওর একটা নাম আছে। এভাবে কথা বলছেন কেন?

— তো কিভাবে কথা বলব? ছয়মাস ধরে আমি আপনার পেছনে পরে আছি। আপনাকে বিভিন্ন ভাবে আমার মনের কথা বোঝাতে…

— মানুষের জীবনে প্রেম একবারই আসে মিস লিন্ডা। আমার জীবনেও প্রেম একবারই এসেছে। আমার সেই প্রেমের নাম অথৈ।

লিন্ডার চোখে জল চলে এলো। কান্নারত সুরে বলল,

— আমাকে একবার গ্রহণ করে দেখুন না? দেখবেন আমি আপনাকে এতটা ভালোবাসা দেব যে আপনি ভুলে যাবেন অথৈকে?

লিন্ডার কথা প্রহর হাসে। প্রহরের হাসি ভ্রু কুচকে তাকায় লিন্ডা।

— গত দুই বছরের ছয় সেকেন্ডের জন্য আমি অথৈকে ভুলতে পারিনি। ঘুমাতে যাওয়ার আগে আমার চোখে সর্বশেষ অথৈর মুখটা ভাসে। রোজ সকালে যখন জেগে উঠি ঠিক তখনও আমি অথৈকে দেখি। আর সেখানে আপনি বলছেন আপনার ভালোবাসা পেলে আমি অথৈকে ভুলে যাব! ভুল ভাবছেন আপনি। আমি চাই না অথৈকে ভুলে যেতে। ওকে ভুলে যাওয়া মানেই আমার ভালোবাসাকে অসম্মান করা।

লিন্ডা আর কিছু বলতে পারল না। কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেলো প্রহরের কেবিন থেকে। প্রহর সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ড্রয়ার খুলতেই বের হয়ে এলো একটি খাম। খামের ওপর হাত বুলিয়ে আনমনে বলে উঠল,,

— অথৈ তোমাকে আমি একবার খুঁজে পাই। তারপর আর কোথাও যেতে দেব না। এতটা ত্যাগ স্বীকার কে করতে বলেছিল তোমায়? মরে যাওয়ার আগে দেখতে পাব তো তোমায়?

আমেরিকায়….

লাল রঙের ভারী শাড়িতে বৌ সাজে চমৎকার দেখাচ্ছে অথৈকে। অথৈ আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে অসহায়ের মত। জীবনটা দরুন বদলে গেছে ওর। আয়নায় যখন তাকালো তখন নিজের প্রতিবিম্বের পাশে আবিরের প্রতিবিম্ব দেখতে পেলো অথৈ। চোখ নীচু করে ফেলল। আবিরের গায়ে শেরওয়ানী। আবির অথৈর সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। অথৈর মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা চলছে।

— জানিস, কতদিন হয়ে গেল তোকে আর আগের রুপে দেখতে পাই না। ? মাঝে মাঝে নিজের কিসমতের ওপর থু থু ফেলতে ইচ্ছে করে কিন্তু পরমূহুর্তে নিজেকে সামলে ফেলি।কারণ, সেদিন তোর বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারত কিন্তু আল্লাহ তোর রক্ষা করেছেন। তুই বেঁচে ফিরেছিস আমার কাছে। আমার আর কিছুর দরকার নেই। শুধু তুই আমার চোখের সামনে থাকলেই হলো।

— পঙ্গুত্ব জীবনের চেয়ে সেদিন যদি আমার মৃত্যু হয়ে যেত বড্ড ভালো হতো আবির। এই যে আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে বারবার গায়ে হাত দিস জানিস আমার নিজেকে কীট মনে হয়।

— অথৈ!!কি বলছিস তুই এসব? আমার স্পর্শ তোর ভালো লাগে না বিধায় তো আজ আমাদের বিয়ে হলো। আর মরে যাওয়ার কথা বারবার বলিস কেন?

— পা হারিয়ে ফেলেছি আমার। বাবা-মা নেই। প্রহরকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিস তুই। পঙ্গুত্ব আমাকে এতটাই গ্রাস করে ফেলেছে যে এখন আমার তোকে স্বামী হিসেবে গ্রহন করতে হচ্ছে? আমার শরীরটাকে পাওয়ার জন্যই তো তুই এতবড়ে ষড়যন্ত্র করেছিস। আমি যদি পারতাম তোকে নিজ হাতে খুন করে ফেলতাম আবির।

অথৈর কথায় ভীষণ কষ্ট পেলো আবির। অথৈকে দেয়া কষ্টগুলোকে ধীরে ধীরে উপলব্ধি করছে আবির। কিন্তু, এখন যে আর কিছুই করার নেই। আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলে শেরওয়ানীর পকেট থেকে পিস্তল বের করে অথৈর হাতে দিয়ে বলল,,

— শরীর ছুঁতে পারার চেয়ে মন ছুঁয়ে দেখা বড্ড কঠিন জিনিস রে অথৈ। অথচ, কিছু বছর আগেও আমেরিকার পার্টিক্লাবের অনেক টপ প্রস্টিটিউটের সঙ্গে আমার ইন্টিমেট হয়েছে। কিন্তু, দেখ তোকে ভালোবাসার পর থেকে আমি তোর শরীর চাইনি। কেবল তোকেই চেয়েছি। তোর মন চাওয়ার মত স্পর্ধা আমার নেই। তোর মন না হয় না চাইতে পারি। কিন্তু, তোকে আজ স্ত্রী হিসেবে পেলাম এটাই বা কম কীসের? হোক না তুই আমার দুদিনের বৌ। তবুও তো তুই আমার বৌ হলি। একান্তই আমার হলি।

কথাগুলো বলেই আবির অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে অথৈর হাতের পিঠে চুমু খেলো। অথৈ আবিরের কাছ থেকে হাত সরিয়ে হুইলচেয়ার চালিয়ে চলে গেল জানালার সামনে। আবির তাকিয়ে রইল অথৈর দিকে। কারণ, আর কয়েকটা দিন এরপর তার এত সাধের মানুষটাকে যে ছেড়ে যেতে হবে বহুদূরে।

#চলবে